রুমের দরজায় ধামধাম আওয়াজ শুনে দরজা খুলতেই নুজহাতের হাতে বড় একটা ডালা ধরিয়ে দিয়ে দরজা টান দিয়ে লাগিয়ে চলে গেলেন ছোট খালা। নুজহাতের ছোট খালা কোনো দিনই আস্তে কথা বলতে পারেন না। ওপাশে কাচ্ছি বেলের আওয়াজ শোনা গেল। নুজহাতের বড় ফুপুও এসেছেন, ঢুকেই বলতে শুরু করলেন :
-কই আমার নুজহাত মা, কই। কেমন আছ ভাবি?
-আরে রুনু, কেমন আছ, বসো বসো, তুমি একাই এসেছ?
-হ্যাঁ ভাবি, তোমার ননদের জামাইয়ের সময় কই বউয়ের সাথে বেড়ানোর। আসবে, তবে একটু দেরি হবে।
নুজহাতের ছোট খালা ও বড় ফুপু কেউ কারও থেকে কম যান না। ছোট খালা শুরু করলেন :
-বুঝেছেন রুনু আপা, ছেলেটা কিন্তু বড় ডাক্তার।
-ছেলেটার নাকি ডিভোর্স হয়েছে, ঝুমা (নুজহাতের ছোট খালা)?
-তো কী হয়েছে? নিজস্ব ফ্ল্যাট, গাড়ি সবই আছে। বাড়তি কোনো ঝামেলা নেই। ওর একটিমাত্র ছেলে আমেরিকা থাকে।
-নাম কী রে পাত্রের, আগের বউয়ের সাথে কী ঝামেলা হয়েছিল?
-ওর নাম শোভন, রুনু আপা। ওর আগের বউটা খুবই অহংকারী ছিল, বুঝেছেন। বড়লোকের মেয়ে, সংসারে মানিয়ে নিতে পারছিল না। কোনোভাবেই ওদের বনিবনা হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স। ছেলে কিন্তু খুব ভালো গানও জানে, জানেন!
-যাক ঠিক আছে, ভালোই হয়েছে।
-আপনারা তো কেউ নুজহাতকে রাজিই করাতে পারছিলেন না। অনেক ঝামেলা করে ওদের দেখা করিয়েছি। ছেলের ছোট খালা আমার বান্ধবী। ও-ই তো আমাকে শোভনের কথা বলল। তারপর আর কি, একবার নুজহাতের বড় মেয়েকে ভালো মেডিসিনের ডাক্তার দেখাবে বলছিল। আমি তখন কায়দা করে শোভনের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। ব্যস, দুজনের পরিচয় হলো। তারপর ধীরে ধীরে পছন্দ হয়ে গেল। পছন্দ না হয়ে যাবে কোথায়, একেবারে সোনায় সোহাগা। এত দিনে আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছেন। যেমন বর তেমন ঘর... বাহ! বাহ!
এভাবেই অনেক কথা হচ্ছিল দরজার ওপাশে। নুজহাত আর মনোযোগ দিয়ে ছোট খালার কথা শুনতে চাচ্ছিল না। আজ নুজহাতের বড় ফুপু খুব একটা ফর্মে নেই, যেহেতু ছোট খালা বিয়ের ব্যাপারটা দেখছেন, সেহেতু ফুপু খুব একটা ফ্লোর পাচ্ছেন না। তা নাহলে উনিও একহাত দেখিয়ে দিতেন। নুজহাতের মা তার বোনকে থামানোর চেষ্টা করছেন।
-আহা ঝুমা, কথা একটু কম বল তো, মাথাব্যথা করছে।
-আমি কই কথা বললাম বড়’পা। বিষয়টা সবাই জানবে না। যেকোনো কাজ তো আর বিনা কসরতে হয় না।
-আমারও অনেক মাথা ধরেছে ভাবি, তোমার রুমের এসির রিমোটটা কই, আমি একটু ঘুমাব। বলেই রুমে চলে গেলেন নুজহাতের ফুপু।
নুজহাত চৌধুরী, একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সিনিয়র টিচার। ওর বড় মেয়ে মানহা, আর এক সেমিস্টার শেষ করলেই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ফেলবে। আর ছোট মেয়ে মুনতাহা এবার এ লেভেল পরীক্ষা দিচ্ছে। মা-মেয়ে তিনজনকেই এক বয়সী মনে হয়। নুজহাতের যখন মাত্র ১৯ বছর বয়স, তখনই ওর বড় মেয়ের জন্ম। নুজহাত ছোট খালার হাত থেকে ডালাটা নিয়ে বিছানার ওপর রাখে। ডালাটা কী সুন্দর করে সাজানো। একটা লাল রঙের রিবন দিয়ে বাঁধা আর গ্লাস পেপার দিয়ে মোড়া, উপরে আবার একটা জারবেরা ফুলও দেওয়া রয়েছে। রিবনটা খুলে গ্লাস পেপারটা সরাতেই দেখা গেল সুন্দর লাল গোলাপ রঙের একটা কাঞ্চিভরম কাতান। এক জোড়া লাল রঙের এপেক্সের স্যান্ডেল, সেটার ওপর আবার একটু স্টোনের কাজও করা। একটা সোনার গয়নার সেট। গয়নাগুলোও বেশ সুন্দর, মেট কালারের গোল্ড, দেখে মনে হচ্ছে তানিশ জুয়েলার্সের গয়না। জিনিসগুলো নুজহাতের দারুণ পছন্দ হয়েছে। সাথে কিছু লাল কাচের চুড়ি আর বেলি ফুলের মালাও দিয়ে দিয়েছে ওরা। ওদের পছন্দ ভালো। ওর জীবনে এই ব্যাপারগুলো এই প্রথম। এত আদর-ভালোবাসা দিয়ে ওর জন্য ডালা এর আগে আসেনি। শাড়িটা খুলে নুজহাত গালে লাগায়, কেমন একটা মায়া মায়া গন্ধ। হালকা মেকআপ করে। গয়নার বাক্স খুলে সীতা হার আর কানে দুলও পরে নেয়। সোনার চুড়ি আর কাচের চুড়িগুলো মিলিয়ে দু’হাতে পরে। তার সাথে বেলি ফুলের মালাগুলোও হাতে জড়িয়ে রাখে। পিঠজুড়ে চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে। চুলগুলো এক সপ্তাহ আগেই কালার করিয়েছিল। গতকাল পার্লার থেকে একটু মেহেদিও পরে এসেছে নুজহাত। পছন্দের পারফিউমও দিল। আয়নাতে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে, সব বয়সেরই একটা সৌন্দর্য থাকে। রুমজুড়ে হাতে পরা বেলি ফুল আর পারফিউমের সুবাসে অদ্ভুত এক মাদকতা তৈরি হয়েছে। গলায় শুধু সীতা হারটা পরাতে গলাটা খানিকটা খালি মনে হচ্ছে, আরেকটা হার পরলে ভালো লাগবে এই ভেবে আলমারিটা খুলতেই অ্যালবামটা পড়ে গেল। এটা শুধু একটা অ্যালবাম নয়, ওর জীবনের আরেকটা অধ্যায়ের সাক্ষী।
অ্যালবামটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে বিছানায় বসে নুজহাত। প্রথম পাতাতেই সেই ছবিটা। প্রথম যেদিন ওরা দুজন পালিয়ে বিয়ে করেছিল। আরমান ছিল ওদের প্রতিবেশী। প্রি-স্কুল থেকে ওরা একসাথে পড়াশোনা করেছে। নুজহাতের দাদা ছিলেন সরকারি বড় কর্মকর্তা। অভিজাত এলাকায় নিজেদের পাঁচতলা বাড়ি। বাড়িটা ওর দাদারই করা, ওর বাবাও একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো পজিশনে ছিলেন। কয়েক পুরুষ ধরেই ওরা সামাজিকভাবে ভীষণ প্রতিষ্ঠিত একটি পরিবার। আর ওদিকে আরমানরা ছিল ওখানকার স্থানীয় লোক। জমি বিক্রি করে ওদের অনেক টাকা-পয়সা হলেও শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থাতে ওরা অনেক পিছিয়ে ছিল। নুজহাতের শৈশবটা দেশ ও বিদেশ দুই জায়গা মিলিয়েই কেটেছে। নুজহাত যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে, তখন ওর বাবার সিঙ্গাপুরে পোস্টিং হয়। বাবার সাথে ওরাও চলে যায় সিঙ্গাপুরে। সেখান থেকেই এ লেভেল শেষ করে দেশে ফেরে। বাবার ছুটিতে যখন দেশে আসত, তখনো ছোটবেলার খেলার সাথি আরমানের সাথে যোগাযোগ হতো তার। আরমান ছিল ভীষণ দুরন্ত। তার দুরন্তপনার খুব ভক্ত ছিল নুজহাত। কার্যত দুই পরিবারের মধ্যে বিস্তর ফারাক ছিল। নুজহাতদের পারিবারিক পরিবেশ ছিল বেশ কঠিন। পারিবারিকভাবে নিজেদেরকে খুব শিক্ষিত এবং এলিট শ্রেণির জাহির করাটাকেই বেশ পছন্দ করতেন ওনারা। খুবই কড়া অনুশাসন আর অতি অভিজাত পারিবারিক পরিবেশের বাইরে গিয়ে আরমানের সাথে নুজহাত যতক্ষণ সময় কাটাত বা আড্ডা দিত, ওই সময়টুকু তার কাছে খুবই প্রিয় ছিল। মনে হতো প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে সে। দেশে এলে দেখা করার বাইরেও ইমেইলের মাধ্যমেও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখত সব সময়। নুজহাতের এ লেভেল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর একেবারে দেশে ফিরে আসে ওরা। দেশে ফিরে আইবিএতে ভর্তি হয় নুজহাত। বরাবরই ছাত্রী হিসেবে খুব মেধাবী ছিল সে। আর আরমান ছিল তার পুরোটাই উল্টা। আরমানের ছিল সালমান খানের মতো লম্বা চুল। মোটরসাইকেল নিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াত সারাক্ষণ। একদম হিন্দি সিনেমার নায়ক। এই ব্যাপারটা নুজহাত দারুণ পছন্দ করত। নুজহাত নিজেকে হিন্দি সিনেমার সিমরান ভাবত তখন। নুজহাতের বাবা-মা যখন খেয়াল করলেন ওর আর আরমানের যোগাযোগ দিনে দিনে বেড়েই চলছে, তখন খুব তড়িঘড়ি করে নুজহাতকে আমেরিকা পাঠিয়ে দেন পড়াশোনা করার জন্য। ওনাদের চাপাচাপিতে এখানে আইবিএতে পড়াশোনা ছেড়ে আমেরিকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং ওখানে এক সেমিস্টার শেষও করে সে। এক সেমিস্টার শেষ করেই দেশে বেড়িয়ে যাওয়ার বাহানা ধরে নুজহাত। ওর বাবা শর্ত দিলেন, দেশে এলেও আরমানের সাথে আর যোগাযোগ করা যাবে না। নুজহাত তাদের কথায় রাজি হয়। কিন্তু দেশে ফেরার পর থেকে কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না নুজহাত। নব্বই দশকের সময়টাতে টিঅ্যান্ডটি ফোনই একমাত্র ভরসা ছিল। তখনো মোবাইল বা ফেসবুক মানুষের নাগালে আসেনি। আরমানের সাথে টিঅ্যান্ডটি ফোনে আর মেইলেই যোগাযোগ করত নুজহাত। দেখা হওয়াটা খুব কঠিন ছিল তাদের। আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার দুই দিন আগে নুজহাত মাকে বলল আইবিএর বন্ধুদের সাথে দেখা করতে চায় সে। মা রাজি হন, উনি ধরেই নেন নুজহাত নিশ্চয় যাওয়ার আগ মুহূর্তে আর কোনো ঝামেলা করবে না।
মায়ের ভাবনার ঊর্ধ্বে গিয়ে নুজহাত আরমানের সাথে পালিয়ে যায়। চোখভর্তি রঙিন স্বপ্ন তখন তার। ‘রংচটা জিন্সের প্যান্ট পরা, জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে ধরা’র যুগ। নুজহাতের পৃথিবীতে তখন আবেগই সব। চোখেমুখে রঙিন স্বপ্ন, দুনিয়া তার কাছে খুবই রঙিন। আরমানকে সে পাগলের মতো ভালোবাসে। আরমানের মোটরসাইকেলের পেছনে বসে একসাথে ছুটে চলাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মনে হতো তার কাছে। এই সম্পর্ক আর বিয়ের পরিণতি কী হতে পারে, তা ওর ভাবনারও ঊর্ধ্বে ছিল। আরমানের বন্ধুদের সহায়তায় কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ওরা। আরমান ওকে নিয়ে ওর এক বন্ধুর বাসায় ওঠে। সেখানে তিন-চার দিন থাকার পর নিজেরা ছোট একটা বাসা ভাড়া করে।
এদিকে নুজহাতের পরিবার ওকে খোঁজাখুঁজি করে পুরো এলাকায় হুলুস্থুল বাধিয়ে ফেলে। তারপর যখন শুনতে পান, ওরা বিয়ে করে ফেলেছে, ওনারা চুপ হয়ে যান। বিয়ের পর এই প্রথম নুজহাত স্বপ্নের জগৎ থেকে মাটিতে পদার্পণ করে। দুই পরিবারের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, তা আন্তে আন্তে বুঝতে শুরু করে। ও যে পরিবেশে বড় হয়েছে আর আরমান যে পরিবেশে বড় হয়েছে, তাতে যে বিস্তর ব্যবধান, তা তখন নুজহাতের কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়।
স্বপ্নের দুনিয়া থেকে নেমে দুজনের জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। আরমান একটা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করে আর নুজহাত করে ঘরকন্না। এই প্রথম দুজন বুঝতে শিখল ভালোবাসা আর সংসার এক ব্যাপার নয়। সবকিছু মোহ আর স্বপ্নতে চলে না। আরমানও ওকে নিয়ে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এভাবেই সংসার চলতে লাগল, দুজনেরই বোধ হতে লাগল, দুই নদীর পানি একই নদীতে প্রবাহিত হলেও তা একসাথে মেশে না। বছর যেতেই বেশ খানিকটা অপরিকল্পিতভাবেই কোলজুড়ে আসে বড় মেয়ে মানহা। নুজহাতের বাবা-মা এত দিন কোনো খোঁজখবর না নিলেও নাতনির জন্মের পর নুজহাতের মা বাসায় আসেন। নুজহাতের সাথে খুব একটা কথা না বললেও মানহাকে বুকে নিয়ে আদর করেন। তার পর থেকে মূলত মানহাকে ওনারাই লালন-পালন করেন।
মা-বাবার সহায়তায় নুজহাত আবারো পড়াশোনা শুরু করে। আরমানও যথাসাধ্য চেষ্টা করে নুজহাতকে ভালো রাখার। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে নুজহাত একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে টিচার হিসেবে জয়েন করে। দুজনের রোজগারে সংসারে একটা গতি আসে। তারপর কোলজুড়ে আসে দ্বিতীয় মেয়ে মুনতাহা। এভাবেই ভালো-মন্দ মিলিয়ে সংসার ভালোই চলছিল তাদের। কিন্তু আরমান আর সে যে দুই কূলের বাসিন্দা। এই ব্যবধানটা কোনোভাবেই ঘোচানো যাচ্ছিল না। নুজহাতের পরিবারের সাথে যতই তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল, আরমান যেন ততই সবকিছু থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। এই পরিবারের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছিলই না সে। ওরা দুজনই প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল তাদের কমিটমেন্ট কমপ্লাই করার জন্য, কিন্তু কোথায় যেন একটা দেয়াল ছিল দুজনের মাঝখানে।
নুজহাত প্রায়ই ভাবে, ও-ই মনে হয় আরমানের সাথে অন্যায় করে ফেলেছে। মানুষটা তার নিজের মতো করে একটা সাদামাটা পরিবার থেকে তার মতো একটা জীবনসঙ্গী বেছে নিত, এটাই হয়তো তার জন্য সবচেয়ে মঙ্গলময় হতো। আজকাল আরমানের ব্লাডপ্রেশার সব সময় হাই হয়ে থাকে, ওষুধেও খুব একটা কন্ট্রোল হতে চায় না। এদিকে মানহা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে তার খরচ, মুনতাহার স্কুলের খরচ। আবার অভিজাত এলাকায় থাকতে গিয়ে ভাড়াও বেশি, সব মিলিয়ে একটা চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল সময়। এর মধ্যে আরমান স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে যায়। উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে গিয়ে দুই পরিবার হিমশিম খায়। তার পরও শেষরক্ষা হয় না। আরমান পাড়ি জমায় অজানা গন্তব্যে।
আরমান চলে যাওয়ার পর থেকেই মেয়ে দুটোসহ মায়ের বাসায় চলে আসে নুজহাত। প্রতি সপ্তাহেই আজিমপুর কবরস্থানে মা-মেয়ে তিনজন গিয়ে দাঁড়ায়, আরমানকে দেখে আসে। চারটা মানুষের জীবনে কী পরিমাণ সংগ্রাম করতে হয়েছে শুধু ক্ষণিকের মোহ আর কিছু ভুলভাল সিদ্ধান্তের জন্য।
আবারও দরজায় ধুমধুম আওয়াজ...
নুজহাত অ্যালবামটা বন্ধ করে বুকের মধ্যে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর সাবধানে চোখ দুটো মুছে। তারপর দরজাটা খোলে। দেখে, ওর মা গোল্ডেন কালারের একটি শাড়ি পরা, তার মুখভর্তি হাসি। পেছনে মেয়ে দুটো দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই নানির সাথে ম্যাচিং করে গোল্ডেন রঙের লেহেঙ্গা পরেছে। মেয়ে দুটোকে পরীর মতো লাগছে। শুধু দুই জোড়া ডানা লাগিয়ে দিতে হবে।
নুজহাত ওদেরকে বলল, ‘তোমরা যাও, আমি আসছি।’
দরজাটা একটু ফাঁক ছিল। তাকিয়ে দেখে, শোভন দাঁড়িয়ে সবার সাথে হাত মেলাচ্ছে। মুক্তার মতো সাদা রঙের একটা পাঞ্জাবি পরেছে ও। লম্বা ছিমছাম একটা মানুষ। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল ব্যক্তিত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকগুণ। পঞ্চাশ বয়সেরও যে একটা সৌন্দর্য থাকে, তা শোভনকে দেখলেই বোঝা যায়।
আজ নুজহাতের নতুন আরেকটি অ্যালবামের সূচনা হবে। সে জানে না এই অ্যালবামটা কী রঙে রঙিন হবে তার।
নুজহাতকে রুম থেকে নিয়ে আসেন ছোট খালা। আকদ পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। দু’পাশে দুই মেয়ে ওর দু’হাত ধরে আছে। আর ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে আছেন নুজহাতের মা।
‘আলহামদুলিল্লাহ।’
বলার সাথে সাথে মেয়ে দুটো তাকে জড়িয়ে চুমু খায়। ছোট খালা শোভনকে নুজহাতের পাশে বসিয়ে দেন। বড় ফুপু মনের অজান্তেই বলে ওঠেন, ‘মাশাআল্লাহ।’
আসলেই সোনায় সোহাগা। ছোট মেয়ে মুনতাহা দুজনের ছবি তুলে দেয়। শোভন বাচ্চা দুটোকেও ডেকে বলে, ‘চলো একটা ফ্যামিলি ফটো হয়ে যাক।’
একপর্যায়ে খাওয়াদাওয়া শেষ করে মেহমানরা সবাই রওনা দেন। বাকিরা সবাই বিভিন্ন গাড়িতে উঠলেও নুজহাত আর শোভন আলাদা গাড়িতে ওঠে। শোভন নিজেই ড্রাইভ করে, তার নতুন ওডি গাড়িতে করে শুধুই ওরা দুজন রওনা দেয়।
বেশ রাত হয়ে গিয়েছে, সুনসান নীরবতা, জোছনা গলে গলে পড়া একটা রাত, রাস্তার লাইটপোস্টের আলো উপচে জোছনার আলো মোমের মতো গলে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, অদ্ভুত এক মায়াময় পরিবেশ। গাড়িতে সামনে অল্প একটু বেলি ফুলের মালা ঝোলানো রয়েছে। এয়ার ফ্রেশনার আর বেলি ফুল মিলে গাড়িতে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। চুপচাপ দুটো মানুষ বসে আছে সিটবেল্ট বেঁধে, কেউ কোনো কথা বলছে না।
নুজহাত অপলক দৃষ্টিতে গাড়ির বাঁ পাশের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। এই রাত, এই জোছনা, এই যাত্রা সবই তার কাছে অন্য রকম নতুন। গাড়ি যাচ্ছে আজিমপুর কবরস্থানের সামনে দিয়ে বেশ হালকা গতিতে। হঠাৎ মনে হলো কবরস্থানের ওই পাশটাতে জোছনার আলো একটু কম, কেমন যেন একটা ধোঁয়া ধোঁয়া অন্ধকার। আর সেই আবছা আলো আর অন্ধকার থেকেই আরমান যেন দূর থেকে তাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। অজান্তেই চোখ ভিজে উঠল নুজহাতের, শোভনের অগোচরে চোখ মুছল সে। শোভন কিছু বুঝল কি না কে জানে, কিন্তু ওর হাতটা ধরে বলল :
‘চলো, সব কষ্ট ভুলে গিয়ে সব অপূর্ণতাকে পূর্ণ করি দুজন মিলে।’
গাড়ি চলছে ধীর গতিতে আর সাউন্ড সিস্টেমে গান বাজছে :
‘এই রাত তোমার আমার, ঐ চাঁদ তোমার আমার, শুধু দুজনের
এই রাত শুধু যে গানের, এইক্ষণ এ দুটি প্রাণের
কুহু কূজনে, এই রাত তোমার আমার।’
নুজহাতও দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে শোভনের হাতটা ধরে রাখে পরম নির্ভরতায়।
-কই আমার নুজহাত মা, কই। কেমন আছ ভাবি?
-আরে রুনু, কেমন আছ, বসো বসো, তুমি একাই এসেছ?
-হ্যাঁ ভাবি, তোমার ননদের জামাইয়ের সময় কই বউয়ের সাথে বেড়ানোর। আসবে, তবে একটু দেরি হবে।
নুজহাতের ছোট খালা ও বড় ফুপু কেউ কারও থেকে কম যান না। ছোট খালা শুরু করলেন :
-বুঝেছেন রুনু আপা, ছেলেটা কিন্তু বড় ডাক্তার।
-ছেলেটার নাকি ডিভোর্স হয়েছে, ঝুমা (নুজহাতের ছোট খালা)?
-তো কী হয়েছে? নিজস্ব ফ্ল্যাট, গাড়ি সবই আছে। বাড়তি কোনো ঝামেলা নেই। ওর একটিমাত্র ছেলে আমেরিকা থাকে।
-নাম কী রে পাত্রের, আগের বউয়ের সাথে কী ঝামেলা হয়েছিল?
-ওর নাম শোভন, রুনু আপা। ওর আগের বউটা খুবই অহংকারী ছিল, বুঝেছেন। বড়লোকের মেয়ে, সংসারে মানিয়ে নিতে পারছিল না। কোনোভাবেই ওদের বনিবনা হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স। ছেলে কিন্তু খুব ভালো গানও জানে, জানেন!
-যাক ঠিক আছে, ভালোই হয়েছে।
-আপনারা তো কেউ নুজহাতকে রাজিই করাতে পারছিলেন না। অনেক ঝামেলা করে ওদের দেখা করিয়েছি। ছেলের ছোট খালা আমার বান্ধবী। ও-ই তো আমাকে শোভনের কথা বলল। তারপর আর কি, একবার নুজহাতের বড় মেয়েকে ভালো মেডিসিনের ডাক্তার দেখাবে বলছিল। আমি তখন কায়দা করে শোভনের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। ব্যস, দুজনের পরিচয় হলো। তারপর ধীরে ধীরে পছন্দ হয়ে গেল। পছন্দ না হয়ে যাবে কোথায়, একেবারে সোনায় সোহাগা। এত দিনে আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছেন। যেমন বর তেমন ঘর... বাহ! বাহ!
এভাবেই অনেক কথা হচ্ছিল দরজার ওপাশে। নুজহাত আর মনোযোগ দিয়ে ছোট খালার কথা শুনতে চাচ্ছিল না। আজ নুজহাতের বড় ফুপু খুব একটা ফর্মে নেই, যেহেতু ছোট খালা বিয়ের ব্যাপারটা দেখছেন, সেহেতু ফুপু খুব একটা ফ্লোর পাচ্ছেন না। তা নাহলে উনিও একহাত দেখিয়ে দিতেন। নুজহাতের মা তার বোনকে থামানোর চেষ্টা করছেন।
-আহা ঝুমা, কথা একটু কম বল তো, মাথাব্যথা করছে।
-আমি কই কথা বললাম বড়’পা। বিষয়টা সবাই জানবে না। যেকোনো কাজ তো আর বিনা কসরতে হয় না।
-আমারও অনেক মাথা ধরেছে ভাবি, তোমার রুমের এসির রিমোটটা কই, আমি একটু ঘুমাব। বলেই রুমে চলে গেলেন নুজহাতের ফুপু।
নুজহাত চৌধুরী, একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সিনিয়র টিচার। ওর বড় মেয়ে মানহা, আর এক সেমিস্টার শেষ করলেই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ফেলবে। আর ছোট মেয়ে মুনতাহা এবার এ লেভেল পরীক্ষা দিচ্ছে। মা-মেয়ে তিনজনকেই এক বয়সী মনে হয়। নুজহাতের যখন মাত্র ১৯ বছর বয়স, তখনই ওর বড় মেয়ের জন্ম। নুজহাত ছোট খালার হাত থেকে ডালাটা নিয়ে বিছানার ওপর রাখে। ডালাটা কী সুন্দর করে সাজানো। একটা লাল রঙের রিবন দিয়ে বাঁধা আর গ্লাস পেপার দিয়ে মোড়া, উপরে আবার একটা জারবেরা ফুলও দেওয়া রয়েছে। রিবনটা খুলে গ্লাস পেপারটা সরাতেই দেখা গেল সুন্দর লাল গোলাপ রঙের একটা কাঞ্চিভরম কাতান। এক জোড়া লাল রঙের এপেক্সের স্যান্ডেল, সেটার ওপর আবার একটু স্টোনের কাজও করা। একটা সোনার গয়নার সেট। গয়নাগুলোও বেশ সুন্দর, মেট কালারের গোল্ড, দেখে মনে হচ্ছে তানিশ জুয়েলার্সের গয়না। জিনিসগুলো নুজহাতের দারুণ পছন্দ হয়েছে। সাথে কিছু লাল কাচের চুড়ি আর বেলি ফুলের মালাও দিয়ে দিয়েছে ওরা। ওদের পছন্দ ভালো। ওর জীবনে এই ব্যাপারগুলো এই প্রথম। এত আদর-ভালোবাসা দিয়ে ওর জন্য ডালা এর আগে আসেনি। শাড়িটা খুলে নুজহাত গালে লাগায়, কেমন একটা মায়া মায়া গন্ধ। হালকা মেকআপ করে। গয়নার বাক্স খুলে সীতা হার আর কানে দুলও পরে নেয়। সোনার চুড়ি আর কাচের চুড়িগুলো মিলিয়ে দু’হাতে পরে। তার সাথে বেলি ফুলের মালাগুলোও হাতে জড়িয়ে রাখে। পিঠজুড়ে চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে। চুলগুলো এক সপ্তাহ আগেই কালার করিয়েছিল। গতকাল পার্লার থেকে একটু মেহেদিও পরে এসেছে নুজহাত। পছন্দের পারফিউমও দিল। আয়নাতে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে, সব বয়সেরই একটা সৌন্দর্য থাকে। রুমজুড়ে হাতে পরা বেলি ফুল আর পারফিউমের সুবাসে অদ্ভুত এক মাদকতা তৈরি হয়েছে। গলায় শুধু সীতা হারটা পরাতে গলাটা খানিকটা খালি মনে হচ্ছে, আরেকটা হার পরলে ভালো লাগবে এই ভেবে আলমারিটা খুলতেই অ্যালবামটা পড়ে গেল। এটা শুধু একটা অ্যালবাম নয়, ওর জীবনের আরেকটা অধ্যায়ের সাক্ষী।
অ্যালবামটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে বিছানায় বসে নুজহাত। প্রথম পাতাতেই সেই ছবিটা। প্রথম যেদিন ওরা দুজন পালিয়ে বিয়ে করেছিল। আরমান ছিল ওদের প্রতিবেশী। প্রি-স্কুল থেকে ওরা একসাথে পড়াশোনা করেছে। নুজহাতের দাদা ছিলেন সরকারি বড় কর্মকর্তা। অভিজাত এলাকায় নিজেদের পাঁচতলা বাড়ি। বাড়িটা ওর দাদারই করা, ওর বাবাও একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো পজিশনে ছিলেন। কয়েক পুরুষ ধরেই ওরা সামাজিকভাবে ভীষণ প্রতিষ্ঠিত একটি পরিবার। আর ওদিকে আরমানরা ছিল ওখানকার স্থানীয় লোক। জমি বিক্রি করে ওদের অনেক টাকা-পয়সা হলেও শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থাতে ওরা অনেক পিছিয়ে ছিল। নুজহাতের শৈশবটা দেশ ও বিদেশ দুই জায়গা মিলিয়েই কেটেছে। নুজহাত যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে, তখন ওর বাবার সিঙ্গাপুরে পোস্টিং হয়। বাবার সাথে ওরাও চলে যায় সিঙ্গাপুরে। সেখান থেকেই এ লেভেল শেষ করে দেশে ফেরে। বাবার ছুটিতে যখন দেশে আসত, তখনো ছোটবেলার খেলার সাথি আরমানের সাথে যোগাযোগ হতো তার। আরমান ছিল ভীষণ দুরন্ত। তার দুরন্তপনার খুব ভক্ত ছিল নুজহাত। কার্যত দুই পরিবারের মধ্যে বিস্তর ফারাক ছিল। নুজহাতদের পারিবারিক পরিবেশ ছিল বেশ কঠিন। পারিবারিকভাবে নিজেদেরকে খুব শিক্ষিত এবং এলিট শ্রেণির জাহির করাটাকেই বেশ পছন্দ করতেন ওনারা। খুবই কড়া অনুশাসন আর অতি অভিজাত পারিবারিক পরিবেশের বাইরে গিয়ে আরমানের সাথে নুজহাত যতক্ষণ সময় কাটাত বা আড্ডা দিত, ওই সময়টুকু তার কাছে খুবই প্রিয় ছিল। মনে হতো প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে সে। দেশে এলে দেখা করার বাইরেও ইমেইলের মাধ্যমেও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখত সব সময়। নুজহাতের এ লেভেল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর একেবারে দেশে ফিরে আসে ওরা। দেশে ফিরে আইবিএতে ভর্তি হয় নুজহাত। বরাবরই ছাত্রী হিসেবে খুব মেধাবী ছিল সে। আর আরমান ছিল তার পুরোটাই উল্টা। আরমানের ছিল সালমান খানের মতো লম্বা চুল। মোটরসাইকেল নিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াত সারাক্ষণ। একদম হিন্দি সিনেমার নায়ক। এই ব্যাপারটা নুজহাত দারুণ পছন্দ করত। নুজহাত নিজেকে হিন্দি সিনেমার সিমরান ভাবত তখন। নুজহাতের বাবা-মা যখন খেয়াল করলেন ওর আর আরমানের যোগাযোগ দিনে দিনে বেড়েই চলছে, তখন খুব তড়িঘড়ি করে নুজহাতকে আমেরিকা পাঠিয়ে দেন পড়াশোনা করার জন্য। ওনাদের চাপাচাপিতে এখানে আইবিএতে পড়াশোনা ছেড়ে আমেরিকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং ওখানে এক সেমিস্টার শেষও করে সে। এক সেমিস্টার শেষ করেই দেশে বেড়িয়ে যাওয়ার বাহানা ধরে নুজহাত। ওর বাবা শর্ত দিলেন, দেশে এলেও আরমানের সাথে আর যোগাযোগ করা যাবে না। নুজহাত তাদের কথায় রাজি হয়। কিন্তু দেশে ফেরার পর থেকে কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না নুজহাত। নব্বই দশকের সময়টাতে টিঅ্যান্ডটি ফোনই একমাত্র ভরসা ছিল। তখনো মোবাইল বা ফেসবুক মানুষের নাগালে আসেনি। আরমানের সাথে টিঅ্যান্ডটি ফোনে আর মেইলেই যোগাযোগ করত নুজহাত। দেখা হওয়াটা খুব কঠিন ছিল তাদের। আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার দুই দিন আগে নুজহাত মাকে বলল আইবিএর বন্ধুদের সাথে দেখা করতে চায় সে। মা রাজি হন, উনি ধরেই নেন নুজহাত নিশ্চয় যাওয়ার আগ মুহূর্তে আর কোনো ঝামেলা করবে না।
মায়ের ভাবনার ঊর্ধ্বে গিয়ে নুজহাত আরমানের সাথে পালিয়ে যায়। চোখভর্তি রঙিন স্বপ্ন তখন তার। ‘রংচটা জিন্সের প্যান্ট পরা, জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে ধরা’র যুগ। নুজহাতের পৃথিবীতে তখন আবেগই সব। চোখেমুখে রঙিন স্বপ্ন, দুনিয়া তার কাছে খুবই রঙিন। আরমানকে সে পাগলের মতো ভালোবাসে। আরমানের মোটরসাইকেলের পেছনে বসে একসাথে ছুটে চলাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মনে হতো তার কাছে। এই সম্পর্ক আর বিয়ের পরিণতি কী হতে পারে, তা ওর ভাবনারও ঊর্ধ্বে ছিল। আরমানের বন্ধুদের সহায়তায় কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ওরা। আরমান ওকে নিয়ে ওর এক বন্ধুর বাসায় ওঠে। সেখানে তিন-চার দিন থাকার পর নিজেরা ছোট একটা বাসা ভাড়া করে।
এদিকে নুজহাতের পরিবার ওকে খোঁজাখুঁজি করে পুরো এলাকায় হুলুস্থুল বাধিয়ে ফেলে। তারপর যখন শুনতে পান, ওরা বিয়ে করে ফেলেছে, ওনারা চুপ হয়ে যান। বিয়ের পর এই প্রথম নুজহাত স্বপ্নের জগৎ থেকে মাটিতে পদার্পণ করে। দুই পরিবারের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, তা আন্তে আন্তে বুঝতে শুরু করে। ও যে পরিবেশে বড় হয়েছে আর আরমান যে পরিবেশে বড় হয়েছে, তাতে যে বিস্তর ব্যবধান, তা তখন নুজহাতের কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়।
স্বপ্নের দুনিয়া থেকে নেমে দুজনের জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। আরমান একটা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করে আর নুজহাত করে ঘরকন্না। এই প্রথম দুজন বুঝতে শিখল ভালোবাসা আর সংসার এক ব্যাপার নয়। সবকিছু মোহ আর স্বপ্নতে চলে না। আরমানও ওকে নিয়ে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এভাবেই সংসার চলতে লাগল, দুজনেরই বোধ হতে লাগল, দুই নদীর পানি একই নদীতে প্রবাহিত হলেও তা একসাথে মেশে না। বছর যেতেই বেশ খানিকটা অপরিকল্পিতভাবেই কোলজুড়ে আসে বড় মেয়ে মানহা। নুজহাতের বাবা-মা এত দিন কোনো খোঁজখবর না নিলেও নাতনির জন্মের পর নুজহাতের মা বাসায় আসেন। নুজহাতের সাথে খুব একটা কথা না বললেও মানহাকে বুকে নিয়ে আদর করেন। তার পর থেকে মূলত মানহাকে ওনারাই লালন-পালন করেন।
মা-বাবার সহায়তায় নুজহাত আবারো পড়াশোনা শুরু করে। আরমানও যথাসাধ্য চেষ্টা করে নুজহাতকে ভালো রাখার। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে নুজহাত একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে টিচার হিসেবে জয়েন করে। দুজনের রোজগারে সংসারে একটা গতি আসে। তারপর কোলজুড়ে আসে দ্বিতীয় মেয়ে মুনতাহা। এভাবেই ভালো-মন্দ মিলিয়ে সংসার ভালোই চলছিল তাদের। কিন্তু আরমান আর সে যে দুই কূলের বাসিন্দা। এই ব্যবধানটা কোনোভাবেই ঘোচানো যাচ্ছিল না। নুজহাতের পরিবারের সাথে যতই তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল, আরমান যেন ততই সবকিছু থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। এই পরিবারের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছিলই না সে। ওরা দুজনই প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল তাদের কমিটমেন্ট কমপ্লাই করার জন্য, কিন্তু কোথায় যেন একটা দেয়াল ছিল দুজনের মাঝখানে।
নুজহাত প্রায়ই ভাবে, ও-ই মনে হয় আরমানের সাথে অন্যায় করে ফেলেছে। মানুষটা তার নিজের মতো করে একটা সাদামাটা পরিবার থেকে তার মতো একটা জীবনসঙ্গী বেছে নিত, এটাই হয়তো তার জন্য সবচেয়ে মঙ্গলময় হতো। আজকাল আরমানের ব্লাডপ্রেশার সব সময় হাই হয়ে থাকে, ওষুধেও খুব একটা কন্ট্রোল হতে চায় না। এদিকে মানহা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে তার খরচ, মুনতাহার স্কুলের খরচ। আবার অভিজাত এলাকায় থাকতে গিয়ে ভাড়াও বেশি, সব মিলিয়ে একটা চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল সময়। এর মধ্যে আরমান স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে যায়। উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে গিয়ে দুই পরিবার হিমশিম খায়। তার পরও শেষরক্ষা হয় না। আরমান পাড়ি জমায় অজানা গন্তব্যে।
আরমান চলে যাওয়ার পর থেকেই মেয়ে দুটোসহ মায়ের বাসায় চলে আসে নুজহাত। প্রতি সপ্তাহেই আজিমপুর কবরস্থানে মা-মেয়ে তিনজন গিয়ে দাঁড়ায়, আরমানকে দেখে আসে। চারটা মানুষের জীবনে কী পরিমাণ সংগ্রাম করতে হয়েছে শুধু ক্ষণিকের মোহ আর কিছু ভুলভাল সিদ্ধান্তের জন্য।
আবারও দরজায় ধুমধুম আওয়াজ...
নুজহাত অ্যালবামটা বন্ধ করে বুকের মধ্যে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর সাবধানে চোখ দুটো মুছে। তারপর দরজাটা খোলে। দেখে, ওর মা গোল্ডেন কালারের একটি শাড়ি পরা, তার মুখভর্তি হাসি। পেছনে মেয়ে দুটো দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই নানির সাথে ম্যাচিং করে গোল্ডেন রঙের লেহেঙ্গা পরেছে। মেয়ে দুটোকে পরীর মতো লাগছে। শুধু দুই জোড়া ডানা লাগিয়ে দিতে হবে।
নুজহাত ওদেরকে বলল, ‘তোমরা যাও, আমি আসছি।’
দরজাটা একটু ফাঁক ছিল। তাকিয়ে দেখে, শোভন দাঁড়িয়ে সবার সাথে হাত মেলাচ্ছে। মুক্তার মতো সাদা রঙের একটা পাঞ্জাবি পরেছে ও। লম্বা ছিমছাম একটা মানুষ। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল ব্যক্তিত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকগুণ। পঞ্চাশ বয়সেরও যে একটা সৌন্দর্য থাকে, তা শোভনকে দেখলেই বোঝা যায়।
আজ নুজহাতের নতুন আরেকটি অ্যালবামের সূচনা হবে। সে জানে না এই অ্যালবামটা কী রঙে রঙিন হবে তার।
নুজহাতকে রুম থেকে নিয়ে আসেন ছোট খালা। আকদ পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। দু’পাশে দুই মেয়ে ওর দু’হাত ধরে আছে। আর ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে আছেন নুজহাতের মা।
‘আলহামদুলিল্লাহ।’
বলার সাথে সাথে মেয়ে দুটো তাকে জড়িয়ে চুমু খায়। ছোট খালা শোভনকে নুজহাতের পাশে বসিয়ে দেন। বড় ফুপু মনের অজান্তেই বলে ওঠেন, ‘মাশাআল্লাহ।’
আসলেই সোনায় সোহাগা। ছোট মেয়ে মুনতাহা দুজনের ছবি তুলে দেয়। শোভন বাচ্চা দুটোকেও ডেকে বলে, ‘চলো একটা ফ্যামিলি ফটো হয়ে যাক।’
একপর্যায়ে খাওয়াদাওয়া শেষ করে মেহমানরা সবাই রওনা দেন। বাকিরা সবাই বিভিন্ন গাড়িতে উঠলেও নুজহাত আর শোভন আলাদা গাড়িতে ওঠে। শোভন নিজেই ড্রাইভ করে, তার নতুন ওডি গাড়িতে করে শুধুই ওরা দুজন রওনা দেয়।
বেশ রাত হয়ে গিয়েছে, সুনসান নীরবতা, জোছনা গলে গলে পড়া একটা রাত, রাস্তার লাইটপোস্টের আলো উপচে জোছনার আলো মোমের মতো গলে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, অদ্ভুত এক মায়াময় পরিবেশ। গাড়িতে সামনে অল্প একটু বেলি ফুলের মালা ঝোলানো রয়েছে। এয়ার ফ্রেশনার আর বেলি ফুল মিলে গাড়িতে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। চুপচাপ দুটো মানুষ বসে আছে সিটবেল্ট বেঁধে, কেউ কোনো কথা বলছে না।
নুজহাত অপলক দৃষ্টিতে গাড়ির বাঁ পাশের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। এই রাত, এই জোছনা, এই যাত্রা সবই তার কাছে অন্য রকম নতুন। গাড়ি যাচ্ছে আজিমপুর কবরস্থানের সামনে দিয়ে বেশ হালকা গতিতে। হঠাৎ মনে হলো কবরস্থানের ওই পাশটাতে জোছনার আলো একটু কম, কেমন যেন একটা ধোঁয়া ধোঁয়া অন্ধকার। আর সেই আবছা আলো আর অন্ধকার থেকেই আরমান যেন দূর থেকে তাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। অজান্তেই চোখ ভিজে উঠল নুজহাতের, শোভনের অগোচরে চোখ মুছল সে। শোভন কিছু বুঝল কি না কে জানে, কিন্তু ওর হাতটা ধরে বলল :
‘চলো, সব কষ্ট ভুলে গিয়ে সব অপূর্ণতাকে পূর্ণ করি দুজন মিলে।’
গাড়ি চলছে ধীর গতিতে আর সাউন্ড সিস্টেমে গান বাজছে :
‘এই রাত তোমার আমার, ঐ চাঁদ তোমার আমার, শুধু দুজনের
এই রাত শুধু যে গানের, এইক্ষণ এ দুটি প্রাণের
কুহু কূজনে, এই রাত তোমার আমার।’
নুজহাতও দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে শোভনের হাতটা ধরে রাখে পরম নির্ভরতায়।