গত ১০ জুলাই শুরু হওয়া ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে’র সমাপণী ঘটেনি। বরং প্রতিদিন নাটকীয়ভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে ঘটনাবলী। কারফিউ পরিস্থিতির মধ্যেও চলছে প্রতিবাদ’ গ্রেপ্তার, মৃত্যু। একদিকে সরকারি দল আ.লীগের ‘পলাতক’ নেতা-কর্মীরা সংঘটিত হচ্ছেন। আন্যদিকে ছাত্র-অভিভাবকদের পাশাপাশি সারা দেশের শিক্ষক, সংস্কৃতিসেবী, সুশীলসমাজও এখন আন্দোলনে। এরইমধ্যে ‘ধর্মপ্রধান দল’ জামায়াত ও শিবিরকে নিষিদ্ধ করার ঘোষণা এসেছে। বাংলাদেশ-ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের চাপে এমনটি ঘটছে বলে অভিযোগ। প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে স্থবিরতায় বাংলাদেশ সরকার উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘ শান্তিমিশনে দেশের শান্তিরক্ষী পাঠানো নিয়ে চলছে অনিশ্চয়তা। যদিও দেশের ক্ষমতার কন্ট্রোল এখনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতেই।
কোটা সংস্কার আন্দোলন- ২০১৮ থেকে ২০২৪ : সংস্কারের বদল বাতিল- রহস্য : বাংলাদেশে ‘কোটা’ সংস্কার আন্দোলন’ চূড়ান্তরূপ নিয়েছিল ২০১৮ তে। ঢাবি ভিপি নূরসহ একাধিক ছাত্রনেতা ছিল নেতৃত্বে। তখন চাকরিবিধিতে ছিল ৫৬ শতাংশ কোটা, বাকিটা মেধাভিত্তিক। মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটা সন্তান ছাড়াও নাতি-নাতনিদের জন্য নির্ধারিত হয়। এতে বিরোধ ও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। দেশে ‘মুক্তিযোদ্ধার তালিকা’য় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামও সংযোজিত হয়। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানার উত্তরসূরিরাও বেনিফিশিয়ারি হন। নাতি-নাতনিদের কোটা-আধিকার বিষয়ে বৈষম্যের অভিযোগ ওঠে। আন্দোলনের ইস্যু হয় কোটা সংস্কারের। উল্লেখ্য, সংবিধানের ২৯-(৩) ধারায় কোটা সংরক্ষণের বিধান রয়েছে। পশ্চাৎপদ/অনগ্রসর/নৃ-গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী। ২০১৮-এর পরিপত্র অনুসারে ৫৬ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত থাকে। ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাসহ জেলা, নারী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী। ফলে মেধার ভিত্তিতে চাকরি প্রাপ্তির পরিমাণ মাত্র ৪৪ শতাংশ। এই অঙ্কটি ৯০ শতাংশের ওপরে নেওয়ার জন্যই জোরালো হয় আন্দোলন।
২০১৮-তে আকস্মিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চমক দেখান। সংসদে ঘোষণা দেন যে ‘সকল কোটা’ই বাতিল। এই মর্মে সরকার প্রজ্ঞাপনও জারি করে। ফলে আন্দোলন প্রশমিত হয়। এরপর করোনা পরিস্থতি চলে গেলে বিষয়টি আদালতে গড়ায়। সরকারি সিদ্ধান্তকে চ্যালেজ করেন দুই মুক্তিযোদ্ধাপুত্র। কোটা পদ্ধতি ‘সাংবিধানিক বিষয়’ বিধায় প্রজ্ঞাপনটি বাতিল হয়। পয়লা জুলাই হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দিলে সুপ্রিমকোর্টে আপীল করা হয়। ৭ আগস্ট শুনানির দিন ধার্য করে আপীল আদালত। এরই মধ্যে কোটা সংস্কার বিষয়ে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সংঘটিত হয়। ১০ জুলাই ঢাকায় ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে সৃষ্টি হয় নাকাল পরিস্থিতি। পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র-আন্দোলন।
চীন সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত দেশে ফেরেন। সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি ছাত্র-আন্দোলনকে কটাক্ষ করেন। বলেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা কোটা পেতেই পারে। তা না হলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা কোটা সুবিধা পাবে? এমন বক্তব্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। আন্দোলনকারীরা নিজেদের অপমানিত বোধ করেন। তাদের ধারণা ছিল কোটা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নিরপেক্ষ থাকবেন। অনেকের মতে, প্রধানমন্ত্রী জানতেন, ওনার প্রজ্ঞাপন আদালতে টিকবে না। ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা’ জেনেও উনি শতভাগ কোটা বাতিল করেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা বাতিল নয়, সংস্কার চেয়েছিল।
নিরস্ত্রদের হত্যা বনাম নামকতার উন্মত্ততা : ১২ জুলাই থেকে সারা দেশে নতুন স্লোগানে মুখরিত হয়। চেয়েছিলাম আধিকার/হয়ে গেলাম রাজাকার।
তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে কে বলেছে- স্বৈরাচার স্বৈরাচার।
ছাত্রদের ডাকে দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বজনীন আন্দোলন। এসময় আ.লীগ সম্পাদক মন্ত্রী ওবায়দুল কদের আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেন। বলেন, আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্রলীগ বসে থাকতে পারে না। ১৪ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাহিংস হামলা। হলে হলে ছাত্রছাত্রীদের ওপর পাশবিক অত্যাচার। এতে ফুঁসে ওঠে শহর-মফস্বল-প্রবাস-বিদেশ। ছাত্রদের পাশে অভিভাবক, শিক্ষক, সচেতন মহল দাঁড়িয়ে যায়। পরদিন রাতে ঢাকার সব হল, ক্যাম্পাসে উল্টোচিত্র। সদলবলে বিতাড়িত হয় ছাত্রলীগ নেতৃবর্গ। অনেক নেতানেত্রীকে কান ধরে উঠ-বসও করানো হয়।
নিরস্ত্রদের হত্যা বনাম স্থাপনায় নাশকতার ভয়াল পরিস্থিতি। আয়ত্তের বাইরে যাওয়ার অবস্থা দাঁড়ায়। সরকার জরুরি ভিত্তিতে কারফিউ জারি করে। সব ধরনের অনলাইন কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। ইন্টারনেট বন্ধ করায় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউবÑ সব অচল। সরকার পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি বাহিনী পাঠায় শিক্ষাঙ্গনে। ভুতুড়ে অবস্থায় হলগুলো থেকে বিতাড়ন করে সকল ছাত্র-ছাত্রীকে।
অভিভাবক ও সচেতন মহল আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। ফলে ছাত্র-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এর মধ্যে রাজনৈতিক সুবিধাভোগী অংশও ঢুকে পড়ে। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদসহ ৮ ছাত্র-সংগঠক নিহত। পুলিশের গুলি, টিয়ার গ্যাস, হেলিকপ্টার সক্রিয়তায় শ^াসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। একদিকে নিরস্ত্রদের হত্যা, অন্যদিকে স্পর্শকাতর স্থাপনায় নাশকতা।
কারফিউ : আ.লীগের কাদের বনাম বিএনপির ফখরুল : ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ। পাশাপাশি সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়। আওয়ামী লীগ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বক্তব্য দেন। বলেন, শ্রীলংকার স্টাইলে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন তছনছ করা হতো। লন্ডন থেকে বিএনপি নেতার সে রকম মেসেজ ছিল। ছাত্রদের কাঁধে বন্দুক রেখে বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় বসতে চেয়েছে। যথাসময়ে কারফিউ দেয়ায় তারা সে সুযোগ পায়নি।
প্রতিউত্তরে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বক্তব্য দেন। বলেন, মিথ্যাচার করে সারা দেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের গ্র্রেপ্তার চলছে। ছাত্র-অভিভাবক গণ-আন্দোলন ঠেকাতে সরকার ব্যর্থ। কোটা আন্দোলনকারীদের তথ্যমতে, ২৬৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। বিএনপি এই মহা-আন্দোলনে সক্রিয় থাকলে অসংখ্যজন হতাহত হতো। কিন্তু মৃতের তালিকায় বিএনপির তেমন কেউ নেই। অতএব নাশকতা মামলায় বিএনপিকে জড়ানো প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়।
ফখরুল- কারফিউ ও সেনা প্রত্যাহার চান। সরকারের পদত্যাগও দাবি করেন তিনি। মূল দাবি মানা হলেও ৮ দফায় অনড় আন্দোলনকারীরা : ডিবি-হারুনকে বোকা বানালো আটক ৬ সমন্বয়ক : ২১ জুলাই ঐতিহাসিক রায় দেয় সুপ্রিমকোর্ট। হাইকোর্টের পূর্বোক্ত নিষেধাজ্ঞা বতিল করে ৩০ শতাংশ। মুক্তিযোদ্ধা, নাতি-নাতনি, জেলা, নারীকোটা বাদ। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ১, প্রতিবন্ধী/তৃতীয় লিঙ্গ ১ শতাংশ। আর আন্দোলনকারীদের জন্য মেধাকোটা ৯৭ শতাংশ ।
মূল দাবি পূরণ হলেও আন্দোলনকারীরা অন্যান্য দবিতে অনড়। সহযোদ্ধা শহীদদের হত্যার বিচার, তাদের মামলা প্রত্যাহার। শিক্ষাঙ্গন খুলে দেওয়া ও কোটা বাস্তবায়ন কমিশন গঠন।
আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহারে সরকার নানা কৌশল গ্রহণ করে। ২৬ জুলাই তিন সমন্বয়কারীকে তুলে আনে হাসপাতাল থেকে। তারা হলেনÑ নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, আবু বকর মজুমদার। ডিবি বা ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ ২৭ জুলাই ধরে আরও তিন সন্বয়ককে। তারা হলেনÑ সারজিস, হাসনাত আব্দুল্লাহ, নুসরাত তাবাসসুম। ডিবি-প্রধান হারুন-অর রশিদ ছাত্রনেতাদের মোরগপোলাও খাওয়ান। তাদের অভিভাবকদেরও এনে সমাদর করেন। তিনি মিডিয়ায় এ বিষয়ে বক্তব্যও দেন। বলেন, অধিকতর নিরাপত্তা দিতে তাদের এনে রাখা হয়েছে। ডিবি অফিসে ৬ সমন্বয়কের আটক নিয়ে নাটকের পর নাটক। ২৭ জুলাই বিকালে ১২ জন সিনিয়র শিক্ষক যান ছাত্রদের দেখতে। ডিবি-প্রধান হারুন অর রশিদের সাক্ষাৎ প্রার্থীও ছিলেন। প্রথমত আন্দোলন-সমন্বয়ক ছাত্ররা কী অবস্থায় আছে জানা। দ্বিতীয়ত আদোলন সমাধান বিষয়ে ভূমিকা পালন। সচেতন মহলের মতে, সংকটটির সামাধান হয়ে যেতে পারত। কিন্তু সরকারপক্ষ ‘সুবর্ণ সুযোগটি’ গ্রহণ করতে পারেনি। ডিবি-প্রধান সিনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎও করেননি। আটক ছাতনেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্ভব নয় বলেও জানান।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ পাঁচটি খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। ১২ জন সিনিয়র শিক্ষকের প্রতি অবমাননায় পাল্টে যায় পরিস্থিতি। সারা দেশের শিক্ষকসমাজ নতুন করে ঐকমত্যে পৌঁছায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনকে নিজেদের ফোরাম বলে ঘোষণা দেন। ফলে মুখ থুবড়ে পড়ে ‘ডিবি-প্রধানে’র আটক-মিশন।’ পরদিন মিন্টো রোডে যান সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ। ডিবি অফিসে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের পরিচয় দেন। বলেন, আমি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা-প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন-পুত্র। পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের প্রথম আহ্বায়ক আমার মা। প্রয়াত জোহরা তাজউদ্দীনের সন্তান-এসেছি বিবেকের তাড়নায়। ডিবিকে জিজ্ঞেস করতে চাই, ছাত্রনেতারা গ্র্রেপ্তারকৃত না অতিথি। গ্র্রেপ্তার না হলে ২/৩ দিন ধরে আটক কেন। তিনি মিডিয়াকে বলেন, স্থাপনার যা ক্ষতি হয়েছে আবার গড়া যাবে। কিন্তু শত শত প্রাণ চলে গেল, তা কি ফেরত পাব। উল্লেখ্য, চারঘন্টা পর ডিবি প্রধানের সাক্ষাৎ পান তিনি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কিছু বলতে নারাজ ছিলেন।
পরে এক ভিডিও বার্তায় ৬ সমন্বয়ক একটি ঘোষণা দেন। বলেন কোটা-সংস্কার আন্দোলনের সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হলো। কিন্তু দু’ঘন্টা পর মাঠে থাকা অপর দু’জন বললেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, ডিবি কতৃর্পক্ষ চাপে ফেলে এমন ঘোষণা দিতে বাধ্য করেছে। নয় দফা দাবিতে আন্দোলন ছিল, আন্দোলন থাকবে।
সরকারের কালোব্যাজ বনাম আন্দোলনকারীদের মুখে লালপট্টি : ৩০ জুলাই সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে শোকদিবস পালন করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১৫০ জনের প্রাণহানির কথা ঘোষণা করেন। সেমতে, সরকারি কর্মকর্তা ও আ.লীগের নেতা-কর্মীরা কালোব্যাজ পরেন। কিন্তু আন্দোলনকারীদের পক্ষে সমন্বয়ক মাহিন সরকার দেন ভিন্ন কর্মসূচি। কালোব্যাজ নয়, মুখে লাল কাপড় বাঁধা প্রতিবাদ দিবস পালন। সারা দেশের প্রধান শিক্ষাঙ্গনে তেমনটিই চললো।
আরেক সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ ঘোষণা করেছে সর্বশেষ কর্মসৃচি। ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ মুভমেন্টÑ জুলাই ৩১ থেকে।
‘ডিবি’তে আটক ৬ সমন্বয়কারীর বিষয়টি হাইকোর্টে উঠেছে। আর কাউকে গুলি না করার বিষয়ে ‘রিট পিটিশন’ করা হয়েছে। বিচারপতি মোস্তফা জামান ও মাসুদ হোসেন দুলাল শুনানি করছেন। ডিবিÑপ্রধানের আপ্যায়নের ভিডিও প্রকাশকে কটাক্ষ করেছেন। বলেছেন, অফিসে নিয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে বসাবেন। এভাবে জাতির সাথে মশকরা করবেন না।
রেমিটেন্সপ্রাপ্তি ও জাতিসংঘ শান্তিমিশন সুরক্ষায় মহাটেনশনে সরকার : বাংলাদেশের শ^াসরুদ্ধকর পরিস্থিতি নিয়ে প্রবাসীরা চরমভাবে উদ্বিগ্ন। ফোনলাইন অনলাইনÑ কোনোভাবেই সংযোগ হচ্ছিল না। ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিশে^র শহরে শহরে মিছিল। অধিকাংশরা বৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুঁিজতে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। দু’সপ্তাহেই রিজার্ভ ৫৩ কোটি ডলার কমে গেছে।
আন্দোলনের দু’সপ্তাহে রেমিট্যান্স অর্ধেকে নেমে এসেছে। জুন মাসে প্রাপ্তি ছিল ২৫৪ কোটি ১৭ লাখ মর্কিন ডলার। জুলাই মাসে পরিমাণটি ১৫৮ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী প্রবাসীদের প্রতি জোর অনুরোধ জানিয়েছেন। বলেছেন, এই দেশ আপনাদের। দেশকে বাঁচাতে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠান।
জাতিসংঘ শান্তিমিশনের আয় নিয়েও সরকার মহাটেনশনে। ১৯৮৮ সাল থেকে সামরিক বাহিনী মিশনে কাজ করছে। ১৯৮৯ থেকে পুলিশ বাহিনীও সংযুক্ত হয়েছে। মিশনে সুযোগ পেলে প্রত্যেকে অর্থনৈতিকভাবে বিশেষ সুযোগপ্রাপ্ত হয়। ২০২৩ পর্যন্ত ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪৮ জন বিভিন্ন দেশে কর্মরত। বাংলাদেশের ৫৭২ জন নারীও মিশনে ইউনিফরম পরে দায়িত্বরত। বাংলাদেশের সামরিক ও পুলিশখাত মিশন সুবিধাটি হারাতে চায় না। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতিসংঘ শতভাগ উদ্বিগ্ন। সহিংসতা ও শিক্ষার্থীদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে। ‘ইউএন’ প্রতীকের সাদা জিপও ব্যবহৃহ হয়েছে আন্দোলনে, পররষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ভুলও স্বীকার করেছেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস ক্ষোভযুক্ত বাণী দিয়েছেন। মুখপাত্র স্টিফেন রোজারিকও ২৯ জুলাইয়ের বিবৃতিতে ব্যাখ্যা চেয়েছেন। সরকারপক্ষ এ বিষয়ে জোরাল পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনুস-এর একটি বিবৃতি বিশ^ব্যাপী আলোড়ন তুলেছে। জাতিসংঘ থেকে ওনার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।
ভারত ও ১৪ দলীয় জোটের চাপে জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ : বিএনপিতে যোগদানের হিড়িক : রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘জামায়াতে ইসলামী’র জীবনপ্রদীপ নিভু নিভু। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকালে মানবাধিকার ট্রাইব্যুনাল নিষিদ্ধের বীজটি বুনেছিল। গোলাম আজমের যাবজ্জীবন রায়ে জামায়াতকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলা হয়। পরে আদালতের মাধ্যমে ‘নির্বাচনী নিবন্ধন’ও বাতিল হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে জামায়াতের ভূমিকাকে ‘আগ্রাসী’ বলা হয়। সহযোগী সংগঠক ইসলামী ছাত্রশিবিরও প্রতিপক্ষের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। জামায়াত বিরোধী প্রথম আঘাতটি আসে ভারত থেকে। সরকারি দল ‘বিজেপি’ আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে বিজেপি স্মারকলিপি প্রদান করে। তাদের দাবি, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আন্দোলনে ভারতবিবোধী স্লেøাগান দেয়া হয়েছে। ধর্মীয় ভাবাবেগে চরম আঘাত হানা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নাম নিয়ে অপমানও করা হয়। সম্প্রতি এসবের কিছু ভিডিও হাতে এসেছে। এই অপকর্মের হোতাদের গ্র্রেপ্তার ও নিষিদ্ধ করা হোক।
বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী ২০ জন বিধায়কসহ দূতাবাসে যান। তিনি অসংখ্য জনসভায় জামায়াত রাজনীতির বিরদ্ধে বক্তব্য রাখেন। রাজধানী দিল্লি থেকে ঢাকায় বার্তা পৌঁছানো হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতিনিধি ঢাকায় কথা বলেন। আ.লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বিষয়টি দেখভাল করেন। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে হোস্ট-মিনিস্টার থাকেন ড. রাজ্জাক। গত ১২ জানুয়ারির নির্বাচনে টাঙ্গাইলে পরাজিত হন এই সাবেক মন্ত্রী।
সরকারপক্ষীয় ১৪ দলের আধিকাংশ প্রবীণ নেতা এখন অবকাশে। আমির হোসেন আমু, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু। এককভাবে চলা আ.লীগের ওপর সতীর্থরা বেজার। কিন্তু কোটাবিরোধী আন্দোলনের মুখে সবাই আবার ডাক পান। মন্ত্রিত্ব ও এমপিত্ব হারানো ড. রাজ্জাকও মুখর হয়ে ওঠেন। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১৪ দলীয় জোটের সভায় জোরালো প্রস্তাব। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হয় এখন সরকারের নির্বাহী আদেশের আপেক্ষায়।
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হওয়ায় বিএনপির আঙিনায় নতুন ঢেউ। যোগদানের হিড়িক পড়ে গেছে। অন্যদিকে ১৪ দলীয় জোটের অবহেলিত প্রবীণ নেতারাও খুশি। একই ছোরায় জামায়াত ও আ.লীগকে শায়েস্তা করতে পেরেছে বলে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন- ২০১৮ থেকে ২০২৪ : সংস্কারের বদল বাতিল- রহস্য : বাংলাদেশে ‘কোটা’ সংস্কার আন্দোলন’ চূড়ান্তরূপ নিয়েছিল ২০১৮ তে। ঢাবি ভিপি নূরসহ একাধিক ছাত্রনেতা ছিল নেতৃত্বে। তখন চাকরিবিধিতে ছিল ৫৬ শতাংশ কোটা, বাকিটা মেধাভিত্তিক। মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটা সন্তান ছাড়াও নাতি-নাতনিদের জন্য নির্ধারিত হয়। এতে বিরোধ ও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। দেশে ‘মুক্তিযোদ্ধার তালিকা’য় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামও সংযোজিত হয়। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানার উত্তরসূরিরাও বেনিফিশিয়ারি হন। নাতি-নাতনিদের কোটা-আধিকার বিষয়ে বৈষম্যের অভিযোগ ওঠে। আন্দোলনের ইস্যু হয় কোটা সংস্কারের। উল্লেখ্য, সংবিধানের ২৯-(৩) ধারায় কোটা সংরক্ষণের বিধান রয়েছে। পশ্চাৎপদ/অনগ্রসর/নৃ-গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী। ২০১৮-এর পরিপত্র অনুসারে ৫৬ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত থাকে। ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাসহ জেলা, নারী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী। ফলে মেধার ভিত্তিতে চাকরি প্রাপ্তির পরিমাণ মাত্র ৪৪ শতাংশ। এই অঙ্কটি ৯০ শতাংশের ওপরে নেওয়ার জন্যই জোরালো হয় আন্দোলন।
২০১৮-তে আকস্মিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চমক দেখান। সংসদে ঘোষণা দেন যে ‘সকল কোটা’ই বাতিল। এই মর্মে সরকার প্রজ্ঞাপনও জারি করে। ফলে আন্দোলন প্রশমিত হয়। এরপর করোনা পরিস্থতি চলে গেলে বিষয়টি আদালতে গড়ায়। সরকারি সিদ্ধান্তকে চ্যালেজ করেন দুই মুক্তিযোদ্ধাপুত্র। কোটা পদ্ধতি ‘সাংবিধানিক বিষয়’ বিধায় প্রজ্ঞাপনটি বাতিল হয়। পয়লা জুলাই হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দিলে সুপ্রিমকোর্টে আপীল করা হয়। ৭ আগস্ট শুনানির দিন ধার্য করে আপীল আদালত। এরই মধ্যে কোটা সংস্কার বিষয়ে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সংঘটিত হয়। ১০ জুলাই ঢাকায় ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে সৃষ্টি হয় নাকাল পরিস্থিতি। পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র-আন্দোলন।
চীন সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত দেশে ফেরেন। সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি ছাত্র-আন্দোলনকে কটাক্ষ করেন। বলেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা কোটা পেতেই পারে। তা না হলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা কোটা সুবিধা পাবে? এমন বক্তব্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। আন্দোলনকারীরা নিজেদের অপমানিত বোধ করেন। তাদের ধারণা ছিল কোটা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নিরপেক্ষ থাকবেন। অনেকের মতে, প্রধানমন্ত্রী জানতেন, ওনার প্রজ্ঞাপন আদালতে টিকবে না। ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা’ জেনেও উনি শতভাগ কোটা বাতিল করেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা বাতিল নয়, সংস্কার চেয়েছিল।
নিরস্ত্রদের হত্যা বনাম নামকতার উন্মত্ততা : ১২ জুলাই থেকে সারা দেশে নতুন স্লোগানে মুখরিত হয়। চেয়েছিলাম আধিকার/হয়ে গেলাম রাজাকার।
তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে কে বলেছে- স্বৈরাচার স্বৈরাচার।
ছাত্রদের ডাকে দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বজনীন আন্দোলন। এসময় আ.লীগ সম্পাদক মন্ত্রী ওবায়দুল কদের আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেন। বলেন, আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্রলীগ বসে থাকতে পারে না। ১৪ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাহিংস হামলা। হলে হলে ছাত্রছাত্রীদের ওপর পাশবিক অত্যাচার। এতে ফুঁসে ওঠে শহর-মফস্বল-প্রবাস-বিদেশ। ছাত্রদের পাশে অভিভাবক, শিক্ষক, সচেতন মহল দাঁড়িয়ে যায়। পরদিন রাতে ঢাকার সব হল, ক্যাম্পাসে উল্টোচিত্র। সদলবলে বিতাড়িত হয় ছাত্রলীগ নেতৃবর্গ। অনেক নেতানেত্রীকে কান ধরে উঠ-বসও করানো হয়।
নিরস্ত্রদের হত্যা বনাম স্থাপনায় নাশকতার ভয়াল পরিস্থিতি। আয়ত্তের বাইরে যাওয়ার অবস্থা দাঁড়ায়। সরকার জরুরি ভিত্তিতে কারফিউ জারি করে। সব ধরনের অনলাইন কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। ইন্টারনেট বন্ধ করায় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউবÑ সব অচল। সরকার পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি বাহিনী পাঠায় শিক্ষাঙ্গনে। ভুতুড়ে অবস্থায় হলগুলো থেকে বিতাড়ন করে সকল ছাত্র-ছাত্রীকে।
অভিভাবক ও সচেতন মহল আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। ফলে ছাত্র-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এর মধ্যে রাজনৈতিক সুবিধাভোগী অংশও ঢুকে পড়ে। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদসহ ৮ ছাত্র-সংগঠক নিহত। পুলিশের গুলি, টিয়ার গ্যাস, হেলিকপ্টার সক্রিয়তায় শ^াসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। একদিকে নিরস্ত্রদের হত্যা, অন্যদিকে স্পর্শকাতর স্থাপনায় নাশকতা।
কারফিউ : আ.লীগের কাদের বনাম বিএনপির ফখরুল : ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ। পাশাপাশি সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়। আওয়ামী লীগ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বক্তব্য দেন। বলেন, শ্রীলংকার স্টাইলে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন তছনছ করা হতো। লন্ডন থেকে বিএনপি নেতার সে রকম মেসেজ ছিল। ছাত্রদের কাঁধে বন্দুক রেখে বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় বসতে চেয়েছে। যথাসময়ে কারফিউ দেয়ায় তারা সে সুযোগ পায়নি।
প্রতিউত্তরে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বক্তব্য দেন। বলেন, মিথ্যাচার করে সারা দেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের গ্র্রেপ্তার চলছে। ছাত্র-অভিভাবক গণ-আন্দোলন ঠেকাতে সরকার ব্যর্থ। কোটা আন্দোলনকারীদের তথ্যমতে, ২৬৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। বিএনপি এই মহা-আন্দোলনে সক্রিয় থাকলে অসংখ্যজন হতাহত হতো। কিন্তু মৃতের তালিকায় বিএনপির তেমন কেউ নেই। অতএব নাশকতা মামলায় বিএনপিকে জড়ানো প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়।
ফখরুল- কারফিউ ও সেনা প্রত্যাহার চান। সরকারের পদত্যাগও দাবি করেন তিনি। মূল দাবি মানা হলেও ৮ দফায় অনড় আন্দোলনকারীরা : ডিবি-হারুনকে বোকা বানালো আটক ৬ সমন্বয়ক : ২১ জুলাই ঐতিহাসিক রায় দেয় সুপ্রিমকোর্ট। হাইকোর্টের পূর্বোক্ত নিষেধাজ্ঞা বতিল করে ৩০ শতাংশ। মুক্তিযোদ্ধা, নাতি-নাতনি, জেলা, নারীকোটা বাদ। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ১, প্রতিবন্ধী/তৃতীয় লিঙ্গ ১ শতাংশ। আর আন্দোলনকারীদের জন্য মেধাকোটা ৯৭ শতাংশ ।
মূল দাবি পূরণ হলেও আন্দোলনকারীরা অন্যান্য দবিতে অনড়। সহযোদ্ধা শহীদদের হত্যার বিচার, তাদের মামলা প্রত্যাহার। শিক্ষাঙ্গন খুলে দেওয়া ও কোটা বাস্তবায়ন কমিশন গঠন।
আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহারে সরকার নানা কৌশল গ্রহণ করে। ২৬ জুলাই তিন সমন্বয়কারীকে তুলে আনে হাসপাতাল থেকে। তারা হলেনÑ নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, আবু বকর মজুমদার। ডিবি বা ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ ২৭ জুলাই ধরে আরও তিন সন্বয়ককে। তারা হলেনÑ সারজিস, হাসনাত আব্দুল্লাহ, নুসরাত তাবাসসুম। ডিবি-প্রধান হারুন-অর রশিদ ছাত্রনেতাদের মোরগপোলাও খাওয়ান। তাদের অভিভাবকদেরও এনে সমাদর করেন। তিনি মিডিয়ায় এ বিষয়ে বক্তব্যও দেন। বলেন, অধিকতর নিরাপত্তা দিতে তাদের এনে রাখা হয়েছে। ডিবি অফিসে ৬ সমন্বয়কের আটক নিয়ে নাটকের পর নাটক। ২৭ জুলাই বিকালে ১২ জন সিনিয়র শিক্ষক যান ছাত্রদের দেখতে। ডিবি-প্রধান হারুন অর রশিদের সাক্ষাৎ প্রার্থীও ছিলেন। প্রথমত আন্দোলন-সমন্বয়ক ছাত্ররা কী অবস্থায় আছে জানা। দ্বিতীয়ত আদোলন সমাধান বিষয়ে ভূমিকা পালন। সচেতন মহলের মতে, সংকটটির সামাধান হয়ে যেতে পারত। কিন্তু সরকারপক্ষ ‘সুবর্ণ সুযোগটি’ গ্রহণ করতে পারেনি। ডিবি-প্রধান সিনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎও করেননি। আটক ছাতনেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্ভব নয় বলেও জানান।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ পাঁচটি খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। ১২ জন সিনিয়র শিক্ষকের প্রতি অবমাননায় পাল্টে যায় পরিস্থিতি। সারা দেশের শিক্ষকসমাজ নতুন করে ঐকমত্যে পৌঁছায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনকে নিজেদের ফোরাম বলে ঘোষণা দেন। ফলে মুখ থুবড়ে পড়ে ‘ডিবি-প্রধানে’র আটক-মিশন।’ পরদিন মিন্টো রোডে যান সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ। ডিবি অফিসে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের পরিচয় দেন। বলেন, আমি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা-প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন-পুত্র। পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের প্রথম আহ্বায়ক আমার মা। প্রয়াত জোহরা তাজউদ্দীনের সন্তান-এসেছি বিবেকের তাড়নায়। ডিবিকে জিজ্ঞেস করতে চাই, ছাত্রনেতারা গ্র্রেপ্তারকৃত না অতিথি। গ্র্রেপ্তার না হলে ২/৩ দিন ধরে আটক কেন। তিনি মিডিয়াকে বলেন, স্থাপনার যা ক্ষতি হয়েছে আবার গড়া যাবে। কিন্তু শত শত প্রাণ চলে গেল, তা কি ফেরত পাব। উল্লেখ্য, চারঘন্টা পর ডিবি প্রধানের সাক্ষাৎ পান তিনি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কিছু বলতে নারাজ ছিলেন।
পরে এক ভিডিও বার্তায় ৬ সমন্বয়ক একটি ঘোষণা দেন। বলেন কোটা-সংস্কার আন্দোলনের সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হলো। কিন্তু দু’ঘন্টা পর মাঠে থাকা অপর দু’জন বললেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, ডিবি কতৃর্পক্ষ চাপে ফেলে এমন ঘোষণা দিতে বাধ্য করেছে। নয় দফা দাবিতে আন্দোলন ছিল, আন্দোলন থাকবে।
সরকারের কালোব্যাজ বনাম আন্দোলনকারীদের মুখে লালপট্টি : ৩০ জুলাই সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে শোকদিবস পালন করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১৫০ জনের প্রাণহানির কথা ঘোষণা করেন। সেমতে, সরকারি কর্মকর্তা ও আ.লীগের নেতা-কর্মীরা কালোব্যাজ পরেন। কিন্তু আন্দোলনকারীদের পক্ষে সমন্বয়ক মাহিন সরকার দেন ভিন্ন কর্মসূচি। কালোব্যাজ নয়, মুখে লাল কাপড় বাঁধা প্রতিবাদ দিবস পালন। সারা দেশের প্রধান শিক্ষাঙ্গনে তেমনটিই চললো।
আরেক সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ ঘোষণা করেছে সর্বশেষ কর্মসৃচি। ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ মুভমেন্টÑ জুলাই ৩১ থেকে।
‘ডিবি’তে আটক ৬ সমন্বয়কারীর বিষয়টি হাইকোর্টে উঠেছে। আর কাউকে গুলি না করার বিষয়ে ‘রিট পিটিশন’ করা হয়েছে। বিচারপতি মোস্তফা জামান ও মাসুদ হোসেন দুলাল শুনানি করছেন। ডিবিÑপ্রধানের আপ্যায়নের ভিডিও প্রকাশকে কটাক্ষ করেছেন। বলেছেন, অফিসে নিয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে বসাবেন। এভাবে জাতির সাথে মশকরা করবেন না।
রেমিটেন্সপ্রাপ্তি ও জাতিসংঘ শান্তিমিশন সুরক্ষায় মহাটেনশনে সরকার : বাংলাদেশের শ^াসরুদ্ধকর পরিস্থিতি নিয়ে প্রবাসীরা চরমভাবে উদ্বিগ্ন। ফোনলাইন অনলাইনÑ কোনোভাবেই সংযোগ হচ্ছিল না। ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিশে^র শহরে শহরে মিছিল। অধিকাংশরা বৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুঁিজতে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। দু’সপ্তাহেই রিজার্ভ ৫৩ কোটি ডলার কমে গেছে।
আন্দোলনের দু’সপ্তাহে রেমিট্যান্স অর্ধেকে নেমে এসেছে। জুন মাসে প্রাপ্তি ছিল ২৫৪ কোটি ১৭ লাখ মর্কিন ডলার। জুলাই মাসে পরিমাণটি ১৫৮ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী প্রবাসীদের প্রতি জোর অনুরোধ জানিয়েছেন। বলেছেন, এই দেশ আপনাদের। দেশকে বাঁচাতে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠান।
জাতিসংঘ শান্তিমিশনের আয় নিয়েও সরকার মহাটেনশনে। ১৯৮৮ সাল থেকে সামরিক বাহিনী মিশনে কাজ করছে। ১৯৮৯ থেকে পুলিশ বাহিনীও সংযুক্ত হয়েছে। মিশনে সুযোগ পেলে প্রত্যেকে অর্থনৈতিকভাবে বিশেষ সুযোগপ্রাপ্ত হয়। ২০২৩ পর্যন্ত ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪৮ জন বিভিন্ন দেশে কর্মরত। বাংলাদেশের ৫৭২ জন নারীও মিশনে ইউনিফরম পরে দায়িত্বরত। বাংলাদেশের সামরিক ও পুলিশখাত মিশন সুবিধাটি হারাতে চায় না। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতিসংঘ শতভাগ উদ্বিগ্ন। সহিংসতা ও শিক্ষার্থীদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে। ‘ইউএন’ প্রতীকের সাদা জিপও ব্যবহৃহ হয়েছে আন্দোলনে, পররষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ভুলও স্বীকার করেছেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস ক্ষোভযুক্ত বাণী দিয়েছেন। মুখপাত্র স্টিফেন রোজারিকও ২৯ জুলাইয়ের বিবৃতিতে ব্যাখ্যা চেয়েছেন। সরকারপক্ষ এ বিষয়ে জোরাল পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনুস-এর একটি বিবৃতি বিশ^ব্যাপী আলোড়ন তুলেছে। জাতিসংঘ থেকে ওনার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।
ভারত ও ১৪ দলীয় জোটের চাপে জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ : বিএনপিতে যোগদানের হিড়িক : রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘জামায়াতে ইসলামী’র জীবনপ্রদীপ নিভু নিভু। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকালে মানবাধিকার ট্রাইব্যুনাল নিষিদ্ধের বীজটি বুনেছিল। গোলাম আজমের যাবজ্জীবন রায়ে জামায়াতকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলা হয়। পরে আদালতের মাধ্যমে ‘নির্বাচনী নিবন্ধন’ও বাতিল হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে জামায়াতের ভূমিকাকে ‘আগ্রাসী’ বলা হয়। সহযোগী সংগঠক ইসলামী ছাত্রশিবিরও প্রতিপক্ষের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। জামায়াত বিরোধী প্রথম আঘাতটি আসে ভারত থেকে। সরকারি দল ‘বিজেপি’ আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে বিজেপি স্মারকলিপি প্রদান করে। তাদের দাবি, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আন্দোলনে ভারতবিবোধী স্লেøাগান দেয়া হয়েছে। ধর্মীয় ভাবাবেগে চরম আঘাত হানা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নাম নিয়ে অপমানও করা হয়। সম্প্রতি এসবের কিছু ভিডিও হাতে এসেছে। এই অপকর্মের হোতাদের গ্র্রেপ্তার ও নিষিদ্ধ করা হোক।
বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী ২০ জন বিধায়কসহ দূতাবাসে যান। তিনি অসংখ্য জনসভায় জামায়াত রাজনীতির বিরদ্ধে বক্তব্য রাখেন। রাজধানী দিল্লি থেকে ঢাকায় বার্তা পৌঁছানো হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতিনিধি ঢাকায় কথা বলেন। আ.লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বিষয়টি দেখভাল করেন। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে হোস্ট-মিনিস্টার থাকেন ড. রাজ্জাক। গত ১২ জানুয়ারির নির্বাচনে টাঙ্গাইলে পরাজিত হন এই সাবেক মন্ত্রী।
সরকারপক্ষীয় ১৪ দলের আধিকাংশ প্রবীণ নেতা এখন অবকাশে। আমির হোসেন আমু, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু। এককভাবে চলা আ.লীগের ওপর সতীর্থরা বেজার। কিন্তু কোটাবিরোধী আন্দোলনের মুখে সবাই আবার ডাক পান। মন্ত্রিত্ব ও এমপিত্ব হারানো ড. রাজ্জাকও মুখর হয়ে ওঠেন। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১৪ দলীয় জোটের সভায় জোরালো প্রস্তাব। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হয় এখন সরকারের নির্বাহী আদেশের আপেক্ষায়।
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হওয়ায় বিএনপির আঙিনায় নতুন ঢেউ। যোগদানের হিড়িক পড়ে গেছে। অন্যদিকে ১৪ দলীয় জোটের অবহেলিত প্রবীণ নেতারাও খুশি। একই ছোরায় জামায়াত ও আ.লীগকে শায়েস্তা করতে পেরেছে বলে।