স্নায়ুযুদ্ধের বিশেষ সন্ধিক্ষণে শি জিন পিংয়ের দেশ চীন সফর করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যান ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়ায়। সফরে মোদি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারসহ শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বৈঠক করেন পুতিনের সঙ্গে। দুজনে একান্তে কিছুক্ষণ আলোচনাও হয়। সফরে যাওয়ার আগেই বিবৃতিতে মোদি বলেছেন, পুতিনের সঙ্গে তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব দিক পর্যালোচনা করতে চান। তারা শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় যৌথ ভূমিকা রাখবেন বলে পাকা কথা হয়েছে। মোদি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফরে গেলেন রাশিয়ায়। এমনকি ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরু হওয়ার পর এটি মোদির প্রথম মস্কো সফর। অন্যদিকে টানা চতুর্থ দফায় ক্ষমতায় বসে দিল্লিতে এক মাসে দুবার সফরের পর চীন গেলেন শেখ হাসিনা। তার সফরকে কূটনৈতিকভাবে দ্বিপক্ষীয় সফর বলা হলেও কার্যত এটি ত্রিপক্ষীয় সফর। ভারতের কনসার্ন নিয়ে রাশিয়া সফরে যাওয়ার কথা বেরিয়ে গেছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ দিয়ে। সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এবং প্রধানমন্ত্রী লিকোসিয়ানের সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পার্শ্ব বৈঠক হয়েছে। শেখ হাসিনার চীন এবং মোদির রাশিয়া সফরে ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব’ থেকে ‘কৌশলগত বিস্তৃত সহযোগিতার অংশীদারত্বে’ উন্নীত করার মন্ত্রে ভরা। মস্কো ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার পর থেকে তার দীর্ঘদিনের মিত্রদের মধ্যে সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে। রাশিয়াকে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের কাছাকাছি ঠেলে দিয়েছে। মোদি শেষবার ২০১৯ সালে রাশিয়ায় ভ্লাদিভোস্টকে এ ধরনের বৈঠক করেছিলেন পুতিনের সঙ্গে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে উজবেকিস্তানে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন ব্লকের শীর্ষ সম্মেলনেও তারা একান্ত হয়েছিলেন।
রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের দৃঢ়তা ১৯৪৮ সালে গত স্নায়ুযুদ্ধ শুরু থেকেই। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে ক্রেমলিন ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর পর থেকে মস্কোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে ভারতের গুরুত্ব আরও বাড়তে থাকে। চীন ও ভারত হয়ে ওঠে রাশিয়ার তেলের প্রধান ক্রেতা। মোদির কূটনীতিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের নিন্দা এড়িয়ে গেছে ভারত। মোদির সফর নিয়ে রাশিয়ার জারি করা বিশেষ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পশ্চিমের দেশগুলো তার সফরকে ‘ঈর্ষার চোখে’ দেখছে। অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টির গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ঘোষণার পরের বছরগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে ওঠে। মস্কো হাজার হাজার সোভিয়েত প্রকৌশলী ও কর্মী পাঠায় চীনে। ট্রেন ভর্তি করে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম পাঠাতে থাকে রাশিয়া। ১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনজুড়ে আধুনিক শিল্প-কারখানার একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে ফেলে, যা যুদ্ধবিমান, ট্যাংক এবং যুদ্ধজাহাজ তৈরি করতে সক্ষমতা এনে দেয়। মস্কো এমনকি কিছু পারমাণবিক প্রযুক্তিও প্রদান করে। একসময় এ সম্পর্কে কিছুটা ফাটল ধরে। লেনিন ও স্টালিন আদর্শের দ্বন্দ্বে ১৯৫০-এর দশকের শেষ এবং ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে দেশ দুটির সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। তা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৬৯ সালে চীন-সোভিয়েত সীমান্ত লড়াইয়ে। তা আবার সময়ে সময়ে উভয়ের প্রয়োজনে উতরে যায়।
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের মাঝেও এমন হেরফের হয়েছে সময়ে সময়ে। ১৯৭১ সালে হেনরি কিসিঞ্জারের পরামর্শে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে, যার চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চাঞ্চল্যকর চীন সফরের মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয় এবং ইউনিয়ন ভেঙে অনেকগুলো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আর ক্রমেই একক বিশে^র নেতা হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন স্নায়ুযুদ্ধে চীন-মার্কিন আবার প্রতিপক্ষ। সেটাও অর্থনৈতিক কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে টেকনোলজি নিয়ে নিজের মতো করে নিজেকে গড়ে তোলে এবং ২০১৭ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি চলে আসে চীন। বাংলাদেশ উভয়ের কাছে ভূ-রাজনৈতিক কারণে দামি। যারপরনাই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী ভারতের কাছেও। চার চোখের এই চাহনিতে বাংলাদেশের সুবিধা-অসুবিধা দুটোই হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতিকূটনীতিতে সবাইকে আয়ত্ত করছেন। পারলে মাঝেমধ্যে টেক্কাও দেন।
ক্ষমতা ধরে রাখার প্রশ্নে ভারত, চীন, রাশিয়ার শতভাগ সমর্থন-সহযোগিতা নিশ্চিত করেছেন তিনি। কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্বেও স্লোগানে যুক্তরাষ্ট্রকেও বশ করার দৃষ্টান্ত পর্যন্ত দেখিয়েছেন তিনি। চারটি সুপার পাওয়ারের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এখন তিনটিরই কমন শত্রু। তাদের কমন ইন্টারেস্ট শেখ হাসিনার প্রাপ্তি দীর্ঘ করে দিচ্ছে। তিস্তা, রোহিঙ্গা, মিয়ানমার ইত্যাদি ইস্যুতে মাঝেমধ্যে গোলমাল দেখা দিলেও শেষতক তিনি তা সামলে ফেলছেন। বার্মা অ্যাক্টের পর সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রিজলভ তিব্বত অ্যাক্ট বেশ আলোচিত। এটিকে বলা হচ্ছে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আগামী দিনের মাস্টারপ্ল্যান। তিব্বত নিয়ে কেবল চীন নয়, দুশ্চিন্তায় ভারতও। তিব্বত ও তাইওয়ান চীনের খুব সেনসেটিভ বিষয়। এ বিষয়টিও শেখ হাসিনার জন্য আশীর্বাদের। তিস্তা নিয়ে ভারত ও চীনের টানাটানির মাঝে চীন সফরে গিয়েও ভিন্ন উচ্চতায় আলোচিত তিনি। ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এবং প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে আলাদা আলোচনায় একান্ত কথাবার্তা ও কয়েকটি সমঝোতার তার প্রাপ্তির ফর্দ বেড়েছে। এদিকে তীক্ষè দৃষ্টি পশ্চিমা বলয়ের দেশগুলোর। এশিয়ার রাজনীতির মাঠের বড় দুই খেলোয়াড় ভারত ও চীনকে পেলে পশ্চিমাদের লাল চাহনিতে তেমন কিছু আসবে-যাবে বলে মনে করছেন না শেখ হাসিনা। তার সরকারের যাবতীয় পদক্ষেপ ও এগিয়ে চলা সেই সমীকরণেই।