গত ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস রিপাবলিকান প্রার্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে হেরে গেছেন। নির্বাচনে জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ২৭০ ইলেকটোরাল ভোট পেতে ব্যর্থতার কারণে তার পরাজয় হয়। ট্রাম্পের ৩১২ ভোটের বিপরীতে কমলা হ্যারিস পান ২২৬ ভোট। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য ক্রিটিক্যাল সাতটি ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটের কোনোটিতেই কমলা হ্যারিস জয় পাননি। পপুলার ভোটেও তার পরাজয় হয়। পপুলার ভোটে ট্রাম্প পান ৫১ ভাগ ভোট আর কমলা হ্যারিস পান ৪৭ ভাগ।
মোটা দাগে যেসব কারণে কমলা হ্যারিসের পরাজয় হয়, তার কয়েকটি কারণ নিম্নরূপ :
ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে এ বছরের জুলাই মাসের শেষ দিকে মার্কিন রাজনীতির ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব ক্যুর মাধ্যমে সিটিং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে সরিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট পদে দলের টিকিট দেওয়া হয়। বাইডেন প্রাইমারি নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করেছিলেন। কিন্তু বাইডেনের শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা, যা ১০ সেপ্টেম্বরের প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠায় দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মধ্যে এই ধারণার জন্ম হয় যে, তার পক্ষে ট্রাম্পকে পরাজিত করা অসম্ভব হবে। এই পরিস্থিতিতে দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার (ওবামা, ক্লিনটন, ন্যান্সি পেলোসি প্রমুখ) হস্তক্ষেপে বাইডেনকে সরিয়ে কমলা হ্যারিসকে দলের মনোনয়নদানের সিদ্ধান্ত হয়। কমলার মনোনয়নপ্রাপ্তিতে ঝিমিয়ে পড়া ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। কমলার নির্বাচনী তহবিলও ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করে। জুলাই মাসের শেষ থেকে নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে ট্রাম্পের প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বিপরীতে কমলার তহবিলে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার জমা হয়। বিভিন্ন জনমত জরিপেও তার অবস্থা ভালো হতে দেখা যায়, যা দেখে অনেকে নির্বাচনে তার বিজয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে মনে করতে থাকেন। জনমত জরিপের ফলাফল যে সব সময় সঠিক হয় না, সে সম্পর্কে সবাই অবহিত আছেন। ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী ম্যাসাচুসেটসের গভর্নর মাইক ডুকাকিস রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ এইচ ডাব্লুউ বুশের (সিনিয়র বুশ) চেয়ে ১৭ পয়েন্টের ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও নির্বাচনে জয় হয় বুশের। এবারের নির্বাচনে একটি জরিপে আইওয়াতে কমলা ট্রাম্পের চেয়ে ৪ পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও সে রাজ্যে ট্রাম্পের জয় হয়।
ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও কমলা হ্যারিস তেমনভাবে লাইমলাইটে ছিলেন না। দীর্ঘ সময় ধরে কোনো আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন না করা এবং প্রেসকে এড়িয়ে চলার কারণে তার মিডিয়া উপস্থিতি ছিল খুবই কম। এ জন্য তাকে ঘিরে জনগণের মধ্যে একধরনের নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়, যা তার মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাসহীনতা ও নার্ভাসনেসের জন্ম দেয়।
ইমিগ্রেশন তথা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে বিপুলসংখ্যক বিদেশি নাগরিকের যুক্তরাষ্ট্রে অবাধে অনুপ্রবেশের ঘটনা এবং এর ফলে চলমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মার্কিন নাগরিকদের কাছে একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে গণ্য হয়। তথ্যমতে, বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের আমলে কমবেশি ১৪ মিলিয়ন বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে। অতীতে ইমিগ্রেশনকে মার্কিনিরা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করলেও সাম্প্রতিক এক জরিপে ৫৫ ভাগ মার্কিন নাগরিক নতুনদের আগমন কমানোর পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন।
অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। উপরন্তু অনুপ্রবেশ বন্ধে পূর্ববর্তী ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া কিছু পদক্ষেপ (দেয়াল নির্মাণ ইত্যাদি) বাতিল করে দেওয়া হয়, যা অবৈধ অনুপ্রবেশকে উৎসাহিত করে বলে মনে করা হয়। অনুপ্রবেশকারীদের অনেকের বিরুদ্ধে হামলা, মাদক ব্যবসা, খুন-রাহাজানি ও যৌন অপরাধের রেকর্ড থাকায় এই ইস্যুর আশু ফয়সালা জরুরি বলে অনেক ভোটার মনে করেন।
বাইডেন কর্তৃক কমলা হ্যারিসকে সীমান্ত সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব (Border Car) দেওয়া হলেও তিনি এ ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সাফল্য দেখাতে ব্যর্থ হন। কমলা হ্যারিস অবশ্য এই ব্যর্থতার জন্য রিপাবলিকানদের অসহযোগিতাকে দায়ী করেন। সীমান্তের পরিস্থিতি সরেজমিন দেখার জন্য তিনি মাত্র একবার সেখানে যান। সেখানে গিয়ে ২০ মিনিট অবস্থান করে ফটোশুট শেষে তিনি ফিরে আসেন। এ বিষয়ে এনবিসির লেস্টার হল্ট তাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ইতিপূর্বে তিনি কখনো ইউরোপে যাননি। সে কারণে ইউক্রেন ও ইউরোপ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই, সেটা সঠিক নয়। তিনি জানেন, ইউক্রেন একটি ছোট দেশ এবং রাশিয়া আকারে বড় ও শক্তিধর একটি দেশ। তার এহেন শিশুসুলভ উত্তর শুনে অনেকেই অবাক হন। তার উত্তর বাংলাদেশে বহুলপ্রচলিত একটি উক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। যেটা হলো, ‘কিসের মধ্যে কী, পান্তাভাতে ঘি’।
দৃশ্যত ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ বন্ধে কমলা হ্যারিসের ভূমিকা ছিল নিতান্তই নগণ্য। তার প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তির লক্ষ্যে কাজ করছে বলে দাবি করলেও, বহু মার্কিনির কাছে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, শান্তি নয় বরং যুদ্ধ প্রসারেই (Facilitate) কেবল তার প্রশাসন সফল হয়েছে। যুদ্ধ এখন গাজা ছাড়িয়ে লেবানন ও ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিস্তারের শঙ্কা তৈরি করেছে। এর বিপরীতে ট্রাম্প আমলে বিশ্বে তেমন কোনো যুদ্ধবিগ্রহের ঘটনা ঘটেনি, যে কারণে ট্রাম্প নির্বাচিত হলে এসব যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে বহু ভোটারের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণার জন্ম হয়।
বিভিন্ন সময়ে পলিসি-সংক্রান্ত বিষয়ে কমলা হ্যারিসের অবস্থান পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। নির্বাচনের পূর্বে বেশ কয়েকটি টিভি প্রোগ্রামে অংশ নেন, যার মধ্যে সিবিএসের সিক্সটি মিনিটস, এবিসি নিউজের The View, হাওয়ার্ড স্টার্ন ও স্টিফেন কোলবেয়ার অন্যতম। The View অনুষ্ঠানে তাকে প্রশ্ন করা হয়, It anything, would you have done something differently than President Biden. প্রশ্ন শুনে কিছুটা বিচলিত হয়ে তিনি উত্তর দেন, There is not a thing comes to mind not a thing. তার উত্তর শুনে অনেক ভোটারের মনে হয়েছে, তিনি যদি বাইডেনের নীতিই হুবহু অনুসরণ করেন, তাহলে তিনি কেন, প্রার্থী হিসেবে বাইডেন থাকলে কী অসুবিধা হতো। পরে অবশ্য Fox News-কে তিনি জানান, তার প্রশাসন বাইডেন প্রশাসনের Continuation হবে না। বিগত বছরগুলোতে ভূগর্ভস্থ তেল, গ্যাস, কয়লার (Fracking) বিরোধী নন। সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের ক্ষেত্রেও তিনি অবস্থান পরিবর্তন করেন।
তিনি পূর্বে স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন, Let me be clear, I am not going to vote for a wall under any circumstances. অথচ নির্বাচনে কয়েক দিন পূর্বে তিনি সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের বিরুদ্ধে নন বলে জানান। গুরুত্বপূর্ণ পলিসি ইস্যুতে যে প্রার্থীর মধ্যে এত সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব বিদ্যমান, সেই প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনে জয়ী হওয়া দুরূহ হবে, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে।
কমলা হ্যারিসের প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্প যখন অর্থনীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, বর্ডার, এনার্জি ও সেফটির (নিরাপদ নেইবারহুড) মতো ইস্যু নিয়ে কথা বলছেন, তখন কমলা হ্যারিস অ্যাবরশন, জেন্ডার ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেছেন। অ্যাবরশন ইস্যুটি তরুণ নারীদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হলেও পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী নারীদের কাছে এর তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না। নারীর Reproductive rights, কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি ও সবার জন্য সুলভ স্বাস্থ্যসেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও গত চার বছরে এসব ক্ষেত্রে কেন যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তার যথাযথ উত্তর তিনি দিতে ব্যর্থ হন। স্পষ্টত কমলা হ্যারিস মার্কিন রাজনীতির সেই বহুল প্রচলিত উক্তি ‘It’s Economy Stupid কথাটি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন।
ট্রাম্প তার প্রতিটি নির্বাচনী সমাবেশে সমবেত জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন রাখেন, Are you better off now than four years before. জনতা সমস্বরে উত্তর দেয় ঘড়ঃ. গত চার বছরে গ্রোসারিসহ জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মার্কিনিদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়ে তারা সেটা ভুলে যায়নি। তা ছাড়া ২৭ অক্টোবর ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের সমাবেশে ট্রাম্প সমর্থক জনৈক বক্তার বক্তব্যে মার্কিন টেরিটরি পুর্তোরিকোকে একটি আবর্জনার দ্বীপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে বাইডেন তাবৎ ট্রাম্প সমর্থকদের আবর্জনা বলে আখ্যা দেন, যে কারণে বিক্ষুব্ধ ট্রাম্প সমর্থকেরা বিপুল সংখ্যায় ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে উৎসাহী হন। তা ছাড়া ট্রাম্প কৃষ্ণাঙ্গ ও ল্যাটিনো সম্প্রদায়ের পূর্বের প্রায় ১০ ভাগের তুলনায় এবার ২৫ ভাগের বেশি ভোট পান। এই দুই সম্প্রদায়ের অনেকে প্রতিশ্রুতি পালনের ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে রিপাবলিকানদের ওপর অধিক আস্থা পোষণ করেন।
ইতিহাস সৃষ্টি হবে-এই প্রত্যাশা নিয়ে বহু মানুষ ওয়াশিংটন ডিসিতে কমলা হ্যারিসের স্কুল হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটিতে জড়ো হন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের, History’র বদলে তাদের হতাশা (Despair) নিয়ে ঘরে ফিরতে হয়। ভবিষ্যতে কোনো যোগ্য Commonsense মধ্যপন্থী (centrist) নারী মনোনয়ন পেলে তার পক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া অসম্ভব নয় বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।
মোটা দাগে যেসব কারণে কমলা হ্যারিসের পরাজয় হয়, তার কয়েকটি কারণ নিম্নরূপ :
ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে এ বছরের জুলাই মাসের শেষ দিকে মার্কিন রাজনীতির ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব ক্যুর মাধ্যমে সিটিং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে সরিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট পদে দলের টিকিট দেওয়া হয়। বাইডেন প্রাইমারি নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করেছিলেন। কিন্তু বাইডেনের শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা, যা ১০ সেপ্টেম্বরের প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠায় দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মধ্যে এই ধারণার জন্ম হয় যে, তার পক্ষে ট্রাম্পকে পরাজিত করা অসম্ভব হবে। এই পরিস্থিতিতে দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার (ওবামা, ক্লিনটন, ন্যান্সি পেলোসি প্রমুখ) হস্তক্ষেপে বাইডেনকে সরিয়ে কমলা হ্যারিসকে দলের মনোনয়নদানের সিদ্ধান্ত হয়। কমলার মনোনয়নপ্রাপ্তিতে ঝিমিয়ে পড়া ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। কমলার নির্বাচনী তহবিলও ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করে। জুলাই মাসের শেষ থেকে নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে ট্রাম্পের প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বিপরীতে কমলার তহবিলে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার জমা হয়। বিভিন্ন জনমত জরিপেও তার অবস্থা ভালো হতে দেখা যায়, যা দেখে অনেকে নির্বাচনে তার বিজয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে মনে করতে থাকেন। জনমত জরিপের ফলাফল যে সব সময় সঠিক হয় না, সে সম্পর্কে সবাই অবহিত আছেন। ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী ম্যাসাচুসেটসের গভর্নর মাইক ডুকাকিস রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ এইচ ডাব্লুউ বুশের (সিনিয়র বুশ) চেয়ে ১৭ পয়েন্টের ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও নির্বাচনে জয় হয় বুশের। এবারের নির্বাচনে একটি জরিপে আইওয়াতে কমলা ট্রাম্পের চেয়ে ৪ পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও সে রাজ্যে ট্রাম্পের জয় হয়।
ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও কমলা হ্যারিস তেমনভাবে লাইমলাইটে ছিলেন না। দীর্ঘ সময় ধরে কোনো আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন না করা এবং প্রেসকে এড়িয়ে চলার কারণে তার মিডিয়া উপস্থিতি ছিল খুবই কম। এ জন্য তাকে ঘিরে জনগণের মধ্যে একধরনের নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়, যা তার মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাসহীনতা ও নার্ভাসনেসের জন্ম দেয়।
ইমিগ্রেশন তথা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে বিপুলসংখ্যক বিদেশি নাগরিকের যুক্তরাষ্ট্রে অবাধে অনুপ্রবেশের ঘটনা এবং এর ফলে চলমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মার্কিন নাগরিকদের কাছে একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে গণ্য হয়। তথ্যমতে, বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের আমলে কমবেশি ১৪ মিলিয়ন বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে। অতীতে ইমিগ্রেশনকে মার্কিনিরা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করলেও সাম্প্রতিক এক জরিপে ৫৫ ভাগ মার্কিন নাগরিক নতুনদের আগমন কমানোর পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন।
অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। উপরন্তু অনুপ্রবেশ বন্ধে পূর্ববর্তী ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া কিছু পদক্ষেপ (দেয়াল নির্মাণ ইত্যাদি) বাতিল করে দেওয়া হয়, যা অবৈধ অনুপ্রবেশকে উৎসাহিত করে বলে মনে করা হয়। অনুপ্রবেশকারীদের অনেকের বিরুদ্ধে হামলা, মাদক ব্যবসা, খুন-রাহাজানি ও যৌন অপরাধের রেকর্ড থাকায় এই ইস্যুর আশু ফয়সালা জরুরি বলে অনেক ভোটার মনে করেন।
বাইডেন কর্তৃক কমলা হ্যারিসকে সীমান্ত সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব (Border Car) দেওয়া হলেও তিনি এ ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সাফল্য দেখাতে ব্যর্থ হন। কমলা হ্যারিস অবশ্য এই ব্যর্থতার জন্য রিপাবলিকানদের অসহযোগিতাকে দায়ী করেন। সীমান্তের পরিস্থিতি সরেজমিন দেখার জন্য তিনি মাত্র একবার সেখানে যান। সেখানে গিয়ে ২০ মিনিট অবস্থান করে ফটোশুট শেষে তিনি ফিরে আসেন। এ বিষয়ে এনবিসির লেস্টার হল্ট তাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ইতিপূর্বে তিনি কখনো ইউরোপে যাননি। সে কারণে ইউক্রেন ও ইউরোপ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই, সেটা সঠিক নয়। তিনি জানেন, ইউক্রেন একটি ছোট দেশ এবং রাশিয়া আকারে বড় ও শক্তিধর একটি দেশ। তার এহেন শিশুসুলভ উত্তর শুনে অনেকেই অবাক হন। তার উত্তর বাংলাদেশে বহুলপ্রচলিত একটি উক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। যেটা হলো, ‘কিসের মধ্যে কী, পান্তাভাতে ঘি’।
দৃশ্যত ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ বন্ধে কমলা হ্যারিসের ভূমিকা ছিল নিতান্তই নগণ্য। তার প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তির লক্ষ্যে কাজ করছে বলে দাবি করলেও, বহু মার্কিনির কাছে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, শান্তি নয় বরং যুদ্ধ প্রসারেই (Facilitate) কেবল তার প্রশাসন সফল হয়েছে। যুদ্ধ এখন গাজা ছাড়িয়ে লেবানন ও ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিস্তারের শঙ্কা তৈরি করেছে। এর বিপরীতে ট্রাম্প আমলে বিশ্বে তেমন কোনো যুদ্ধবিগ্রহের ঘটনা ঘটেনি, যে কারণে ট্রাম্প নির্বাচিত হলে এসব যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে বহু ভোটারের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণার জন্ম হয়।
বিভিন্ন সময়ে পলিসি-সংক্রান্ত বিষয়ে কমলা হ্যারিসের অবস্থান পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। নির্বাচনের পূর্বে বেশ কয়েকটি টিভি প্রোগ্রামে অংশ নেন, যার মধ্যে সিবিএসের সিক্সটি মিনিটস, এবিসি নিউজের The View, হাওয়ার্ড স্টার্ন ও স্টিফেন কোলবেয়ার অন্যতম। The View অনুষ্ঠানে তাকে প্রশ্ন করা হয়, It anything, would you have done something differently than President Biden. প্রশ্ন শুনে কিছুটা বিচলিত হয়ে তিনি উত্তর দেন, There is not a thing comes to mind not a thing. তার উত্তর শুনে অনেক ভোটারের মনে হয়েছে, তিনি যদি বাইডেনের নীতিই হুবহু অনুসরণ করেন, তাহলে তিনি কেন, প্রার্থী হিসেবে বাইডেন থাকলে কী অসুবিধা হতো। পরে অবশ্য Fox News-কে তিনি জানান, তার প্রশাসন বাইডেন প্রশাসনের Continuation হবে না। বিগত বছরগুলোতে ভূগর্ভস্থ তেল, গ্যাস, কয়লার (Fracking) বিরোধী নন। সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের ক্ষেত্রেও তিনি অবস্থান পরিবর্তন করেন।
তিনি পূর্বে স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন, Let me be clear, I am not going to vote for a wall under any circumstances. অথচ নির্বাচনে কয়েক দিন পূর্বে তিনি সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের বিরুদ্ধে নন বলে জানান। গুরুত্বপূর্ণ পলিসি ইস্যুতে যে প্রার্থীর মধ্যে এত সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব বিদ্যমান, সেই প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনে জয়ী হওয়া দুরূহ হবে, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে।
কমলা হ্যারিসের প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্প যখন অর্থনীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, বর্ডার, এনার্জি ও সেফটির (নিরাপদ নেইবারহুড) মতো ইস্যু নিয়ে কথা বলছেন, তখন কমলা হ্যারিস অ্যাবরশন, জেন্ডার ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেছেন। অ্যাবরশন ইস্যুটি তরুণ নারীদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হলেও পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী নারীদের কাছে এর তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না। নারীর Reproductive rights, কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি ও সবার জন্য সুলভ স্বাস্থ্যসেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও গত চার বছরে এসব ক্ষেত্রে কেন যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তার যথাযথ উত্তর তিনি দিতে ব্যর্থ হন। স্পষ্টত কমলা হ্যারিস মার্কিন রাজনীতির সেই বহুল প্রচলিত উক্তি ‘It’s Economy Stupid কথাটি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন।
ট্রাম্প তার প্রতিটি নির্বাচনী সমাবেশে সমবেত জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন রাখেন, Are you better off now than four years before. জনতা সমস্বরে উত্তর দেয় ঘড়ঃ. গত চার বছরে গ্রোসারিসহ জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মার্কিনিদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়ে তারা সেটা ভুলে যায়নি। তা ছাড়া ২৭ অক্টোবর ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের সমাবেশে ট্রাম্প সমর্থক জনৈক বক্তার বক্তব্যে মার্কিন টেরিটরি পুর্তোরিকোকে একটি আবর্জনার দ্বীপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে বাইডেন তাবৎ ট্রাম্প সমর্থকদের আবর্জনা বলে আখ্যা দেন, যে কারণে বিক্ষুব্ধ ট্রাম্প সমর্থকেরা বিপুল সংখ্যায় ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে উৎসাহী হন। তা ছাড়া ট্রাম্প কৃষ্ণাঙ্গ ও ল্যাটিনো সম্প্রদায়ের পূর্বের প্রায় ১০ ভাগের তুলনায় এবার ২৫ ভাগের বেশি ভোট পান। এই দুই সম্প্রদায়ের অনেকে প্রতিশ্রুতি পালনের ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে রিপাবলিকানদের ওপর অধিক আস্থা পোষণ করেন।
ইতিহাস সৃষ্টি হবে-এই প্রত্যাশা নিয়ে বহু মানুষ ওয়াশিংটন ডিসিতে কমলা হ্যারিসের স্কুল হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটিতে জড়ো হন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের, History’র বদলে তাদের হতাশা (Despair) নিয়ে ঘরে ফিরতে হয়। ভবিষ্যতে কোনো যোগ্য Commonsense মধ্যপন্থী (centrist) নারী মনোনয়ন পেলে তার পক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া অসম্ভব নয় বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।