একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক, ভাষাবিদ ও শিক্ষাবিদ আমাদের সবার প্রিয় ড. মাহবুবুল হক গত ২৪ জুলাই বুধবার পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। ‘জন্মিলে মরিতে হইবে’-এটাই পৃথিবীর চিরন্তন সত্য। তার পরও কিছু মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। ভীষণ কষ্ট হয়। মনের আঙিনায় স্মৃতিরা এসে ভিড় করে। চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে।
স্যার ছিলেন আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলার শিক্ষক। কলেজ পাস করেছি বহু বছর হয়েছে কিন্তু পিতৃতুল্য স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল অটুট। স্যার ছিলেন আমার বাবা মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য গবেষক অধ্যাপক সুলতান আহমেদ ভূঁইয়ার ছাত্র। আমি ছিলাম তার ছাত্রী। সম্পর্কটা বলতে গেলে পরম্পরা। স্যারকে যতটুকু কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল, সুধী পাঠক, আপনাদের কাছে তার কিছুটা তুলে ধরতে চেষ্টা করব।
ফিরে যাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সেই স্মৃতিময় দিনগুলোতে। কলেজের প্রথম দিন আমরা মুগ্ধ হয়ে পিনপতন নিস্তব্ধতায় স্যারের বক্তব্য শুনছিলাম। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি জানালেন কী করে তিনি দু’পা থেকে চার পা, ছয় পা এবং তারপর আট পা সঙ্গে নিয়ে চলেছেন। অনেক বছর পর ফেসবুকে স্যারকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, স্যার, আপনি এখন ক’পা নিয়ে চলছেন?
‘সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ’Ñহৈমন্তী গল্প পড়াচ্ছিলেন স্যার। প্রশ্ন ছুড়লেনÑকে ব্যাখ্যা দিতে পারবে এই উক্তির। আমি হাত তুলে বললাম, স্যার, সম্পত্তির সীমাবদ্ধতা থাকে কিন্তু সম্পদ অফুরান। স্যার আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন, ঠিক। বরাবরই বাংলা ছিল আমার প্রিয় বিষয় আর শিক্ষক যদি হন মাহবুব স্যার, তবে তো কথাই নেই। বান্ধবীরা মিলে অন্য ক্লাস মিস দিলেও স্যারের ক্লাস কখনো ফাঁকি দিইনি।
কলেজ থেকে চট্টগ্রাম বেতারে একটি অনুষ্ঠান করব। অনুষ্ঠান শেষে আমরা সবাই স্যারের লালখান বাজারের বাসায় গেলাম। কলেজের শেষ দিন স্যারের কাছে অটোগ্রাফ চাইলাম। স্যার আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হেসে লিখে দিলেন, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।’
কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। শুদ্ধ বানানের ওপর প্রতি শুক্রবার স্যার বিটিভিতে একটি অনুষ্ঠান করতেন। শুক্রবার সকাল হলে সবাই টিভির সামনে বসে পড়তাম স্যারের অনুষ্ঠানটি দেখতে আর কিছু শিখতে। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছেড়ে স্যার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগ দিয়েছেন। স্যারের সুখ্যাতি চারদিকে। পড়ালেখা শেষে আমি ঢাকার ড্যাফোডিলে অধ্যাপনা শুরু করি। মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসে গেলে স্যারের সঙ্গে দেখা করতাম। তুমুল ব্যস্ততার মাঝেও তিনি সময় দিতেন।
স্যার খুব নির্মোহ ও সাধারণ জীবনযাপন করতেন। সংসারের বড় সন্তান হিসেবে ভাইবোনদের আগলে রেখেছেন। ছিলেন মহান মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। বাংলাদেশ, ভারত এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তার ৪০টিরও বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রবন্ধ রচনা, ফকলোর চর্চা, গবেষণা, অনুবাদ, অভিধান সম্পাদনা ও পাঠ্যবই রচনার জন্য দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছেন। এত জ্ঞানী কিন্তু ছিলেন নিরহংকার। তিনি কিছুদিন কুমিল্লায় সিসিএন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং স্বেচ্ছায় তার পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তার ব্যক্তিগত কিছু অভিমত আমাকে জানিয়েছিলেন। এমন অসাধারণ কিন্তু খুব সাধারণ মানুষ জীবনে কমই দেখেছি। তাই তো পদ কিংবা পদবিকে ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের প্রিয়।
ফরিদপুরে জন্ম হলেও তিনি বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামে। মাহবুব স্যারের ৭০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে চট্টগ্রামবাসী তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেবেন। এ উপলক্ষে একটি স্মারকগ্রন্থ বের হবে। স্যার আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘আমাকে নিয়ে একটা স্মৃতিচারণামূলক লেখা পাঠাও।’ আমি খুব খুশি হলাম স্যারের এমন শুভক্ষণে স্যার নিজে আমাকে লেখা পাঠাতে বলেছেন বলে।
২০১৮ সালে দেশে যাই মাত্র নয় দিনের জন্য। আমি দুবাই এয়ারপোর্টে ফেসবুক চালু করতেই স্যারের অসুস্থতার খবর দেখলাম। মুহূর্তেই বাল্যবন্ধু মিমি আর ইতিকে বললাম, যত ব্যস্তই থাকিস আমি তোদের নিয়ে মাহবুব স্যারের সঙ্গে দেখা করব। দেশে গিয়ে একদিন মধ্যদুপুরে স্যারের মেয়ের বসুন্ধরার বাসায় কড়া নাড়লাম। বললাম, আমরা স্যারের প্রাক্তন ছাত্রী। দেখতে এসেছি। আমাদেরকে এত বছর পর এভাবে হঠাৎ দেখে স্যার তো বিস্মিত। অনেক গল্পগুজব, স্মৃতিচারণা-চমৎকার এক দুপুর। স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমাকে এভাবে চমকে দেওয়ার আইডিয়া কার?’ বন্ধুরা বলে ওঠে, ছন্দার। স্যার আমাকে বললেন, ‘এত অল্প দিনের জন্য দেশে এসেছ, কিন্তু প্রতিদিনই তোমার কার্যদিবস ফেসবুকে দেখি, তুমি তো পিএম স্ক্যাজুয়েলে চলো।’ দীর্ঘ আড্ডা শেষে যখন বিদায়ের পালা, তখন স্যার বললেন, ‘ছন্দা, তোমার গল্পবলার ক্ষমতা অসাধরণ। সাধারণত খুব বড় মাপের গল্পকারদের মাঝে এই গুণটি দেখা যায়।’ স্যারের কথাটি আমার কাছে অনুপ্রেরণার কাজ করল। যদিও পত্রিকায় গল্প ছাপা হয়েছে কিন্তু বই বের করিনি। বিদ্যা প্রকাশ থেকে আমার কাব্যগ্রন্থ বের হলেও গল্পগ্রন্থ বের করিনি। মনে মনে বললাম, শিগগিরই গল্পগ্রন্থ বের করব, তারপর স্যারকে নিজ হাতে উপহার দেব। কিন্তু প্রবাসের জীবন, অনেক কিছু ইচ্ছে হলেও সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। ২০২৪-এ বিদ্যা প্রকাশ থেকে বের হলো আমার গল্পগ্রন্থ ‘সাগর পাড়ে নন্দিনী’। ইচ্ছে ছিল নিজের হাতে স্যারকে বইটি দিয়ে বলব, স্যার, পড়ে আপনার অভিমত জানাবেন। কিন্তু ২০২৪-এ স্বল্প সময়ের জন্য দেশে গেলেও মাতৃবিয়োগকাতর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন এবং ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, বরিশাল করে আর স্যারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হলো না। ভেবেছি শিগগিরই তো আবার দেশে যাব, তখন দেখা করব। সেই ইচ্ছা আর পূরণ হলো না। মে মাসেও স্যার সানদিয়াগো এসেছিলেন ছেলের কাছে, আমার সঙ্গে কথা হলো। সেটাই যে স্যারের সঙ্গে আমার শেষ কথা ছিল, এটা কখনো ভাবিনি।
ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনের সুবাদে স্যারের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই তো তিনি চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে। স্যার, দু’পা থেকে আট পা, আট পা থেকে অগণিত পা আপনার সঙ্গে চলছিল কিন্তু আপনি সব পা’কে রেখে দু’পা নিয়েই চলে গেলেন। স্যার, আপনি বেঁচে থাকবেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আকাশে এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে। বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে বাতিঘর হয়ে। আমাদের এই চরম দুঃসময়ে আপনাদের মতো শিক্ষকদের বড় প্রয়োজন ছিল, স্যার।
লেখক : সাংবাদিক, নিউইয়র্ক
স্যার ছিলেন আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলার শিক্ষক। কলেজ পাস করেছি বহু বছর হয়েছে কিন্তু পিতৃতুল্য স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল অটুট। স্যার ছিলেন আমার বাবা মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য গবেষক অধ্যাপক সুলতান আহমেদ ভূঁইয়ার ছাত্র। আমি ছিলাম তার ছাত্রী। সম্পর্কটা বলতে গেলে পরম্পরা। স্যারকে যতটুকু কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল, সুধী পাঠক, আপনাদের কাছে তার কিছুটা তুলে ধরতে চেষ্টা করব।
ফিরে যাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সেই স্মৃতিময় দিনগুলোতে। কলেজের প্রথম দিন আমরা মুগ্ধ হয়ে পিনপতন নিস্তব্ধতায় স্যারের বক্তব্য শুনছিলাম। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি জানালেন কী করে তিনি দু’পা থেকে চার পা, ছয় পা এবং তারপর আট পা সঙ্গে নিয়ে চলেছেন। অনেক বছর পর ফেসবুকে স্যারকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, স্যার, আপনি এখন ক’পা নিয়ে চলছেন?
‘সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ’Ñহৈমন্তী গল্প পড়াচ্ছিলেন স্যার। প্রশ্ন ছুড়লেনÑকে ব্যাখ্যা দিতে পারবে এই উক্তির। আমি হাত তুলে বললাম, স্যার, সম্পত্তির সীমাবদ্ধতা থাকে কিন্তু সম্পদ অফুরান। স্যার আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন, ঠিক। বরাবরই বাংলা ছিল আমার প্রিয় বিষয় আর শিক্ষক যদি হন মাহবুব স্যার, তবে তো কথাই নেই। বান্ধবীরা মিলে অন্য ক্লাস মিস দিলেও স্যারের ক্লাস কখনো ফাঁকি দিইনি।
কলেজ থেকে চট্টগ্রাম বেতারে একটি অনুষ্ঠান করব। অনুষ্ঠান শেষে আমরা সবাই স্যারের লালখান বাজারের বাসায় গেলাম। কলেজের শেষ দিন স্যারের কাছে অটোগ্রাফ চাইলাম। স্যার আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হেসে লিখে দিলেন, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।’
কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। শুদ্ধ বানানের ওপর প্রতি শুক্রবার স্যার বিটিভিতে একটি অনুষ্ঠান করতেন। শুক্রবার সকাল হলে সবাই টিভির সামনে বসে পড়তাম স্যারের অনুষ্ঠানটি দেখতে আর কিছু শিখতে। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছেড়ে স্যার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগ দিয়েছেন। স্যারের সুখ্যাতি চারদিকে। পড়ালেখা শেষে আমি ঢাকার ড্যাফোডিলে অধ্যাপনা শুরু করি। মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসে গেলে স্যারের সঙ্গে দেখা করতাম। তুমুল ব্যস্ততার মাঝেও তিনি সময় দিতেন।
স্যার খুব নির্মোহ ও সাধারণ জীবনযাপন করতেন। সংসারের বড় সন্তান হিসেবে ভাইবোনদের আগলে রেখেছেন। ছিলেন মহান মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। বাংলাদেশ, ভারত এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তার ৪০টিরও বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রবন্ধ রচনা, ফকলোর চর্চা, গবেষণা, অনুবাদ, অভিধান সম্পাদনা ও পাঠ্যবই রচনার জন্য দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছেন। এত জ্ঞানী কিন্তু ছিলেন নিরহংকার। তিনি কিছুদিন কুমিল্লায় সিসিএন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং স্বেচ্ছায় তার পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তার ব্যক্তিগত কিছু অভিমত আমাকে জানিয়েছিলেন। এমন অসাধারণ কিন্তু খুব সাধারণ মানুষ জীবনে কমই দেখেছি। তাই তো পদ কিংবা পদবিকে ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের প্রিয়।
ফরিদপুরে জন্ম হলেও তিনি বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামে। মাহবুব স্যারের ৭০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে চট্টগ্রামবাসী তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেবেন। এ উপলক্ষে একটি স্মারকগ্রন্থ বের হবে। স্যার আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘আমাকে নিয়ে একটা স্মৃতিচারণামূলক লেখা পাঠাও।’ আমি খুব খুশি হলাম স্যারের এমন শুভক্ষণে স্যার নিজে আমাকে লেখা পাঠাতে বলেছেন বলে।
২০১৮ সালে দেশে যাই মাত্র নয় দিনের জন্য। আমি দুবাই এয়ারপোর্টে ফেসবুক চালু করতেই স্যারের অসুস্থতার খবর দেখলাম। মুহূর্তেই বাল্যবন্ধু মিমি আর ইতিকে বললাম, যত ব্যস্তই থাকিস আমি তোদের নিয়ে মাহবুব স্যারের সঙ্গে দেখা করব। দেশে গিয়ে একদিন মধ্যদুপুরে স্যারের মেয়ের বসুন্ধরার বাসায় কড়া নাড়লাম। বললাম, আমরা স্যারের প্রাক্তন ছাত্রী। দেখতে এসেছি। আমাদেরকে এত বছর পর এভাবে হঠাৎ দেখে স্যার তো বিস্মিত। অনেক গল্পগুজব, স্মৃতিচারণা-চমৎকার এক দুপুর। স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমাকে এভাবে চমকে দেওয়ার আইডিয়া কার?’ বন্ধুরা বলে ওঠে, ছন্দার। স্যার আমাকে বললেন, ‘এত অল্প দিনের জন্য দেশে এসেছ, কিন্তু প্রতিদিনই তোমার কার্যদিবস ফেসবুকে দেখি, তুমি তো পিএম স্ক্যাজুয়েলে চলো।’ দীর্ঘ আড্ডা শেষে যখন বিদায়ের পালা, তখন স্যার বললেন, ‘ছন্দা, তোমার গল্পবলার ক্ষমতা অসাধরণ। সাধারণত খুব বড় মাপের গল্পকারদের মাঝে এই গুণটি দেখা যায়।’ স্যারের কথাটি আমার কাছে অনুপ্রেরণার কাজ করল। যদিও পত্রিকায় গল্প ছাপা হয়েছে কিন্তু বই বের করিনি। বিদ্যা প্রকাশ থেকে আমার কাব্যগ্রন্থ বের হলেও গল্পগ্রন্থ বের করিনি। মনে মনে বললাম, শিগগিরই গল্পগ্রন্থ বের করব, তারপর স্যারকে নিজ হাতে উপহার দেব। কিন্তু প্রবাসের জীবন, অনেক কিছু ইচ্ছে হলেও সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। ২০২৪-এ বিদ্যা প্রকাশ থেকে বের হলো আমার গল্পগ্রন্থ ‘সাগর পাড়ে নন্দিনী’। ইচ্ছে ছিল নিজের হাতে স্যারকে বইটি দিয়ে বলব, স্যার, পড়ে আপনার অভিমত জানাবেন। কিন্তু ২০২৪-এ স্বল্প সময়ের জন্য দেশে গেলেও মাতৃবিয়োগকাতর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন এবং ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, বরিশাল করে আর স্যারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হলো না। ভেবেছি শিগগিরই তো আবার দেশে যাব, তখন দেখা করব। সেই ইচ্ছা আর পূরণ হলো না। মে মাসেও স্যার সানদিয়াগো এসেছিলেন ছেলের কাছে, আমার সঙ্গে কথা হলো। সেটাই যে স্যারের সঙ্গে আমার শেষ কথা ছিল, এটা কখনো ভাবিনি।
ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনের সুবাদে স্যারের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই তো তিনি চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে। স্যার, দু’পা থেকে আট পা, আট পা থেকে অগণিত পা আপনার সঙ্গে চলছিল কিন্তু আপনি সব পা’কে রেখে দু’পা নিয়েই চলে গেলেন। স্যার, আপনি বেঁচে থাকবেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আকাশে এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে। বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে বাতিঘর হয়ে। আমাদের এই চরম দুঃসময়ে আপনাদের মতো শিক্ষকদের বড় প্রয়োজন ছিল, স্যার।
লেখক : সাংবাদিক, নিউইয়র্ক