অবশেষে বাংলাদেশের স্মরণকালের ঘৃণিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। দেশের সাহসী সন্তানেরা গণভবন দখল করে হাসিনাকে শুধু পদত্যাগ নয়, দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম না হলে হাসিনাকে হয়তো ছাত্রসমাজের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে জীবন দিতে হতো। সুহৃদ পাঠক, সাধারণ মানুষের কতটা ক্ষোভ ও ঘৃণা থাকলে এমনটি হতে পারে নিশ্চয় আপনারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আমাদের দেশে একটি কথা আছে, ‘তোড় গাঙ বেশি দিন বয় না।’ অর্থাৎ যে নদীতে বেশি স্রোত প্রবহমান থাকে, সে নদী নিরবধি হয় না। পতিত স্বৈরাচারী হাসিনার ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। জনগণের ওপর নির্যাতন চালাতে গিয়ে সকল মানুষকে খেপিয়ে তোলায় শেষ পর্যন্ত আর গদি রক্ষা করতে পারেননি হাসিনা। শেখ হাসিনা গত দেড় দশকে পুরো দেশকে এক দল ও এক নেতার দেশে পরিণত করেছিলেন। গণগ্রেফতার, গণহত্যা ও গণধর্ষণ সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। কেউ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারত না। এমনকি সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দিতেও ভয় পেত। ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতা অর্জন ছিল একটি দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের ফসল। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, জেনারেল ওসমানী, শহীদ জিয়াউর রহমান প্রমুখ জাতীয় নেতা দেশের স্বাধীনতা অর্জনে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গিয়ে এমন ইতিহাস রচনা করতে চাইলেন যে তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া দেশের স্বাধীনতা অর্জনে আর কারও কোনো অবদান ছিল না। দলীয়করণ ও পারিবারিকীকরণের এমন নজির স্থাপন করলেন যে দেশের মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে ভুলে গেলেন। পুলিশ ও কোর্ট-কাছারি দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেন। ছাত্রসমাজ যখন সরকারের নিকট সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমুক্ত একটি কোটা দাবি করেছিল, তখন সরকার শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের চেষ্টা না করে পুলিশ দিয়ে নির্বিচারে ছাত্রদের ওপর বুলেট, টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে এবং হত্যার পথ বেছে নিয়ে তাদের দাবিকে অবজ্ঞা করল। পুলিশের নির্বিচার গুলিতে অনেক ছাত্র, সাধারণ মানুষ, এমনকি শিশুরাও প্রাণ হারায়। পরে সাধারণ ছাত্রসমাজ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুললে এর মাশুল দিতে হয় অবৈধ সরকারকে। শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী নামিয়ে, কারফিউ জারি করে ও দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েও আর গদি রক্ষা করতে পারেননি।
শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন পুলিশ দিয়ে আন্দোলন বানচাল করা তার নিকট কিছুই নয়। তাই ছাত্রসমাজের ক্ষোভ ও মনোভাবকে বিবেচনায় না নিয়ে এটিকে নাশকতায় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের দুষ্কৃতকারী ও দুর্বৃত্ত এমনকি রাজাকার বলে অভিহিত করতে কুণ্ঠিত হননি। তবে এবারের ছাত্র আন্দোলন দেশের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো সরকার পতনের দাবিতে দীর্ঘ দিন যাবৎ আন্দোলন করে সফলতা অর্জন করতে না পারলেও মাত্র এক সপ্তাহের তীব্র ছাত্র আন্দোলন অবৈধ সরকারের গদিকে ধুলার মতো উড়িয়ে দিয়েছে। গত দেড় দশকে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার আন্দোলন শেখ হাসিনা পুলিশ দিয়ে দমন করতে সক্ষম হলেও কোটার দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন দেশের পুরো চিত্রকে বদলে দেয়। সরকারি চাকরিতে ৫৬ ভাগ কোটা সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে সরকার মূলত দেশে দলের অনুগত একটি প্রশাসন গড়ে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু সাধারণ ছাত্রসমাজ দীর্ঘ দিন যাবৎ বঞ্চিত হতে হতে তাদের পিঠ দেয়ালে গিয়ে ঠেকে যাওয়ায় এই বঞ্চনাই শেষ পর্যন্ত বিস্ফোরণে রূপ নেয়। ফলে আন্দোলন বানচাল করার কোনো কৌশল কাজে আসেনি। ছাত্রসমাজের দাবি যৌক্তিক হওয়ায় সাধারণ মানুষ তাতে সমর্থন করে। অভিভাবক থেকে শুরু করে রিকশাচালক, কুলি, মজুরসহ সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের সমর্থন তাদের মনোবল ও সাহসকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। ফলে জনগণের সম্মিলিত শক্তির নিকট পতিত স্বৈরাচার সরকারের কোনো প্রেসক্রিপশন কাজে আসেনি। তাই গুলি, লাঠি ও হুমকি ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি গদিরক্ষার কৌশল। ছাত্রদের ওপর পুলিশি নির্যাতন ও গুলিবর্ষণের সিদ্ধান্ত তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে জনমনে।
ফলে গত কয়েক দিনে দেখেছি বহু বিবেকবান আওয়ামী লীগ সমর্থকও ছাত্রসমাজের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে নেমে আসে রাজপথে। আন্দোলন শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের বাইরেও। গত সপ্তাহে লন্ডন, ইতালি ও সুইজারল্যান্ড ঘুরে সর্বত্র চোখে পড়েছে প্রবাসী সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ। নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ার, ইংল্যান্ডের আলতাফ আলী পার্ক এবং অস্ট্রেলিয়া, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিশাল প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের বাইরে লন্ডন ও নিউইয়র্কে সাধারণ মানুষের হাতে আওয়ামী লীগের নেতারা নাজেহাল হয়েছেন। এই আন্দোলনে অনেক জায়গায় ভেঙে পড়ে আইনের শাসন। বহু জায়গায় জনগণ সরকারি স্থাপনা ও শেখ মুজিবুর রহমানের নামে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের অফিস ও বাসাবাড়িতে আগুন দিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের কিছু ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য গণমানুষের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ছাত্রসমাজের ন্যায়সংগত দাবিকে আমলে না নিয়ে সরকার ছাত্রলীগ দিয়ে দমনের অপচেষ্টা চালিয়ে হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে নিহত হয় কয়েক শতাধিক ছাত্র। এমন নির্মম গণহত্যা আইয়ুব, ইয়াহিয়া, মার্কোস, গাদ্দাফি, ফেরাউনের নির্মমতাকেও হার মানিয়েছে। সব মিলিয়ে এভাবে আওয়ামী লীগ নিজেই নিজের কবর রচনা করে।
কথায় আছেÑঅহংকার পতনের মূল। ক্ষমতা পতিত আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের এতটা অহংকারী করে তুলেছিল যে তারা মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবতে ভুলে গিয়েছিল। পুরো দেশকে একটি টর্চার সেলে পরিণত করেছিল। তাদের আশকারা পেয়ে পুলিশ যে রাষ্ট্রের কর্মচারী, এটা তারা ভুলে গিয়েছিল। পুলিশের আইজি ও র্যাবপ্রধানের কথা শুনলে মনে হতো তারা দেশের মালিক। বিনা বিচারে যখন তখন যে কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়া, খুন, গুম ও নির্যাতনের এমন এক পরিবেশ দেশে গড়ে তুলেছিল যে জনগণের শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন সারা দেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিদেশে টাকা পাচার স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়। দখলদার সরকারের প্রধান নিজে স্বীকার করেন, তার পিয়ন এখন চারশত কোটি টাকার মালিক। প্রশ্নপত্র ফাঁসের রমরমা ব্যবসা করে সামান্য গাড়িচালক হাজার কোটি টাকার মালিক। দুর্নীতির এমন নজির সমকালীন বিশ্বে দেখা যায়নি। অন্যদিকে পতিত স্বৈরাচারী সরকারের প্রতিপক্ষ হওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীরা নির্যাতিত হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও দেশের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ বেগম খালেদা জিয়াকে প্রায় এক যুগ যাবৎ হাউস এরেস্ট করে রাখা হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে মিথ্যা মামলায় সাজানো রায় দিয়ে দেশে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বিএনপির মহাসচিবসহ অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে শত শত মিথ্যা মামলা দায়ের করে পুরো দেশে নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথকে বন্ধ করে রাখা হয়।
জনগণের ওপর স্টিম রোলার চালিয়ে পৃথিবীতে কোনো স্বৈরাচারী সরকার টিকে থাকতে পারেনি। তাই শেখ হাসিনা সরকারেরও পতন হয়েছে। এই পতন থেকে দেশের সকল রাজনীতিবিদের অনেক শিক্ষা নেওয়ার আছে। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ করলে কারও পরিণাম শুভ হয় না, শেখ হাসিনার পতন সে কথাই মনে করিয়ে দিল। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও আইনের শাসন বিরাজমান থাকলে হাসিনাকে ক্ষমতা হারালেও দেশ থেকে এভাবে পালিয়ে যেতে হতো না।
এখন দেশের দায়িত্বভার যে সরকারের হাতে অর্পিত হয়েছে, তাদের প্রথম কাজ হবে দেশে আইনের শাসন কায়েম করা। কোটা সংস্কারের ন্যায্য দাবি আদায় করতে গিয়ে যেসব নিরীহ ও নিরপরাধ ছাত্রকে নির্দয়ভাবে সরকারি মদদে জীবন দিতে হয়েছে তাদেরকে জাতীয় বীরের মর্যাদা প্রদান করে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। গণহত্যায় জড়িত সকল পুলিশ কর্মকর্তা ও আওয়ামী দলীয় ক্যাডারদের আইনের হাতে সোপর্দ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে না হয়। তা ছাড়া বিনা ভোটে নির্বাচিত সকল সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও জেলা পরিষদ ভেঙে দিয়ে দেশে জনগণের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই সঙ্গে এই মুহূর্তে প্রত্যেক নাগরিককে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা বাঞ্ছনীয়। পতিত স্বৈরশাসকের জায়গায় দেশে মানুষ নতুন করে আর কোনো স্বৈরশাসককে দেখতে চায় না। মানুষ নির্বিচারে গণহত্যার জন্য শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। গণতন্ত্র চায়, আইনের শাসন চায়, ভোট দেওয়ার অধিকার চায়, বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র চায়, যেখানে ন্যায়সংগত দাবির কথা বললে মানুষকে এভাবে নিগৃহীত হতে হবে না। এইজন্য দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে দেশের জন্য এক ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। হাসিনার পতন ঘটাতে আমরা যেভাবে এক যুগে রাজপথে নেমে এসেছিলাম, আসুন, সমান শক্তি নিয়ে দেশ বাঁচাতে কাজ শুরু করি। আর কোনো স্বৈরাচারী সরকার নয়, দেশের মানুষ আগামী দিনে দেশে একটি দেশপ্রেমিক সরকার ও ন্যায়বিচারভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা দেখতে চায়।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ, নিউইয়র্ক
শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন পুলিশ দিয়ে আন্দোলন বানচাল করা তার নিকট কিছুই নয়। তাই ছাত্রসমাজের ক্ষোভ ও মনোভাবকে বিবেচনায় না নিয়ে এটিকে নাশকতায় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের দুষ্কৃতকারী ও দুর্বৃত্ত এমনকি রাজাকার বলে অভিহিত করতে কুণ্ঠিত হননি। তবে এবারের ছাত্র আন্দোলন দেশের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো সরকার পতনের দাবিতে দীর্ঘ দিন যাবৎ আন্দোলন করে সফলতা অর্জন করতে না পারলেও মাত্র এক সপ্তাহের তীব্র ছাত্র আন্দোলন অবৈধ সরকারের গদিকে ধুলার মতো উড়িয়ে দিয়েছে। গত দেড় দশকে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার আন্দোলন শেখ হাসিনা পুলিশ দিয়ে দমন করতে সক্ষম হলেও কোটার দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন দেশের পুরো চিত্রকে বদলে দেয়। সরকারি চাকরিতে ৫৬ ভাগ কোটা সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে সরকার মূলত দেশে দলের অনুগত একটি প্রশাসন গড়ে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু সাধারণ ছাত্রসমাজ দীর্ঘ দিন যাবৎ বঞ্চিত হতে হতে তাদের পিঠ দেয়ালে গিয়ে ঠেকে যাওয়ায় এই বঞ্চনাই শেষ পর্যন্ত বিস্ফোরণে রূপ নেয়। ফলে আন্দোলন বানচাল করার কোনো কৌশল কাজে আসেনি। ছাত্রসমাজের দাবি যৌক্তিক হওয়ায় সাধারণ মানুষ তাতে সমর্থন করে। অভিভাবক থেকে শুরু করে রিকশাচালক, কুলি, মজুরসহ সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের সমর্থন তাদের মনোবল ও সাহসকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। ফলে জনগণের সম্মিলিত শক্তির নিকট পতিত স্বৈরাচার সরকারের কোনো প্রেসক্রিপশন কাজে আসেনি। তাই গুলি, লাঠি ও হুমকি ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি গদিরক্ষার কৌশল। ছাত্রদের ওপর পুলিশি নির্যাতন ও গুলিবর্ষণের সিদ্ধান্ত তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে জনমনে।
ফলে গত কয়েক দিনে দেখেছি বহু বিবেকবান আওয়ামী লীগ সমর্থকও ছাত্রসমাজের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে নেমে আসে রাজপথে। আন্দোলন শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের বাইরেও। গত সপ্তাহে লন্ডন, ইতালি ও সুইজারল্যান্ড ঘুরে সর্বত্র চোখে পড়েছে প্রবাসী সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ। নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ার, ইংল্যান্ডের আলতাফ আলী পার্ক এবং অস্ট্রেলিয়া, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিশাল প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের বাইরে লন্ডন ও নিউইয়র্কে সাধারণ মানুষের হাতে আওয়ামী লীগের নেতারা নাজেহাল হয়েছেন। এই আন্দোলনে অনেক জায়গায় ভেঙে পড়ে আইনের শাসন। বহু জায়গায় জনগণ সরকারি স্থাপনা ও শেখ মুজিবুর রহমানের নামে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের অফিস ও বাসাবাড়িতে আগুন দিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের কিছু ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য গণমানুষের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ছাত্রসমাজের ন্যায়সংগত দাবিকে আমলে না নিয়ে সরকার ছাত্রলীগ দিয়ে দমনের অপচেষ্টা চালিয়ে হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে নিহত হয় কয়েক শতাধিক ছাত্র। এমন নির্মম গণহত্যা আইয়ুব, ইয়াহিয়া, মার্কোস, গাদ্দাফি, ফেরাউনের নির্মমতাকেও হার মানিয়েছে। সব মিলিয়ে এভাবে আওয়ামী লীগ নিজেই নিজের কবর রচনা করে।
কথায় আছেÑঅহংকার পতনের মূল। ক্ষমতা পতিত আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের এতটা অহংকারী করে তুলেছিল যে তারা মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবতে ভুলে গিয়েছিল। পুরো দেশকে একটি টর্চার সেলে পরিণত করেছিল। তাদের আশকারা পেয়ে পুলিশ যে রাষ্ট্রের কর্মচারী, এটা তারা ভুলে গিয়েছিল। পুলিশের আইজি ও র্যাবপ্রধানের কথা শুনলে মনে হতো তারা দেশের মালিক। বিনা বিচারে যখন তখন যে কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়া, খুন, গুম ও নির্যাতনের এমন এক পরিবেশ দেশে গড়ে তুলেছিল যে জনগণের শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন সারা দেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিদেশে টাকা পাচার স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়। দখলদার সরকারের প্রধান নিজে স্বীকার করেন, তার পিয়ন এখন চারশত কোটি টাকার মালিক। প্রশ্নপত্র ফাঁসের রমরমা ব্যবসা করে সামান্য গাড়িচালক হাজার কোটি টাকার মালিক। দুর্নীতির এমন নজির সমকালীন বিশ্বে দেখা যায়নি। অন্যদিকে পতিত স্বৈরাচারী সরকারের প্রতিপক্ষ হওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীরা নির্যাতিত হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও দেশের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ বেগম খালেদা জিয়াকে প্রায় এক যুগ যাবৎ হাউস এরেস্ট করে রাখা হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে মিথ্যা মামলায় সাজানো রায় দিয়ে দেশে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বিএনপির মহাসচিবসহ অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে শত শত মিথ্যা মামলা দায়ের করে পুরো দেশে নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথকে বন্ধ করে রাখা হয়।
জনগণের ওপর স্টিম রোলার চালিয়ে পৃথিবীতে কোনো স্বৈরাচারী সরকার টিকে থাকতে পারেনি। তাই শেখ হাসিনা সরকারেরও পতন হয়েছে। এই পতন থেকে দেশের সকল রাজনীতিবিদের অনেক শিক্ষা নেওয়ার আছে। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ করলে কারও পরিণাম শুভ হয় না, শেখ হাসিনার পতন সে কথাই মনে করিয়ে দিল। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও আইনের শাসন বিরাজমান থাকলে হাসিনাকে ক্ষমতা হারালেও দেশ থেকে এভাবে পালিয়ে যেতে হতো না।
এখন দেশের দায়িত্বভার যে সরকারের হাতে অর্পিত হয়েছে, তাদের প্রথম কাজ হবে দেশে আইনের শাসন কায়েম করা। কোটা সংস্কারের ন্যায্য দাবি আদায় করতে গিয়ে যেসব নিরীহ ও নিরপরাধ ছাত্রকে নির্দয়ভাবে সরকারি মদদে জীবন দিতে হয়েছে তাদেরকে জাতীয় বীরের মর্যাদা প্রদান করে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। গণহত্যায় জড়িত সকল পুলিশ কর্মকর্তা ও আওয়ামী দলীয় ক্যাডারদের আইনের হাতে সোপর্দ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে না হয়। তা ছাড়া বিনা ভোটে নির্বাচিত সকল সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও জেলা পরিষদ ভেঙে দিয়ে দেশে জনগণের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই সঙ্গে এই মুহূর্তে প্রত্যেক নাগরিককে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা বাঞ্ছনীয়। পতিত স্বৈরশাসকের জায়গায় দেশে মানুষ নতুন করে আর কোনো স্বৈরশাসককে দেখতে চায় না। মানুষ নির্বিচারে গণহত্যার জন্য শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। গণতন্ত্র চায়, আইনের শাসন চায়, ভোট দেওয়ার অধিকার চায়, বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র চায়, যেখানে ন্যায়সংগত দাবির কথা বললে মানুষকে এভাবে নিগৃহীত হতে হবে না। এইজন্য দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে দেশের জন্য এক ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। হাসিনার পতন ঘটাতে আমরা যেভাবে এক যুগে রাজপথে নেমে এসেছিলাম, আসুন, সমান শক্তি নিয়ে দেশ বাঁচাতে কাজ শুরু করি। আর কোনো স্বৈরাচারী সরকার নয়, দেশের মানুষ আগামী দিনে দেশে একটি দেশপ্রেমিক সরকার ও ন্যায়বিচারভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা দেখতে চায়।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ, নিউইয়র্ক