এভাবেই সময় চলে যায়। কিছুতেই সময়ের রাশ টেনে ধরা যায় না। মনে হয় এই তো সেদিন কানাডা আসলাম। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে প্রথম দিনের স্মৃতি, দৃশ্যপট। অথচ দেখতে দেখতে ২২ বছর হয়ে গেছে! যেদিন পিয়ারসন এয়ারপোর্টে নামলাম, সেদিন অদ্ভুত একটা ফিলিংস হয়েছিল আমার। মনে হয়েছিল, কীভাবে নিজের শিকড় উপরে ফেলে মানুষ! প্লেনে বসেই আমার বরিশাল, আমার মা, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, আমার সংগ্রামময় জীবন যে ঢাকা শহরÑসব ভিড় করে আসতে লাগল। কেবলই আমাকে পিছু টানছিল। প্লেনের সুস্বাদু খাবার বিস্বাদ লেগেছিল। টরন্টো নেমে আমরা সোজা অটোয়ার পথে রওনা হলাম। ঢাকা থেকে হিথ্রো, তারপর টরন্টো। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে। হিথ্রোতে তিন ঘণ্টা ফ্লাইট ডিলে ছিল মনে আছে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে নামলাম নতুন এক দেশে, নতুন এক পরিবেশে। ইমিগ্রেশনের ফর্মালিটি শেষ করে যখন সকাল ১০টায় এয়ারপোর্ট থেকে বের হলাম, তখন টরন্টোর আকাশ রৌদ্রকরোজ্জ্বল। ফুরফুরে বাতাস। চারদিকে সবুজের সমাহার। ২৮ জুন ছিল সেটা। কানাডায় তখন তুমুল সামার। দুটো গাড়িতে আটটা বড় লাগেজ (প্রতিটি ৭০ পাউন্ড) এবং চারটা ক্যারিঅন ব্যাগ নিয়ে আমরা অটোয়ার পথে রওনা হলাম। টরন্টো থেকে আরও চার ঘণ্টার ড্রাইভ। সুশৃঙ্খল হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। দু’পাশে সবুজ দৃশ্য দ্রুত অপস্রিয়মাণ হচ্ছে। ১২০ কিলোমিটার স্পিড। হাইওয়ের নাম ৪০১। গাড়ি শহর ছাড়িয়ে পূর্ব দিকে ছুটে চলেছে। একটার পর একটা শহর পার হচ্ছি। পোর্ট ইউনিয়ন, পিকারিং, এজাক্স, হুইটবি, অশোয়া, বোমেনভিল...। দূরেই দৃশ্যমান হচ্ছে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। লেক অন্টারিও। দূর থেকেই দেখতে পেলাম লেকের জল রৌদ্রের আলো পড়ে চিকচিক করছে। অর্ক অরিত্রি দীর্ঘ প্লেন ভ্রমণে গাড়ির মধ্যে ঘুমে ঢুলু ঢুলু। জেসমিনের চোখ বাইরে। এক গভীর অনিশ্চয়তা সেখানে।
জেসমিন আসতে চায়নি কানাডা। অর্ক অরিত্রি সব পরিবেশেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে। আর আমি কখনো কখনো আগুনে ঝাঁপ দিতেও দ্বিধা করি না। পূর্বাপর ভেবে সবকিছু করা যায় না। আমার পুরো জীবনটাই এমন। আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি আমি। জীবন নিয়ে আমার কোনো উচ্চাভিলাষ নাই। সারা জীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছি। বিদেশের জীবন হবে আরও বেশি প্রতিকূল, সেটা জানা আছে। আমি শুধু চাই আমার সন্তানদের সুখী করতে, সেটা যেকোনো জায়গায়ই হোক না কেন।
এত বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। ছেলেমেয়েদের নিজেদের জীবন হয়েছে, সংসার হয়েছে। আরও কত কী বদলে যাবে। আমি এসব টের পাই। আমার অবজারভেশন খুব ভালো। আমি আগাম টের পাই বলে জীবনে অনেক অঘটন থেকে রেহাই পেয়েছি। তার পরও আমি ভুল করি। সবচেয়ে বড় ভুল হয় মানুষ চিনতে। মানুষকে আমি অন্ধের মতো বিশ্বাস করি এবং প্রায়শই ঠকি। কষ্ট পাই। কিন্তু সেসব নিয়ে আমার কোনো অনুতাপ হয় না। দেশে-বিদেশে সব জায়গায়ই আমি মানুষের কারণে অনেক যন্ত্রণা পেয়েছি। কিন্তু সেসব আমি মনে রাখিনি। সবাই তো আর এক রকম হবে না। আগে বেশি এসব নিয়ে আদিখ্যেতা করতাম। মাথা ঘামাতাম। এখন করি না। এটাই জীবন। এসব নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। পৃথিবীতে নিরবচ্ছিন্ন সুখ যেমন নেই, দুঃখও নেই।
যেমন মা চলে গেলেন। এই তো সেদিনের কথা। অথচ দেখতে দেখতে ১৪টি বছর পার হয়ে গেল।
জীবন থেকে এভাবেই সময় চলে যায়। মা চলে গেলেও তিনি আছেন হৃদয়ে, স্মরণে, মননে, স্মৃতির আয়নায়। অনেক অসাধারণ সব স্মৃতি আছে আমাদের, যা সব সময় জ্বলজ্বল করে। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো সব সময় মুক্তোর মতো ঔজ্জ্বল্য ছড়ায় প্রতিনিয়ত। একটা ঘটনা মনে আছে, তখন আমার বয়স ১০-১২ বছর হবে। মামাবাড়িতে গেছি। অজ গ্রাম। একেক দিন সন্ধ্যাবেলা আমার খুব মন খারাপ লাগত। এমন একেকটা বিকেলবেলা আছে, যখন সূর্য ডুবে যাওয়ার সময় অন্তত একটা মায়াবী অপার্থিব আলো এসে পড়ত উঠোনে। আকাশের রং যেত পাল্টে। সমস্ত বাড়িটায় কেমন এক আলো-আঁধারির সৃষ্টি হতো। হঠাৎ হঠাৎ আমার বহুজনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া আমাকে অনুভব করতাম। টের পেতাম আমার আলাদা একা এক ‘আমি’ আছে। সেই সব বিষণ্ন বিকেলে আমার মাঝে মাঝে মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে হতো। প্রায়ই পশ্চিমের ঘরে মাকে খুঁজতে গিয়ে পেতাম না। সারা বাড়ি খুঁজে মাকে হয়তো পেতাম বড় ঘরের পাটাতনের সিঁড়ির তলায় গামলায় চাল মেপে তুলছেন। আমি অবোধ, দুর্জ্ঞেয় এক বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই যে মায়ের কাছে গিয়েছি, তা মা বুঝতেন না। তবু একটুক্ষণের জন্য হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিতেন। একটুক্ষণের জন্য মাথাটা চেপে রাখতেন বুকে। আমি তখন মায়ের গা থেকে মা মা গন্ধটা পেতাম। মা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করতেন, দুপুরে পেট ভরেছিল? আমি বুকভরে মায়ের গায়ের সুঘ্রাণ নিতাম। আজ মা নেই। কোথায় হারিয়ে গেছে সেই আনন্দ।
সেদিনের আকাশেও সপ্তর্ষি ছিল, ছায়াপথ ছিল না। মা বসে থাকেন পাশে। পিঠে হাত বোলান। কথা বলেন না। নীরবে মাতা-পুত্রের সময় পার হয়ে যায়। ধুলারাশির মতো আকীর্ণ নক্ষত্রপুঞ্জ বিপুল একটি অনির্দিষ্ট পথের মতো পড়ে থাকে, ওখানে রোজ ঝড় ওঠে, ঝোড়ো হাওয়ায় নক্ষত্রের গুঁড়ো উড়ে সমস্ত আকাশে ছড়ায়। সপ্তর্ষির চেহারা শান্ত। প্রশ্নচিহ্নের মতো। ব্যক্ত ও অব্যক্ত জগতের সীমায় বসে আছেন সাতজন শান্ত-সমাহিত ঋষি। মৃত্যুর পর থাকে কি কোনো চেতনা? অথবা আরেকবার কি জন্ম নেওয়া যায়? মৃত্যু, মহান একটি ঘুম, তার বেশি কিছু নয়। ছেলেবেলায় ফাঁকা মাঠে শুয়ে আকাশ দেখা হতো। দেখতে দেখতে কোনো শূন্যতায় পৌঁছে যেত মন। পার্থিব কোনো কিছুই আর মনে থাকত না। তখন আকাশে থাকতেন দেবতারা, মানুষের ইচ্ছা পূরণ করতেন। আজ তারা কেউ নেইÑনা মনে, না আকাশে। তবু আজও সপ্তর্ষির অদৃশ্য আলো শরীর আর মনে অনুভব করা যায়। আবার যদি দেখা হয় মায়ের সঙ্গে। আবার যদি! আমার মাথায় একটু হাত রাখো তো মা, একটু হাত রাখো। মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, কেন রে? সব ভুলিয়ে দাও তো মা, ভুলিয়ে দাও তো। বুদ্ধি, স্মৃতি, অবস্থা ভুলিয়ে দাও। আবার ছোট হয়ে কোলে ফিরে যাই..।
তখন আমার জগৎটা আলোকিত হয়ে ওঠে
মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করি, আমার কি কোনো দুঃখ আছে! মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করি, আমি কি সুখী! আমি আমার শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলোর সঙ্গে বর্তমানের দিনগুলোর তুলনা করি এবং এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। এই দুইয়ের মাঝে মধ্যবর্তী যে জীবন ছিল আমার, সেখানে অভাব-অনটন, লড়াই-সংগ্রাম, অপমান-অবহেলা, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না সবই ছিল। কী ছিল না সেই জীবনে! সবই ছিল। সেসবেরও ব্যবচ্ছেদ করি। সুখ বা দুঃখ কোনোটা নিয়েই আমি কখনো আদিখ্যেতা করিনি। কোনোটাই নিরবচ্ছিন্ন নয় জীবনে। দুটোই জীবনের অংশ। তাই জীবনের বঞ্চনাগুলো নিয়ে আমি কখনো নিজেকে দুঃখিত করে তুলিনি। ভারাক্রান্ত হইনি। নির্দিষ্টভাবে কাউকে দায়ী করিনি। বরং আমি যে এখন নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছি, সে জন্য নেপথ্যের মানুষগুলোর প্রতি অবনতমস্তকে কৃতজ্ঞতা জানাই। যারা আমাকে স্বার্থহীনভাবে ভালোবেসেছে, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, পাশে থেকেছে, প্রশ্রয় দিয়েছে, তাদের প্রতি আমার একবুক ভালোবাসা সব সময়। এখনো যারা আমার প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়ায়, ভালোবাসে, মাথায় হাত রাখে, তাদের স্পর্শ আমার কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। বাঁচতে শেখায়।
মনে আছে, যখন স্কুলে পড়ি, লেইজারে আমি খুব কম দিনই মালেক ভাইয়ের মালাই আইসক্রিম খেতে পারতাম। একটা-দুটোর বেশি জামা, প্যান্ট বা জুতা ছিল না আমার। রোদে-বৃষ্টিতে ভিজত, আবার গায়েই শুকাত। ঠান্ডা লাগত না। শরীর সব সয়ে নিত। আমার ক্লাসের যে বন্ধু আমাকে ডেকে নিয়ে আইসক্রিম অফার করত, তার কথাও আমি কখনো ভুলিনি। এক ঈদে আমার নতুন জামা ছিল না। পুরোনো জামা ধুয়ে মা ইস্ত্রি করে দিয়েছিল। বাড়ির সবাই নতুন জামা পরে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছে, আমি পুরোনো জামা পরেছি, তাও আমার মনে কষ্ট হয়নি। মা বলেছিল, কষ্ট পেয়ো না। তোমার জন্য দোয়া করি, একদিন তুমি অনেক জামা পরতে পারবে। আমার ছেলেমেয়েরা যে আমাকে এত এত জামাকাপড় গিফট দেয়, অনেক প্যাকেট দুই বছরেও খোলা হয়নি আমার। যখন ঢাকা শহরে আমার থাকার জায়গা ছিল না, খাওয়ার পয়সা ছিল না, তখন যারা আমার পাশে থেকেছিল, আমি তাদের কথা কী করে ভুলি! প্রথম দিন যে বন্ধুর জামা পরে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তার কথা কি ভোলা যায়! বিয়ের সময় যে বন্ধুরা বিভিন্নভাবে হেল্প করেছিল, তারাও থাকে হৃদয়ের গভীরে।
এমনই অনেক কিছুই জড়িয়ে থাকে এক জীবনে। ব্যক্তি জড়িয়ে থাকে, ঘটনা জড়িয়ে থাকে। সেখানে বঞ্চনা আর অপমান যেমন থাকে, আনন্দও থাকে। মোটা দাগের সেসব অপমানের কথা মনে করে আমি কখনো নিজের জীবনকে বিষিয়ে তুলিনি। এসব সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এখনো করে। যারা আমাকে তাচ্ছিল্য করেছিল বা অবহেলা, আমি সেই সব মানুষকে গিয়ে কখনো বলিনি তোমরা আমার সঙ্গে এমন কেন করেছিলে! কেন কষ্ট দিয়েছিলে! বরং সেসব মানুষই যখন আমাকে ভালোবেসে কাছে টানতে চায় বা সম্মান দেখায়, তখন আমি পেছনের সবকিছু ভুলে যাই। হ্যাঁ, কিছু কষ্ট থাকে যা সহজে ভোলা যায় না। কিছু বঞ্চনা থাকে যা মনের গভীরে দাগ ফেলে দেয়। সবকিছু মনে রাখলে মানুষ যেমন বাঁচতে পারত না আবার সবকিছু ভুলেও যাওয়া যায় না। ভুলতে পারলে ভালো হতো। ভুলত্রুটি নিয়েই এই জীবন।
কিছু মানুষ থাকে সারা জীবনই অন্যকে ছোট করে দেখে, তাচ্ছিল্য করে। এ ধরনের মানুষ আমি অনেক দেখেছি। সেসব মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় মনে করেছি। কারও সঙ্গে লড়াই করার চেয়ে অ্যাভয়েড করা ভালো সমাধান মনে করি। অনেক কাছের মানুষও আমার সঙ্গে এমন আচরণ করে, দূরের মানুষও করে। আমার প্রতি নির্বিকার থাকে। আমি সব সময় তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাই। তাদের প্রতি আমি কোনো ক্ষোভ নিয়ে বসে নেই। আমি আমার নিজের মধ্যে একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছি। সেই জগতে আমার বসবাস। বাঁচার জন্য আমাকে এমনটা করতে হয়েছে। এই একাকী জীবনে হঠাৎ হঠাৎ একেকজন আমার জীবনে দেবদূতের মতো আবির্ভূত হয়। আমার জগৎটা আলোকিত হয়ে ওঠে। সাধারণ এই জীবনে অসাধারণ অনুভূতি দেয়। সকল গ্লানি মুছে যায়।
আবুল হাসানের কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করছি...
হলুদ সন্ধ্যায় একা একা, হায় কার অভিশাপে
এত নির্জনতা, বিমর্ষ সঙ্গতা এই আমার রক্তের, করছি কেবল পান,
আমায় কি একবারও মনে পড়ে না সেই হলদে পাখির মুখোমুখি
নীল ঘাসে ঢাকা, শাক ও সবজির শ্যামলে বিছানো হাত আর পায়ের ক্রন্দন।
স্বপ্ন কাজল মাখা
টরন্টো শহরটা আমার অনেক প্রিয়। আমি এই শহরের বাসিন্দা বলেই যে টরন্টো প্রিয় শহর তা নয়। টরন্টো এমন একটা শহর, যেখানে সবকিছু মনে হবে হাতের নাগালের মধ্যে। কোনো কিছুকেই দূরের মনে হয় না। এত ফ্রেন্ডলি এত আপন শহর পৃথিবীতে বেশি নেই। এটা কোনো কথার কথা নয়। কারণ আমি পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহর দেখেছি। সেই সব শহরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মনে আছে, যখন স্কুলে পড়তাম, তখন থেকেই পালিয়ে সিনেমা দেখতাম। আর লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই এনে পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়তাম। তখন থেকেই আমি মোটামুটি ইঁচড়ে পাকা। স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার জন্য মায়ের হাতে ধরা পড়ে মারও খেয়েছি অনেকবার। কিন্তু সিনেমা দেখা বন্ধ হয়নি। লুকিয়ে লুকিয়ে ইংরেজি সিনেমাও দেখতাম। তখন শুক্রবার ইংরেজি সিনেমা চলত। যেসব ছবির পোস্টারে লেখা থাকত ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’, সেগুলো আরও উৎসাহ নিয়ে দেখতাম।
একবার বিউটি সিনেমা হলে গেলাম সিনেমা দেখতে। বরিশালে। কোনো রকম টিকিটের পয়সা জোগাড় করেছি। তাও রিয়ার স্টল। একদম সামনের আসনে সিট। ঘাড় উঁচু করে দেখতে হয়, ছারপোকার কামড় তো আছেই। লোকজন শিস বাজায়। হু কেয়ারস! সব সময় রিয়ার স্টলেই সিনেমা দেখেছি। ডিসি ক্লাসে কোনো দিন সিনেমা দেখিনি। পঞ্চাশ পয়সা টিকিটের দাম ছিল তখন সম্ভবত। ব্ল্যাকে কাটতে হলে বেশি দাম পড়ত। ম্যাটিনি শোতে গেলাম সিনেমা দেখতে। সেদিন ছিল বৃষ্টি। রিকশা ভাড়া নেই বলে ঠিক করলাম হেঁটেই যাব কিন্তু বৃষ্টির কারণে করলাম কি একটা রিকশার পেছনে ঝুলে ঝুলে অনেকখানি পথ গেলাম। রিকশাওয়ালা চাচা টের পেলেই বকা দিত। সিনেমার নামটা ছিল ‘নীল আকাশের নীচে’। সেবারের ঈদের ছবি। রাজ্জাক-কবরী অভিনীত। কবরী আমার তখন থেকেই প্রিয় নায়িকা। চিত্রালী, পূর্ববাণী পত্রিকা থেকে কবরীর ছবি কেটে বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখি। রাত গভীর হলে বের করে দেখি। কবরীর হাসি ভুবন বিখ্যাত।
সেই সিনেমায় একটা গান আছে, রাজ্জাক গায়। নীল আকাশের নীচে আমি রাস্তা চলেছি একা...। স্পষ্ট মনে আছে, প্যান্ট-শার্ট পরা সুদর্শন রাজ্জাক দৌড়ে দৌড়ে গানটা গায়, কলেজের ছাত্র, হাতে একটা নোটবুক। কখনো গাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়ে, কখনো কুকুরের সঙ্গে দুষ্টুমি করে, কখনো মিষ্টি রোমান্টিক হেসে হেসে.. এই সবুজের শ্যামল মায়ায় দৃষ্টি পড়েছে ঢাকা...। শন শন বাতাসের গুঞ্জন এল চঞ্চল করে এই মন.. বউ কথা কও, ডাকে কেন বউ কি দেবে দেখা...! আহা ‘বউ’ শব্দটা তখন থেকেই মনের মধ্যে গেঁথে ছিল। কী রোমান্টিক! সাদাকালো গানের দৃশ্যটাতে বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফুটে উঠেছিল অপরূপভাবে। কত যে সবুজ আর মনোরম ছিল সে সময়। আহা এখন কি আর ওরকম আছে! চারদিকে শুধু বিল্ডিং আর ঘরবাড়ি। গ্যাস চেম্বারের মধ্যে বাস করছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। আমাদের সন্তানেরা।
কিন্তু টরন্টো শহরটা ওই রকম সবুজে সবুজে আচ্ছাদিত। একটা পাতাও কেউ ছেঁড়ে না। গাছ কাটার কোনো বিধান নেই। নিজের বাড়ির গাছ কাটতে হলেও সিটির অনুমতি লাগে। টরন্টো শহরটাকে বলা হয় সিটি অব পার্ক। একদিকে লেক অন্টারিও আর অন্য চারদিকে মাইলের পর মাইল শুধু পার্ক। শহরের রাস্তায় আমি একা একা ঘুরে বেড়াই। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো গাড়ি নিয়ে। আমার তো বেশি কেউ নেই, রাস্তাই আমার বন্ধু, আমি রাস্তার সঙ্গে মিতালি করি, পার্কে গিয়ে বসে থাকি অথবা লেকের কাছে, ওখানকার গাছপালা, কীটপতঙ্গের সঙ্গে ভাব করি, পাখিদের সঙ্গে, গাছেদের সঙ্গে কথা বলি। গাছেরা আমার ভাষা বুঝতে পারে। আমার নিঃসঙ্গতাকে ওরা টের পায়। রাজ্জাকের মতো গাছের ডালে ঝুলে গান গাইতে ইচ্ছা করে, বউ কথা কও, ডাকে কেন বউ কি দেবে দেখা..! তখন দূরে কোথাও কোকিলের ডাক ভেসে আসে, বউ কথা কও..।
টরন্টো শহর আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। টরন্টো আমার নিঃসঙ্গতা, আমার নির্জনতা, আমার বেদনা, আমার আনন্দের শহর। এই শহরকে কখনো ভোলা যায় না। টরন্টো আমার চাওয়া-পাওয়া, পাপ-পুণ্য, আশা- আকাক্সক্ষার সাক্ষী..।
অতীত কখনো মুছে যায় না
শৈশবকালটা কেমন ছন্নছাড়া ছিল। বড়ও হয়েছিলাম যেমন তেমনভাবে। আমাদের নামও রাখা হয়েছিল উল্টাপাল্টা, কোনো রীতি না মেনে। শিশুবেলা মনে হয় ন্যাংটো হয়েও ঘুরেছি, প্যান্ট যে কোথায় হারিয়ে যেত! মা রাগ করত, বকত। বাড়ির পেছনে ছিল বড় পুকুর, একটু দূরেই ছিল খাল। কাজেই খুব ছোটবেলাতেই আমি সাঁতার শিখেছিলাম। সাঁতার এবং জলের নেশা শিশুবয়সে খুব প্রবল ছিল। বেলা থাকতেই পুকুরে গিয়ে পড়তাম। যখন মা পানি থেকে টেনে তুলত, তখন গা সাদা, আর চোখ লাল হয়ে যেত। কদাচিৎ সাবান দিয়ে গোসল করানো হতো, কিংবা চুলে পড়ত চিরুনি। কোথা থেকে জামা-প্যান্ট তৈরি হতো জানি না। সেসব প্যান্ট-জামা ঠিকমতো ফিট করত না। টেনেহিঁচড়ে পরতাম, তারপর এর ওর জামা-প্যান্ট গুলিয়ে যেত, তারপর হারাত। প্রায়ই দাঁত মাজার কথা মনে থকত না। ঝাঁকড়-মাকর চুল, ময়লা দাঁত, খালি গাÑময়লা নোংরা একদঙ্গল রাস্তার ছেলের মতো ঘুরে বেড়াতাম। আমার দুরন্তপনায় মা অনেক টেনশন করত। বলত, বাপমরা ছেলে লেখাপড়া না শিখলে খাবে কী! কে দেখবে!
মাছকে সাঁতার শেখাতে হয় না। আমাকে কেউ সাঁতার শেখায়নি। জীবনের সবকিছুই আমি নিজে নিজে শিখেছি। আমি হচ্ছি সেলফ মেইড। হয়তো এ কারণে আমার অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আমি আমার ত্রুটিগুলোকে মেনে নিয়েছি। সাঁতারও আমি একা একাই শিখেছিলাম। এখনো আমি যখন সুইমিং পুলে নামি, অবলীলায় পার হয়ে যেতে পারি এমাথা থেকে ওমাথা। আমার সঙ্গে যারা সাঁতার কাটে, তারা বলে, তোমার বয়স কত? আমি বয়স বলি। ওরা বলে, ওয়াও! আমাদের চারটি বাড়িতে প্রায় দশটি পুকুর ছিল। পাশেই বয়ে গেছে খাল। একসময় সেই পুকুর আর খালে পানি ছিল ভরভরন্ত। জোয়ারের ঘোলা পানিতে নেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতরেছি। কাঠের পুল থেকে ডাইভ দিতাম পানিতে। আর বাড়িতে যে বড় পুকুরটা ছিল, সেখানেও স্কুল থেকে এসেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম। মা এসে টেনে তুলত। চোখ লাল আর চামড়া সাদা হয়ে যেত। এখন সেই পুকুর আর খাল কেমন শীর্ণকায় হয়ে গেছে। কত কাদা পানিতে সাঁতার কেটেছি। যখন নাওয়া শেষে উঠতাম, দেখতাম গায়ে কাদা লেগে আছে। কত দিন পরপর সাবান দিতাম, কে জানে। মনে আছে, তিব্বত ৫৭০ সাবান পেলেই খুশিতে ডগমগ হতাম। জীবনে অনেক কিছুই বদলে যায় কিন্তু স্মৃতিগুলো থেকে যায়।
মানুষের মন একটা অদ্ভুত জিনিস। প্রত্যেক মানুষের যে জিনিসটা নিয়ে সারাক্ষণ চড়াই-উতরাই চলে, সেটা হচ্ছে তার মন। সবার ভেতরেই একটা করে মন আছে। যা দেখা যায় না, দেখানোও যায় না। সেই মন দিয়ে সে অন্যের হৃদয় জয় করে, হৃদয় হরণ করে। অন্যকে সুখ দেয়, শান্তি দেয়, আবার দুঃখ দেয়, কষ্টও দেয়। এই মন আছে বলেই মন নিয়ে খেলা আছে। আছে লুকোচুরি, আছে প্রেম, আছে ভালোবাসা, আছে মোহ, কাছে পাওয়ার বাসনা, আছে ঘৃণা, আছে প্রতারণা, আছে উচাটন মন। কেউ কারও মনের কথা বোঝে না, কেউ কারও মনের খবর রাখে না। এটাই মনের রহস্য।
মন একক, মন স্বাধীন। মন কারও ধার ধারে না। মনের রয়েছে অবাধ বিচরণ। মাঝে মাঝে আমিও এই মন নিয়ে উতলা হয়ে পড়ি। মন কী চায় বুঝতে পারি না। আউলা-ঝাউলা লাগে। মনটাকে কোথায় জমা করব, কার কাছে রাখব, বুঝতে পারি না। তখন ভাবি, মন আসলে কী! এটার কাজ কী! মন অস্থির হয়, মন এলোমেলো হয়। যেভাবে ভাবি সেভাবে কিছু ঘটে না। মন পালাই পালাই করে। কিন্তু মন মুক্তি পায় না। তখন মন আরও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে! মানুষের যত সমস্যা এই মন নিয়েই..।
যতটা না সুখ তার চেয়ে বেশি দুঃখ মানুষের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। বলা যায়, দুঃখ নামক বোধটা মানুষের শিরা-উপশিরা, ধমনি-মহাধমনিতে বহমান। দুঃখ আচমকা এসে হানা দেয়। কেউই দুঃখ চায় না, সবাই চায় সুখ। কিন্তু বিস্ময়করভাবে মানুষ যেটা চায়, সেটা পায় না। মানুষ যা চায় না, তা-ই মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। দুঃখের এই রহস্যটা আমাদের জানা নেই! জানা থাকলে ভালো হতো। কেন সুখের চেয়ে দুঃখের ভার বেশি! কেন সুখকে ক্ষণস্থায়ী এবং দুঃখকে প্রলম্বিত মনে হয়! কেন মানুষ দুঃখে ভেঙে পড়ে! কেন মানুষের দুঃখের রাত সহজে ভোর হতে চায় না। একেকজন মানুষের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দুঃখের অনুভূতি। তেমনি সুখের অনুভূতিও ভিন্নতর। কেউ সংসারজীবনে দুঃখী, কেউ স্বামী বা স্ত্রীর জন্য দুঃখী, কেউ সন্তান বা বন্ধু নিয়ে দুঃখী। কেউ তার অসুস্থ শরীর নিয়ে দুঃখী, কেউ চাকরি নিয়ে দুঃখী, কেউ মা-বাবা বা ভাই-বোন কিংবা কোনো আপনজন হারিয়ে দুঃখী। কেউ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে দুঃখী, কেউ বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় দুঃখী। কেউ আবার প্রত্যাশিত জিনিস না পেয়ে দুঃখী। মানুষ অনেক তুচ্ছ কারণেও দুঃখী হতে পারে। দুঃখ একটা বোধের নাম। কেউ দুঃখকে সামলে নিতে পারে, কেউ পারে না। আমি নিজেও দুঃখকে সামলাতে পারি না। দুঃখ আমাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়। অনেক সামান্য কারণেও আমি দুঃখ পাই, ব্যথিত হই..।
নিজেকে আবার আবিষ্কার করলাম। কথার মাঝখানে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া আমার স্বভাবে আছে। যখন স্কুলে পড়তাম, প্রায়ই আমি স্যারদের বেতের বাড়ি খেতাম। আফতাব স্যার দরজা দিয়ে ক্লাসে ঢোকার মুখেই এলজাবরার সূত্র বলতে বলতে ঢুকতেন, আশরাফ স্যার ঢুকেই ক্লাসের পেছনের বেঞ্চের দিকে তাকাতেন বা প্রমোদ বাবু স্যার ইংরেজিতে কঠিন কঠিন বাক্য গঠন করতে বলতেন। আমি যে পেছনের বেঞ্চে বসি, এটা স্যাররা জানেন। আমি পড়ার বইয়ের আড়ালে গল্পের বই পড়তাম বা কারও সঙ্গে খুনসুটি করতাম। আশরাফ স্যারের বাঁহাত ছিল ডিসঅ্যাবল। ছোটখাটো মানুষটা ওই হাত দিয়েই চেপে ধরে ডান হাতে বেত মারতে পারতেন। ওই রকম হাতে এত শক্তি কোথা থেকে আসত, কে জানে। ধরলে সহজে ছোটানো যেত না। সাঁড়াশির মতো শক্ত ছিল।
সে সময় ক্লাসে প্রতিদিন স্যাররা পড়া ধরত। না পারলে হাতে শপাং শপাং বেতের বাড়ি। ক্লাসে আমি ছিলাম সবচেয়ে অমনোযোগী। স্যাররা কী বলছে আমি শুনতে পেতাম না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও আমার এই স্বভাব ছিল। এ জন্য স্যারদের সঙ্গে আমার কখনো সখ্য গড়ে ওঠেনি। আমি সব সময় তাদের এড়িয়ে চলতাম। আমি বেশির ভাগ স্যারেরই নাম ভুলে গেছি। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে আমার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান কে ছিল বা লিটারেচার কে পড়াত, আমি বলতে পারি না। আলোচনা অনুষ্ঠান, টক শো এমনকি সিনেমা দেখতে দেখতেও আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাই, কিছু শুনতে পাই না। তখন অন্য কোনো জগতে থাকি আমি..।
এখনো যখন কারও সঙ্গে কথা বলি বা চায়ের টেবিলে বসি ওয়ান টু ওয়ানÑএটা খুব বাজে স্বভাব আমার, একটা-দুটা কথা বলার পরই আমি খেই হারিয়ে ফেলি। তখন অপরজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেই বলুক আমি শুধু শুনব। গ্রুপে হলে আরও ভালো, বেশি কথা বলতে হয় না। সেটা স্বস্তিদায়ক। সবার সামনে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া কেমন না! কিন্তু মানুষের স্বভাব সহজে বদলায় না। আমিও নিজেকে বদলাতে পারি না। পারলে ভালো হতো...।
কাউকে আঘাত দেওয়া খুবই সহজ কাজ। কিন্তু কাউকে ভালোবেসে বুকে টেনে নেওয়া কঠিন। অথচ ভালোবাসাই চিরন্তন, ভালোবাসাই টিকে থাকে, ভালোবাসার রয়েছে রূপমাধুর্য। ঘৃণা আপনাকে কিছুই দেবে না। ঘৃণা ছড়ানো বা বিদ্বেষ প্রকাশ আপনাকে সাময়িক জয়ী করবে বটে কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে আপনি হেরে গেছেন। আপনি যখন নিজের মুখোমুখি হবেন, নিজেকে আয়নায় দেখবেন, তখন বুঝতে পারবেন আপনি অন্যকে ইচ্ছা করে কষ্ট দিয়েছিলেন, অবহেলা করেছিলেন কিংবা বিদ্বেষ পোষণ করেছিলেন। মানুষ অনেক সময় নিজের অবচেতনে জেলাস হয়, কোনো কারণ ছাড়াই আমরা অন্যকে অপছন্দ করি। এই রহস্যের কিনারা করা কঠিন। আমার নিজের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়। সবারই নিজেকে চেনার দরকার আছে। আমি নিজেও অনেক সময় অন্যের বিদ্বেষের কারণ হই। কেউ কেউ বুঝে হোক না বুঝে হোক বিদ্বেষ বা ক্ষোভ প্রকাশ করে। আমি নিজে কাউকে আঘাত করে কিছু বলি না। দ্বিমত পোষণ করলে তা বিনয়ের সঙ্গে উল্লেখ করি বা নীরবতা পালন করি। এমনকি সংসারজীবনেও আমি অনেক ক্ষেত্রে নীরবতার আশ্রয় নিই। আপস করি। সবকিছুরই একটা নিয়ম আছে। নিয়মের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারি না। আমরা প্রায়ই আমাদের মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এই লেখার অর্থ এই নয় যে আমি কাউকে মাত্রাজ্ঞান শেখাচ্ছি। আমার নিজেরও অনেক ভুল আছে। আমি আমার ভুলগুলোকে শুধরে নিতে চাই। আমরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নই..।
যখনই বরিশালের পথ দিয়ে হাঁটি, তখন অন্য রকম একটা অনুভূতি কাজ করে। একটা আনন্দের শিহরণ কুলকুল করে বয়ে যায় সব সময়। এই রকম একটি স্বপ্নের জায়গা ছেড়ে আমি কীভাবে দূরে চলে গেলাম! এখানকার মাটি আমার সঙ্গে কথা বলত। প্রতিটি গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ ছিল আমার অনেক আপন। আমি ভাব করতাম মেঘেদের সঙ্গে, আকাশের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে আমার অনেক সখ্য ছিল। তখন কত অভাব ছিল, না পাওয়া ছিল আর ছিল অবহেলা। কিন্তু তার পরও আমি সব সময় আনন্দিত থাকতে চেয়েছি।
টরন্টো, কানাডা
জেসমিন আসতে চায়নি কানাডা। অর্ক অরিত্রি সব পরিবেশেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে। আর আমি কখনো কখনো আগুনে ঝাঁপ দিতেও দ্বিধা করি না। পূর্বাপর ভেবে সবকিছু করা যায় না। আমার পুরো জীবনটাই এমন। আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি আমি। জীবন নিয়ে আমার কোনো উচ্চাভিলাষ নাই। সারা জীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছি। বিদেশের জীবন হবে আরও বেশি প্রতিকূল, সেটা জানা আছে। আমি শুধু চাই আমার সন্তানদের সুখী করতে, সেটা যেকোনো জায়গায়ই হোক না কেন।
এত বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। ছেলেমেয়েদের নিজেদের জীবন হয়েছে, সংসার হয়েছে। আরও কত কী বদলে যাবে। আমি এসব টের পাই। আমার অবজারভেশন খুব ভালো। আমি আগাম টের পাই বলে জীবনে অনেক অঘটন থেকে রেহাই পেয়েছি। তার পরও আমি ভুল করি। সবচেয়ে বড় ভুল হয় মানুষ চিনতে। মানুষকে আমি অন্ধের মতো বিশ্বাস করি এবং প্রায়শই ঠকি। কষ্ট পাই। কিন্তু সেসব নিয়ে আমার কোনো অনুতাপ হয় না। দেশে-বিদেশে সব জায়গায়ই আমি মানুষের কারণে অনেক যন্ত্রণা পেয়েছি। কিন্তু সেসব আমি মনে রাখিনি। সবাই তো আর এক রকম হবে না। আগে বেশি এসব নিয়ে আদিখ্যেতা করতাম। মাথা ঘামাতাম। এখন করি না। এটাই জীবন। এসব নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। পৃথিবীতে নিরবচ্ছিন্ন সুখ যেমন নেই, দুঃখও নেই।
যেমন মা চলে গেলেন। এই তো সেদিনের কথা। অথচ দেখতে দেখতে ১৪টি বছর পার হয়ে গেল।
জীবন থেকে এভাবেই সময় চলে যায়। মা চলে গেলেও তিনি আছেন হৃদয়ে, স্মরণে, মননে, স্মৃতির আয়নায়। অনেক অসাধারণ সব স্মৃতি আছে আমাদের, যা সব সময় জ্বলজ্বল করে। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো সব সময় মুক্তোর মতো ঔজ্জ্বল্য ছড়ায় প্রতিনিয়ত। একটা ঘটনা মনে আছে, তখন আমার বয়স ১০-১২ বছর হবে। মামাবাড়িতে গেছি। অজ গ্রাম। একেক দিন সন্ধ্যাবেলা আমার খুব মন খারাপ লাগত। এমন একেকটা বিকেলবেলা আছে, যখন সূর্য ডুবে যাওয়ার সময় অন্তত একটা মায়াবী অপার্থিব আলো এসে পড়ত উঠোনে। আকাশের রং যেত পাল্টে। সমস্ত বাড়িটায় কেমন এক আলো-আঁধারির সৃষ্টি হতো। হঠাৎ হঠাৎ আমার বহুজনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া আমাকে অনুভব করতাম। টের পেতাম আমার আলাদা একা এক ‘আমি’ আছে। সেই সব বিষণ্ন বিকেলে আমার মাঝে মাঝে মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে হতো। প্রায়ই পশ্চিমের ঘরে মাকে খুঁজতে গিয়ে পেতাম না। সারা বাড়ি খুঁজে মাকে হয়তো পেতাম বড় ঘরের পাটাতনের সিঁড়ির তলায় গামলায় চাল মেপে তুলছেন। আমি অবোধ, দুর্জ্ঞেয় এক বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই যে মায়ের কাছে গিয়েছি, তা মা বুঝতেন না। তবু একটুক্ষণের জন্য হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিতেন। একটুক্ষণের জন্য মাথাটা চেপে রাখতেন বুকে। আমি তখন মায়ের গা থেকে মা মা গন্ধটা পেতাম। মা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করতেন, দুপুরে পেট ভরেছিল? আমি বুকভরে মায়ের গায়ের সুঘ্রাণ নিতাম। আজ মা নেই। কোথায় হারিয়ে গেছে সেই আনন্দ।
সেদিনের আকাশেও সপ্তর্ষি ছিল, ছায়াপথ ছিল না। মা বসে থাকেন পাশে। পিঠে হাত বোলান। কথা বলেন না। নীরবে মাতা-পুত্রের সময় পার হয়ে যায়। ধুলারাশির মতো আকীর্ণ নক্ষত্রপুঞ্জ বিপুল একটি অনির্দিষ্ট পথের মতো পড়ে থাকে, ওখানে রোজ ঝড় ওঠে, ঝোড়ো হাওয়ায় নক্ষত্রের গুঁড়ো উড়ে সমস্ত আকাশে ছড়ায়। সপ্তর্ষির চেহারা শান্ত। প্রশ্নচিহ্নের মতো। ব্যক্ত ও অব্যক্ত জগতের সীমায় বসে আছেন সাতজন শান্ত-সমাহিত ঋষি। মৃত্যুর পর থাকে কি কোনো চেতনা? অথবা আরেকবার কি জন্ম নেওয়া যায়? মৃত্যু, মহান একটি ঘুম, তার বেশি কিছু নয়। ছেলেবেলায় ফাঁকা মাঠে শুয়ে আকাশ দেখা হতো। দেখতে দেখতে কোনো শূন্যতায় পৌঁছে যেত মন। পার্থিব কোনো কিছুই আর মনে থাকত না। তখন আকাশে থাকতেন দেবতারা, মানুষের ইচ্ছা পূরণ করতেন। আজ তারা কেউ নেইÑনা মনে, না আকাশে। তবু আজও সপ্তর্ষির অদৃশ্য আলো শরীর আর মনে অনুভব করা যায়। আবার যদি দেখা হয় মায়ের সঙ্গে। আবার যদি! আমার মাথায় একটু হাত রাখো তো মা, একটু হাত রাখো। মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, কেন রে? সব ভুলিয়ে দাও তো মা, ভুলিয়ে দাও তো। বুদ্ধি, স্মৃতি, অবস্থা ভুলিয়ে দাও। আবার ছোট হয়ে কোলে ফিরে যাই..।
তখন আমার জগৎটা আলোকিত হয়ে ওঠে
মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করি, আমার কি কোনো দুঃখ আছে! মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করি, আমি কি সুখী! আমি আমার শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলোর সঙ্গে বর্তমানের দিনগুলোর তুলনা করি এবং এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। এই দুইয়ের মাঝে মধ্যবর্তী যে জীবন ছিল আমার, সেখানে অভাব-অনটন, লড়াই-সংগ্রাম, অপমান-অবহেলা, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না সবই ছিল। কী ছিল না সেই জীবনে! সবই ছিল। সেসবেরও ব্যবচ্ছেদ করি। সুখ বা দুঃখ কোনোটা নিয়েই আমি কখনো আদিখ্যেতা করিনি। কোনোটাই নিরবচ্ছিন্ন নয় জীবনে। দুটোই জীবনের অংশ। তাই জীবনের বঞ্চনাগুলো নিয়ে আমি কখনো নিজেকে দুঃখিত করে তুলিনি। ভারাক্রান্ত হইনি। নির্দিষ্টভাবে কাউকে দায়ী করিনি। বরং আমি যে এখন নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছি, সে জন্য নেপথ্যের মানুষগুলোর প্রতি অবনতমস্তকে কৃতজ্ঞতা জানাই। যারা আমাকে স্বার্থহীনভাবে ভালোবেসেছে, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, পাশে থেকেছে, প্রশ্রয় দিয়েছে, তাদের প্রতি আমার একবুক ভালোবাসা সব সময়। এখনো যারা আমার প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়ায়, ভালোবাসে, মাথায় হাত রাখে, তাদের স্পর্শ আমার কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। বাঁচতে শেখায়।
মনে আছে, যখন স্কুলে পড়ি, লেইজারে আমি খুব কম দিনই মালেক ভাইয়ের মালাই আইসক্রিম খেতে পারতাম। একটা-দুটোর বেশি জামা, প্যান্ট বা জুতা ছিল না আমার। রোদে-বৃষ্টিতে ভিজত, আবার গায়েই শুকাত। ঠান্ডা লাগত না। শরীর সব সয়ে নিত। আমার ক্লাসের যে বন্ধু আমাকে ডেকে নিয়ে আইসক্রিম অফার করত, তার কথাও আমি কখনো ভুলিনি। এক ঈদে আমার নতুন জামা ছিল না। পুরোনো জামা ধুয়ে মা ইস্ত্রি করে দিয়েছিল। বাড়ির সবাই নতুন জামা পরে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছে, আমি পুরোনো জামা পরেছি, তাও আমার মনে কষ্ট হয়নি। মা বলেছিল, কষ্ট পেয়ো না। তোমার জন্য দোয়া করি, একদিন তুমি অনেক জামা পরতে পারবে। আমার ছেলেমেয়েরা যে আমাকে এত এত জামাকাপড় গিফট দেয়, অনেক প্যাকেট দুই বছরেও খোলা হয়নি আমার। যখন ঢাকা শহরে আমার থাকার জায়গা ছিল না, খাওয়ার পয়সা ছিল না, তখন যারা আমার পাশে থেকেছিল, আমি তাদের কথা কী করে ভুলি! প্রথম দিন যে বন্ধুর জামা পরে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তার কথা কি ভোলা যায়! বিয়ের সময় যে বন্ধুরা বিভিন্নভাবে হেল্প করেছিল, তারাও থাকে হৃদয়ের গভীরে।
এমনই অনেক কিছুই জড়িয়ে থাকে এক জীবনে। ব্যক্তি জড়িয়ে থাকে, ঘটনা জড়িয়ে থাকে। সেখানে বঞ্চনা আর অপমান যেমন থাকে, আনন্দও থাকে। মোটা দাগের সেসব অপমানের কথা মনে করে আমি কখনো নিজের জীবনকে বিষিয়ে তুলিনি। এসব সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এখনো করে। যারা আমাকে তাচ্ছিল্য করেছিল বা অবহেলা, আমি সেই সব মানুষকে গিয়ে কখনো বলিনি তোমরা আমার সঙ্গে এমন কেন করেছিলে! কেন কষ্ট দিয়েছিলে! বরং সেসব মানুষই যখন আমাকে ভালোবেসে কাছে টানতে চায় বা সম্মান দেখায়, তখন আমি পেছনের সবকিছু ভুলে যাই। হ্যাঁ, কিছু কষ্ট থাকে যা সহজে ভোলা যায় না। কিছু বঞ্চনা থাকে যা মনের গভীরে দাগ ফেলে দেয়। সবকিছু মনে রাখলে মানুষ যেমন বাঁচতে পারত না আবার সবকিছু ভুলেও যাওয়া যায় না। ভুলতে পারলে ভালো হতো। ভুলত্রুটি নিয়েই এই জীবন।
কিছু মানুষ থাকে সারা জীবনই অন্যকে ছোট করে দেখে, তাচ্ছিল্য করে। এ ধরনের মানুষ আমি অনেক দেখেছি। সেসব মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় মনে করেছি। কারও সঙ্গে লড়াই করার চেয়ে অ্যাভয়েড করা ভালো সমাধান মনে করি। অনেক কাছের মানুষও আমার সঙ্গে এমন আচরণ করে, দূরের মানুষও করে। আমার প্রতি নির্বিকার থাকে। আমি সব সময় তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাই। তাদের প্রতি আমি কোনো ক্ষোভ নিয়ে বসে নেই। আমি আমার নিজের মধ্যে একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছি। সেই জগতে আমার বসবাস। বাঁচার জন্য আমাকে এমনটা করতে হয়েছে। এই একাকী জীবনে হঠাৎ হঠাৎ একেকজন আমার জীবনে দেবদূতের মতো আবির্ভূত হয়। আমার জগৎটা আলোকিত হয়ে ওঠে। সাধারণ এই জীবনে অসাধারণ অনুভূতি দেয়। সকল গ্লানি মুছে যায়।
আবুল হাসানের কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করছি...
হলুদ সন্ধ্যায় একা একা, হায় কার অভিশাপে
এত নির্জনতা, বিমর্ষ সঙ্গতা এই আমার রক্তের, করছি কেবল পান,
আমায় কি একবারও মনে পড়ে না সেই হলদে পাখির মুখোমুখি
নীল ঘাসে ঢাকা, শাক ও সবজির শ্যামলে বিছানো হাত আর পায়ের ক্রন্দন।
স্বপ্ন কাজল মাখা
টরন্টো শহরটা আমার অনেক প্রিয়। আমি এই শহরের বাসিন্দা বলেই যে টরন্টো প্রিয় শহর তা নয়। টরন্টো এমন একটা শহর, যেখানে সবকিছু মনে হবে হাতের নাগালের মধ্যে। কোনো কিছুকেই দূরের মনে হয় না। এত ফ্রেন্ডলি এত আপন শহর পৃথিবীতে বেশি নেই। এটা কোনো কথার কথা নয়। কারণ আমি পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহর দেখেছি। সেই সব শহরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মনে আছে, যখন স্কুলে পড়তাম, তখন থেকেই পালিয়ে সিনেমা দেখতাম। আর লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই এনে পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়তাম। তখন থেকেই আমি মোটামুটি ইঁচড়ে পাকা। স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার জন্য মায়ের হাতে ধরা পড়ে মারও খেয়েছি অনেকবার। কিন্তু সিনেমা দেখা বন্ধ হয়নি। লুকিয়ে লুকিয়ে ইংরেজি সিনেমাও দেখতাম। তখন শুক্রবার ইংরেজি সিনেমা চলত। যেসব ছবির পোস্টারে লেখা থাকত ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’, সেগুলো আরও উৎসাহ নিয়ে দেখতাম।
একবার বিউটি সিনেমা হলে গেলাম সিনেমা দেখতে। বরিশালে। কোনো রকম টিকিটের পয়সা জোগাড় করেছি। তাও রিয়ার স্টল। একদম সামনের আসনে সিট। ঘাড় উঁচু করে দেখতে হয়, ছারপোকার কামড় তো আছেই। লোকজন শিস বাজায়। হু কেয়ারস! সব সময় রিয়ার স্টলেই সিনেমা দেখেছি। ডিসি ক্লাসে কোনো দিন সিনেমা দেখিনি। পঞ্চাশ পয়সা টিকিটের দাম ছিল তখন সম্ভবত। ব্ল্যাকে কাটতে হলে বেশি দাম পড়ত। ম্যাটিনি শোতে গেলাম সিনেমা দেখতে। সেদিন ছিল বৃষ্টি। রিকশা ভাড়া নেই বলে ঠিক করলাম হেঁটেই যাব কিন্তু বৃষ্টির কারণে করলাম কি একটা রিকশার পেছনে ঝুলে ঝুলে অনেকখানি পথ গেলাম। রিকশাওয়ালা চাচা টের পেলেই বকা দিত। সিনেমার নামটা ছিল ‘নীল আকাশের নীচে’। সেবারের ঈদের ছবি। রাজ্জাক-কবরী অভিনীত। কবরী আমার তখন থেকেই প্রিয় নায়িকা। চিত্রালী, পূর্ববাণী পত্রিকা থেকে কবরীর ছবি কেটে বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখি। রাত গভীর হলে বের করে দেখি। কবরীর হাসি ভুবন বিখ্যাত।
সেই সিনেমায় একটা গান আছে, রাজ্জাক গায়। নীল আকাশের নীচে আমি রাস্তা চলেছি একা...। স্পষ্ট মনে আছে, প্যান্ট-শার্ট পরা সুদর্শন রাজ্জাক দৌড়ে দৌড়ে গানটা গায়, কলেজের ছাত্র, হাতে একটা নোটবুক। কখনো গাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়ে, কখনো কুকুরের সঙ্গে দুষ্টুমি করে, কখনো মিষ্টি রোমান্টিক হেসে হেসে.. এই সবুজের শ্যামল মায়ায় দৃষ্টি পড়েছে ঢাকা...। শন শন বাতাসের গুঞ্জন এল চঞ্চল করে এই মন.. বউ কথা কও, ডাকে কেন বউ কি দেবে দেখা...! আহা ‘বউ’ শব্দটা তখন থেকেই মনের মধ্যে গেঁথে ছিল। কী রোমান্টিক! সাদাকালো গানের দৃশ্যটাতে বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফুটে উঠেছিল অপরূপভাবে। কত যে সবুজ আর মনোরম ছিল সে সময়। আহা এখন কি আর ওরকম আছে! চারদিকে শুধু বিল্ডিং আর ঘরবাড়ি। গ্যাস চেম্বারের মধ্যে বাস করছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। আমাদের সন্তানেরা।
কিন্তু টরন্টো শহরটা ওই রকম সবুজে সবুজে আচ্ছাদিত। একটা পাতাও কেউ ছেঁড়ে না। গাছ কাটার কোনো বিধান নেই। নিজের বাড়ির গাছ কাটতে হলেও সিটির অনুমতি লাগে। টরন্টো শহরটাকে বলা হয় সিটি অব পার্ক। একদিকে লেক অন্টারিও আর অন্য চারদিকে মাইলের পর মাইল শুধু পার্ক। শহরের রাস্তায় আমি একা একা ঘুরে বেড়াই। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো গাড়ি নিয়ে। আমার তো বেশি কেউ নেই, রাস্তাই আমার বন্ধু, আমি রাস্তার সঙ্গে মিতালি করি, পার্কে গিয়ে বসে থাকি অথবা লেকের কাছে, ওখানকার গাছপালা, কীটপতঙ্গের সঙ্গে ভাব করি, পাখিদের সঙ্গে, গাছেদের সঙ্গে কথা বলি। গাছেরা আমার ভাষা বুঝতে পারে। আমার নিঃসঙ্গতাকে ওরা টের পায়। রাজ্জাকের মতো গাছের ডালে ঝুলে গান গাইতে ইচ্ছা করে, বউ কথা কও, ডাকে কেন বউ কি দেবে দেখা..! তখন দূরে কোথাও কোকিলের ডাক ভেসে আসে, বউ কথা কও..।
টরন্টো শহর আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। টরন্টো আমার নিঃসঙ্গতা, আমার নির্জনতা, আমার বেদনা, আমার আনন্দের শহর। এই শহরকে কখনো ভোলা যায় না। টরন্টো আমার চাওয়া-পাওয়া, পাপ-পুণ্য, আশা- আকাক্সক্ষার সাক্ষী..।
অতীত কখনো মুছে যায় না
শৈশবকালটা কেমন ছন্নছাড়া ছিল। বড়ও হয়েছিলাম যেমন তেমনভাবে। আমাদের নামও রাখা হয়েছিল উল্টাপাল্টা, কোনো রীতি না মেনে। শিশুবেলা মনে হয় ন্যাংটো হয়েও ঘুরেছি, প্যান্ট যে কোথায় হারিয়ে যেত! মা রাগ করত, বকত। বাড়ির পেছনে ছিল বড় পুকুর, একটু দূরেই ছিল খাল। কাজেই খুব ছোটবেলাতেই আমি সাঁতার শিখেছিলাম। সাঁতার এবং জলের নেশা শিশুবয়সে খুব প্রবল ছিল। বেলা থাকতেই পুকুরে গিয়ে পড়তাম। যখন মা পানি থেকে টেনে তুলত, তখন গা সাদা, আর চোখ লাল হয়ে যেত। কদাচিৎ সাবান দিয়ে গোসল করানো হতো, কিংবা চুলে পড়ত চিরুনি। কোথা থেকে জামা-প্যান্ট তৈরি হতো জানি না। সেসব প্যান্ট-জামা ঠিকমতো ফিট করত না। টেনেহিঁচড়ে পরতাম, তারপর এর ওর জামা-প্যান্ট গুলিয়ে যেত, তারপর হারাত। প্রায়ই দাঁত মাজার কথা মনে থকত না। ঝাঁকড়-মাকর চুল, ময়লা দাঁত, খালি গাÑময়লা নোংরা একদঙ্গল রাস্তার ছেলের মতো ঘুরে বেড়াতাম। আমার দুরন্তপনায় মা অনেক টেনশন করত। বলত, বাপমরা ছেলে লেখাপড়া না শিখলে খাবে কী! কে দেখবে!
মাছকে সাঁতার শেখাতে হয় না। আমাকে কেউ সাঁতার শেখায়নি। জীবনের সবকিছুই আমি নিজে নিজে শিখেছি। আমি হচ্ছি সেলফ মেইড। হয়তো এ কারণে আমার অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আমি আমার ত্রুটিগুলোকে মেনে নিয়েছি। সাঁতারও আমি একা একাই শিখেছিলাম। এখনো আমি যখন সুইমিং পুলে নামি, অবলীলায় পার হয়ে যেতে পারি এমাথা থেকে ওমাথা। আমার সঙ্গে যারা সাঁতার কাটে, তারা বলে, তোমার বয়স কত? আমি বয়স বলি। ওরা বলে, ওয়াও! আমাদের চারটি বাড়িতে প্রায় দশটি পুকুর ছিল। পাশেই বয়ে গেছে খাল। একসময় সেই পুকুর আর খালে পানি ছিল ভরভরন্ত। জোয়ারের ঘোলা পানিতে নেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতরেছি। কাঠের পুল থেকে ডাইভ দিতাম পানিতে। আর বাড়িতে যে বড় পুকুরটা ছিল, সেখানেও স্কুল থেকে এসেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম। মা এসে টেনে তুলত। চোখ লাল আর চামড়া সাদা হয়ে যেত। এখন সেই পুকুর আর খাল কেমন শীর্ণকায় হয়ে গেছে। কত কাদা পানিতে সাঁতার কেটেছি। যখন নাওয়া শেষে উঠতাম, দেখতাম গায়ে কাদা লেগে আছে। কত দিন পরপর সাবান দিতাম, কে জানে। মনে আছে, তিব্বত ৫৭০ সাবান পেলেই খুশিতে ডগমগ হতাম। জীবনে অনেক কিছুই বদলে যায় কিন্তু স্মৃতিগুলো থেকে যায়।
মানুষের মন একটা অদ্ভুত জিনিস। প্রত্যেক মানুষের যে জিনিসটা নিয়ে সারাক্ষণ চড়াই-উতরাই চলে, সেটা হচ্ছে তার মন। সবার ভেতরেই একটা করে মন আছে। যা দেখা যায় না, দেখানোও যায় না। সেই মন দিয়ে সে অন্যের হৃদয় জয় করে, হৃদয় হরণ করে। অন্যকে সুখ দেয়, শান্তি দেয়, আবার দুঃখ দেয়, কষ্টও দেয়। এই মন আছে বলেই মন নিয়ে খেলা আছে। আছে লুকোচুরি, আছে প্রেম, আছে ভালোবাসা, আছে মোহ, কাছে পাওয়ার বাসনা, আছে ঘৃণা, আছে প্রতারণা, আছে উচাটন মন। কেউ কারও মনের কথা বোঝে না, কেউ কারও মনের খবর রাখে না। এটাই মনের রহস্য।
মন একক, মন স্বাধীন। মন কারও ধার ধারে না। মনের রয়েছে অবাধ বিচরণ। মাঝে মাঝে আমিও এই মন নিয়ে উতলা হয়ে পড়ি। মন কী চায় বুঝতে পারি না। আউলা-ঝাউলা লাগে। মনটাকে কোথায় জমা করব, কার কাছে রাখব, বুঝতে পারি না। তখন ভাবি, মন আসলে কী! এটার কাজ কী! মন অস্থির হয়, মন এলোমেলো হয়। যেভাবে ভাবি সেভাবে কিছু ঘটে না। মন পালাই পালাই করে। কিন্তু মন মুক্তি পায় না। তখন মন আরও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে! মানুষের যত সমস্যা এই মন নিয়েই..।
যতটা না সুখ তার চেয়ে বেশি দুঃখ মানুষের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। বলা যায়, দুঃখ নামক বোধটা মানুষের শিরা-উপশিরা, ধমনি-মহাধমনিতে বহমান। দুঃখ আচমকা এসে হানা দেয়। কেউই দুঃখ চায় না, সবাই চায় সুখ। কিন্তু বিস্ময়করভাবে মানুষ যেটা চায়, সেটা পায় না। মানুষ যা চায় না, তা-ই মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। দুঃখের এই রহস্যটা আমাদের জানা নেই! জানা থাকলে ভালো হতো। কেন সুখের চেয়ে দুঃখের ভার বেশি! কেন সুখকে ক্ষণস্থায়ী এবং দুঃখকে প্রলম্বিত মনে হয়! কেন মানুষ দুঃখে ভেঙে পড়ে! কেন মানুষের দুঃখের রাত সহজে ভোর হতে চায় না। একেকজন মানুষের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দুঃখের অনুভূতি। তেমনি সুখের অনুভূতিও ভিন্নতর। কেউ সংসারজীবনে দুঃখী, কেউ স্বামী বা স্ত্রীর জন্য দুঃখী, কেউ সন্তান বা বন্ধু নিয়ে দুঃখী। কেউ তার অসুস্থ শরীর নিয়ে দুঃখী, কেউ চাকরি নিয়ে দুঃখী, কেউ মা-বাবা বা ভাই-বোন কিংবা কোনো আপনজন হারিয়ে দুঃখী। কেউ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে দুঃখী, কেউ বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় দুঃখী। কেউ আবার প্রত্যাশিত জিনিস না পেয়ে দুঃখী। মানুষ অনেক তুচ্ছ কারণেও দুঃখী হতে পারে। দুঃখ একটা বোধের নাম। কেউ দুঃখকে সামলে নিতে পারে, কেউ পারে না। আমি নিজেও দুঃখকে সামলাতে পারি না। দুঃখ আমাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়। অনেক সামান্য কারণেও আমি দুঃখ পাই, ব্যথিত হই..।
নিজেকে আবার আবিষ্কার করলাম। কথার মাঝখানে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া আমার স্বভাবে আছে। যখন স্কুলে পড়তাম, প্রায়ই আমি স্যারদের বেতের বাড়ি খেতাম। আফতাব স্যার দরজা দিয়ে ক্লাসে ঢোকার মুখেই এলজাবরার সূত্র বলতে বলতে ঢুকতেন, আশরাফ স্যার ঢুকেই ক্লাসের পেছনের বেঞ্চের দিকে তাকাতেন বা প্রমোদ বাবু স্যার ইংরেজিতে কঠিন কঠিন বাক্য গঠন করতে বলতেন। আমি যে পেছনের বেঞ্চে বসি, এটা স্যাররা জানেন। আমি পড়ার বইয়ের আড়ালে গল্পের বই পড়তাম বা কারও সঙ্গে খুনসুটি করতাম। আশরাফ স্যারের বাঁহাত ছিল ডিসঅ্যাবল। ছোটখাটো মানুষটা ওই হাত দিয়েই চেপে ধরে ডান হাতে বেত মারতে পারতেন। ওই রকম হাতে এত শক্তি কোথা থেকে আসত, কে জানে। ধরলে সহজে ছোটানো যেত না। সাঁড়াশির মতো শক্ত ছিল।
সে সময় ক্লাসে প্রতিদিন স্যাররা পড়া ধরত। না পারলে হাতে শপাং শপাং বেতের বাড়ি। ক্লাসে আমি ছিলাম সবচেয়ে অমনোযোগী। স্যাররা কী বলছে আমি শুনতে পেতাম না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও আমার এই স্বভাব ছিল। এ জন্য স্যারদের সঙ্গে আমার কখনো সখ্য গড়ে ওঠেনি। আমি সব সময় তাদের এড়িয়ে চলতাম। আমি বেশির ভাগ স্যারেরই নাম ভুলে গেছি। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে আমার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান কে ছিল বা লিটারেচার কে পড়াত, আমি বলতে পারি না। আলোচনা অনুষ্ঠান, টক শো এমনকি সিনেমা দেখতে দেখতেও আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাই, কিছু শুনতে পাই না। তখন অন্য কোনো জগতে থাকি আমি..।
এখনো যখন কারও সঙ্গে কথা বলি বা চায়ের টেবিলে বসি ওয়ান টু ওয়ানÑএটা খুব বাজে স্বভাব আমার, একটা-দুটা কথা বলার পরই আমি খেই হারিয়ে ফেলি। তখন অপরজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেই বলুক আমি শুধু শুনব। গ্রুপে হলে আরও ভালো, বেশি কথা বলতে হয় না। সেটা স্বস্তিদায়ক। সবার সামনে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া কেমন না! কিন্তু মানুষের স্বভাব সহজে বদলায় না। আমিও নিজেকে বদলাতে পারি না। পারলে ভালো হতো...।
কাউকে আঘাত দেওয়া খুবই সহজ কাজ। কিন্তু কাউকে ভালোবেসে বুকে টেনে নেওয়া কঠিন। অথচ ভালোবাসাই চিরন্তন, ভালোবাসাই টিকে থাকে, ভালোবাসার রয়েছে রূপমাধুর্য। ঘৃণা আপনাকে কিছুই দেবে না। ঘৃণা ছড়ানো বা বিদ্বেষ প্রকাশ আপনাকে সাময়িক জয়ী করবে বটে কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে আপনি হেরে গেছেন। আপনি যখন নিজের মুখোমুখি হবেন, নিজেকে আয়নায় দেখবেন, তখন বুঝতে পারবেন আপনি অন্যকে ইচ্ছা করে কষ্ট দিয়েছিলেন, অবহেলা করেছিলেন কিংবা বিদ্বেষ পোষণ করেছিলেন। মানুষ অনেক সময় নিজের অবচেতনে জেলাস হয়, কোনো কারণ ছাড়াই আমরা অন্যকে অপছন্দ করি। এই রহস্যের কিনারা করা কঠিন। আমার নিজের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়। সবারই নিজেকে চেনার দরকার আছে। আমি নিজেও অনেক সময় অন্যের বিদ্বেষের কারণ হই। কেউ কেউ বুঝে হোক না বুঝে হোক বিদ্বেষ বা ক্ষোভ প্রকাশ করে। আমি নিজে কাউকে আঘাত করে কিছু বলি না। দ্বিমত পোষণ করলে তা বিনয়ের সঙ্গে উল্লেখ করি বা নীরবতা পালন করি। এমনকি সংসারজীবনেও আমি অনেক ক্ষেত্রে নীরবতার আশ্রয় নিই। আপস করি। সবকিছুরই একটা নিয়ম আছে। নিয়মের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারি না। আমরা প্রায়ই আমাদের মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এই লেখার অর্থ এই নয় যে আমি কাউকে মাত্রাজ্ঞান শেখাচ্ছি। আমার নিজেরও অনেক ভুল আছে। আমি আমার ভুলগুলোকে শুধরে নিতে চাই। আমরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নই..।
যখনই বরিশালের পথ দিয়ে হাঁটি, তখন অন্য রকম একটা অনুভূতি কাজ করে। একটা আনন্দের শিহরণ কুলকুল করে বয়ে যায় সব সময়। এই রকম একটি স্বপ্নের জায়গা ছেড়ে আমি কীভাবে দূরে চলে গেলাম! এখানকার মাটি আমার সঙ্গে কথা বলত। প্রতিটি গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ ছিল আমার অনেক আপন। আমি ভাব করতাম মেঘেদের সঙ্গে, আকাশের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে আমার অনেক সখ্য ছিল। তখন কত অভাব ছিল, না পাওয়া ছিল আর ছিল অবহেলা। কিন্তু তার পরও আমি সব সময় আনন্দিত থাকতে চেয়েছি।
টরন্টো, কানাডা