রবীন্দ্রনাথের জীবনসায়াহ্নে তখনকার যেসব তরুণ কবি তার স্নেহ-সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখ্য কয়েকটি নামের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের নাম অতি তাৎপর্যপূর্ণ কারণে স্মরণীয়। তার সাহিত্যকর্মের শুরু থেকেই যে রবীন্দ্রনাথের সানুরাগ আগ্রহ ছিল, সে কথা কবি মুক্তকণ্ঠে প্রকাশ করেছেন ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা পড়ে বুদ্ধদেব বসুকে লেখা চিঠিতে। ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার সঙ্গে প্রথম থেকেই আমার পরিচয় আছে এবং তার প্রতি আমার পক্ষপাত জন্মে গেছে। তার একটি কারণ, তার কাব্য অনেকখানি রূপ নিয়েছে আমার কাব্য থেকে-নিয়েছে নিঃসংকোচে অথচ তার প্রকৃতি সম্পূর্ণ তার আপন। তার স্বকীয়তা চেষ্টামাত্র করেনি অনন্যত্বের স্পর্ধায় যথাস্থানে থেকে প্রাপ্তিস্বীকার উপেক্ষা করতে। এ সাহস ক্ষমতারই সাহস।’ (৩ অক্টোবর ১৯৩৫)
কবির বন্ধু আইনজ্ঞ হীরেন্দ্রনাথ দত্তের ছেলে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। কবির সঙ্গে তার পরিচয়ও ছিল দীর্ঘদিনের। এখানে প্রশ্ন দেখা দেয়, সুধীন্দ্রনাথের পিতার কারণে রবীন্দ্রনাথের নিরন্তর নৈকট্য লাভের সুযোগ হলেও কীভাবে তার সংস্পর্শে এসে স্নেহধন্য হয়ে ওঠেন এই তরুণ কবি? এ প্রসঙ্গে তার অনুজ হরীন্দ্রনাথ দত্ত ১৩৬৯, শ্রাবণ-আশ্বিন সংখ্যা ‘উত্তরসূরি’ পত্রিকায় ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও পরিচয়’ নিবন্ধে লেখেন, ‘সুধীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালে গ্র্যাজুয়েট হন এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এম এ ক্লাসে ভর্তি হন। একই সঙ্গে ল’ ক্লাসেও যোগ দেন এবং এই সময় বাবার অফিস এইচ এন দত্ত এন্ড কোং-এ শিক্ষানবিসী হিসাবে কাজ করতে থাকেন। যদিও বাবার সবিশেষ ইচ্ছা ছিল বড় ছেলে তার কাজের দায়িত্ব নেবে, কিন্তু ক্রমশ সুধীন্দ্রনাথ সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়তে থাকলেন। ফলে পিতার আইন ব্যবসার প্রতি পুত্রের আর আগ্রহ থাকল না।’
এই সময়েই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ওর যোগাযোগ হয় এবং প্রায়ই সুধীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত করতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আধুনিক সাহিত্য (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সাহিত্য) নিয়ে তিনি অনেক সময়ই তর্ক করতেন এবং রবীন্দ্রনাথ প্রশান্তচিত্তে অনুসন্ধিৎসু তরুণ সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাহিত্য-আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেন। বিশেষ করে, বিদেশি সাহিত্য, ইউরোপীয় সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার ব্যুৎপত্তি দেখে তিনি মনে মনে সুধীন্দ্রনাথকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতেন এবং বয়সের বিরাট ব্যবধান সত্ত্বেও বন্ধুর মতো ব্যবহার করতেন।
পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রায় সময় তরুণ সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের জমাট আড্ডার আসর বসত। প্রায়ই সন্ধ্যার দিকে আসতেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, অপূর্বকুমার চন্দ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ। ১৯২৮ সালের এই রকম এক মজলিসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিতর্ককালে একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটে সুধীন্দ্রনাথের জীবনে। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আধুনিক ইংরেজি কবিতার ফর্ম ও বিষয়বৈচিত্র্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথের দীর্ঘ বিতর্ক চলছিল। দুজনের তর্ক কিছুতেই থামছে না। বিষয় ‘গৌরবের মূল্য কবিতার ক্ষেত্রে গৌণ’-এমন অভিমত প্রকাশ করায় সুধীন্দ্রনাথকে পরিহাসচ্ছলে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘সুধীন, তাহলে মোরগের ওপর কবিতা লেখো তো, দেখা যাক কী রকম উতরোয়।’ সুধীন্দ্রনাথ হাসিমুখে সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, কবিতা হবেই এবং সে কবিতা আপনার বিচারে উত্তীর্ণ হবে, আশা রাখি।’ কবির চরণে প্রণাম জানিয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিলেন সুধীন্দ্রনাথ।
কয়েক দিন পরে সুধীন্দ্রনাথ ‘কক্কুট’ (মোরগ) নামে একটি কবিতা লিখে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের কাছে দুরদুর বক্ষে হাজির হলেন। বাইরে যতই সাহস দেখান, মনে মনে দুর্বলতা ছিল। কেননা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সেই কবিতা পড়ে রায় দেবেন। কবিতাটি তার হাতে দিয়ে সুধীন্দ্রনাথ উৎকণ্ঠিতচিত্তে অপেক্ষা করতে লাগলেন। রবীন্দ্রনাথ কবিতাটি পড়লেন। আবার পড়লেন। প্রশান্ত হাসিতে তার মুখ ভরে উঠল। বললেন, ‘না, তুমি জিতেছ।’ রবীন্দ্রনাথ কবিতাটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন এবং নিজেই ‘প্রবাসী’র সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন প্রকাশের জন্য। এটি ছিল ‘প্রবাসী’-তে সুধীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত কবিতা।
সেই সময়েই রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে যান সুধীন্দ্রনাথ। সেখানে উত্তরায়ণে কবির সান্নিধ্যে ‘গভীর আনন্দে’ তিন রাত্রি কাটিয়ে অনুভব করেছিলেন ‘অনির্বচনীয় গৌরব’। শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় ফিরে এসে ১৩৩৫ সালের ২৭ আষাঢ় সুধীন্দ্রনাথ কবিকে এক চিঠিতে লেখেন, ‘আমার ধর্ম-বিশ্বাস যদি এত দুর্বল না হতো, তাহলে হয়তো ভাবতে পারতুম বোলপুরে যা পেয়েছি, তা পূর্বজন্মের সুকৃতির পুরস্কার মাত্র। দুর্ভাগ্যবশত জন্মান্তরবাদের প্রতি আমার আস্থা অল্পই। নিজের দৈন্যের পরিমাণও খুব ভালো করে জানি। কাজেই আপনার করুণা আপনার নিজের মহত্ত্বেরই অকাট্য প্রমাণ, এ বিষয়ে সন্দেহ করতে পারছি না। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করাও সম্ভব নয়, কেননা সৌভাগ্যের কথা যখন ওঠে তখন, যখন দৈবাৎ নাগালে পৌঁছায় কৃপণের দুষ্প্রবেশ্য ভাণ্ডারে। কিন্তু আপনার উদারতা সংকোচ-শূন্য বেনো বনে মুক্তা ছড়াতে তার দ্বিধা নেই। সে উদারতার নিশ্চয়ই অপব্যবহার করেছি, তবুও সেজন্যে অনুতপ্ত নই। অত বড় অত মহার্ঘ্য দানের কণামাত্রও যদি ছেড়ে আসতুম, তাহলেই ক্ষোভের অন্ত থাকত না।’
শান্তিনিকেতনে অবস্থানকালে দুই কালের দুই কবির মধ্যে কবিতা ও প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল, তার ধারা অব্যাহত থাকে তাদের পরবর্তীকালের চিঠিপত্রে। বলা বাহুল্য, এই দুই নবীন ও প্রবীণ কবির পত্রগুচ্ছ বাংলা পত্র-সাহিত্যের এক অতি মূল্যবান সম্পদ।
১৯৩৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘আকাশ প্রদীপ’ কাব্যখানি সুধীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করে উৎসর্গপত্রে কবি লেখেন, ‘বয়েসে তোমাকে অনেক দূরে পেরিয়ে এসেছি তবু তোমাদের কালের সঙ্গে আমার যোগ লুপ্তপ্রায় হয়ে এসেছে, এমনতরো অস্বীকৃতির সংশয়বাক্য তোমার কাছ থেকে শুনিনি। তাই আমার রচনা তোমাদের কালকে স্পর্শ করবে আশা করে এই বই তোমার হাতের কাছে এগিয়ে দিলুম। তুমি আধুনিক সাহিত্যের সাধনক্ষেত্র থেকে একে গ্রহণ করো।’
১৯২৯ সালে কানাডায় আয়োজিত শিক্ষা সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণ এলে তিনি সুধীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে যান। রবীন্দ্রনাথের নিয়ত সাহচর্যে ও বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে সুধীন্দ্রনাথের মনের পরিধি প্রসারিত হলো এবং বিশ্ব-ইতিহাস, সাহিত্য ও দর্শন সম্বন্ধে প্রগাঢ় অনুরাগ সঞ্চারিত হলো। ১০ মাসের প্রবাসজীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে এসে শুরু হয় যেন তার নতুন জীবন। ১৮৩৮-এর শ্রাবণ মাসে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো ত্রৈমাসিক ‘পরিচয়’ পত্রিকা।
এই ‘পরিচয়’ পত্রিকার সূত্রে সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ ও লেখক রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক এক নতুন মাত্রা লাভ করে। তাদের ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বাড়তে থাকেÑতার অজস্র প্রমাণ তাদের সেই সময়কার চিঠিপত্রে। বন্ধুপুত্র বা পুত্রতুল্য সুধীন্দ্রনাথকে লিখিত অধিকাংশ চিঠির শেষে নাম স্বাক্ষরের আগে কবি লিখতেন, ‘স্নেহানুরক্ত’ বা ‘স্নেহাসক্ত’ কথাটি। এতে বোঝা যায়, সুধীন্দ্রনাথের প্রতি স্নেহের আর্দ্রতার পরিমাপ কতটুকু। এদিকে পরিচয় পত্রিকাকে কেন্দ্র করে প্রতি শুক্রবারে বসত এক জমাট আড্ডা। এখানে খোলামেলা পরিবেশে মুক্তমনে সবার মতপ্রকাশের ছিল স্বাধীনতা। সেখানে হাজির হতেন প্রমথ চৌধুরী, অপূর্বকুমার চন্দ, হুমায়ুন কবির, তুলসী গোঁসাই, আবু সয়ীদ আইয়ুব, হিরেন মুখোপাধ্যায়, সুশোভন সরকার, হিরণ কুমার সান্যাল, বসন্তকুমার মল্লিকের ন্যায় বিদ্যা, বৈদগ্ধ ও প্রতিভায় অলংকৃত জ্ঞানী-গুণীজন।
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ১৩৩৭ সালে সুধীন্দ্রনাথ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তন্বী’ উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। ‘তন্বী’কে যথার্থ সুন্দরী করে তুলতে পরিচর্যায় রবীন্দ্রনাথের হাতের ছোঁয়া লেগেছিল। রবীন্দ্রনাথ তাকে কতখানি স্নেহ করতেন, তার একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে এই লেখাটি শেষ করব। ১৯৩৫ সালে সুধীন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কবির কাছে যখন সে খবর আসে, তখন তিনি ‘রেখার খেলায় মুক্তি খুঁজছেন’ অর্থাৎ দিনরাত ছবি আঁকার নেশায় বিভোর। তারই মাঝে সুধীন্দ্রনাথকে লিখলেন, ‘তোমার শরীরের জন্যে উদ্বিগ্ন আছি। আমার শরীরটাকে প্রায় সত্তর বৎসর নির্ম্মমভাবে ব্যবহার করেছি-অন্তত দুটো জন্মের মতো কাজ এক জন্মে আদায় করা গেছে, সুতরাং আজ যদি তার চাকা আলগা হয়ে থাকে নালিশ চলবে না। কিন্তু তোমার তরুণ দেহ যদি বেমজবুৎ হয়ে পড়ে তাহলে নিতান্তই ঠকা হবে।’ এই স্নেহের পরশমাখা পত্রের ভেতর দিয়েই বোঝা যায়, নবীন কবি সুধীন্দ্রনাথের প্রতি রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে স্নেহের টান কত গভীরে প্রোথিত ছিল। ২৫ জুন ১৯৬০ সালে এই ক্ষণজন্মা কবি কলকাতায় লোকান্তরিত হন।
লেখক : কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক। নিউইয়র্ক।
কবির বন্ধু আইনজ্ঞ হীরেন্দ্রনাথ দত্তের ছেলে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। কবির সঙ্গে তার পরিচয়ও ছিল দীর্ঘদিনের। এখানে প্রশ্ন দেখা দেয়, সুধীন্দ্রনাথের পিতার কারণে রবীন্দ্রনাথের নিরন্তর নৈকট্য লাভের সুযোগ হলেও কীভাবে তার সংস্পর্শে এসে স্নেহধন্য হয়ে ওঠেন এই তরুণ কবি? এ প্রসঙ্গে তার অনুজ হরীন্দ্রনাথ দত্ত ১৩৬৯, শ্রাবণ-আশ্বিন সংখ্যা ‘উত্তরসূরি’ পত্রিকায় ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও পরিচয়’ নিবন্ধে লেখেন, ‘সুধীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালে গ্র্যাজুয়েট হন এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এম এ ক্লাসে ভর্তি হন। একই সঙ্গে ল’ ক্লাসেও যোগ দেন এবং এই সময় বাবার অফিস এইচ এন দত্ত এন্ড কোং-এ শিক্ষানবিসী হিসাবে কাজ করতে থাকেন। যদিও বাবার সবিশেষ ইচ্ছা ছিল বড় ছেলে তার কাজের দায়িত্ব নেবে, কিন্তু ক্রমশ সুধীন্দ্রনাথ সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়তে থাকলেন। ফলে পিতার আইন ব্যবসার প্রতি পুত্রের আর আগ্রহ থাকল না।’
এই সময়েই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ওর যোগাযোগ হয় এবং প্রায়ই সুধীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত করতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আধুনিক সাহিত্য (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সাহিত্য) নিয়ে তিনি অনেক সময়ই তর্ক করতেন এবং রবীন্দ্রনাথ প্রশান্তচিত্তে অনুসন্ধিৎসু তরুণ সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাহিত্য-আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেন। বিশেষ করে, বিদেশি সাহিত্য, ইউরোপীয় সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার ব্যুৎপত্তি দেখে তিনি মনে মনে সুধীন্দ্রনাথকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতেন এবং বয়সের বিরাট ব্যবধান সত্ত্বেও বন্ধুর মতো ব্যবহার করতেন।
পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রায় সময় তরুণ সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের জমাট আড্ডার আসর বসত। প্রায়ই সন্ধ্যার দিকে আসতেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, অপূর্বকুমার চন্দ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ। ১৯২৮ সালের এই রকম এক মজলিসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিতর্ককালে একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটে সুধীন্দ্রনাথের জীবনে। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আধুনিক ইংরেজি কবিতার ফর্ম ও বিষয়বৈচিত্র্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথের দীর্ঘ বিতর্ক চলছিল। দুজনের তর্ক কিছুতেই থামছে না। বিষয় ‘গৌরবের মূল্য কবিতার ক্ষেত্রে গৌণ’-এমন অভিমত প্রকাশ করায় সুধীন্দ্রনাথকে পরিহাসচ্ছলে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘সুধীন, তাহলে মোরগের ওপর কবিতা লেখো তো, দেখা যাক কী রকম উতরোয়।’ সুধীন্দ্রনাথ হাসিমুখে সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, কবিতা হবেই এবং সে কবিতা আপনার বিচারে উত্তীর্ণ হবে, আশা রাখি।’ কবির চরণে প্রণাম জানিয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিলেন সুধীন্দ্রনাথ।
কয়েক দিন পরে সুধীন্দ্রনাথ ‘কক্কুট’ (মোরগ) নামে একটি কবিতা লিখে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের কাছে দুরদুর বক্ষে হাজির হলেন। বাইরে যতই সাহস দেখান, মনে মনে দুর্বলতা ছিল। কেননা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সেই কবিতা পড়ে রায় দেবেন। কবিতাটি তার হাতে দিয়ে সুধীন্দ্রনাথ উৎকণ্ঠিতচিত্তে অপেক্ষা করতে লাগলেন। রবীন্দ্রনাথ কবিতাটি পড়লেন। আবার পড়লেন। প্রশান্ত হাসিতে তার মুখ ভরে উঠল। বললেন, ‘না, তুমি জিতেছ।’ রবীন্দ্রনাথ কবিতাটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন এবং নিজেই ‘প্রবাসী’র সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন প্রকাশের জন্য। এটি ছিল ‘প্রবাসী’-তে সুধীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত কবিতা।
সেই সময়েই রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে যান সুধীন্দ্রনাথ। সেখানে উত্তরায়ণে কবির সান্নিধ্যে ‘গভীর আনন্দে’ তিন রাত্রি কাটিয়ে অনুভব করেছিলেন ‘অনির্বচনীয় গৌরব’। শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় ফিরে এসে ১৩৩৫ সালের ২৭ আষাঢ় সুধীন্দ্রনাথ কবিকে এক চিঠিতে লেখেন, ‘আমার ধর্ম-বিশ্বাস যদি এত দুর্বল না হতো, তাহলে হয়তো ভাবতে পারতুম বোলপুরে যা পেয়েছি, তা পূর্বজন্মের সুকৃতির পুরস্কার মাত্র। দুর্ভাগ্যবশত জন্মান্তরবাদের প্রতি আমার আস্থা অল্পই। নিজের দৈন্যের পরিমাণও খুব ভালো করে জানি। কাজেই আপনার করুণা আপনার নিজের মহত্ত্বেরই অকাট্য প্রমাণ, এ বিষয়ে সন্দেহ করতে পারছি না। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করাও সম্ভব নয়, কেননা সৌভাগ্যের কথা যখন ওঠে তখন, যখন দৈবাৎ নাগালে পৌঁছায় কৃপণের দুষ্প্রবেশ্য ভাণ্ডারে। কিন্তু আপনার উদারতা সংকোচ-শূন্য বেনো বনে মুক্তা ছড়াতে তার দ্বিধা নেই। সে উদারতার নিশ্চয়ই অপব্যবহার করেছি, তবুও সেজন্যে অনুতপ্ত নই। অত বড় অত মহার্ঘ্য দানের কণামাত্রও যদি ছেড়ে আসতুম, তাহলেই ক্ষোভের অন্ত থাকত না।’
শান্তিনিকেতনে অবস্থানকালে দুই কালের দুই কবির মধ্যে কবিতা ও প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল, তার ধারা অব্যাহত থাকে তাদের পরবর্তীকালের চিঠিপত্রে। বলা বাহুল্য, এই দুই নবীন ও প্রবীণ কবির পত্রগুচ্ছ বাংলা পত্র-সাহিত্যের এক অতি মূল্যবান সম্পদ।
১৯৩৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘আকাশ প্রদীপ’ কাব্যখানি সুধীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করে উৎসর্গপত্রে কবি লেখেন, ‘বয়েসে তোমাকে অনেক দূরে পেরিয়ে এসেছি তবু তোমাদের কালের সঙ্গে আমার যোগ লুপ্তপ্রায় হয়ে এসেছে, এমনতরো অস্বীকৃতির সংশয়বাক্য তোমার কাছ থেকে শুনিনি। তাই আমার রচনা তোমাদের কালকে স্পর্শ করবে আশা করে এই বই তোমার হাতের কাছে এগিয়ে দিলুম। তুমি আধুনিক সাহিত্যের সাধনক্ষেত্র থেকে একে গ্রহণ করো।’
১৯২৯ সালে কানাডায় আয়োজিত শিক্ষা সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণ এলে তিনি সুধীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে যান। রবীন্দ্রনাথের নিয়ত সাহচর্যে ও বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে সুধীন্দ্রনাথের মনের পরিধি প্রসারিত হলো এবং বিশ্ব-ইতিহাস, সাহিত্য ও দর্শন সম্বন্ধে প্রগাঢ় অনুরাগ সঞ্চারিত হলো। ১০ মাসের প্রবাসজীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে এসে শুরু হয় যেন তার নতুন জীবন। ১৮৩৮-এর শ্রাবণ মাসে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো ত্রৈমাসিক ‘পরিচয়’ পত্রিকা।
এই ‘পরিচয়’ পত্রিকার সূত্রে সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ ও লেখক রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক এক নতুন মাত্রা লাভ করে। তাদের ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বাড়তে থাকেÑতার অজস্র প্রমাণ তাদের সেই সময়কার চিঠিপত্রে। বন্ধুপুত্র বা পুত্রতুল্য সুধীন্দ্রনাথকে লিখিত অধিকাংশ চিঠির শেষে নাম স্বাক্ষরের আগে কবি লিখতেন, ‘স্নেহানুরক্ত’ বা ‘স্নেহাসক্ত’ কথাটি। এতে বোঝা যায়, সুধীন্দ্রনাথের প্রতি স্নেহের আর্দ্রতার পরিমাপ কতটুকু। এদিকে পরিচয় পত্রিকাকে কেন্দ্র করে প্রতি শুক্রবারে বসত এক জমাট আড্ডা। এখানে খোলামেলা পরিবেশে মুক্তমনে সবার মতপ্রকাশের ছিল স্বাধীনতা। সেখানে হাজির হতেন প্রমথ চৌধুরী, অপূর্বকুমার চন্দ, হুমায়ুন কবির, তুলসী গোঁসাই, আবু সয়ীদ আইয়ুব, হিরেন মুখোপাধ্যায়, সুশোভন সরকার, হিরণ কুমার সান্যাল, বসন্তকুমার মল্লিকের ন্যায় বিদ্যা, বৈদগ্ধ ও প্রতিভায় অলংকৃত জ্ঞানী-গুণীজন।
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ১৩৩৭ সালে সুধীন্দ্রনাথ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তন্বী’ উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। ‘তন্বী’কে যথার্থ সুন্দরী করে তুলতে পরিচর্যায় রবীন্দ্রনাথের হাতের ছোঁয়া লেগেছিল। রবীন্দ্রনাথ তাকে কতখানি স্নেহ করতেন, তার একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে এই লেখাটি শেষ করব। ১৯৩৫ সালে সুধীন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কবির কাছে যখন সে খবর আসে, তখন তিনি ‘রেখার খেলায় মুক্তি খুঁজছেন’ অর্থাৎ দিনরাত ছবি আঁকার নেশায় বিভোর। তারই মাঝে সুধীন্দ্রনাথকে লিখলেন, ‘তোমার শরীরের জন্যে উদ্বিগ্ন আছি। আমার শরীরটাকে প্রায় সত্তর বৎসর নির্ম্মমভাবে ব্যবহার করেছি-অন্তত দুটো জন্মের মতো কাজ এক জন্মে আদায় করা গেছে, সুতরাং আজ যদি তার চাকা আলগা হয়ে থাকে নালিশ চলবে না। কিন্তু তোমার তরুণ দেহ যদি বেমজবুৎ হয়ে পড়ে তাহলে নিতান্তই ঠকা হবে।’ এই স্নেহের পরশমাখা পত্রের ভেতর দিয়েই বোঝা যায়, নবীন কবি সুধীন্দ্রনাথের প্রতি রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে স্নেহের টান কত গভীরে প্রোথিত ছিল। ২৫ জুন ১৯৬০ সালে এই ক্ষণজন্মা কবি কলকাতায় লোকান্তরিত হন।
লেখক : কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক। নিউইয়র্ক।