ভারতের পানি আগ্রাসন ও বাংলাদেশের বন্যা

প্রকাশ : ৩০ অগাস্ট ২০২৪, ২১:৩৫ , অনলাইন ভার্সন
প্রতিবেশী দেশ ভারতের ভয়াবহ পানি আগ্রাসনের শিকার বাংলাদেশ। সম্প্রতি কয়েক দিনের অবিরাম বৃষ্টিতে এমনিতেই বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলসমূহ প্লাবিত হতে শুরু করেছিল। এর মধ্যে কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই ভারত গজলডোবা, ডুম্বুরসহ অভিন্ন নদীর প্রায় সবগুলো বাঁধের স্লুইসগেট রাতের আঁধারে আকস্মিকভাবে খুলে দেওয়ায় বৃহত্তর নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্তত ১১টি জেলা ভয়ংকর এক বন্যা পরিস্থিতির সম্মুখীন। এত দ্রুততার সঙ্গে এসব এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাস্তা ও বাড়িঘর তলিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে লাখ লাখ পরিবার। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেও ২৬ আগস্ট সোমবার ভারতের বিহার ও ঝাড়খণ্ডে বন্যার জেরে ফারাক্কা ব্যারেজের ১০৯টি গেট খুলে দিয়েছে ভারত। এই গেট খুলে দেওয়ায় দেশের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জসহ আশপাশের জেলাগুলো নতুন করে প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ইতিমধ্যে বন্যাকবলিত ১১ জেলার সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফেনী-নোয়াখালীর কিছু কিছু এলাকায় টিনের ঘরের চাল এবং একতলা ভবন পর্যন্ত তলিয়ে যাওয়ার তথ্যচিত্র পাওয়া যাচ্ছে! কোথাও কোথাও আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো শুকনো বা উঁচু জায়গা পর্যন্ত নেই! তীব্র পানির তোড়ে এসব জেলার হাজার হাজার মাছের ঘের ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে, তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। ফেনী, নোয়াখালী অঞ্চলের অনেক হাঁস-মুরগি, গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়াও ভেসে গেছে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় তাৎক্ষণিক বন্যা উপদ্রুত সবচেয়ে খারাপ এলাকাগুলোর প্রকৃত অবস্থার তথ্য পাওয়া এবং উদ্ধার তৎপরতা ও ত্রাণ বিতরণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
গত দেড় দশকের মাফিয়াতান্ত্রিক লুটপাটে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেতর থেকে ফোকলা হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে নির্লজ্জ ফ্যাসিবাদী দলীয়করণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেশকে চরম ভঙ্গুর অবস্থায় ঠেলে দিয়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক নরেন্দ্র মোদির ছত্রচ্ছায়ায় বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার ধারাবাহিক অপতৎপরতা দেখা গেছে। দেড় মাস ধরে রাজপথে ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার ও প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় দেশে একধরনের স্থবিরতা ও অচলাবস্থা দেখা দিয়েছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার আগেই ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি নতুন সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এ কথা বলার অবকাশ রাখে না যে, চলমান ভয়াবহ বন্যার দুর্যোগ যতটা না প্রাকৃতিক, ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির আওতায় পানি আগ্রাসন তার চেয়ে বেশি দায়ী।
ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী গণআন্দোলন পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। সেই ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে জাতির সকল সংকটকালীন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমান এই বন্যা শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগও বটে। এর পেছনে রয়েছে প্রতিবেশী দেশের আধিপত্যবাদী রাজনীতি। অতএব, এর ধারাবাহিকতায় আরও অনেক কিছু মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে হবে।
সুস্পষ্ট প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ১৯৭৪ সালে পরীক্ষামূলক বলে ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে গঙ্গা/পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহের গতিপথ স্থায়ীভাবে পরিবর্তন করেছে। আবার তিস্তার উজানেও একাধিক বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে ভারত সরকার ইচ্ছামাফিক শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দিচ্ছে; আবার বর্ষা মৌসুমে পানি ছেড়ে দিয়ে নদীর আশপাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে। এতে বাংলাদেশের কৃষকের ব্যাপক ফসলহানি ঘটছে। এসব কারণে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকার কৃষক ও সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন। পানি নিয়ে ভারতের আধিপত্যবাদী মনোভাবের ফলে বাংলাদেশের নদ-নদী, নৌপরিবহন, প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, কৃষি অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। পানি ইস্যুতে ভারত কার্যত আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ সীমান্তের ৬০ কিলোমিটার উজানে ভারত সরকার এই বাঁধ নির্মাণ করে। এই গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে তিস্তা নদীর নিয়ন্ত্রণ মূলত ভারতের হাতে চলে গেছে। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই বাংলাদেশের উচিত এর প্রতিকারের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। সম্প্রতি চীন সরকার যে তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশকে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে অনতিবিলম্বে সাড়া দেওয়া জরুরি।
নদীর সঙ্গে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বাঁধা। সেই নদীকেই কাজে লাগিয়ে ভারত বাংলাদেশের অস্তিত্ববিনাশী তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে প্রবাহিত নদীর সংখ্যা ৫০টির বেশি। এসব নদীতে ভারত বাঁধ ও প্রতিবন্ধক নির্মাণ করে শুকনো মৌসুমে ইচ্ছামতো পানি সরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ ন্যায্য ও প্রাপ্য পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশের নদীগুলো শুকনো মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে পড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুপ্রক্রিয়া এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততার বিস্তার ক্রমাগত বাড়ছে। কৃষি ও শিল্পোৎপাদন, প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর অপূরণীয় বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এবার যে নজিরবিহীন অনাবৃষ্টি ও প্রচণ্ড খরা হলো, বিশেষজ্ঞদের মতে, এ জন্য নদীর পানিশূন্যতা বহুলাংশে দায়ী। শুকনো মৌসুমে পানি না দিয়ে যেমন ভারত বাংলাদেশকে মারে, তেমনি বর্ষা মৌসুমে পানির সয়লাব বা বন্যা সৃষ্টি করেও বাংলাদেশকে মারে। অভিন্ন নদীর উজানে যেসব বাঁধ ও প্রতিবন্ধক নির্মাণ করেছে ভারত, বর্ষা মৌসুমে সেগুলো একযোগে খুলে দিয়ে বিপুল পানি ঠেলে দেয় বাংলাদেশে। এতে দ্রুত বাংলাদেশ অস্বাভাবিক বন্যার কবলে পতিত হয়। ফসলাদি, ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়। বন্যার সঙ্গে দেখা দেয় নদীভাঙন। নদীভাঙনে অসংখ্য গ্রাম-জনপদ, শস্যক্ষেত্র, বৃক্ষ-বাগান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সীমান্ত নদীগুলোর ভাঙনে বাংলাদেশ এ-যাবৎ যে কত ভূমি হারিয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
ভারতের অমানবিক এ পানি আগ্রাসন বাংলাদেশকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তার বিবরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। অনলাইনে সার্চ করলেই এ-সংক্রান্ত অসংখ্য তথ্য ও বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, নদীই বাংলাদেশের প্রাণ। অথচ এই প্রাণ আজ ওষ্ঠাগত। নদী রক্ষা কমিশনের তথ্যমতে, ছোট-বড় মিলে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ১ হাজার ৮টি। এর মধ্যে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীও অন্তর্ভুক্ত। পানির অধিকাংশের উৎস আন্তর্জাতিক নদীগুলো। এসব নদী উজান থেকে পানি বয়ে আনে এবং বাংলাদেশ হয়ে সাগরে পতিত হয়। অভ্যন্তরীণ নদীগুলো বৃষ্টি ছাড়া আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানির ওপর নির্ভরশীল। ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণে এসব নদীর কয়েকশ ইতিমধ্যে মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। বাকিগুলোরও অধিকাংশ যাওয়ার পথে। এভাবে নদী যদি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়, বাংলাদেশ বাঁচবে কীভাবে? জাতীয় একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক খবরে বিভিন্ন সূত্রের বরাতে বলা হয়েছে, ভারত অভিন্ন নদীতে বাঁধ, ব্যারাজ, পানিবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প, আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প, জলাধার ইত্যাদি গড়ে তুলে নির্বিচারে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এ ধরনের স্ট্রাকচার, কাঠামো বা স্থাপনার সংখ্যা ১৯৪৭ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার। আর ১৯৯০ থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে আরও ৭০০। এত প্রতিবন্ধক নির্মাণের পর অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশ পাবে, কোনো বিবেচনাতেই তা ধারণা করা যায় না। আন্তর্জাতিক ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের জোরালো কোনো পদক্ষেপ ছাড়া এমনি এমনিই ভারত বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য ন্যায্য পানির হিস্যা দেবেÑএ কথা কোনো পাগলেও আর বিশ্বাস করে না। নদী ছাড়া, পানি ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, অভিন্ন নদীতে উজানের দেশ ভাটির দেশের ক্ষতি হয়, এমন কোনো বাঁধ, ব্যারাজ বা প্রতিবন্ধক নির্মাণ করতে পারে না। নির্মাণ করতে চাইলে ভাটির দেশের অনুমোদন অপরিহার্য পূর্বশর্ত। কোনো কাঠামো বা প্রকল্প নেওয়ার আগে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করেছে, অনুমোদন নিয়েছে, এমন প্রমাণ নেই। ফলে ভারত যা কিছুই করেছে, আইন লঙ্ঘন করেই করেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার এ নিয়ে অভিযোগ জানানো বা বিচার চাওয়ার যে ব্যবস্থা আছে, বাংলাদেশ সরকার দ্রুতই সে পথে হাঁটবে বলে জনগণ আশা করে।
লেখক : মানবাধিকারকর্মী, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078