
আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাশূন্য করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন’ও নিয়েছে ‘জিরো টলারেন্স’ প্রক্রিয়া। পতিত হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা গ্রেফতার হচ্ছেন। প্রথম ধাক্কায় বাতিল হয়েছে মন্ত্রিসভা, সমগ্র সংসদ। ১৯ আগস্ট বাতিল হলো সিটি-জেলা-উপজেলা-মেয়র পরিষদ। প্রায় ১০ হাজার আওয়ামী নেতা একযোগে পদ হারালেন। শীর্ষ পদগুলো পেলেন ডিসি, ইউএনও ও বিসিএস ক্যাডাররা। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্টাইলে নতুন দল গঠনের মাধ্যমে এই সংকট থেকে বের হতে চাচ্ছে ড. ইউনূসের সরকার। ফলে নীরবে চলছে ‘কিংস পার্টি’ গঠনের তৎপরতা।
বিএনপি-জাপা স্টাইলে ‘কিংস পার্টি’র গোপন প্রস্তুতি
২০০৭ সালেই নতুন দল খুলতে চেয়েছিলেন ড. ইউনূস। ‘ওয়ান ইলেভেনে’র সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে প্রধান উপদেষ্টা হননি। ওনার পরামর্শেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন পদটি পান। অন্যদিকে দল গঠনের প্রস্তুতি নেন নোবেলজয়ী ইউনূস। অনুজ সাংবাদিক-সহোদর মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর ঢাকায় মিনি অফিসও খোলেন। ১৯৯২-এ ড. কামালের গণফোরাম প্রতিষ্ঠাকালেও ছিল পদক্ষেপ। উদ্বোধনীতে ‘আমার দল’ শিরোনামে প্রবন্ধ পড়েন ড. ইউনূস। বিষয়টি তির্যক দৃষ্টিতে দেখেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। যদিও ১৯৯৬-এ প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন ‘হাবিবুর-ইউনূসে’র হাত হরে। বিচারপতি মু. হাবিবুর রহমান ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রফেসর মু. ইউনূস ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সদস্য। তখন প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে বলা হতো ‘দুই মুহাম্মদের আশীর্বাদকন্যা’। কিন্তু বঙ্গবন্ধু-কন্যা হাসিনা ড. ইউনূসকে চরম অশান্তি উপহার দেন।
ঘটনার পরস্পরায় ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর ক্ষমতা পান জেনারেল জিয়া। ৬ নভেম্বর সামরিক শাসন ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছিলেন সেনাপ্রধান। জাসদ, গণবাহিনীর বিপ্লব-আন্দোলনে তিনি ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত। গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত জিয়া প্রেসিডেন্ট সায়েমের অধীনে পুনরায় সেনাপ্রধান হন। জাসদ প্রস্তাবিত বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠায় শহীদ মিনারে যাননি। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সামরিক পরিস্থিতিকে গণতন্ত্রে ফেরান। মহামুজিব প্রবর্তিত একদলীয় ‘বাকশাল’ নিষিদ্ধ করেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের বাতাবরণে ‘আওয়ামী লীগ’কে রাজনীতিতে বৈধতা দেন। ১৯৭৮-এ তাজউদ্দীন-পত্নী জোহরা তাজউদ্দীন দলের আহ্বায়ক হন। পয়লা মে থেকে রাজনৈতিক সভা করার অনুমতি দেয় সরকার।
স্বাধীনতার ঘোষক জেনালে জিয়া নিজেও দল গড়েন। ১৯৭৮-এর পয়লা সেপ্টেম্বর নিবন্ধিত হয় বিএনপি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ভাসানী-ন্যাপ প্রধান রাজনীতিক মশিয়ূর রহমান যাদুমিয়া সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। বলাবাহুল্য, চেয়ারম্যান হন রাষ্ট্রপতি জে. জিয়াউর রহমান। দলটির দলীয় সংগীতÑশাহনাজ রহমতুল্লাহ গীত-
‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ,
জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ।’
১৯৭৯-এর ১৮ ফেব্রয়ারি হয় দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে। ১৯৮১-এর ১৭ মে শেখ হাসিনার দিল্লি থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন। বিবদমান আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ। ৩০ মে ’৮১ চট্টগ্রামে সৈনিকের গুলিতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুবরণ। ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুর সাত্তার নতুন রাষ্ট্রপতি হন। কিন্তু সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ সামরিক ক্যু ঘটান। ১৯৮২-এর ২৪ মার্চ ঘোষণা করেন সামরিক শাসন। দুই বছরের জন্য বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে বানান রাষ্ট্রপতি।
১৯৮৬-এর পয়লা জানুয়ারি ‘জাতীয় পার্টি’ গড়েন জে. এরশাদ। মিজান চৌধুরী, শামসুল হুদা, ডা. মতিন ছিলেন রাজনৈতিক সহযোগী। কবি-শাসক এইচ এম এরশাদ নিজেই লেখেন দলীয় সংগীত-
‘নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা
নতুন করে আজ শপথ নিলাম।’
১৯৮৬-এর ৭ মে হয়েছিল তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। জাতীয় পার্টি বিজয়ী হয়, বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। প্রথম এমপি হয়ে বিরোধী নেত্রী হন শেখ হাসিনা। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ‘বিএনপি’ নির্বাচন বর্জন করে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতও নির্বাচন করেছিল। তখন দেশে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ছিল। সংসদনেতা ও প্রধানমন্ত্রী হন জাপার মিজান চৌধুরী। ১০ জুলাই নতুন সংসদের উদ্বোধক ছিলেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ।
মিজানুর রহমান চৌধুরী ছিলেন সাবেক আওয়ামী লীগার। বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের পদচ্যুত তথ্যমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বরাবর ওনাকে চাচা ডাকতেন। এই চাচা-ভাতিজি মিলে পার্লামেন্টারি ক্যুর চেষ্টা চালান। ফলে ১৯৮৭-এর ৬ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট এরশাদ সংসদ বিলুপ্ত করেন। পরে ৪ মার্চের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আ.লীগ-বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনটি বর্জন করে। ১৯৯০-এর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতন। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন। ২৭ ফেব্রুয়ারি ’৯১-এর নির্বাচনে বিজয় পায় বিএনপি। বাংলাদেশে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া। বিরোধীদলীয় নেত্রী হন আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা। বেগম জিয়া পাঁচটি আসনে দাঁড়িয়ে পাঁচটিতেই বিজয় পান। শেখ হাসিনা চারটি আসনে দাঁড়িয়ে তিনটিতে হারেন। একমাত্র টুঙ্গিপাড়ার আসনে জিতে এমপি হন বঙ্গবন্ধু-কন্যা।
১৯৯৬-এ প্রথমবার ও ২০০৯-এ দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বতিল করেন আদালতের রায়ের অছিলায়। এরপর নিজের অধীনেই তিনবার নির্বাচন করে জেতেন। ২০১৩, ২০১৮ ও ২০২৪-এর ৭ জানুয়ারি। নির্বাচনগুলো ছিল অনেকটা ভোটারবিহীন, বিতর্কিত। নতুন জেনারেশন ভোট দিতে না পারায় ছিল চরমভাবে ক্ষুব্ধ।
ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট পতন ঘটেছে হাসিনা সরকারের। কিন্তু সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। জে. জিয়া ও জে. এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ নিয়ে বিতর্ক ছিল। গৃহীত পদক্ষেপসমূহ সংসদে পাস করানোর বাধ্যবাধকতাও ছিল। ফলে দলগঠনের মাধ্যমে সংসদে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। চলমান কেয়ারটেকার বা অন্তর্বর্তী সরকারও একই সমস্যায় ভুগছে। আসন্ন সংসদে বিএনপি, আওয়ামী লীগ বা জাপা-নির্ভর হতে চায় না। ফলে নীরবে প্রক্রিয়া চলছে ‘কিংস পার্টি’ গঠনের। ‘বৈষম্যহীন ছাত্র-আন্দোলন’ দলগঠনে একান্ত আগ্রহী। ইতিমধ্যে রয়টার্সকে সাক্ষাৎকার দিয়ে আগ্রহের কথা জানিয়েছে। ৭৬ বছর বয়স্ক আওয়ামী লীগকে ধরাশায়ী করায় মনোবল চাঙা। ইতিমধ্যে তাদের সামাজিক কর্মকাণ্ড সমাজে প্রভাব ফেলেছে। যেমন অভ্যুত্থান-পরবর্তী জাতীয় কর্মসূচিসমূহ :
গণভবন, সংসদ ভবনসহ সকল সড়ক পরিষ্কারকরণ,
পুলিশের অনুপস্থিতিতে সাফল্যের সঙ্গে ট্রাফিক ব্যবস্থা পরিচালনা, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ও ডাকাত ঠেকাতে পাহারা বসানো, রাজধানীসহ প্রধান সড়কসমূহে গ্রাফিতি অঙ্কন, সজ্জিতকরণ, বাজারের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসারত শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রদান, সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ‘সাংবিধানিক ক্যু’ প্রতিহতকরণ, ১৫ আগস্ট মহামুজিবের ৩২ নম্বরে আওয়ামীপন্থীদের কর্মসূচি ভণ্ডুলকরণ।
উল্লেখ্য, ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক উপদেষ্টা পরিষদে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু অপর সমন্বয়কেরা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডকে অগ্রবর্তী করে চলেছেন।
হাসিনাপন্থী ১৮৭৬ মেয়র, জেলা-উপজেলা চেয়ারম্যান পদচ্যুত ॥ রাষ্ট্রপতি-স্পিকার-সেনাপ্রধান-এসপি-ইউএনএ-ওসি বহাল ॥
আওয়ামী ক্যাডারদের হাতেই মাঠ প্রশাসন
স্থানীয় সরকারের সকল জনপ্রতিনিধিই পদ-পদবি হারালেন। এদের ৯৭ শতাংশই ছিলেন আওয়ামী লীগ বা হাসিনাপন্থী। সিটি করপোরেশনে ১২ জন মেয়র। ৬০ জন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। সঙ্গে ১৪ জন করে পরিষদ সদস্য। ৪৯৩ জন করে উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান। সঙ্গে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানও। ৩২৩ জন মেয়র + ৯ জন করে কাউন্সিলর। সাকল্যে আওয়ামী লীগের প্রায় ১০ হাজার তৃণমূল নেতা পদ হারালেন। এগুলোতে আপাতত প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদায়ন করা হচ্ছে।
সিটি করপোরেশনগুলোর প্রশাসক হয়েছেন অতিরিক্ত সচিব তথা বিভাগীয় কমিশনার। জেলা পরিষদে উপসচিব তথা জেলা প্রশাসক। উপজেলা পরিষদ ও মেয়র পদে ইউএনও বা এসি (ল্যান্ড)। সচেতন মহলের মতে, তাদের ৯৫ শতাংশ নিয়োগ পেয়েছেন আওয়ামী শাসনামলে। অধিকাংশই আওয়ামী পরিবারের সন্তান। পিএসসি বা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে সকলের চাকরিপ্রাপ্তি।
২০১৫ থেকে চেয়ারম্যান ছিলেন কবি ড. মোহাম্মদ সাদিক। ২০২৪-এর ৭ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ থেকে নৌকার এমপি হন। জনপ্রশাসন-বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভপতিও ছিলেন। মাঠ প্রশাসনের ইউএনও, সহকারী কমিশনারদের ‘সাদিক-ক্যাডার’ও বলা হয়। তিনি ২০১৩-১৪ সালে নির্বাচন কমিশনের সচিব ছিলেন। শেখ হাসিনাকে তৃতীয় বার সংসদ জয়ে সহযোগিতা করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু-কন্যা তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রীও বনে যান। মোহাম্মদ সাদিক অতঃপর শিক্ষাসচিব ও পিএসসির চেয়ারম্যান হন। কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পান এই সৃষ্টিশীল সচিব।
আওয়ামী লীগ মনোনীত রাষ্ট্রপতি মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপপু। সাড়ে তিন বছর মেয়াদ আছে ওনার। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সাংবিধানিকভাবে এখনো স্বপদে বহাল। রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে ওনারই দায়িত্ব নেওয়ার কথা। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের চাকরি আরও আড়াই বছর। ছাত্র-গণ অভ্যুত্থান ও পরবর্তীকালের ভূমিকায় প্রশংসিত। বিমান ও নৌ-প্রধান আওয়ামী শাসনকালের হলেও নিরপেক্ষতা দেখিয়েছেন। ডিসি-এসপি, ইউএনও-ওসিÑসবার চাকরি হাসিনা-যুগে। পরিস্থিতির কারণে দলীয় আনুগত্যের পরিবর্তে সবাই এখন নিরপেক্ষ। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা পুরোপুরি আস্থায় নিতে পারছেন না তাদের। ইতিমধ্যে ২৫ জেলার ডিসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাকিদেরও সরানো হবে। তবু হতাশ কণ্ঠে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন-আওয়ামী ক্যাডারদের হাতেই মাঠ প্রশাসন!
পুলিশের হাতে অস্ত্র দিতে সরকারের দ্বিধা
‘জুলাই-আগস্ট’ গণ-অভ্যুত্থানে নিহতের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। নাম-অলাদের জাতিসংঘ-স্বীকৃত সংখ্যা ৬৫০, এখন ৮০৩। অজ্ঞাতনামা হত্যা আরও প্রায় এক হাজার। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রায় সাড়ে তিন হাজার। আহত-নিহতের ৯০ শতাংশই দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থী। হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের মৃত্যু বহাল রয়েছে। ফলে নাগরিক জীবনে শোকের বাতাবরণ থামছে না। হত্যাকারী হিসেবে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির প্রতি ক্ষোভ চলমান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড হচ্ছে হত্যাকাণ্ডের নির্মম ভিডিও।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশও আক্রান্ত হয়েছে। নরসিংদীতে গণ-আক্রমণে পরাস্ত হয়েছিল প্রহরারত পুলিশ। জেল সুপার ও এসপি বলেছেন, ১০ হাজার মানুষ। এই গণজোয়ার ঠেকানোর শক্তিমত্তা আমাদের ছিল না। ফলে জঙ্গিসহ সাড়ে ৮০০ কয়েদি ফেরার। প্রায় ১০০ অস্ত্র লুট, পুরো কারাগারে অগ্নিকাণ্ড।
৫ আগস্ট ’২৪ দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ। বিমানযোগে ভারত পলায়ন, দেশে-বিদেশে গণ-উল্লাস। ওই সময়ে সারা দেশের থানায় থানায় চলে আক্রমণ। অধিকাংশ থানার পুলিশেরা আত্মসমর্পণ করতে থাকে। কিন্তু সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানা-পুলিশ আক্রমণ করে বসে। ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পরে আন্দোলনকারীরা সংগঠিত হয়ে অগ্নিকাণ্ড চালায়। প্রায় ১৩ জন পুলিশ নগদে, ২ জন হাসপাতালে প্রয়াত হন। দাপ্তরিকভাবে দেশে ৪২ জন পুলিশ নিহত বলে জানা গেছে।
গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই পুলিশ সেক্টর কর্মবিরতিতে নামে। থানাগুলো পুলিশবিহীন হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। রাজধানী ও মফস্বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ভাঙচুর হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রাজনীতি-যুক্তরাও আক্রান্ত হন। অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা হলে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় নামেন। শহরে শহরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রছাত্রীরাই।
মতবিনিময় শেষে নোটিশ দেওয়া হয় পুলিশ সদস্যদের। ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কর্মকর্তারা পলাতক থাকেন। তবে থানায় থানায় দায়িত্ব পালনকারীদের সিংহভাগ কাজে ফেরেন। তদুপরি ২০ শতাংশ কাজে যোগ দেয়নি বলে অভিযোগ।
পুলিশে শৃঙ্খলা ফেরানো নিয়ে প্রায়শ পর্যালোচনা বৈঠক বসছে। সোয়া দুই লাখ পুলিশের ৮০ শতাংশই সাবেক ছাত্রলীগ, যুবলীগ। শেখ হাসিনা দুই দফায় ২২ বছর সরকারে ছিলেন। ১৯৯৬-২০০১ আবার ২০০৯ থেকে ২০২৪। এই সময়কালেই পুলিশ বিভাগকে দলীয়করণ করার অভিযোগ। ২০১১-তে সংসদে বিরোধী দলে ছিল বিএনপি। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ছিলেন জয়নুল আবদিন ফারুক। ওনাকে সংসদ ভবনের সামনে পিটিয়ে ধরাশায়ী করা হয়। এই ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের হোতা ছিলেন দুই খ্যাতিমান পুলিশ কর্মকর্তা। ‘ডিবি হারুন’ ও বিপ্লব কুমার সরকার। ১৩ বছর পর ২০২৪-এ মামলার সুযোগ পেলেন রাজনীতিক ফারুক।
৩১ জুলাই ’২৪ ছাত্রদের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি ছিল শাহবাগে। মিছিলে কলেজ-শিক্ষার্থী নাহিদুল ইসলামের শ্বাসরোধ করা হয়। মুখ চিপে ধরেন ডিএমপি পরিদর্শক (অপারেশন) আরশাদ। সেই অমানবিক ছবি ফেসবুক-টুইটারে ছড়িয়ে পড়ে। অস্ত্র হাতে সরাসরি গুলি করারও অসংখ্য স্মৃতিচিত্র। পানি ছিটানোর নাম করে হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ। গুলিতে আহত ছাত্রকে গাড়ি থেকে সড়কে ফেলে চলে যাওয়া। এমন অসংখ্য অবর্ণনীয় বিবরণ পর্যালোচনায় এসেছে। পুলিশের নবনিযুক্ত আইজিপি ময়নুল হক তদন্ত সেল খুলেছেন। চাকরিদানে ঊর্ধ্বতনরা শত শত কোটি টাকা বাগিয়েছেন। সব মিলিয়ে চলমান পুলিশ বাহিনী নিয়ে বিতর্ক বিস্তর।
এ অবস্থায় একটি প্রস্তাবনা নিয়ে সরকার ভীষণ দোটানায়। একাধিক মানবাধিকার সংগঠক দিয়েছেন দাবিনামা। বলেছেন, এখনই পুলিশের হাতে অস্ত্র নয়। বিশ্বাসের জায়গায় না আসা পর্যন্ত ‘রিস্ক’ নেওয়া ঠিক হবে না। দিশানা পারুল নামের এক সমাজকর্মী জোর আবেদন রেখেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। দুই হাজার কিশোরকে পুলিশ নির্মমভাবে হত্যা করেছে। রাজনৈতিকভাবে তাদের দল পরাজিত হয়েছে। পুনর্বাসন পেয়ে হয়তো মনের বলও ফিরে পেয়েছে। কিন্তু বুলেটভরা অস্ত্র পেলে তারা পাগল হয়ে উঠবে। অতএব, আপাতত পরীক্ষামূলকভাবে চাকরি ফেরত দেওয়া যায় কিন্তু হাতে হাতে অস্ত্র এখনই নয়। আর অস্ত্র দিলেও গোলাবারুদ-কার্তুজের সম্ভার নয়।
বিএনপি-জাপা স্টাইলে ‘কিংস পার্টি’র গোপন প্রস্তুতি
২০০৭ সালেই নতুন দল খুলতে চেয়েছিলেন ড. ইউনূস। ‘ওয়ান ইলেভেনে’র সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে প্রধান উপদেষ্টা হননি। ওনার পরামর্শেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন পদটি পান। অন্যদিকে দল গঠনের প্রস্তুতি নেন নোবেলজয়ী ইউনূস। অনুজ সাংবাদিক-সহোদর মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর ঢাকায় মিনি অফিসও খোলেন। ১৯৯২-এ ড. কামালের গণফোরাম প্রতিষ্ঠাকালেও ছিল পদক্ষেপ। উদ্বোধনীতে ‘আমার দল’ শিরোনামে প্রবন্ধ পড়েন ড. ইউনূস। বিষয়টি তির্যক দৃষ্টিতে দেখেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। যদিও ১৯৯৬-এ প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন ‘হাবিবুর-ইউনূসে’র হাত হরে। বিচারপতি মু. হাবিবুর রহমান ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রফেসর মু. ইউনূস ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সদস্য। তখন প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে বলা হতো ‘দুই মুহাম্মদের আশীর্বাদকন্যা’। কিন্তু বঙ্গবন্ধু-কন্যা হাসিনা ড. ইউনূসকে চরম অশান্তি উপহার দেন।
ঘটনার পরস্পরায় ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর ক্ষমতা পান জেনারেল জিয়া। ৬ নভেম্বর সামরিক শাসন ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছিলেন সেনাপ্রধান। জাসদ, গণবাহিনীর বিপ্লব-আন্দোলনে তিনি ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত। গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত জিয়া প্রেসিডেন্ট সায়েমের অধীনে পুনরায় সেনাপ্রধান হন। জাসদ প্রস্তাবিত বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠায় শহীদ মিনারে যাননি। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সামরিক পরিস্থিতিকে গণতন্ত্রে ফেরান। মহামুজিব প্রবর্তিত একদলীয় ‘বাকশাল’ নিষিদ্ধ করেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের বাতাবরণে ‘আওয়ামী লীগ’কে রাজনীতিতে বৈধতা দেন। ১৯৭৮-এ তাজউদ্দীন-পত্নী জোহরা তাজউদ্দীন দলের আহ্বায়ক হন। পয়লা মে থেকে রাজনৈতিক সভা করার অনুমতি দেয় সরকার।
স্বাধীনতার ঘোষক জেনালে জিয়া নিজেও দল গড়েন। ১৯৭৮-এর পয়লা সেপ্টেম্বর নিবন্ধিত হয় বিএনপি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ভাসানী-ন্যাপ প্রধান রাজনীতিক মশিয়ূর রহমান যাদুমিয়া সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। বলাবাহুল্য, চেয়ারম্যান হন রাষ্ট্রপতি জে. জিয়াউর রহমান। দলটির দলীয় সংগীতÑশাহনাজ রহমতুল্লাহ গীত-
‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ,
জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ।’
১৯৭৯-এর ১৮ ফেব্রয়ারি হয় দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে। ১৯৮১-এর ১৭ মে শেখ হাসিনার দিল্লি থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন। বিবদমান আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ। ৩০ মে ’৮১ চট্টগ্রামে সৈনিকের গুলিতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুবরণ। ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুর সাত্তার নতুন রাষ্ট্রপতি হন। কিন্তু সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ সামরিক ক্যু ঘটান। ১৯৮২-এর ২৪ মার্চ ঘোষণা করেন সামরিক শাসন। দুই বছরের জন্য বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে বানান রাষ্ট্রপতি।
১৯৮৬-এর পয়লা জানুয়ারি ‘জাতীয় পার্টি’ গড়েন জে. এরশাদ। মিজান চৌধুরী, শামসুল হুদা, ডা. মতিন ছিলেন রাজনৈতিক সহযোগী। কবি-শাসক এইচ এম এরশাদ নিজেই লেখেন দলীয় সংগীত-
‘নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা
নতুন করে আজ শপথ নিলাম।’
১৯৮৬-এর ৭ মে হয়েছিল তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। জাতীয় পার্টি বিজয়ী হয়, বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। প্রথম এমপি হয়ে বিরোধী নেত্রী হন শেখ হাসিনা। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ‘বিএনপি’ নির্বাচন বর্জন করে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতও নির্বাচন করেছিল। তখন দেশে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ছিল। সংসদনেতা ও প্রধানমন্ত্রী হন জাপার মিজান চৌধুরী। ১০ জুলাই নতুন সংসদের উদ্বোধক ছিলেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ।
মিজানুর রহমান চৌধুরী ছিলেন সাবেক আওয়ামী লীগার। বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের পদচ্যুত তথ্যমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বরাবর ওনাকে চাচা ডাকতেন। এই চাচা-ভাতিজি মিলে পার্লামেন্টারি ক্যুর চেষ্টা চালান। ফলে ১৯৮৭-এর ৬ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট এরশাদ সংসদ বিলুপ্ত করেন। পরে ৪ মার্চের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আ.লীগ-বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনটি বর্জন করে। ১৯৯০-এর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতন। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন। ২৭ ফেব্রুয়ারি ’৯১-এর নির্বাচনে বিজয় পায় বিএনপি। বাংলাদেশে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া। বিরোধীদলীয় নেত্রী হন আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা। বেগম জিয়া পাঁচটি আসনে দাঁড়িয়ে পাঁচটিতেই বিজয় পান। শেখ হাসিনা চারটি আসনে দাঁড়িয়ে তিনটিতে হারেন। একমাত্র টুঙ্গিপাড়ার আসনে জিতে এমপি হন বঙ্গবন্ধু-কন্যা।
১৯৯৬-এ প্রথমবার ও ২০০৯-এ দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বতিল করেন আদালতের রায়ের অছিলায়। এরপর নিজের অধীনেই তিনবার নির্বাচন করে জেতেন। ২০১৩, ২০১৮ ও ২০২৪-এর ৭ জানুয়ারি। নির্বাচনগুলো ছিল অনেকটা ভোটারবিহীন, বিতর্কিত। নতুন জেনারেশন ভোট দিতে না পারায় ছিল চরমভাবে ক্ষুব্ধ।
ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট পতন ঘটেছে হাসিনা সরকারের। কিন্তু সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। জে. জিয়া ও জে. এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ নিয়ে বিতর্ক ছিল। গৃহীত পদক্ষেপসমূহ সংসদে পাস করানোর বাধ্যবাধকতাও ছিল। ফলে দলগঠনের মাধ্যমে সংসদে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। চলমান কেয়ারটেকার বা অন্তর্বর্তী সরকারও একই সমস্যায় ভুগছে। আসন্ন সংসদে বিএনপি, আওয়ামী লীগ বা জাপা-নির্ভর হতে চায় না। ফলে নীরবে প্রক্রিয়া চলছে ‘কিংস পার্টি’ গঠনের। ‘বৈষম্যহীন ছাত্র-আন্দোলন’ দলগঠনে একান্ত আগ্রহী। ইতিমধ্যে রয়টার্সকে সাক্ষাৎকার দিয়ে আগ্রহের কথা জানিয়েছে। ৭৬ বছর বয়স্ক আওয়ামী লীগকে ধরাশায়ী করায় মনোবল চাঙা। ইতিমধ্যে তাদের সামাজিক কর্মকাণ্ড সমাজে প্রভাব ফেলেছে। যেমন অভ্যুত্থান-পরবর্তী জাতীয় কর্মসূচিসমূহ :
গণভবন, সংসদ ভবনসহ সকল সড়ক পরিষ্কারকরণ,
পুলিশের অনুপস্থিতিতে সাফল্যের সঙ্গে ট্রাফিক ব্যবস্থা পরিচালনা, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ও ডাকাত ঠেকাতে পাহারা বসানো, রাজধানীসহ প্রধান সড়কসমূহে গ্রাফিতি অঙ্কন, সজ্জিতকরণ, বাজারের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসারত শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রদান, সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ‘সাংবিধানিক ক্যু’ প্রতিহতকরণ, ১৫ আগস্ট মহামুজিবের ৩২ নম্বরে আওয়ামীপন্থীদের কর্মসূচি ভণ্ডুলকরণ।
উল্লেখ্য, ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক উপদেষ্টা পরিষদে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু অপর সমন্বয়কেরা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডকে অগ্রবর্তী করে চলেছেন।
হাসিনাপন্থী ১৮৭৬ মেয়র, জেলা-উপজেলা চেয়ারম্যান পদচ্যুত ॥ রাষ্ট্রপতি-স্পিকার-সেনাপ্রধান-এসপি-ইউএনএ-ওসি বহাল ॥
আওয়ামী ক্যাডারদের হাতেই মাঠ প্রশাসন
স্থানীয় সরকারের সকল জনপ্রতিনিধিই পদ-পদবি হারালেন। এদের ৯৭ শতাংশই ছিলেন আওয়ামী লীগ বা হাসিনাপন্থী। সিটি করপোরেশনে ১২ জন মেয়র। ৬০ জন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। সঙ্গে ১৪ জন করে পরিষদ সদস্য। ৪৯৩ জন করে উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান। সঙ্গে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানও। ৩২৩ জন মেয়র + ৯ জন করে কাউন্সিলর। সাকল্যে আওয়ামী লীগের প্রায় ১০ হাজার তৃণমূল নেতা পদ হারালেন। এগুলোতে আপাতত প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদায়ন করা হচ্ছে।
সিটি করপোরেশনগুলোর প্রশাসক হয়েছেন অতিরিক্ত সচিব তথা বিভাগীয় কমিশনার। জেলা পরিষদে উপসচিব তথা জেলা প্রশাসক। উপজেলা পরিষদ ও মেয়র পদে ইউএনও বা এসি (ল্যান্ড)। সচেতন মহলের মতে, তাদের ৯৫ শতাংশ নিয়োগ পেয়েছেন আওয়ামী শাসনামলে। অধিকাংশই আওয়ামী পরিবারের সন্তান। পিএসসি বা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে সকলের চাকরিপ্রাপ্তি।
২০১৫ থেকে চেয়ারম্যান ছিলেন কবি ড. মোহাম্মদ সাদিক। ২০২৪-এর ৭ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ থেকে নৌকার এমপি হন। জনপ্রশাসন-বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভপতিও ছিলেন। মাঠ প্রশাসনের ইউএনও, সহকারী কমিশনারদের ‘সাদিক-ক্যাডার’ও বলা হয়। তিনি ২০১৩-১৪ সালে নির্বাচন কমিশনের সচিব ছিলেন। শেখ হাসিনাকে তৃতীয় বার সংসদ জয়ে সহযোগিতা করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু-কন্যা তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রীও বনে যান। মোহাম্মদ সাদিক অতঃপর শিক্ষাসচিব ও পিএসসির চেয়ারম্যান হন। কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পান এই সৃষ্টিশীল সচিব।
আওয়ামী লীগ মনোনীত রাষ্ট্রপতি মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপপু। সাড়ে তিন বছর মেয়াদ আছে ওনার। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সাংবিধানিকভাবে এখনো স্বপদে বহাল। রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে ওনারই দায়িত্ব নেওয়ার কথা। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের চাকরি আরও আড়াই বছর। ছাত্র-গণ অভ্যুত্থান ও পরবর্তীকালের ভূমিকায় প্রশংসিত। বিমান ও নৌ-প্রধান আওয়ামী শাসনকালের হলেও নিরপেক্ষতা দেখিয়েছেন। ডিসি-এসপি, ইউএনও-ওসিÑসবার চাকরি হাসিনা-যুগে। পরিস্থিতির কারণে দলীয় আনুগত্যের পরিবর্তে সবাই এখন নিরপেক্ষ। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা পুরোপুরি আস্থায় নিতে পারছেন না তাদের। ইতিমধ্যে ২৫ জেলার ডিসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাকিদেরও সরানো হবে। তবু হতাশ কণ্ঠে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন-আওয়ামী ক্যাডারদের হাতেই মাঠ প্রশাসন!
পুলিশের হাতে অস্ত্র দিতে সরকারের দ্বিধা
‘জুলাই-আগস্ট’ গণ-অভ্যুত্থানে নিহতের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। নাম-অলাদের জাতিসংঘ-স্বীকৃত সংখ্যা ৬৫০, এখন ৮০৩। অজ্ঞাতনামা হত্যা আরও প্রায় এক হাজার। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রায় সাড়ে তিন হাজার। আহত-নিহতের ৯০ শতাংশই দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থী। হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের মৃত্যু বহাল রয়েছে। ফলে নাগরিক জীবনে শোকের বাতাবরণ থামছে না। হত্যাকারী হিসেবে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির প্রতি ক্ষোভ চলমান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড হচ্ছে হত্যাকাণ্ডের নির্মম ভিডিও।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশও আক্রান্ত হয়েছে। নরসিংদীতে গণ-আক্রমণে পরাস্ত হয়েছিল প্রহরারত পুলিশ। জেল সুপার ও এসপি বলেছেন, ১০ হাজার মানুষ। এই গণজোয়ার ঠেকানোর শক্তিমত্তা আমাদের ছিল না। ফলে জঙ্গিসহ সাড়ে ৮০০ কয়েদি ফেরার। প্রায় ১০০ অস্ত্র লুট, পুরো কারাগারে অগ্নিকাণ্ড।
৫ আগস্ট ’২৪ দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ। বিমানযোগে ভারত পলায়ন, দেশে-বিদেশে গণ-উল্লাস। ওই সময়ে সারা দেশের থানায় থানায় চলে আক্রমণ। অধিকাংশ থানার পুলিশেরা আত্মসমর্পণ করতে থাকে। কিন্তু সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানা-পুলিশ আক্রমণ করে বসে। ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পরে আন্দোলনকারীরা সংগঠিত হয়ে অগ্নিকাণ্ড চালায়। প্রায় ১৩ জন পুলিশ নগদে, ২ জন হাসপাতালে প্রয়াত হন। দাপ্তরিকভাবে দেশে ৪২ জন পুলিশ নিহত বলে জানা গেছে।
গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই পুলিশ সেক্টর কর্মবিরতিতে নামে। থানাগুলো পুলিশবিহীন হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। রাজধানী ও মফস্বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ভাঙচুর হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রাজনীতি-যুক্তরাও আক্রান্ত হন। অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা হলে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় নামেন। শহরে শহরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রছাত্রীরাই।
মতবিনিময় শেষে নোটিশ দেওয়া হয় পুলিশ সদস্যদের। ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কর্মকর্তারা পলাতক থাকেন। তবে থানায় থানায় দায়িত্ব পালনকারীদের সিংহভাগ কাজে ফেরেন। তদুপরি ২০ শতাংশ কাজে যোগ দেয়নি বলে অভিযোগ।
পুলিশে শৃঙ্খলা ফেরানো নিয়ে প্রায়শ পর্যালোচনা বৈঠক বসছে। সোয়া দুই লাখ পুলিশের ৮০ শতাংশই সাবেক ছাত্রলীগ, যুবলীগ। শেখ হাসিনা দুই দফায় ২২ বছর সরকারে ছিলেন। ১৯৯৬-২০০১ আবার ২০০৯ থেকে ২০২৪। এই সময়কালেই পুলিশ বিভাগকে দলীয়করণ করার অভিযোগ। ২০১১-তে সংসদে বিরোধী দলে ছিল বিএনপি। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ছিলেন জয়নুল আবদিন ফারুক। ওনাকে সংসদ ভবনের সামনে পিটিয়ে ধরাশায়ী করা হয়। এই ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের হোতা ছিলেন দুই খ্যাতিমান পুলিশ কর্মকর্তা। ‘ডিবি হারুন’ ও বিপ্লব কুমার সরকার। ১৩ বছর পর ২০২৪-এ মামলার সুযোগ পেলেন রাজনীতিক ফারুক।
৩১ জুলাই ’২৪ ছাত্রদের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি ছিল শাহবাগে। মিছিলে কলেজ-শিক্ষার্থী নাহিদুল ইসলামের শ্বাসরোধ করা হয়। মুখ চিপে ধরেন ডিএমপি পরিদর্শক (অপারেশন) আরশাদ। সেই অমানবিক ছবি ফেসবুক-টুইটারে ছড়িয়ে পড়ে। অস্ত্র হাতে সরাসরি গুলি করারও অসংখ্য স্মৃতিচিত্র। পানি ছিটানোর নাম করে হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ। গুলিতে আহত ছাত্রকে গাড়ি থেকে সড়কে ফেলে চলে যাওয়া। এমন অসংখ্য অবর্ণনীয় বিবরণ পর্যালোচনায় এসেছে। পুলিশের নবনিযুক্ত আইজিপি ময়নুল হক তদন্ত সেল খুলেছেন। চাকরিদানে ঊর্ধ্বতনরা শত শত কোটি টাকা বাগিয়েছেন। সব মিলিয়ে চলমান পুলিশ বাহিনী নিয়ে বিতর্ক বিস্তর।
এ অবস্থায় একটি প্রস্তাবনা নিয়ে সরকার ভীষণ দোটানায়। একাধিক মানবাধিকার সংগঠক দিয়েছেন দাবিনামা। বলেছেন, এখনই পুলিশের হাতে অস্ত্র নয়। বিশ্বাসের জায়গায় না আসা পর্যন্ত ‘রিস্ক’ নেওয়া ঠিক হবে না। দিশানা পারুল নামের এক সমাজকর্মী জোর আবেদন রেখেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। দুই হাজার কিশোরকে পুলিশ নির্মমভাবে হত্যা করেছে। রাজনৈতিকভাবে তাদের দল পরাজিত হয়েছে। পুনর্বাসন পেয়ে হয়তো মনের বলও ফিরে পেয়েছে। কিন্তু বুলেটভরা অস্ত্র পেলে তারা পাগল হয়ে উঠবে। অতএব, আপাতত পরীক্ষামূলকভাবে চাকরি ফেরত দেওয়া যায় কিন্তু হাতে হাতে অস্ত্র এখনই নয়। আর অস্ত্র দিলেও গোলাবারুদ-কার্তুজের সম্ভার নয়।