বছরের এই সময়টাতে ম্যাডিসনের গাছে গাছে পাতায় পাতায় শুধু রং আর রং, মাঠে ঘন সবুজ ঘাস; কী যে অস্থির আর ভয়াবহ রকম সুন্দর প্রকৃতি, কে বলবে এই কয়েক দিন আগেই শীতে আর বরফে জবুথবু ছিল পুরো শহর। গাছগুলোর মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা লেগেছে, কে কার আগে রঙিন সাজে সাজতে পারে। বরফে ডুবে থাকা পেরিনিয়ালগুলো যেন মন-প্রাণ বাজি রেখে জেগে উঠতে ব্যস্ত। এ রকমই দু-একটা গাছে অনেক আগেই ফুল দেখা গিয়েছিল, মাঝে বরফ পড়ায় ওরা বরফে লুকিয়ে গেল কিছুদিনের জন্য, এখন আবারও জেগে উঠছে।
মনের জোর মানুষের চাইতে গাছপালারই হয়তো অনেক বেশি (আবোলতাবোল কথা হয়ে গেল, গাছের কি আর মন আছে? কিন্তু আমার যে এ রকমই চিন্তা করতে ভালো লাগে)।
সবুজ ঘাসে হঠাৎই দেখা যায় খরগোশ ঘোরাফেরা করছে, গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে কাঠবিড়ালি লাফিয়ে বেড়ায়। ঘুম থেকে উঠে জানালা খুলে দিলেই কিচিরমিচির পাখির শব্দ, বাসার সামনে বা পেছনে রঙিন গাছপালা কিংবা পাশের খেলার মাঠের সবুজ ঘাসে যখনই দেখি নানা রকম পাখির আনাগোনা, তখন আমার মন একমুহূর্তেই চলে যায় আমার প্রিয় দেশে, এখনকার বাংলাদেশে নয়, তখনকার বাংলাদেশে, আমার প্রিয় রোকেয়া হলের দিনগুলোতে। সেই রোকেয়া হলের মাঠে, সেই ইউনিভার্সিটির দিনগুলোতে।
আসলেই প্রকৃতির প্রতিটা সৌন্দর্যের সঙ্গে শৈশব বা তারুণ্যের এক অসাধারণ যোগসূত্র আছে, আমি পদে পদে সেই যোগসূত্র খুঁজে পাই। পেতেই থাকি। আমার শৈশব, আমার রোকেয়া হলের জীবন বারবার আমার কাছে ফিরে আসে। আনন্দের আর বৈচিত্র্যের সেই সব স্মৃতি ঘেঁটে অনায়াসে একজীবন পুরোটাই কাটানো যাবে।
রোকেয়া হলের সময়টাতে শালিক নিয়ে আমাদের একটু বাড়তি রকমের বাড়াবাড়ি ছিল বলতেই হবে। হলের বিশাল বড় সবুজ মাঠে নানা রকম পাখির সঙ্গে শালিকের কমতি ছিল না কখনোই। বন্ধুরা সবাই মিলে ক্লাসে যাওয়ার সময় সেই শালিক পাখি দেখে দিন কেমন যাবে সেটা নিয়ে কখনো অনেক সিরিয়াস হয়ে যাওয়া বা কখনো হাসি-তামাশা করাÑআমাদের নিত্যদিনের অভ্যাস ছিল।
ওয়ান ফর সরো,
টু ফর জয়,
থ্রি ফর লেটার্স,
ফোর ফর গেস্ট
-এই কথাগুলো ঠিক না বেঠিক, মিলল কি মিলল না, এ নিয়ে বিশ্লেষণ লেগেই থাকত।
‘সরো’, ‘জয়’, ‘লেটার্স’ কিংবা ‘গেস্ট’ সবগুলো শব্দই ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট ছিল বাবা-মা, ভাইবোনকে ফেলে দূরের শহরে হলে থাকা আমাদের সবার জীবনে। তাই বুঝে হোক বা না-বুঝেই হোক, মজা করে হোক বা সিরিয়াসলিই হোক, আমরা শালিক দেখার সঙ্গে নিজের দিন কেমন কাটবে, সেটা মেলানোর একটা চেষ্টা করতাম সব সময়ই।
এক শালিক দেখা মানেই আতঙ্ক ছিল। বিসনেস ফ্যাকাল্টিতে মিডটার্মের শেষ নেই। প্রতিটি সেমিস্টারে পাঁচটি করে কোর্সের প্রতিটি কোর্সেই দুটি করে মিডটার্ম আর সেমিস্টার ফাইনাল মিলিয়ে ছয় মাসে ১৫টা পরীক্ষা হতো। তাই আমাদের সেমিস্টারগুলো ছিল পরীক্ষাময়। মজার ব্যাপার হলো, এই শালিক দেখার সঙ্গে ভবিষ্যৎ মেলানো-জাতীয় কুসংস্কারে আমাদের মতো ‘সেলফ-সার্টিফায়েড স্মার্ট’ মেয়েরা কেউই বিশ্বাস করতাম না বলে দাবি করলেও কেন যেন পরীক্ষার সময়গুলোতে সকালে উঠে এক শালিক দেখার ভয়ে আমরা সবাই তটস্থ থাকতাম। অবাক ব্যাপার হলো, হাজার হাজার পাখি চারদিকে, তার পরও কেন যেন পরীক্ষার সময়ই এক শালিক চোখে পড়ত বারবার।
স্বপ্নার কথাগুলো এখনো কানে ভাসে, ‘দেখ তো রুমানা, এই অসভ্য শালিকটার কি কোনো কাজ নাই, সাতসকালে আমার সামনে পড়তেই হবে কেন, বল তো? এমনিতেই আমার প্রিপারেশন ভালো না, তার ওপর মরার শালিক চোখের সামনে এসে পড়ল।’ কিংবা আমার নিজেরই এক শালিক দেখে চোখ বন্ধ করে শালিককে না দেখার ভাণ করা আর মনে মনে সুরা জপতে শুরু করা। ইশ্্, কী ভয়ংকর সময় ছিল। আইরিন, খাঁদু, স্মৃতি, মলি-সবারই একই রকম ভয় ছিল, তবে খুকু একটু ডেসপারেট ছিল, মাঝেমধ্যে গালি দিতে দিতে দৌড়ে গিয়ে লাত্থি দিয়ে, না হয় হাতে থাকা ফাইল দিয়ে শালিককে তাড়াত।
দুটি শালিক দেখলে তো খুশির শেষ নেই। যেভাবেই হোক ওই দিনকে আনন্দের বানাতে হবে। তাই জোড়াতালি দিয়ে হলেই দিন শেষে ওই দিনকে আনন্দের প্রমাণ করার একটা প্রতিযোগিতা থাকত। আমাদের মধ্যে যে দুই শালিক দেখল, তার মনে একটা স্বস্তি আসত। যাক পরীক্ষার দিন হলে হয়তো পরীক্ষা ভালো হবে বা পরীক্ষা না থাকলে হয়তো অন্য কোনোভাবে দিনটা ভালো কাটবে। ওই দিনই আবার যে এক শালিক দেখেছে, সে তুলনা করা শুরু করত, ‘দেখ, তুই তো দুই শালিক দেখলি, দেখবি তোর পরীক্ষা ভালো হবে, আর আমার, এমনিতেই প্রিপারেশন খারাপ, তার মধ্যে দেখলাম এক শালিক, আমার আজকে খবর আছে।’
এখন এসব ভাবলে অবাক লাগে, আমরা বন্ধুরা আসলেই পাগল ছিলাম। কী ছেলেমানুষি সব চিন্তা আর কী সহজ-সরল জীবন।
তিনটা শালিক দেখলেও আনন্দের আর অপেক্ষার কমতি থাকত না। মোবাইল ফোনবিহীন তখনকার যুগ তো ছিল চিঠির যুগ। একটা চিঠি পাওয়া মানে পুরো দিন বা পুরো সপ্তাহটাই আনন্দে কাটা। ক্লাসের ফাঁকে হলে ফিরে বা ছুটির দিনে দুপুরবেলায় একটু ঘুমানোর সময় ছিল দাদুর চিঠি বিলানোর সময়। রুমে রুমে গিয়ে দরজার নিচে চিঠি বিলি করত দাদু। রুমে যার চিঠি আসত, তার চিৎকার আর খুশিতে বাকি রুমমেটদের ঘুমের বারোটা বেজে যেত। তাও একজনের আনন্দ সবার ভাগাভাগিতেও অন্য রকম আনন্দ থাকত। তাই তো তিনটা শালিক দেখলে মনের কোণে আশা জমত-হয়তো চিঠি আসবে আজ। তখন স্কুল-কলেজ জীবনের (বারো বছরের) আত্মার আত্মীয় সিলেটের বন্ধুদের মাত্রই ছেড়ে এসেছি, ওদেরও মন খারাপ, আমারও মন খারাপ, সব গল্প তাই চিঠিতেই হতো। হল-জীবনের প্রথম দিকে আমার সিলেটের বন্ধুদের চিঠি পেলে মনে হতো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। আর বাসা থেকে আম্মা কিংবা ভাইবোনের চিঠি এলে তো হাসি-কান্নার মাখামাখি থাকত।
চারটা শালিক দেখলে খুশির আর অপেক্ষার মাত্রা চরমে থাকত। ওই যে বললাম, তখনকার যুগে না ছিল মোবাইল ফোন, না ছিল ইন্টারনেট। ভাঙা কয়েন বক্সে টিপে ফোন করা বা নীলক্ষেতে গিয়ে ফোনের দোকান থেকে বাসায় ফোন করাই একমাত্র ভরসা ছিল। আর ছিল বিকেলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা, কেউ যদি দেখতে আসে। হলের গেট থেকে দাদু যদি একটা স্লিপ নিয়ে আসে-হোক না বাসার কেউ, কিংবা কোনো বন্ধু কিংবা বন্ধুদের কারও ফ্যামিলির কেউ। যে কেউ এলেই আমরা সব বন্ধু দল বেঁধে দেখা করতে, চানাচুর-ফুচকা খেতে বের হতাম। এই ঘোরাঘুরিতে আনন্দের শেষ ছিল না। শালিকময় রোকেয়া হল জীবনে এক শালিক দেখা ছাড়া বাকি সময়গুলোতে দুই, তিন বা চার শালিক দেখা মানেই কোনো না কোনোভাবে আনন্দে ভেসে যাওয়া। সত্যি হোক বা না হোক, বাস্তবে ঘটা ঘটনার সঙ্গে শালিকের সম্পর্ক মিলিয়ে ফেলার মতো ছেলেমানুষি আমাদের মধ্যে ভীষণভাবেই উপস্থিত ছিল।
তাই তো এই প্রবাস-জীবনের সকালবেলায় শালিক দেখে ঘর থেকে বের হলে পুরো সময়টা যতক্ষণ আমি ড্রাইভ করি বা বাসা থেকে অফিস করার সময়ে কোনো অফিশিয়াল কাজে মগ্ন থাকলে আসলে অবচেতন মনে আমার মাথায় রোকেয়া হল, রোকেয়া হলের সবুজ মাঠ, আমার হলের বন্ধুরা, আমাদের সকাল-বিকালের আড্ডা, ক্লাসে যাওয়া-আসার সময়টা, বিকেলে ঘুরতে যাওয়ার সময়টা কিংবা রোকেয়ার পদতলে বা ক্যানটিনে বা হলের গেটের সামনে বসে আড্ডা দেওয়ার সময়টা আর সঙ্গে সেই শালিকদের আনাগোনা আর কিচিরমিচির মাথায় ঘুরতে থাকে। এই ঘোরাঘুরিতে মাঝেমধ্যে ড্রাইভ করার সময় হঠাৎ করে রাস্তাও হারিয়ে ফেলি। কখনো জিপিএস বা কখনো নিজের মনই হঠাৎ করে টনক নাড়িয়ে দেয়। আমাকে যেন বলতে থাকে, ‘এই যে মহিলা সাবধান হন, আপনি এখন মধ্যবয়সী চাকরিজীবী নারী, গাড়ি চালাচ্ছেন, অফিসে যাচ্ছেন, অফিসের কাজ করছেন, আপনি মাথা ঝাড়ুন, বাস্তবে ফিরে আসুন।’
আমি বাধ্য হয়েই মাথা ঝাড়ি, নিষ্ঠুর বাস্তবে ফিরে আসি।
মনের জোর মানুষের চাইতে গাছপালারই হয়তো অনেক বেশি (আবোলতাবোল কথা হয়ে গেল, গাছের কি আর মন আছে? কিন্তু আমার যে এ রকমই চিন্তা করতে ভালো লাগে)।
সবুজ ঘাসে হঠাৎই দেখা যায় খরগোশ ঘোরাফেরা করছে, গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে কাঠবিড়ালি লাফিয়ে বেড়ায়। ঘুম থেকে উঠে জানালা খুলে দিলেই কিচিরমিচির পাখির শব্দ, বাসার সামনে বা পেছনে রঙিন গাছপালা কিংবা পাশের খেলার মাঠের সবুজ ঘাসে যখনই দেখি নানা রকম পাখির আনাগোনা, তখন আমার মন একমুহূর্তেই চলে যায় আমার প্রিয় দেশে, এখনকার বাংলাদেশে নয়, তখনকার বাংলাদেশে, আমার প্রিয় রোকেয়া হলের দিনগুলোতে। সেই রোকেয়া হলের মাঠে, সেই ইউনিভার্সিটির দিনগুলোতে।
আসলেই প্রকৃতির প্রতিটা সৌন্দর্যের সঙ্গে শৈশব বা তারুণ্যের এক অসাধারণ যোগসূত্র আছে, আমি পদে পদে সেই যোগসূত্র খুঁজে পাই। পেতেই থাকি। আমার শৈশব, আমার রোকেয়া হলের জীবন বারবার আমার কাছে ফিরে আসে। আনন্দের আর বৈচিত্র্যের সেই সব স্মৃতি ঘেঁটে অনায়াসে একজীবন পুরোটাই কাটানো যাবে।
রোকেয়া হলের সময়টাতে শালিক নিয়ে আমাদের একটু বাড়তি রকমের বাড়াবাড়ি ছিল বলতেই হবে। হলের বিশাল বড় সবুজ মাঠে নানা রকম পাখির সঙ্গে শালিকের কমতি ছিল না কখনোই। বন্ধুরা সবাই মিলে ক্লাসে যাওয়ার সময় সেই শালিক পাখি দেখে দিন কেমন যাবে সেটা নিয়ে কখনো অনেক সিরিয়াস হয়ে যাওয়া বা কখনো হাসি-তামাশা করাÑআমাদের নিত্যদিনের অভ্যাস ছিল।
ওয়ান ফর সরো,
টু ফর জয়,
থ্রি ফর লেটার্স,
ফোর ফর গেস্ট
-এই কথাগুলো ঠিক না বেঠিক, মিলল কি মিলল না, এ নিয়ে বিশ্লেষণ লেগেই থাকত।
‘সরো’, ‘জয়’, ‘লেটার্স’ কিংবা ‘গেস্ট’ সবগুলো শব্দই ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট ছিল বাবা-মা, ভাইবোনকে ফেলে দূরের শহরে হলে থাকা আমাদের সবার জীবনে। তাই বুঝে হোক বা না-বুঝেই হোক, মজা করে হোক বা সিরিয়াসলিই হোক, আমরা শালিক দেখার সঙ্গে নিজের দিন কেমন কাটবে, সেটা মেলানোর একটা চেষ্টা করতাম সব সময়ই।
এক শালিক দেখা মানেই আতঙ্ক ছিল। বিসনেস ফ্যাকাল্টিতে মিডটার্মের শেষ নেই। প্রতিটি সেমিস্টারে পাঁচটি করে কোর্সের প্রতিটি কোর্সেই দুটি করে মিডটার্ম আর সেমিস্টার ফাইনাল মিলিয়ে ছয় মাসে ১৫টা পরীক্ষা হতো। তাই আমাদের সেমিস্টারগুলো ছিল পরীক্ষাময়। মজার ব্যাপার হলো, এই শালিক দেখার সঙ্গে ভবিষ্যৎ মেলানো-জাতীয় কুসংস্কারে আমাদের মতো ‘সেলফ-সার্টিফায়েড স্মার্ট’ মেয়েরা কেউই বিশ্বাস করতাম না বলে দাবি করলেও কেন যেন পরীক্ষার সময়গুলোতে সকালে উঠে এক শালিক দেখার ভয়ে আমরা সবাই তটস্থ থাকতাম। অবাক ব্যাপার হলো, হাজার হাজার পাখি চারদিকে, তার পরও কেন যেন পরীক্ষার সময়ই এক শালিক চোখে পড়ত বারবার।
স্বপ্নার কথাগুলো এখনো কানে ভাসে, ‘দেখ তো রুমানা, এই অসভ্য শালিকটার কি কোনো কাজ নাই, সাতসকালে আমার সামনে পড়তেই হবে কেন, বল তো? এমনিতেই আমার প্রিপারেশন ভালো না, তার ওপর মরার শালিক চোখের সামনে এসে পড়ল।’ কিংবা আমার নিজেরই এক শালিক দেখে চোখ বন্ধ করে শালিককে না দেখার ভাণ করা আর মনে মনে সুরা জপতে শুরু করা। ইশ্্, কী ভয়ংকর সময় ছিল। আইরিন, খাঁদু, স্মৃতি, মলি-সবারই একই রকম ভয় ছিল, তবে খুকু একটু ডেসপারেট ছিল, মাঝেমধ্যে গালি দিতে দিতে দৌড়ে গিয়ে লাত্থি দিয়ে, না হয় হাতে থাকা ফাইল দিয়ে শালিককে তাড়াত।
দুটি শালিক দেখলে তো খুশির শেষ নেই। যেভাবেই হোক ওই দিনকে আনন্দের বানাতে হবে। তাই জোড়াতালি দিয়ে হলেই দিন শেষে ওই দিনকে আনন্দের প্রমাণ করার একটা প্রতিযোগিতা থাকত। আমাদের মধ্যে যে দুই শালিক দেখল, তার মনে একটা স্বস্তি আসত। যাক পরীক্ষার দিন হলে হয়তো পরীক্ষা ভালো হবে বা পরীক্ষা না থাকলে হয়তো অন্য কোনোভাবে দিনটা ভালো কাটবে। ওই দিনই আবার যে এক শালিক দেখেছে, সে তুলনা করা শুরু করত, ‘দেখ, তুই তো দুই শালিক দেখলি, দেখবি তোর পরীক্ষা ভালো হবে, আর আমার, এমনিতেই প্রিপারেশন খারাপ, তার মধ্যে দেখলাম এক শালিক, আমার আজকে খবর আছে।’
এখন এসব ভাবলে অবাক লাগে, আমরা বন্ধুরা আসলেই পাগল ছিলাম। কী ছেলেমানুষি সব চিন্তা আর কী সহজ-সরল জীবন।
তিনটা শালিক দেখলেও আনন্দের আর অপেক্ষার কমতি থাকত না। মোবাইল ফোনবিহীন তখনকার যুগ তো ছিল চিঠির যুগ। একটা চিঠি পাওয়া মানে পুরো দিন বা পুরো সপ্তাহটাই আনন্দে কাটা। ক্লাসের ফাঁকে হলে ফিরে বা ছুটির দিনে দুপুরবেলায় একটু ঘুমানোর সময় ছিল দাদুর চিঠি বিলানোর সময়। রুমে রুমে গিয়ে দরজার নিচে চিঠি বিলি করত দাদু। রুমে যার চিঠি আসত, তার চিৎকার আর খুশিতে বাকি রুমমেটদের ঘুমের বারোটা বেজে যেত। তাও একজনের আনন্দ সবার ভাগাভাগিতেও অন্য রকম আনন্দ থাকত। তাই তো তিনটা শালিক দেখলে মনের কোণে আশা জমত-হয়তো চিঠি আসবে আজ। তখন স্কুল-কলেজ জীবনের (বারো বছরের) আত্মার আত্মীয় সিলেটের বন্ধুদের মাত্রই ছেড়ে এসেছি, ওদেরও মন খারাপ, আমারও মন খারাপ, সব গল্প তাই চিঠিতেই হতো। হল-জীবনের প্রথম দিকে আমার সিলেটের বন্ধুদের চিঠি পেলে মনে হতো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। আর বাসা থেকে আম্মা কিংবা ভাইবোনের চিঠি এলে তো হাসি-কান্নার মাখামাখি থাকত।
চারটা শালিক দেখলে খুশির আর অপেক্ষার মাত্রা চরমে থাকত। ওই যে বললাম, তখনকার যুগে না ছিল মোবাইল ফোন, না ছিল ইন্টারনেট। ভাঙা কয়েন বক্সে টিপে ফোন করা বা নীলক্ষেতে গিয়ে ফোনের দোকান থেকে বাসায় ফোন করাই একমাত্র ভরসা ছিল। আর ছিল বিকেলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা, কেউ যদি দেখতে আসে। হলের গেট থেকে দাদু যদি একটা স্লিপ নিয়ে আসে-হোক না বাসার কেউ, কিংবা কোনো বন্ধু কিংবা বন্ধুদের কারও ফ্যামিলির কেউ। যে কেউ এলেই আমরা সব বন্ধু দল বেঁধে দেখা করতে, চানাচুর-ফুচকা খেতে বের হতাম। এই ঘোরাঘুরিতে আনন্দের শেষ ছিল না। শালিকময় রোকেয়া হল জীবনে এক শালিক দেখা ছাড়া বাকি সময়গুলোতে দুই, তিন বা চার শালিক দেখা মানেই কোনো না কোনোভাবে আনন্দে ভেসে যাওয়া। সত্যি হোক বা না হোক, বাস্তবে ঘটা ঘটনার সঙ্গে শালিকের সম্পর্ক মিলিয়ে ফেলার মতো ছেলেমানুষি আমাদের মধ্যে ভীষণভাবেই উপস্থিত ছিল।
তাই তো এই প্রবাস-জীবনের সকালবেলায় শালিক দেখে ঘর থেকে বের হলে পুরো সময়টা যতক্ষণ আমি ড্রাইভ করি বা বাসা থেকে অফিস করার সময়ে কোনো অফিশিয়াল কাজে মগ্ন থাকলে আসলে অবচেতন মনে আমার মাথায় রোকেয়া হল, রোকেয়া হলের সবুজ মাঠ, আমার হলের বন্ধুরা, আমাদের সকাল-বিকালের আড্ডা, ক্লাসে যাওয়া-আসার সময়টা, বিকেলে ঘুরতে যাওয়ার সময়টা কিংবা রোকেয়ার পদতলে বা ক্যানটিনে বা হলের গেটের সামনে বসে আড্ডা দেওয়ার সময়টা আর সঙ্গে সেই শালিকদের আনাগোনা আর কিচিরমিচির মাথায় ঘুরতে থাকে। এই ঘোরাঘুরিতে মাঝেমধ্যে ড্রাইভ করার সময় হঠাৎ করে রাস্তাও হারিয়ে ফেলি। কখনো জিপিএস বা কখনো নিজের মনই হঠাৎ করে টনক নাড়িয়ে দেয়। আমাকে যেন বলতে থাকে, ‘এই যে মহিলা সাবধান হন, আপনি এখন মধ্যবয়সী চাকরিজীবী নারী, গাড়ি চালাচ্ছেন, অফিসে যাচ্ছেন, অফিসের কাজ করছেন, আপনি মাথা ঝাড়ুন, বাস্তবে ফিরে আসুন।’
আমি বাধ্য হয়েই মাথা ঝাড়ি, নিষ্ঠুর বাস্তবে ফিরে আসি।