কারও অজানা নয় যে আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার এবং পৌত্তলিকতার মূলোচ্ছেদ করতে গিয়ে হজরত মোহাম্মদ (সা.) বর্ণনাতীত ক্লেশ-দৈহিক নির্যাতন এবং অমানুষিক ত্যাগ স্বীকার করছেন। নিজেদের স্থায়ী আয়ের উৎস চিরতরে নস্যাৎ হওয়ার পর্যায়ে উপনীত হওয়ায় তদানীন্তন মক্কার প্রতিষ্ঠিত পৌত্তলিক গোত্রপতিরা শেষ পর্যন্ত মোহাম্মদ (সা.) কে হত্যার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছিল এবং খুনিকে ১০০ উট উপহার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। জীবনভর বৃক্ষের মতো ছায়াদানকারী চাচা আবু তালিব এবং সারা জীবনের সুখ-দুঃখের অকৃত্রিম অংশীদার বিবি খাদিজার (রা.) মৃত্যুর পর এ পর্যায়ে পরম করুণাময়ের নির্দেশেই এক রাতে হজরত মোহাম্মদ (সা.) বিশ^স্ত সহচর হজরত আবু বকরেেক (রা) সঙ্গে নিয়ে ইয়াসরিব বা মদিনার উদ্দেশে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে নানা অলৌকিক কর্মকাণ্ড ও চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে অবশেষে নবীজি (সা.) আবু বকর (রা.) সমভিব্যাহারে ইয়াসরিব বা মদিনায় পৌঁছালেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন। মদিনার অনুকূল পরিবেশে ইসলাম প্রচারের কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেলেও জন্মভূমি মক্কার হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ ও মাধুরীমণ্ডিত অতীত স্মৃতি আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর মানসপটে সর্বদা ভেসে উঠত। স্বদেশপ্রেমের অন্তঃসলিলা ফল্গুধারা নবীজির (সা.) অন্তরে সর্বদা প্রবহমান ছিল বিধায় অবশেষে সপ্তম হিজরিতে তিনি হজব্রত পালনের নিমিত্তে পবিত্র মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। কিন্তু শান্তির ধর্ম ইসলাম এবং হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর চিরশত্রু মক্কার পৌত্তলিক গোত্রপতিরা হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর হজ পালনের ক্ষেত্রে বাধার দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর তৈরি করল। অহেতুক যুদ্ধবিগ্রহ ও ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর খাতিরে পরিশেষে মক্কার অদূরবর্তী হুদায়বিয়া নামক স্থানে পৌত্তলিক গোত্রপতি এবং মোহাম্মদ বিন আবদুল্লার মধ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদিত হলো।
ঐতিহাসিক হুদায়বিয়া চুক্তির শর্তাবলি বাহ্য দৃষ্টিতে মুসলমানদের স্বার্থ পরিপন্থী বিবেচিত হওয়ায় নবদীক্ষিত অনেক মুসলমান এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। অথচ পবিত্র কোরআনের সুরা ফাতহের বর্ণনা অনুসারে ওই চুক্তিতেই মহান আল্লাহ তায়ালা বিনা যুদ্ধে মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত প্রদান করেছিলেন। আর সেই ঐতিহাসিক চুক্তির রেশ ধরেই অষ্টম হিজরিতে হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর নেতৃত্বে কোনো ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ এবং বাধা ছাড়াই মুসলমানরা মক্কা জয় করলেন। মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের সংবাদে ইসলামের চিরশত্রু পৌত্তলিক গোত্রপতিরা দিগবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে সদলবলে পালাতে লাগল। নিজ নিজ প্রাণ নিয়ে পালানোর কালে ষাটোর্ধ্ব এক মহিলাকে পরিবারের সদস্যরা একা রেখে রুদ্ধশ্বাসে মক্কা ত্যাগ করল। মাথায় বোঝা নিয়ে আলুথালু পায়ে প্রাণপণ প্রচেষ্টায় বৃদ্ধাও অন্যদের পিছু পিছু একাকী ছুটছিলেন। এ সময় একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ দৌড়ে এসে অবসন্ন ও ক্লান্ত বৃদ্ধার বোঝাটি স্বেচ্ছায় নিজের মাথায় তুলে নিলেন এবং বৃদ্ধাকে পালানোর কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করলেন। নির্দিষ্ট গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছার পর বৃদ্ধার অনুরোধে অচেনা পুরুষ লোকটি মহিলার বোঝা তাকে বুঝিয়ে দিলেন। ইত্যবসরে বৃদ্ধা সাহায্যকারী পুরুষটির পরিচয় জানতে চাইলেন। প্রত্যুত্তরে সাহায্যকারী পুরুষটিও বৃদ্ধাকে তার পালানোর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে বৃদ্ধা জানালেন, আবদুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদের সাঁড়াশি আক্রমণ ও বর্বর নিষ্পেষণের কবল থেকে আত্মরক্ষার খাতিরে তিনি পালাচ্ছিলেন। পুরুষ লোকটি মৃদু হেসে বললেন, আপনি যেই মোহাম্মদের নির্যাতনের ভয়ে পালাচ্ছিলেন, আমিই আবদুল্লাহর পুত্র সেই মোহাম্মদ। বৃদ্ধা মহানবীর (সা.) হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। অশ্রুসিক্তা বৃদ্ধা বললেন, যেই স্বামীর আদর-সোহাগে জীবনের ৫০টি বছর কাটিয়েছি; যে সকল জঠরজাত সন্তান-সন্ততির কল্যাণে নিজের যথাসর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিÑআজকের এই চরম দুর্যোগ মুহূর্তে তারা সবাই আমাকে একা রেখে প্রাণভয়ে পালিয়েছে। আর উপযাজক সেজে আপনি আমাকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করেছেন। তাই আর কালবিলম্ব না করে দয়া করে আপনি আমাকে ইসলামে দীক্ষিত করুন। অতঃপর ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা কালেমা পড়ে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিলেন এবং জীবনের বাকি অংশ মক্কাতেই অতিবাহিত করেছিলেন।
বস্তুত, মক্কা বিজয়ের পর হজরত মোহাম্মদ (সা.) আজন্মের শত্রু পৌত্তলিক মক্কাবাসীকে অকাতরে ক্ষমা করে দিয়ে ক্ষমা ও ঔদার্যের যে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, মানবসভ্যতার কয়েক সহস্রাধিক বছরের ইতিহাসে এর দ্বিতীয় নজির মিলবে না। মক্কা বিজয়ের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.) সাতজন পুরুষ এবং শহীদ হজরত আব্বাসের কলিজা ভক্ষণকারী হানজালাসহ সর্বমোট ছয়জন মহিলাকে গ্রেপ্তারের আদেশ দিয়েছিলেন। অপরাধীদের প্রচলিত আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং আইনানুগ শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল। তবে কোনো সাহাবি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেননি।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সোমবার ভাগীরতীর তীরবর্তী পলাশীর আম্রকাননে নবাব আলিবর্দির আদরের নাতি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছিল। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ঊর্ণনাভ ঘসেটি বেগম, কতিপয় দেশদ্রোহী ও নবাব সিরাজের সিপাহশালার মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলা মায়ের সিঁথির সিঁদুর ভাগীরথীর বানে ভেসে যাওয়ার পর ব্রিটিশ বেনিয়াদের কবল থেকে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ছিনিয়ে আনতে দীর্ঘ ১৯০ বছর সময় লেগেছিল। মাতৃভূমির লৌহশৃঙ্খল ছিন্ন করতে এই দীর্ঘ সময়ে দেশপ্রেমিক অসংখ্য রাজনীতিবিদ, সেনাসদস্য এবং বীরদের জেল-জুলুমসহ অমানুষিক নির্যাতন ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর দেশবাসী বিজয়োল্লাসে মেতে উঠেছিল। কিন্তু সদ্য স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানে অবিভক্ত বাংলার সর্বশেষ ও সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঢাকা আগমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ায় মুহূর্তেই বাঁধভাঙা আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ল। পরবর্তী সময়ে মুসলিম লীগ, পশ্চিম পাকিস্তানের হোমরাচোমরা, বড়লাট কায়েদে আযমের বিমাতাসুলভ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে অসন্তোষ ধূমায়িত হতে লাগল এবং একপর্যায়ে মওলানা ভাসানীর নেত্বত্বে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলো। আবার কায়েদে আযমের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে উর্দুর স্থলে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদাদানের দাবিতে বাংলার আপামর ছাত্র-জনতা বিদ্রোহ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। আর সেই প্রজ্জ্বলিত দাবানল বক্ষে ধারণ করে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষাযুদ্ধে রফিক-সালাম-বরকত প্রমুখ কামানের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন এবং ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের নানা বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ড, অর্থনৈতিক মুক্তি, স্বায়ত্তশাসন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ইত্যাদি অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে বহুল কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা অর্জনের বিজয়দীপ্ত ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো মূলত আগাগোড়া বিষাদের কাহিনিতেই ভরে উঠেছিল।
১৯৭১ সালে সর্বাধিক প্রশিক্ষিত ও সর্বাধুনিক সমরাস্ত্রসজ্জিত বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র ও স্বল্প প্রশিক্ষিত বীর বাঙালির মুখোমুখি লড়াই ছিল ঝিনুক দিয়ে সাগর সেচার দুরূহ এবং অসাধ্য প্রচেষ্টা। অথচ ৯ মাসের চোরাগোপ্তা হামলা ও সম্মুখযুদ্ধের পর ৯৬ হাজার পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে রক্তিম সূর্যখচিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল বিশ্বের মুক্তিকামী জনতার জন্য নিঃসন্দেহে ম্যাগনাকাটা বা দিগদর্শন যন্ত্র। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বর্ণাঢ্য আয়োজনে সর্বস্তরের বীর বাঙালির বিজয় দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানমালার সঠিক বর্ণনায় ভাষা হার মানতে বাধ্য। অথচ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সদ্য স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে আমাদের সেই বাঁধভাঙা আনন্দ-উচ্ছ্বাসও দুর্ভাগ্যক্রমে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ভাগ-বাঁটোয়ারা, পাওয়া-না পাওয়া, ব্যক্তিগত ইগো, উচ্চাভিলাষ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েই আমরা মুক্তিযোদ্ধা, মুজিব বাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনী, অমুক বাহিনী-তমুক বাহিনী ইত্যাদিতে বিভেদ-বিভক্তি ও বৈষম্যে জড়িয়ে পড়লাম। অবশেষে জাসদ, সর্বহারা ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র ক্যাডারের ছদ্মাবরণে গুপ্তহত্যা ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে অসংখ্য বাঙালির তরতাজা রক্তে দেশের মাটিকে রঞ্জিত করলেম। প্রতিশোধপরায়ণতার বশে অমানুষিক নির্যাতন ও শোষণের স্টিম রোলার চালিয়ে অনেককে হত্যা করা হলো। অনেকে কর্মক্ষমতা হারিয়ে চিরতরে পরাশ্রয়ী ও পরনির্ভরশীল হয়ে পড়লাম। গুপ্তহত্যার শিকার হয়ে বহু সধবা বিধবা হলেন, বহু শিশু এতিম-অনাথের খাতায় নাম লেখাল। বিজয়ের হর্ষের এই অনাকাক্সিক্ষত ও বিষাদময় পরিণতি কারও কাম্য না হলেও সরকার কিংবা দেশবাসী কেউই তা ঠেকাতে পারেনি।
আবার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর কয়েকটি রাজনৈতিক দলের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা আনন্দে আত্মহারা এবং আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তাদের সেই আনন্দ-উল্লাসও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কর্নেল তাহেরের ফাঁসি এবং অনেকগুলো ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে হর্ষের পরিবর্তে বিষাদই দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। আবার ১৯৮১ সালের ৩০ মের অভ্যুত্থানে জেনারেল জিয়ার প্রাণহানির পরও একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী এবং সমর্থকেরা রীতিমতো লম্ফঝম্ফ দিয়েছিলেন। লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মসনদ দখলের পর তাদের যাবতীয় আশা-আকাক্সক্ষার গুড়ে বালি পড়ল। অবশেষে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের গণেশ ওল্টানো; তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচন-পরবর্তী সরকার গঠন, মেয়াদ শেষে সরকারের বিদায় এবং নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিটি দল এবং দলীয় নেতাকর্মীদের পালাক্রমে বিজয়োল্লাস; সর্বক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি; চরম প্রতিশোধপরায়ণতার কারণে আমাদের কোনো বিজয়োল্লাসই জাতীয় জীবনে সুফল বয়ে আনেনি এবং দেশবাসীর প্রত্যাশার অপমৃত্যু হয়েছে। বরং প্রতিটি বিজয়ই দেশের কিছুসংখ্যক লোককে বিষাদের অতলস্পর্শী সাগরে ডুবিয়েছে এবং অন্য পক্ষকে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে স্মরণাতীত কাল থেকেই রাজ্য-সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, ক্ষমতার হাতবদল; দেশের মানচিত্র, পরিধি ও জাতীয় পতাকার নকশা বদল; মসনদে আরোহণকারীদের আনন্দের আতিশয্য ও আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়া; মসনদচ্যুত দলের বর্ণনাতীত শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়া, গোটা দেশবাসীর জীবনে ক্ষণিকের আনন্দ এবং দীর্ঘস্থায়ী নিরানন্দ বা দুর্ভোগ ইত্যাদি জাতি হিসেবে বাঙালির ললাটের লিখন কিংবা রাহুর মিতালি কিংবা বরাতে শাখের করাতে পরিণত হয়েছে। সবশেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বহু প্রত্যাশিত বিজয়ের গৌরবোজ্জ্বল বদনেও একশ্রেণির প্রতিশোধপরায়ণ ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী অত্যন্ত সুকৌশলে ও পরিকল্পিত উপায়ে অতি সম্প্রতি কলঙ্কের কালিমা লেপন করেছে। পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে সিদ্ধহস্ত এই বিশেষ সম্প্রদায় নিজেদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড এবং ঘৃণ্য আচরণের মাধ্যমে প্রতিটি জাতীয় বিজয়োল্লাসকে অল্প দিনেই সূচিভেদ্য অন্ধকার এবং বিষাদের তামসতমিস্রায় আচ্ছাদিত করেছে। তারা জাতীয় সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি ব্যক্তিস্বার্থ ও প্রতিশোধপরায়ণতায়ও কড়ায় গন্ডায় চরিতার্থ করেছে। যাহোক, মেঘে মেঘে বেলা অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতার বিগত ৫৩ বছরে নানা আন্দোলন-সংগ্রামে অসংখ্য তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। তাই অনাকাক্সিক্ষত প্রাণহানির মূলোচ্ছেদ এবং দেশ ও জাতির অস্তিত্ব-অগ্রগতি বা সার্বিক কল্যাণের খাতিরে যেকোনো মূল্যে এই স্বার্থান্বেষী নরকের কীটদের ব্যাপারে ছাত্র-শিক্ষক, পাড়া-প্রতিবেশী, দেশপ্রেমিক আপামর জনগোষ্ঠীকে সম্যক সচেতন থাকতে হবে। অন্যথায় বহু প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এবারের অবিস্মরণীয় বিজয়ও অল্প দিনেই গোটা দেশ এবং জাতির জন্য বড় ধরনের অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে।
উপসংহারে বলব, প্রতিশোধপরায়ণতা নয়, ক্ষমা ও ঔদার্যই বিজয়ের কাক্সিক্ষত সুফলকে স্থায়িত্ব ও অমরত্ব দান করে। কারণ পবিত্র কোরআনের সুরা আল-মুলকে আল্লাহ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন : সবকিছুই একদিন বিলীন হয়ে যাবে এবং একমাত্র আল্লাহর রাজত্বই টিকে থাকবে।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
২০ আগস্ট ২০২৪
ঐতিহাসিক হুদায়বিয়া চুক্তির শর্তাবলি বাহ্য দৃষ্টিতে মুসলমানদের স্বার্থ পরিপন্থী বিবেচিত হওয়ায় নবদীক্ষিত অনেক মুসলমান এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। অথচ পবিত্র কোরআনের সুরা ফাতহের বর্ণনা অনুসারে ওই চুক্তিতেই মহান আল্লাহ তায়ালা বিনা যুদ্ধে মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত প্রদান করেছিলেন। আর সেই ঐতিহাসিক চুক্তির রেশ ধরেই অষ্টম হিজরিতে হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর নেতৃত্বে কোনো ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ এবং বাধা ছাড়াই মুসলমানরা মক্কা জয় করলেন। মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের সংবাদে ইসলামের চিরশত্রু পৌত্তলিক গোত্রপতিরা দিগবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে সদলবলে পালাতে লাগল। নিজ নিজ প্রাণ নিয়ে পালানোর কালে ষাটোর্ধ্ব এক মহিলাকে পরিবারের সদস্যরা একা রেখে রুদ্ধশ্বাসে মক্কা ত্যাগ করল। মাথায় বোঝা নিয়ে আলুথালু পায়ে প্রাণপণ প্রচেষ্টায় বৃদ্ধাও অন্যদের পিছু পিছু একাকী ছুটছিলেন। এ সময় একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ দৌড়ে এসে অবসন্ন ও ক্লান্ত বৃদ্ধার বোঝাটি স্বেচ্ছায় নিজের মাথায় তুলে নিলেন এবং বৃদ্ধাকে পালানোর কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করলেন। নির্দিষ্ট গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছার পর বৃদ্ধার অনুরোধে অচেনা পুরুষ লোকটি মহিলার বোঝা তাকে বুঝিয়ে দিলেন। ইত্যবসরে বৃদ্ধা সাহায্যকারী পুরুষটির পরিচয় জানতে চাইলেন। প্রত্যুত্তরে সাহায্যকারী পুরুষটিও বৃদ্ধাকে তার পালানোর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে বৃদ্ধা জানালেন, আবদুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদের সাঁড়াশি আক্রমণ ও বর্বর নিষ্পেষণের কবল থেকে আত্মরক্ষার খাতিরে তিনি পালাচ্ছিলেন। পুরুষ লোকটি মৃদু হেসে বললেন, আপনি যেই মোহাম্মদের নির্যাতনের ভয়ে পালাচ্ছিলেন, আমিই আবদুল্লাহর পুত্র সেই মোহাম্মদ। বৃদ্ধা মহানবীর (সা.) হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। অশ্রুসিক্তা বৃদ্ধা বললেন, যেই স্বামীর আদর-সোহাগে জীবনের ৫০টি বছর কাটিয়েছি; যে সকল জঠরজাত সন্তান-সন্ততির কল্যাণে নিজের যথাসর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিÑআজকের এই চরম দুর্যোগ মুহূর্তে তারা সবাই আমাকে একা রেখে প্রাণভয়ে পালিয়েছে। আর উপযাজক সেজে আপনি আমাকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করেছেন। তাই আর কালবিলম্ব না করে দয়া করে আপনি আমাকে ইসলামে দীক্ষিত করুন। অতঃপর ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা কালেমা পড়ে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিলেন এবং জীবনের বাকি অংশ মক্কাতেই অতিবাহিত করেছিলেন।
বস্তুত, মক্কা বিজয়ের পর হজরত মোহাম্মদ (সা.) আজন্মের শত্রু পৌত্তলিক মক্কাবাসীকে অকাতরে ক্ষমা করে দিয়ে ক্ষমা ও ঔদার্যের যে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, মানবসভ্যতার কয়েক সহস্রাধিক বছরের ইতিহাসে এর দ্বিতীয় নজির মিলবে না। মক্কা বিজয়ের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.) সাতজন পুরুষ এবং শহীদ হজরত আব্বাসের কলিজা ভক্ষণকারী হানজালাসহ সর্বমোট ছয়জন মহিলাকে গ্রেপ্তারের আদেশ দিয়েছিলেন। অপরাধীদের প্রচলিত আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং আইনানুগ শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল। তবে কোনো সাহাবি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেননি।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সোমবার ভাগীরতীর তীরবর্তী পলাশীর আম্রকাননে নবাব আলিবর্দির আদরের নাতি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছিল। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ঊর্ণনাভ ঘসেটি বেগম, কতিপয় দেশদ্রোহী ও নবাব সিরাজের সিপাহশালার মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলা মায়ের সিঁথির সিঁদুর ভাগীরথীর বানে ভেসে যাওয়ার পর ব্রিটিশ বেনিয়াদের কবল থেকে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ছিনিয়ে আনতে দীর্ঘ ১৯০ বছর সময় লেগেছিল। মাতৃভূমির লৌহশৃঙ্খল ছিন্ন করতে এই দীর্ঘ সময়ে দেশপ্রেমিক অসংখ্য রাজনীতিবিদ, সেনাসদস্য এবং বীরদের জেল-জুলুমসহ অমানুষিক নির্যাতন ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর দেশবাসী বিজয়োল্লাসে মেতে উঠেছিল। কিন্তু সদ্য স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানে অবিভক্ত বাংলার সর্বশেষ ও সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঢাকা আগমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ায় মুহূর্তেই বাঁধভাঙা আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ল। পরবর্তী সময়ে মুসলিম লীগ, পশ্চিম পাকিস্তানের হোমরাচোমরা, বড়লাট কায়েদে আযমের বিমাতাসুলভ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে অসন্তোষ ধূমায়িত হতে লাগল এবং একপর্যায়ে মওলানা ভাসানীর নেত্বত্বে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলো। আবার কায়েদে আযমের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে উর্দুর স্থলে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদাদানের দাবিতে বাংলার আপামর ছাত্র-জনতা বিদ্রোহ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। আর সেই প্রজ্জ্বলিত দাবানল বক্ষে ধারণ করে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষাযুদ্ধে রফিক-সালাম-বরকত প্রমুখ কামানের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন এবং ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের নানা বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ড, অর্থনৈতিক মুক্তি, স্বায়ত্তশাসন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ইত্যাদি অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে বহুল কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা অর্জনের বিজয়দীপ্ত ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো মূলত আগাগোড়া বিষাদের কাহিনিতেই ভরে উঠেছিল।
১৯৭১ সালে সর্বাধিক প্রশিক্ষিত ও সর্বাধুনিক সমরাস্ত্রসজ্জিত বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র ও স্বল্প প্রশিক্ষিত বীর বাঙালির মুখোমুখি লড়াই ছিল ঝিনুক দিয়ে সাগর সেচার দুরূহ এবং অসাধ্য প্রচেষ্টা। অথচ ৯ মাসের চোরাগোপ্তা হামলা ও সম্মুখযুদ্ধের পর ৯৬ হাজার পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে রক্তিম সূর্যখচিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল বিশ্বের মুক্তিকামী জনতার জন্য নিঃসন্দেহে ম্যাগনাকাটা বা দিগদর্শন যন্ত্র। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বর্ণাঢ্য আয়োজনে সর্বস্তরের বীর বাঙালির বিজয় দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানমালার সঠিক বর্ণনায় ভাষা হার মানতে বাধ্য। অথচ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সদ্য স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে আমাদের সেই বাঁধভাঙা আনন্দ-উচ্ছ্বাসও দুর্ভাগ্যক্রমে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ভাগ-বাঁটোয়ারা, পাওয়া-না পাওয়া, ব্যক্তিগত ইগো, উচ্চাভিলাষ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েই আমরা মুক্তিযোদ্ধা, মুজিব বাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনী, অমুক বাহিনী-তমুক বাহিনী ইত্যাদিতে বিভেদ-বিভক্তি ও বৈষম্যে জড়িয়ে পড়লাম। অবশেষে জাসদ, সর্বহারা ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র ক্যাডারের ছদ্মাবরণে গুপ্তহত্যা ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে অসংখ্য বাঙালির তরতাজা রক্তে দেশের মাটিকে রঞ্জিত করলেম। প্রতিশোধপরায়ণতার বশে অমানুষিক নির্যাতন ও শোষণের স্টিম রোলার চালিয়ে অনেককে হত্যা করা হলো। অনেকে কর্মক্ষমতা হারিয়ে চিরতরে পরাশ্রয়ী ও পরনির্ভরশীল হয়ে পড়লাম। গুপ্তহত্যার শিকার হয়ে বহু সধবা বিধবা হলেন, বহু শিশু এতিম-অনাথের খাতায় নাম লেখাল। বিজয়ের হর্ষের এই অনাকাক্সিক্ষত ও বিষাদময় পরিণতি কারও কাম্য না হলেও সরকার কিংবা দেশবাসী কেউই তা ঠেকাতে পারেনি।
আবার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর কয়েকটি রাজনৈতিক দলের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা আনন্দে আত্মহারা এবং আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তাদের সেই আনন্দ-উল্লাসও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কর্নেল তাহেরের ফাঁসি এবং অনেকগুলো ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে হর্ষের পরিবর্তে বিষাদই দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। আবার ১৯৮১ সালের ৩০ মের অভ্যুত্থানে জেনারেল জিয়ার প্রাণহানির পরও একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী এবং সমর্থকেরা রীতিমতো লম্ফঝম্ফ দিয়েছিলেন। লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মসনদ দখলের পর তাদের যাবতীয় আশা-আকাক্সক্ষার গুড়ে বালি পড়ল। অবশেষে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের গণেশ ওল্টানো; তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচন-পরবর্তী সরকার গঠন, মেয়াদ শেষে সরকারের বিদায় এবং নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিটি দল এবং দলীয় নেতাকর্মীদের পালাক্রমে বিজয়োল্লাস; সর্বক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি; চরম প্রতিশোধপরায়ণতার কারণে আমাদের কোনো বিজয়োল্লাসই জাতীয় জীবনে সুফল বয়ে আনেনি এবং দেশবাসীর প্রত্যাশার অপমৃত্যু হয়েছে। বরং প্রতিটি বিজয়ই দেশের কিছুসংখ্যক লোককে বিষাদের অতলস্পর্শী সাগরে ডুবিয়েছে এবং অন্য পক্ষকে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে স্মরণাতীত কাল থেকেই রাজ্য-সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, ক্ষমতার হাতবদল; দেশের মানচিত্র, পরিধি ও জাতীয় পতাকার নকশা বদল; মসনদে আরোহণকারীদের আনন্দের আতিশয্য ও আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়া; মসনদচ্যুত দলের বর্ণনাতীত শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়া, গোটা দেশবাসীর জীবনে ক্ষণিকের আনন্দ এবং দীর্ঘস্থায়ী নিরানন্দ বা দুর্ভোগ ইত্যাদি জাতি হিসেবে বাঙালির ললাটের লিখন কিংবা রাহুর মিতালি কিংবা বরাতে শাখের করাতে পরিণত হয়েছে। সবশেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বহু প্রত্যাশিত বিজয়ের গৌরবোজ্জ্বল বদনেও একশ্রেণির প্রতিশোধপরায়ণ ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী অত্যন্ত সুকৌশলে ও পরিকল্পিত উপায়ে অতি সম্প্রতি কলঙ্কের কালিমা লেপন করেছে। পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে সিদ্ধহস্ত এই বিশেষ সম্প্রদায় নিজেদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড এবং ঘৃণ্য আচরণের মাধ্যমে প্রতিটি জাতীয় বিজয়োল্লাসকে অল্প দিনেই সূচিভেদ্য অন্ধকার এবং বিষাদের তামসতমিস্রায় আচ্ছাদিত করেছে। তারা জাতীয় সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি ব্যক্তিস্বার্থ ও প্রতিশোধপরায়ণতায়ও কড়ায় গন্ডায় চরিতার্থ করেছে। যাহোক, মেঘে মেঘে বেলা অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতার বিগত ৫৩ বছরে নানা আন্দোলন-সংগ্রামে অসংখ্য তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। তাই অনাকাক্সিক্ষত প্রাণহানির মূলোচ্ছেদ এবং দেশ ও জাতির অস্তিত্ব-অগ্রগতি বা সার্বিক কল্যাণের খাতিরে যেকোনো মূল্যে এই স্বার্থান্বেষী নরকের কীটদের ব্যাপারে ছাত্র-শিক্ষক, পাড়া-প্রতিবেশী, দেশপ্রেমিক আপামর জনগোষ্ঠীকে সম্যক সচেতন থাকতে হবে। অন্যথায় বহু প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এবারের অবিস্মরণীয় বিজয়ও অল্প দিনেই গোটা দেশ এবং জাতির জন্য বড় ধরনের অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে।
উপসংহারে বলব, প্রতিশোধপরায়ণতা নয়, ক্ষমা ও ঔদার্যই বিজয়ের কাক্সিক্ষত সুফলকে স্থায়িত্ব ও অমরত্ব দান করে। কারণ পবিত্র কোরআনের সুরা আল-মুলকে আল্লাহ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন : সবকিছুই একদিন বিলীন হয়ে যাবে এবং একমাত্র আল্লাহর রাজত্বই টিকে থাকবে।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
২০ আগস্ট ২০২৪