অপূর্ব, ব্যবসায়ী বাবার একমাত্র ছেলে। অভিজাত এলাকায় ডুপ্লেক্স বাড়ি, সামাজিক প্রতিষ্ঠা, দৃশ্যত খুবই সুখী ও সফল পরিবার। অনন্যা ওই পরিবারের একমাত্র বউ। অনন্যার বাবা একজন সরকারি চাকরিজীবী। তিন বোন, এক ভাই ওরা। প্রকৃত সুখী পরিবার বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই। ওদের মা ভীষণ ধর্মভীরু একজন মহিলা। স্বামী সংসার দু’হাতে আগলে রাখা আর নামাজ কালাম করাই তার একমাত্র কাজ। অনন্যা এই উচ্চবিত্ত পরিবারের সাথে যুক্ত হয় তার মেজো বোন সোমার সূত্র ধরে। সোমা তখন চারুকলায় পড়ত, ওর প্রেম ছিল সহপাঠী মামুনের সাথে। অনন্যার বাবা খুবই উদার মনের মানুষ। এগুলো নিয়ে ওনার খুব একটা মাথাব্যথা নেই। কিন্তু তাদের মা এ ব্যাপারগুলো একদমই পছন্দ করেন না। বিষয়টি আঁচ করতে পারার পর থেকেই বাসায় হালকা একটা নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি কোনোভাবেই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তার মধ্যে শোনা গেল, সোমা যে শুধু প্রেম করেছে তা নয়, ছেলেটি নাকি বিরাট বড়লোকের ছেলে।
একদিন হঠাৎ করেই মামুন ওর মাকে নিয়ে অনন্যাদের বাসায় হাজির হয়। অনন্যা তখন মাত্র বাইরে থেকে ফিরেছে। ঘরে ঢুকেই দেখে ড্রয়িংরুমে একজন মহিলা ও একটি ছেলে বসা। মামুনের সাথে অনন্যার এর আগে কখনো দেখা হয়নি। কিন্তু এটা যে সেই নিম্নচাপেরই অংশ, সেটা বুঝতে তার আর দেরি হয় না। মামুন অনন্যাকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে ওর মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগল। ড্রয়িংরুমে অনন্যার বাবা-মা আর মামুন ও মামুনের মা ছিলেন। লম্বা-চওড়া আভিজাত্যে ভরা একজন মানুষ। তাকে দেখে খারাপ লাগার মতো নয় বরং ভেতর থেকে এটা শ্রদ্ধা এল অনন্যার। সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে ভেতরে চলে গেল সে। ভেতরে গিয়ে দেখে সোমার চোখ দুটো ছলছল করছে, আর ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।
-বুবু দেখ, মামুন না বলেই ওর মাকে নিয়ে চলে এসেছে।
কিছুক্ষণ পর অনন্যার বাবা ভেতরে এসে বললেন, অনন্যা, মামুনের মা তোকে ডাকছেন।
অনন্যা ড্রয়িংরুমে যাওয়ার পর মামুনের মা বললেন, আমি তোমার বাবা-মায়ের সাথে আলাপ করেছি। সোমাকে আমি আমার ঘরের বউ করে নিতে চাই। কিন্তু তোমাকে রেখে ওনারা সোমাকে বিয়ে দেবেন না বলছেন। এখন তুমিই বলো।
অনন্যা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভেবে বলল, রাজি না হওয়ার তো কোনো কারণ দেখি না। বাবা-মা শোনো, আন্টি কত আগ্রহ করে এসেছেন, ফিরিয়ে দেওয়ার তো কিছু দেখি না।
অনন্যা সোমাকে মায়ের একটা হালকা গোলাপি রঙের জামদানি শাড়ি আর মায়ের ছোট্ট একটা গহনার সেট পরিয়ে দেয়। সবাই বলে, ওদের বোনদের নাকি দুধে-আলতা গায়ের রং। সোমার চোখগুলো ওর বাবার মতোই বড় বড়। চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে একটুখানি পারফিউমও ছড়িয়ে দিল ওর গায়ে। সোমাকে তখন স্বর্গের অপ্সরী মনে হচ্ছিল। ড্রয়িংরুমে নিয়ে যেতেই মামুনের মা এগিয়ে এসে সোমাকে নিয়ে গেলেন, আর বলতে থাকেন, আমার মামুনের পছন্দ আছে, চোখ জুড়িয়ে গেল মা। ব্যাগ থেকে একটি ডায়মন্ডের আংটি বের করে পরিয়ে দিলেন ওর হাতে।
যাওয়ার সময় মামুনের মা অনন্যার বাবাকে বলে গেলেন, খুব শিগগিরই উনি সোমাকে ঘরে তুলতে চান।
বছরখানেক পর মামুন ও সোমার বিয়ে হয়ে গেল। ওদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার সাথে সাথেই। সোমা বরাবরই অনেক মেধাবী ছিল। সব মিলিয়ে ওর লাইফ খুব ভালোভাবেই সেটেল হয়ে গেল।
অনন্যা মাস্টার্স শেষ করে চাকরির জন্য চেষ্টা করতে লাগল। খুব একটা জুতসই চাকরি হচ্ছিল না তার। এদিকে ওদের বাবাও রিটায়ারমেন্টে চলে গিয়েছেন। চাকরিটা অনেক জরুরি হয়ে পড়েছিল অনন্যার। মামুনের ফুপা একটি গ্রুপের চেয়ারম্যান। অনন্যাকে সিভিসহ মামুনের ফুপার বাসায় সোমা আর মামুন মিলে নিয়ে যায় চাকরির জন্য। মামুনের ফুপু আর ফুপার সাথে ঘরোয়া পরিবেশে অনেক আলাপ হয় তাদের। একপর্যায়ে ওনার সুপারিশে ভালো একটা চাকরিও হয় অনন্যার। এর কিছুদিন পর অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখে সোমা ও মামুন এসেছে। ওরা কিছু একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলাপ করছে। অনন্যাকে দেখেই চুপ হয়ে গেল সবাই। একপর্যায়ে নাশতার টেবিলে বসে সবই বোঝা গেল। মামুনের ফুপা তার বোনের ছেলের জন্য অনন্যাকে পছন্দ করেছেন। ছেলেটির নাম অপূর্ব। দেশের বাইরে পাইলট প্রশিক্ষণে আছে। ওনাদের ইচ্ছা ট্রেনিং শেষ করে এসে কোনো এয়ারলাইন্সে জয়েন করার। অনন্যা ঠিক বুঝতে পারছিল না, ওনারা কী কারণে ওকে পছন্দ করলেন। পরে ওকে বোঝানো হলো, ওনারা একটা সংসারী মেয়ে চান। আর যেহেতু সোমাকে ওর শ্বশুরবাড়ির সবাই খুবই পছন্দ করেন এবং অনন্যা দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী, তাই অনন্যাকে ওনারা চান।
সবকিছু ছাপিয়ে অনন্যার মাথায় ছিল ওর বাবা রিটায়ারমেন্টে চলে গেছেন, তা ছাড়া ছোট বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে ওকে রেখে। সুতরাং ওর এখন বিয়ে হয়ে যাওয়াটা জরুরি। তা ছাড়া বয়সও খুব একটা কম হয়নি তার। এদিকে অনন্যার ছোট ভাই পাভেলেরও গ্র্যাজুয়েশন শেষ। ওর একটা চাকরি দরকার। আর ছোট বোন রুমা পড়ে ক্লাস সেভেনে। বাবা-মা তাদের সংসারকে গোছাতে চাচ্ছিলেন মনেপ্রাণে। অনন্যার বিয়ের কথাবার্তা চলতে চলতে ওর ভাই পাভেলের একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি হয়ে যায় মামুনের ফুপার সুবাদে।
সবকিছু মিলিয়ে সংসারের অনেক সমস্যার সমাধান নিমেষেই হয়ে যায় সোমার শ্বশুরবাড়ির সহায়তায়। অনন্যা আর কোনো আগপিছ না ভেবে খুশিমনেই বিয়েতে সম্মতি দেয়। সংসারের প্রতি, বাবা-মায়ের প্রতি তার অনেক দরদ। পরিবারের সবাই ভালোভাবে সেটেল হোক, এটাই তার চাওয়া, নিজেকে নিয়ে অতশত ভাবে না সে।
অপূর্বর ট্রেনিং তখনো শেষ হয়নি, ওর মা-বাবা চাইলেন ফোনে ওদের আকদ সেরে নিতে। অনন্যা অজানা আশঙ্কায় দুলতে থাকে, যে মানুষটাকে সে চোখে দেখেনি তার সাথেই গাঁটছড়া বাঁধতে চলেছে সে। তবে ও সান্ত্বনা পায় এই ভেবে যে সোমা তো সুখে আছে। ওরা তো সোমার শ্বশুরবাড়িরই আত্মীয়।
এক শুক্রবার দুপুরে খুব সীমিত পরিসরে আয়োজন করে বাসায় আকদের অনুষ্ঠান হয়ে যায় ওদের। সব মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জনের আয়োজন। ফোনে আকদ হয়, ও বাড়ি থেকে দামি সব শাড়ি, গয়না, পারফিউম সবকিছুই আসে। কোনো কিছুর কমতি হয় না। অনন্যা সব সময়ই রূপবতী ছিল। সব ব্র্যান্ডের জিনিস আর রূপের ঝলকে দুই পক্ষই অনেক খুশি ছিল সেদিন। আকদের পরে অপূর্বর সাথে ফোনে দু’একটা কথা হয় অনন্যার। এর পর থেকে টুকটাক যোগাযোগ হতে থাকে তাদের। কিন্তু অনন্যা কিসের যেন একটা শূন্যতা অনুভব করে।
এর ঠিক এক মাস পর অপূর্বর আসার দিনক্ষণ ঠিক হয়। আসার দুই দিনের মাথায় বিয়ের অনুষ্ঠানের তারিখও ঠিক হয়ে যায়। অপূর্বর বাবা-মা অনন্যাকে বাসা থেকে গাড়ি করে নিয়ে যান অপূর্বকে আনার জন্য। সোমা অপূর্বকে দেওয়ার জন্য বড় একটি ফুলের তোড়া এনে দেয় অনন্যাকে। বেগুনি রঙের অর্কিড, সাথে কিছু দোলনচাঁপা আর জিপসি ফুল। গাড়িজুড়ে দোলনচাঁপার মিষ্টি সুবাস ছড়াতে থাকে। চাপা ভয় আর উৎকণ্ঠা নিয়ে এক অজানা ভবিষ্যতের কথা ভেবে আনন্দ আর আশঙ্কার দোলাচলে দুলছিল সেদিন অনন্যা। এয়ারপোর্টে যেতেই দেখতে পায়, মাঝারি উচ্চতার বেশ ফরসা একটি মানুষ ট্রলি ঠেলে ঠেলে সামনের দিকে আসছে। ছেলেটা অনন্যা থেকে যেন বেশ একটু আলাদা। ফুলের তোড়াটা নিয়ে কাছে যেতেই পারফিউম ও সিগারেটের মিশ্রণে বেশ ঝাঁজালো একটা গন্ধ নাকে আসে অনন্যার। মনটা খুব বিষণ্ন হয়ে যায় তার।
অনন্যাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে শুধু অপূর্ব গাড়ি থেকে নেমে অনন্যার বাবা-মাকে একটু সালাম দিয়ে হাই-হ্যালো করে চলে যায়। অনন্যার মা মন খারাপ করে বলতে থাকেন, আমরা কি মেয়েকে ঠিক জায়গায়ই বিয়ে দিচ্ছি। আমার কিন্তু মন টানছে না অনন্যার বাপ।
Ñআরে দূর, সোমা সংসার করছে না। টাকা-পয়সা বেশি থাকলে মানুষ একটু-আধটু এলোমেলো হয়ে থাকে। ও কিছু না, ওগুলো নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই।
অনন্যার বাবা তার সর্বস্ব দিয়ে মেয়ের বিয়ের আয়োজন করতে থাকেন। কোথাও কোনো কিছুর কমতি রাখতে চান না তিনি। ও বাড়ির লোকজনও সবকিছুতে খুবই খুশি। ওনাদের কথাÑআপনি আপনার সাধ্যমতো করেন, আমাদের কোনো সমস্যা নেই।
বিয়ের রাত থেকেই স্বপ্নভাঙা শুরু হয় অনন্যার। অপূর্ব ঘরে এসে অনন্যার সাথে কথাবার্তা বললেও তার মনোযোগ ছিল অন্য কোথাও। এর মধ্যে একটি ওভারসিজ কল এলে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে ইংরেজিতে কথা বলতে থাকে অপূর্ব। ওপাশের কথা শুনতে না পেলেও অনন্যা এটা বেশ বুঝতে পারছিল, অপূর্ব বারবার করে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে যাবেÑএটাই বোঝাতে চাচ্ছে। অনন্যা মনে মনে ভাবতে থাকে, এই সুন্দর ঘরবাড়ি তার হলেও সংসারটা কতটুকু তার হবে, কে জানে? বারান্দা থেকে এসে সে ড্রিঙ্ক করা শুরু করে। অনন্যা কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ে।
বিয়ের একদিন পর বউভাতের অনুষ্ঠান হয়। এলাহি কাণ্ডকারখানা, বিশাল আয়োজন। অপূর্বর দাদা-বাবা দুজনই যেহেতু সামাজিকভাবে ভালো অবস্থানে ছিলেন, সমাজের উঁচু পর্যায়ের লোকজন সবাইকে এ অনুষ্ঠানে পাওয়া গিয়েছিল সেদিন। অনন্যার আত্মীয়স্বজন সবাই বলাবলি করতে লাগল, অনন্যা অনেক ভাগ্যবতী, এত বড় ঘরে ওর বিয়ে হয়েছে।
অপূর্ব কখনোই অনন্যার সাথে কোনো খারাপ আচরণ করেনি। কিন্তু সে একজন হারিয়ে যাওয়া মানুষ ছিল, কাছে থেকেও কাছে ছিল না। অনন্যা আস্তে আস্তে সবকিছুই আবিষ্কার করতে লাগল। দেশের বাইরে থাকাকালীন একটা স্প্যানিশ মেয়ের সাথে ওর প্রেম ছিল। যে কারণে অপূর্বর বাবা-মা অপূর্বকে অনেকটা জোর করে দেশে এনে তড়িঘড়ি করে বিয়েটা দিয়েছেন। এত দিনে অনন্যা বুঝতে পারে, কী কারণে ওকে এত পছন্দ হয়েছিল ওনাদের। ওনারা ধরেই নিয়েছিলেন, মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে এসে ঠিকই ঘরমুখী করতে পারবে উড়নচণ্ডী অপূর্বকে।
বিয়ের কিছুদিন পরই অপূর্ব বিদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। এটা নিয়ে ওর বাবা-মায়ের সাথে তুমুল ঝগড়া হয়। ওনাদের কথাবার্তা থেকে সবই পরিষ্কার বুঝতে পারে অনন্যা। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে একপর্যায়ে অপূর্বর বাবা স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হন। অপূর্ব নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বাইরে যাবার ব্যাপারটা থেকে সরে আসে। অনন্যার সাথে ওর সম্পর্কটা অনেকটা অযাচিতভাবেই টিকে যায়।
অপূর্ব তার জীবন থেকে অনন্যাকে সরাতেও পারছিল না আবার গ্রহণও করতে পারছিল না মন থেকে। এভাবেই চলতে থাকে সংসার। অনন্যা থাকে চুপচাপ নিরুত্তর, কোনো কিছুতেই কোনো উচ্চবাচ্য করে না সে। অনন্যা ওর পরিবারকে এসব কোনো কিছুই জানায় না। ওনারা ধরেই নেন, ওনাদের দুই মেয়েরই খুব ভালো পরিবারে বিয়ে হয়েছে এবং ওরা ভালোও আছে। আর কেনই-বা হবে না, ওনাদের মেয়ে দুটোও তো রূপে-গুণে কোনো অংশে কম নয়। অপূর্ব ওর বাবা-মায়ের চাপাচাপিতে সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটা স্থগিত রাখে আর দেশে থেকেই পাইলট হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করে।
অপূর্ব নিজেকে বাবা-মায়ের পছন্দের ছেলে হয়ে ওঠার জন্য চেষ্টা করতে শুরু করে। ওর বাবা-মা অনেকটা জোর করেই দুজনকে বাইরে ঘুরতে পাঠান। দুজন মিলে অস্ট্রেলিয়ার ভিজিট ভিসা নিয়ে মাসখানেক ঘুরে আসে। হানিমুনে যাওয়ার ব্যাপার না থাকলেও অনেকটা হানিমুনের মতোই হয়ে যায় ব্যাপারটা। দুজনের মধ্যে খুব একটা প্রাণখোলা সম্পর্ক তৈরি না হলেও আস্তে আস্তে স্বামী-স্ত্রীর একটা বন্ধন তৈরি হতে থাকে দুজনের মাঝে।
এর কিছুদিন পরই অনন্যা টের পায়, সে মা হতে যাচ্ছে। ওই সময়টাতে যত্ন-আত্তির কোনোই অভাব হয়নি অনন্যার। শুধু অভাব ছিল মানুষটার মনোযোগের। নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে জন্ম নেয় ওদের মেয়ে প্রিয়ন্তী। অপূর্বও অনেক খুশি হয় মেয়েকে পেয়ে। অনন্যা বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকে পুরোটা সময়। আর অপূর্ব ব্যস্ত থাকে ফ্লাইট নিয়ে। শুরু থেকেই দুটো মানুষের মনের মিল ছিল না, তার ওপর বাচ্চা হওয়ার পর তাদের নিজেদের মধ্যে দূরত্ব আরও বেড়ে যায়।
অপূর্বর ফ্লাইটের বিভিন্ন সময়ে শিডিউল থাকে, তাকে সময়মতো ঘুমিয়ে নিতে হয়। এভাবেই সে বেডরুম ছেড়ে গেস্টরুমে নিজেকে সেট করে নেয়। এতে অপূর্ব আর অনন্যার মাঝে যা কিছুটা আন্তরিকতা তৈরি হয়েছিল, তাতেও ভাটা পড়ে যায়। অপূর্ব কখন ফ্লাইটে যায়, কখন আসে, এগুলো নিয়ে অনন্যা আর খুব একটা খেয়ালও করতে পারে না। ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে অফিসে জয়েন করতে বললে শ্বশুর-শাশুড়ি বাধা দেন। সংসার, বাচ্চা এগুলো সামাল দেওয়ার কথা বলেন। অনন্যাও ওনাদের কথা মেনে নেয়। ছকে বাঁধা বন্দিজীবন কাটতে থাকে অনন্যার।
অনন্যা একপর্যায়ে সোমা আর মামুনের কাছে সবকিছু খুলে বললে ওরা জানায়, স্প্যানিশ মেয়েটার সাথে যোগাযোগ না থাকলেও অপূর্বর আরও অনেকের সাথেই নতুন করে যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অনন্যা ওর অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু অনন্যার প্রতি তার কোনো মনোযোগই ছিল না।
অপূর্বর অবহেলা ধীরে ধীরে অনন্যাকে অনেক প্রতিবাদী করে তুলেছিল। এভাবেই দিন যায়, বছর যায়। বাচ্চার বয়স তিন বছর হয়ে গেলে ওকে স্কুলে ভর্তি করে দেয় অনন্যা। একাকিত্ব আর অবহেলা নিতে নিতে অনন্যা অনেকটা ডিপ্রেশনে চলে যায়।
একসময় ডাক্তারের পরামর্শে অনন্যা অনেকটা জোর করেই শ্বশুরের অফিসে বসতে শুরু করে। ব্যাপারটা অনন্যার শাশুড়ি একদম পছন্দ করছিলেন না। যাও উনি এতকাল ওর পক্ষের লোক ছিলেন, উনিও এখন অনন্যাকে আগের মতো সবকিছুতে সাপোর্ট করতে চান না, যদিও শ্বশুর ব্যাপারটাকে খুবই পজিটিভভাবে দেখছিলেন। অনন্যা এই প্রথম বুঝতে পারে, এই পরিবারের সবাই তার ডানাটা কেটে দিতে চান। ওনারা অনন্যাকে ওনাদের পুতুল বানিয়ে রাখতে চান। দিনে দিনে অনন্যা অনেকটা জেদি আর উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে।
অফিসের কাজের খাতিরেই মইনুলের সাথে পরিচয় হয় অনন্যার। প্রায়ই ফোনে কথা হয় দুজনের। অনন্যা প্রাণখুলে কথা বলার একজন মানুষ খুঁজে পায়। অফিস শেষে মাঝে মাঝে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায় দুজন মিলে। অনন্যার শাশুড়ি সবকিছু দেখেশুনে ভীষণ খেপতে থাকেন। অপূর্ব এসব কোনো কিছুই মাথায় নেয় না। সে তার মতো করে জীবন কাটাতে থাকে। এসব ঝুটঝামেলায় পরিবারে সব সময় হইচই, চিৎকার-চেঁচামেচি, মান-অভিমান চলতেই থাকে। একপর্যায়ে অনন্যাদের ছেড়ে ওনারা ওনাদের বাগানবাড়িতে গিয়ে ওঠেন।
এদিকে যতই দিন যায় অনন্যা ও মইনুল দুজনের প্রতি দুজনের ভালোবাসা আর আস্থার জায়গাটা বাড়তে থাকে। একটা সময়ের সবকিছু মেনে নেওয়া মানুষটা বদলে গিয়ে বেপরোয়া হতে থাকে। অনন্যার এই চালচলনে কারও খুব একটা কথা বলারও জায়গা থাকে না। কিছুদিন পরপর অনন্যা দেশের বাইরে ঘুরতে গেলে মইনুলও সাথে যায় কাউকে কিছু না জানিয়ে। এভাবেই অপূর্ব তার মতো করে এবং অনন্যা তার মতো করে বাঁচতে শেখে। বাবা-মায়ের আদর্শ মেয়ে হিসেবে কোনটা নীতি আর কোনটা নীতি নয় অথবা কোনটা আদর্শের বাইরে, সেটা ভুলে যেতে থাকে অনন্যা।
একাকিত্ব কাটিয়ে প্রত্যেকে যার যার মতো করে ভালোই সময় কাটাচ্ছিল। তারপর হঠাৎ করেই করোনা সবার জীবনে অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসে। লম্বা সময় ধরে করোনার কারণে ব্যবসা আর আগের অবস্থায় চালানো যাচ্ছিল না। যদিও ব্যবসার অবস্থা অনেক আগেই খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছিল। একপর্যায়ে দেখা গেল, অফিস চালু রাখতে গেলে লাভের চেয়ে লসই হচ্ছে বেশি। শ্বশুরের পরামর্শে অনন্যা অফিস বন্ধ করে দিল।
এদিকে করোনার কারণে অপূর্বর ফ্লাইটও বন্ধ হয়ে গেল। ওদের মেয়েরও অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। তিনজনেরই বাইরে যাওয়া বন্ধ। জীবনে এই প্রথমবার তিনটি প্রাণী একসাথে বাসায় থাকা শিখল। এদিকে মইনুলও তার ব্যবসা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে আছে। করোনার কারণে সবার মতো তার ব্যবসাও আগের মতো ঠিকঠাক চলছিল না। আজকাল অনন্যার সাথে খুব একটা কথাও হয় না তার। কেমন যেন প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সংসারে মনোযোগী হওয়া শুরু করল। করোনা অনেক কিছুই কেড়ে নিয়ে পরিবারের বন্ধনগুলো ঠিক করতেই যেন এসেছিল।
বাসায় তিনটা প্রাণী একসাথে সময় কাটানো শুরু করল। বুয়ারাও এখন কাজে নেই। অনলাইনে বাজার-সদাই করে নিজেরা রান্নাবান্না করে খায়। ওয়াশিং মেশিনে কাপড়চোপড় ধুয়ে তিনজন মিলে ছাদে ছড়িয়ে দিতে যায়। একসাথে সময় কাটানোই এখন একমাত্র বিনোদন তাদের। এত বছর পর এই প্রথম অপূর্ব অনন্যার দিকে ভালো করে চোখ মেলে দেখে। মনে মনে ভাবে, অনন্যা যে এত সুন্দর একটা মানুষ, তা আগে কখনো চোখেই পড়েনি। সংসারেও তো বেশ আনন্দ আছে।
একা একা ভাবে, এগুলো তো কখনোই তার জীবনে পাওয়া হয়নি। যখন খুব ছোট, তখনই দার্জিলিংয়ে পাঠানো হলো পড়াশোনা করার জন্য। তারপর আমেরিকায় পাইলট ট্রেনিংয়ে চলে গেল সে। বছরে দু-একবার ছুটি কাটাতে দেশে আসা। পরিবারের সুখ, আনন্দ কেমন হয় কখনোই জানার সুযোগ হয়নি তার।
মেয়ে বাবার পেছনে পেছনে হাঁটে আর বলে, ‘বাবা, বাবা, আমাদের অনেক ফান হচ্ছে, তাই না?’
অপূর্ব হাসে আর মাথা নাড়ে। মনে মনে ভাবে, চাইলে জীবনকে আরও অনেক গুছিয়ে সাজানো যেত।
আজকাল অপূর্ব আর অনন্যার মাঝে টুকটাক গল্প-আড্ডাও হয়। ওর প্রতি অপূর্বর মনোযোগ ওর খুব একটা খারাপ লাগে না। যদিও ওরা যার যার রুমে থাকে। কিন্তু একসাথে খাওয়াদাওয়া, বিকেলে একটু ছাদে যাওয়া, একসাথে মুভি দেখা, সবকিছু মিলিয়ে খুব একটা খারাপ সময় কাটে না তাদের। একদিন রাতে অনন্যার প্রচণ্ড জ্বর এলে ওদের মেয়ে দৌড়ে গিয়ে বাবার কাছে জানায়। করোনা হয়েছে কি না ভেবে মেয়েকে আলাদা রুমে পাঠিয়ে অপূর্ব অনন্যার পাশে থাকে।
কত বছর ওরা একসাথে এক রুমে সময় কাটায় না, তার কোনো হিসাব নেই। শুরুতে অনন্যার বেশ একটু অস্বস্তি কাজ করলেও পরে সব কেটে যায়।
আজকাল মানুষটার প্রতি কেমন যেন একটা মায়া কাজ করে। অনন্যাও ভাবে, মানুষটা যদি আগে থেকেই এ রকম ঠিকঠাক হতো, তাহলে জীবনটা অন্য রকম হতে পারত। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে মইনুলকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। অনন্যা এটা নিয়ে একটু উৎকণ্ঠার মধ্যেও আছে। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না কিন্তু ভেতর থেকে অশান্তি লাগছে তার।
একদিন দুপুরে ওরা তিনজন একসাথে খাবার খাচ্ছিল। হঠাৎ অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে।
Ñম্যাডাম, আমি মইনুল স্যারের অফিসে কাজ করি, মইনুল স্যার করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আইসিইউতে আছেন। আমি ওনার আর আপনার ব্যাপারটা জানি। উনি অসুস্থ অবস্থায় ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে আপনার নাম ধরে ডাকেন। আমি আপনার নাম্বার জোগাড় করে আপনাকে ফোন দিলাম। ওনার অবস্থা ভালো নয়।
অনন্যা ভয়ে-কষ্টে কুঁকড়ে যায়। বিষয়টা কাউকে বলতেও পারছিল না সে। শুধু অপূর্বকে জানাল, তার এক বন্ধু করোনায় আক্রান্ত এবং তার অবস্থা ভালো নয়। এর দুদিন পর খবর এল, মইনুল আর বেঁচে নেই।
কাউকে কিছু না বলেই অনন্যা দৌড়ে হাসপাতালে যায়। গিয়ে দেখে মইনুলকে হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে, দূরে দাঁড়িয়ে আছে মইনুলের বউ আর তিন বছর বয়সী মেয়ে। ওখানে কারও সাথেই কোনো কথা না বলে চলে আসে অনন্যা।
কিছুদিন ধরে অনন্যার শরীরটা খুবই খারাপ যাচ্ছে। ডাক্তার কোনোভাবেই বের করতে পারছে না কী কারণে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বারবার কমে যাচ্ছে। অপূর্ব ওর বেশ যত্ন করার চেষ্টা করছে। এই জুস ওই জুস বানিয়ে দিচ্ছে। মানুষটা মন থেকে খুব একটা খারাপ নয়। কিন্তু কোনো কিছুতেই অনন্যার শরীরটা সুস্থ হচ্ছে না। আজ খুব করে মইনুলের কথা মনে পড়ছে অনন্যার। কেমন আছে ওর সন্তান, স্ত্রী, ওর মা, কিছুই তো জানে না সে। মানুষটা না বলেই চলে গেল।
সম্পর্কহীন একটা সম্পর্ক ছিল মানুষটার সাথে। শুধু দিয়ে গেছে কিছু মিষ্টি স্মৃতি। পৃথিবী থেকে চলে গিয়েই কি সবকিছু ঠিকঠাক করতে চেয়েছে সে অনন্যার?
আজকাল কারও সাথে কথা বলতে একদম ইচ্ছে হয় না তার। শরীরটা একদম ঠিক যাচ্ছে না। অপূর্ব ট্রিটমেন্টের জন্য বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও যেতে পারছে না করোনাকালীন পরিস্থিতির জন্য। একটি বড় হাসপাতালে চেকআপের জন্য নিয়ে আসে অনন্যাকে। এই উড়নচণ্ডী মানুষটা যে এত কেয়ারিং হতে পারে, অনন্যা তা স্বপ্নেও ভাবেনি। সব রিপোর্ট দেখে ডাক্তার অপূর্বকে একা চেম্বারে ডেকে নিয়ে কিছু একটা বললেন। অপূর্ব চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল বিমর্ষ মুখে। অনন্যাকে কিছুই বলল না। অনন্যাও কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইল না। খুব বিষণ্ন মন নিয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়ে বাসার দিকে রওনা দিল। গাড়িতে রেডিওটা ছাড়তেই রবীন্দ্রসংগীত বেজে উঠল...
‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না,
শুধু সুখ চলে যায় এমনি মায়ার ছলনা।
এরা ভুলে যায় কারে ছেড়ে কারে চায়...’
গাড়ি চলছে আর দুটো মানুষ চুপচাপ বসে আছে গাড়িতে। অপূর্ব একবার জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু খাবে?’ অনন্যা মাথা নেড়ে না করল। শুধু বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘মানুষের জীবন এত ছোট কেন?’
একদিন হঠাৎ করেই মামুন ওর মাকে নিয়ে অনন্যাদের বাসায় হাজির হয়। অনন্যা তখন মাত্র বাইরে থেকে ফিরেছে। ঘরে ঢুকেই দেখে ড্রয়িংরুমে একজন মহিলা ও একটি ছেলে বসা। মামুনের সাথে অনন্যার এর আগে কখনো দেখা হয়নি। কিন্তু এটা যে সেই নিম্নচাপেরই অংশ, সেটা বুঝতে তার আর দেরি হয় না। মামুন অনন্যাকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে ওর মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগল। ড্রয়িংরুমে অনন্যার বাবা-মা আর মামুন ও মামুনের মা ছিলেন। লম্বা-চওড়া আভিজাত্যে ভরা একজন মানুষ। তাকে দেখে খারাপ লাগার মতো নয় বরং ভেতর থেকে এটা শ্রদ্ধা এল অনন্যার। সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে ভেতরে চলে গেল সে। ভেতরে গিয়ে দেখে সোমার চোখ দুটো ছলছল করছে, আর ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।
-বুবু দেখ, মামুন না বলেই ওর মাকে নিয়ে চলে এসেছে।
কিছুক্ষণ পর অনন্যার বাবা ভেতরে এসে বললেন, অনন্যা, মামুনের মা তোকে ডাকছেন।
অনন্যা ড্রয়িংরুমে যাওয়ার পর মামুনের মা বললেন, আমি তোমার বাবা-মায়ের সাথে আলাপ করেছি। সোমাকে আমি আমার ঘরের বউ করে নিতে চাই। কিন্তু তোমাকে রেখে ওনারা সোমাকে বিয়ে দেবেন না বলছেন। এখন তুমিই বলো।
অনন্যা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভেবে বলল, রাজি না হওয়ার তো কোনো কারণ দেখি না। বাবা-মা শোনো, আন্টি কত আগ্রহ করে এসেছেন, ফিরিয়ে দেওয়ার তো কিছু দেখি না।
অনন্যা সোমাকে মায়ের একটা হালকা গোলাপি রঙের জামদানি শাড়ি আর মায়ের ছোট্ট একটা গহনার সেট পরিয়ে দেয়। সবাই বলে, ওদের বোনদের নাকি দুধে-আলতা গায়ের রং। সোমার চোখগুলো ওর বাবার মতোই বড় বড়। চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে একটুখানি পারফিউমও ছড়িয়ে দিল ওর গায়ে। সোমাকে তখন স্বর্গের অপ্সরী মনে হচ্ছিল। ড্রয়িংরুমে নিয়ে যেতেই মামুনের মা এগিয়ে এসে সোমাকে নিয়ে গেলেন, আর বলতে থাকেন, আমার মামুনের পছন্দ আছে, চোখ জুড়িয়ে গেল মা। ব্যাগ থেকে একটি ডায়মন্ডের আংটি বের করে পরিয়ে দিলেন ওর হাতে।
যাওয়ার সময় মামুনের মা অনন্যার বাবাকে বলে গেলেন, খুব শিগগিরই উনি সোমাকে ঘরে তুলতে চান।
বছরখানেক পর মামুন ও সোমার বিয়ে হয়ে গেল। ওদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার সাথে সাথেই। সোমা বরাবরই অনেক মেধাবী ছিল। সব মিলিয়ে ওর লাইফ খুব ভালোভাবেই সেটেল হয়ে গেল।
অনন্যা মাস্টার্স শেষ করে চাকরির জন্য চেষ্টা করতে লাগল। খুব একটা জুতসই চাকরি হচ্ছিল না তার। এদিকে ওদের বাবাও রিটায়ারমেন্টে চলে গিয়েছেন। চাকরিটা অনেক জরুরি হয়ে পড়েছিল অনন্যার। মামুনের ফুপা একটি গ্রুপের চেয়ারম্যান। অনন্যাকে সিভিসহ মামুনের ফুপার বাসায় সোমা আর মামুন মিলে নিয়ে যায় চাকরির জন্য। মামুনের ফুপু আর ফুপার সাথে ঘরোয়া পরিবেশে অনেক আলাপ হয় তাদের। একপর্যায়ে ওনার সুপারিশে ভালো একটা চাকরিও হয় অনন্যার। এর কিছুদিন পর অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখে সোমা ও মামুন এসেছে। ওরা কিছু একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলাপ করছে। অনন্যাকে দেখেই চুপ হয়ে গেল সবাই। একপর্যায়ে নাশতার টেবিলে বসে সবই বোঝা গেল। মামুনের ফুপা তার বোনের ছেলের জন্য অনন্যাকে পছন্দ করেছেন। ছেলেটির নাম অপূর্ব। দেশের বাইরে পাইলট প্রশিক্ষণে আছে। ওনাদের ইচ্ছা ট্রেনিং শেষ করে এসে কোনো এয়ারলাইন্সে জয়েন করার। অনন্যা ঠিক বুঝতে পারছিল না, ওনারা কী কারণে ওকে পছন্দ করলেন। পরে ওকে বোঝানো হলো, ওনারা একটা সংসারী মেয়ে চান। আর যেহেতু সোমাকে ওর শ্বশুরবাড়ির সবাই খুবই পছন্দ করেন এবং অনন্যা দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী, তাই অনন্যাকে ওনারা চান।
সবকিছু ছাপিয়ে অনন্যার মাথায় ছিল ওর বাবা রিটায়ারমেন্টে চলে গেছেন, তা ছাড়া ছোট বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে ওকে রেখে। সুতরাং ওর এখন বিয়ে হয়ে যাওয়াটা জরুরি। তা ছাড়া বয়সও খুব একটা কম হয়নি তার। এদিকে অনন্যার ছোট ভাই পাভেলেরও গ্র্যাজুয়েশন শেষ। ওর একটা চাকরি দরকার। আর ছোট বোন রুমা পড়ে ক্লাস সেভেনে। বাবা-মা তাদের সংসারকে গোছাতে চাচ্ছিলেন মনেপ্রাণে। অনন্যার বিয়ের কথাবার্তা চলতে চলতে ওর ভাই পাভেলের একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি হয়ে যায় মামুনের ফুপার সুবাদে।
সবকিছু মিলিয়ে সংসারের অনেক সমস্যার সমাধান নিমেষেই হয়ে যায় সোমার শ্বশুরবাড়ির সহায়তায়। অনন্যা আর কোনো আগপিছ না ভেবে খুশিমনেই বিয়েতে সম্মতি দেয়। সংসারের প্রতি, বাবা-মায়ের প্রতি তার অনেক দরদ। পরিবারের সবাই ভালোভাবে সেটেল হোক, এটাই তার চাওয়া, নিজেকে নিয়ে অতশত ভাবে না সে।
অপূর্বর ট্রেনিং তখনো শেষ হয়নি, ওর মা-বাবা চাইলেন ফোনে ওদের আকদ সেরে নিতে। অনন্যা অজানা আশঙ্কায় দুলতে থাকে, যে মানুষটাকে সে চোখে দেখেনি তার সাথেই গাঁটছড়া বাঁধতে চলেছে সে। তবে ও সান্ত্বনা পায় এই ভেবে যে সোমা তো সুখে আছে। ওরা তো সোমার শ্বশুরবাড়িরই আত্মীয়।
এক শুক্রবার দুপুরে খুব সীমিত পরিসরে আয়োজন করে বাসায় আকদের অনুষ্ঠান হয়ে যায় ওদের। সব মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জনের আয়োজন। ফোনে আকদ হয়, ও বাড়ি থেকে দামি সব শাড়ি, গয়না, পারফিউম সবকিছুই আসে। কোনো কিছুর কমতি হয় না। অনন্যা সব সময়ই রূপবতী ছিল। সব ব্র্যান্ডের জিনিস আর রূপের ঝলকে দুই পক্ষই অনেক খুশি ছিল সেদিন। আকদের পরে অপূর্বর সাথে ফোনে দু’একটা কথা হয় অনন্যার। এর পর থেকে টুকটাক যোগাযোগ হতে থাকে তাদের। কিন্তু অনন্যা কিসের যেন একটা শূন্যতা অনুভব করে।
এর ঠিক এক মাস পর অপূর্বর আসার দিনক্ষণ ঠিক হয়। আসার দুই দিনের মাথায় বিয়ের অনুষ্ঠানের তারিখও ঠিক হয়ে যায়। অপূর্বর বাবা-মা অনন্যাকে বাসা থেকে গাড়ি করে নিয়ে যান অপূর্বকে আনার জন্য। সোমা অপূর্বকে দেওয়ার জন্য বড় একটি ফুলের তোড়া এনে দেয় অনন্যাকে। বেগুনি রঙের অর্কিড, সাথে কিছু দোলনচাঁপা আর জিপসি ফুল। গাড়িজুড়ে দোলনচাঁপার মিষ্টি সুবাস ছড়াতে থাকে। চাপা ভয় আর উৎকণ্ঠা নিয়ে এক অজানা ভবিষ্যতের কথা ভেবে আনন্দ আর আশঙ্কার দোলাচলে দুলছিল সেদিন অনন্যা। এয়ারপোর্টে যেতেই দেখতে পায়, মাঝারি উচ্চতার বেশ ফরসা একটি মানুষ ট্রলি ঠেলে ঠেলে সামনের দিকে আসছে। ছেলেটা অনন্যা থেকে যেন বেশ একটু আলাদা। ফুলের তোড়াটা নিয়ে কাছে যেতেই পারফিউম ও সিগারেটের মিশ্রণে বেশ ঝাঁজালো একটা গন্ধ নাকে আসে অনন্যার। মনটা খুব বিষণ্ন হয়ে যায় তার।
অনন্যাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে শুধু অপূর্ব গাড়ি থেকে নেমে অনন্যার বাবা-মাকে একটু সালাম দিয়ে হাই-হ্যালো করে চলে যায়। অনন্যার মা মন খারাপ করে বলতে থাকেন, আমরা কি মেয়েকে ঠিক জায়গায়ই বিয়ে দিচ্ছি। আমার কিন্তু মন টানছে না অনন্যার বাপ।
Ñআরে দূর, সোমা সংসার করছে না। টাকা-পয়সা বেশি থাকলে মানুষ একটু-আধটু এলোমেলো হয়ে থাকে। ও কিছু না, ওগুলো নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই।
অনন্যার বাবা তার সর্বস্ব দিয়ে মেয়ের বিয়ের আয়োজন করতে থাকেন। কোথাও কোনো কিছুর কমতি রাখতে চান না তিনি। ও বাড়ির লোকজনও সবকিছুতে খুবই খুশি। ওনাদের কথাÑআপনি আপনার সাধ্যমতো করেন, আমাদের কোনো সমস্যা নেই।
বিয়ের রাত থেকেই স্বপ্নভাঙা শুরু হয় অনন্যার। অপূর্ব ঘরে এসে অনন্যার সাথে কথাবার্তা বললেও তার মনোযোগ ছিল অন্য কোথাও। এর মধ্যে একটি ওভারসিজ কল এলে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে ইংরেজিতে কথা বলতে থাকে অপূর্ব। ওপাশের কথা শুনতে না পেলেও অনন্যা এটা বেশ বুঝতে পারছিল, অপূর্ব বারবার করে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে যাবেÑএটাই বোঝাতে চাচ্ছে। অনন্যা মনে মনে ভাবতে থাকে, এই সুন্দর ঘরবাড়ি তার হলেও সংসারটা কতটুকু তার হবে, কে জানে? বারান্দা থেকে এসে সে ড্রিঙ্ক করা শুরু করে। অনন্যা কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ে।
বিয়ের একদিন পর বউভাতের অনুষ্ঠান হয়। এলাহি কাণ্ডকারখানা, বিশাল আয়োজন। অপূর্বর দাদা-বাবা দুজনই যেহেতু সামাজিকভাবে ভালো অবস্থানে ছিলেন, সমাজের উঁচু পর্যায়ের লোকজন সবাইকে এ অনুষ্ঠানে পাওয়া গিয়েছিল সেদিন। অনন্যার আত্মীয়স্বজন সবাই বলাবলি করতে লাগল, অনন্যা অনেক ভাগ্যবতী, এত বড় ঘরে ওর বিয়ে হয়েছে।
অপূর্ব কখনোই অনন্যার সাথে কোনো খারাপ আচরণ করেনি। কিন্তু সে একজন হারিয়ে যাওয়া মানুষ ছিল, কাছে থেকেও কাছে ছিল না। অনন্যা আস্তে আস্তে সবকিছুই আবিষ্কার করতে লাগল। দেশের বাইরে থাকাকালীন একটা স্প্যানিশ মেয়ের সাথে ওর প্রেম ছিল। যে কারণে অপূর্বর বাবা-মা অপূর্বকে অনেকটা জোর করে দেশে এনে তড়িঘড়ি করে বিয়েটা দিয়েছেন। এত দিনে অনন্যা বুঝতে পারে, কী কারণে ওকে এত পছন্দ হয়েছিল ওনাদের। ওনারা ধরেই নিয়েছিলেন, মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে এসে ঠিকই ঘরমুখী করতে পারবে উড়নচণ্ডী অপূর্বকে।
বিয়ের কিছুদিন পরই অপূর্ব বিদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। এটা নিয়ে ওর বাবা-মায়ের সাথে তুমুল ঝগড়া হয়। ওনাদের কথাবার্তা থেকে সবই পরিষ্কার বুঝতে পারে অনন্যা। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে একপর্যায়ে অপূর্বর বাবা স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হন। অপূর্ব নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বাইরে যাবার ব্যাপারটা থেকে সরে আসে। অনন্যার সাথে ওর সম্পর্কটা অনেকটা অযাচিতভাবেই টিকে যায়।
অপূর্ব তার জীবন থেকে অনন্যাকে সরাতেও পারছিল না আবার গ্রহণও করতে পারছিল না মন থেকে। এভাবেই চলতে থাকে সংসার। অনন্যা থাকে চুপচাপ নিরুত্তর, কোনো কিছুতেই কোনো উচ্চবাচ্য করে না সে। অনন্যা ওর পরিবারকে এসব কোনো কিছুই জানায় না। ওনারা ধরেই নেন, ওনাদের দুই মেয়েরই খুব ভালো পরিবারে বিয়ে হয়েছে এবং ওরা ভালোও আছে। আর কেনই-বা হবে না, ওনাদের মেয়ে দুটোও তো রূপে-গুণে কোনো অংশে কম নয়। অপূর্ব ওর বাবা-মায়ের চাপাচাপিতে সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটা স্থগিত রাখে আর দেশে থেকেই পাইলট হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করে।
অপূর্ব নিজেকে বাবা-মায়ের পছন্দের ছেলে হয়ে ওঠার জন্য চেষ্টা করতে শুরু করে। ওর বাবা-মা অনেকটা জোর করেই দুজনকে বাইরে ঘুরতে পাঠান। দুজন মিলে অস্ট্রেলিয়ার ভিজিট ভিসা নিয়ে মাসখানেক ঘুরে আসে। হানিমুনে যাওয়ার ব্যাপার না থাকলেও অনেকটা হানিমুনের মতোই হয়ে যায় ব্যাপারটা। দুজনের মধ্যে খুব একটা প্রাণখোলা সম্পর্ক তৈরি না হলেও আস্তে আস্তে স্বামী-স্ত্রীর একটা বন্ধন তৈরি হতে থাকে দুজনের মাঝে।
এর কিছুদিন পরই অনন্যা টের পায়, সে মা হতে যাচ্ছে। ওই সময়টাতে যত্ন-আত্তির কোনোই অভাব হয়নি অনন্যার। শুধু অভাব ছিল মানুষটার মনোযোগের। নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে জন্ম নেয় ওদের মেয়ে প্রিয়ন্তী। অপূর্বও অনেক খুশি হয় মেয়েকে পেয়ে। অনন্যা বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকে পুরোটা সময়। আর অপূর্ব ব্যস্ত থাকে ফ্লাইট নিয়ে। শুরু থেকেই দুটো মানুষের মনের মিল ছিল না, তার ওপর বাচ্চা হওয়ার পর তাদের নিজেদের মধ্যে দূরত্ব আরও বেড়ে যায়।
অপূর্বর ফ্লাইটের বিভিন্ন সময়ে শিডিউল থাকে, তাকে সময়মতো ঘুমিয়ে নিতে হয়। এভাবেই সে বেডরুম ছেড়ে গেস্টরুমে নিজেকে সেট করে নেয়। এতে অপূর্ব আর অনন্যার মাঝে যা কিছুটা আন্তরিকতা তৈরি হয়েছিল, তাতেও ভাটা পড়ে যায়। অপূর্ব কখন ফ্লাইটে যায়, কখন আসে, এগুলো নিয়ে অনন্যা আর খুব একটা খেয়ালও করতে পারে না। ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে অফিসে জয়েন করতে বললে শ্বশুর-শাশুড়ি বাধা দেন। সংসার, বাচ্চা এগুলো সামাল দেওয়ার কথা বলেন। অনন্যাও ওনাদের কথা মেনে নেয়। ছকে বাঁধা বন্দিজীবন কাটতে থাকে অনন্যার।
অনন্যা একপর্যায়ে সোমা আর মামুনের কাছে সবকিছু খুলে বললে ওরা জানায়, স্প্যানিশ মেয়েটার সাথে যোগাযোগ না থাকলেও অপূর্বর আরও অনেকের সাথেই নতুন করে যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অনন্যা ওর অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু অনন্যার প্রতি তার কোনো মনোযোগই ছিল না।
অপূর্বর অবহেলা ধীরে ধীরে অনন্যাকে অনেক প্রতিবাদী করে তুলেছিল। এভাবেই দিন যায়, বছর যায়। বাচ্চার বয়স তিন বছর হয়ে গেলে ওকে স্কুলে ভর্তি করে দেয় অনন্যা। একাকিত্ব আর অবহেলা নিতে নিতে অনন্যা অনেকটা ডিপ্রেশনে চলে যায়।
একসময় ডাক্তারের পরামর্শে অনন্যা অনেকটা জোর করেই শ্বশুরের অফিসে বসতে শুরু করে। ব্যাপারটা অনন্যার শাশুড়ি একদম পছন্দ করছিলেন না। যাও উনি এতকাল ওর পক্ষের লোক ছিলেন, উনিও এখন অনন্যাকে আগের মতো সবকিছুতে সাপোর্ট করতে চান না, যদিও শ্বশুর ব্যাপারটাকে খুবই পজিটিভভাবে দেখছিলেন। অনন্যা এই প্রথম বুঝতে পারে, এই পরিবারের সবাই তার ডানাটা কেটে দিতে চান। ওনারা অনন্যাকে ওনাদের পুতুল বানিয়ে রাখতে চান। দিনে দিনে অনন্যা অনেকটা জেদি আর উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে।
অফিসের কাজের খাতিরেই মইনুলের সাথে পরিচয় হয় অনন্যার। প্রায়ই ফোনে কথা হয় দুজনের। অনন্যা প্রাণখুলে কথা বলার একজন মানুষ খুঁজে পায়। অফিস শেষে মাঝে মাঝে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায় দুজন মিলে। অনন্যার শাশুড়ি সবকিছু দেখেশুনে ভীষণ খেপতে থাকেন। অপূর্ব এসব কোনো কিছুই মাথায় নেয় না। সে তার মতো করে জীবন কাটাতে থাকে। এসব ঝুটঝামেলায় পরিবারে সব সময় হইচই, চিৎকার-চেঁচামেচি, মান-অভিমান চলতেই থাকে। একপর্যায়ে অনন্যাদের ছেড়ে ওনারা ওনাদের বাগানবাড়িতে গিয়ে ওঠেন।
এদিকে যতই দিন যায় অনন্যা ও মইনুল দুজনের প্রতি দুজনের ভালোবাসা আর আস্থার জায়গাটা বাড়তে থাকে। একটা সময়ের সবকিছু মেনে নেওয়া মানুষটা বদলে গিয়ে বেপরোয়া হতে থাকে। অনন্যার এই চালচলনে কারও খুব একটা কথা বলারও জায়গা থাকে না। কিছুদিন পরপর অনন্যা দেশের বাইরে ঘুরতে গেলে মইনুলও সাথে যায় কাউকে কিছু না জানিয়ে। এভাবেই অপূর্ব তার মতো করে এবং অনন্যা তার মতো করে বাঁচতে শেখে। বাবা-মায়ের আদর্শ মেয়ে হিসেবে কোনটা নীতি আর কোনটা নীতি নয় অথবা কোনটা আদর্শের বাইরে, সেটা ভুলে যেতে থাকে অনন্যা।
একাকিত্ব কাটিয়ে প্রত্যেকে যার যার মতো করে ভালোই সময় কাটাচ্ছিল। তারপর হঠাৎ করেই করোনা সবার জীবনে অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসে। লম্বা সময় ধরে করোনার কারণে ব্যবসা আর আগের অবস্থায় চালানো যাচ্ছিল না। যদিও ব্যবসার অবস্থা অনেক আগেই খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছিল। একপর্যায়ে দেখা গেল, অফিস চালু রাখতে গেলে লাভের চেয়ে লসই হচ্ছে বেশি। শ্বশুরের পরামর্শে অনন্যা অফিস বন্ধ করে দিল।
এদিকে করোনার কারণে অপূর্বর ফ্লাইটও বন্ধ হয়ে গেল। ওদের মেয়েরও অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। তিনজনেরই বাইরে যাওয়া বন্ধ। জীবনে এই প্রথমবার তিনটি প্রাণী একসাথে বাসায় থাকা শিখল। এদিকে মইনুলও তার ব্যবসা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে আছে। করোনার কারণে সবার মতো তার ব্যবসাও আগের মতো ঠিকঠাক চলছিল না। আজকাল অনন্যার সাথে খুব একটা কথাও হয় না তার। কেমন যেন প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সংসারে মনোযোগী হওয়া শুরু করল। করোনা অনেক কিছুই কেড়ে নিয়ে পরিবারের বন্ধনগুলো ঠিক করতেই যেন এসেছিল।
বাসায় তিনটা প্রাণী একসাথে সময় কাটানো শুরু করল। বুয়ারাও এখন কাজে নেই। অনলাইনে বাজার-সদাই করে নিজেরা রান্নাবান্না করে খায়। ওয়াশিং মেশিনে কাপড়চোপড় ধুয়ে তিনজন মিলে ছাদে ছড়িয়ে দিতে যায়। একসাথে সময় কাটানোই এখন একমাত্র বিনোদন তাদের। এত বছর পর এই প্রথম অপূর্ব অনন্যার দিকে ভালো করে চোখ মেলে দেখে। মনে মনে ভাবে, অনন্যা যে এত সুন্দর একটা মানুষ, তা আগে কখনো চোখেই পড়েনি। সংসারেও তো বেশ আনন্দ আছে।
একা একা ভাবে, এগুলো তো কখনোই তার জীবনে পাওয়া হয়নি। যখন খুব ছোট, তখনই দার্জিলিংয়ে পাঠানো হলো পড়াশোনা করার জন্য। তারপর আমেরিকায় পাইলট ট্রেনিংয়ে চলে গেল সে। বছরে দু-একবার ছুটি কাটাতে দেশে আসা। পরিবারের সুখ, আনন্দ কেমন হয় কখনোই জানার সুযোগ হয়নি তার।
মেয়ে বাবার পেছনে পেছনে হাঁটে আর বলে, ‘বাবা, বাবা, আমাদের অনেক ফান হচ্ছে, তাই না?’
অপূর্ব হাসে আর মাথা নাড়ে। মনে মনে ভাবে, চাইলে জীবনকে আরও অনেক গুছিয়ে সাজানো যেত।
আজকাল অপূর্ব আর অনন্যার মাঝে টুকটাক গল্প-আড্ডাও হয়। ওর প্রতি অপূর্বর মনোযোগ ওর খুব একটা খারাপ লাগে না। যদিও ওরা যার যার রুমে থাকে। কিন্তু একসাথে খাওয়াদাওয়া, বিকেলে একটু ছাদে যাওয়া, একসাথে মুভি দেখা, সবকিছু মিলিয়ে খুব একটা খারাপ সময় কাটে না তাদের। একদিন রাতে অনন্যার প্রচণ্ড জ্বর এলে ওদের মেয়ে দৌড়ে গিয়ে বাবার কাছে জানায়। করোনা হয়েছে কি না ভেবে মেয়েকে আলাদা রুমে পাঠিয়ে অপূর্ব অনন্যার পাশে থাকে।
কত বছর ওরা একসাথে এক রুমে সময় কাটায় না, তার কোনো হিসাব নেই। শুরুতে অনন্যার বেশ একটু অস্বস্তি কাজ করলেও পরে সব কেটে যায়।
আজকাল মানুষটার প্রতি কেমন যেন একটা মায়া কাজ করে। অনন্যাও ভাবে, মানুষটা যদি আগে থেকেই এ রকম ঠিকঠাক হতো, তাহলে জীবনটা অন্য রকম হতে পারত। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে মইনুলকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। অনন্যা এটা নিয়ে একটু উৎকণ্ঠার মধ্যেও আছে। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না কিন্তু ভেতর থেকে অশান্তি লাগছে তার।
একদিন দুপুরে ওরা তিনজন একসাথে খাবার খাচ্ছিল। হঠাৎ অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে।
Ñম্যাডাম, আমি মইনুল স্যারের অফিসে কাজ করি, মইনুল স্যার করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আইসিইউতে আছেন। আমি ওনার আর আপনার ব্যাপারটা জানি। উনি অসুস্থ অবস্থায় ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে আপনার নাম ধরে ডাকেন। আমি আপনার নাম্বার জোগাড় করে আপনাকে ফোন দিলাম। ওনার অবস্থা ভালো নয়।
অনন্যা ভয়ে-কষ্টে কুঁকড়ে যায়। বিষয়টা কাউকে বলতেও পারছিল না সে। শুধু অপূর্বকে জানাল, তার এক বন্ধু করোনায় আক্রান্ত এবং তার অবস্থা ভালো নয়। এর দুদিন পর খবর এল, মইনুল আর বেঁচে নেই।
কাউকে কিছু না বলেই অনন্যা দৌড়ে হাসপাতালে যায়। গিয়ে দেখে মইনুলকে হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে, দূরে দাঁড়িয়ে আছে মইনুলের বউ আর তিন বছর বয়সী মেয়ে। ওখানে কারও সাথেই কোনো কথা না বলে চলে আসে অনন্যা।
কিছুদিন ধরে অনন্যার শরীরটা খুবই খারাপ যাচ্ছে। ডাক্তার কোনোভাবেই বের করতে পারছে না কী কারণে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বারবার কমে যাচ্ছে। অপূর্ব ওর বেশ যত্ন করার চেষ্টা করছে। এই জুস ওই জুস বানিয়ে দিচ্ছে। মানুষটা মন থেকে খুব একটা খারাপ নয়। কিন্তু কোনো কিছুতেই অনন্যার শরীরটা সুস্থ হচ্ছে না। আজ খুব করে মইনুলের কথা মনে পড়ছে অনন্যার। কেমন আছে ওর সন্তান, স্ত্রী, ওর মা, কিছুই তো জানে না সে। মানুষটা না বলেই চলে গেল।
সম্পর্কহীন একটা সম্পর্ক ছিল মানুষটার সাথে। শুধু দিয়ে গেছে কিছু মিষ্টি স্মৃতি। পৃথিবী থেকে চলে গিয়েই কি সবকিছু ঠিকঠাক করতে চেয়েছে সে অনন্যার?
আজকাল কারও সাথে কথা বলতে একদম ইচ্ছে হয় না তার। শরীরটা একদম ঠিক যাচ্ছে না। অপূর্ব ট্রিটমেন্টের জন্য বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও যেতে পারছে না করোনাকালীন পরিস্থিতির জন্য। একটি বড় হাসপাতালে চেকআপের জন্য নিয়ে আসে অনন্যাকে। এই উড়নচণ্ডী মানুষটা যে এত কেয়ারিং হতে পারে, অনন্যা তা স্বপ্নেও ভাবেনি। সব রিপোর্ট দেখে ডাক্তার অপূর্বকে একা চেম্বারে ডেকে নিয়ে কিছু একটা বললেন। অপূর্ব চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল বিমর্ষ মুখে। অনন্যাকে কিছুই বলল না। অনন্যাও কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইল না। খুব বিষণ্ন মন নিয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়ে বাসার দিকে রওনা দিল। গাড়িতে রেডিওটা ছাড়তেই রবীন্দ্রসংগীত বেজে উঠল...
‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না,
শুধু সুখ চলে যায় এমনি মায়ার ছলনা।
এরা ভুলে যায় কারে ছেড়ে কারে চায়...’
গাড়ি চলছে আর দুটো মানুষ চুপচাপ বসে আছে গাড়িতে। অপূর্ব একবার জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু খাবে?’ অনন্যা মাথা নেড়ে না করল। শুধু বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘মানুষের জীবন এত ছোট কেন?’