(গত সংখ্যার পর)
তিনি একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার অবদানকে অস্বীকার করে যতটা সম্ভব ততটাই অপমানে ক্ষত-বিক্ষত করে তার চাকরিচ্যুতির মতো ঘটনা ঘটিয়ে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর কাছে নতি স্বীকার করেছিলেন। এ ঘটনার কারণে পরবর্তী সময়ে ভারতের বড় ভাইসুলভ মনোভাবের বিস্তৃতি ঘটেছে বহুগুণ বেশি। হয়তো পরবর্তীকালে ওই রকম বড় আকারের সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনা আর ঘটেনি কোনো দিন, কিন্তু সীমান্তে অবাধে বাংলাদেশি নিরপরাধ মানুষকে বিনা কারণে হত্যার ঘটনা ঘটেই চলেছে। সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীÑশুধু এই এক কথাকে সম্বল করে এ পর্যন্ত অসংখ্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে বিএসএফ। এর মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ জঘন্য মাত্রার অপরাধের অন্যতম ছিল ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ১৫ বছর বয়সী ফেলানী নামের এক কিশোরীকে তারা হত্যার পর লাশটা কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখে। এই ঘটনা বিশ্ব বিবেককে একেবারে হতবাক করে দিয়েছিল। এ-সংক্রান্ত খবরের অংশবিশেষ হলো গত ১০ বছরে বাংলাদেশের প্রায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ বিএসএফ সীমান্তরক্ষীর হাতে খুন হয়েছেন। তারা শুধু অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন না, সীমান্তবর্তী ধানের খেতে কর্মরত অবস্থায় ছিলেন কেউ, কেউ হয়তো খালে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে পানিতে নেমেছিলেন। অধিকন্তু সীমান্ত রক্ষার নামে রাষ্ট্র কর্তৃক বিএসএফ সদস্যদেরকে ‘শ্যুট অন সাইট’ (দেখামাত্র গুলি করা) নীতি নামক যে দায়মুক্তি অধ্যাদেশের মতো মানবাধিকার পরিপন্থী আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তার পেছনে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি।
শেখ হাসিনার বিগত ১৬ বছরের ইতিহাস হচ্ছে ভারতের প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য প্রদর্শনের ইতিহাস। হাসিনা সরকারের প্রতি ভারতের সর্বোচ্চ প্রশাসনের অধিকারবোধের বিষয়টা সে কারণেই অন্যমাত্রার উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছেছিল এবং হাসিনা সরকারের সেই মনোভাবকে কাজে লাগিয়েই ভারত ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে ভয়াবহ ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটানোর সাহস দেখিয়েছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল নয়টার সময় পিলখানার দরবার হলে অনুষ্ঠিতব্য বার্ষিক সমাবেশে ওইদিন সারা দেশ থেকে ২ হাজার ৫৬০ জন বিডিআর সদস্য উপস্থিত হয়েছিলেন। বিডিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের স্ত্রীদের নিয়েও সভাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সভার শুরুতে বিডিআরের মহাপরিচালক শাকিল আহমদ যখন মাইক্রোফোন হাতে নিয়েছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে উপস্থিত বিডিআর সদস্যদের মধ্য থেকে কেউ একজন তার দিকে রাইফেল উঁচিয়ে ধরলে গন্ডগোলের সূত্রপাত। ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ৯টা ৩০ মিনিট। ঘটনার ২০ মিনিটের মধ্যে র্যাব ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। খবর পেয়ে সকাল ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে সেনাবাহিনী পৌঁছাল পিলখানায়। তার আগে অবশ্য সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ফোন এতটাই ব্যস্ত ছিল যে মইন উ আহমেদের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা সম্ভব হয়ে উঠল না। তা সত্ত্বেও তিনি তার বাহিনীকে নিয়ে পিলখানায় উপস্থিত হলেন।
শেখ হাসিনার পতনের পর বিদেশি মিডিয়ায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মঈন উ আহমেদ বলেন, যখন পিলখানার দরবার হলে প্রবেশের জন্য অপেক্ষমাণ ছিলেন তিনি, তখন সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে তাকে ভেতরে যেতে নিষেধ করে বলা হয়েছিল, সরকার বিষয়টাকে রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাজেই সেনাবাহিনী যেন ব্যারাকে ফিরে যায়। তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে সোহেল তাজ তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন, যদিও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তার বনিবনা না হওয়ায় অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ছিলেন তিনি। যেহেতু তার পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে থাকে, তাই ওই ঘটনার সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই ছিলেন। সোহেল তাজের ভাষ্য ছিল, ‘খবরটা শুনেই আমি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি আমাকে ধমকের সুরে জবাব দিলেন, আমেরিকায় থেকে দেশ নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে। বিষয়টা আমি দেখব।’
ফলে টানা দুই দিন ধরে পিলখানার ভেতরে ভয়াবহ এক হত্যাকাণ্ডের মহোৎসব চলল এবং সত্য হলো সরকারের ছত্রচ্ছায়াই সংঘটিত হলো সবকিছু। এত বড় হত্যাকাণ্ডের খবর প্রচারে জাতীয় প্রচারমাধ্যম বিটিভি যেহেতু আগাগোড়া নীরবতা পালন করল, সে কারণে অন্যান্য প্রচার মিডিয়াও দেশবাসীকে জানানোর জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে সাহস দেখাল না।
২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে টানা ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের অবসান ঘটল। পিলখানার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করল পুলিশ। ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধান মিলল পিলখানার ভেতরে গণকবরের। সাত ফুট গভীর গর্তের মধ্যে সেই ৪২ জন অফিসারকে বিদ্রোহীরা মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিল। এ ছাড়া ড্রেন টানেলের ভেতরে পাওয়া গেল আরও ৫৮ জনের লাশ। তার মধ্যে ৫২ জন ছিলেন সেনা কর্মকর্তা। নিহতের তালিকায় তখন ৭৪ জনের নাম উঠেছে। এত বড় ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সরকারের চামচারা তখন নানামুখী প্রচারণায় মেতে উঠতে শুরু করেছে। এত দিন বিএনপিকে দোষারূপ করা হলেও এবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয় সরাসরি সেনাবাহিনীর দিকে আঙুল তুললেন। তার ভাষ্যমতে, ‘জাতিসংঘ মিশনে যাওয়ার সুযোগ থেকে বিডিআর সদস্যদেরকে বঞ্চিত করাসহ রেশন বৈষম্য এবং ডাল-ভাত কর্মসূচির নামে টাকা আত্মসাৎসহ নানা বিষয়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ বিডিআরের অভিযোগের কোনো সীমা ছিল না। সেখান থেকেই এই বিদ্রোহের সূত্রপাত এবং এই হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটাল তারা।’
বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে সরকার থেকে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। দোষীরা সেই সাধারণ ক্ষমার ঘোষণাকে গ্রহণ করেই পুলিশের হাতে অস্ত্র সমর্পণ করেছিল সেদিন। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো, জাতির ইতিহাসে এত বড় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটানোর সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত ছিলেন, তাদের নাম সামনে এল না কোনো দিন। সরকার তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে যতটা সম্ভব অপরাধীদের আড়াল করার জন্য। প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, অপরাধীদের দরবার হল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে যতটা সম্ভব সময় দেওয়া হলো, যেন তারা পরনের কাপড় বদলে সাধারণ বেশে বের হয়ে যেতে পারেন। সেই সময়ে কেউ কেউ গলা ছেড়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানও দিলেন। দু-একজন চিৎকার করে জানান দিলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর মানুষ।’
এরা কারা ছিল? ছদ্মবেশের অন্তরালে অন্য কোনো দেশের বাসিন্দা ছিল কি? তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন সাহারা খাতুন। তার সঙ্গে তখন যোগ দিয়েছেন ফজলে নূর তাপস ও জাহাঙ্গীর কবির নানক। এই কয়েকজনকে ছোটাছুটি করতে দেখা গেল। বাদবাকিরা এই ঘটনায় যাদের এগিয়ে আসার কথা ছিল, তাদেরকে সর্বোচ্চ প্রশাসন থেকে চুপ থাকছে বলা হয়েছে। সেনাবাহিনীকে তখন দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা গেল এবং ঘটনার দিন সকালে যখন ক্যাপ্টেন শফিকের নেতৃত্বে র্যাবের ৩৫৫ জন সদস্য পিলখানার গেটে অবস্থান করছিলেন, তাদেরকে তখন ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো না। বলা হলো, বিষয়টা প্রধানমন্ত্রী দেখছেন। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, অপরাধীরা যদিও পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করল, কিন্তু পরে ওই ঘটনার তদন্তকাজে পর্যন্ত পুলিশের আইজিকে জড়িত হতে না দিয়ে আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে দাবি উঠল, বিচারটা যেন সামরিক আদালতের পরিবর্তে বেসামরিক আদালতে নেওয়া হয়।
ওই ঘটনার সময় অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ডিনারে যোগ দেওয়ার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রীর। ঘটনার আগেই মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, অনিবার্য কারণে প্রধানমন্ত্রী ডিনারে যোগ দিতে পারবেন না। বিষয়টা কেমন হলো? জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ডিনারে যোগ দিতে আগেই প্রধানমন্ত্রীকে নিষেধ করে দিয়েছিল? কিন্তু উনি তো সব খবরই জানতেন, শুধু কলকাঠি নাড়িয়েছেন অন্তরাল থেকে। সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে অপরাধীদের মধ্য থেকে শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন পালিয়ে গিয়েছিলেন দুবাই। এক ভিডিও বার্তায় দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র জয় দুবাইতে গিয়ে তাদের কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করে কয়েকটা মুখবন্ধ সাদা খাম তুলে দিলেন তাদের হাতে।
অনেকের মতে, ঘটনাটার সঙ্গে শুধু ‘র’ জড়িত ছিল না, সঙ্গে ছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। জয়ের বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন ইহুদি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। অনেকের মতে, ওই ঘটনার পেছনে জয়ের সেই ইহুদি বংশোদ্ভূত স্ত্রীর একটা ভূমিকা ছিল।
তিনি একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার অবদানকে অস্বীকার করে যতটা সম্ভব ততটাই অপমানে ক্ষত-বিক্ষত করে তার চাকরিচ্যুতির মতো ঘটনা ঘটিয়ে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর কাছে নতি স্বীকার করেছিলেন। এ ঘটনার কারণে পরবর্তী সময়ে ভারতের বড় ভাইসুলভ মনোভাবের বিস্তৃতি ঘটেছে বহুগুণ বেশি। হয়তো পরবর্তীকালে ওই রকম বড় আকারের সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনা আর ঘটেনি কোনো দিন, কিন্তু সীমান্তে অবাধে বাংলাদেশি নিরপরাধ মানুষকে বিনা কারণে হত্যার ঘটনা ঘটেই চলেছে। সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীÑশুধু এই এক কথাকে সম্বল করে এ পর্যন্ত অসংখ্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে বিএসএফ। এর মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ জঘন্য মাত্রার অপরাধের অন্যতম ছিল ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ১৫ বছর বয়সী ফেলানী নামের এক কিশোরীকে তারা হত্যার পর লাশটা কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখে। এই ঘটনা বিশ্ব বিবেককে একেবারে হতবাক করে দিয়েছিল। এ-সংক্রান্ত খবরের অংশবিশেষ হলো গত ১০ বছরে বাংলাদেশের প্রায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ বিএসএফ সীমান্তরক্ষীর হাতে খুন হয়েছেন। তারা শুধু অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন না, সীমান্তবর্তী ধানের খেতে কর্মরত অবস্থায় ছিলেন কেউ, কেউ হয়তো খালে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে পানিতে নেমেছিলেন। অধিকন্তু সীমান্ত রক্ষার নামে রাষ্ট্র কর্তৃক বিএসএফ সদস্যদেরকে ‘শ্যুট অন সাইট’ (দেখামাত্র গুলি করা) নীতি নামক যে দায়মুক্তি অধ্যাদেশের মতো মানবাধিকার পরিপন্থী আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তার পেছনে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি।
শেখ হাসিনার বিগত ১৬ বছরের ইতিহাস হচ্ছে ভারতের প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য প্রদর্শনের ইতিহাস। হাসিনা সরকারের প্রতি ভারতের সর্বোচ্চ প্রশাসনের অধিকারবোধের বিষয়টা সে কারণেই অন্যমাত্রার উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছেছিল এবং হাসিনা সরকারের সেই মনোভাবকে কাজে লাগিয়েই ভারত ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে ভয়াবহ ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটানোর সাহস দেখিয়েছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল নয়টার সময় পিলখানার দরবার হলে অনুষ্ঠিতব্য বার্ষিক সমাবেশে ওইদিন সারা দেশ থেকে ২ হাজার ৫৬০ জন বিডিআর সদস্য উপস্থিত হয়েছিলেন। বিডিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের স্ত্রীদের নিয়েও সভাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সভার শুরুতে বিডিআরের মহাপরিচালক শাকিল আহমদ যখন মাইক্রোফোন হাতে নিয়েছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে উপস্থিত বিডিআর সদস্যদের মধ্য থেকে কেউ একজন তার দিকে রাইফেল উঁচিয়ে ধরলে গন্ডগোলের সূত্রপাত। ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ৯টা ৩০ মিনিট। ঘটনার ২০ মিনিটের মধ্যে র্যাব ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। খবর পেয়ে সকাল ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে সেনাবাহিনী পৌঁছাল পিলখানায়। তার আগে অবশ্য সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ফোন এতটাই ব্যস্ত ছিল যে মইন উ আহমেদের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা সম্ভব হয়ে উঠল না। তা সত্ত্বেও তিনি তার বাহিনীকে নিয়ে পিলখানায় উপস্থিত হলেন।
শেখ হাসিনার পতনের পর বিদেশি মিডিয়ায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মঈন উ আহমেদ বলেন, যখন পিলখানার দরবার হলে প্রবেশের জন্য অপেক্ষমাণ ছিলেন তিনি, তখন সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে তাকে ভেতরে যেতে নিষেধ করে বলা হয়েছিল, সরকার বিষয়টাকে রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাজেই সেনাবাহিনী যেন ব্যারাকে ফিরে যায়। তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে সোহেল তাজ তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন, যদিও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তার বনিবনা না হওয়ায় অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ছিলেন তিনি। যেহেতু তার পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে থাকে, তাই ওই ঘটনার সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই ছিলেন। সোহেল তাজের ভাষ্য ছিল, ‘খবরটা শুনেই আমি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি আমাকে ধমকের সুরে জবাব দিলেন, আমেরিকায় থেকে দেশ নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে। বিষয়টা আমি দেখব।’
ফলে টানা দুই দিন ধরে পিলখানার ভেতরে ভয়াবহ এক হত্যাকাণ্ডের মহোৎসব চলল এবং সত্য হলো সরকারের ছত্রচ্ছায়াই সংঘটিত হলো সবকিছু। এত বড় হত্যাকাণ্ডের খবর প্রচারে জাতীয় প্রচারমাধ্যম বিটিভি যেহেতু আগাগোড়া নীরবতা পালন করল, সে কারণে অন্যান্য প্রচার মিডিয়াও দেশবাসীকে জানানোর জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে সাহস দেখাল না।
২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে টানা ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের অবসান ঘটল। পিলখানার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করল পুলিশ। ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধান মিলল পিলখানার ভেতরে গণকবরের। সাত ফুট গভীর গর্তের মধ্যে সেই ৪২ জন অফিসারকে বিদ্রোহীরা মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিল। এ ছাড়া ড্রেন টানেলের ভেতরে পাওয়া গেল আরও ৫৮ জনের লাশ। তার মধ্যে ৫২ জন ছিলেন সেনা কর্মকর্তা। নিহতের তালিকায় তখন ৭৪ জনের নাম উঠেছে। এত বড় ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সরকারের চামচারা তখন নানামুখী প্রচারণায় মেতে উঠতে শুরু করেছে। এত দিন বিএনপিকে দোষারূপ করা হলেও এবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয় সরাসরি সেনাবাহিনীর দিকে আঙুল তুললেন। তার ভাষ্যমতে, ‘জাতিসংঘ মিশনে যাওয়ার সুযোগ থেকে বিডিআর সদস্যদেরকে বঞ্চিত করাসহ রেশন বৈষম্য এবং ডাল-ভাত কর্মসূচির নামে টাকা আত্মসাৎসহ নানা বিষয়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ বিডিআরের অভিযোগের কোনো সীমা ছিল না। সেখান থেকেই এই বিদ্রোহের সূত্রপাত এবং এই হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটাল তারা।’
বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে সরকার থেকে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। দোষীরা সেই সাধারণ ক্ষমার ঘোষণাকে গ্রহণ করেই পুলিশের হাতে অস্ত্র সমর্পণ করেছিল সেদিন। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো, জাতির ইতিহাসে এত বড় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটানোর সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত ছিলেন, তাদের নাম সামনে এল না কোনো দিন। সরকার তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে যতটা সম্ভব অপরাধীদের আড়াল করার জন্য। প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, অপরাধীদের দরবার হল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে যতটা সম্ভব সময় দেওয়া হলো, যেন তারা পরনের কাপড় বদলে সাধারণ বেশে বের হয়ে যেতে পারেন। সেই সময়ে কেউ কেউ গলা ছেড়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানও দিলেন। দু-একজন চিৎকার করে জানান দিলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর মানুষ।’
এরা কারা ছিল? ছদ্মবেশের অন্তরালে অন্য কোনো দেশের বাসিন্দা ছিল কি? তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন সাহারা খাতুন। তার সঙ্গে তখন যোগ দিয়েছেন ফজলে নূর তাপস ও জাহাঙ্গীর কবির নানক। এই কয়েকজনকে ছোটাছুটি করতে দেখা গেল। বাদবাকিরা এই ঘটনায় যাদের এগিয়ে আসার কথা ছিল, তাদেরকে সর্বোচ্চ প্রশাসন থেকে চুপ থাকছে বলা হয়েছে। সেনাবাহিনীকে তখন দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা গেল এবং ঘটনার দিন সকালে যখন ক্যাপ্টেন শফিকের নেতৃত্বে র্যাবের ৩৫৫ জন সদস্য পিলখানার গেটে অবস্থান করছিলেন, তাদেরকে তখন ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো না। বলা হলো, বিষয়টা প্রধানমন্ত্রী দেখছেন। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, অপরাধীরা যদিও পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করল, কিন্তু পরে ওই ঘটনার তদন্তকাজে পর্যন্ত পুলিশের আইজিকে জড়িত হতে না দিয়ে আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে দাবি উঠল, বিচারটা যেন সামরিক আদালতের পরিবর্তে বেসামরিক আদালতে নেওয়া হয়।
ওই ঘটনার সময় অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ডিনারে যোগ দেওয়ার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রীর। ঘটনার আগেই মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, অনিবার্য কারণে প্রধানমন্ত্রী ডিনারে যোগ দিতে পারবেন না। বিষয়টা কেমন হলো? জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ডিনারে যোগ দিতে আগেই প্রধানমন্ত্রীকে নিষেধ করে দিয়েছিল? কিন্তু উনি তো সব খবরই জানতেন, শুধু কলকাঠি নাড়িয়েছেন অন্তরাল থেকে। সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে অপরাধীদের মধ্য থেকে শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন পালিয়ে গিয়েছিলেন দুবাই। এক ভিডিও বার্তায় দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র জয় দুবাইতে গিয়ে তাদের কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করে কয়েকটা মুখবন্ধ সাদা খাম তুলে দিলেন তাদের হাতে।
অনেকের মতে, ঘটনাটার সঙ্গে শুধু ‘র’ জড়িত ছিল না, সঙ্গে ছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। জয়ের বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন ইহুদি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। অনেকের মতে, ওই ঘটনার পেছনে জয়ের সেই ইহুদি বংশোদ্ভূত স্ত্রীর একটা ভূমিকা ছিল।