-শা-লা! তোর চৌদ্দ গুষ্টিরে...!
হেদায়েতালির মুখ থেকে পানের পিকের সাথে বেরিয়ে আসে একরাশ খিস্তি।
হেদায়েতালির সামনে দাঁড়িয়ে জব্বর খাঁ। কোনো নড়ন-চড়ন নেই। মুখের ভাবেরও তার কোনো পরিবর্তন নেই। নেই কোনো কেয়ার, যেন জব্বর খাঁ হেদায়েতালির মতো কোনো হোমরাচোমরা সরকারি চামচার সামনে দাঁড়িয়ে নেই। হেদায়েতালির কুমড়োর মতো গাঁট্টাগোট্টা শরীরটা নড়ে উঠছে। সে দাঁত চিবিয়ে স্বগত প্রলাপ উচ্চারণ করছে, ‘উজবুক! ইতর! আদব কী তা জানে না। ছোটলোকের আস্ত বেস্ট স্যাম্পল, শালা জব্বর!’
রাগে-ক্ষোভে তার সারা গা জ্বলছে। চোখ দুটো ঠিকরে বেরোতে চাইছে যেন! একদম!
স্যামসন সাহেবকে কী বলবে সে? এই জব্বর শালা উল্লুককার দরকার তার। মদ খাও। কভি নেহি! লেড়কি চলেগা? তওবা! তওবা! বাস্তবে এমন সাচ্চা ধার্মিক এই হেদায়েতালি নয়! তো স্যামসন সাহেবের পাল্লায় পড়ে ওদের জন্য সবই করতে হচ্ছে তাকে। খাঁটি সত্য কথা! তো সাহেবদের মন জিনিসটা বাগে আনা খুবই কঠিন কাজ। আসলেই ভেরি হার্ড! ওদের মন, সে এক আজব চিজ! ইস্ট ইন্ডিয়ার বিগ স্যারেরা যার-তার ঘরে তাঁদের মূল্যবান পায়ের ধুলো দেন না! যার কপাল বলতে কিছু আছে, সেই হয় ‘খান বাহাদুর’। পায় ‘ডি লিট’। আরও অনেক লোভনীয় উপাধি! জমিদার বলো, খানসামা বলো আর গোমস্তাই বলো, শালা রাঘব বোয়ালেরা! মান-ইজ্জত, শরীর বেবাক ছেড়ে দিয়ে নেতিয়ে পড়ছে লাইন ধরে সব হোয়াইট-ডগদের চরণের নিচে! আর তুমি শালা জব্বর খাঁ! না চেহারা! না ছুরত! তোমারে তারা কল করেছে। কী আছে তোমার? আর তুমি কও, ‘দিঘি দিমু না! জমিও দিমু না!’ আমি মাগার হেদায়েতালি, আমার পুরা মূল্যবান জাহান শ্যাষ কইরা দিতাছি...! তবু হালার খান বাহাদুরিটা পাইতাছি না! তোর স্বদেশির খ্যাতায় আগুন! গান্ধী তোর বাপ লাগে, না? জিন্নাহ কি তোর বাড়িতে এক চৌকিতে ঘুমায়? কথা ক...!
কথা আর বলে না জব্বর। রাগে-ক্ষোভে সারাটা শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। বলবে কেন? আর কত অপমান? আর কত লাঞ্ছনা আর বঞ্চনা? গোটা উপমহাদেশে চলছে লাগাতার আন্দোলন। ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে জ্বলছে বিদ্রোহের লেলিহান দাবানল! বাস্তবে সবই নিজের চোখে দেখছে জব্বর। নিজের কানে শুনছে তার কাহিনি। এ দেশের মানুষের ধন, মান আর ইজ্জত সবকিছুই কেড়ে নিচ্ছে ওরা বেনিয়া গোষ্ঠী! তাদের পোষা এ দেশের দালালরা!
নিজের ভুঁড়িটা দু’হাতে আলতো উঁচিয়ে ধরে উঠে দাঁড়ায় হেদায়েত আলী। কুঁতকুঁতে চোখ দুটো তার মোটা ভুরুর নিচে পিটপিট করছে। মুখ থেকে পানের পিক ফেলছে বারবার।
Ñআই অ্যাম দ্য গ্রেট হেদায়েতালি খান বাহাদুর! টুমি জব্বরালি সারতে পারবা না। চেয়ে দেখো চারিডিকেই শত্রু! তারা গান্ধীকে, জিন্নাহকে ঘিরে ফেলেছে! টো, নাউ টুমি আমার কঠা শুনো। হামাডের শ্যামসন শাহেব টোমাকে জরুরি টলব করেছেন। এক্ষুনি হামার গাড়িতে করে টোমাকে সদরে যেটে হবে। টারা টোমাকে চায়। বহুত বখশিস আছে, হ্যাঁ!
জব্বার খাঁর ঘাড় শক্ত হয়ে ওঠে। শিরদাঁড়া বেয়ে গরম রক্ত সারা মাথায় চলে আসে!
-না! আমি যামু না! আমি বলতাছি, আমাগো সর্বনাশ আপনেরা আর কইরেন না! একশ পঁচাত্তর বছর ধইরা বিদেশি কুত্তারা আমগো খাবলাইয়া খাবলাইয়া খাইতাছে! আর আপনেরা তাদের দালালি করতাছেন! তয় আর খাইতে দিমু না! পলাশীতে যেই তাজ আমরা হারাইছি, তা কাইড়া নিয়া আবার স্বাধীন মানুষ হিসাবে মাথা তুইলা দাঁড়ামু...! আপনেরা ওদের পক্ষ নিবেন না আর। এইবার ঘুইরা দাঁড়ান। আমাদের পক্ষে ফিরা আইসেন!
Ñশালা সিরাজের বাচ্চা!
জব্বারের মাথার চুল টেনে ধরে হেদায়েতালি।
Ñশালা! তুমি মীরজাফর, জগৎশেঠ, ঘসেটি বেগমকে চেনো? তয় চেনামু! আদর কইরা চেনামু সোনা! হগগলেরই চেনামু!
Ñআপনাদের এই রাজত্ব বেশি দিন থাকবে না। আসেন, আমরা সোনার মানুষ হই। মুক্ত স্বাধীন সোনার দেশ গড়ে তুলি...!
জব্বার দু’হাত নেড়ে চুল ছাড়াতে চেষ্টা চালায়। কিন্তু পারে না। এবার সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, ‘আপনেরা নিজের দেশের যে ক্ষতি করতাছেন, তার হিসাব একদিন দিওন লাগবো! আপনেরা নিজেদের বউ-ঝির ইজ্জত ওই বিদেশি কুত্তার হাতে তুইলা দিতাছেন! আপনেরা আমার দোস্ত শামসুরে লোভ দেখাইয়া নিয়া নিখোঁজ করেছেন! আর আইজ আমারে জোর কইরা ধইরা আপনের বাড়িতে আইনা ইংরাজদের কাছে লইয়া যাইবার চাইতাছেন! দোহাই আপনের আলি ভাই! আমার কোনো ক্ষতি আপনে কইরেন না! বাড়িতে আমার বউ রহিমা আর বইন জাহানারা পথের দিকে চাইয়া আছে। আমারে ছাইড়া দেন! আল্লার দোহাই!
-শালা কাইলা! কুত্তার বাচ্চা! ওঠ গাড়িতে!
হিড়হিড় করে টেনে গাড়ির পেছনের ডালার ভেতরে জব্বারকে ঠেলে দেয় হেদায়েতালি। তারপর নিজেই দরজা বন্ধ করে বাইরে একটা তালা লাগিয়ে দেয়। গাড়ির ভেতরে চার হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করতে থাকে জব্বার। ততক্ষণে গাড়ি হুংকার দিয়ে হেদায়েতালির বাসভবন ছেড়ে চলতে থাকে সদরের দিকে।
পড়ন্ত বিকেলে সদর কুঠিবাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ি থামে। ভেতরে মড়ার মতো নিস্তেজ পড়ে থাকে অসহায় জব্বার খাঁ। হেদায়েতালি গাড়ি থেকে নেমে তালা খুলে ডালার ভেতর থেকে চুল ধরে টেনে বের করে আনে জব্বারকে। বন্দীকে ধাক্কা মেরে একটি রুমের ভেতর ঢুকিয়ে দেয় হেদা। হুমড়ি খেয়ে সামনের টেবিলের কাছে পড়ে যায় জব্বার।
-কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়া শালা! আমাদের শ্যামসন সাহেবকে কুর্নিশ কর!
জব্বারের পাছায় কষে এক লাথি মারে হেদা। লাথি খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে উঠে দাঁড়ায় জব্বার। স্যামসন সাহেবের দিকে মাথা তুলে তাকাতেই চমকে ওঠে সে। এ কে? এ যে তার দোস্ত! অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে, ‘শামসু! দোস্ত তুমি!’
-শালা! কে তোর দোস্ত?
পেছন থেকে গর্জে ওঠে হেদায়েতালি। ‘ইয়ার্কি আর কি! এবার চেনো, স্যামসন সাহেব কে!’
-ইয়েস! হামি স্যামসন সাহেব! হামি টুমাডের মঙ্গল চায়। টবে হামার কঠা টুমাডের শুনিটে হইবে। টুমি মিস্টার জব্বর খাঁ। হামি টুমাকে খানবাহাডুর বানাইবে। টুমাকে হামাডের প্রয়োজন আছে। হামাদের টুমার সুন্ডরী পরিবার, সুন্ডরী বহিনের প্রয়োজন আছে।
-না! না! আমি মরে গেলেও তা করতে পারব না! আমি রক্ত দিতে পারি! জান দিতে পারি! কিন্তু আমাদের ইজ্জত দিতে পারি না! সম্পত্তি দিতে পারি না!
-হাঃ হাঃ হাঃ!
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে স্যামসন সাহেব। ‘ইজ্জত দেবে না! সম্পত্তি দেবে না! হাঃ হাঃ হাঃ! হেদায়েত, ওদের নিয়ে এসো এখানে!’
বিনা মেঘে বজ্রপাত হয় যেন জব্বার খাঁর মাথায়। পেছন দিকে সে তাকিয়ে দেখে, তার স্ত্রী রহিমা ও বোন জাহানারা। তাদের দুজনেরই পেছন দিকে হাত বাঁধা। মুখে কালো স্কচটেপ আঁটা। কিছুই বলতে পারছে না তারা!
-শামসু! শুয়োর! তুই আমার কলিজায় থাবা দিছোস। তুই আমাগো ইজ্জত কাইড়া নিবি? পারবি না!
স্যামসনরূপী শামসুর ওপর এবার ঝাঁপিয়ে পড়ে জব্বার খাঁ। শামসু কায়দা করে জব্বারের গলা দু’হাতে চেপে ধরে। পেছনে অসহায় রহিমা ও জাহানারা ঢলে পড়ে মেঝেতে।
-শোন জব্বার। ওরা আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। তুই দ্যাখ, আমি কেমন বড় সাহেব হয়ে গেছি! আমার মতো তুইও হইবি। শুধু রহিমা ও জাহানারাকে ওরা চায়। ব্যস। বেশি কিছু না। আর বিনিময়ে তুই পাইবি ‘খানবাহাদুর’ বকশিশ! বল, রাজি! বল। বল। বল... ... ...।
-এ তুই কী করছিস শামসু? জব্বর যে মইরা যাইবো!
হেদায়েতালি ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসে। ‘আর জব্বর মইরা গেলে লাট সাহেবের উদ্দেশ্যটা বরবাদ হইয়া যাইবো! তুই জবাব দিবি কী? তোর স্যামসন সাহেবি চাকরিটাও যাইবো! তখন দেশের মানুষ তোকে আমাকে সুদ্ধা একেবারে কাঁচা গিলে খাবে।’
কিন্তু শামসু ছাড়ে না জব্বারের টুটি। জব্বারের চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
-শামসু! শালার বাচ্চা শালা! আমি দশ বছর ধইরা হুজুর হুজুর কইরা খানবাহাদুরিটা পাইলাম না! আর তুমি শালা ছয় মাসেই স্যামসন সাহেব বইনা গেছো! আইজ তোমার স্যামসন সাহেবগিরি আমি ... ...।
দড়াম করে শামসুর নাকের ওপর হেদায়েতালির ওজনদার এক ঘুষি এসে পড়ে। আচমকা টাল সামলাতে না পেরে চক্কর খেয়ে পড়ে যায় শামসু। জব্বারও ছিটকে পড়ে। হেদায়েত হাত বাড়িয়ে জব্বারকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। জব্বার দাঁড়িয়েই ছুটে যায় স্ত্রী রহিমা ও বোন জাহানারার কাছে। হেদায়েত এবার শামসুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পিস্তল বের করার জন্য পকেটে হাত দেয় শামসু। হেদায়েত চিৎকার করে ওঠে, ‘শামসু! যদি বাঁচতে চাস, এখনো সময় আছে। পকেটে হাত দিস না!’ দু’হাতে যথাশক্তি দিয়ে শামসুর গলা চেপে ধরে সে।
জব্বার খাঁ পেছন থেকে ছুটে আসে। কাছে এসেই শামসুর পকেটে হাত ঢুকিয়ে পিস্তলখানা বের করে আনে। হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছে শামসু।
Ñআমার কোনো দোস্ত বন্ধু নাই!
শামসুর দিকে পিস্তল তাক করে জব্বার খাঁ গর্জে ওঠে। ‘আমার রহিমা জাহানারার ইজ্জত যে কাইড়া নেয়, যে স্যামসন সাহেব সাইজা দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার করে, নিজের মানুষের ওপর অত্যাচার করে, তারে খুন করলে নেক কাম হয়।’
পিস্তলের ট্রিগার চেপে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে জব্বার খাঁ। আত্মরক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে দূরে ছিটকে পড়েছিল হেদায়েতালি। এবার ছুটে এসে জব্বারকে জড়িয়ে ধরে সে।
-জব্বর ভাই! তাড়াতাড়ি ওঠো! রহিমা জাহানারাকে নিয়ে আমরা এখনি পালাই। আর দেরি নয়। লাল কুত্তার বাচ্চারা এসে পড়বে। তাড়াতাড়ি... ... ...!
রহিমা, জাহানারা ও জব্বারকে টেনে গাড়িতে তোলে হেদায়েত। কুঠিবাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্য পথ ধরে গাড়ি চালাচ্ছে সে।
এবার উচ্ছ্বসিত মুক্ত হাসিতে ভেঙে পড়ে হেদায়েতালি।
-তুমি মীরজাফর, জগৎশেঠ, ঘসেটি বেগমকে চেনো? হেদায়েতালি, খান বাহাদুর স্যামসন সাহেবকে চেনো? হগগলেরই এইবার চেনো! দেখো, পলাশীতে আমরা যে তাজ একশ পঁচাত্তর বছর আগে হারায়েছিলাম, এবার তা ছিনিয়ে নেওয়ার পালা ... ... ...। জব্বার ভাই! তুমি ঠিকই বলেছ, পলাশীতে যেই তাজ আমরা হারাইছি, তা কাইড়া নিয়া আবার স্বাধীন মানুষ হিসাবে মাথা তুইলা দাঁড়ামু ...! আমি হেদায়েত আলী এইবার ঘুরে দাঁড়িয়েছি! তোমাদের পক্ষে ফিরে এসেছি! হ্যাঁ! এবার আমরা সোনার মানুষ হয়ে উঠব। মুক্ত স্বাধীন ... ... ...!
ইঞ্জিনের প্রচণ্ড শব্দের তোড়ে হেদায়েতালির শেষের কথাগুলো আর শোনা গেল না। অমাবস্যা রাত্রির ঘন অন্ধকার ভেদ করে পলাশীর প্রান্তর বেয়ে ছুটে চলেছে হেদায়েত আলী, জব্বর খাঁ, রহিমা, জাহানারা ওরা সকলে।
হেদায়েতালির মুখ থেকে পানের পিকের সাথে বেরিয়ে আসে একরাশ খিস্তি।
হেদায়েতালির সামনে দাঁড়িয়ে জব্বর খাঁ। কোনো নড়ন-চড়ন নেই। মুখের ভাবেরও তার কোনো পরিবর্তন নেই। নেই কোনো কেয়ার, যেন জব্বর খাঁ হেদায়েতালির মতো কোনো হোমরাচোমরা সরকারি চামচার সামনে দাঁড়িয়ে নেই। হেদায়েতালির কুমড়োর মতো গাঁট্টাগোট্টা শরীরটা নড়ে উঠছে। সে দাঁত চিবিয়ে স্বগত প্রলাপ উচ্চারণ করছে, ‘উজবুক! ইতর! আদব কী তা জানে না। ছোটলোকের আস্ত বেস্ট স্যাম্পল, শালা জব্বর!’
রাগে-ক্ষোভে তার সারা গা জ্বলছে। চোখ দুটো ঠিকরে বেরোতে চাইছে যেন! একদম!
স্যামসন সাহেবকে কী বলবে সে? এই জব্বর শালা উল্লুককার দরকার তার। মদ খাও। কভি নেহি! লেড়কি চলেগা? তওবা! তওবা! বাস্তবে এমন সাচ্চা ধার্মিক এই হেদায়েতালি নয়! তো স্যামসন সাহেবের পাল্লায় পড়ে ওদের জন্য সবই করতে হচ্ছে তাকে। খাঁটি সত্য কথা! তো সাহেবদের মন জিনিসটা বাগে আনা খুবই কঠিন কাজ। আসলেই ভেরি হার্ড! ওদের মন, সে এক আজব চিজ! ইস্ট ইন্ডিয়ার বিগ স্যারেরা যার-তার ঘরে তাঁদের মূল্যবান পায়ের ধুলো দেন না! যার কপাল বলতে কিছু আছে, সেই হয় ‘খান বাহাদুর’। পায় ‘ডি লিট’। আরও অনেক লোভনীয় উপাধি! জমিদার বলো, খানসামা বলো আর গোমস্তাই বলো, শালা রাঘব বোয়ালেরা! মান-ইজ্জত, শরীর বেবাক ছেড়ে দিয়ে নেতিয়ে পড়ছে লাইন ধরে সব হোয়াইট-ডগদের চরণের নিচে! আর তুমি শালা জব্বর খাঁ! না চেহারা! না ছুরত! তোমারে তারা কল করেছে। কী আছে তোমার? আর তুমি কও, ‘দিঘি দিমু না! জমিও দিমু না!’ আমি মাগার হেদায়েতালি, আমার পুরা মূল্যবান জাহান শ্যাষ কইরা দিতাছি...! তবু হালার খান বাহাদুরিটা পাইতাছি না! তোর স্বদেশির খ্যাতায় আগুন! গান্ধী তোর বাপ লাগে, না? জিন্নাহ কি তোর বাড়িতে এক চৌকিতে ঘুমায়? কথা ক...!
কথা আর বলে না জব্বর। রাগে-ক্ষোভে সারাটা শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। বলবে কেন? আর কত অপমান? আর কত লাঞ্ছনা আর বঞ্চনা? গোটা উপমহাদেশে চলছে লাগাতার আন্দোলন। ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে জ্বলছে বিদ্রোহের লেলিহান দাবানল! বাস্তবে সবই নিজের চোখে দেখছে জব্বর। নিজের কানে শুনছে তার কাহিনি। এ দেশের মানুষের ধন, মান আর ইজ্জত সবকিছুই কেড়ে নিচ্ছে ওরা বেনিয়া গোষ্ঠী! তাদের পোষা এ দেশের দালালরা!
নিজের ভুঁড়িটা দু’হাতে আলতো উঁচিয়ে ধরে উঠে দাঁড়ায় হেদায়েত আলী। কুঁতকুঁতে চোখ দুটো তার মোটা ভুরুর নিচে পিটপিট করছে। মুখ থেকে পানের পিক ফেলছে বারবার।
Ñআই অ্যাম দ্য গ্রেট হেদায়েতালি খান বাহাদুর! টুমি জব্বরালি সারতে পারবা না। চেয়ে দেখো চারিডিকেই শত্রু! তারা গান্ধীকে, জিন্নাহকে ঘিরে ফেলেছে! টো, নাউ টুমি আমার কঠা শুনো। হামাডের শ্যামসন শাহেব টোমাকে জরুরি টলব করেছেন। এক্ষুনি হামার গাড়িতে করে টোমাকে সদরে যেটে হবে। টারা টোমাকে চায়। বহুত বখশিস আছে, হ্যাঁ!
জব্বার খাঁর ঘাড় শক্ত হয়ে ওঠে। শিরদাঁড়া বেয়ে গরম রক্ত সারা মাথায় চলে আসে!
-না! আমি যামু না! আমি বলতাছি, আমাগো সর্বনাশ আপনেরা আর কইরেন না! একশ পঁচাত্তর বছর ধইরা বিদেশি কুত্তারা আমগো খাবলাইয়া খাবলাইয়া খাইতাছে! আর আপনেরা তাদের দালালি করতাছেন! তয় আর খাইতে দিমু না! পলাশীতে যেই তাজ আমরা হারাইছি, তা কাইড়া নিয়া আবার স্বাধীন মানুষ হিসাবে মাথা তুইলা দাঁড়ামু...! আপনেরা ওদের পক্ষ নিবেন না আর। এইবার ঘুইরা দাঁড়ান। আমাদের পক্ষে ফিরা আইসেন!
Ñশালা সিরাজের বাচ্চা!
জব্বারের মাথার চুল টেনে ধরে হেদায়েতালি।
Ñশালা! তুমি মীরজাফর, জগৎশেঠ, ঘসেটি বেগমকে চেনো? তয় চেনামু! আদর কইরা চেনামু সোনা! হগগলেরই চেনামু!
Ñআপনাদের এই রাজত্ব বেশি দিন থাকবে না। আসেন, আমরা সোনার মানুষ হই। মুক্ত স্বাধীন সোনার দেশ গড়ে তুলি...!
জব্বার দু’হাত নেড়ে চুল ছাড়াতে চেষ্টা চালায়। কিন্তু পারে না। এবার সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, ‘আপনেরা নিজের দেশের যে ক্ষতি করতাছেন, তার হিসাব একদিন দিওন লাগবো! আপনেরা নিজেদের বউ-ঝির ইজ্জত ওই বিদেশি কুত্তার হাতে তুইলা দিতাছেন! আপনেরা আমার দোস্ত শামসুরে লোভ দেখাইয়া নিয়া নিখোঁজ করেছেন! আর আইজ আমারে জোর কইরা ধইরা আপনের বাড়িতে আইনা ইংরাজদের কাছে লইয়া যাইবার চাইতাছেন! দোহাই আপনের আলি ভাই! আমার কোনো ক্ষতি আপনে কইরেন না! বাড়িতে আমার বউ রহিমা আর বইন জাহানারা পথের দিকে চাইয়া আছে। আমারে ছাইড়া দেন! আল্লার দোহাই!
-শালা কাইলা! কুত্তার বাচ্চা! ওঠ গাড়িতে!
হিড়হিড় করে টেনে গাড়ির পেছনের ডালার ভেতরে জব্বারকে ঠেলে দেয় হেদায়েতালি। তারপর নিজেই দরজা বন্ধ করে বাইরে একটা তালা লাগিয়ে দেয়। গাড়ির ভেতরে চার হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করতে থাকে জব্বার। ততক্ষণে গাড়ি হুংকার দিয়ে হেদায়েতালির বাসভবন ছেড়ে চলতে থাকে সদরের দিকে।
পড়ন্ত বিকেলে সদর কুঠিবাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ি থামে। ভেতরে মড়ার মতো নিস্তেজ পড়ে থাকে অসহায় জব্বার খাঁ। হেদায়েতালি গাড়ি থেকে নেমে তালা খুলে ডালার ভেতর থেকে চুল ধরে টেনে বের করে আনে জব্বারকে। বন্দীকে ধাক্কা মেরে একটি রুমের ভেতর ঢুকিয়ে দেয় হেদা। হুমড়ি খেয়ে সামনের টেবিলের কাছে পড়ে যায় জব্বার।
-কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়া শালা! আমাদের শ্যামসন সাহেবকে কুর্নিশ কর!
জব্বারের পাছায় কষে এক লাথি মারে হেদা। লাথি খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে উঠে দাঁড়ায় জব্বার। স্যামসন সাহেবের দিকে মাথা তুলে তাকাতেই চমকে ওঠে সে। এ কে? এ যে তার দোস্ত! অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে, ‘শামসু! দোস্ত তুমি!’
-শালা! কে তোর দোস্ত?
পেছন থেকে গর্জে ওঠে হেদায়েতালি। ‘ইয়ার্কি আর কি! এবার চেনো, স্যামসন সাহেব কে!’
-ইয়েস! হামি স্যামসন সাহেব! হামি টুমাডের মঙ্গল চায়। টবে হামার কঠা টুমাডের শুনিটে হইবে। টুমি মিস্টার জব্বর খাঁ। হামি টুমাকে খানবাহাডুর বানাইবে। টুমাকে হামাডের প্রয়োজন আছে। হামাদের টুমার সুন্ডরী পরিবার, সুন্ডরী বহিনের প্রয়োজন আছে।
-না! না! আমি মরে গেলেও তা করতে পারব না! আমি রক্ত দিতে পারি! জান দিতে পারি! কিন্তু আমাদের ইজ্জত দিতে পারি না! সম্পত্তি দিতে পারি না!
-হাঃ হাঃ হাঃ!
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে স্যামসন সাহেব। ‘ইজ্জত দেবে না! সম্পত্তি দেবে না! হাঃ হাঃ হাঃ! হেদায়েত, ওদের নিয়ে এসো এখানে!’
বিনা মেঘে বজ্রপাত হয় যেন জব্বার খাঁর মাথায়। পেছন দিকে সে তাকিয়ে দেখে, তার স্ত্রী রহিমা ও বোন জাহানারা। তাদের দুজনেরই পেছন দিকে হাত বাঁধা। মুখে কালো স্কচটেপ আঁটা। কিছুই বলতে পারছে না তারা!
-শামসু! শুয়োর! তুই আমার কলিজায় থাবা দিছোস। তুই আমাগো ইজ্জত কাইড়া নিবি? পারবি না!
স্যামসনরূপী শামসুর ওপর এবার ঝাঁপিয়ে পড়ে জব্বার খাঁ। শামসু কায়দা করে জব্বারের গলা দু’হাতে চেপে ধরে। পেছনে অসহায় রহিমা ও জাহানারা ঢলে পড়ে মেঝেতে।
-শোন জব্বার। ওরা আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। তুই দ্যাখ, আমি কেমন বড় সাহেব হয়ে গেছি! আমার মতো তুইও হইবি। শুধু রহিমা ও জাহানারাকে ওরা চায়। ব্যস। বেশি কিছু না। আর বিনিময়ে তুই পাইবি ‘খানবাহাদুর’ বকশিশ! বল, রাজি! বল। বল। বল... ... ...।
-এ তুই কী করছিস শামসু? জব্বর যে মইরা যাইবো!
হেদায়েতালি ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসে। ‘আর জব্বর মইরা গেলে লাট সাহেবের উদ্দেশ্যটা বরবাদ হইয়া যাইবো! তুই জবাব দিবি কী? তোর স্যামসন সাহেবি চাকরিটাও যাইবো! তখন দেশের মানুষ তোকে আমাকে সুদ্ধা একেবারে কাঁচা গিলে খাবে।’
কিন্তু শামসু ছাড়ে না জব্বারের টুটি। জব্বারের চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
-শামসু! শালার বাচ্চা শালা! আমি দশ বছর ধইরা হুজুর হুজুর কইরা খানবাহাদুরিটা পাইলাম না! আর তুমি শালা ছয় মাসেই স্যামসন সাহেব বইনা গেছো! আইজ তোমার স্যামসন সাহেবগিরি আমি ... ...।
দড়াম করে শামসুর নাকের ওপর হেদায়েতালির ওজনদার এক ঘুষি এসে পড়ে। আচমকা টাল সামলাতে না পেরে চক্কর খেয়ে পড়ে যায় শামসু। জব্বারও ছিটকে পড়ে। হেদায়েত হাত বাড়িয়ে জব্বারকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। জব্বার দাঁড়িয়েই ছুটে যায় স্ত্রী রহিমা ও বোন জাহানারার কাছে। হেদায়েত এবার শামসুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পিস্তল বের করার জন্য পকেটে হাত দেয় শামসু। হেদায়েত চিৎকার করে ওঠে, ‘শামসু! যদি বাঁচতে চাস, এখনো সময় আছে। পকেটে হাত দিস না!’ দু’হাতে যথাশক্তি দিয়ে শামসুর গলা চেপে ধরে সে।
জব্বার খাঁ পেছন থেকে ছুটে আসে। কাছে এসেই শামসুর পকেটে হাত ঢুকিয়ে পিস্তলখানা বের করে আনে। হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছে শামসু।
Ñআমার কোনো দোস্ত বন্ধু নাই!
শামসুর দিকে পিস্তল তাক করে জব্বার খাঁ গর্জে ওঠে। ‘আমার রহিমা জাহানারার ইজ্জত যে কাইড়া নেয়, যে স্যামসন সাহেব সাইজা দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার করে, নিজের মানুষের ওপর অত্যাচার করে, তারে খুন করলে নেক কাম হয়।’
পিস্তলের ট্রিগার চেপে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে জব্বার খাঁ। আত্মরক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে দূরে ছিটকে পড়েছিল হেদায়েতালি। এবার ছুটে এসে জব্বারকে জড়িয়ে ধরে সে।
-জব্বর ভাই! তাড়াতাড়ি ওঠো! রহিমা জাহানারাকে নিয়ে আমরা এখনি পালাই। আর দেরি নয়। লাল কুত্তার বাচ্চারা এসে পড়বে। তাড়াতাড়ি... ... ...!
রহিমা, জাহানারা ও জব্বারকে টেনে গাড়িতে তোলে হেদায়েত। কুঠিবাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্য পথ ধরে গাড়ি চালাচ্ছে সে।
এবার উচ্ছ্বসিত মুক্ত হাসিতে ভেঙে পড়ে হেদায়েতালি।
-তুমি মীরজাফর, জগৎশেঠ, ঘসেটি বেগমকে চেনো? হেদায়েতালি, খান বাহাদুর স্যামসন সাহেবকে চেনো? হগগলেরই এইবার চেনো! দেখো, পলাশীতে আমরা যে তাজ একশ পঁচাত্তর বছর আগে হারায়েছিলাম, এবার তা ছিনিয়ে নেওয়ার পালা ... ... ...। জব্বার ভাই! তুমি ঠিকই বলেছ, পলাশীতে যেই তাজ আমরা হারাইছি, তা কাইড়া নিয়া আবার স্বাধীন মানুষ হিসাবে মাথা তুইলা দাঁড়ামু ...! আমি হেদায়েত আলী এইবার ঘুরে দাঁড়িয়েছি! তোমাদের পক্ষে ফিরে এসেছি! হ্যাঁ! এবার আমরা সোনার মানুষ হয়ে উঠব। মুক্ত স্বাধীন ... ... ...!
ইঞ্জিনের প্রচণ্ড শব্দের তোড়ে হেদায়েতালির শেষের কথাগুলো আর শোনা গেল না। অমাবস্যা রাত্রির ঘন অন্ধকার ভেদ করে পলাশীর প্রান্তর বেয়ে ছুটে চলেছে হেদায়েত আলী, জব্বর খাঁ, রহিমা, জাহানারা ওরা সকলে।