চট্টগ্রামের ঘটনা ইসকন ও আধিপত্যবাদ

প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫৯ , অনলাইন ভার্সন
সারা দেশে স্লোগান উঠেছে, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’। এই স্লোগান নতুন নয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এ দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল, নয়া আধিপত্যবাদ বাংলাদেশকে কবজা করতে চায়। তারা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য যা করেছে, তার পেছনে সদিচ্ছা ছিল না, ছিল কূটনীতি। তাই স্বাধীনতার পরপরই ঢাকার স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখার চিন্তায় এই স্লোগানের উৎপত্তি। জুলাই বিপ্লবের পর এই স্লোগানের কেন সৃষ্টি হয়েছিল, তা অনুভব করতে পারছে বর্তমান প্রজন্ম। বুঝতে পারছে এই স্লোগানের প্রয়োজনীয়তা। গত ১৭ বছরে এই স্লোগান ছিল নিষিদ্ধ। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি দাবি করে, স্বতন্ত্রতা তথা স্বাধীনতার সম্পূরক এই স্লোগানকে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল।
আজ যখন দিল্লির আধিপত্যবাদের দোসররা বিতাড়িত, তখন খোদ দিল্লি প্রকাশ্য হতে শুরু করেছে। একটা বিবৃতিই তাদের দৃশ্যমানতা দিয়েছে। এত দিন দোসরদের দিয়েই কাজ চালিয়ে নিত তারা, কিন্তু জেনারেশন জেডের নেতৃত্বে এ দেশের ছাত্র-জনতা দোসরদের বিদায় করেছে। বিপ্লব-পরবর্তী তিন মাস নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে বর্তমান সরকারকে হটানোর জন্য। তাদের প্রতিটা পদক্ষেপই ব্যর্থ হয়েছে। আনসার, রিকশা শ্রমিক, নার্স, চিকিৎসক, গ্রাম পুলিশ, সর্বশেষ ঋণ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ঢাকায় লোক জড়ো করে সরকারকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টাও পর্যবসিত হয়েছে ব্যর্থতায়। এখন খোদ দিল্লি প্রকাশ্যে এসে তাদের শেষ কার্ডটা খেলেছে। কী কার্ড তা অজানা নয়। ভারতের ছায়া উপস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির সংখ্যালঘু-বিষয়ক কার্ড। সেটাও প্রায় ব্যর্থ হতে চলেছে।
‘সনাতন জাগরণ জোট’, যার পেছনে রয়েছে মূলত ‘ইসকন’ নামের হিন্দুত্ববাদী একটি সংগঠন। যার শাখা রয়েছে নানান দেশে এবং কোনো কোনো দেশে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য নিষিদ্ধও হয়েছে সংগঠনটি। এরা গত ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণে ঘটিয়েছে এক ভয়াবহ কাণ্ড। কুপিয়ে খুন করেছে রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইনজীবীকে। শুধু তা-ই নয়, তারা মসজিদে হামলা চালিয়েছে, হামলা চালিয়েছে আদালতে, পুলিশের ভ্যানে, পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর ওপরও। কেন এই হামলা? এই হামলা হলো ইসকন ও সনাতন জাগরণ জোটের এক ধর্মগুরু চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে গ্রেপ্তারের কারণে। কী কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা না হয় পরে বলছি। এখন বলি এই গ্রেপ্তার নিয়ে সম্ভাব্য কী পরিকল্পনা ছিল তার ব্যাপারে।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের গ্রেপ্তার নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক খোদ উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি প্রদান করে। তার পরই চট্টগ্রামে উন্মত্ত হয়ে ওঠে চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের অনুসারী তথা সনাতন জাগরণ জোট ও ইসকনের লোকজন। চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের জামিন নামঞ্জুর হওয়ার পর তাকে কারাগারে নেওয়ার পুলিশের চেষ্টা রুখে দেয় চিন্ময় সমর্থকেরা। তিন ঘণ্টা আটকে থাকে পুলিশ ভ্যান। পুলিশ শেষে লাঠিচার্জ করতে বাধ্য হয়। এ সময়ই চিন্ময় সমর্থকদের চরম রূপ প্রকাশ্য হয়। তারা আদালত প্রাঙ্গণ, পার্শ্ববর্তী মসজিদ, দোকানপাট, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী এবং আইনজীবীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় তাদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে হত্যাকারীদের অন্তত ছয়জনকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। ফুটেজে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আলিফকে খুন করতে দেখা গেছে। তাদের তিনজনের নামও প্রকাশ করা হয়েছে। সুতরাং ঘটনার ধারাবাহিকতায় এই হামলা ও হত্যা শুধু বিক্ষুব্ধ লোকজনের আবেগের কারণে হয়েছে এমন বলা হবে চরম ভণ্ডামি।
এ ঘটনা আবেগের ফল নয়, পরিকল্পনার ফল। আমরা লিখে আসছিলাম রাজনৈতিকভাবে ফ্যাসিজমের প্রত্যাবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। ফ্যাসিজমের পেছনের শক্তি হলো ভারত। এর মধ্যে কোনো লুকোছাপা ছিল না। ফ্যাসিস্ট রেজিমে ফ্যাসিস্টদের কেউ কেউ প্রকাশ্যেই বলেছে নির্বাচন ও ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে ভারত ছিল তাদের সহায়। বিপরীতে ভারত থেকেও কাছাকাছি রকমের কথা বলা হয়েছে। ভারতের এটা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। সুতরাং ফ্যাসিজম প্রত্যাবর্তনের একমাত্র রাস্তা হচ্ছে দেশে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার সৃষ্টি করা। সেই হাঙ্গামার অজুহাতে বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ কিংবা আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে ফ্যাসিজমকে পুনর্বাসিত করা। চট্টগ্রামের ঘটনা সেই চিন্তারই গ্রাউন্ড ওয়ার্ক।
চিন্তাটা ছিল ভারতীয়। যেমন ভারতের কোথাও মুসলমানরা যদি এমনভাবে কুপিয়ে কোনো হিন্দুকে হত্যা করত, তাদের মন্দির ভাঙত, তাহলে সে এলাকায় মুসলমানদের কচুকাটাসহ বাড়িঘর, স্থাপনা সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দেওয়া হতো। প্রতিটা এলাকা হয়ে উঠত একেকটা গুজরাট। এমন ঘটনার বহু নজির রয়েছে ভারতে। বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের সাম্ভালের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। সেখানে মসজিদ বিষয়ে ঘটনার জেরে ছয় মুসলিমকে হত্যা করেছে সরকারি বাহিনী। তাদের ধারণা ছিল চট্টগ্রামের ঘটনায় সারা দেশে মুসলমানরা উত্তেজিত হয়ে হিন্দু নিধন ও মন্দির ভাঙা শুরু করবে। সঙ্গে যোগ দেবে উত্তর প্রদেশের আদলে সরকারি বাহিনীগুলো। আর এই দেখিয়েই বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যাবে। কিন্তু ভারতীয় ও ভারতঘেঁষা চিন্তকদের সে পরিকল্পনা আপাতত ব্যর্থ করে দিয়েছে বাংলাদেশের মুসলমান এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। চট্টগ্রামের ঘটনায় মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছে, সভা করেছে, মিছিল করেছে। অথচ কোথাও ইসকনের মন্দির ভাঙা হয়নি। একজন হিন্দুও নিহত হননি। অথচ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের বিবৃতির পরই এমন ঘটনা ঘটিয়েছে চিন্ময় সমর্থকেরা। সেই বিবৃতি তাদের সাহস জুগিয়েছে।
বাংলাদেশে কোনোকালেই ধর্মীয় কারণে কোনো হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মের মানুষ নির্যাতিত হয়নি। কোনো মন্দির ভাঙা হয়নি। যা হয়েছে তার সিংহভাগই রাজনৈতিক এবং বাকিগুলো জমিজমা কিংবা পারিবারিক কোন্দলের ফল। অথচ ভারতীয় প্রোপাগান্ডিস্টরা এসবকেই কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতন বলে চালিয়েছে এত দিন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে তার উল্টো। সংখ্যায় বেশি মানুষেরা যারা মুসলিম, তারাই ভয়ে রয়েছে সব সময়। কারণ তারা কিছু করলেই বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিম তাদের জামায়াত-শিবির-রাজাকার আখ্যা দিয়েছে। বলেছে জঙ্গি। এখনো যেমন বলে জঙ্গিবাদ। অথচ বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবের পর পরিষ্কার হয়েছে, এখানে জঙ্গিবাদ যা ছিল, তা বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিম সৃষ্ট। জঙ্গিবাদের নামে বেশির ভাগই নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে ছিল নারী এবং শিশু পর্যন্ত। আর সেই হত্যাকাণ্ড ছিল অবশ্যই বিচার-বহির্ভূত। মূলত এই জঙ্গি জুজুর ভয় দেখিয়েই পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে সহানুভূতি আদায় করা হয়েছে। এবারও চেষ্টা করা হয়েছিল সেই ধারাতেই। কিন্তু তা আপাতত ব্যর্থ হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো দাঙ্গার খবর পাওয়া যায়নি। উল্টো ঘটনাটি বুমেরাং হয়েছে ইসকন, সনাতন জাগরণ জোট ও ভারতের প্রতি।
বাংলাদেশের মুসলমানরা যে কতটা উদার, কতটা অসাম্প্রদায়িক, তার প্র্মাণ তারা দিয়েছে। তাদের নিয়ে ভারতীয় রটনা তারা মিথ্যা করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গসহ সারা ভারতে গো-রক্ষকদের কীর্তিকলাপ আমাদের জানা আছে। জানা আছে, গরুর গোশত রাখার অপরাধেও মুসলমানদের পিটিয়ে মারার কথা। বিপরীতে বাংলাদেশে এমন একটা ঘটনার প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না, ধর্মীয় আচার-আচরণের কারণে কোনো হিন্দু বা অন্য ধর্মের মানুষকে হত্যা তো দূরের কথা, নির্যাতনও করা হয়েছে। শিক্ষা বিষয়ে গবেষক রাখাল রাহা, যিনি এত দিন স্বীকার করেননি, এবার সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে মুসলমানদের এই উদারতার কথা স্বীকার করেছেন। সাংবাদিক গোলাম মোর্তাজা, যিনি চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তিনি চট্টগ্রামের ঘটনার পর তার ভুলের কথা স্বীকার করে বলেছেন, এদের বিরুদ্ধে আরও আগেই কঠোর হওয়ার দরকার ছিল। অর্থাৎ যারা এত দিন প্রোপাগান্ডায় বিশ্বাস করতেন, মাঠের আসল চিত্র জানতেন না, তারাও এখন বুঝতে পারছেন, আসল ঘটনা কী। এই দুজনই নয়, এই ঘরানার অনেকেরই ভুল ভেঙেছে কিংবা ভাঙতে শুরু করেছে। তারা বুঝতে পারছেন, মুসলমানদের কীভাবে পরিকল্পিতভাবে উত্তেজিত করা হয় এবং সেই উত্তেজনার আউটপুট থেকে যা আসে, তা ভারতপন্থীদের থলেতে যায়। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের ভুল ভাঙতে শুরু করলেও ভারতাধীন পশ্চিমবঙ্গের অনেক বুদ্ধিজীবীর সামন্তবাদী মস্তিষ্ক এখনো প্রতিহিংসার বয়ানেই বিশ্বাস করে। আমারই পরিচিত একজন, যিনি পশ্চিমবঙ্গে মোটামুটি পরিচিত গাইয়ে ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে, তাকে জানে সবাই বামধারায় বিশ্বাসী বলে কিন্তু বাংলাদেশ এবং মুসলমান প্রশ্নে তার চিন্তা হলো ‘মোর দ্যান আরএসএস’র মতন। বিশেষ করে, জুলাই বিপ্লবের পর সামাজিক মাধ্যমে সেই গাইয়ে বুদ্ধিজীবীর লেখা তাকে পশ্চিমবঙ্গের রিপাবলিক টিভির সাংবাদিক ও প্রেজেন্টার রামপাঠা ময়ূখ রঞ্জন দাশের সমপর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। মূলত এরা সবাই একেকজন ময়ূখ রঞ্জন দাশ, চুলকানির মলম বিক্রেতা। যে মলমে চুলকানি কমে না, বরং দশগুণ বাড়ে।
যাকগে, চুলকানির কথা থাক, আসল কথায় আসি। বাংলাদেশের মানুষ, তথা মুসলমান এবং হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ই সনাতন জাগরণ জোট কিংবা ইসকনের ফাঁদে পা দেয়নি। শুধু চট্টগ্রাম এবং রংপুরেই সনাতন জাগরণ জোট ও ইসকন যা একটু প্রভাব দেখাতে পেরেছে। দেশের বেশির ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের সাম্প্রদায়িক আট দফার পক্ষে রাস্তায় নামেনি। আর চট্টগ্রামে এত বড় ঘটনা ঘটানোর পরও সারা দেশের মুসলমানরা জাগরণ জোট তথা ইসকন তথা ভারতীয় ফাঁদে পা দেয়নি, অন্তত আমি যখন লিখছি তখন পর্যন্ত। আর শেষ পর্যন্ত যদি বাংলাদেশের মানুষ সেই ফাঁদে পা না দেয়, তাহলে এ দেশে ফ্যাসিজমের বদৌলতে আধিপত্যবাদ পুনর্বাসনের কোনো সম্ভাবনা সুদূর ভবিষ্যতেও পরাহত।
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041