যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নানা বিচারে ঐতিহাসিক এবং গুরুত্ববহনকারী (কনসিকোয়েন্সিয়াল)। এই প্রথমবার একজন আইনে দণ্ডিত (ফৌজদারি ও দেওয়ানি), আগের নির্বাচনে পরাজিত, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধাদানকারী এবং বয়সজনিত স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন আরেক ঐতিহাসিক সংযোজন একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রাউন কালারের নারী প্রার্থী কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে। নির্বাচনের জরিপগুলো হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস এবং সিয়েনা কলেজের সুইং রাজ্যগুলোতে সর্বশেষ জরিপ এ রকম : পেনসিলভানিয়া-হ্যারিস ১+, উইসকনসিন-হ্যারিস ১+, মিশিগান-হ্যারিস ১+, নেভাদা-হ্যারিস ১+, জর্জিয়া-ট্রাম্প ২+, নর্থ ক্যারোলিনা-ট্রাম্প ২+, অ্যারিজোনা-সমান সমান, টেক্সাস-ট্রাম্প-৬+, মিনেসোটা-হ্যারিস ৬+। নির্বাচনের এখনো প্রায় দুই সপ্তাহ বাকি আছে, এর মধ্যেই ফলাফল অনেকটা স্পষ্ট হবে। এ লেখক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, কমলা হ্যারিসই বিজয়ী হবেন। এখন অভিবাসী হিসেবে আমরা কাকে ভোট দেব এবং কেন দেব, সেটা কি আমরা একটু ভেবে দেখতে পারি?
রিপাবলিকান : ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬-২০২০ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন প্রশাসনিক অনিয়ম, নিপোটিজম, অদক্ষতা এবং পরাজিত হয়েও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করেছিলেন। তার ওই চার বছরের শাসনামল নিয়ে ‘বিজনেস ইনসাইডারের’ রিপোর্ট অনুযায়ী অন্তত ২২টি বেস্ট সেলার বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে মাইকেল ওল্ফের ‘ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি’, বব উডওয়ার্ডের ‘ফিয়ার’, ক্লিফ সিমসের ‘টিম অব ভাইপারস’, ভিকি ওয়ার্ডের ‘কুসনার ইনক, গ্রিড, অ্যামবিশন, করাপশন’, ফিলিপ রাকারের ‘এ স্টেবল জিনিয়াস’ অন্যতম। এসব বইতে ট্রাম্প প্রশাসনের অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, অযোগ্যতা এবং দায়িত্বহীনতার এক করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। মাইকেল ওল্ফের ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি বই থেকে একটা ঘটনার উদাহরণ দিলে একটা চিত্র পাওয়া যাবে। ট্রাম্পের জামাতা জেরেট কুশনার এফবিআইয়ের সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স পায়নি কিন্তু তাকে রাষ্ট্রের অত্যন্ত সেনসিটিভ কাগজপত্র দেখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। পরে তার চিফ অব স্টাফ জন কেলি সেটা বন্ধ করে দিলে ট্রাম্প কেলিকে চাকরি থেকে অপসারণ করেন। আমেরিকায় ঘটনার সত্যতা যাচাই করার ‘ফ্যাক্ট চেক’ নামে একটি বেসরকারি সংগঠন আছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ট্রাম্প তার চার বছরের শাসনামলে ৪০ হাজারেরও বেশি অসত্য কথা বলেছেন। তার অসত্য কথা বলার একটা উদাহরণ : ভারতের নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটন সফর করে যাওয়ার মাসখানেক পর পাকিস্তানের ইমরান খান ওয়াশিংটন সফরে এলে ইমরান খানকে ট্রাম্প বলেন, নরেন্দ্র মোদি তাকে কাশ্মীর ইস্যুতে মধ্যস্থতা করতে বলেছেন। ইমরান খান খুশি হয়ে বললেন, তার সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করবে। ভারতীয় প্রেসে যখন খবরটা জানাজানি হয়ে গেল, ভারতের পররাষ্ট্র দফতর থেকে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করলে ট্রাম্প প্রশাসন একদম চুপ মেরে যায়। এ ছাড়া তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি বিশ্বব্যবস্থার জন্য সহায়ক নয়। তিনি রাশিয়ার স্বার্থে অথবা আমেরিকায় অর্থ ব্যয় কমাতে ইউরোপীয় সিকিউরিটির প্রয়োজনে ন্যাটোতে থাকতে চান না। ট্রাম্প থাকলে হয়তো এত দিনে ইউক্রেন রাশিয়ার এবং তাইওয়ান চীনের পেটে চলে যেত। তার শাসনামলের উচ্চ পর্যায়ের কেবিনেট সদস্যরা, যেমন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট, জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান, দুজন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, চিফ অব স্টাফ, সামরিক জয়েন্ট চিফ অব স্টাফÑসবাই ট্রাম্পকে আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য হুমকি মনে করেন।
এখন প্রশ্ন করা যেতেই পারে, এমন লোক সাদা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এত জনপ্রিয় হন কেমন করে? এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন নিউইয়র্কার ম্যাগাজিনের একজন রিপোর্টার ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রাক্কালে। তিনি লিখেছেন, আমেরিকায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে নন-সাদা লোকজন আসতে আসতে সাদাদের আধিক্য বা প্রভাব ক্রমশ কমে যাওয়ায় তারা মনঃকষ্টে ভুগছিল এবং কোনো পলিটিশিয়ানই এই বিষয়টির দিকে নজর দেননি। কিন্তু ট্রাম্প খুব সুচতুরভাবে হোয়াইট সুপ্রিমেসি গ্রুপ, কেকেক, রাসলিম্ব (প্রয়াত), স্টিভ বেননদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুসলমানদের এ দেশে আসা বন্ধ, হেইতিয়ানদের তাচ্ছিল্য করা, ইউরোপিয়ানরা কম আসে কেন এসব প্রশ্ন তুলে সাদাদের মন জয় করে নিয়েছেন। অবশ্য শিক্ষিত সাদা এবং শহরাঞ্চলের সাদা মহিলাদের ভোট তিনি খুব কম পান। এবার তো এবরশন ইস্যুতে মহিলা ভোটাররা ট্রাম্পকে ভোট দেবেন না। এই মুহূর্তে তার মানসিক অবস্থার অবনতির বিষয়টি নিয়ে নিউজ মিডিয়ায় খুব আলোচনা চলছে। তিনি বিভিন্ন মিডিয়ায় যেসব সাক্ষাৎকার দেওয়ার কথা ছিল, তা একে একে বাতিল করছেন। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রতি খুব বেশি সহানুভূতিশীল। ২০১৬-২০২০ শাসনামলে ফিলিস্তিন, জর্ডান বা জাতিসংঘ, কারোরই অনুমোদন ছাড়া পূর্ব জেরুজালেম ও গোলানহাইটকে ইসরায়েলের হাতে তুলে দেন। এবার ক্ষমতায় গেলে পুরো গাজা ইসরায়েলের হাতে তুলে দেবেন।
ডেমোক্র্যাট : কমলা হ্যারিস কালারড এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলে সাদাদের আগ্রহ একটু কম, এমনকি তারা ডেমোক্র্যাট হলেও। ইমিগ্রেশন বা বর্ডার ইস্যুতে ডেমোক্র্যাটরা লিবারেল বিধায় ট্রাম্প সব নির্বাচনী সভায় কমলা হ্যারিসকে ঝাড়েন এবং এতে কিছু ফলও পান। কমলা হ্যারিসের আরেকটি দুর্বলতা মুসলমানদের ভোট, বিশেষ করে সুইং রাজ্য মিশিগানে। মধ্যপ্রাচ্যে বাইডেন অন্ধভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করায় সেই রাজ্যের মুসলমানরা প্রকাশ্যেই বলছেন, তারা ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেবেন না। অথচ এ রাজ্যটি জয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য বাইডেন সরে যাওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কমলা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে একটু ভারসাম্য বজায় রেখে কথা বলার চেষ্টা করেন। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবার আমেরিকার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করায় কিছু ডেমোক্র্যাট সন্দেহ করেন নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে জেতানোর জন্যই হামাস/লেবাননের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হচ্ছেন না। সে কারণে আড়ালে প্রেসিডেন্ট বাইডেন নেতানিয়াহুকে বিশ্রী ভাষায় গালমন্দ করেছেন, যা অতি সম্প্রতি বব উডওয়ার্ডের নতুন একটি বই ‘ওয়ারে’ লেখা হয়েছে। বাইডেনের অজনপ্রিয়তায় কমলা হ্যারিস বলতে শুরু করেছেন, তার প্রশাসন বাইডেনের বর্ধিতাংশ হবে না, তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনায় দেশ চালাবেন। ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম বিতর্কে ট্রাম্পকে পরাজিত এবং বিভিন্ন মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন।
আমরা : বাংলাদেশি অভিবাসীরা কালেক্টিভলি কাকে সমর্থন করব? দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা আওয়ামী লীগ-বিএনপির দূরত্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মার্কিন নির্বাচনেও আমরা বিভক্ত হয়ে গিয়েছি। আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা ট্রাম্পের কট্টর ভক্ত হয়ে গিয়েছে। সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন ডেমোক্র্যাটদের পরাজয় দেখার জন্য। কদিন আগে নিউইয়র্কের এক ছেলের সঙ্গে ফোনালাপে ছেলেটি বলছিল, ট্রাম্প জিতে যাবে। শেখ হাসিনা খুশি হয়ে বলেছিলেন, সব কর্মী যেন লোকাল কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় দুই লাখ ডলারে কোনো এক লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছেন। শেখ হাসিনার পতনের আগেও আওয়ামী লীগের বন্ধুদের কাছে শুনতাম, ট্রাম্প জিতলে মোদির প্রভাব ব্যবহার করে শেখ হাসিনার সব মুশকিল আসান করা যাবে। তাই তারা সবাই ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা ট্রাম্পকে ভোট দিতেই পারেন, কিন্তু ট্রাম্পকে ভোট দিলেও নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ায় কিছু আসবে যাবে না। আর ট্রাম্প জিতলেই কি শেখ হাসিনা গদি ফিরে পাবেন? বিষয়টি এত সহজ নয়। শেখ হাসিনা কিছু কারণে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছেন, যার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুব সহজ নয় বা মোদি চাইলেই ট্রাম্প সব উঠিয়ে নিতে পারবেন না। আমরা কালেক্টিভলি কী কী চাই? আমরা চাই আমাদের মা, বাবা, ভাই, বোনদের এ দেশে আনতে; কিছু মেডিকেল সুযোগ-সুবিধা; বাংলাদেশ থেকে আরও ছাত্রছাত্রীর পড়ার সুযোগ; রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশকে আর্থিক সহযোগিতা, শুল্কমুক্ত ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাধান। ট্রাম্প তো মুসলিম-বিদ্বেষী। ইমিগ্র্যান্টদের ফ্যামিলি ভিসা বন্ধ, কোনো ভিজিট ভিসা নিয়ে কারও আমেরিকায় সন্তান জন্মালেও নাগরিকত্ব না দেওয়া, ইসরায়েল ব্যতীত অন্য কোনো দেশকে সাহায্য না দেওয়া-এগুলোই ট্রাম্পের পলিসি। নিউইয়র্ক বা ক্যালিফোর্নিয়া বাদে আমরা যদি পেনসিলভানিয়া, মিশিগান, উইসকনসিন, নেভাদা বা জর্জিয়ার ভোটার হই; তাহলে আমাদের অল্প কটি ভোটই আমাদের চাহিদায় বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।
-নিউইয়র্ক
রিপাবলিকান : ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬-২০২০ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন প্রশাসনিক অনিয়ম, নিপোটিজম, অদক্ষতা এবং পরাজিত হয়েও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করেছিলেন। তার ওই চার বছরের শাসনামল নিয়ে ‘বিজনেস ইনসাইডারের’ রিপোর্ট অনুযায়ী অন্তত ২২টি বেস্ট সেলার বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে মাইকেল ওল্ফের ‘ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি’, বব উডওয়ার্ডের ‘ফিয়ার’, ক্লিফ সিমসের ‘টিম অব ভাইপারস’, ভিকি ওয়ার্ডের ‘কুসনার ইনক, গ্রিড, অ্যামবিশন, করাপশন’, ফিলিপ রাকারের ‘এ স্টেবল জিনিয়াস’ অন্যতম। এসব বইতে ট্রাম্প প্রশাসনের অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, অযোগ্যতা এবং দায়িত্বহীনতার এক করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। মাইকেল ওল্ফের ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি বই থেকে একটা ঘটনার উদাহরণ দিলে একটা চিত্র পাওয়া যাবে। ট্রাম্পের জামাতা জেরেট কুশনার এফবিআইয়ের সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স পায়নি কিন্তু তাকে রাষ্ট্রের অত্যন্ত সেনসিটিভ কাগজপত্র দেখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। পরে তার চিফ অব স্টাফ জন কেলি সেটা বন্ধ করে দিলে ট্রাম্প কেলিকে চাকরি থেকে অপসারণ করেন। আমেরিকায় ঘটনার সত্যতা যাচাই করার ‘ফ্যাক্ট চেক’ নামে একটি বেসরকারি সংগঠন আছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ট্রাম্প তার চার বছরের শাসনামলে ৪০ হাজারেরও বেশি অসত্য কথা বলেছেন। তার অসত্য কথা বলার একটা উদাহরণ : ভারতের নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটন সফর করে যাওয়ার মাসখানেক পর পাকিস্তানের ইমরান খান ওয়াশিংটন সফরে এলে ইমরান খানকে ট্রাম্প বলেন, নরেন্দ্র মোদি তাকে কাশ্মীর ইস্যুতে মধ্যস্থতা করতে বলেছেন। ইমরান খান খুশি হয়ে বললেন, তার সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করবে। ভারতীয় প্রেসে যখন খবরটা জানাজানি হয়ে গেল, ভারতের পররাষ্ট্র দফতর থেকে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করলে ট্রাম্প প্রশাসন একদম চুপ মেরে যায়। এ ছাড়া তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি বিশ্বব্যবস্থার জন্য সহায়ক নয়। তিনি রাশিয়ার স্বার্থে অথবা আমেরিকায় অর্থ ব্যয় কমাতে ইউরোপীয় সিকিউরিটির প্রয়োজনে ন্যাটোতে থাকতে চান না। ট্রাম্প থাকলে হয়তো এত দিনে ইউক্রেন রাশিয়ার এবং তাইওয়ান চীনের পেটে চলে যেত। তার শাসনামলের উচ্চ পর্যায়ের কেবিনেট সদস্যরা, যেমন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট, জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান, দুজন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, চিফ অব স্টাফ, সামরিক জয়েন্ট চিফ অব স্টাফÑসবাই ট্রাম্পকে আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য হুমকি মনে করেন।
এখন প্রশ্ন করা যেতেই পারে, এমন লোক সাদা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এত জনপ্রিয় হন কেমন করে? এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন নিউইয়র্কার ম্যাগাজিনের একজন রিপোর্টার ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রাক্কালে। তিনি লিখেছেন, আমেরিকায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে নন-সাদা লোকজন আসতে আসতে সাদাদের আধিক্য বা প্রভাব ক্রমশ কমে যাওয়ায় তারা মনঃকষ্টে ভুগছিল এবং কোনো পলিটিশিয়ানই এই বিষয়টির দিকে নজর দেননি। কিন্তু ট্রাম্প খুব সুচতুরভাবে হোয়াইট সুপ্রিমেসি গ্রুপ, কেকেক, রাসলিম্ব (প্রয়াত), স্টিভ বেননদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুসলমানদের এ দেশে আসা বন্ধ, হেইতিয়ানদের তাচ্ছিল্য করা, ইউরোপিয়ানরা কম আসে কেন এসব প্রশ্ন তুলে সাদাদের মন জয় করে নিয়েছেন। অবশ্য শিক্ষিত সাদা এবং শহরাঞ্চলের সাদা মহিলাদের ভোট তিনি খুব কম পান। এবার তো এবরশন ইস্যুতে মহিলা ভোটাররা ট্রাম্পকে ভোট দেবেন না। এই মুহূর্তে তার মানসিক অবস্থার অবনতির বিষয়টি নিয়ে নিউজ মিডিয়ায় খুব আলোচনা চলছে। তিনি বিভিন্ন মিডিয়ায় যেসব সাক্ষাৎকার দেওয়ার কথা ছিল, তা একে একে বাতিল করছেন। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রতি খুব বেশি সহানুভূতিশীল। ২০১৬-২০২০ শাসনামলে ফিলিস্তিন, জর্ডান বা জাতিসংঘ, কারোরই অনুমোদন ছাড়া পূর্ব জেরুজালেম ও গোলানহাইটকে ইসরায়েলের হাতে তুলে দেন। এবার ক্ষমতায় গেলে পুরো গাজা ইসরায়েলের হাতে তুলে দেবেন।
ডেমোক্র্যাট : কমলা হ্যারিস কালারড এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলে সাদাদের আগ্রহ একটু কম, এমনকি তারা ডেমোক্র্যাট হলেও। ইমিগ্রেশন বা বর্ডার ইস্যুতে ডেমোক্র্যাটরা লিবারেল বিধায় ট্রাম্প সব নির্বাচনী সভায় কমলা হ্যারিসকে ঝাড়েন এবং এতে কিছু ফলও পান। কমলা হ্যারিসের আরেকটি দুর্বলতা মুসলমানদের ভোট, বিশেষ করে সুইং রাজ্য মিশিগানে। মধ্যপ্রাচ্যে বাইডেন অন্ধভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করায় সেই রাজ্যের মুসলমানরা প্রকাশ্যেই বলছেন, তারা ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেবেন না। অথচ এ রাজ্যটি জয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য বাইডেন সরে যাওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কমলা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে একটু ভারসাম্য বজায় রেখে কথা বলার চেষ্টা করেন। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবার আমেরিকার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করায় কিছু ডেমোক্র্যাট সন্দেহ করেন নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে জেতানোর জন্যই হামাস/লেবাননের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হচ্ছেন না। সে কারণে আড়ালে প্রেসিডেন্ট বাইডেন নেতানিয়াহুকে বিশ্রী ভাষায় গালমন্দ করেছেন, যা অতি সম্প্রতি বব উডওয়ার্ডের নতুন একটি বই ‘ওয়ারে’ লেখা হয়েছে। বাইডেনের অজনপ্রিয়তায় কমলা হ্যারিস বলতে শুরু করেছেন, তার প্রশাসন বাইডেনের বর্ধিতাংশ হবে না, তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনায় দেশ চালাবেন। ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম বিতর্কে ট্রাম্পকে পরাজিত এবং বিভিন্ন মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন।
আমরা : বাংলাদেশি অভিবাসীরা কালেক্টিভলি কাকে সমর্থন করব? দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা আওয়ামী লীগ-বিএনপির দূরত্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মার্কিন নির্বাচনেও আমরা বিভক্ত হয়ে গিয়েছি। আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা ট্রাম্পের কট্টর ভক্ত হয়ে গিয়েছে। সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন ডেমোক্র্যাটদের পরাজয় দেখার জন্য। কদিন আগে নিউইয়র্কের এক ছেলের সঙ্গে ফোনালাপে ছেলেটি বলছিল, ট্রাম্প জিতে যাবে। শেখ হাসিনা খুশি হয়ে বলেছিলেন, সব কর্মী যেন লোকাল কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় দুই লাখ ডলারে কোনো এক লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছেন। শেখ হাসিনার পতনের আগেও আওয়ামী লীগের বন্ধুদের কাছে শুনতাম, ট্রাম্প জিতলে মোদির প্রভাব ব্যবহার করে শেখ হাসিনার সব মুশকিল আসান করা যাবে। তাই তারা সবাই ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা ট্রাম্পকে ভোট দিতেই পারেন, কিন্তু ট্রাম্পকে ভোট দিলেও নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ায় কিছু আসবে যাবে না। আর ট্রাম্প জিতলেই কি শেখ হাসিনা গদি ফিরে পাবেন? বিষয়টি এত সহজ নয়। শেখ হাসিনা কিছু কারণে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছেন, যার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুব সহজ নয় বা মোদি চাইলেই ট্রাম্প সব উঠিয়ে নিতে পারবেন না। আমরা কালেক্টিভলি কী কী চাই? আমরা চাই আমাদের মা, বাবা, ভাই, বোনদের এ দেশে আনতে; কিছু মেডিকেল সুযোগ-সুবিধা; বাংলাদেশ থেকে আরও ছাত্রছাত্রীর পড়ার সুযোগ; রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশকে আর্থিক সহযোগিতা, শুল্কমুক্ত ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাধান। ট্রাম্প তো মুসলিম-বিদ্বেষী। ইমিগ্র্যান্টদের ফ্যামিলি ভিসা বন্ধ, কোনো ভিজিট ভিসা নিয়ে কারও আমেরিকায় সন্তান জন্মালেও নাগরিকত্ব না দেওয়া, ইসরায়েল ব্যতীত অন্য কোনো দেশকে সাহায্য না দেওয়া-এগুলোই ট্রাম্পের পলিসি। নিউইয়র্ক বা ক্যালিফোর্নিয়া বাদে আমরা যদি পেনসিলভানিয়া, মিশিগান, উইসকনসিন, নেভাদা বা জর্জিয়ার ভোটার হই; তাহলে আমাদের অল্প কটি ভোটই আমাদের চাহিদায় বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।
-নিউইয়র্ক