১৮৭৮ সাল। আরব বিশ্বে অটোমান সাম্রাজ্যের সময় মুসলমানদের আধিপত্য ছিল। বিদ্যাশিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদিতে ছিল তারা এগিয়ে। মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল আকসা মসজিদ জেরুজালেমকে কেন্দ্র করেই ছিল বসতি, নগরায়ণ। জনসংখ্যার ৮৭% ছিল মুসলিম, ১০% খ্রিষ্টান আর মাত্র ৩% ছিল ইহুদি। অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশদের সহায়তায় এই অঞ্চলে ইহুদি বসতি স্থাপন শুরু করে। ১৯৩৮ সালের দিকে ইউরোপের বিভিন্ন এলাকা থেকে ইহুদিরা এখানে এসে জায়গা কিনে বসতি স্থাপন করে এবং অতিদ্রুত এ সংখ্যা বেড়ে ৩% থেকে ৩০% হয়ে যায়। তারপর ধীরে ধীরে তারা রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করে। ১৯৪৭ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দিলে ফিলিস্তিনিরা তা মেনে নেয়নি। ১৯৪৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সবকিছু উপেক্ষা করে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা দেওয়া হয়। সমস্যার সূত্রপাত এখন থেকেই।
রাষ্ট্র ঘোষণার পর থেকেই তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে এসে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে ইসরায়েল। ১৯৪৮ সালের পর আরবদের সঙ্গে ১৯৫৬, ৬৫, ৬৭, ৭৩, ৮৩ সালে ব্যাপক যুদ্ধ হলে প্রতিটি যুদ্ধেই আরবদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং আরবরা পরাজিত হয়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি মিসরের সিনাই উপত্যকায় লেবানন ও জর্ডানের কিছু অংশ ইসরায়েলিরা দখল করে নেয়। এভাবেই শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও নির্যাতনের। জাতিসংঘের মাধ্যমে আপস সমাধানের বারবার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি।
অবশেষে ১৯৭৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের মধ্যে ‘অসলো শান্তিচুক্তি’ হয়। ১৯৯৪ সালে বিশ্বশান্তি প্রসারিত ও সমঝোতার জন্য এই উভয় নেতা নোবেল পান। ১৯৯৫ সালে একদল ইহুদি উগ্রবাদীর হাতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন নিহত হন। এই নিহতের মধ্য দিয়ে উগ্রবাদীদের নেতা হিসেবে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তার ক্ষমতা গ্রহণের পর শান্তিচুক্তি তামাদি হয়ে যায়। নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি ফিলিস্তিনি নিধন এবং তাদের বাস্তুচ্যুত করে বাড়িঘর ও ভূমি দখল শুরু করেন। ২০১৫ সালে আমেরিকার সহায়তায় জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল আকসা মসজিদের ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী সময়ে আমেরিকার তত্ত্বাবধানে দুই পক্ষের মধ্যে ‘আব্রাহা’ চুক্তির মাধ্যমে আরবদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিনিদের দাবি উপেক্ষিত হয়ে যায়। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা তাদের মাতৃভূমির দাবিতে অটুট থাকে। একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অগণিত ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়। লক্ষাধিক নারী, পুরুষ, শিশু বিকলাঙ্গ ও আহত হয়। পুরো গাজা একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
কিন্তু ফিলিস্তিনিরা হার না-মানা এক জাতি। বিশ্বের আধুনিক সমরাস্ত্রের বিরুদ্ধে মাটির ভেতর থেকে বের হয়ে ইটপাটকেল মেরে ও শত্রুর মোকাবিলা করে তারা অকাতরে জীবন দিয়ে যাচ্ছে। দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ এক জাতি এবং তাদের সংগঠন হামাস শত্রুর মোকাবিলা করে যাচ্ছে। শত্রুপক্ষের হাতে নিহত হয়েছেন তাদের রাজনৈতিক শাখার প্রধান নেতা ইসমাইল হানিয়া। জায়োনিস্ট বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে গত ১৩ মাস ধরে মাটি কামড়ে এক পা হারিয়ে আহত অবস্থায় হামাস বাহিনীকে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। গত ১৬ সেপ্টেম্বর গাজার মাটিতে ইসরায়েল বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে ঘৃণায় সর্বশেষ তার হাতের লাঠি (ক্রাচ, যার ওপর ভর দিয়ে চলতেন) তাদের ওপর ছুড়ে মেরে মাতৃভূমির জন্য প্রাণ বিসর্জন দিলে লাশটাও তারা নিয়ে যায়। এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিলেন, আমাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও যুদ্ধ চালিয়ে যাব। তার অনুপস্থিতিতে হামাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘খলিল আল হায়া’ সেই ঘোষণা দেন। ওরা ভাবছিল, একে একে নেতাদের মৃত্যু হলেই যুদ্ধ বা নেতৃত্ব শেষ হবে। কিন্তু না, প্রতিটি ফিলিস্তিনি নাগরিকই নেতা ও যোদ্ধা। একেক নেতার শহীদি আত্মত্যাগে ফিলিস্তিনসহ মিত্র শক্তি দ্বিগুণ শপথে উজ্জীবিত হচ্ছে।
এদিকে হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যুতে শোকাভিভূত মুসলিম বিশ্ব। গত শুক্রবার পবিত্র জুমার নামাজের পর দোয়া ও গায়েবানা জানাজা শেষে ইরান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে লক্ষাধিক মানুষ রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ ও প্রতিশোধের স্লোগান দেন। এই ভয়কে মানুষের শক্তি, মানবতা দিয়ে জয় করার অঙ্গীকার করেন। তারা সারা বিশ্বকে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে, মানবতার পক্ষে, মুসলমানদের তীর্থ ভূমি মসজিদুল আকসা রক্ষার সংগ্রামে শরিক হওয়ার আহ্বান জানান।
অন্যদিকে ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যুদ্ধের আরেকটি মাত্রা যোগ হলো। হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতিসহ ছোট-বড় সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসরায়েলের ওপর মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। তাদের আক্রমণে অনেক ইসরায়েলি সৈন্য নিহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। জায়োনিস্টদের রক্ষার জন্য ইউরোপ, আমেরিকাসহ বন্ধুদেশগুলোও মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যেই আমেরিকার সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত শত শত সেনাবাহিনী গাজাসহ বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে ইসরায়েলি বাহিনীকে সহায়তা করে যাচ্ছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী মামলা বিচারাধীন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মার্কিন বিমানবাহিনীর ২৫ বছরের যুবক ‘এরন কুশনার’, যিনি গাজা যুদ্ধে ছিলেন, তিনি ছুটিতে আসার পর ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণের লোমহর্ষক বর্ণনা দেন এবং ওয়াশিংটনে ইসরায়েল দূতাবাসের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে চিৎকার করে বলেন, ‘গাজার মানুষকে বাঁচান।’ একজন আমেরিকানের এই প্রতিবাদী মৃত্যু বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। এ ব্যাপারে সাংবাদিকেরা তার পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞেস করলে তাদের উত্তর ছিল, গাজায় যে গণহত্যা চলছে, তার তুলনায় আমাদের পরিবারের সদস্যের আত্মত্যাগ খুব সামান্য। তার বিনিময়ে যদি গাজায় শান্তি ফিরে আসে, তাতে আমরা খুশি।
মুসলিম রক্তপিপাসু উন্মাদ বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্য হলো, মিসরের নীল নদ থেকে ইরাকের ফুরাত নদী পর্যন্ত এই বিশাল অংশজুড়ে ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ সাম্রাজ্য বিস্তার করে তাদের শাসন চলবে। এসব এলাকার মধ্যে ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, মিসর, ইরাক ও সৌদি আরবের অংশবিশেষ রয়েছে। এই সাতটি দেশের অস্তিত্ব তারা মেনে নেবে না, যা ইতিমধ্যেই ইসরায়েলি অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে বেরিয়ে এসেছে।
পৃথিবীব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও ইসরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা হচ্ছে। ইহুদিদের একমাত্র পথের কাঁটা ইরান ও হামাস, হুতি, হিজবুল্লাহ এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাদের ধ্বংস করতে পারলে বাকি কাজ সহজ হয়ে যাবে। তাই অনেক আগ থেকেই এই স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোকে সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে নির্মূল করার চেষ্টা করছে। তবু বর্তমান সংকটময় সময়ে একমাত্র এই সংগঠনগুলো মরণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দেশের জনগণ এবং তার মিত্র দেশগুলোকে বলেছিলেন, মাত্র এক মাসের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ করে ফেলবেন। কিন্তু ৩ মাস হলো, এখনো হামাস-হিজবুল্লাহকে ধ্বংস তো দূরের কথা, প্রচণ্ডভাবে সম্মুখ প্রতিরোধযুদ্ধ করে যাচ্ছে ইসরায়েল এবং উভয় পক্ষেরই আহত-নিহতের খবর আসছে। তেল আবিবে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বাসভবনে ড্রোন হামলাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হিজবুল্লাহর আক্রমণের ভয়ে ইসরায়েলিদের ঘুম হারাম। প্রায়ই সাইরেনের শব্দের কারণে তাদের বাংকারে আশ্রয় নিতে হয়। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় খোদ ইসরায়েলের জনগণ শান্তির জন্য যুদ্ধবিরতি, জিম্মিদের মুক্তি, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছে এবং অনেক শান্তিপ্রিয় ইহুদি ‘ইসরায়েল নিরাপদ নয়’ ভেবে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছেন। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৪৫ হাজারেরও বেশি, এ বছর দ্বিগুণ হবে। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের কারণে দেশ অনেক ক্ষতির সম্মুখীন। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। যে কারণে নিজের দেশেই নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা তলানিতে। তার ভুল নীতির কারণে সারা দুনিয়ায় ইহুদিবিদ্বেষ, ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ছে। এটা ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্য হুমকি এবং তারা একঘরে হয়ে পড়ছে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্য হলো এই যুদ্ধকে ইসরায়েলের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। এখন যুদ্ধবিরতি হলে এটা হবে তাদের জন্য চরম পরাজয়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী স্বপ্ন দেখছেন, এই সশস্ত্র গোষ্ঠীকে প্রতিহত এবং ইরানকে আক্রমণ করে দুর্বল করতে পারলেই তার সাম্রাজ্যের বিস্তারের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
এদিকে বিগত দিনে ইরানের প্রেসিডেন্ট থেকে কূটনীতিক, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা কেউই ইসরায়েলের গুপ্তহত্যার হাত থেকে রেহাই পাননি। তাই গত ১ অক্টোবর ইরান ইসরায়েলের মাটিতে ১৮০টি ড্রোন হামলা করে। সে সময় ইসরায়েলজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভয়ে ছোটাছুটি করে সবাই বাংকারে আশ্রয় নেয়। এরপর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েলের মাটিতে এই আক্রমণের চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে। হামলার তিন সপ্তাহ হলো। ইসরায়েল কী প্রতিশোধ নেয়, তা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব। ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের আক্রমণের একটা গোপন নথি প্রকাশ পেয়েছে। এতে ইরানের সামরিক স্থাপনার ওপর হামলার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, খার্গ আইল্যান্ডে অয়েল টার্মিনাল এবং পারমাণবিক স্থাপনার ওপরও হামলার টার্গেট হতে পারে। যদি তা-ই হয়, তাহলে শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, সারা পৃথিবীতে এর প্রতিক্রিয়া হবে। ইরানও সাফ জানিয়ে দিয়েছে, যদি ইসরায়েল আক্রমণ করে, তবে তারা ইসরায়েলের মানচিত্র পাল্টে দেবে।
হাসান নসরুল্লাহ, ইসমাইল হানিয়া, ইয়াহিয়া সিনওয়ার, কাসেম সোলাইমানিসহ লাখো শহীদের আত্মদান আরব বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষকে যুদ্ধের জন্য উজ্জীবিত করছে। অন্যদিকে রক্তপিপাসু বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পশ্চিমা ও মার্কিন মদদপুষ্ট হয়ে সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্নে বিভোর। এ অবস্থায় টান টান উত্তেজনার মধ্য দিয়েই দিনাতিপাত করছে মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশের নিরীহ, নিরপরাধ মানুষ। দখলদার এই বাহিনীর হাত থেকে মুসলিমদের রক্ষায় ত্রাণকর্তা হিসেবে পৃথিবীর কেউ কি এগিয়ে আসবেন?
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিক
রাষ্ট্র ঘোষণার পর থেকেই তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে এসে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে ইসরায়েল। ১৯৪৮ সালের পর আরবদের সঙ্গে ১৯৫৬, ৬৫, ৬৭, ৭৩, ৮৩ সালে ব্যাপক যুদ্ধ হলে প্রতিটি যুদ্ধেই আরবদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং আরবরা পরাজিত হয়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি মিসরের সিনাই উপত্যকায় লেবানন ও জর্ডানের কিছু অংশ ইসরায়েলিরা দখল করে নেয়। এভাবেই শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও নির্যাতনের। জাতিসংঘের মাধ্যমে আপস সমাধানের বারবার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি।
অবশেষে ১৯৭৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের মধ্যে ‘অসলো শান্তিচুক্তি’ হয়। ১৯৯৪ সালে বিশ্বশান্তি প্রসারিত ও সমঝোতার জন্য এই উভয় নেতা নোবেল পান। ১৯৯৫ সালে একদল ইহুদি উগ্রবাদীর হাতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন নিহত হন। এই নিহতের মধ্য দিয়ে উগ্রবাদীদের নেতা হিসেবে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তার ক্ষমতা গ্রহণের পর শান্তিচুক্তি তামাদি হয়ে যায়। নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি ফিলিস্তিনি নিধন এবং তাদের বাস্তুচ্যুত করে বাড়িঘর ও ভূমি দখল শুরু করেন। ২০১৫ সালে আমেরিকার সহায়তায় জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল আকসা মসজিদের ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী সময়ে আমেরিকার তত্ত্বাবধানে দুই পক্ষের মধ্যে ‘আব্রাহা’ চুক্তির মাধ্যমে আরবদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিনিদের দাবি উপেক্ষিত হয়ে যায়। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা তাদের মাতৃভূমির দাবিতে অটুট থাকে। একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অগণিত ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়। লক্ষাধিক নারী, পুরুষ, শিশু বিকলাঙ্গ ও আহত হয়। পুরো গাজা একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
কিন্তু ফিলিস্তিনিরা হার না-মানা এক জাতি। বিশ্বের আধুনিক সমরাস্ত্রের বিরুদ্ধে মাটির ভেতর থেকে বের হয়ে ইটপাটকেল মেরে ও শত্রুর মোকাবিলা করে তারা অকাতরে জীবন দিয়ে যাচ্ছে। দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ এক জাতি এবং তাদের সংগঠন হামাস শত্রুর মোকাবিলা করে যাচ্ছে। শত্রুপক্ষের হাতে নিহত হয়েছেন তাদের রাজনৈতিক শাখার প্রধান নেতা ইসমাইল হানিয়া। জায়োনিস্ট বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে গত ১৩ মাস ধরে মাটি কামড়ে এক পা হারিয়ে আহত অবস্থায় হামাস বাহিনীকে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। গত ১৬ সেপ্টেম্বর গাজার মাটিতে ইসরায়েল বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে ঘৃণায় সর্বশেষ তার হাতের লাঠি (ক্রাচ, যার ওপর ভর দিয়ে চলতেন) তাদের ওপর ছুড়ে মেরে মাতৃভূমির জন্য প্রাণ বিসর্জন দিলে লাশটাও তারা নিয়ে যায়। এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিলেন, আমাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও যুদ্ধ চালিয়ে যাব। তার অনুপস্থিতিতে হামাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘খলিল আল হায়া’ সেই ঘোষণা দেন। ওরা ভাবছিল, একে একে নেতাদের মৃত্যু হলেই যুদ্ধ বা নেতৃত্ব শেষ হবে। কিন্তু না, প্রতিটি ফিলিস্তিনি নাগরিকই নেতা ও যোদ্ধা। একেক নেতার শহীদি আত্মত্যাগে ফিলিস্তিনসহ মিত্র শক্তি দ্বিগুণ শপথে উজ্জীবিত হচ্ছে।
এদিকে হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যুতে শোকাভিভূত মুসলিম বিশ্ব। গত শুক্রবার পবিত্র জুমার নামাজের পর দোয়া ও গায়েবানা জানাজা শেষে ইরান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে লক্ষাধিক মানুষ রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ ও প্রতিশোধের স্লোগান দেন। এই ভয়কে মানুষের শক্তি, মানবতা দিয়ে জয় করার অঙ্গীকার করেন। তারা সারা বিশ্বকে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে, মানবতার পক্ষে, মুসলমানদের তীর্থ ভূমি মসজিদুল আকসা রক্ষার সংগ্রামে শরিক হওয়ার আহ্বান জানান।
অন্যদিকে ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যুদ্ধের আরেকটি মাত্রা যোগ হলো। হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতিসহ ছোট-বড় সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসরায়েলের ওপর মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। তাদের আক্রমণে অনেক ইসরায়েলি সৈন্য নিহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। জায়োনিস্টদের রক্ষার জন্য ইউরোপ, আমেরিকাসহ বন্ধুদেশগুলোও মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যেই আমেরিকার সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত শত শত সেনাবাহিনী গাজাসহ বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে ইসরায়েলি বাহিনীকে সহায়তা করে যাচ্ছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী মামলা বিচারাধীন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মার্কিন বিমানবাহিনীর ২৫ বছরের যুবক ‘এরন কুশনার’, যিনি গাজা যুদ্ধে ছিলেন, তিনি ছুটিতে আসার পর ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণের লোমহর্ষক বর্ণনা দেন এবং ওয়াশিংটনে ইসরায়েল দূতাবাসের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে চিৎকার করে বলেন, ‘গাজার মানুষকে বাঁচান।’ একজন আমেরিকানের এই প্রতিবাদী মৃত্যু বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। এ ব্যাপারে সাংবাদিকেরা তার পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞেস করলে তাদের উত্তর ছিল, গাজায় যে গণহত্যা চলছে, তার তুলনায় আমাদের পরিবারের সদস্যের আত্মত্যাগ খুব সামান্য। তার বিনিময়ে যদি গাজায় শান্তি ফিরে আসে, তাতে আমরা খুশি।
মুসলিম রক্তপিপাসু উন্মাদ বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্য হলো, মিসরের নীল নদ থেকে ইরাকের ফুরাত নদী পর্যন্ত এই বিশাল অংশজুড়ে ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ সাম্রাজ্য বিস্তার করে তাদের শাসন চলবে। এসব এলাকার মধ্যে ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, মিসর, ইরাক ও সৌদি আরবের অংশবিশেষ রয়েছে। এই সাতটি দেশের অস্তিত্ব তারা মেনে নেবে না, যা ইতিমধ্যেই ইসরায়েলি অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে বেরিয়ে এসেছে।
পৃথিবীব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও ইসরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা হচ্ছে। ইহুদিদের একমাত্র পথের কাঁটা ইরান ও হামাস, হুতি, হিজবুল্লাহ এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাদের ধ্বংস করতে পারলে বাকি কাজ সহজ হয়ে যাবে। তাই অনেক আগ থেকেই এই স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোকে সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে নির্মূল করার চেষ্টা করছে। তবু বর্তমান সংকটময় সময়ে একমাত্র এই সংগঠনগুলো মরণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দেশের জনগণ এবং তার মিত্র দেশগুলোকে বলেছিলেন, মাত্র এক মাসের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ করে ফেলবেন। কিন্তু ৩ মাস হলো, এখনো হামাস-হিজবুল্লাহকে ধ্বংস তো দূরের কথা, প্রচণ্ডভাবে সম্মুখ প্রতিরোধযুদ্ধ করে যাচ্ছে ইসরায়েল এবং উভয় পক্ষেরই আহত-নিহতের খবর আসছে। তেল আবিবে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বাসভবনে ড্রোন হামলাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হিজবুল্লাহর আক্রমণের ভয়ে ইসরায়েলিদের ঘুম হারাম। প্রায়ই সাইরেনের শব্দের কারণে তাদের বাংকারে আশ্রয় নিতে হয়। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় খোদ ইসরায়েলের জনগণ শান্তির জন্য যুদ্ধবিরতি, জিম্মিদের মুক্তি, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছে এবং অনেক শান্তিপ্রিয় ইহুদি ‘ইসরায়েল নিরাপদ নয়’ ভেবে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছেন। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৪৫ হাজারেরও বেশি, এ বছর দ্বিগুণ হবে। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের কারণে দেশ অনেক ক্ষতির সম্মুখীন। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। যে কারণে নিজের দেশেই নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা তলানিতে। তার ভুল নীতির কারণে সারা দুনিয়ায় ইহুদিবিদ্বেষ, ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ছে। এটা ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্য হুমকি এবং তারা একঘরে হয়ে পড়ছে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্য হলো এই যুদ্ধকে ইসরায়েলের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। এখন যুদ্ধবিরতি হলে এটা হবে তাদের জন্য চরম পরাজয়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী স্বপ্ন দেখছেন, এই সশস্ত্র গোষ্ঠীকে প্রতিহত এবং ইরানকে আক্রমণ করে দুর্বল করতে পারলেই তার সাম্রাজ্যের বিস্তারের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
এদিকে বিগত দিনে ইরানের প্রেসিডেন্ট থেকে কূটনীতিক, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা কেউই ইসরায়েলের গুপ্তহত্যার হাত থেকে রেহাই পাননি। তাই গত ১ অক্টোবর ইরান ইসরায়েলের মাটিতে ১৮০টি ড্রোন হামলা করে। সে সময় ইসরায়েলজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভয়ে ছোটাছুটি করে সবাই বাংকারে আশ্রয় নেয়। এরপর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েলের মাটিতে এই আক্রমণের চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে। হামলার তিন সপ্তাহ হলো। ইসরায়েল কী প্রতিশোধ নেয়, তা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব। ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের আক্রমণের একটা গোপন নথি প্রকাশ পেয়েছে। এতে ইরানের সামরিক স্থাপনার ওপর হামলার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, খার্গ আইল্যান্ডে অয়েল টার্মিনাল এবং পারমাণবিক স্থাপনার ওপরও হামলার টার্গেট হতে পারে। যদি তা-ই হয়, তাহলে শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, সারা পৃথিবীতে এর প্রতিক্রিয়া হবে। ইরানও সাফ জানিয়ে দিয়েছে, যদি ইসরায়েল আক্রমণ করে, তবে তারা ইসরায়েলের মানচিত্র পাল্টে দেবে।
হাসান নসরুল্লাহ, ইসমাইল হানিয়া, ইয়াহিয়া সিনওয়ার, কাসেম সোলাইমানিসহ লাখো শহীদের আত্মদান আরব বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষকে যুদ্ধের জন্য উজ্জীবিত করছে। অন্যদিকে রক্তপিপাসু বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পশ্চিমা ও মার্কিন মদদপুষ্ট হয়ে সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্নে বিভোর। এ অবস্থায় টান টান উত্তেজনার মধ্য দিয়েই দিনাতিপাত করছে মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশের নিরীহ, নিরপরাধ মানুষ। দখলদার এই বাহিনীর হাত থেকে মুসলিমদের রক্ষায় ত্রাণকর্তা হিসেবে পৃথিবীর কেউ কি এগিয়ে আসবেন?
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিক