এ বছর দুটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। সৌভাগ্য এ জন্য বলছি, আজকাল আমেরিকায় বসবাসরত বাঙালি ছেলেমেয়ে এবং তাদের পরিবারের সম্মতি অনুযায়ী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া অনেকটা আকাশ-কুসুম স্বপ্নের মতো।
ইমিগ্র্যান্ট বাবা-মায়ের একমাত্র স্বপ্ন ছেলেমেয়েদের প্রচুর পড়াশোনা করাবেন। ওরা অনেক ভালো পজিশনে জব করবে। এত পড়াশোনা করতে করতে, ভালো জব করতে করতে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্ম কখন যে পেছনে ফেলে অনেক দূরে অগ্রসর হয়ে যায়, সন্তানদের জন্য তা কল্পনাতীত।
ইমিগ্র্যান্ট বাবা-মা সব সময় চিন্তা করেন, তারা আমেরিকায় আসার পর যেসব ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়েছে, তাদের সন্তানেরা যেন সেগুলোর সম্মুখীন না হয়। যেসব বাচ্চা বাংলাদেশ থেকে কিছুটা বড় হয়ে এসেছে, যেমন ধরুন প্রাইমারি স্কুল বা হাইস্কুল শেষ করে এসেছে, এখানে আসার পর কলেজে গ্র্যাজুয়েশন করার পর ভালো জব করছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের শৈশব ও কৈশোর যেখানে পার করেছে, তারা সে দেশের সঙ্গে অনেকটাই কানেকটেড। তারা এখানে রুচিশীল কোনো পরিবারের সঙ্গে বিয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়, নইলে বাংলাদেশে গিয়ে বিয়ে করে। অন্যদিকে যেসব ইমিগ্র্যান্ট পরিবারের বাচ্চার আমেরিকায় জন্ম হয়েছে, তাদের ব্যাপারটা পুরোটাই আলাদা।
আমেরিকান বাচ্চাদের থিঙ্কিং প্রসেসটা পুরোই আলাদা। বাবা-মা বাসায় যতই সংস্কৃতি আর ধর্মচর্চা করুক, বাচারা স্কুলে এবং বাইরে যা কিছু দেখে, সে তাতেই বেশি প্রভাবিত হয়। এখানে অভিভাবকদের দোষ দেওয়া যায় না, কারণ তারা তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করেন বাচ্চাদের সঠিক পথে গাইড করার জন্য। সন্তানদেরও দোষ তেমন দেওয়া যায় না, কারণ একদিকে দেশীয় সংস্কৃতি, অন্যদিকে পশ্চিমা সংস্কৃতি। বাচ্চাদের এতে করে দোটানার মধ্যে বড় হতে হয়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে বয়সে ছেলেমেয়েদের একজন বন্ধুর দরকার হয়, সে বয়সে তাদের আশপাশে যোগ্য বা দেশি ছেলেমেয়ে খুঁজে না পাওয়ার কারণে ছেলেমেয়েরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাচ্চারা যখন বড় হয়, তখন অনেক উচ্চশিক্ষিত বাবা-মাও বাকরুদ্ধ এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক এবং হতাশার কথা হচ্ছে, যখন দ্বিতীয় প্রজন্মের বাচ্চারা বলে বসে বাঙালি পরিবারেই কেন বিয়ে করতে হবে কিংবা বিয়েই-বা কেন করতে হবে? নির্বিকার আর হতাশাগ্রস্ত বাবা-মায়ের তখন আর কোনো কিছু বলার থাকে না।
একটা ব্যাপার খুব অবাক লাগে, একটি পরিবারের দুটি মেয়ে ও একটি ছেলে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে একজন বাঙালি ছেলের সঙ্গে, ছোট মেয়ের বিয়ে হয়েছে একজন পাকিস্তানি ছেলের সঙ্গে এবং ছেলের বিয়ে হয়েছে একজন স্প্যানিশ মেয়ের সঙ্গে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওই পরিবারের বাবা-মা ছেলেমেয়ে তিনজনকেই একই কালচার এবং ধার্মিক শিক্ষা দিয়েছেন কিন্তু ছেলেমেয়ে তিনজন তিন ধরনের ডিসিশন নেওয়ার পেছনে আসল কারণটা কী।
এটা হচ্ছে একটা মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। যাই হোক, আসল কারণটা কী? সেখানে কি এজ গ্যাপ নাকি জেনারেশন গ্যাপ?
যুগের দোষ দেব না, কারণ যুগ এ জন্য দায়ী নয়। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগেও বাংলাদেশে বাবা-মায়ের অমতে প্রেম করে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে এ রকম অনেক ঘটনা আছে। আর বর্তমানে মডার্ন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগের কথা তো বাদই দিলাম। সবার হাতে মোবাইল ফোন। আর ফেসবুকে চলছে অবাধ বন্ধুত্ব এবং প্রেমের কাহিনি। কত কিছু হয়ে যাচ্ছে নজরের অগোচরে। এসব দিক দিয়ে বাংলাদেশ অবশ্য আমেরিকা থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে আছে।
এবার এই পরিবারের তিন ছেলেমেয়ের গল্প বলা যাক। বড় মেয়ে নাইমা কলেজ গ্র্যাজুয়েশন করার পর বাবা-মা উঠেপড়ে লেগেছেন তাকে বিয়ে দিতে। আমেরিকায় উপযুক্ত ছেলে খুঁজে পাচ্ছিলেন না বলে বাধ্য হয়ে মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে উপযুক্ত ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলের বংশ খানদান ভালো। ছেলে দেখতে সুদর্শন, লম্বা, ইঞ্জিনিয়ার।
বিয়ের পর আমেরিকায় এসে নাইমা তার বরের জন্য অ্যাপ্লাই করে। ইমিগ্রেশনে আসতে কারও ছয় মাস লাগে, কারও নয় মাসও লাগতে পারে। যা-ই হোক, নাইমার অ্যাপ্লাই করার পর ছয় মাসের চেয়ে বেশি সময় লাগছিল বলে নাইমাকে তখন থেকেই অনেক কথা শুনতে হয়েছিল শ্বশুরের পরিবারের পক্ষ থেকে। তাদের বক্তব্য, তাদের আশপাশে পরিচিত অনেকে ছয় মাসের মধ্যে কীভাবে চলে গিয়েছে এবং সে কেন আসতে পারছে না। নাইমার বর ইঞ্জিনিয়ার জহির আমেরিকায় আসার আগে থেকেই নাইমার প্রতি মানসিক প্রেশার ও ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল শুরু হয়।
আমেরিকায় আসার পর জহিরের এখানকার পরিবেশ, সামাজিকতা সবকিছুর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে বেশ কিছু সময় লেগেছে। তারা কিছুদিন নাইমার বাবার বাসায় ছিল, তাদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করা পর্যন্ত। মাটি শক্ত করতে করতে তিন বছর চলে যায়। তত দিনে জহির সিটিজেন হয়ে তার বাবা-মায়ের জন্য অ্যাপ্লাই করে। বাবা-মায়ের জন্য অ্যাপ্লাই করার দেড় বছরের মধ্যেই তারা আমেরিকায় চলে আসেন। নাইমা এত দিন জহিরের মানসিক অত্যাচার সহ্য করেছে, এবার আবার শ্বশুর-শাশুড়ির দায়ভার তার কাঁধে পড়েছে। তত দিনে তার ঘরে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের আগমন ঘটেছে।
সংসার এবং চারদিকের সামাজিকতা ও বাবা-মায়ের কথা চিন্তা করে এবং তার ছোট আরেকটি ভাই ও বোনের বিয়ে বাকি আছে তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নাইমা সব ধরনের মানসিক অত্যাচার সহ্য করে সংসার করে যাচ্ছে।
এবার দ্বিতীয় বোন সায়মার কথায় আসা যাক। সায়মা কলেজে পড়াশোনা করা অবস্থায় আদিল নামের এক পাকিস্তানি ছেলের সঙ্গে তার প্রেম হয়। পাকিস্তানি ছেলের পরিবারও আমেরিকায় বসবাসরত। কলেজ গ্র্যাজুয়েশনের পর বাবা-মা যখন বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগেন, তখন সে আদিলের কথা বলে। তার পরিবার রাজি না হওয়ায় সে আদিলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে কোর্ট ম্যারেজ করে।
বাবা-মা প্রথম দিকে এই বিয়ে মেনে না নিলেও বিয়ের দুই বছর পর যখন সায়মার বাচ্চা হয়, তখন নাতিকে দেখে আর না মেনে নিতে পারেননি। পরে দুই পরিবার মিলিত হয়েছে এবং এখন তাদের মধ্যে আসা-যাওয়া হচ্ছে।
সায়মার সঙ্গে তার হাজবেন্ডের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো এবং সে বেশ সুখে আছে। তার শ্বশুরের পরিবার তাদের নিজের বাড়িতে থাকে এবং সায়মাদের নিজের আলাদা বাড়িতে তারা থাকে। শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে আসা-যাওয়া আছে। সবাই যার যার প্রাইভেসি এবং একটা সুন্দর, সুস্থ পরিবেশ মেনটেইন করছে।
এবার ছেলে সিয়ামের কথায় আসা যাক। সে একজন আইনজীবী। একটি ল’ ফার্মে কাজ করা অবস্থায় স্প্যানিশ মেয়ে ল’ইয়ার মারিয়ার সঙ্গে তার পরিচয় ও প্রেম হয়। পরে সে মারিয়ার কথা তার পরিবারে বলার পরে পরিবারের সবাই অসম্মতি জানায়। তখন সিয়াম সবাইকে বলে, বিয়ে যদি করতে হয়, তাহলে মারিয়াকেই করবে, নইলে সে কাউকে বিয়ে করবে না। একপর্যায়ে বাবা-মা বাধ্য হয়ে বিয়েতে রাজি হন। বিয়ের পরে সিয়াম তার বউকে নিয়ে আলাদা নিজের বাড়িতে থাকে এবং পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসা-যাওয়া হয়, দেখা-সাক্ষাৎ হয়।
যা-ই হোক, প্রত্যেক বাবা-মা স্বপ্ন দেখেন ছেলেমেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী দেখে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করবেন। তারা সুখে-শান্তিতে পরিবার নিয়ে থাকবে। অনেক বাবা-মায়ের স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যায়, সন্তানদের বিয়ের ঝলক দেখার ভাগ্য অনেকের হয় না। আর অনেক সময় ইচ্ছার বিরুদ্ধেও পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেক কিছু মেনে নিতে হয়।
লেখক : কলামিস্ট, মেরিল্যান্ড
ইমিগ্র্যান্ট বাবা-মায়ের একমাত্র স্বপ্ন ছেলেমেয়েদের প্রচুর পড়াশোনা করাবেন। ওরা অনেক ভালো পজিশনে জব করবে। এত পড়াশোনা করতে করতে, ভালো জব করতে করতে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্ম কখন যে পেছনে ফেলে অনেক দূরে অগ্রসর হয়ে যায়, সন্তানদের জন্য তা কল্পনাতীত।
ইমিগ্র্যান্ট বাবা-মা সব সময় চিন্তা করেন, তারা আমেরিকায় আসার পর যেসব ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়েছে, তাদের সন্তানেরা যেন সেগুলোর সম্মুখীন না হয়। যেসব বাচ্চা বাংলাদেশ থেকে কিছুটা বড় হয়ে এসেছে, যেমন ধরুন প্রাইমারি স্কুল বা হাইস্কুল শেষ করে এসেছে, এখানে আসার পর কলেজে গ্র্যাজুয়েশন করার পর ভালো জব করছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের শৈশব ও কৈশোর যেখানে পার করেছে, তারা সে দেশের সঙ্গে অনেকটাই কানেকটেড। তারা এখানে রুচিশীল কোনো পরিবারের সঙ্গে বিয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়, নইলে বাংলাদেশে গিয়ে বিয়ে করে। অন্যদিকে যেসব ইমিগ্র্যান্ট পরিবারের বাচ্চার আমেরিকায় জন্ম হয়েছে, তাদের ব্যাপারটা পুরোটাই আলাদা।
আমেরিকান বাচ্চাদের থিঙ্কিং প্রসেসটা পুরোই আলাদা। বাবা-মা বাসায় যতই সংস্কৃতি আর ধর্মচর্চা করুক, বাচারা স্কুলে এবং বাইরে যা কিছু দেখে, সে তাতেই বেশি প্রভাবিত হয়। এখানে অভিভাবকদের দোষ দেওয়া যায় না, কারণ তারা তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করেন বাচ্চাদের সঠিক পথে গাইড করার জন্য। সন্তানদেরও দোষ তেমন দেওয়া যায় না, কারণ একদিকে দেশীয় সংস্কৃতি, অন্যদিকে পশ্চিমা সংস্কৃতি। বাচ্চাদের এতে করে দোটানার মধ্যে বড় হতে হয়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে বয়সে ছেলেমেয়েদের একজন বন্ধুর দরকার হয়, সে বয়সে তাদের আশপাশে যোগ্য বা দেশি ছেলেমেয়ে খুঁজে না পাওয়ার কারণে ছেলেমেয়েরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাচ্চারা যখন বড় হয়, তখন অনেক উচ্চশিক্ষিত বাবা-মাও বাকরুদ্ধ এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক এবং হতাশার কথা হচ্ছে, যখন দ্বিতীয় প্রজন্মের বাচ্চারা বলে বসে বাঙালি পরিবারেই কেন বিয়ে করতে হবে কিংবা বিয়েই-বা কেন করতে হবে? নির্বিকার আর হতাশাগ্রস্ত বাবা-মায়ের তখন আর কোনো কিছু বলার থাকে না।
একটা ব্যাপার খুব অবাক লাগে, একটি পরিবারের দুটি মেয়ে ও একটি ছেলে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে একজন বাঙালি ছেলের সঙ্গে, ছোট মেয়ের বিয়ে হয়েছে একজন পাকিস্তানি ছেলের সঙ্গে এবং ছেলের বিয়ে হয়েছে একজন স্প্যানিশ মেয়ের সঙ্গে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওই পরিবারের বাবা-মা ছেলেমেয়ে তিনজনকেই একই কালচার এবং ধার্মিক শিক্ষা দিয়েছেন কিন্তু ছেলেমেয়ে তিনজন তিন ধরনের ডিসিশন নেওয়ার পেছনে আসল কারণটা কী।
এটা হচ্ছে একটা মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। যাই হোক, আসল কারণটা কী? সেখানে কি এজ গ্যাপ নাকি জেনারেশন গ্যাপ?
যুগের দোষ দেব না, কারণ যুগ এ জন্য দায়ী নয়। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগেও বাংলাদেশে বাবা-মায়ের অমতে প্রেম করে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে এ রকম অনেক ঘটনা আছে। আর বর্তমানে মডার্ন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগের কথা তো বাদই দিলাম। সবার হাতে মোবাইল ফোন। আর ফেসবুকে চলছে অবাধ বন্ধুত্ব এবং প্রেমের কাহিনি। কত কিছু হয়ে যাচ্ছে নজরের অগোচরে। এসব দিক দিয়ে বাংলাদেশ অবশ্য আমেরিকা থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে আছে।
এবার এই পরিবারের তিন ছেলেমেয়ের গল্প বলা যাক। বড় মেয়ে নাইমা কলেজ গ্র্যাজুয়েশন করার পর বাবা-মা উঠেপড়ে লেগেছেন তাকে বিয়ে দিতে। আমেরিকায় উপযুক্ত ছেলে খুঁজে পাচ্ছিলেন না বলে বাধ্য হয়ে মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে উপযুক্ত ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলের বংশ খানদান ভালো। ছেলে দেখতে সুদর্শন, লম্বা, ইঞ্জিনিয়ার।
বিয়ের পর আমেরিকায় এসে নাইমা তার বরের জন্য অ্যাপ্লাই করে। ইমিগ্রেশনে আসতে কারও ছয় মাস লাগে, কারও নয় মাসও লাগতে পারে। যা-ই হোক, নাইমার অ্যাপ্লাই করার পর ছয় মাসের চেয়ে বেশি সময় লাগছিল বলে নাইমাকে তখন থেকেই অনেক কথা শুনতে হয়েছিল শ্বশুরের পরিবারের পক্ষ থেকে। তাদের বক্তব্য, তাদের আশপাশে পরিচিত অনেকে ছয় মাসের মধ্যে কীভাবে চলে গিয়েছে এবং সে কেন আসতে পারছে না। নাইমার বর ইঞ্জিনিয়ার জহির আমেরিকায় আসার আগে থেকেই নাইমার প্রতি মানসিক প্রেশার ও ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল শুরু হয়।
আমেরিকায় আসার পর জহিরের এখানকার পরিবেশ, সামাজিকতা সবকিছুর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে বেশ কিছু সময় লেগেছে। তারা কিছুদিন নাইমার বাবার বাসায় ছিল, তাদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করা পর্যন্ত। মাটি শক্ত করতে করতে তিন বছর চলে যায়। তত দিনে জহির সিটিজেন হয়ে তার বাবা-মায়ের জন্য অ্যাপ্লাই করে। বাবা-মায়ের জন্য অ্যাপ্লাই করার দেড় বছরের মধ্যেই তারা আমেরিকায় চলে আসেন। নাইমা এত দিন জহিরের মানসিক অত্যাচার সহ্য করেছে, এবার আবার শ্বশুর-শাশুড়ির দায়ভার তার কাঁধে পড়েছে। তত দিনে তার ঘরে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের আগমন ঘটেছে।
সংসার এবং চারদিকের সামাজিকতা ও বাবা-মায়ের কথা চিন্তা করে এবং তার ছোট আরেকটি ভাই ও বোনের বিয়ে বাকি আছে তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নাইমা সব ধরনের মানসিক অত্যাচার সহ্য করে সংসার করে যাচ্ছে।
এবার দ্বিতীয় বোন সায়মার কথায় আসা যাক। সায়মা কলেজে পড়াশোনা করা অবস্থায় আদিল নামের এক পাকিস্তানি ছেলের সঙ্গে তার প্রেম হয়। পাকিস্তানি ছেলের পরিবারও আমেরিকায় বসবাসরত। কলেজ গ্র্যাজুয়েশনের পর বাবা-মা যখন বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগেন, তখন সে আদিলের কথা বলে। তার পরিবার রাজি না হওয়ায় সে আদিলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে কোর্ট ম্যারেজ করে।
বাবা-মা প্রথম দিকে এই বিয়ে মেনে না নিলেও বিয়ের দুই বছর পর যখন সায়মার বাচ্চা হয়, তখন নাতিকে দেখে আর না মেনে নিতে পারেননি। পরে দুই পরিবার মিলিত হয়েছে এবং এখন তাদের মধ্যে আসা-যাওয়া হচ্ছে।
সায়মার সঙ্গে তার হাজবেন্ডের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো এবং সে বেশ সুখে আছে। তার শ্বশুরের পরিবার তাদের নিজের বাড়িতে থাকে এবং সায়মাদের নিজের আলাদা বাড়িতে তারা থাকে। শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে আসা-যাওয়া আছে। সবাই যার যার প্রাইভেসি এবং একটা সুন্দর, সুস্থ পরিবেশ মেনটেইন করছে।
এবার ছেলে সিয়ামের কথায় আসা যাক। সে একজন আইনজীবী। একটি ল’ ফার্মে কাজ করা অবস্থায় স্প্যানিশ মেয়ে ল’ইয়ার মারিয়ার সঙ্গে তার পরিচয় ও প্রেম হয়। পরে সে মারিয়ার কথা তার পরিবারে বলার পরে পরিবারের সবাই অসম্মতি জানায়। তখন সিয়াম সবাইকে বলে, বিয়ে যদি করতে হয়, তাহলে মারিয়াকেই করবে, নইলে সে কাউকে বিয়ে করবে না। একপর্যায়ে বাবা-মা বাধ্য হয়ে বিয়েতে রাজি হন। বিয়ের পরে সিয়াম তার বউকে নিয়ে আলাদা নিজের বাড়িতে থাকে এবং পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসা-যাওয়া হয়, দেখা-সাক্ষাৎ হয়।
যা-ই হোক, প্রত্যেক বাবা-মা স্বপ্ন দেখেন ছেলেমেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী দেখে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করবেন। তারা সুখে-শান্তিতে পরিবার নিয়ে থাকবে। অনেক বাবা-মায়ের স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যায়, সন্তানদের বিয়ের ঝলক দেখার ভাগ্য অনেকের হয় না। আর অনেক সময় ইচ্ছার বিরুদ্ধেও পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেক কিছু মেনে নিতে হয়।
লেখক : কলামিস্ট, মেরিল্যান্ড