যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ভোট গ্রহণ করা হবে আগামী ৫ নভেম্বর। সময় যতই ঘনিয়ে আসছে প্রভাবশালী দুই প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের সমর্থক শিবির থেকে নির্বাচনী প্রচার অভিযানও যেন তুঙ্গে। নিজের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে সাফাই গাইছেন তারা। দেশটির ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিস এমন পূর্বাভাস দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যালান লিচম্যান। তিনি এর আগে ৯টি নির্বাচনে সঠিক পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। এ জন্য তাকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির পূর্বাভাসের ‘নস্ট্রাডামাস’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি বলেছেন, এবার নির্বাচনে কমলা হ্যারিসের পক্ষ থেকে বড় বিস্ময় বা সারপ্রাইজ আসছে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন আসন্ন ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নির্বাচনে খুব সম্ভব বিজয়ী হবেন কমলা হ্যারিস। এ খবর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন ইনকুইজিটর।
লিচম্যান ইউটিউবে সরাসরি এক অনুষ্ঠানকালে এ দাবি করেছেন। ইমেইলে দেয়া কিছু রাজ্যের ভোট ডেমোক্র্যাট পার্টির বিজয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। নিউজউইকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, জবাবে লিচম্যান বলেছেন, আমি এটা বলতে পারি না যে- এর অর্থ ওইসব রাজ্য নীল (ব্লু) হয়ে যাবে। তবে এটা নিশ্চিত একটি চিহ্ন যে, এসব রাজ্য নীল হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, ডেমোক্রেটদের রং নীল বা ব্লু। তিনি ডেমোক্রেটদের জয় বোঝাতে নীল শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এছাড়া সাম্প্রতিক জাতীয় পর্যায়ের জরিপে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অল্প ব্যবধানে এগিয়ে আছেন কমলা হ্যারিস। ফাইভ থার্টি এইটের তথ্যমতে, দুই প্রার্থীর এই ব্যবধান ছিল মাত্র ২.৪ পয়েন্ট। এদিকে প্রেসিডেন্ট প্রতিযোগিতায় আরব মার্কিনীদের মধ্যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের চেয়ে সামান্য এগিয়ে গেছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। নতুন একটি জরিপে দেখা গেছে, গাজা যুদ্ধের প্রভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যগুলোতে ডেমোক্র্যাটদের প্রতি ভোটারদের সমর্থন কমেছে।
আরব নিউজ প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী, ৪৫ শতাংশ আরব আমেরিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এবং ৪৩ শতাংশ কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করছেন।
জরিপ অনুযায়ী, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব সফলভাবে সমাধান করার প্রশ্নে রিপাবলিকান প্রার্থী পেয়েছেন ৩৯ শতাংশ আর প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী পেয়েছেন ৩৩ শতাংশ ভোটারের সমর্থন। ‘সার্বিকভাবে’ মধ্যপ্রাচ্যের জন্য কে ভালো হবেন, এই প্রশ্নে ট্রাম্প ও হ্যারিস উভয়েই সমান ৩৮ শতাংশ সমর্থন পান। আরব-আমেরিকান সম্প্রদায়ের কাছে কোন সমস্যাগুলো সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের জানতে চাওয়া হলে, ২৯ শতাংশ উত্তরদাতা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে বেছে নেন, ২১ শতাংশের বেছে নেন অর্থনীতি ও উচ্চ জীবনযাত্রার খরচ। ভোটারদের ১৩ শতাংশ বর্ণবাদ ও বৈষম্যকে সবচে বেশি উদ্বেগজনক হিসেবে বেছে নেন। এই জরিপটি ডেমোক্র্যাটদের জন্য সর্বশেষ সতর্কবার্তা যে, গাজায় ইসরায়েলের প্রতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সমর্থন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে নিরাশ করতে পারে। তবে বিভিন্ন জরিপের ফলাফল যাই বলুক, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের চূড়ান্ত বিষয়টি নিশ্চিত হয় ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ ভোটিংয়ের মাধ্যমে। নির্বাচনে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন, তিনিই যে জয়ী হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। এর কারণ হচ্ছে দেশটিতে ভোটাররা সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট প্রয়োগ করেন না। ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ নামের পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন তারা। যে কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শেষ মূর্হুতে জয়লাভে বড় ফ্যাক্টর ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’।
‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ কী?
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা যখন নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেবেন, বেশিরভাগই হয় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস অথবা রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। তবে এদের দুজনের মধ্যে কে জয়ী হবেন, সেটা ভোটারদের দেওয়া ভোটে সরাসরি নির্ধারিত হবে না। জাতীয় স্তরের নির্বাচনী লড়াইয়ের বদলে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে একেকটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী লড়াইয়ের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের একটিতে জয়ী হওয়ার অর্থ একজন প্রার্থী সেই অঙ্গরাজ্যের সবকটি ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ ভোট পেয়ে যাবেন। ইলেক্টোরাল কলেজের মোট ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। মাইন ও নেব্রাসকা এই দুটো অঙ্গরাজ্য বাদে বাকি সবগুলো রাজ্যের ইলেক্টোরাল ভোট যোগ দিলে যে প্রার্থী ২৭০টি বা তারও বেশি ভোট পাবেন তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। সেই প্রার্থীর রানিং মেট হয়ে যাবেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট।
কীভাবে কাজ করে ইলেক্টোরাল কলেজ?
প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের বেশ কয়েকটি করে ইলেক্টোরাল ভোট থাকে, যা ওই অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার মোটামুটিভাবে সমানুপাতিক হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার হাতে সর্বাধিক ৫৪টি, এবং ওয়াইমিং, আলাস্কা এবং নর্থ ডাকোটা (ওয়াশিংটন ডিসি)-র মতো যেসব অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যা খুবই কম, তাদের হাতে অন্তত তিনটি ইলেক্টোরাল ভোট আছে। সাধারণত অঙ্গরাজ্যগুলো তাদের হাতে থাকা ইলেক্টোরাল ভোট সেই প্রার্থীকেই দেয়, যিনি ওই অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের সরাসরি ভোটে জয়ী হয়েছেন।
ধরা যাক, টেক্সাসে একজন প্রার্থী ভোটারদের সরাসরি ভোটের ৫০.১% পেয়েছেন, তিনি ওই অঙ্গরাজ্যের হাতে থাকা ৪০টি ইলেক্টোরাল ভোটের সবগুলোই পেয়ে যাবেন। একটি অঙ্গরাজ্যে জয়ের ব্যবধান যদি বিরাট হয়, তাহলেও জয়ী প্রার্থী সবগুলো ইলেক্টোরাল ভোট পাবেন।
দেশব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েও কি কেউ পরাজিত হতে পারে?
হ্যাঁ, সেটা সম্ভব। একজন প্রার্থী সারা দেশে হয়ত কম ভোট পেয়েছেন, কিন্তু বেশ কতগুলো কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়ে একজন প্রেসিডেন্ট হয়ে যেতে পারেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের থেকে প্রায় ৩০ লাখ কম ভোট পেয়েও হিলারিকে পরাজিত করেছিলেন। জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০০ সালে আল গোরকে পরাজিত করেছিলেন, যদিও সাধারণ ভোটে তার জয়ের ব্যবধান ছিল পাঁচ লক্ষেরও বেশি। ওই দুজনের আগে আর মাত্র তিনজন সাধারণ ভোটে না জিতেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তবে সেগুলো উনবিংশ শতাব্দীর ঘটনা। একেক রাজ্যের হাতে একেক সংখ্যক ভোট থাকার কারণে প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচারণার ব্যাপারে এমনভাবে ছক তৈরি করেন যেখানে তারা বেশি ভোট আছে এমন রাজ্যগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ কেন বলা হয়?
‘কলেজ’ শব্দটির অর্থ এখানে সেই ব্যক্তিদের বোঝানো হয়, যারা একটি অঙ্গরাজ্যের ভোট দেওয়ার অধিকারী। ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ হচ্ছে কর্মকর্তাদের একটি প্যানেল, যাদের ‘ইলেক্টরস্’ বলা হয়। এরা এক কথায় নির্বাচকমণ্ডলী। প্রতি চার বছর পর পর এটি গঠন করা হয় এবং এরাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টকে বাছাই করেন।
কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে প্রতিটি স্টেটের ইলেক্টর সংখ্যা নির্ধারিত হয়। স্টেটে সিনেটরের সংখ্যা (প্রত্যেক স্টেটে দুইজন) এবং প্রতিনিধি পরিষদে প্রতিনিধির (যা জনসংখ্যার অনুপাতে) যোগফল মিলে ইলেক্টর সংখ্যা নির্ধারিত হয়। ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি অনুযায়ী যেসব রাজ্যে জনসংখ্যা বেশি, সেসব রাজ্যে ইলেক্টোরাল ভোটও বেশি। এই প্রথা শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্যই ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য সব নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় সরাসরি মানুষের ভোটেই।
যে প্রার্থী অঙ্গরাজ্যে জয়ী হবেন, তাকেই কী ভোট দিতে বাধ্য নির্বাচকরা?
কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে নির্বাচকদের আইনগতভাবে সেই স্বাধীনতা আছে যে সাধারণ ভোটাররা কাকে পছন্দ করেছেন, তার ওপরে নির্ভর না করে নিজের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। তবে প্রকৃতপক্ষে দেখা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েছেন যে প্রার্থী, তাকেই নির্বাচকরা ভোট দিয়েছেন। অঙ্গরাজ্য থেকে যাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়, তার বিরুদ্ধে যদি কোনো নির্বাচক ভোট দেন, তাকে ‘ফেইথলেস’ বা অবিশ্বাসী বলা হয়। এর আগে ২০১৬ সালের নির্বাচনে এভাবেই সাতটি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট দেওয়া হয়েছিল, তবে নির্বাচনের ফলাফলে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে ‘ফেইথলেস’ নির্বাচকদের জরিমানা করা হয় বা তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হতে পারে।
ইলেক্টোরাল ভোটে ‘টাই’ হলে কী হবে?
কোনো ক্ষেত্রে যদি স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা কেউ না পান, সেক্ষেত্রে মার্কিন আইন সভার নিম্ন-কক্ষ হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভস ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। এই ঘটনা মাত্র একবারই হয়েছে ১৮২৪ সালে। ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট চারজন প্রার্থীর মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ায় কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। বর্তমানে অবশ্য রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টি দুটির যে আধিপত্য রয়েছে, তাতে ওইরকম ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই।
ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি কেন বেছে নেওয়া হয়েছিল?
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান যখন লেখা হচ্ছিল ১৭৮৭ সালে, তখন বিশালাকার দেশটিতে যোগাযোগের অভাবের ফলে জাতীয় স্তরে সাধারণ মানুষের ভোট নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা কার্যত অসম্ভব ছিল। সংবিধান রচয়িতারা তখন ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। সংবিধান প্রনেতারা ১৭৮৭ সালে সংবিধান রচনার সময় কংগ্রেস এবং জনগণের সরাসরি ভোটে (পপুলার ভোট) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুটো ধারণাই বাতিল করে দেন। তাদের যুক্তি ছিল পপুলার ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে লোকেরা তাদের স্থানীয় প্রার্থীকে ভোট দেবে এবং তার ফলে বড় রাজ্যগুলো আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে। ছোট ছোট রাজ্যগুলো এই ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতিকে সমর্থন করে কারণ এর ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এই পদ্ধতির পক্ষ নেয় কারণ সেসময় এসব রাজ্যে দাসের সংখ্যা ছিলো অনেক। দাসদের ভোটাধিকার না থাকা সত্ত্বেও আদম শুমারিতে তাদের গণনা করা হতো। এছাড়াও সংবিধান রচয়িতারা চাননি যে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে শুধু আইন প্রণেতারা দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করুক।
ইলেক্টোরাল কলেজ ব্যবস্থার ভাল-মন্দ
এই পদ্ধতির সুবিধাগুলো হচ্ছে, ছোট অঙ্গরাজ্যগুলো প্রার্থীদের কাছে গুরুত্ব পায়। প্রার্থীদের পুরো দেশ ঘোরার দরকার হয় না, গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যগুলোর প্রতি নজর দিলেই চলে। পুনর্গণনা সহজতর, কারণ কর্মকর্তারা একটি অঙ্গরাজ্যের সমস্যা সহজে চিহ্নিত করতে পারেন।
অসুবিধাগুলো হচ্ছে, সাধারণ মানুষের ভোটে জয়ী প্রার্থীও নির্বাচনে হেরে যেতে পারেন। ভোটারদের একাংশের মনে হয় যে তাদের ব্যক্তিগত ভোটের কোনো মূল্য নেই। কথিত ‘সুইং স্টেট’গুলোর হাতে অত্যধিক ক্ষমতা।
নির্বাচনের উল্লেখযোগ্য কিছু ইতিহাস
২০১৬: রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩০৬টি ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যদিও তিনি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ ভোট কম পেয়েছিলেন। ২০০০: রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ ডব্লিউ বুশ ২৭১টি ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যদিও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী অ্যাল গোর পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ভোট বেশি পেয়েছিলেন। ১৮৮৮: রিপাবলিকান প্রার্থী বেঞ্জামিন হ্যারিসন ২৩৩টি ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যদিও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড এক লাখ ৪৫৬ ভোট বেশি পেয়েছিলেন। ১৮৭৬: রিপাবলিকান রাদারফোর্ড বি হেইজ ১৮৫টি ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, কিন্তু ডেমোক্র্যাট প্রার্থী স্যামুয়েল জে টিলডেন দুই লাখ ৬৪ হাজার ভোট বেশি পেয়েছিলেন। ১৮২৪: ইলেক্টোরাল কলেজ চারজন প্রার্থীর পক্ষে বিভক্ত হওয়ায় হাউজ জন কুইন্সি অ্যাডামসকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে, যদিও এন্ড্রু জ্যাকসন তার চেয়েও বেশি পপুলার ইলেক্টোরাল ভোট পেয়েছিলেন।
এবার পূর্বাভাস দেয়া কঠিন : এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না কে আগামী মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হতে চলেছেন। বেশির ভাগ বিশ্লেষক বলছেন কে জয়ী হবেন সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো পূর্বাভাস দেয়া সত্যিই খুব কঠিন কাজ। কেননা- উভয় প্রার্থীর জনপ্রিয়তা এখনো সমান্তরাল গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে।
সিএনএনের সাংবাদিক হ্যারি এন্টেন বলেন, নির্বাচনের আর মাত্র কয়দিন বাকি, আমার জীবনে কভার করা যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে এ বছরের নির্বাচনী ফলাফলের পূর্বাভাস অনুমান করা কঠিন বলে মনে হয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য যেমন ভালো সংকেত রয়েছে তেমনি ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের জন্যও এবারের নির্বাচন বেশ সম্ভাবনার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক আমেরিকান বিশ্বাস করেন যে, এবারের নির্বাচনে বেশ কিছু বিষয় রয়েছে যার ভিত্তিতে আগাম পূর্বাভাস দেয়া কঠিন। এবার আগের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে অধিক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে বলে ধারণা করছেন তারা।
কমলার জন্য মিশিগান, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিন রাজ্যে জয়ের পথ সহজ হতে পারে। তবে তিনি যদি অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, নেভাদা এবং উত্তর ক্যারোলাইনা রাজ্যে পরাজিত হন তাহলে তার জয়ের সমীকরণ মেলানো বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
অন্যদিকে মিশিগান, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিনে ভোটগ্রহণের গড় ফলাফলে এই মুহূর্তে কমলা এবং ট্রাম্প এক পয়েন্ট ব্যবধানে অবস্থান করছেন। নির্বাচনের দিন পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকলে, অন্তত ৫০ বছরের মধ্যে এবার প্রথমবারের মতো এই তিনটি রাজ্যে মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে চূড়ান্ত গড় তৈরি হবে। এর চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে কমলা ওই তিন রাজ্যে ধারাবাহিকভাবে খুব সামান্য পয়েন্ট পেয়ে এগিয়ে ছিলেন। ট্রাম্প বা কমলা কেউই কখনো এই রাজ্যগুলোতে ৫ পয়েন্টের বেশি ব্যবধান নিশ্চিত করতে পারেননি। ৬০ বছরের মধ্যে এটিও প্রথম যে, কোনো প্রার্থীই একে অপরের বিরুদ্ধে ৫ পয়েন্টের বেশি গড় অতিক্রম করতে পারেননি।
লিচম্যান ইউটিউবে সরাসরি এক অনুষ্ঠানকালে এ দাবি করেছেন। ইমেইলে দেয়া কিছু রাজ্যের ভোট ডেমোক্র্যাট পার্টির বিজয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। নিউজউইকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, জবাবে লিচম্যান বলেছেন, আমি এটা বলতে পারি না যে- এর অর্থ ওইসব রাজ্য নীল (ব্লু) হয়ে যাবে। তবে এটা নিশ্চিত একটি চিহ্ন যে, এসব রাজ্য নীল হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, ডেমোক্রেটদের রং নীল বা ব্লু। তিনি ডেমোক্রেটদের জয় বোঝাতে নীল শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এছাড়া সাম্প্রতিক জাতীয় পর্যায়ের জরিপে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অল্প ব্যবধানে এগিয়ে আছেন কমলা হ্যারিস। ফাইভ থার্টি এইটের তথ্যমতে, দুই প্রার্থীর এই ব্যবধান ছিল মাত্র ২.৪ পয়েন্ট। এদিকে প্রেসিডেন্ট প্রতিযোগিতায় আরব মার্কিনীদের মধ্যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের চেয়ে সামান্য এগিয়ে গেছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। নতুন একটি জরিপে দেখা গেছে, গাজা যুদ্ধের প্রভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যগুলোতে ডেমোক্র্যাটদের প্রতি ভোটারদের সমর্থন কমেছে।
আরব নিউজ প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী, ৪৫ শতাংশ আরব আমেরিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এবং ৪৩ শতাংশ কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করছেন।
জরিপ অনুযায়ী, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব সফলভাবে সমাধান করার প্রশ্নে রিপাবলিকান প্রার্থী পেয়েছেন ৩৯ শতাংশ আর প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী পেয়েছেন ৩৩ শতাংশ ভোটারের সমর্থন। ‘সার্বিকভাবে’ মধ্যপ্রাচ্যের জন্য কে ভালো হবেন, এই প্রশ্নে ট্রাম্প ও হ্যারিস উভয়েই সমান ৩৮ শতাংশ সমর্থন পান। আরব-আমেরিকান সম্প্রদায়ের কাছে কোন সমস্যাগুলো সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের জানতে চাওয়া হলে, ২৯ শতাংশ উত্তরদাতা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে বেছে নেন, ২১ শতাংশের বেছে নেন অর্থনীতি ও উচ্চ জীবনযাত্রার খরচ। ভোটারদের ১৩ শতাংশ বর্ণবাদ ও বৈষম্যকে সবচে বেশি উদ্বেগজনক হিসেবে বেছে নেন। এই জরিপটি ডেমোক্র্যাটদের জন্য সর্বশেষ সতর্কবার্তা যে, গাজায় ইসরায়েলের প্রতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সমর্থন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে নিরাশ করতে পারে। তবে বিভিন্ন জরিপের ফলাফল যাই বলুক, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের চূড়ান্ত বিষয়টি নিশ্চিত হয় ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ ভোটিংয়ের মাধ্যমে। নির্বাচনে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন, তিনিই যে জয়ী হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। এর কারণ হচ্ছে দেশটিতে ভোটাররা সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট প্রয়োগ করেন না। ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ নামের পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন তারা। যে কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শেষ মূর্হুতে জয়লাভে বড় ফ্যাক্টর ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’।
‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ কী?
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা যখন নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেবেন, বেশিরভাগই হয় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস অথবা রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। তবে এদের দুজনের মধ্যে কে জয়ী হবেন, সেটা ভোটারদের দেওয়া ভোটে সরাসরি নির্ধারিত হবে না। জাতীয় স্তরের নির্বাচনী লড়াইয়ের বদলে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে একেকটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী লড়াইয়ের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের একটিতে জয়ী হওয়ার অর্থ একজন প্রার্থী সেই অঙ্গরাজ্যের সবকটি ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ ভোট পেয়ে যাবেন। ইলেক্টোরাল কলেজের মোট ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। মাইন ও নেব্রাসকা এই দুটো অঙ্গরাজ্য বাদে বাকি সবগুলো রাজ্যের ইলেক্টোরাল ভোট যোগ দিলে যে প্রার্থী ২৭০টি বা তারও বেশি ভোট পাবেন তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। সেই প্রার্থীর রানিং মেট হয়ে যাবেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট।
কীভাবে কাজ করে ইলেক্টোরাল কলেজ?
প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের বেশ কয়েকটি করে ইলেক্টোরাল ভোট থাকে, যা ওই অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার মোটামুটিভাবে সমানুপাতিক হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার হাতে সর্বাধিক ৫৪টি, এবং ওয়াইমিং, আলাস্কা এবং নর্থ ডাকোটা (ওয়াশিংটন ডিসি)-র মতো যেসব অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যা খুবই কম, তাদের হাতে অন্তত তিনটি ইলেক্টোরাল ভোট আছে। সাধারণত অঙ্গরাজ্যগুলো তাদের হাতে থাকা ইলেক্টোরাল ভোট সেই প্রার্থীকেই দেয়, যিনি ওই অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের সরাসরি ভোটে জয়ী হয়েছেন।
ধরা যাক, টেক্সাসে একজন প্রার্থী ভোটারদের সরাসরি ভোটের ৫০.১% পেয়েছেন, তিনি ওই অঙ্গরাজ্যের হাতে থাকা ৪০টি ইলেক্টোরাল ভোটের সবগুলোই পেয়ে যাবেন। একটি অঙ্গরাজ্যে জয়ের ব্যবধান যদি বিরাট হয়, তাহলেও জয়ী প্রার্থী সবগুলো ইলেক্টোরাল ভোট পাবেন।
দেশব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েও কি কেউ পরাজিত হতে পারে?
হ্যাঁ, সেটা সম্ভব। একজন প্রার্থী সারা দেশে হয়ত কম ভোট পেয়েছেন, কিন্তু বেশ কতগুলো কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়ে একজন প্রেসিডেন্ট হয়ে যেতে পারেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের থেকে প্রায় ৩০ লাখ কম ভোট পেয়েও হিলারিকে পরাজিত করেছিলেন। জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০০ সালে আল গোরকে পরাজিত করেছিলেন, যদিও সাধারণ ভোটে তার জয়ের ব্যবধান ছিল পাঁচ লক্ষেরও বেশি। ওই দুজনের আগে আর মাত্র তিনজন সাধারণ ভোটে না জিতেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তবে সেগুলো উনবিংশ শতাব্দীর ঘটনা। একেক রাজ্যের হাতে একেক সংখ্যক ভোট থাকার কারণে প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচারণার ব্যাপারে এমনভাবে ছক তৈরি করেন যেখানে তারা বেশি ভোট আছে এমন রাজ্যগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ কেন বলা হয়?
‘কলেজ’ শব্দটির অর্থ এখানে সেই ব্যক্তিদের বোঝানো হয়, যারা একটি অঙ্গরাজ্যের ভোট দেওয়ার অধিকারী। ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ হচ্ছে কর্মকর্তাদের একটি প্যানেল, যাদের ‘ইলেক্টরস্’ বলা হয়। এরা এক কথায় নির্বাচকমণ্ডলী। প্রতি চার বছর পর পর এটি গঠন করা হয় এবং এরাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টকে বাছাই করেন।
কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে প্রতিটি স্টেটের ইলেক্টর সংখ্যা নির্ধারিত হয়। স্টেটে সিনেটরের সংখ্যা (প্রত্যেক স্টেটে দুইজন) এবং প্রতিনিধি পরিষদে প্রতিনিধির (যা জনসংখ্যার অনুপাতে) যোগফল মিলে ইলেক্টর সংখ্যা নির্ধারিত হয়। ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি অনুযায়ী যেসব রাজ্যে জনসংখ্যা বেশি, সেসব রাজ্যে ইলেক্টোরাল ভোটও বেশি। এই প্রথা শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্যই ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য সব নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় সরাসরি মানুষের ভোটেই।
যে প্রার্থী অঙ্গরাজ্যে জয়ী হবেন, তাকেই কী ভোট দিতে বাধ্য নির্বাচকরা?
কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে নির্বাচকদের আইনগতভাবে সেই স্বাধীনতা আছে যে সাধারণ ভোটাররা কাকে পছন্দ করেছেন, তার ওপরে নির্ভর না করে নিজের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। তবে প্রকৃতপক্ষে দেখা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েছেন যে প্রার্থী, তাকেই নির্বাচকরা ভোট দিয়েছেন। অঙ্গরাজ্য থেকে যাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়, তার বিরুদ্ধে যদি কোনো নির্বাচক ভোট দেন, তাকে ‘ফেইথলেস’ বা অবিশ্বাসী বলা হয়। এর আগে ২০১৬ সালের নির্বাচনে এভাবেই সাতটি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট দেওয়া হয়েছিল, তবে নির্বাচনের ফলাফলে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে ‘ফেইথলেস’ নির্বাচকদের জরিমানা করা হয় বা তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হতে পারে।
ইলেক্টোরাল ভোটে ‘টাই’ হলে কী হবে?
কোনো ক্ষেত্রে যদি স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা কেউ না পান, সেক্ষেত্রে মার্কিন আইন সভার নিম্ন-কক্ষ হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভস ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। এই ঘটনা মাত্র একবারই হয়েছে ১৮২৪ সালে। ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট চারজন প্রার্থীর মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ায় কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। বর্তমানে অবশ্য রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টি দুটির যে আধিপত্য রয়েছে, তাতে ওইরকম ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই।
ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি কেন বেছে নেওয়া হয়েছিল?
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান যখন লেখা হচ্ছিল ১৭৮৭ সালে, তখন বিশালাকার দেশটিতে যোগাযোগের অভাবের ফলে জাতীয় স্তরে সাধারণ মানুষের ভোট নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা কার্যত অসম্ভব ছিল। সংবিধান রচয়িতারা তখন ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। সংবিধান প্রনেতারা ১৭৮৭ সালে সংবিধান রচনার সময় কংগ্রেস এবং জনগণের সরাসরি ভোটে (পপুলার ভোট) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুটো ধারণাই বাতিল করে দেন। তাদের যুক্তি ছিল পপুলার ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে লোকেরা তাদের স্থানীয় প্রার্থীকে ভোট দেবে এবং তার ফলে বড় রাজ্যগুলো আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে। ছোট ছোট রাজ্যগুলো এই ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতিকে সমর্থন করে কারণ এর ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এই পদ্ধতির পক্ষ নেয় কারণ সেসময় এসব রাজ্যে দাসের সংখ্যা ছিলো অনেক। দাসদের ভোটাধিকার না থাকা সত্ত্বেও আদম শুমারিতে তাদের গণনা করা হতো। এছাড়াও সংবিধান রচয়িতারা চাননি যে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে শুধু আইন প্রণেতারা দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করুক।
ইলেক্টোরাল কলেজ ব্যবস্থার ভাল-মন্দ
এই পদ্ধতির সুবিধাগুলো হচ্ছে, ছোট অঙ্গরাজ্যগুলো প্রার্থীদের কাছে গুরুত্ব পায়। প্রার্থীদের পুরো দেশ ঘোরার দরকার হয় না, গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যগুলোর প্রতি নজর দিলেই চলে। পুনর্গণনা সহজতর, কারণ কর্মকর্তারা একটি অঙ্গরাজ্যের সমস্যা সহজে চিহ্নিত করতে পারেন।
অসুবিধাগুলো হচ্ছে, সাধারণ মানুষের ভোটে জয়ী প্রার্থীও নির্বাচনে হেরে যেতে পারেন। ভোটারদের একাংশের মনে হয় যে তাদের ব্যক্তিগত ভোটের কোনো মূল্য নেই। কথিত ‘সুইং স্টেট’গুলোর হাতে অত্যধিক ক্ষমতা।
নির্বাচনের উল্লেখযোগ্য কিছু ইতিহাস
২০১৬: রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩০৬টি ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যদিও তিনি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ ভোট কম পেয়েছিলেন। ২০০০: রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ ডব্লিউ বুশ ২৭১টি ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যদিও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী অ্যাল গোর পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ভোট বেশি পেয়েছিলেন। ১৮৮৮: রিপাবলিকান প্রার্থী বেঞ্জামিন হ্যারিসন ২৩৩টি ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যদিও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড এক লাখ ৪৫৬ ভোট বেশি পেয়েছিলেন। ১৮৭৬: রিপাবলিকান রাদারফোর্ড বি হেইজ ১৮৫টি ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, কিন্তু ডেমোক্র্যাট প্রার্থী স্যামুয়েল জে টিলডেন দুই লাখ ৬৪ হাজার ভোট বেশি পেয়েছিলেন। ১৮২৪: ইলেক্টোরাল কলেজ চারজন প্রার্থীর পক্ষে বিভক্ত হওয়ায় হাউজ জন কুইন্সি অ্যাডামসকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে, যদিও এন্ড্রু জ্যাকসন তার চেয়েও বেশি পপুলার ইলেক্টোরাল ভোট পেয়েছিলেন।
এবার পূর্বাভাস দেয়া কঠিন : এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না কে আগামী মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হতে চলেছেন। বেশির ভাগ বিশ্লেষক বলছেন কে জয়ী হবেন সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো পূর্বাভাস দেয়া সত্যিই খুব কঠিন কাজ। কেননা- উভয় প্রার্থীর জনপ্রিয়তা এখনো সমান্তরাল গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে।
সিএনএনের সাংবাদিক হ্যারি এন্টেন বলেন, নির্বাচনের আর মাত্র কয়দিন বাকি, আমার জীবনে কভার করা যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে এ বছরের নির্বাচনী ফলাফলের পূর্বাভাস অনুমান করা কঠিন বলে মনে হয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য যেমন ভালো সংকেত রয়েছে তেমনি ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের জন্যও এবারের নির্বাচন বেশ সম্ভাবনার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক আমেরিকান বিশ্বাস করেন যে, এবারের নির্বাচনে বেশ কিছু বিষয় রয়েছে যার ভিত্তিতে আগাম পূর্বাভাস দেয়া কঠিন। এবার আগের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে অধিক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে বলে ধারণা করছেন তারা।
কমলার জন্য মিশিগান, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিন রাজ্যে জয়ের পথ সহজ হতে পারে। তবে তিনি যদি অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, নেভাদা এবং উত্তর ক্যারোলাইনা রাজ্যে পরাজিত হন তাহলে তার জয়ের সমীকরণ মেলানো বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
অন্যদিকে মিশিগান, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিনে ভোটগ্রহণের গড় ফলাফলে এই মুহূর্তে কমলা এবং ট্রাম্প এক পয়েন্ট ব্যবধানে অবস্থান করছেন। নির্বাচনের দিন পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকলে, অন্তত ৫০ বছরের মধ্যে এবার প্রথমবারের মতো এই তিনটি রাজ্যে মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে চূড়ান্ত গড় তৈরি হবে। এর চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে কমলা ওই তিন রাজ্যে ধারাবাহিকভাবে খুব সামান্য পয়েন্ট পেয়ে এগিয়ে ছিলেন। ট্রাম্প বা কমলা কেউই কখনো এই রাজ্যগুলোতে ৫ পয়েন্টের বেশি ব্যবধান নিশ্চিত করতে পারেননি। ৬০ বছরের মধ্যে এটিও প্রথম যে, কোনো প্রার্থীই একে অপরের বিরুদ্ধে ৫ পয়েন্টের বেশি গড় অতিক্রম করতে পারেননি।