শিরোনামে ব্যবহৃত বাক্যটির শেষ শব্দ দুটি ছিল ‘উচ্চারিত হলো’। অর্থাৎ স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে এসে ওই নামটির প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কথা জানিয়ে দেওয়া হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে। সেই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হলো, বিগত হাসিনার শাসনামলে যে নীতিমালার অধীনে পাঠ্যপুস্তক ছাপানো হতো, তার ভেতরে বিশেষভাবে পাঁচটি বড় ধরনের পরিবর্তন সাধনের মধ্য দিয়ে তাতে নতুন মাত্রা যোগ করে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। যার অন্যতম পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস দেশের আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। আর এই ইতিহাসের অন্যতম এক অধ্যায়ের সঙ্গে যে দুই ব্যক্তি বিশেষ করে জড়িত ছিলেন, তাদের একজন ছিলেন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং অন্যজন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের সশস্ত্র বাহিনীর সেনাপ্রধান জনাব আতাউল গণি ওসমানী, যাকে ডাকা হতো পাপা টাইগার নামে। ইতিহাস সাক্ষী, এই দুই মহান ব্যক্তিত্ব ছাড়া ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের সফল সমাপ্তির কথা কেউ চিন্তাও করতে পারবে না কোনো দিন। অথচ সেটাই হয়েছিল স্বাধীনতা-পরবর্তী সদ্য জন্ম নেওয়া সার্বভৌম একটা দেশে। জাতি যাকে জনকের আসনে বসিয়েছিল, দুঃখজনক হলেও সত্য, নয় মাসের যুদ্ধকালীন তার শারীরিক অনুপস্থিতির কারণে তিনি একেবারেই সেই রক্তাক্ত যুদ্ধের বিষয়ে ছিলেন চরমতম এক অন্ধকারে। যুদ্ধের পুরো নয় মাস তিনি কারাভোগ অবস্থায় কাটিয়েছেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বন্দিশালায়।
বাহাত্তর সালের জানুয়ারি মাসে মুক্ত জীবন ফিরে পেয়ে দেশে আসার পর বঙ্গবন্ধুর উচিত ছিল সেই নয়টা মাস কীভাবে যুদ্ধে জড়িয়েছিল পুরো জাতি, তার অনুসন্ধান করা। কিন্তু তিনি তখন একশ্রেণির তোষামোদকারীর ক্রীড়নকে পরিণত হলেন। যার প্রধান রূপকার ছিলেন আপন ভাগনে শেখ মণি এবং তার অন্য সহযোগীরা। শেখ সাহেবের একটা বিশেষ গুণ ছিল, তিনি কানকথা শুনতেন খুব। পাশে তখন খন্দকার মোশতাকের মতো নরকের কীটও ছিল। অতএব, শেখ সাহেব তার পরামর্শদাতাদের কথামতো তাজউদ্দীন আহমদের ওপরই প্রথমে প্রতিশোধটা নিয়েছিলেন। ১০ জানুয়ারি ঢাকায় ফেরত আসার পর ১১ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাক্ষরিত ‘বাংলাদেশ এর অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ৭২’ জারি করে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করলেন এবং তাজউদ্দীনকে অর্থমন্ত্রীর পদে নিয়োগ দেওয়া হলো। এই ঘটনাটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের জন্য একটা প্রাথমিক বিজয়। কারণ এর কিছুদিনের মধ্যে তাজউদ্দীনের মন্ত্রিত্ব কেড়ে নিয়ে খন্দকার মোশতাককে অর্থমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিলেন বঙ্গবন্ধু। ঘরে-বাইরে তখন শুধু তাজউদ্দীন আহমদের শত্রুসংখ্যা হু হু করে বাড়ছিল। যার কারণে ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর শেখ সাহেবের নির্দেশে তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। একসময় একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালেই চলে গেলেন তাজউদ্দীন। কিন্তু ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বিশ্বাসঘাতক মোশতাকের মন্ত্রিসভায় তাজউদ্দীন ছাড়াও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এইচ কামরুজ্জামান কখনোই যোগ দেবেন না, বিষয়টা ভালোভাবেই জানত বলেই ঘাতক মোশতাকের নির্দেশেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৩ নভেম্বর রাতে এই জাতীয় চার নেতাকে খুন করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন পরে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের যাত্রার শুরু থেকে মাঝখানে ২০০১ থেকে ২০০৯ সালÑএই সময়টা বাদ দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ২০০৯ থেকে ২০২৪ এই সুদীর্ঘ সময়জুড়ে শেখ হাসিনা তার রাজত্বের কোনো একটা পর্যায়েও মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদের অবদান নিয়ে কিংবা বাকি তিন জাতীয় নেতার বিষয়ে কোনো দিন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে টুঁ শব্দও করেননি। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীও ছিলেন উপেক্ষিত এক সমরনায়ক। অবশ্য শেখ মুজিবুর রহমানের পুরো শাসনামলে এই দুই স্মরণীয় ব্যক্তিত্বকে যতটা পারা যায় ততটাই অপমানে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য একটাই ছিলÑশেখ মুজিবুর রহমানকে আজীবন অমরত্বের আসনে বসিয়ে জাতির জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে যাওয়া। কাজটা তার কন্যার শাসনামলের সুদীর্ঘ সময়জুড়ে কৌশলে এবং অপকৌশলে দুই অবস্থাতেই করা হয়েছে। বাকি যারা ছিলেন, তাদেরকে উপেক্ষা করে যাওয়া হয়েছে সমানে। তাজউদ্দীন আহমদ এবং ওসমানী সেই রকম দুই ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যাদের নিয়ে সাম্প্রতিক ইতিহাস আগাগোড়াই নীরবতা পালন করে গেছে।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য যেসব পাঠ্যপুস্তক ছাপাখানায় ছাপার জন্য দেওয়া হয়েছে, সেসব পুস্তকে মোট পাঁচটি পরিবর্তন আনা হবে। তার মধ্যে অন্যতম হলো পাঠ্যপুস্তকে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার প্রতিফলন হিসেবে আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ অন্য শহীদদের কথা তুলে ধরা হবে। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধ মানেই শেখ মুজিব-এই ধারণাকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বাকি সব জাতীয় নেতাকে অন্ধকারে রেখেছিল, যেমন মওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ, জিয়াউর রহমান, জেনারেল ওসামানীসহ অন্যদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা থাকবে এবং কোনো কোনো ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকে যেখানে এত দিন পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণীসহ ছবি ছাপা হতো, সেটা তুলে দেওয়া হবে। খুব ভালো খবরের একটা অংশ এসব বিষয়। বিগত ১৬ বছর এক দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে সময় গেছে মানুষের। দেশটা তার পৈতৃক সম্পত্তি ছিল, তিনি নিজেও খুব বড় গলায় বলতেন, ‘আমি মুজিবের বেটি।’ কথাটা কেবল আক্ষরিক অর্থেই নয়, অনেকটা ছিল প্রকৃতিগতভাবেই সত্য। তিনি তার পিতার সুযোগ্য সন্তানই ছিলেন, তাই শেখ হাসিনার বিগত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ছিল সত্যিকার অর্থে তার জনকের শাসনামলের ধারাবাহিকতারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অনেকের মতে, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভেতরে শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তার ও চেতনার প্রতিফলন ঘটেছিল পুরো মাত্রায়। তাই ওই দুই শাসনামলের পুরোটা সময়ে ছিল একচ্ছত্র ক্ষমতার মসনদে আরোহণের চেষ্টা এবং সে কারণে দুই আমলে নির্বাচন-ব্যবস্থাটায় ছিল ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের প্রয়াস। যেমন স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল তৎকালীন আওয়ামী দুঃশাসনই শুধু নয়, ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণায়ও একই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিল তারা। শেখ হাসিনার শাসনামলে একইভাবে সকল নির্বাচনকে তারা দলীয় নির্বাচনে পরিণত করে একদলীয় বিধিব্যবস্থার আওতায় নিয়ে এসেছিল, যেমন করে স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে তিন বছরের ভেতরে বাকশাল গঠন করে একদলীয় শাসন কায়েম করেছিল শেখ সাহেবের আওয়ামী লীগ। ’৭২-পরবর্তী রক্ষীবাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে জাতিকে এক কঠিন দুঃশাসনের জাঁতাকলে শুধু পিষ্ট করেনি, সেনাবাহিনীর প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ভেতর দিয়েও পুরো জাতিকে এক অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকেও ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। ওই সময়ের প্রধান সংকট হিসেবে তখন ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের আগমন, লাগামহীন দুর্নীতি এবং ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা এতটাই বেড়েছিল যে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম ঘটে। কন্ট্রোলের বাইরে চলে যায় সবকিছু। এবার সারা জাতি নতুনভাবে দেখল বাকশাল প্রতিষ্ঠা না করলেও শেখ হাসিনা তার শাসনামলের পুরোটা সময়ে পিতার দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরেই হাঁটলেন।
পিতার প্রতিষ্ঠিত ‘ছাত্রলীগ’কে তিনি রক্ষীবাহিনীর আদলে এক দানবশক্তি রূপে তৈরি করে দেশটাতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেন। দুর্নীতির সীমা পাতাল ছেড়ে আকাশের উচ্চতায় পৌঁছাল এতটাই যে তিনিও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করলেন, তার ঘরে গৃহকর্মী হিসেবে যে মানুষটা কাজ করত, সেও নাকি এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেসে হেসে বললেন, সে নাকি এখন হেলিকপ্টারে করে দেশের ভেতরে যাতায়াত করে। কতটা নির্লজ্জ হলে মানুষ এতটা বেহায়ার মতো নিজের ঢোল নিজে বাজায়? টেলিভিশনের সামনে বসে মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করতেও ভুলে গেল যেন। তিনি আবার বড় গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করতেন, দুর্নীতির প্রশ্নে তার সরকার জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলে। অথচ কী ভয়াবহ চিত্র দেখেছে মানুষ। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সচিত্র প্রতিবেদনে বিষয়টা যখন সামনে এল, মানুষ হতবাক হয়ে দেখল হেডিংটা ‘বেনজীরের ঘরে আলাদিনের চেরাগ’। না, এই তালিকায় এক বেনজীর ছিলেন না-একে একে বেরিয়ে এল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আরও অনেক বেনজীরের নজিরবিহীন অনৈতিক কাণ্ড-কারখানার খবর। দরবেশ নামক যে ব্যক্তিটি ছিলেন একসময় শেখ হাসিনার ডানহাত, তিনি এখন কারাগারে। কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে অন্য আরও কয়েক দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালীর সঙ্গে তারও এক নতুন অধ্যায়ের জীবন শুরু হয়েছে। শেষ পর্যন্ত রিমান্ডে গিয়ে স্বীকার করলেন অনেক কিছুই, তার ভেতরে একটা কথা ছিল সালমান এফ রহমান নামক দরবেশের, তিনি বলেছেন, এস আলমের মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হওয়া দেড় লাখ কোটি টাকার অর্ধেকই শেখ রেহানা ও সজীব ওয়াজেদ জয়কে দেওয়া হয়েছে। তার বক্তব্যমতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার এসব লেনদেনের বিষয়ে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী মানুষদের হয়তো কথাটা মনে আছে। শেখ সাহেবের শাসনামলের শেষ দিকে যখন চূড়ান্ত মাত্রায় ব্যাংক ডাকাতির হার বেড়ে গিয়েছিল, তখন পুলিশ নির্বিকার ভূমিকা পালন করত। তার পরও বড় কোনো ঘটনার পরে কদাচিৎ আটকের মতো কোনো কিছুর দরকার পড়লে যখন পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে বিষয়টা জানানো হতো তৎকালীন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কাছে, সেখান থেকে ফোর্স করা হতো সরাসরি লাল টেলিফোন সেটে। সেখান থেকে উত্তর আসত, দাঁড়াও, দেখি কামাল বাড়িতে আছে কি না। সেটা ছিল স্নেহে অন্ধ এক পিতার প্রতিকৃতি, যার দুই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। একটা ছিল স্বাধীনতা-পূর্ব জাতীয় নেতার ভূমিকায়, আর অন্যটা ছিল স্বাধীনতা-উত্তর দলীয় চরিত্রের এক ব্যক্তি। যিনি শাসক হিসেবে চূড়ান্ত মাত্রায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। সেই ধরনের এক নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মানুষও বিশ্বাস করত, দোষে-গুণে মিলিয়েই মানুষ। তার পরও তাকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে মানুষ শ্রদ্ধা করতে চেয়েছে, ভালোবাসতে চেয়েছে; কিন্তু তার নিজের কন্যার হাতেই তার পরাজয়ের ইতিহাসের সূচনা ঘটল। তিনি তার পিতাকে মানুষ হওয়ার ঊর্ধ্বে তুলে ধরে অতিমানবের আসনে বসাতে গিয়ে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যে বাড়াবাড়ির নজির সৃষ্টি করলেন, বলা হয়ে থাকে, আপন কন্যার বাড়াবাড়ির জন্যই মানুষ বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃত মূল্যায়ন করতে অপারগতা দেখাল। সেটা শুধু সাধারণ মানুষের দোষ ছিল না, শেখ হাসিনার জবরদস্তিমূলক কাজেরও দায় ছিল অনেকটা। তার মুজিব-বন্দনার নামে অতিমাত্রার বাড়াবাড়ি দেশের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে চিহ্নিত হলেও সর্বোচ্চ প্রশাসন সে বিষয়টা আমলে নেয়নি কখনো। তাই দেখা যায়, দেশজুড়ে সহস্রাধিক ভাস্কর্য ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তৈরি করা হয়েছে মুজিব কর্নার। এ ছাড়া দেশ এবং দেশের বাইরে থেকে বইমেলা উপলক্ষে যারাই বঙ্গবন্ধুর শ্রুতিবাক্য দিয়ে ছড়ার বই, কবিতার বই কিংবা শিশুতোষ গল্পের বই ছাপিয়েছেন, তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বাংলা একাডেমি পদক ছাড়াও একুশে পদকের মতো সম্মানজনক স্বীকৃতির উপহার। বিষয়টা অনেকটাই ‘বানরের’ গলায় মুক্তার অলংকারের মতো। ফলে গত কয়েক বছরে এসব পুরস্কারেরও মূল্যমান শূন্যের কোঠায় নেমে এসছে। এ ছাড়া আরও একটা বিষয় হলো, কাগজি নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপানোর কাহিনি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের কাগজি নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপা হয়েছিল, যদিও ’৭৫-এর পর সেই ছবি ছাপানোর কাজ বন্ধ হয়ে যায় সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। ১৯৯৬ সালে হাসিনা প্রথমবারের মতো ১০ টাকা এবং ৫০০ টাকার নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপেন।
বাংলাদেশের মুদ্রা ছাপানোর কাজ করে থাকে ‘দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন লিমিটেড’, যাকে সহজ ভাষায় বলা হয়ে থাকে ‘টাঁকশাল’। ১৯৭৬ সালে ওই টাঁকশাল প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৮৮ সালের জুন মাসে ‘এক টাকা’ ছাপানোর মধ্য দিয়ে প্রেসের নোট ছাপানো শুরু হয়ছিল। প্রতিটি নোট ছাপানোর আগে তার ‘নকশা’ অনুমোদন করে সরকার। সে জন্য দরপত্র দিয়ে চিত্রশিল্পীদের কাছ থেকে নকশার কাজ করানো হয়। টাকা ছাপানোর কাজটা খুবই ব্যয়বহুল। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর নতুন ছবি-সংবলিত ২০০ টাকার নোট ছাপানো হয়েছিল ২০২০ সালে। আগে ছাপানো নোট থেকে পুরোনো ছবি বাদ দিয়ে ওই সময় থেকে সব ধরনের টাকার নোটে শেখ মুজিবুর রহমানের দুই ধরনের ছবি ছাপার বিধান প্রবর্তন করা হয়েছিল এবং এ পর্যন্ত ২০, ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটে ছবি রয়েছে শেখ সাহেবের। সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাগুজে নোটের ওপর থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের সব ধরনের ছবি সরিয়ে দিয়ে নতুন নোট ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ঘটনাটা ঘটল কেবল শেখ হাসিনার জেদের কারণে। তিনি তার পিতাকে জাতির কাছে অবিনশ্বর এক মূর্তিমান ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কার্যত অপমানে ক্ষত-বিক্ষত করলেন। আসলে তিনি যে কখনো ক্ষমতার শীর্ষবিন্দু থেকে নেমে যেতে পারেন, এমন কথা শুধু তিনি নন, তার পরিষদবর্গও তাকে বোঝাতে পারেননি কোনো দিন।
পুনশ্চ : লেখাটার শুরুতে শিরোনাম হিসেবে জেনারেল ওসমানীর নামটা লিখেছিলাম। সে নিয়েই কিছু লিখতে চাই। জাতির ইতিহাসে তিনি অনেকটাই ছিলেন ‘প্রদীপের নিচের অন্ধকার’।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সর্বপ্রথম প্রবাসী সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে জাতীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে), তাজউদ্দীন আহমদকে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং জেনারেল ওসমানীকে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ভেতর দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল। জাতির সেই চরম ক্রান্তিকালে তার ওপর অর্পিত সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি গড়ে তুললেন মুক্তিবাহিনী প্লাস গেরিলা বাহিনীর সমন্বয়ে এক বিশাল গণবাহিনী, যারা মরণপণ যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিল।
সেই যুদ্ধকালীন তার ভূমিকা নিয়ে রণাঙ্গনের একজন যোদ্ধা একসময় মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমরা যখন রণাঙ্গনে যুদ্ধরত ছিলাম, তখন নিজেকে প্রবোধ দিতাম এই বলে যে, আমি একা নই, আমাদের একজন ওসমানী আছেন।’ তার সম্পর্কে বলা হতো, ‘তিনি বিদ্রোহ করেন কিন্তু ধ্বংস করেন না।’ একসময় পাকিস্তানি আর্মির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন, আরও আগে ১৯৩৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশশাসিত ভারতের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি তার অনেক সিনিয়র অফিসারকে অতিক্রম করে এবং অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে কম বয়সী মেজর পদে উন্নীত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি যান্ত্রিক পরিবহন ব্যাটালিয়নের পরিচালনায় কৃতিত্ব প্রদর্শন করে অর্জন করেছিলেন দুর্লভ এক সম্মান। তার সময়ে বড় আরেক ঘটনা ছিল অভিন্ন ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ‘বেঙ্গল রেজিমেন্ট’ নামে স্বতন্ত্র একটি রেজিমেন্টের জন্ম দেওয়া। ৪৭-পরবর্তী সদ্য জন্ম নেওয়া পাকিস্তানে তিনি যখন ওই বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্ব লাভ করলেন, তখন তার নামকরণ করা হয়েছিল ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট বা ইপিআর। তিনি ইপিআরে যোগ দিয়েই ওই বাহিনীতে অবাঙালি সৈন্য নিয়োগ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং তিনি তখন ইপিআরের মার্চ সংগীত হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বিখ্যাত কবিতা ‘চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ’ এবং দিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা ‘ধন ধান্যে পুষ্পভরা আমাদের ঐ বসুন্ধরা’ গান দুটিকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ব্যান্ড সংগীত হিসেবে প্রচলনের কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। এটা ছিল সেই সময়ে একজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তার জন্য এক অবিস্মরণীয় কাজ। ১৯৬৫ সালে তিনি পাক-ভারত যুদ্ধের সময়েও ডেপুটি ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছিলেন তিনি। এর পরই বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগে। এ সম্পর্কে তার মন্তব্য ছিল, ‘আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল সমাজতন্ত্র কায়েমের, সে অঙ্গীকার করেছিল দলটি। সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আমারও একটা ভূমিকা থাকবে, এমন আশা নিয়েই যোগ দিয়েছিলাম; কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, বাংলার রাজনীতিবিদ কর্তৃক এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে বাঙালিরা শত্রু-মিত্রের প্রভেদ করতে সব সময়ই অক্ষম ছিল।’ তার পরের ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার ইতিহাস। মুজিবনগর সরকার তাকে যুদ্ধে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিলেও সামরিক পদমর্যাদার বিষয়ে মাথা ঘামায়নি, যে কারণে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে তাকে অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। তার জীবনের বড় ট্র্যাজেডি ছিল ৯টা মাস যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া সত্ত্বেও ৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন পাকিস্তানের পরাজিত বাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করল, সেই অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকতে পারলেন না তিনি। কেন পারলেন না, সেই উত্তরটি অজানা রয়ে গেল সবার কাছে। আরও বড় রহস্যজনক বিষয় হলো ওইদিন তিনি নাকি সিলেট থেকে ঢাকায় আসার উদ্দেশে হেলিকপ্টারে রওনা হয়েছিলেন; কিন্তু ফেঞ্চুগঞ্জের আকাশে আসার পর নিচে থেকে গুলি ছুড়ে হেলিকপ্টারটিকে নষ্ট করে দিলে তিনি যাত্রাপথেই আটকা পড়ে গেলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সেনা অধিনায়কের পদ বিলুপ্ত হলে দ্বিতীয়বারের মতো অবসরে গেলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত দেশে প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ওসমানী সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করলে বঙ্গবন্ধু তাকে বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিলে তিনি প্রথমবারের মতো সিলেট বিমানবন্দরের সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় টিকতে পারলেন না বেশি দিন। ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে জাতীয় সংসদে সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে জনতার কাতারে নেমে এলেন তিনি। গঠন করলেন জাতীয় জনতা পার্টি। দুঃখজনক সত্য হলো, স্বাধীনতা-পরবর্তী কোনো সরকারই তার প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখায়নি।
অকৃতদার এই মহান পুরুষ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একাকী পথ চলেছেন নিজের চিন্তা ও চেতনাকে সম্বল করে। তার এই একাকী জীবন সম্পর্কে ভারতীয় এক সেনানায়ক একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘ওসমানী মরে গেলেও কারও কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না।’ আসলে আত্মসমর্পণ যে কী করে করতে হয়, সেটাই জানেন না তিনি। সেই রকম এক ব্যক্তিত্বকে বর্তমান সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সেই সিদ্ধান্তের প্রতি আমাদের সীমাহীন কৃতজ্ঞতা।
বাহাত্তর সালের জানুয়ারি মাসে মুক্ত জীবন ফিরে পেয়ে দেশে আসার পর বঙ্গবন্ধুর উচিত ছিল সেই নয়টা মাস কীভাবে যুদ্ধে জড়িয়েছিল পুরো জাতি, তার অনুসন্ধান করা। কিন্তু তিনি তখন একশ্রেণির তোষামোদকারীর ক্রীড়নকে পরিণত হলেন। যার প্রধান রূপকার ছিলেন আপন ভাগনে শেখ মণি এবং তার অন্য সহযোগীরা। শেখ সাহেবের একটা বিশেষ গুণ ছিল, তিনি কানকথা শুনতেন খুব। পাশে তখন খন্দকার মোশতাকের মতো নরকের কীটও ছিল। অতএব, শেখ সাহেব তার পরামর্শদাতাদের কথামতো তাজউদ্দীন আহমদের ওপরই প্রথমে প্রতিশোধটা নিয়েছিলেন। ১০ জানুয়ারি ঢাকায় ফেরত আসার পর ১১ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাক্ষরিত ‘বাংলাদেশ এর অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ৭২’ জারি করে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করলেন এবং তাজউদ্দীনকে অর্থমন্ত্রীর পদে নিয়োগ দেওয়া হলো। এই ঘটনাটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের জন্য একটা প্রাথমিক বিজয়। কারণ এর কিছুদিনের মধ্যে তাজউদ্দীনের মন্ত্রিত্ব কেড়ে নিয়ে খন্দকার মোশতাককে অর্থমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিলেন বঙ্গবন্ধু। ঘরে-বাইরে তখন শুধু তাজউদ্দীন আহমদের শত্রুসংখ্যা হু হু করে বাড়ছিল। যার কারণে ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর শেখ সাহেবের নির্দেশে তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। একসময় একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালেই চলে গেলেন তাজউদ্দীন। কিন্তু ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বিশ্বাসঘাতক মোশতাকের মন্ত্রিসভায় তাজউদ্দীন ছাড়াও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এইচ কামরুজ্জামান কখনোই যোগ দেবেন না, বিষয়টা ভালোভাবেই জানত বলেই ঘাতক মোশতাকের নির্দেশেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৩ নভেম্বর রাতে এই জাতীয় চার নেতাকে খুন করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন পরে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের যাত্রার শুরু থেকে মাঝখানে ২০০১ থেকে ২০০৯ সালÑএই সময়টা বাদ দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ২০০৯ থেকে ২০২৪ এই সুদীর্ঘ সময়জুড়ে শেখ হাসিনা তার রাজত্বের কোনো একটা পর্যায়েও মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদের অবদান নিয়ে কিংবা বাকি তিন জাতীয় নেতার বিষয়ে কোনো দিন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে টুঁ শব্দও করেননি। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীও ছিলেন উপেক্ষিত এক সমরনায়ক। অবশ্য শেখ মুজিবুর রহমানের পুরো শাসনামলে এই দুই স্মরণীয় ব্যক্তিত্বকে যতটা পারা যায় ততটাই অপমানে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য একটাই ছিলÑশেখ মুজিবুর রহমানকে আজীবন অমরত্বের আসনে বসিয়ে জাতির জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে যাওয়া। কাজটা তার কন্যার শাসনামলের সুদীর্ঘ সময়জুড়ে কৌশলে এবং অপকৌশলে দুই অবস্থাতেই করা হয়েছে। বাকি যারা ছিলেন, তাদেরকে উপেক্ষা করে যাওয়া হয়েছে সমানে। তাজউদ্দীন আহমদ এবং ওসমানী সেই রকম দুই ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যাদের নিয়ে সাম্প্রতিক ইতিহাস আগাগোড়াই নীরবতা পালন করে গেছে।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য যেসব পাঠ্যপুস্তক ছাপাখানায় ছাপার জন্য দেওয়া হয়েছে, সেসব পুস্তকে মোট পাঁচটি পরিবর্তন আনা হবে। তার মধ্যে অন্যতম হলো পাঠ্যপুস্তকে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার প্রতিফলন হিসেবে আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ অন্য শহীদদের কথা তুলে ধরা হবে। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধ মানেই শেখ মুজিব-এই ধারণাকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বাকি সব জাতীয় নেতাকে অন্ধকারে রেখেছিল, যেমন মওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ, জিয়াউর রহমান, জেনারেল ওসামানীসহ অন্যদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা থাকবে এবং কোনো কোনো ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকে যেখানে এত দিন পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণীসহ ছবি ছাপা হতো, সেটা তুলে দেওয়া হবে। খুব ভালো খবরের একটা অংশ এসব বিষয়। বিগত ১৬ বছর এক দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে সময় গেছে মানুষের। দেশটা তার পৈতৃক সম্পত্তি ছিল, তিনি নিজেও খুব বড় গলায় বলতেন, ‘আমি মুজিবের বেটি।’ কথাটা কেবল আক্ষরিক অর্থেই নয়, অনেকটা ছিল প্রকৃতিগতভাবেই সত্য। তিনি তার পিতার সুযোগ্য সন্তানই ছিলেন, তাই শেখ হাসিনার বিগত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ছিল সত্যিকার অর্থে তার জনকের শাসনামলের ধারাবাহিকতারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অনেকের মতে, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভেতরে শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তার ও চেতনার প্রতিফলন ঘটেছিল পুরো মাত্রায়। তাই ওই দুই শাসনামলের পুরোটা সময়ে ছিল একচ্ছত্র ক্ষমতার মসনদে আরোহণের চেষ্টা এবং সে কারণে দুই আমলে নির্বাচন-ব্যবস্থাটায় ছিল ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের প্রয়াস। যেমন স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল তৎকালীন আওয়ামী দুঃশাসনই শুধু নয়, ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণায়ও একই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিল তারা। শেখ হাসিনার শাসনামলে একইভাবে সকল নির্বাচনকে তারা দলীয় নির্বাচনে পরিণত করে একদলীয় বিধিব্যবস্থার আওতায় নিয়ে এসেছিল, যেমন করে স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে তিন বছরের ভেতরে বাকশাল গঠন করে একদলীয় শাসন কায়েম করেছিল শেখ সাহেবের আওয়ামী লীগ। ’৭২-পরবর্তী রক্ষীবাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে জাতিকে এক কঠিন দুঃশাসনের জাঁতাকলে শুধু পিষ্ট করেনি, সেনাবাহিনীর প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ভেতর দিয়েও পুরো জাতিকে এক অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকেও ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। ওই সময়ের প্রধান সংকট হিসেবে তখন ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের আগমন, লাগামহীন দুর্নীতি এবং ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা এতটাই বেড়েছিল যে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম ঘটে। কন্ট্রোলের বাইরে চলে যায় সবকিছু। এবার সারা জাতি নতুনভাবে দেখল বাকশাল প্রতিষ্ঠা না করলেও শেখ হাসিনা তার শাসনামলের পুরোটা সময়ে পিতার দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরেই হাঁটলেন।
পিতার প্রতিষ্ঠিত ‘ছাত্রলীগ’কে তিনি রক্ষীবাহিনীর আদলে এক দানবশক্তি রূপে তৈরি করে দেশটাতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেন। দুর্নীতির সীমা পাতাল ছেড়ে আকাশের উচ্চতায় পৌঁছাল এতটাই যে তিনিও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করলেন, তার ঘরে গৃহকর্মী হিসেবে যে মানুষটা কাজ করত, সেও নাকি এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেসে হেসে বললেন, সে নাকি এখন হেলিকপ্টারে করে দেশের ভেতরে যাতায়াত করে। কতটা নির্লজ্জ হলে মানুষ এতটা বেহায়ার মতো নিজের ঢোল নিজে বাজায়? টেলিভিশনের সামনে বসে মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করতেও ভুলে গেল যেন। তিনি আবার বড় গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করতেন, দুর্নীতির প্রশ্নে তার সরকার জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলে। অথচ কী ভয়াবহ চিত্র দেখেছে মানুষ। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সচিত্র প্রতিবেদনে বিষয়টা যখন সামনে এল, মানুষ হতবাক হয়ে দেখল হেডিংটা ‘বেনজীরের ঘরে আলাদিনের চেরাগ’। না, এই তালিকায় এক বেনজীর ছিলেন না-একে একে বেরিয়ে এল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আরও অনেক বেনজীরের নজিরবিহীন অনৈতিক কাণ্ড-কারখানার খবর। দরবেশ নামক যে ব্যক্তিটি ছিলেন একসময় শেখ হাসিনার ডানহাত, তিনি এখন কারাগারে। কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে অন্য আরও কয়েক দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালীর সঙ্গে তারও এক নতুন অধ্যায়ের জীবন শুরু হয়েছে। শেষ পর্যন্ত রিমান্ডে গিয়ে স্বীকার করলেন অনেক কিছুই, তার ভেতরে একটা কথা ছিল সালমান এফ রহমান নামক দরবেশের, তিনি বলেছেন, এস আলমের মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হওয়া দেড় লাখ কোটি টাকার অর্ধেকই শেখ রেহানা ও সজীব ওয়াজেদ জয়কে দেওয়া হয়েছে। তার বক্তব্যমতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার এসব লেনদেনের বিষয়ে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী মানুষদের হয়তো কথাটা মনে আছে। শেখ সাহেবের শাসনামলের শেষ দিকে যখন চূড়ান্ত মাত্রায় ব্যাংক ডাকাতির হার বেড়ে গিয়েছিল, তখন পুলিশ নির্বিকার ভূমিকা পালন করত। তার পরও বড় কোনো ঘটনার পরে কদাচিৎ আটকের মতো কোনো কিছুর দরকার পড়লে যখন পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে বিষয়টা জানানো হতো তৎকালীন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কাছে, সেখান থেকে ফোর্স করা হতো সরাসরি লাল টেলিফোন সেটে। সেখান থেকে উত্তর আসত, দাঁড়াও, দেখি কামাল বাড়িতে আছে কি না। সেটা ছিল স্নেহে অন্ধ এক পিতার প্রতিকৃতি, যার দুই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। একটা ছিল স্বাধীনতা-পূর্ব জাতীয় নেতার ভূমিকায়, আর অন্যটা ছিল স্বাধীনতা-উত্তর দলীয় চরিত্রের এক ব্যক্তি। যিনি শাসক হিসেবে চূড়ান্ত মাত্রায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। সেই ধরনের এক নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মানুষও বিশ্বাস করত, দোষে-গুণে মিলিয়েই মানুষ। তার পরও তাকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে মানুষ শ্রদ্ধা করতে চেয়েছে, ভালোবাসতে চেয়েছে; কিন্তু তার নিজের কন্যার হাতেই তার পরাজয়ের ইতিহাসের সূচনা ঘটল। তিনি তার পিতাকে মানুষ হওয়ার ঊর্ধ্বে তুলে ধরে অতিমানবের আসনে বসাতে গিয়ে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যে বাড়াবাড়ির নজির সৃষ্টি করলেন, বলা হয়ে থাকে, আপন কন্যার বাড়াবাড়ির জন্যই মানুষ বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃত মূল্যায়ন করতে অপারগতা দেখাল। সেটা শুধু সাধারণ মানুষের দোষ ছিল না, শেখ হাসিনার জবরদস্তিমূলক কাজেরও দায় ছিল অনেকটা। তার মুজিব-বন্দনার নামে অতিমাত্রার বাড়াবাড়ি দেশের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে চিহ্নিত হলেও সর্বোচ্চ প্রশাসন সে বিষয়টা আমলে নেয়নি কখনো। তাই দেখা যায়, দেশজুড়ে সহস্রাধিক ভাস্কর্য ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তৈরি করা হয়েছে মুজিব কর্নার। এ ছাড়া দেশ এবং দেশের বাইরে থেকে বইমেলা উপলক্ষে যারাই বঙ্গবন্ধুর শ্রুতিবাক্য দিয়ে ছড়ার বই, কবিতার বই কিংবা শিশুতোষ গল্পের বই ছাপিয়েছেন, তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বাংলা একাডেমি পদক ছাড়াও একুশে পদকের মতো সম্মানজনক স্বীকৃতির উপহার। বিষয়টা অনেকটাই ‘বানরের’ গলায় মুক্তার অলংকারের মতো। ফলে গত কয়েক বছরে এসব পুরস্কারেরও মূল্যমান শূন্যের কোঠায় নেমে এসছে। এ ছাড়া আরও একটা বিষয় হলো, কাগজি নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপানোর কাহিনি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের কাগজি নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপা হয়েছিল, যদিও ’৭৫-এর পর সেই ছবি ছাপানোর কাজ বন্ধ হয়ে যায় সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। ১৯৯৬ সালে হাসিনা প্রথমবারের মতো ১০ টাকা এবং ৫০০ টাকার নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপেন।
বাংলাদেশের মুদ্রা ছাপানোর কাজ করে থাকে ‘দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন লিমিটেড’, যাকে সহজ ভাষায় বলা হয়ে থাকে ‘টাঁকশাল’। ১৯৭৬ সালে ওই টাঁকশাল প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৮৮ সালের জুন মাসে ‘এক টাকা’ ছাপানোর মধ্য দিয়ে প্রেসের নোট ছাপানো শুরু হয়ছিল। প্রতিটি নোট ছাপানোর আগে তার ‘নকশা’ অনুমোদন করে সরকার। সে জন্য দরপত্র দিয়ে চিত্রশিল্পীদের কাছ থেকে নকশার কাজ করানো হয়। টাকা ছাপানোর কাজটা খুবই ব্যয়বহুল। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর নতুন ছবি-সংবলিত ২০০ টাকার নোট ছাপানো হয়েছিল ২০২০ সালে। আগে ছাপানো নোট থেকে পুরোনো ছবি বাদ দিয়ে ওই সময় থেকে সব ধরনের টাকার নোটে শেখ মুজিবুর রহমানের দুই ধরনের ছবি ছাপার বিধান প্রবর্তন করা হয়েছিল এবং এ পর্যন্ত ২০, ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটে ছবি রয়েছে শেখ সাহেবের। সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাগুজে নোটের ওপর থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের সব ধরনের ছবি সরিয়ে দিয়ে নতুন নোট ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ঘটনাটা ঘটল কেবল শেখ হাসিনার জেদের কারণে। তিনি তার পিতাকে জাতির কাছে অবিনশ্বর এক মূর্তিমান ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কার্যত অপমানে ক্ষত-বিক্ষত করলেন। আসলে তিনি যে কখনো ক্ষমতার শীর্ষবিন্দু থেকে নেমে যেতে পারেন, এমন কথা শুধু তিনি নন, তার পরিষদবর্গও তাকে বোঝাতে পারেননি কোনো দিন।
পুনশ্চ : লেখাটার শুরুতে শিরোনাম হিসেবে জেনারেল ওসমানীর নামটা লিখেছিলাম। সে নিয়েই কিছু লিখতে চাই। জাতির ইতিহাসে তিনি অনেকটাই ছিলেন ‘প্রদীপের নিচের অন্ধকার’।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সর্বপ্রথম প্রবাসী সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে জাতীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে), তাজউদ্দীন আহমদকে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং জেনারেল ওসমানীকে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ভেতর দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল। জাতির সেই চরম ক্রান্তিকালে তার ওপর অর্পিত সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি গড়ে তুললেন মুক্তিবাহিনী প্লাস গেরিলা বাহিনীর সমন্বয়ে এক বিশাল গণবাহিনী, যারা মরণপণ যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিল।
সেই যুদ্ধকালীন তার ভূমিকা নিয়ে রণাঙ্গনের একজন যোদ্ধা একসময় মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমরা যখন রণাঙ্গনে যুদ্ধরত ছিলাম, তখন নিজেকে প্রবোধ দিতাম এই বলে যে, আমি একা নই, আমাদের একজন ওসমানী আছেন।’ তার সম্পর্কে বলা হতো, ‘তিনি বিদ্রোহ করেন কিন্তু ধ্বংস করেন না।’ একসময় পাকিস্তানি আর্মির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন, আরও আগে ১৯৩৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশশাসিত ভারতের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি তার অনেক সিনিয়র অফিসারকে অতিক্রম করে এবং অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে কম বয়সী মেজর পদে উন্নীত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি যান্ত্রিক পরিবহন ব্যাটালিয়নের পরিচালনায় কৃতিত্ব প্রদর্শন করে অর্জন করেছিলেন দুর্লভ এক সম্মান। তার সময়ে বড় আরেক ঘটনা ছিল অভিন্ন ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ‘বেঙ্গল রেজিমেন্ট’ নামে স্বতন্ত্র একটি রেজিমেন্টের জন্ম দেওয়া। ৪৭-পরবর্তী সদ্য জন্ম নেওয়া পাকিস্তানে তিনি যখন ওই বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্ব লাভ করলেন, তখন তার নামকরণ করা হয়েছিল ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট বা ইপিআর। তিনি ইপিআরে যোগ দিয়েই ওই বাহিনীতে অবাঙালি সৈন্য নিয়োগ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং তিনি তখন ইপিআরের মার্চ সংগীত হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বিখ্যাত কবিতা ‘চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ’ এবং দিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা ‘ধন ধান্যে পুষ্পভরা আমাদের ঐ বসুন্ধরা’ গান দুটিকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ব্যান্ড সংগীত হিসেবে প্রচলনের কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। এটা ছিল সেই সময়ে একজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তার জন্য এক অবিস্মরণীয় কাজ। ১৯৬৫ সালে তিনি পাক-ভারত যুদ্ধের সময়েও ডেপুটি ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছিলেন তিনি। এর পরই বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগে। এ সম্পর্কে তার মন্তব্য ছিল, ‘আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল সমাজতন্ত্র কায়েমের, সে অঙ্গীকার করেছিল দলটি। সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আমারও একটা ভূমিকা থাকবে, এমন আশা নিয়েই যোগ দিয়েছিলাম; কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, বাংলার রাজনীতিবিদ কর্তৃক এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে বাঙালিরা শত্রু-মিত্রের প্রভেদ করতে সব সময়ই অক্ষম ছিল।’ তার পরের ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার ইতিহাস। মুজিবনগর সরকার তাকে যুদ্ধে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিলেও সামরিক পদমর্যাদার বিষয়ে মাথা ঘামায়নি, যে কারণে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে তাকে অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। তার জীবনের বড় ট্র্যাজেডি ছিল ৯টা মাস যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া সত্ত্বেও ৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন পাকিস্তানের পরাজিত বাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করল, সেই অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকতে পারলেন না তিনি। কেন পারলেন না, সেই উত্তরটি অজানা রয়ে গেল সবার কাছে। আরও বড় রহস্যজনক বিষয় হলো ওইদিন তিনি নাকি সিলেট থেকে ঢাকায় আসার উদ্দেশে হেলিকপ্টারে রওনা হয়েছিলেন; কিন্তু ফেঞ্চুগঞ্জের আকাশে আসার পর নিচে থেকে গুলি ছুড়ে হেলিকপ্টারটিকে নষ্ট করে দিলে তিনি যাত্রাপথেই আটকা পড়ে গেলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সেনা অধিনায়কের পদ বিলুপ্ত হলে দ্বিতীয়বারের মতো অবসরে গেলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত দেশে প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ওসমানী সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করলে বঙ্গবন্ধু তাকে বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিলে তিনি প্রথমবারের মতো সিলেট বিমানবন্দরের সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় টিকতে পারলেন না বেশি দিন। ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে জাতীয় সংসদে সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে জনতার কাতারে নেমে এলেন তিনি। গঠন করলেন জাতীয় জনতা পার্টি। দুঃখজনক সত্য হলো, স্বাধীনতা-পরবর্তী কোনো সরকারই তার প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখায়নি।
অকৃতদার এই মহান পুরুষ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একাকী পথ চলেছেন নিজের চিন্তা ও চেতনাকে সম্বল করে। তার এই একাকী জীবন সম্পর্কে ভারতীয় এক সেনানায়ক একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘ওসমানী মরে গেলেও কারও কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না।’ আসলে আত্মসমর্পণ যে কী করে করতে হয়, সেটাই জানেন না তিনি। সেই রকম এক ব্যক্তিত্বকে বর্তমান সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সেই সিদ্ধান্তের প্রতি আমাদের সীমাহীন কৃতজ্ঞতা।