গল্পগুলো জানা, অজানা কেবল টুপি আর মাথার সাইজ

প্রকাশ : ২২ অগাস্ট ২০২৪, ১৪:৩৮ , অনলাইন ভার্সন
কুয়ো আর সমুদ্রের ব্যাঙ দিয়েই শুরু করা যাক। সমুদ্রের এক ব্যাঙের হঠাৎ ইচ্ছে হলো ডাঙায় ঘুরে আসার। যেই কথা সেই কাজ। একদিন ডাঙায় ঘুরতে আসে সমুদ্রের ব্যাঙ। লাফাতে লাফাতে পড়ে যায় একটি কুয়োর ভেতরে। সেখানে আগে থেকেই দীর্ঘদিন বাস করে আসছিল আরেক ব্যাঙ। সাগরের ব্যাঙকে দেখে কুয়োর ব্যাঙ কিছুটা রাগতভাবে জানতে চাইল-তুমি আবার কে, কোথা থেকে এলে? আগত ব্যাঙ বলল, সমুদ্র থেকে এসেছি। কুয়োর ব্যাঙ বলল, সমুদ্র! সে আবার কী? আগত ব্যাঙের উত্তরÑসমুদ্র অনেক বড়, অনেক বিশাল জলরাশি, যেদিকে তাকাই শুধু পানি আর পানি। কুয়োর ব্যাঙ তখন কুয়োর পানিতে কিছুটা ঢেউ তুলে তাচ্ছিল্য করে বলল, এর চেয়েও বেশি পানি? আগত ব্যাঙ বলল, সমুদ্রের পানির কোনো সীমা-পরিসীমা নাই। এরপর আরও রাগান্বিত হয়ে কুয়োর ব্যাঙ কুয়োর উপরে উঠে আবার লাফিয়ে পড়ে নিচে, এক পাড় থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে আরেক পাড়ে যায়; বলে-তোমার সমুদ্র কি এমনই গভীর, এক পাড় থেকে আরেক পাড় কি এর চেয়েও দূরে? সমুদ্রের ব্যাঙ তখন বলে, সমুদ্রের গভীরতা এত বিশাল, এক পাড় থেকে আরেক পাড়ের দূরত্ব এতই বেশি, যা কল্পনা করাও অসম্ভব। কুয়োর ব্যাঙ কোনোমতেই সমুদ্রের বিশালতা বুঝতে ও মানতে চায় না। বরং ভর্ৎসনা করে সমুদ্রের ব্যাঙকে তাড়িয়ে দিতে চায়। সমুদ্রের ব্যাঙ ভেবে পায় না, সমুদ্রের বিশালতা এই কুয়োর ব্যাঙকে কীভাবে বোঝাবে!
দ্বিতীয় গল্পের নাম ‘পথ জানা নেই’। লেখক শামসুদদীন আবুল কালাম। বরিশালের গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে রচিত গল্পের সারসংক্ষেপ কিছুটা এমন-জোনাবালী হাওলাদার কিছুটা শহুরে, আধুনিক চিন্তার মানুষ। তিনি গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার জন্য একটি রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব করেন। কিন্তু গ্রামবাসী তাতে সায় দেয় না। একপর্যায়ে জোনাবালী গ্রামবাসীকে বোঝাতে সক্ষম হন, রাস্তা হলে তাদের জীবন-মান ও অর্থনৈতিক অবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধিত হবে। গ্রামবাসী তখন তা মেনে নেয়। অবশেষে নির্মিত হয় রাস্তা। যোগাযোগ স্থাপিত হয় শহরের সঙ্গে গ্রামের। পাল্টে যেতে থাকে গ্রামবাসীর জীবনমান। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তনশীল এই অবস্থার সঙ্গে সবাই খাপ খাওয়াতে পারে না। যে রাস্তার ফলে সূচিত হয় অর্থনৈতিক উন্নতির, একদিন সেই রাস্তা ধরেই আসে চোরাকারবারি। আধুনিকতার সঙ্গে আসে অপসংস্কৃতি। একদিন শত্রু-মিলিটারিও আসে সেই রাস্তা ধরে। শহরের কোনো এক নাগর এসে ভাগিয়ে নিয়ে যায় গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র গহুরালির অবলা স্ত্রীকে। মনের রাগে, দুঃখে গহুরালি তাই শরীরের সকল শক্তি দিয়ে সেই মহাসড়ক নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় কোনো এক সকালবেলা।
এবার সবার জানা একটি প্রবাদ মনে করিয়ে দিইÑমাথার চেয়ে টুপি বড়।
উপরে যে দুটি গল্প ও একটি প্রবাদ উল্লেখ করা হয়েছে, তা যেন সৃষ্টিই হয়েছিল বাংলাদেশে ইন্টারনেটের বিকাশ ও ব্যবহারের কদর্যের কথা চিন্তা করে। এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক, বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে সাগরের তলদেশ থেকে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হয় ভারত। ভারতের বেঙ্গালুরুতে যখন সেই সংযোগের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়, তখন বাংলাদেশকে প্রস্তাব করা হয়েছিল কোনো প্রকার অর্থ খরচ না করেই সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার। বাংলাদেশের তখনকার বিএনপি সরকার দেশের নিরাপত্তার কথা বলে সেই সুযোগ নিতে অসম্মতি জানায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সরকার এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে বাংলাদেশকে সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত করতে উদ্বুদ্ধ হয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে যুক্ত হওয়ার জন্য চুক্তি সম্পন্ন করে এবং তার কাজ অনেকাংশে সম্পন্ন করে, যদিও তা আর বিনে পয়সায় পাওয়া যাইনি। ২০০১ সালে আবার সরকার পরিবর্তন হয়। ক্ষমতায় আসে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট। এ সময়েও কিছুটা বিকাশ ঘটে ইন্টারনেটের। তবে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এসে এই সেক্টরের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন ছড়িয়ে দেয় দেশবাসীর মধ্যে। ফলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অল্প সময়ে ডিজিটাল বিপ্লবের শুরু হয়। উন্মুক্ত হয় বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের নতুন দিগন্তের। মানুষের ব্যক্তিগত জীবনমান, আর্থসামাজিক অবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্যে সূচিত হয় এক দারুণ সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দেয় সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম।
পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা এখনো এর বিশালতা বুঝতে পারিনি। ইন্টারনেট-সমুদ্রে আমরা এখনো কেবলই কুয়োর ব্যাঙ। ফলে যে ইন্টারনেট-পথে অর্থনৈতিক, সামাজিক সমৃদ্ধি এসেছে; সেই পথ দিয়েই দেশের অর্থ চলে যাচ্ছে অজানা গন্তব্যে। যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে গ্রামের কৃষক পরিবারের কোনো এক সন্তান ঘরে বসেই দেশে নিয়ে আসছেন বৈদেশিক মুদ্রা; সেই পথ ব্যবহার করেই তৈরি হচ্ছে বিশেষ ব্যক্তি, সমাজ ও গোষ্ঠীর উপর আক্রমণের প্লট। যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারাদনি কর্মক্লান্ত দূরপ্রবাসী সহজেই দেখতে পান পিতা-মাতা, সন্তান কিংবা প্রেয়সির মুখ; সেই পথ ব্যবহার করেই ছড়িয়ে পড়ছে ট্রলের মতো ব্যক্তি-আক্রমণের জীবন-বিনাশী তীঁর। যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনেকে সহজেই তৈরি করে নিচ্ছেন উচ্চশিক্ষার সুযোগ; সেই পথেই দেখা যায় এমন এক শ্রেণী যারা এখনো মনে করে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সব কিছুই সত্য। এসব মূলত ইন্টারনেট নামক বিশাল টুপির তুলনায় আমাদের সম্মিলিত মাথা যে নেহাতই ছোট, তা-ই মনে করিয়ে দেয়। বাঙালির মাথা থেকে তাই বারবার খসে পড়ে যায় সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি আর সহাবস্থানের ঐতিহ্যের টুপি।
নতুন যে সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছে তাদের অনেক চ্যালেঞ্জর নসিহত দেখা যায় নানা মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে বেশির ভাগ মানুষের হাতে এখন ইন্টারনেট। সেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার চেয়ে মিথ্যা, অসত্য, খণ্ডিত তথ্যের বিচরণ মহামারি পর্যায়ের। এই মহামারী সারাতে পদক্ষেপ না নিলে এ সরকারকেও একসময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। তাই অন্য সব চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি এটিকেও একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জের তালিকায় রাখার প্রয়োজনীয়তা কম নয়। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই মহাসড়ক কেটে ফেলা যাবে না। টুপির সাইজও ছোট করা যাবে না। কেবল কুয়োর ব্যাঙকে সমুদ্র দেখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, অর্থাৎ ইন্টারনেটের বিশালতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা যেতে পারে। আর মাথার সাইজ বড় করার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের মানুষকে ইন্টারনেটের সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ বোঝার সহজ কৌশল শেখাতে হবে।
-সাউথ ক্যারোলাইনা, ১৮ আগস্ট ২০২৪।
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041