আহমদ ছফা রচিত ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’  সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং সামাজিক  চিন্তার অকাট্য দলিল

প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৪, ১৮:৫৯ , অনলাইন ভার্সন
বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য লেখক, গবেষক, চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার সর্বাধিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ।  সুশীলসমাজের অধিকাংশ পাঠকের কাছে আলোড়িত এজন্যে যে, - সেই সময়কার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার বিপক্ষে,  প্রতিকুল পরিবেশে সেই বইটি ছিল একটি সাহসী রচনা। ফলে, বারবার বইটি পূণঃর্মুদ্রিত হয়। তবে, সরকারের তোষামোদকারী কতিপয় বুদ্ধিজীবীর স্বার্থে আঘাত হানে। ফলে, উল্লেখিত বইটিকে একটি বিতর্কিত রচনা হিসেবেও বুঝানোর চেষ্টা করা হয়।
প্রথমে ১৯৭২ সালে অধুনালুপ্ত দৈনিক গণকন্ঠে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়। আহমদ ছফা তখন ছিলেন একজন বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ। থাকতেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে। সেসময় পাঠক ও ভক্তকুলের অনুরোধে সেটিকে বই আকারে প্রকাশের চিন্তা করা হয়। অবশেষে, সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারার কিংবদন্তী প্রকাশক বাবু চিত্তরঞ্জন সাহার বিশেষ তাগিদ ও অনুরোধে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন,  চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামেই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৫৭ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। কৈশোর থেকেই তাঁর ভেতর একধরণের স্বপ্ন ও কল্পনার যে বীজ উত্থিত হতে থাকে,- সেটি ক্রমান্বয়ে শক্তির উচ্ছ্বাসে হৃদয়ের গভীরে অঙ্কুরিত হয়।
আহমদ ছফা বাঙালি মুসলিম লেখকদের মধ্যে অন্যতম কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক,  সাংবাদিক,  গণবুদ্ধিজীবী এবং রাষ্ট্রচিন্তক হিশেবেও তিনি খ্যাতিমান।  ছাত্রজীবন থেকে তিনি বাম চিন্তাদর্শের উপর গড়ে উঠেন। স্কুলজীবনে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন এবং তিনি ছিলেন মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত।
আহমদ ছফার সাহিত্যিক জীবন কখনও মসৃণ ছিলনা। সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে গণমুখি চিন্তাদর্শন এবং আপোষহীন লেখালেখির জন্য তাঁকে সবসময় বাধার সম্মুখীন হতে হয়। একই কারণে,  তাঁকে কোন কোন বুদ্ধিজীবীদের ঈর্ষানল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের রোষানলে পড়তে  হয়েছে।
কেননা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বৈপরীত্যের নানা বিষয়কে উপাত্ত করে একশ্রেণীর শিক্ষিত সমাজের সুবিধাবাদী অবস্থান, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে তিনি লিখেছেন বলে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরাগভাজন হন।
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রকাশের পর সমগ্র দেশে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। একই কারনে তিনি সরকার পক্ষীয় বুদ্ধিজীবী ছাড়াও সুবিধাভোগীদের তোপের মুখে পড়েন এবং ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হন।
আমার তরুণতম ছাত্রজীবন থেকে দেখেছি যে, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা বিচলিত হয়ে উঠতেন। চিন্তা-চেতনায় শান্তগম্ভীর হলেও তাঁর উচ্চারণ ছিল সাহসী এবং সাহিত্য কার্যক্রম ছিল বিস্ময়কর। রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও অনৈতিক সমাজনীতির বিরুদ্ধাচরণ করে সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লিখতেন।
অবহেলিত বস্তিবাসী ও ছিন্নমূল মানুষের কল্যাণে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নে তিনি ব্যাপক কর্মতৎপর ছিলেন। শিক্ষার আলো ছড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ। সেই বিদ্যাপিঠে সুবিধাবাদী শিক্ষকদের অনৈতিক কার্যক্রমের উপরও তিনি কথা বলেছেন। শিক্ষাঙ্গণে সন্ত্রাস ও বখাট রাজনীতির বিরুদ্ধে তাঁর অনেক প্রতিবাদী লেখা আছে।
দারিদ্র বিমোচন ও সর্বস্তরে শিক্ষার আলো ছড়ানোর প্রত্যয়ে,  বস্তির শিশুদের জন্য শাহাবাগে অবৈতনিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেশের অবহেলিত কবি-সাহিত্যিকদের কল্যাণেও অবদান রাখেন। বিশেষ করে,  মেধাবী ও মননশীল তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণে কাজ করেন।
তিক্ত হলেও সত্যি যে, বর্তমানে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ভয়ংকর খারাপ। রাষ্ট্র ও সমাজের সৎ-চিন্তাশীল রাজনীতির ব্যবস্থাপনাসমূহ থুবরে পড়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে প্রশাসনিকস্তর ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। সুশীল রাজনীতির পরিবর্তে সুবিধাভোগী মাফিয়াচক্র এবং অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে রাষ্ট্রপুঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে ক্ষমতার দুবৃত্তায়ন ঘটেছে। সন্ত্রাস, হত্যা ও পাশবিকতাপূর্ণ নিপীড়নমূলক আচরণ সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে গেছে। সামাজিক অবক্ষয় ও অরাজকতায় গোটাদেশ রাজনীতিশূন্য হয়ে পড়েছে।
অথচ, আহমদ ছফা আমাদের রাষ্ট্র ও চলমান সমাজের আগাম বিপদের অশনি সংকেত জানিয়ে, অনেক আগেই লিখেছেন। সেজন্য তাঁর রচনাসমূহ সবসময়ের পাঠকের জন্য প্রাসঙ্গিক। রূঢ় হলেও সত্যি যে- দেশের সর্বত্র প্রকট সমস্যার মেঘ ঘনিভূত হয়ে আসছে। তখোন, আহমদ ছফা’র মতো প্রতিবাদী ও সাহসী  বিকল্পধারার বুদ্ধিজীবী আমরা খুঁজি- কিন্তু পাইনা!
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও পাঠকপ্রিয়তার প্রেক্ষিতে আহমদ ছফার উক্ত বইটি ছাড়াও কয়েকটি গ্রন্থ বহুবার পূণর্মুদ্রিত হয়েছে।  ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে’বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’গ্রন্থটির ২৫ বছর পূর্তিতে’সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’শিরোনামে(পরিবর্ধিত সংস্করণ) নতুনভাবে প্রকাশিত হয়।  বইটিতে’সাম্প্রতিক বিবেচনা’ নামে আহমদ ছফা একটি দীর্ঘ ভূমিকা লিখেন। বইটিতে বুদ্ধিজীবী ছাড়াও ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির ব্যর্থতার এগারোটি কারণ নির্দেশনার একটি খতিয়ান তুলে ধরা হয়।  যার ফলে, সরকারের লেজুরবৃত্তি পোষণকারী বাম ঘরানার লোকেরাও আহমদ ছফার প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেন।
নতুন শিরোনামে বইটির পূণঃপ্রকাশ সম্পর্কে এক দীর্ঘভূমিকায় লেখক আহমদ ছফা নিজের সাহিত্য রচনা সম্পর্কে বলেন- ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ রচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল উনিশ শ’ বাহাত্তর সালে।  এখন উনিশ শ’ সাতানব্বই। এরই মধ্যে পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেছে। যখন লেখাটি প্রকাশিত হয় আমার বয়স বড়জোর আটাশ। বিগত পঁচিশ বছরে এই লেখাটির অনেকগুলো সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে তৎকালীন পরিবেশ পরিস্থিতি স্নায়ুতন্ত্রর ওপর চাপ সৃষ্টি করে আমাকে এই লেখাটি লিখতে বাধ্য করেছিল।
তিক্ত হলেও সত্যি যে- সুবিধাবাদীদের বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে কথা বলায় আহমদ ছফাকে জীবনে অনেক কঠিন সময় পাড় করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সঠিক মন্তব্য ও প্রতিবাদী লেখার কারণে আহমদ ছফা বারবার বাধাগ্রস্থ হন এবং তথাকথিত লেখক ও বুদ্ধিজীবী মহলের প্রতিহিংসার শিকার হন।
গ্রন্থটিতে আহমদ ছফা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক মানসজগতের মানচিত্র অঙ্কন করেন এবং বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদিতার মুখোশ  নগ্নরূপ  উন্মোচিত হয়।
একইসঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের সত্যিকার দায়িত্বের স্বরূপ ও দিকনির্দেশনান্তায় মননশীল সৃজনকর্মের দ্বারা একটি সুন্দর সফল উদ্ভাবিত স্বদেশ গড়বার তাগিদ অনুভূত হয়েছে।
বর্ণনাপূর্বক তাঁদের সতর্ক করে দিতে বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে,  সে সম্পর্কেও ভবিষ্যদ্বাণী করেন। নিজেদের দুরাবস্থার কথা বুঝাতে তিনি বলেন-
“আমরা এমন এক যুগে বাস করছি,  যখন রক্ত দিয়েই চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি। চারদিকে এত অন্যায়,  অবিচার,  এত মুঢ়তা এবং কাপুরুষতা ওঁৎ পেতে আছে যে এ ধরনের পরিবেশে নিতান্ত সহজে বোঝা যায় এমন সহজ কথাও চেঁচিয়ে না বললে কেউ কানে তোলে না।” আহমদ ছফা, -১৯৭২
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’বইটিতে অকপটভাবে বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ আহমদ ছফা বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও রাষ্ট্রচিন্তকদের অবস্থান এবং কী করণীয়, সে বিষয়ে কথা বলেন। বইটির ছত্রে ছত্রে প্রতিবাদ ও সাহিত্যভাষার মাধুর্যে ভরপুর হয়ে আছে।
বাস্তবাতার নিরিখে বুদ্ধিবৃত্তিক সাহিত্য রচনা এবং মুক্তচিন্তায় আপোষহীনতা বজায় রাখতে গিয়ে তিনি বলেন;
-‘‘মাঝে মাঝে এমন চিন্তাও আমার মনে আসে,  লেখাটি যদি না লিখতাম,  হয়ত আমার জীবন অন্যরকম হতে পারত। এই লেখাটির জন্যই  আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর রোষ আমাকে পেছন থেকে অভিশাপের মত তাড়া করেছে। অদ্যবধি আমি জীবনে স্বস্তি কি বস্তু তার সন্ধান পাইনি। আগামীতে কোনদিন পাব,  সে ভরসাও করিনে।”
আমাদের চলমান অবক্ষয়ী সমাজ ও রাষ্ট্রপুঞ্জের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেসব দুর্নীতি, অন্যায়, জুলুম, অত্যাচারমূলক শোষণ-নিপীড়ন চলছেÑ সেসবের বিরুদ্ধে কথা না বলে আপোষহীনতাকে তিনি কাপুরুষিত কাজ রূপে আখ্যা দিয়েছেন। যারা অন্ধভাবে অন্যায়ের সমর্থন করে, এবং অন্যায়ের সমর্থনকারীদের বিপক্ষে আহমদ ছফা সেভাবেই তাঁর সাহসী কলাম লিখে সুবিখ্যাত ও জনপ্রিয় লেখক হয়ে উঠেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি কঠোর মন্তব্য ও অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন, এভাবে- “আমাদের কবি-সাহিত্যিকেরা আমাদের সমাজের সবচেয়ে নোংড়া মানুষ। তাঁরা দেশকে যে ফাঁকি দিয়েছেন,  কোন কালোবাজারির সঙ্গে তুলনা হয় না। তাঁদের ছদ্ম আদর্শবাদিতার সঙ্গে গণিকাদের সতীপনার তুলনা করা যায়। কে না জানে পাকিস্তান-ভারত যে যুদ্ধ হয়েছিল বলা হয়ে থাকে। এই  আসোয়ান ড্যাম ভাল করে তৈরি করার টাকা ঋণ না পেয়ে প্রেসিডেন্ট নাসের রাতারাতি মার্কিন ব্লক থেকে সোভিয়েত ব্লকে চলে গিয়েছিলেন। এমনি একটা যুদ্ধকে নিন্দা  করার মত একজন কবি, একজন লেখক ছিলেন না। অথচ পশ্চিম-বঙ্গে এই যুদ্ধের প্রতি সমর্থন দেননি বলে প্রায় আশিজন বুদ্ধিজীবীকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। আমাদের লেখকেরা কি করেছেন?
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের করণীয় কী হওয়া উচিত ছিল এবং তা কতটুকু পালিত হয়েছে? সে সম্পর্কে আহমদ ছফার স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া হচ্ছে,- “বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মনন-রীতি এবং চিরন্তন পদ্ধতির মধ্যে, আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় একটা গুণগত পরিবর্তন খুবই প্রত্যাশিত ছিল। সমগ্র বাঙালি জাতির লিখিত ইতিহাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মত তাৎপর্যবহ কোন ঘটনা নেই।
এই-ই প্রথম বাঙালি জাতি একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। সে রাষ্ট্রের আঙ্গিক এবং প্রকরণ যা-ই হোক না কেন,  বাংলার ঐতিহাসিক অহং-এর এই অভ্যুদয় যে সম্পূর্ণ  অভিনব ঘটনা, তার  গুরুত্ব কিছুতেই ছোট করে দেখার উপায় নেই। একটি নবীন রাষ্ট্রসত্ত্বা হিসেবে বাংলাদেশের পরিচিতি চিহ্ন তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিক্ষকদের, সাংবাদিকদের, কবি-সাহিত্যিকদের চিন্তাধারার মধ্যে একটা ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাঁরা সে দাবি মিটাতে পারছেন না। ” -(বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস;৬৭)
প্রকাশ থাকে যে,  স্বাধীনতার পর যখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমাগত বিপর্যয়ের দিকে চলে যায়। তখন যেসব সাহসী কলমযোদ্ধা ঝুঁকির মধ্যে লেখালেখি করেছেন, নিপীড়নের শিকার হয়েছে এবং জেল খেঁটেছেন। আহমদ ছফা ছিলেন তাঁদের অন্যতম। সেসময় দেশের প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত লেখক-বুদ্ধিজীবীরা প্রতিসপ্তাহে আহমদ ছফার সাহসী কলামের কিস্তির দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে মুখচেনা বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে,  নানারকম প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা,  গল্প-উপন্যাসে পাকিস্তান প্রশস্তি,  স্বৈরশাসকের জীবনী সংক্রান্ত নানান কিছুর অনুবাদ করেছেন। এতদসংক্রান্ত লেখার বিষয়ে আহমদ ছফা মেনে নিতে পারেন নি। বরং সেসব লেখকদের মেরুদণ্ডহীনতার চূড়ান্ত দলিল হিসেবে তিনি।   
একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বমূহুর্তে লেখকসমাজের নিষ্ক্রিয়তা,  যুদ্ধের সময় দ্বিধান্বিত ভূমিকা,  ভারতে পালিয়ে বেড়ানো,  ভোগবিলাসে মত্ত থাকার প্রসঙ্গেও আহমদ ছফা তাঁর রচনায় তুলে ধরেন। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাংলাদেশের লেখকসমাজ কতটা অপরিণামদর্শী ও অদূরদর্শী ছিলেন; সে সম্পর্কেও  আহমদ ছফা লিখেছেন।
তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, - ঐসব বুদ্ধিজীবীর কোনো চিন্তা-কর্ম-উপদেশ সমাজের বিশেষ কোন কাজে আসে না। আহমদ ছফা বলেন, “বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন,- শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এইসব বুদ্ধিজীবীরা এখন যা বলছেন,  শুনলে - বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না। ”
বইটিতে এপ্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করা হয়Ñ‘আমাদের মন-মানস এতো দীর্ঘকাল ধরে দাসত্ব করেছে যে,  তার হদিস আমরা নিজেরাও জানিনে। অসংখ্য বিদেশি জিনিসের মধ্যে কোনটা আমাদের জন্য উপযুক্ত, কোনটা অনুপযুক্ত, কোনটা প্রয়োজন, কোনটা অপ্রয়োজন, কোনটা খেলে ভালো হবে,  কোনটা খেলে খারাপ হবে,  কোনটা করা উচিত,  কোনটা করা উচিত নয় সে ব্যাপারে আমাদের ধারণা করার শক্তিও নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা জ্ঞানকে কতোদূর সার্বজনীন করব,  প্রযুক্তিবিদ্যার কী পরিমাণ প্রসার ঘটাব এবং বিজ্ঞানের ফলিত প্রয়োগ কতোদূর নিশ্চিত করব তার উপরেই নির্ভর করছে আমাদের স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ। এসব যদি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে তাহলে নামে স্বাধীন হলেও কার্যত আমাদের দাস থেকেই যেতে হবে। অপরের বাঁধা-ধরা চিন্তার মধ্যে আমাদের আবর্তিত হতে হবে। আমাদের নিজস্ব রুচি নিজস্ব সংস্কৃতির যে নির্দিষ্ট কোনো আকার আছে,  তা কোনোদিন দৃশ্যমান করে তুলতে পারব না।’
বাঙালি-সংস্কৃতি বলতে যদি আদ্যিকালের কোনো সমাজের চিন্তা-চেতনায় আচ্ছন্ন থাকি বা তা আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করি তাহলে আমরা সভ্য মানুষ হিসাবে স্বীকৃত হতে পারব না। ইতিহাসের ধারায় বাঙালি আজ যেখানে এসে পৌঁছেছে সবকিছু স্বীকার করে নিয়ে,  মেনে নিয়ে এই বৈজ্ঞানিক যুগে পৃথিবীর অপরাপর দেশের সঙ্গে তাল রেখে আমাদের মাটি জলহাওয়া যে আমাদের চরিত্রকে একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে তৈরি করেছে,  সেটি ফুটিয়ে তুলতে পারাটাই হবে আমাদের যথার্থ মৌলিকতার স্ফূরণ এবং সেটাই হবে আমাদের যথার্থ বাঙালিয়ানা।
আজ এই দাস্য মনোভাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। তা নইলে আমাদের স্বাধীনতা মিথ্যা হয়ে যাবে। কিন্তু এই মানসিক দাসত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাজটা হৈ হৈ করে হওয়ার কথা নয়। এতে প্রয়োজন সুন্দরতম ধৈর্য,  মহত্তম সাহস,  তীক্ষ্ণতম মেধা এবং প্রচণ্ড কুলছাপানো ভালোবাসা,  যার স্পর্শে আমাদের জনগণের কুঁকড়ে যাওয়া মানসিক প্রত্যঙ্গে আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগবে এবং সাহস ফণা মেলবে। ”
দেশের কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, পেশাজীবী ও সুশীল বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা সম্পর্কেও  আহমদ ছফার  ছিল অকপট উক্তিÑ “বাংলাদেশের অনেক সাহিত্যিক-সাংবাদিক মুখে স্বাধীনতা-সংগ্রামকে সমর্থন করেছেন, কিন্তু করেছেন উল্টো। সকলের সম্পর্কে আমরা বলছিনে। কোলকাতাতে যেয়ে যাঁরা সুযোগ লুট এবং টাকা ভাগাভাগি করার চক্র-উপচক্র সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁদের কথাই বলছি এবং তাঁদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ। একশ্রেণীর শিক্ষক এবং সাহিত্যিক ভারতে যেয়ে আমেরিকার টাকায় আরামে দিন কাটিয়েছেন। অথচ সে সময়ে মার্কিন অস্ত্রে এ দেশের মানুষকে পাকিস্তানি সৈন্যরা পশুর মত হত্যা করছে। তাঁরা কি করে এই সময়ে মার্কিন অর্থ গ্রহণ করতে পারলেন,  তার রহস্য এখনো অজানা থেকে গেছে। ” -(বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস:-পৃষ্ঠা:৬৬)।
পছন্দের ধারাকে ‘প্রগতিশীল’ এবং অপছন্দের ধারাকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ লেবেলিং করার প্রথাকে ভাঙতে না পারলেও আহমদ ছফা সুস্পষ্ট করে বলেছেন যে, প্রগতিবাদও একটি ধর্ম। তবে, প্রগতিশীলতার দাবিদার নকল পরিচয় দানকারীদের আহমদ ছফা কখনো কাছে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করেন নি।  বরং তাঁর দৃষ্টিতে ‘প্রকৃত প্রতিক্রিয়াশীল’ গোষ্ঠীর চেয়েও ‘নকল প্রগতিশীল’ গোষ্ঠীকে বেশি বিপদজনক মনে করতেন তিনি।
বইটিতে জাতীয় জীবনে ধর্মীয় গোঁড়ামির  ‘অভিভাবকত্ব’ কমিয়ে সংস্কৃতিকে ব্যবহার করার তাগিদ রয়েছে। এছাড়া কোন উদ্দেশ্যহীন শিল্প-সংস্কৃতির বিপরীতে অৎঃ ভড়ৎ ষরভব’ং ংধশব দর্শনের যৌক্তিকতা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে।
‘সংস্কৃতি’ বলে আজকে বাঙালি মুসলিমদের যা বুঝানো হচ্ছে এবং যারা সেসব গেলানোর চেষ্টা করছেন,  তার কোনোটিই যে নিরপেক্ষ নয় – সে ব্যাপারে পাঠকগণ আহমদ ছফার রচনাসমূহ থেকে একটা ধারণা পেতে পারেন।
আরও লক্ষণীয় যে,  ধর্মীয় ‘কুসংস্কারে’ আচ্ছন্ন জনগোষ্ঠীকে আহমদ ছফা ‘সংস্কারান্ধ’ হিশেবে আখ্যা দিয়েছেন।  এ প্রসঙ্গে যেমন তিনি বলেন, -“এই বাংলাদেশে যেখানে শতকরা আশিজন মানুষ মুসলমান-আশিজনের মধ্যে উনসত্তরজন সংস্কারান্ধ,  সেই সমাজে আজকে যদি একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাধনের প্রয়োজন হয়ে দাঁডায়, তার চেহারা কি হবে ?”
বইটিতে স্পষ্টভাবে বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীগণ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চিন্তনজগতের মানবিক উন্নয়নে আলোড়ন সৃষ্টি করতে অক্ষম। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়নে সরকারি রাজনীতির অক্টোপাসে জনমতের হাওয়া যেদিকে প্রবাহিত হয়, দেশের বুদ্ধিজীবীরাও সেদিকেই তাঁদের পাখা ছড়িয়ে দেন।
তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশ-পলাতক অনেকেই স্রেফ ঘটনাচক্রে মুক্তিসংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন। ‘বর্তমান  সময়েও অতীতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে সেইসব অভিযোগগুলোর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়।  রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সমাজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতিতে সন্ত্রাস ও জবরদখলি কার্যক্রমের সেইসব চিত্রসমূহ ভয়ংকরভাবে দেখা যায়।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের সুবিধাবাদী আচরণের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করে- ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ গ্রন্থটিতে আহমদ ছফা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানচিত্র অঙ্কন করেন এবং বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদিতার নগ্নরূপ উন্মোচন করেন।
আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সত্যিকার দায়িত্বের স্বরূপ ও দিকনির্দেশনামূলক বর্ণনা এবং বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে সে বিষয়েও তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন।
তবে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’রচনার মধ্যে যে, শুধু হতাশার কথা বলা হয়েছে (?) তা নয়,  -বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলনের গণমুখি প্রেক্ষাপটের তুলনামূলক আলোচনা রয়েছে এতে। আহমদ ছফা তাঁর আশাবোধের কথা জানিয়ে বাংলাদেশের উত্থান এবং সামগ্রিক উন্নয়নে রেনেসাঁর প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন-“রেনেসাঁর মূলকথা হল, -মানুষের জীবন সম্পর্কিত সমস্ত বিষয়ের নতুন মূল্যায়ন  এবং বাস্তবসম্মত উপায়ে কি ব্যক্তিক জীবনে, কি সামাজিক জীবনে স্বীকার করে নেয়া। এই কাজটিতেই প্রয়োজন জ্ঞানের। যখনই আমাদের সমাজে স্বীকৃতি পাবে- জ্ঞানই শক্তি, তখনই আমাদের দেশে সম্ভাবিত হয়ে উঠবে একটি রেনেসাঁ। ”
তবে, আহমদ ছফার মতের সঙ্গে এটিও যুক্ত হতে পারে, মূলত কোন রাষ্ট্র ও সামাজিক উন্নয়নে যেমন রেনেসাঁর জন্য প্রয়োজন,  তেমন প্রয়োজন, -নাগরিক সমাজের সচেতনতা। যেখানে গণমানুষের স্বার্থেই থাকবে রাজনীতি,  অর্থনীতি, শিক্ষা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান নিসৃত সামগ্রিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা।  তিনি দেশের সমাজবাস্তবতা,  রাজনীতি, গণতন্ত্র ও জনস্বার্থ রক্ষার্থে নতুন একটি রেনেসাঁর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।
এক্ষেত্রে  তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবোধকে বিসর্জন দিয়ে দেশ ও সমাজের নবীন রাষ্ট্রচিন্তকদের এগিয়ে নিয়ে আসার সংযুক্তির উপর গুরুত্বারোপ করে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন।
কেননা,  সমাজ উন্নয়নে গণমুখী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখার মতো নবীন শিল্পী-সাহিত্যিক ও সমাজমনস্ক রাষ্ট্রচিন্তকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যারা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। যারা বলে দিতে পারবে-আগামীতে এ হতে যাচ্ছে। যারা অনুধাবন করবেন, তাদের মতো বুদ্ধিজীবী মহল বা সুশীল সমাজের কালেক্টিভ অ্যাকশনের ভিত্তিতে এবং সকলের অভিমতই মূলতঃ সুশাসন ও জাতীর উন্নয়নের সহায়ক। আহমদ ছফা সবসময় স্বপ্ন যুবসমাজ নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন।
একই কারনে, তিনি দেশে সুশীল সেজে বসে থাকা সুবিধাবাদীদের মুখোশ উন্মোচন করেন ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এর বইয়ের প্রথমাংশে। আহমদ ছফা বলেছেন, -“বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন,  শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন,  শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না। আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন,  বিশ্বাসের কারণে নয়- প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন- সেও ঠেলায় পড়ে যারা সারা জীবন কোনোকিছুতে যদি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পেরেছেন- সে বস্তুটির নাম সুবিধাবাদ।”
আমরা মনে করি- সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে যাই বলি না কেন, - বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাঁদের চরিত্র বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ গ্রন্থ  দেশের বুদ্ধিজীবী এবং তাঁদের চরিত্রের বিশ্লেষণ নিয়ে নাগরিক সমাজের করণীয় কি- সেটি নির্ধারণ করবার অনিবার্য সুযোগ করে দিয়েছে।
আহমদ ছফা দেশ ও জাতি গঠনে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার উপর গুরুত্ব দেন। যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কতিপয় শিক্ষকের ভূমিকা এবং শিক্ষাঙ্গনে অরাজকতা সম্পর্কে আহমদ ছফার মূল্যায়ন ভিন্নরকম।
যেমন তিনি বলেন- “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল গুলোতেও বিলেত, আমেরিকা ফেরতাদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু তার নগদ ফল হয়েছে এই যে, বিলেত, আমেরিকা ফেরতাদের দৌরাত্ম্যে সমাজে টেকা একরকম দায় হয়ে আছে। এই বিলেত, আমেরিকা-ফেরত পন্ডিতের বিলেত, আমেরিকার কথা স্মরণ করে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলেন। স্বদেশের মাটির দিকে তাদের দৃষ্টি কদাচিৎ আকৃষ্ট হয়। সলিড কিছু করার বদলে বিলেতে বিদ্যের গুমর দেখাতেই তাঁরা অত্যন্ত আনন্দ পেয়ে থাকেন। বিলেতে যেয়ে আমাদের সাহিত্য এবং ইতিহাস নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেছেন এমন দু’তিনখানা বই নেড়েচেড়ে দেখবার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। দেখা শুনে ধারণা জন্মে গেছে যে ও-ধরণের বই ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরির ভিড়ের মধ্যে চা সিগ্রেট খেয়ে আড্ডা গুলতানি মেরে তিন কি সাড়ে তিন মাস সময়ের মধ্যে অনায়াসে লিখে দেয়া যায়।”   Ñনতুন বিন্যাস:৭৯।
আসলে, দেশের মাটি ও মানুষের কল্যাণকামিতা এবং তাঁদের প্রতি নিঃসঙ্কোচ ভালোবাসার বাইরে কোন কিছু চাওয়ার ছিলনা আহমদ ছফার। নিজের ক্ষতির ঝুঁকি জেনেও তিনি সত্যবোধের উপর অটল ছিলেন। সেই কারণেই এধরণের সাহসী লেখা তিনি লিখতে পেরেছেন।
যেসব সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী আপোষ করে  চলেন, নিজের মেরুদন্ডকে সোজা করে শক্তি-সাহস নিয়ে সমাজের অন্যায়-অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কথা বলতে দ্বিধান্বিত থাকেন (!), তাঁদের শক্তিমনস্কতার উন্নয়নের জন্য আহবান জানিয়েছেন।
চোখের সামনে রাষ্ট্র ও সমাজের অন্যায়-অনাচারবৃত্তি ও শিক্ষাহীন সমাজের দুষ্টুমোড়লদের অরাজকতা নিয়ে কথা বলে, নিজেদের দাসানুভাবকে দূরীকরণের পথ দেখিয়েছেন।
এপ্রসঙ্গে আহমদ ছফার বক্তব্য স্পষ্টÑ “আজ এই দাস্য মনোভাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তা নইলে আমাদের স্বাধীনতা মিথ্যা হয়ে যাবে। কিন্তু এই মানসিক দাসত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাজটা হৈ হৈ করে হওয়ার কথা নয়। এতে প্রয়োজন সুন্দরতম ধৈর্য, মহত্তম সাহস,  তীক্ষ্নতম মেধা এবং প্রচণ্ড কূলছাপানো ভালবাসা, যার স্পর্শে আমাদের জনগণের কুঁকড়ে যাওয়া মানসিক প্রত্যঙ্গে আশা-আকাঙ্খা জাগবে এবং সাহস ফণা মেলবে।”
সবকিছুর বিচার-বিশ্লেষণে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে বিশ্বে উন্নত দেশের শীর্ষতালিকায় পৌঁছানোর স্বপ্নে তাঁর আশাবোধ ব্যক্ত করা হয়।
পরিশেষে, উপরোল্লেখিত ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ গ্রন্থ’র শেষের ক’টি লাইন দিয়েই আজকের আলোচনার ইতি টানছি- “বাংলাদেশের নাড়ির স্পন্দনে আজ যা ধ্বনিত হচ্ছে, তার সুর আন্তর্জাতিক। তার নিজের যা আছে তাই নিয়ে বিশ্বের সামনে তাকে দাঁড়াতে হবে। তাতে পাকিস্তানি সমাজ বা বাংলার কৃষিনির্ভর সামন্ত সমাজের কোন স্থান যদি থাকে, থাকবে স্মৃতি হিসেবে, কখনো তা প্রধান ধারা নয়। তার প্রধান ধারাটি হবে আন্তর্দেশীয়,  বাংলাদেশের হয়েও হবে সর্ব মানুষের। এই ধারাটি এখন প্রমত্তা পদ্মার মত ফুলে ফুলে উঠার কথা এবং এই ধারাস্রোতে অবগাহিত হয়ে বাংলার এই অংশে জন্ম নেবে নতুনকালের রবীন্দ্রনাথ, নতুন কালের বিদ্যাসাগর, নতুন কালের জগদীশচন্দ্র বসু এবং নতুন কালের নজরুল ইসলাম ”
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
(কুইন্স লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত, সাহিত্য বিশ্লেষক নীরা কাদরী পরিচালিত’লেখকের অঙ্গন’-এ লেখাটি পঠিত,  এবং ২৮ জুলাই আহমদ ছফা’র মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে নিবেদিত )।
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078