মৃত বসন্ত

প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৫৭ , অনলাইন ভার্সন
সাদিক ফ্যাক্স হাতে নিয়ে বসে আছে। সে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের সেলস ম্যানেজার। সে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সকাল আটটায় জামিলকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে বাসায় না গিয়ে অফিসে চলে এসেছে। রাস্তা প্রায় ফাঁকা ছিল, তাই সহজেই মতিঝিল অফিসে পৌঁছে গেছে। জামিলের সকাল ১১টার ফ্লাইট ছিল। নেপালে যাচ্ছে অফিসের কাজে। জামিলের স্ত্রীর আবার হার্টের সমস্যা। কীভাবে যে খবরটা দেবে! ফ্যাক্সে লেখা সবাই মারা গেছে। সাদিক কনফার্ম হওয়ার জন্য ফোন করে খবরটা যাচাই করে। খবর সঠিক।
সাদিক ভাবির ছোট বোন মেরিকে সঙ্গে নিয়ে সাদিকের বাসায় যায়। গেটের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ঠোঁট চেপে। মেরির দু’চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। দুজনই কেমন জানি দ্বিধাগ্রস্ত।
মেরি একদৌড়ে দোতলায় বড় বোনের বেডরুমে প্রবেশ করে। নিশাত বিছানায় বসে চা খাচ্ছে তখন। মেরির চোখের পানি দেখে নিশাত বুঝে যায়। নিশাত, জামিল ভাই... বলতে বলতে বোনকে জড়িয়ে ধরে মেরি। দুই বোনের কান্নাকাটির শব্দ বাইর থেকে সাদিক শুনতে পায়।
কিছুক্ষণ পর নিশাত উঠে দাঁড়ায়। পাশে জামিলের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। বোন বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। রুমের জানালার সামনে আরামকেদারা। ওখানে ধপাস করে বসে পড়ে সে। তারপর একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশের মেঘগুলোকে তুলতুলে বালিশের মতো লাগে। মনে হয়, ওখানে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ি। ভাবলেশহীন এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ কানে মধু ঢালে। বাগান রং-বেরঙের ফুলে ছেয়ে আছে। বসন্ত এসেছে।
নিশাত কেমন জানি ঘোরের মধ্যে চলে যায়। জামিলের মৃত্যুতে সে আনন্দিত না ব্যথিত, বুঝতে পারছে না। সে তার দুই হাতের দিকে তাকায়। হাত দুটো কেমন শুকিয়ে গেছে। ওর বয়স পঁয়ত্রিশ হয়নি অথচ দেখলে মনে হবে ৫০ বছর হয়ে গেছে। চেহারায় কোনো লাবণ্য নেই। জামিলকে সকালে বিদায় করে আরাম করে চা বানিয়ে বিছানায় বসে খায়। মনে হচ্ছিল কত বছর চা না খেয়ে আছে। ছোটবেলায় মা-বাবা মারা যাওয়ার পর মামার বাসায় বড় হয়েছে। দেখতে সুন্দর হওয়ায় এসএসসি পাস করার পর বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী জামিল ওর থেকে ১৫ বছরের বড় ছিল। বিয়ে নিয়ে ওর যা স্বপ্ন-কল্পনা ছিল, বিয়ের কয়েক দিন পর তা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ওই লোক বিয়ে করেনি, ঘরে একটা কাজের লোক এনেছে। ঘটকের কাছ থেকে মামা শোনেন, ছেলের অনেক টাকা, বড় বাড়ি আছে। রানির মতো থাকবে তোমাদের মেয়ে। এসব শুনে মামা বিয়ে দিয়ে দেন। জামিল মামার কাছ থেকে একটা জিনিসও গ্রহণ করেনি নিশাতকে ছাড়া। কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসে বিয়ে করে বউ নিয়ে যায়। নিশাতের তখন কত স্বপ্ন বাসর রাত নিয়ে। গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায় রাতের কথা চিন্তা করে।
নিশাততে নিয়ে ঘরে ঢোকার পর বন্ধুদের বিদায় দিয়ে রুমে ঢুকে বলে, ‘এই মেয়ে, কাপড় বদলে আসো।’ নিশাত কিছুটা কাঁপতে কাঁপতে ঘরে পরার শাড়ি বের করে বাথরুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই জামিল বলে, ‘এখানে বদলাও। আমি তো তোমার স্বামী। কোনো লজ্জা করলে হবে না।’
নিশাত দেয়ালের দিকে মুখ করে কাপড় বদলাতে শুরু করলে জামিল চেঁচিয়ে বলে, ‘আমার দিকে ঘুরে কাপড় বদলাও।’ নিশাত তখন রীতিমতো কাঁপছে!
ঘরের শাড়ি পরতে গেলে জামিল বাধা দেয়। বলে, ‘এখন বিছানায় যাও। শুয়ে পড়ো। আমি আসছি।’
সারা রাত নিশাতের শরীরের ওপর তাণ্ডব চলে আর নিশাতের চোখ বেয়ে পানি ঝরে। ‘তোমার শরীরটা সত্যি খাসা।’ বলে জামিল পাশ ফিরে ঘুমিয়ে যায়। নিশাত আস্তে করে উঠে বাথরুমে গিয়ে গোসল সারে। বাকি রাতটুকু জেগে কাটায়।
সকাল সাতটায় জামিলের ঘুম ভাঙে। সে উঠে দেখে নিশাত বারান্দায় বসে আছে স্থির হয়ে। নিশাত লক্ষ করে, বাসায় কোনো কাজের লোক নেই।
-এখানে বসে আছ কেন? নাশতা বানিয়েছ?
-আমি তো জানি না কোথায় কী আছে?
-রান্নাঘরে যাও, সব পেয়ে যাবে। পরোটা আর ডিমভাজি করবে। তার আগে আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যাও। আর শোনো, আর যেন আমাকে বলতে না হয় প্রতিদিন এক কথা।
জামিল ব্যবসা করে। কী ব্যবসা করে নিশাত জানে না। জিজ্ঞেস করলে বলে, তার জানার দরকার নেই। 
দিনরাত রান্না, কাপড় ধোয়া, ঘর পরিষ্কার করা, থালাবাসন ধোয়াÑএসব কাজ করতে করতে ওর দিন যায়। গোসল করে একটু খেয়ে যখন বিছানায় গা গড়ায়, সে সময় জামিল এসে হাজির হয়। জামিল ঘরে ঢুকে যখন দেখে নিশাত বিছানায়, তখন সে চিৎকার করে ওঠে। বলে, ‘মহারানিকে পালছি মৌজ করার জন্য।’
সারা রাতের ভোগ ও সারা দিনের কাজ করতে করতে ওকে দেখতে বয়স্কদের মতো লাগে। চেহারায় বলিরেখা পড়ে যায়। এর মধ্যে একদিন প্রচণ্ড বুকব্যথা হলে ও নিজেই ট্যাক্সি নিয়ে হাসপাতালে যায়। পরে জামিল জানতে পেরে হাসপাতালে আসে।
ডাক্তার জানায়, হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। রোগীকে বিশ্রামে থাকতে হবে। সে সময় নিশাত ১০ দিন হাসপাতালে ছিল। নিশাতের তখন মনে হচ্ছিল, সে বেহেশতে আছে। বাসায় ঢোকার সময় জামিল বলে, ‘বাগানে অনেক দিন পানি দেওয়া হয়নি। আজকে না হয়, কাল পানি দিয়ে দিয়ো।’ নিশাত ভেবেছিল, এবার হয়তো কাজের লোক নেওয়ার কথা বলবে।
শুরু হলো আবার একই রুটিন।
দরজায় ধাক্কার শব্দ হচ্ছে। মেরি চিৎকার করে ওকে ডাকছে, ‘এতক্ষণ কী করছিস? দরজা খোল।’
নিশাতের চোখের নিচে কালির দাগ। গতকালও তার মনে হচ্ছিল তার জীবনটা এত বড় কেন? অথচ এখন মনে হচ্ছে, জীবনটা অনেক সুন্দর। এখন বসন্ত শুরু হয়েছে। পৃথিবী ঝলমল করছে। মনে হচ্ছে, মন থেকে আনন্দ বাইরে ছিটকে পড়বে। তবে সে কাঁদতেও পারছে না, আবার হাসতেও। শরীরটা হালকা লাগছে। কিছুক্ষণ কেদারায় মুখ গুঁজে পড়ে থাকে সে। তারপর মুখ উঠিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। আরে একি, আকাশে রং-বেরঙের অনেক তারা ঝলমল করছে। নীল আকাশ চোখে একটা ঠান্ডা আমেজ বুলিয়ে দিচ্ছে। মনের ভেতর থেকে কে যেন চিৎকার দিয়ে বলছে, আমি স্বাধীন! আমি স্বাধীন! আমি স্বাধীন। সে যে এই খবরে এত আনন্দিত, সেটা সে বোনকে দেখাতে চায় না।
কেদারা থেকে সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।
‘আপা, দরজা খোল। আপা, তুমি মারা যাবে, আপা।’ কী হলো বলে মেরি চেঁচাতে থাকে। নিশাত ভাবলেশহীন চেহারায় দরজা খোলে। তারপর বোনের কোমর জড়িয়ে মুখ নিচু করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। মূল দরজা দিয়ে বেরিয়ে ওরা তিনজন বাইরে বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কোনো কথা বলে না।
হঠাৎ বাগানের মাঝের মূল ফটক খোলার শব্দ হয়। ফটকের সামনে জামিল। আরে বোলো না, নয়টার ফ্লাইট ক্রাশ করেছে আর আমাদের চার ঘণ্টা বসিয়ে রেখে ফ্লাইট ক্যানসেল করেছে। জামিল ঢুকতে ঢুকতে মেরির তীক্ষ- চিৎকারে জামিল মেরির দিকে তাকায়। নিশাত মাটিতে পড়ে আছে।
ডাক্তার এসে নিশাতকে পরীক্ষা করে। তারপর জামিলকে বলে, স্বামীর মৃত্যুসংবাদের পর ওকে জীবিত দেখে অতি আনন্দে নিশাতের হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে।
-নিউইয়র্ক, ৮ এপ্রিল ২০২৪
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041