আমি তখন পরিবারের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ শহরে বাস করি। দিনটি ২৫ মার্চ ১৯৭১। স্কুল-কলেজ বন্ধ। আশপাশে সবকিছু কেমন যেন নিষ্প্রভ। সকাল থেকেই শোনা যাচ্ছিল পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংক নিয়ে ঢাকার রাস্তায় বিচরণ করছে। খুব শিগগিরই গুলি ছুড়ে হত্যাকাণ্ড শুরু করে দেবে। আমাদের বাসার জানালা থেকে বড় রাস্তা দেখা যায়। জানালায় উঁকি দিয়ে দেখলাম, রাস্তায় গাড়ি, রিকশা, লোকজন আছে, তবে আগের তুলনায় খুবই কম।
বাইরে থেকে প্রতিবেশী যারা ঘরে ফিরে এল, তারা বলে গেল, ঢাকা আর নারায়ণগঞ্জের রাস্তার মাঝে বড় বড় গাছ ফেলে রাখা হয়েছে, যাতে পাকিস্তানি সেনারা সহজে নারায়ণগঞ্জে ঢুকতে না পারে। দুশ্চিন্তায় সময় কাটছে সবার। আমাদের ও প্রতিবেশীদের সম্মুখ বিপদ থেকে পালানোর কোনো প্রস্তুতি নেই। কীভাবে গোলাবারুদের মাঝে বেঁচে থাকব, কারও তা জানা নেই।
রাত তখন প্রায় ১০টা। আমাদের সবার রাতের খাবারের পর্ব শেষ। ঘুমুতে যাওয়ার আগে রাস্তায় কী হচ্ছে দেখার জন্য আমি জানালার বাইরে তাকালাম। সেখানে দেখি গাড়ি নেই। দু-একটা যাত্রীবিহীন রিকশা ক্রিং ক্রিং বেল টিপে চলে যাচ্ছে। রাস্তার একটা মোড়ে কিছু লোক দাঁড়িয়ে কথা বলছে, হয়তো-বা সম্মুখ বিপদেরই আলোচনা। হঠাৎ দেখলাম আড্ডায় জমে থাকা লোকগুলো চিৎকার করে দৌড়ে এদিক-সেদিক পালিয়ে গেল, যেন সামনে বাঘ এসেছে গ্রাস করতে! প্রায় নীরব রাস্তা থেকে ওদের গলার স্বর আমার কানে এল, ‘মিলিটারি এসে গেছে।’ জানালা বন্ধ করে পরিবারের সঙ্গে একত্রিত হলাম।
রাত তখন প্রায় ১১টা। নিঝুম রাস্তাঘাট। কোনো মানুষ বা যানবাহনের সাড়াশব্দ নেই। তাহলে কিছুক্ষণ আগে এখানে মিলিটারি ঢোকার সংকেত কি ভুল ছিল? মিলিটারি তাহলে নারায়ণগঞ্জে অর্থাৎ যেখানে আমরা আছি, সেখানে আসেনি? কী যে শান্তি! কিন্তু মাঝে মাঝেই গুমগুম ভারী শব্দ সবার কানে আসছিল। মনে হচ্ছিল অনতি দূরে রাজধানী ঢাকায়, মিলিটারিদের অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই করা চলন্ত ট্রাকের ভারে রাস্তা কেঁপে উঠছে এবং সঙ্গে কামান দাগানোর শব্দ হচ্ছে। নরহত্যার এক তাণ্ডবলীলা হয়তো-বা চলছে সেখানে। আতঙ্কে সবার বুকই ধড়ফড় করছে!
কিছুক্ষণ পরই আমাদের বাড়িওয়ালা এলেন আমার বাবার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার জন্য। রাত যতই গভীর হতে থাকল, ভারী শব্দের আওয়াজ যেন আরও ভারী হয়ে কানে বাজল। রাত তখন প্রায় দুটো, বাড়িওয়ালা আমাদের ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। আধো ঘুমে আর আধো জাগরণে বাকি রাতটুকু আমার কেটে গেল।
২৬ মার্চ ১৯৭১
সকালে ঘুম থেকে জেগেই দেখতে পাচ্ছিলাম, আমাদের প্রতিবেশীরা বাক্স-পেটরা গুছিয়ে ওদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছে। কারণ, মিলিটারি নারায়ণগঞ্জের দিকে এগোচ্ছে। গ্রামের রাস্তাঘাটে গাড়ি চালানো অসম্ভব, সেখানে যাওয়া পাকিস্তানি মিলিটারিদের পক্ষে সহজ হবে না। তাই গ্রামই তখন নিরাপদ আশ্রয়।
আমাদের পরিবারের তো গ্রামে বাড়ি নেই। বেশ কয়েক বছর আগে গ্রামে আমাদের একটি বাড়ি ছিল। বর্তমান বাসস্থান থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা রাস্তা পেরিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী। নৌকায় সেই নদী অতিক্রম করে তিন মাইল রাস্তা হেঁটে গেলেই একটি গ্রাম। নাম তার লম্বা দরদী। তীর্থস্থান লাঙ্গলবন্দের খুব কাছাকাছি। সে গ্রামেই আমার ঠাকুমা, দাদু ও কাকা তার পরিবার নিয়ে বাস করতেন। ১৯৬৪ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় সেটাকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সব আত্মীয়স্বজন নিজেদের ভিটেমাটি ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তখন।
আমাদের কক্ষের উল্টো দিকে বাড়িওয়ালার কক্ষ। ওদের ঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম অনেক লোকের ভিড়। কাছে গিয়ে প্রত্যক্ষ করলাম, কিছু লোক আমাদের পাড়া-পড়শি আর বাকিরা বাড়িওয়ালার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। ওরা বাড়িওয়ালাদের গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিতে যাচ্ছে কিছুদিনের জন্য।
আমার বাবাকে পড়শিদের গ্রামে পালিয়ে যাওয়ার খবর জানাতেই তিনি বললেন, আমরা বাড়ি থেকে পূর্ব দিকে ১০ মিনিট হেঁটে শীতলক্ষ্যা নদীর দিকে যাব। সেখান থেকে নৌকায় নদী পার হয়ে ওপারে ‘বন্দর’ নামক স্থানটিতে যে স্কুল রয়েছে, সেখানে রাতে আশ্রয় নেব। মিলিটারি যখন আগামীকাল নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে চলে যাবে, তখন আমরা ফিরে আসব।’
স্কুলঘরে রাতে থাকা আমার কাছে মোটেও নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। মিলিটারির হাতে ধরা না পড়লেও ওখানকার স্থানীয় দুষ্কৃতকারীদের উৎপাতের শঙ্কা অবধারিত। তাই বাবাকে বললাম, আমরা যদি আমাদের বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে গ্রামে চলে যাই, তাহলে কেমন হয়, বাবা? স্কুল আমার কাছে নিরাপদ মনে হচ্ছে না।
কারও কাছ থেকে নিজের জন্য কিছু চাওয়া আমার বাবার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু তার কাছে সব সময়ই আমার কথার গুরুত্ব ছিল। তাই তিনি কিছুটা আমতা আমতা করে বললেন, ঠিক আছে, ওদেরকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখ। তবে আমি তোদেরকে রেখে আজই ফিরে আসব।
আমি খুশি হয়ে তৎক্ষণাৎ বাড়িওয়ালার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা আপনাদের সঙ্গে আপনাদের গ্রামের বাড়ি যেতে পারব? ভদ্রমহিলা কিছু না ভেবে এককথায় বলে ফেললেন, হ্যাঁ আয়।
তখনকার মতো মনে শান্তি পেলাম। বাবাকেও আমাদের সঙ্গে সেদিন গ্রামে থেকে যাওয়ার জন্য রাজি করিয়ে ফেললাম। একটু পরেই রেডিওতে এক বাঙালি মেজর জেনারেলের গলা শুনতে পেলাম, বাঙালির নেতা শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আমরা সবাই বুঝে গেলাম, সামনে দীর্ঘদিনের যুদ্ধ!
আমাদের বাড়িওয়ালার পরিবার ও তাদের আত্মীয় এবং আমাদের প্রতিবেশীসহ আমরা সবাই কিছু পরিধেয় বস্ত্র থলিতে ভরে একই রাস্তায় হেঁটে রওনা দিয়েছি গ্রামের পথে। রাস্তায় অজস্র মানুষের পদযাত্রা। সবার গন্তব্য একÑগ্রামে পদার্পণ, তবে ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে। আমরা যে গ্রামটিতে যাচ্ছিলাম, তার নাম ছিল গোপালনগর। মুন্সিগঞ্জ শহরের কাছাকাছি এবং নারায়ণগঞ্জ, যেখানে আমরা থাকছিলাম সেখান থেকে প্রায় পাঁচ মাইল। প্রায় তিন মাইল দক্ষিণ দিকে হেঁটে একটি নদীর তীরে পৌঁছালাম। নদীর নাম ‘বুড়িগঙ্গা’। সারি বেঁধে মাঝিসহ নৌকা দাঁড়িয়ে। বিনা পারিশ্রমিকে যাত্রীদের এপার থেকে ওপার নিয়ে যাচ্ছে। নদী পার হয়ে দুই মাইল হেঁটে গেলেই গোপালনগর গ্রাম। সেখানেই বাড়িওয়ালির জ্যাঠা-জ্যাঠাইমার (দুজন বুড়ো-বুড়ি) বাড়ি।
আমাদের গন্তব্যস্থল, গ্রামের বাড়িটিতে যখন পৌঁছালাম, তখন শেষ বিকেল। সূর্য প্রায় অস্তাচলের পথে। অনেক বড় বাড়ি। প্রথমেই চোখে পড়ে একটি খোলা জায়গা, যেখানে রয়েছে বড় বড় গাছ। কোনো কোনো গাছে আম-কাঁঠাল ধরে আছে। এই খোলা জায়গাকেই বলা হতো বাগান। কিছু ফুলের গাছও ছিল সেই বাগানে। বাগান থেকে রাস্তায় চলমান লোকজন দৃশ্যত হলেও রাস্তা থেকে বাগানের পেছনে বাড়ির অবস্থান আঁচ করা দুষ্কর ছিল। বাগানের পেছনে লতাপাতায় আবৃত একটি গেট। সেটি পার হলেই বড় উঠোন, এটির উত্তর দিকে কয়েকটি ঘর। তিনটি ঘর ছিল ইট দিয়ে খুব সুন্দরভাবে তৈরি। এই বাড়ির মালিক আর মালকিন, অর্থাৎ আমাদের শহরের বাড়ির যিনি বাড়িওয়ালি তার জ্যাঠা-জ্যাঠাইমার বাসস্থান। আর বাকি চারখানা ঘর অনেকটা নিম্নমানের। সেগুলো ছিল ভাড়াটেদের আবাসন। পশ্চিম দিকে একটি দোতলা বাড়ি। ইটের তৈরি। এই বাড়িটির নিচতলায়, প্রথম ঢুকে যে ঘরটি, সেখানেই অন্যদের সঙ্গে আমাদের ঠাঁই হলো। এই নিচতলার আর বাকি দুটো ঘর অন্য ভাড়াটিয়ার, সেখানেও কিছু লোকের থাকার ব্যবস্থা হলো। উপরের ঘরটিতে একজন ভাড়াটে আগে থেকেই ছিল। আমাদেরকে নিয়ে সব মিলিয়ে সে বাড়িতে তখন প্রায় ৫০ জন লোক। রাত প্রায় আটটা, সব আগন্তুক মায়েরা হাতে হাত লাগিয়ে ডাল, ভাত ও মাছের ঝোল রান্না করে ফেললেন। রাতের খাবার শেষে এক অজানা আশঙ্কা নিয়ে, মাটিতে বিছানো চাদরে সবাই গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন ২৭ মার্চ সকালে বাড়ির উঠোনে প্রতিবেশীদের সমাগম। ওদের মধ্যে কয়েকজন বুড়িগঙ্গার এ-পারে অবস্থিত ‘কমলাঘাট’ বন্দর থেকে পাওয়া খবর নিয়ে আলোচনা করছিল। ওরা জানতে পেরেছিল, আগের রাতে নারায়ণগঞ্জে পাকিস্তানি মিলিটারির আক্রমণে কিছু নেতাসহ প্রায় কুড়ি জন নিহত হয়েছে। গত দুই দিন রাজধানী ঢাকায় হত্যাকাণ্ডে হিন্দু ছাত্রাবাসের কিছু সুপারভাইজারসহ বহু ছাত্রকে অত্যাচার করে খুন করা হয়েছে। অনেক লোককে বাড়ি থেকে তুলে অন্য স্থানে নিয়ে মারা হয়েছে। অনেক মহিলা ও তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলছে। সবচাইতে মর্মান্তিক খবর ছিল, আমাদের বাড়ি থেকে ১০ মিনিট দূরত্বে অবস্থিত শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে, স্কুলঘরে সে রাতে যারা আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের প্রত্যেককে মিলিটারিরা গুলি করে হত্যা করেছে। সেখানে আমাদের পূর্বপরিচিত কয়েকজনও ছিল। কী ভয়ানক খবর! সেখানেই তো আমাদের আশ্রয় নেওয়ার কথা ছিল সেই কালরাত্রিতে। বিধাতার আশীর্বাদে আমরা বেঁচে গেছি!
তারপর নয় মাস সেই গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। নানা রকমের উদ্বেগ, ভয় আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় জীবন নিরর্থক মনে হয়েছিল। সেই ভয়ংকর অনেকগুলো অধ্যায়ের একটি আজ এখানে বর্ণনা করছি :
খুব সম্ভবত ১৯৭১ সালের জুলাই মাস। রাতে গুলির আওয়াজ শোনা যায়। কেউ বলে মুক্তিবাহিনী গুলি ছুড়ে মিলিটারি মারছে, আবার কেউ বলে মিলিটারি মানুষ মারছে। কিন্তু দিনের বেলায় গ্রামে মিলিটারির কোনো উপদ্রবের কথা শোনা যায় না। একদিন দুপুরের দিকে মনে কেমন একটা আনন্দ হলো, নির্ভয়ের আনন্দ। বেঁচে আছি, তার আনন্দ। আমাদের শহরের বাড়িওয়ালির মেয়ের (আমার চাইতে বছর দুই ছোট) সঙ্গে গল্প করছিলাম। সহজ, সরল, ভালো মেয়ে। বহুদিন পর গল্পের মাঝে আমাদের মুখে হাসিও ছিল। হঠাৎ মেয়েটি একটি নতুন শাড়ি আমার সামনে ধরে আবদার করে বসল, ‘আমার এই কমলা রঙের শাড়িটি পরুন দিদি, খুব ভালো দেখাবে।’
এত গল্পে মজে ছিলাম, ওকে না বলতে মন চাইল না। শাড়িটি পরে ফেললাম। মুহূর্তের মধ্যে কে একজন দৌড়ে ঘরে ঢুকে বলল, মিলিটারি আসছে। সব আনন্দ কোথায় উবে গেল। ভয়ে শরীর নিথর হয়ে গেল।
আগেরবার যখন মিলিটারির কথা শুনেছিলাম, তখন কোথাও পালানোর পথ খুঁজে পাইনি। কিন্তু এবার সবার কাছে একটা পালানোর রাস্তা জানা। সেটা হচ্ছে বাড়ির পেছনের দিকে যে পুকুর, তা পেরিয়ে অপর পারে চলে যাওয়া। আমার বাবা, আমার ছোট ভাই রতন, বাড়িওয়ালা, তার মেয়ে আর আমি পালিয়ে যাওয়ার রাস্তার দিকে ছুটলাম। তখন মিলিটারিদের চোখ ছিল পুরুষ আর কম বয়সী মেয়েদের দিকে। তাই অন্যরা ঘরেই রয়ে গেল। আমার মা, আমার চাইতে ছয় বছরের ছোট বোন সাধনা এবং ১০ বছরের ছোট বোন কনিকাও রয়ে গেল বাড়িতেই। আমার দুই ভাই হিমাংশু ও শিশির ছিল কমলাঘাটে, নতুন ব্যবসা সামলাতে।
যে পুকুরপাড় হয়ে ওপারে যাওয়া যায়, সেটা বহু বছরের জমে থাকা কচুরিপানায় পূর্ণ। সামনের দিকে অল্প একটু পরিষ্কার জল, সেখানে এই বাড়ির বাসিন্দারা বাসন পরিষ্কার করে। আমি দেখতে পেলাম, জল-কাদা আর কচুরিপানায় কোমর ডুবিয়ে সবাই ওপারে যেতে চেষ্টা করছে। জল-কাদা সব সময় এড়িয়ে চলেছি, কীভাবে এ পথ পার হব, বুঝতে পারছিলাম না। চলতে গিয়ে দেখলাম, পা তুলে কাদা-জল-কচুরিপানায় হাঁটা খুব মুশকিল। শাড়ি পরে আছি, তাই এগোনো আরও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সামনের দিকে চেয়ে দেখলাম, প্রায় সবাই পুকুরের ওপারে চলে গিয়েছে। কচুরিপানার ভেতর শরীর আটকে যাচ্ছিল। মনে ভয় হচ্ছিল, এই বুঝি পেছন থেকে মিলিটারির গুলি এসে শরীর ভেদ করবে। ভেবেছিলাম, জলে ডুব দিয়ে বাঁচা যাবে কি না। কিন্তু ভারি জল। এগোনোই মুশকিল, ডুব দেওয়া তো দূরে থাক। ফেলে আসা জীবনে, সমস্যা এলে আপনজনদের বাড়িয়ে দেওয়া হাত পেয়েছি। এখানে তো কেউ নেই এই পচা কচুরিপানায় পূর্ণ, কর্দমাক্ত পুষ্করিণী পার করে দেওয়ার জন্য। অনেক কসরত করে শরীর টেনে টেনে কোনোভাবে ওপাড়ে উঠে গেলাম। ময়লা-কাদা-কচুরিপানায় ভর্তি দেহ তখন চুলকাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, আমার পরনে, কমলা রঙের শাড়িটির ধূসর বরণে রূপান্তর দেখে মনে খুব পীড়া দিচ্ছিল, শাড়ির অধিকারিণী সেই আবেগপ্রবণ বন্ধুটির কথা ভেবে।
ওপারে গিয়ে চোখে পড়ল একটি ছোট্ট কুটির। সে কুটিরে উঁকি দিতেই এক থুত্থুড়ে বুড়িকে দেখতে পেলাম, মনে হলো আশির উপর বয়স। অনেক অনুনয়-বিনয় করে সে ঘরে আশ্রয় চাইলাম। বুড়ি শুধু মেয়েদের ঠাঁই দেবে বলল, পুরুষদের নয়। আমার ছোট ভাই রতন চলে গেল আরও অনেক দূরের পথে। বাবা ঘরের বাইরে থেকে গেলেন, বললেন, ‘আমি পাহারায় থাকলাম। কোনো সংকেত পেলে জানাব, তাতে করে সবাই এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারব।’ মুশকিল হলো আমাদের বাড়িওয়ালাকে নিয়ে। কুটিরের বুড়ি মালকিন, আমাদের প্রাক্তন বাড়িওয়ালার দিকে কটমট করে তাকিয়ে খিচমিচ করে বলল, ‘তুমি এখানে থাকতে পারবা না।’ ভদ্রলোক খুবই ভিতু স্বভাবের। কিন্তু এই বুড়িকে কীভাবে শান্ত করতে হবে তৎক্ষণাৎ সে বুদ্ধি তার মাথায় এসেছিল এবং পকেট থেকে কয়েকটি টাকা বের করে বুড়ির হাতে গুঁজে দিলেন। বুড়ি দন্তহীন মুখে আনন্দের হাসি হেসে বাড়িওয়ালাকে একটি বসার স্থান দেখিয়ে দিল। প্রায় ১০ মিনিট কেটে গেল সেখানে। আমরা একটা গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। কোথায় গুলি হলো আমাদের পার্শ্ববর্তী পালবাড়ি নাকি আমাদের বাড়ি? নিজেদের জন্য এবং ফেলে আসা পরিবারের জন্য আমরা তখন দুশ্চিন্তায় অস্থির। আরও ১৫ মিনিট কেটে গেল এভাবে। ওপার থেকে আমাদের নতুন বাড়িওয়ালির গলা শুনতে পেলাম, ‘মিলিটারি চলে গেছে। সবাই ফিরে আসো।’ বাড়ি ফিরে এলাম অন্য পথ ধরে। আমাদের পার্শ্ববর্তী পালবাড়ির একজন বাসিন্দাকে মারা হয়েছিল, সেই গুলির আওয়াজই শুনেছিলাম ওপারের কুটির থেকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের আরও কত রকমের ভয়ংকর ঘটনার ভুক্তভোগী এবং সাক্ষী হয়ে এখনো বেঁচে আছি!
বাইরে থেকে প্রতিবেশী যারা ঘরে ফিরে এল, তারা বলে গেল, ঢাকা আর নারায়ণগঞ্জের রাস্তার মাঝে বড় বড় গাছ ফেলে রাখা হয়েছে, যাতে পাকিস্তানি সেনারা সহজে নারায়ণগঞ্জে ঢুকতে না পারে। দুশ্চিন্তায় সময় কাটছে সবার। আমাদের ও প্রতিবেশীদের সম্মুখ বিপদ থেকে পালানোর কোনো প্রস্তুতি নেই। কীভাবে গোলাবারুদের মাঝে বেঁচে থাকব, কারও তা জানা নেই।
রাত তখন প্রায় ১০টা। আমাদের সবার রাতের খাবারের পর্ব শেষ। ঘুমুতে যাওয়ার আগে রাস্তায় কী হচ্ছে দেখার জন্য আমি জানালার বাইরে তাকালাম। সেখানে দেখি গাড়ি নেই। দু-একটা যাত্রীবিহীন রিকশা ক্রিং ক্রিং বেল টিপে চলে যাচ্ছে। রাস্তার একটা মোড়ে কিছু লোক দাঁড়িয়ে কথা বলছে, হয়তো-বা সম্মুখ বিপদেরই আলোচনা। হঠাৎ দেখলাম আড্ডায় জমে থাকা লোকগুলো চিৎকার করে দৌড়ে এদিক-সেদিক পালিয়ে গেল, যেন সামনে বাঘ এসেছে গ্রাস করতে! প্রায় নীরব রাস্তা থেকে ওদের গলার স্বর আমার কানে এল, ‘মিলিটারি এসে গেছে।’ জানালা বন্ধ করে পরিবারের সঙ্গে একত্রিত হলাম।
রাত তখন প্রায় ১১টা। নিঝুম রাস্তাঘাট। কোনো মানুষ বা যানবাহনের সাড়াশব্দ নেই। তাহলে কিছুক্ষণ আগে এখানে মিলিটারি ঢোকার সংকেত কি ভুল ছিল? মিলিটারি তাহলে নারায়ণগঞ্জে অর্থাৎ যেখানে আমরা আছি, সেখানে আসেনি? কী যে শান্তি! কিন্তু মাঝে মাঝেই গুমগুম ভারী শব্দ সবার কানে আসছিল। মনে হচ্ছিল অনতি দূরে রাজধানী ঢাকায়, মিলিটারিদের অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই করা চলন্ত ট্রাকের ভারে রাস্তা কেঁপে উঠছে এবং সঙ্গে কামান দাগানোর শব্দ হচ্ছে। নরহত্যার এক তাণ্ডবলীলা হয়তো-বা চলছে সেখানে। আতঙ্কে সবার বুকই ধড়ফড় করছে!
কিছুক্ষণ পরই আমাদের বাড়িওয়ালা এলেন আমার বাবার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার জন্য। রাত যতই গভীর হতে থাকল, ভারী শব্দের আওয়াজ যেন আরও ভারী হয়ে কানে বাজল। রাত তখন প্রায় দুটো, বাড়িওয়ালা আমাদের ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। আধো ঘুমে আর আধো জাগরণে বাকি রাতটুকু আমার কেটে গেল।
২৬ মার্চ ১৯৭১
সকালে ঘুম থেকে জেগেই দেখতে পাচ্ছিলাম, আমাদের প্রতিবেশীরা বাক্স-পেটরা গুছিয়ে ওদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছে। কারণ, মিলিটারি নারায়ণগঞ্জের দিকে এগোচ্ছে। গ্রামের রাস্তাঘাটে গাড়ি চালানো অসম্ভব, সেখানে যাওয়া পাকিস্তানি মিলিটারিদের পক্ষে সহজ হবে না। তাই গ্রামই তখন নিরাপদ আশ্রয়।
আমাদের পরিবারের তো গ্রামে বাড়ি নেই। বেশ কয়েক বছর আগে গ্রামে আমাদের একটি বাড়ি ছিল। বর্তমান বাসস্থান থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা রাস্তা পেরিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী। নৌকায় সেই নদী অতিক্রম করে তিন মাইল রাস্তা হেঁটে গেলেই একটি গ্রাম। নাম তার লম্বা দরদী। তীর্থস্থান লাঙ্গলবন্দের খুব কাছাকাছি। সে গ্রামেই আমার ঠাকুমা, দাদু ও কাকা তার পরিবার নিয়ে বাস করতেন। ১৯৬৪ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় সেটাকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সব আত্মীয়স্বজন নিজেদের ভিটেমাটি ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তখন।
আমাদের কক্ষের উল্টো দিকে বাড়িওয়ালার কক্ষ। ওদের ঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম অনেক লোকের ভিড়। কাছে গিয়ে প্রত্যক্ষ করলাম, কিছু লোক আমাদের পাড়া-পড়শি আর বাকিরা বাড়িওয়ালার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। ওরা বাড়িওয়ালাদের গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিতে যাচ্ছে কিছুদিনের জন্য।
আমার বাবাকে পড়শিদের গ্রামে পালিয়ে যাওয়ার খবর জানাতেই তিনি বললেন, আমরা বাড়ি থেকে পূর্ব দিকে ১০ মিনিট হেঁটে শীতলক্ষ্যা নদীর দিকে যাব। সেখান থেকে নৌকায় নদী পার হয়ে ওপারে ‘বন্দর’ নামক স্থানটিতে যে স্কুল রয়েছে, সেখানে রাতে আশ্রয় নেব। মিলিটারি যখন আগামীকাল নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে চলে যাবে, তখন আমরা ফিরে আসব।’
স্কুলঘরে রাতে থাকা আমার কাছে মোটেও নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। মিলিটারির হাতে ধরা না পড়লেও ওখানকার স্থানীয় দুষ্কৃতকারীদের উৎপাতের শঙ্কা অবধারিত। তাই বাবাকে বললাম, আমরা যদি আমাদের বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে গ্রামে চলে যাই, তাহলে কেমন হয়, বাবা? স্কুল আমার কাছে নিরাপদ মনে হচ্ছে না।
কারও কাছ থেকে নিজের জন্য কিছু চাওয়া আমার বাবার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু তার কাছে সব সময়ই আমার কথার গুরুত্ব ছিল। তাই তিনি কিছুটা আমতা আমতা করে বললেন, ঠিক আছে, ওদেরকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখ। তবে আমি তোদেরকে রেখে আজই ফিরে আসব।
আমি খুশি হয়ে তৎক্ষণাৎ বাড়িওয়ালার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা আপনাদের সঙ্গে আপনাদের গ্রামের বাড়ি যেতে পারব? ভদ্রমহিলা কিছু না ভেবে এককথায় বলে ফেললেন, হ্যাঁ আয়।
তখনকার মতো মনে শান্তি পেলাম। বাবাকেও আমাদের সঙ্গে সেদিন গ্রামে থেকে যাওয়ার জন্য রাজি করিয়ে ফেললাম। একটু পরেই রেডিওতে এক বাঙালি মেজর জেনারেলের গলা শুনতে পেলাম, বাঙালির নেতা শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আমরা সবাই বুঝে গেলাম, সামনে দীর্ঘদিনের যুদ্ধ!
আমাদের বাড়িওয়ালার পরিবার ও তাদের আত্মীয় এবং আমাদের প্রতিবেশীসহ আমরা সবাই কিছু পরিধেয় বস্ত্র থলিতে ভরে একই রাস্তায় হেঁটে রওনা দিয়েছি গ্রামের পথে। রাস্তায় অজস্র মানুষের পদযাত্রা। সবার গন্তব্য একÑগ্রামে পদার্পণ, তবে ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে। আমরা যে গ্রামটিতে যাচ্ছিলাম, তার নাম ছিল গোপালনগর। মুন্সিগঞ্জ শহরের কাছাকাছি এবং নারায়ণগঞ্জ, যেখানে আমরা থাকছিলাম সেখান থেকে প্রায় পাঁচ মাইল। প্রায় তিন মাইল দক্ষিণ দিকে হেঁটে একটি নদীর তীরে পৌঁছালাম। নদীর নাম ‘বুড়িগঙ্গা’। সারি বেঁধে মাঝিসহ নৌকা দাঁড়িয়ে। বিনা পারিশ্রমিকে যাত্রীদের এপার থেকে ওপার নিয়ে যাচ্ছে। নদী পার হয়ে দুই মাইল হেঁটে গেলেই গোপালনগর গ্রাম। সেখানেই বাড়িওয়ালির জ্যাঠা-জ্যাঠাইমার (দুজন বুড়ো-বুড়ি) বাড়ি।
আমাদের গন্তব্যস্থল, গ্রামের বাড়িটিতে যখন পৌঁছালাম, তখন শেষ বিকেল। সূর্য প্রায় অস্তাচলের পথে। অনেক বড় বাড়ি। প্রথমেই চোখে পড়ে একটি খোলা জায়গা, যেখানে রয়েছে বড় বড় গাছ। কোনো কোনো গাছে আম-কাঁঠাল ধরে আছে। এই খোলা জায়গাকেই বলা হতো বাগান। কিছু ফুলের গাছও ছিল সেই বাগানে। বাগান থেকে রাস্তায় চলমান লোকজন দৃশ্যত হলেও রাস্তা থেকে বাগানের পেছনে বাড়ির অবস্থান আঁচ করা দুষ্কর ছিল। বাগানের পেছনে লতাপাতায় আবৃত একটি গেট। সেটি পার হলেই বড় উঠোন, এটির উত্তর দিকে কয়েকটি ঘর। তিনটি ঘর ছিল ইট দিয়ে খুব সুন্দরভাবে তৈরি। এই বাড়ির মালিক আর মালকিন, অর্থাৎ আমাদের শহরের বাড়ির যিনি বাড়িওয়ালি তার জ্যাঠা-জ্যাঠাইমার বাসস্থান। আর বাকি চারখানা ঘর অনেকটা নিম্নমানের। সেগুলো ছিল ভাড়াটেদের আবাসন। পশ্চিম দিকে একটি দোতলা বাড়ি। ইটের তৈরি। এই বাড়িটির নিচতলায়, প্রথম ঢুকে যে ঘরটি, সেখানেই অন্যদের সঙ্গে আমাদের ঠাঁই হলো। এই নিচতলার আর বাকি দুটো ঘর অন্য ভাড়াটিয়ার, সেখানেও কিছু লোকের থাকার ব্যবস্থা হলো। উপরের ঘরটিতে একজন ভাড়াটে আগে থেকেই ছিল। আমাদেরকে নিয়ে সব মিলিয়ে সে বাড়িতে তখন প্রায় ৫০ জন লোক। রাত প্রায় আটটা, সব আগন্তুক মায়েরা হাতে হাত লাগিয়ে ডাল, ভাত ও মাছের ঝোল রান্না করে ফেললেন। রাতের খাবার শেষে এক অজানা আশঙ্কা নিয়ে, মাটিতে বিছানো চাদরে সবাই গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন ২৭ মার্চ সকালে বাড়ির উঠোনে প্রতিবেশীদের সমাগম। ওদের মধ্যে কয়েকজন বুড়িগঙ্গার এ-পারে অবস্থিত ‘কমলাঘাট’ বন্দর থেকে পাওয়া খবর নিয়ে আলোচনা করছিল। ওরা জানতে পেরেছিল, আগের রাতে নারায়ণগঞ্জে পাকিস্তানি মিলিটারির আক্রমণে কিছু নেতাসহ প্রায় কুড়ি জন নিহত হয়েছে। গত দুই দিন রাজধানী ঢাকায় হত্যাকাণ্ডে হিন্দু ছাত্রাবাসের কিছু সুপারভাইজারসহ বহু ছাত্রকে অত্যাচার করে খুন করা হয়েছে। অনেক লোককে বাড়ি থেকে তুলে অন্য স্থানে নিয়ে মারা হয়েছে। অনেক মহিলা ও তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলছে। সবচাইতে মর্মান্তিক খবর ছিল, আমাদের বাড়ি থেকে ১০ মিনিট দূরত্বে অবস্থিত শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে, স্কুলঘরে সে রাতে যারা আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের প্রত্যেককে মিলিটারিরা গুলি করে হত্যা করেছে। সেখানে আমাদের পূর্বপরিচিত কয়েকজনও ছিল। কী ভয়ানক খবর! সেখানেই তো আমাদের আশ্রয় নেওয়ার কথা ছিল সেই কালরাত্রিতে। বিধাতার আশীর্বাদে আমরা বেঁচে গেছি!
তারপর নয় মাস সেই গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। নানা রকমের উদ্বেগ, ভয় আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় জীবন নিরর্থক মনে হয়েছিল। সেই ভয়ংকর অনেকগুলো অধ্যায়ের একটি আজ এখানে বর্ণনা করছি :
খুব সম্ভবত ১৯৭১ সালের জুলাই মাস। রাতে গুলির আওয়াজ শোনা যায়। কেউ বলে মুক্তিবাহিনী গুলি ছুড়ে মিলিটারি মারছে, আবার কেউ বলে মিলিটারি মানুষ মারছে। কিন্তু দিনের বেলায় গ্রামে মিলিটারির কোনো উপদ্রবের কথা শোনা যায় না। একদিন দুপুরের দিকে মনে কেমন একটা আনন্দ হলো, নির্ভয়ের আনন্দ। বেঁচে আছি, তার আনন্দ। আমাদের শহরের বাড়িওয়ালির মেয়ের (আমার চাইতে বছর দুই ছোট) সঙ্গে গল্প করছিলাম। সহজ, সরল, ভালো মেয়ে। বহুদিন পর গল্পের মাঝে আমাদের মুখে হাসিও ছিল। হঠাৎ মেয়েটি একটি নতুন শাড়ি আমার সামনে ধরে আবদার করে বসল, ‘আমার এই কমলা রঙের শাড়িটি পরুন দিদি, খুব ভালো দেখাবে।’
এত গল্পে মজে ছিলাম, ওকে না বলতে মন চাইল না। শাড়িটি পরে ফেললাম। মুহূর্তের মধ্যে কে একজন দৌড়ে ঘরে ঢুকে বলল, মিলিটারি আসছে। সব আনন্দ কোথায় উবে গেল। ভয়ে শরীর নিথর হয়ে গেল।
আগেরবার যখন মিলিটারির কথা শুনেছিলাম, তখন কোথাও পালানোর পথ খুঁজে পাইনি। কিন্তু এবার সবার কাছে একটা পালানোর রাস্তা জানা। সেটা হচ্ছে বাড়ির পেছনের দিকে যে পুকুর, তা পেরিয়ে অপর পারে চলে যাওয়া। আমার বাবা, আমার ছোট ভাই রতন, বাড়িওয়ালা, তার মেয়ে আর আমি পালিয়ে যাওয়ার রাস্তার দিকে ছুটলাম। তখন মিলিটারিদের চোখ ছিল পুরুষ আর কম বয়সী মেয়েদের দিকে। তাই অন্যরা ঘরেই রয়ে গেল। আমার মা, আমার চাইতে ছয় বছরের ছোট বোন সাধনা এবং ১০ বছরের ছোট বোন কনিকাও রয়ে গেল বাড়িতেই। আমার দুই ভাই হিমাংশু ও শিশির ছিল কমলাঘাটে, নতুন ব্যবসা সামলাতে।
যে পুকুরপাড় হয়ে ওপারে যাওয়া যায়, সেটা বহু বছরের জমে থাকা কচুরিপানায় পূর্ণ। সামনের দিকে অল্প একটু পরিষ্কার জল, সেখানে এই বাড়ির বাসিন্দারা বাসন পরিষ্কার করে। আমি দেখতে পেলাম, জল-কাদা আর কচুরিপানায় কোমর ডুবিয়ে সবাই ওপারে যেতে চেষ্টা করছে। জল-কাদা সব সময় এড়িয়ে চলেছি, কীভাবে এ পথ পার হব, বুঝতে পারছিলাম না। চলতে গিয়ে দেখলাম, পা তুলে কাদা-জল-কচুরিপানায় হাঁটা খুব মুশকিল। শাড়ি পরে আছি, তাই এগোনো আরও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সামনের দিকে চেয়ে দেখলাম, প্রায় সবাই পুকুরের ওপারে চলে গিয়েছে। কচুরিপানার ভেতর শরীর আটকে যাচ্ছিল। মনে ভয় হচ্ছিল, এই বুঝি পেছন থেকে মিলিটারির গুলি এসে শরীর ভেদ করবে। ভেবেছিলাম, জলে ডুব দিয়ে বাঁচা যাবে কি না। কিন্তু ভারি জল। এগোনোই মুশকিল, ডুব দেওয়া তো দূরে থাক। ফেলে আসা জীবনে, সমস্যা এলে আপনজনদের বাড়িয়ে দেওয়া হাত পেয়েছি। এখানে তো কেউ নেই এই পচা কচুরিপানায় পূর্ণ, কর্দমাক্ত পুষ্করিণী পার করে দেওয়ার জন্য। অনেক কসরত করে শরীর টেনে টেনে কোনোভাবে ওপাড়ে উঠে গেলাম। ময়লা-কাদা-কচুরিপানায় ভর্তি দেহ তখন চুলকাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, আমার পরনে, কমলা রঙের শাড়িটির ধূসর বরণে রূপান্তর দেখে মনে খুব পীড়া দিচ্ছিল, শাড়ির অধিকারিণী সেই আবেগপ্রবণ বন্ধুটির কথা ভেবে।
ওপারে গিয়ে চোখে পড়ল একটি ছোট্ট কুটির। সে কুটিরে উঁকি দিতেই এক থুত্থুড়ে বুড়িকে দেখতে পেলাম, মনে হলো আশির উপর বয়স। অনেক অনুনয়-বিনয় করে সে ঘরে আশ্রয় চাইলাম। বুড়ি শুধু মেয়েদের ঠাঁই দেবে বলল, পুরুষদের নয়। আমার ছোট ভাই রতন চলে গেল আরও অনেক দূরের পথে। বাবা ঘরের বাইরে থেকে গেলেন, বললেন, ‘আমি পাহারায় থাকলাম। কোনো সংকেত পেলে জানাব, তাতে করে সবাই এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারব।’ মুশকিল হলো আমাদের বাড়িওয়ালাকে নিয়ে। কুটিরের বুড়ি মালকিন, আমাদের প্রাক্তন বাড়িওয়ালার দিকে কটমট করে তাকিয়ে খিচমিচ করে বলল, ‘তুমি এখানে থাকতে পারবা না।’ ভদ্রলোক খুবই ভিতু স্বভাবের। কিন্তু এই বুড়িকে কীভাবে শান্ত করতে হবে তৎক্ষণাৎ সে বুদ্ধি তার মাথায় এসেছিল এবং পকেট থেকে কয়েকটি টাকা বের করে বুড়ির হাতে গুঁজে দিলেন। বুড়ি দন্তহীন মুখে আনন্দের হাসি হেসে বাড়িওয়ালাকে একটি বসার স্থান দেখিয়ে দিল। প্রায় ১০ মিনিট কেটে গেল সেখানে। আমরা একটা গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। কোথায় গুলি হলো আমাদের পার্শ্ববর্তী পালবাড়ি নাকি আমাদের বাড়ি? নিজেদের জন্য এবং ফেলে আসা পরিবারের জন্য আমরা তখন দুশ্চিন্তায় অস্থির। আরও ১৫ মিনিট কেটে গেল এভাবে। ওপার থেকে আমাদের নতুন বাড়িওয়ালির গলা শুনতে পেলাম, ‘মিলিটারি চলে গেছে। সবাই ফিরে আসো।’ বাড়ি ফিরে এলাম অন্য পথ ধরে। আমাদের পার্শ্ববর্তী পালবাড়ির একজন বাসিন্দাকে মারা হয়েছিল, সেই গুলির আওয়াজই শুনেছিলাম ওপারের কুটির থেকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের আরও কত রকমের ভয়ংকর ঘটনার ভুক্তভোগী এবং সাক্ষী হয়ে এখনো বেঁচে আছি!