এপ্রিল মাস আমেরিকার কবিতার মাস।
১৯৯৬ সালে এপ্রিলকে আমেরিকার জাতীয় কবিতার মাস হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। তার পর থেকেই আমেরিকার সর্বত্র যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে এপ্রিলকে কবিতার মাস হিসেবে পালন করা হয়। কবিতাকে সর্ববিস্তারী করে তোলার জন্য পুরো একটি মাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে মুখর হয়ে থাকে কবি ও কবিতার কর্মশালা।
কবিতা কী? আমরা কবিতা কেন পড়ি এবং কেন লিখি? প্রশ্নটি ছোট হলেও তার অর্থ অনেক ব্যাপক। যিনি সৃষ্টি করেন, তাকে যেমন স্রষ্টা বলা হয়; কবিতা যিনি লেখেন তাকে কবি বলা হয়। কবির দায়িত্ব সৃষ্টি করা। সৃজনে মননে সাহিত্যের সুশীল ছায়ায় সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে মানুষের জন্য কবিতাকে ছড়িয়ে দেওয়া।
সভ্যতার উষালগ্ন থেকে মননশীল মানুষের মেধা ও মননের উৎকর্ষ ঘটেছে। মানুষের ভেতর সৃষ্টিতত্ত্বের প্রবল সৃজনশীল ক্ষমতা জগৎকে পরিশীলিত ও পরিমার্জিত করে তুলেছে। মানুষের চেতনায় আধুনিক মনন ও বিজ্ঞানমনস্ক মনোজগতের আবির্ভাব ঘটেছে। সাহিত্য-সংস্কৃতির গতিময়তায় কবিতার বিকাশমান ধারাটিও মানবসংস্কৃতির একটি অন্যতম অংশ হয়ে প্রতিষ্ঠিত।
আমরা জানি, ছন্দময় লেখনীর ঔজ্জ্বল্যে যুগে যুগে এই পৃথিবীর সৃষ্টিকুল এবং মানুষের জন্য ছন্দময় পঙ্্ক্তি সাজিয়ে কবিতার ফরম্যাট তৈরি হয়।
সেই শক্তির বলয়ে অন্তরস্পর্শী লেখার মধ্য দিয়ে কবি যা লেখেন, সেটিই কবিতা। এই গুরুদায়িত্বটি কবির ওপরই বেশি বর্তায়। রাষ্ট্রপুঞ্জ যেমন জনকল্যাণের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তেমনি কবির সৃষ্টিশীল রচনা কবিতা হয়ে পাঠকের জন্য অনুকরণীয় নীতিমালা সৃষ্টি করা হয়। উদাহরণস্বরূপ কবি ও সাহিত্যিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথা অনুপাতে বলতে হয়, ‘একজন কবি যখন নিজের মুক্তির কথা লিখছেন, তা পড়ে অন্যরাও মুক্তি অনুভব করছে। কবি তো সরস্বতীর সঙ্গে দায়িত্বতার চুক্তি করে লিখতে বসছেন না। তবে কবির দায়বদ্ধতা থাকে কবিতার প্রতি, নিজের প্রতি।’
কবিকে সর্বদা আত্মমগ্ন থাকতে হয়। আমি মনে করি, কবিকে অবশ্যই সৃষ্টিশীলতার গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি রেখে স্বনির্মিতির ওপর অটল ও অবিচল থাকতে হবে। কবি মূলত বিত্তহীন। তার মূল সম্পদ হচ্ছে তার সৃষ্টিকর্ম ও নিজস্ব কাব্যবোধ। কবিতার গুণে এবং মহত্ত্বের দ্বারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে একজন কবির কাছে মানুষ ও প্রকৃতি হচ্ছে আসল চিন্তার উৎস। কবিতা চিরকালই একজন কবির মনন ও চেতনায় সৃজনশীলতার প্রকৃষ্ট সম্পদ। আমি মনে করি, মানুষের পক্ষে নিঃস্বার্থ ও নিরপেক্ষতার নিঃশর্ত ঘোষণা দিয়েই কবি তার কাব্যরচনা করেন। একজন প্রকৃত কবির কাজ মূলত তা-ই। কেননা কবিতা সর্বদাই জীবন্ময় ও মানুষের জীবনের শক্তিময়তার জোগানদাতা। কবিকে তার সৃষ্টিশীল কবিতার মাধ্যমে সেটি আয়ত্ত করে নিতে হয়।
একটি ভালো কবিতা একজন দৃঢ়চেতা বিশ্বাসী মানুষের মতো। বিশ্বাসী মানুষের সান্নিধ্য লাভ করতে যেমন সবাই চায়, তেমনি একটি ভালো কবিতাও পাঠক আশা করে। যে কবিতা মানুষের স্বপ্ন-সম্ভাবনা ও আশার দুয়ার খুলে দেয়। মোটকথা, একটি ভালো কবিতা পাঠ করার মধ্য দিয়ে আমরা সত্যিকারভাবে বিশ্বাসের আলো পেতে পারি। সেই কবিতা সবাই প্রত্যাশা করে। একটি ভালো কবিতা বিশ্বাসের দীপ্তিকে অবারিত করে। মানবচৈতন্যে আনন্দ ও পরিতৃপ্তির খোরাক জোগায়। একটি ভালো কবিতার যে আনন্দ আছে, তৃপ্তি আছে; একজন সত্যিকার কাব্যপ্রেমী মানুষই তার অনুভব ও উপলব্ধির মধ্য দিয়ে ঋদ্ধ হন এবং সিক্ত হয়ে ওঠেন।
কবিকে আমি আলোকিত মানুষ মনে করি। যিনি আগামীকে দেখেন এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য লিখে যান। একজন প্রকৃত কবিকে যখন সত্যিকার মানুষ হিসেবে পেয়ে যাই, তখন আনন্দের সীমা থাকে না। কবি সর্বদাই চক্ষুষ্মান ও সত্যান্বেষী। তাকে সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকতে হয়। সত্যের নিরন্তর অন্বেষণ হচ্ছে কবির প্রধান দায়িত্ব ও কাজ। সত্যানুসন্ধানের মধ্য দিয়ে কবি সর্বদা মানুষ ও প্রকৃতির ভবিষ্যৎ পথনির্দেশনার কাজটি করতে পারেন।
কবির মধ্যে মানবিক ও প্রাকৃতিক উভয় দিকের সাম্যদর্শন আছে, যা দ্বারা তিনি অনাগত ও ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। কবির মাঝে প্রেম, বিরহ-বেদনা, দ্রোহ, বিদ্রƒপ ও প্রতিবাদের প্রখর চেতনাবোধ থাকে। ওই চেতনার মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবী, মানুষ ও প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেন। মানুষকে ভালোবাসেন এবং কবিতার বাণী দিয়ে ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ করেন। কবিতার মাসের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আমাদের আমেরিকার কবিতা ও কবিদের দিকেই তাকানো উচিত। আমেরিকায় হাজার বছর ধরেই চলে আসছে কবিতার চাষ। শিক্ষা, সামাজিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য আমেরিকার সর্বত্র শিল্প-সাহিত্যের কদর আছে। কবিতার গতিময়তা এবং সর্বব্যাপী কবিতাকে সর্বত্র গ্রহণযোগ্য করে তোলার নিরন্তর প্রয়াসে এপ্রিল মাসকে কবিতার মাস বলা হয়। কবিতার জাগরণে আমেরিকায় এপ্রিল মাসে নানাবিধ কার্যক্রম বিদ্যমান।
কবিকে ইতিহাসের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়। পূর্বগামী কবির কাছ থেকে স্পৃহাবোধ সংগ্রহ করে তিনি নিজের কবিতাটিকে ভবিষ্যৎ নিয়তির ওপর ছেড়ে দিতে উদ্যত হন। কবিতার মধ্য দিয়ে প্রেম, বিরহ, দ্রোহ ও ভালোবাসার পথ সৃষ্টি করেন। কবিতার স্থিতি ও পরিমিতির মধ্য দিয়ে কবিকে যেমন প্রেম ও রোমান্টিকতা আস্বাদন করতে হয়, তেমনি মানুষের স্বার্থেই কবিকে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে হয়। কবিতার স্পষ্ট উচ্চারণের মধ্য দিয়ে বৈষম্যের পরিবর্তে তাকে সাম্যের পথ নির্ণয় করে দিতে হয়।
কবি ও কবিতাকে বিচার করতে হলে অপরের সৃজনের প্রতি সম্মানবোধ থাকতে হবে। যিনি এটি করতে পারেন, মূলত তিনিই উত্তম মানুষ।
কবিকে তার কবিতার অসম্ভব বীজগুলো সবার জন্য উজাড় করে দিতে হয়। এভাবেই কবিতা মানুষের মধ্যে প্রেম, মমত্ববোধ এবং অপার ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে। আমেরিকা-ইউরোপসহ পৃথিবীর সকল কবির কাব্যচর্চার মূল ভিত্তি সেটি। কেননা উপলব্ধি ও অনুভবের ছোঁয়ায় কবি কাব্য সৃষ্টির প্রবল স্পৃহা ও প্রেরণা পান। এ জন্য কবিতায় আত্মমগ্নতা একটা জরুরি বিষয়। সাহিত্যের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কবি তৃপ্ত ও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেন।
আমাদের ক্ষীণায়মান জীবনে সর্বদা যে নৈরাশ্যের ছাপ থাকে; সেই নৈরাশ্য থেকে রক্ষাকল্পে উন্নত ব্যবহারের মানুষের ছায়াঘন স্পর্শই পৃথিবী, প্রকৃতি ও মানুষের অনেক দিন বাঁচার সুযোগ করে দেয়। ঘনিষ্ঠতা এবং আত্মার মিলনের মধ্য দিয়ে মূলত মানুষ স্মরণীয় হয়ে থাকে। যতই অন্ধকারে থাকি না কেন, সাহিত্যের মাঝে সত্যিকার আলোর আবাসটুকুই আমাদের ছায়া মায়া দেয়। বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়।
রবার্ট ফ্রস্ট আমেরিকার বিখ্যাত কবিদের অন্যতম। কবিতার মাস হিসেবে এখানে রবার্ট ফ্রস্টের একটি কবিতার কিয়দংশ-যেমন ‘দ্য রোড নট টেকেন’ (যে পথে যাইনি আমি) নামে একটি বিখ্যাত কবিতা এ রকম :
‘দুটো পথ : একটি হরিদ্রাভ মসৃণ
আরেকটি গিয়েছে বনখণ্ডের মধ্য দিয়ে। আমি
একই সঙ্গে দুটো পথে চলতে পারি না। তাই
যতদূর চোখ যায়-
দাঁড়িয়ে দেখলাম
একটি পথ ঘন আগাছায় ভরা জনপদ চিহ্নহীন!
অন্য পথটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন-
আরও রয়েছে
মানুষের পায়ে হাঁটার স্বাক্ষর।
উভয় পথেই সকালের মিষ্টি রোদ পড়েছেÑ
কিন্তু যে পথে কেউ কখনো পা রাখেনি
আমি সে-পথটিই বেছে নিলাম।’
রবার্ট ফ্রস্টের কবিতায় জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার দৃপ্ত অঙ্গীকার আছে। কঠিনতম দিনে দুর্গম পথের যাত্রী হয়েও তিনি প্রচুর রোমান্টিক কবিতা লিখেছেন। তেমন একটি কবিতা :
‘একুয়েন্টেড উইথ দ্য নাইট’
‘নিশিরাতের সঙ্গী’
‘আমি তো এখন নিশিরাত (নিশাচর) সঙ্গী বৃষ্টিতে ভিজে আবার ফিরে এসেছি বৃষ্টির মাঝে
পার হয়ে গেছি শহরের দূরতম শহরের প্রদীপ
স্বচক্ষে দেখেছি দুঃখক্লিষ্ট অলিগলি সরুপথ দায়িত্ব পালন করেছি দারোয়ানের পাশে
সব কথা গোপন রেখেছি দু’চোখের পাতায়...
শুভ অথবা অশুভ এটাই এখনকার প্রদীপ
অথচ,
এখনো আমি নিশাচর হয়ে নিশুত রাতের সঙ্গী।’
এই হচ্ছে রবার্ট ফ্রস্টের জীবন ও কর্মের কিছুটা দৃষ্টান্ত। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও যিনি জীবনকে বিচিত্রভাবে উপভোগ করেছেন। সমাজ-রাষ্ট্রে তার ভূমিকা রেখেছেন। রবার্ট ফ্রস্টের জীবন ও কর্মের কঠিনতম দিকগুলো তাকে আরও বেশি স্পষ্ট করে তোলে। মাটি, মানুষ ও দেশাত্মবোধের প্রবল স্পৃহা নিয়ে তিনি আজীবন কাব্যসাধনা করেছেন। কবিতার মধ্য দিয়েই তিনি বিশ্বে খ্যাতিমান হয়েছেন।
এই পৃথিবী তো একটি পান্থশালা। এখানে পথের টানে জীবনের পানেই মূলত আমরা ছুটে চলি। কখনো পিছিয়ে গেলেও আলোর পথের সন্ধানেই যেন জীবন অতিবাহিত হয়। তাই তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কলি মনে পড়ে :
‘পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে।
পিছিয়ে পড়েছি আমি, যাব যে কী করে।
এসেছে নিবিড় নিশি, পথরেখা গেছে মিশি-
সাড়া দাও, সাড়া দাও আঁধারের ঘোরে।’
আরেকটি কবিতায় তিনি পথের কূলকিনারা নিয়ে বলেন :
‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!
এত কামনা, এত সাধনা কোথায় মেশে।
ঢেউ ওঠে-পড়ে কাদার সম্মুখে ঘন আঁধার
পার আছে কোন্ দেশে।’
তেমনি মানবতার কবি; দ্রোহ, বিরহ ও রোমান্টিকতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়ও আমরা মানবজীবনের সকল চৈতন্য ও ঐশ্বর্যের সন্ধান পাই। প্রেম-বিরহ, দ্রোহ, মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য প্রতিবাদের দীক্ষা পাই। তিনি নারী-পুরুষের মিলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে আত্ম-অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করার দাবি করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
‘নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, ক্ষুধায় সুধায় মিলে
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে।’
আরেক জায়গায় নারী-পুরুষের (স্বামী-স্ত্রী) রহস্য-রোমাঞ্চের কথা তিনি অকপটে উচ্চারণ করেন :
‘পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,
কামিনী এনেছে যামিনী শান্তি, সমীরণ বারিদাহ।
দিবসে শক্তি সাহস, নিশীথে হয়েছে বধূ,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে, নারী যোগায়েছে মধু।’
কবিতার কোনো স্থান-কাল-পাত্র নেই। পৃথিবীর যেকোনো বিষয়াবৃত্তিতেই কবিতার স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ রয়েছে।
আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্ট বাংলার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় সমসাময়িক। রবীন্দ্রনাথের কাব্যপ্রতিভার প্রতি রবার্ট ফ্রস্টের সম্মানবোধ ছিল। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে রবার্ট ফ্রস্ট আমেরিকান টেলিভিশনে এক ভাষণে রবীন্দ্রনাথের প্রতি সম্মান জানিয়েছিলেন। কথাটি এ জন্য উচ্চরণ করলাম, কবিতাকে কোনো সীমায়িত গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা যায় না। কবিতা সব সময় সর্বব্যাপী ও সর্ববিস্তারী। আমরা চাই, বাংলা কবিতার জগতে সেই কাব্যবোধ সর্ববিস্তারী হয়ে উঠুক। বাংলা সাহিত্যের সম্প্রসারণে কবিদেরকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। আমেরিকায় কবিতার মাস প্রসঙ্গে আসা যাক। আমেরিকা দেশটি যেমন অনেক বড়, তেমনি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও ঐতিহ্যের স্বকীয়তায় এই দেশটি বিখ্যাত হয়ে আছে। এখানকার শিল্প-সাহিত্য যেমন উন্নত, তেমনি কবিতাও ব্যাপক এবং সর্ববিস্তারী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র উন্নততর শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যোগসূত্রতা ঘটিয়ে কবিতাকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়ে সর্বব্যাপী কবিতার প্রতি গুরুত্ব দিয়েই এপ্রিল মাসকে কবিতার মাস হিসেবে পালন করা হয়। কবিতার মাস উপলক্ষে আমেরিকার দুজন বিখ্যাত কবির কবিতার উদ্ধৃতি ও প্রসঙ্গ তুলে এই লেখা শেষ করতে চাই।
একজন কবিকে বিখ্যাত হতে হলে অনেক কবিতার দরকার হয় না। অসংখ্য কাব্যসম্ভারের মধ্যে দু-চারটি উল্লেখযোগ্য কবিতাই তাকে খ্যাতিমান করে তুলতে পারে। লুইস এলিজাবেথ গ্লিক ২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পাওয়া একজন প্রখ্যাত আমেরিকান কবি। ১৯৪৩ সালের ২২ এপ্রিল তিনি নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। স্বাভাবিক জীবনের চৈতন্যের ওপর সহজ ও সাবলীল পরিমিতিবোধের মধ্য দিয়েই তিনি একজন সত্যিকার কবি হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। জীবনকে সর্বসাধারণের আকরে সাজিয়ে তিনি তার অপার কাব্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। যেখানে প্রেম আছে, রোমান্টিকতা ও দেশাত্মবোধের শিক্ষা আছে। আরও আছে দ্রোহ ও প্রতিবাদের ভাষা।
‘হ্যাপিনেস’ ‘সুখ’ নামক একটি রোমান্টিক কবিতায় তিনি বলেন :
‘দুজন মানুষ (স্ত্রী-পুরুষ) শুয়ে আছে রাত্রিনিশিতে
সাদা বিছানায় মাখামাখি দুজন-দুজনায়
ভোরের স্নিগ্ধতায় সহসাই ভাঙবে তাদের ঘুম
সজ্জা-শিয়রের ফুলদানিতে
শোভামান একগুচ্ছ লিলিÑ
ওদের সর্বাঙ্গে পড়েছে
সূর্যের মোহময় আলো...
পুরুষটি পাশ ফেরে;
মৃদুস্বরে প্রিয় সঙ্গিনীকে করে আলিঙ্গন
সহসাই দুলে উঠল সুখের পর্দা, স্নিগ্ধ বাতায়নে
বাহিরে পাখির কলতান।
এবার নারীটিও পাশ ফেরে, সর্বাঙ্গের উষ্ণতাপে
প্রিয় সঙ্গীর নিঃশ্বাসে দুজনায়
একাকার হয়ে যায়...’
এই কবিতার মধ্য দিয়ে লুইস গ্লিক মানুষের জীবন্ময়তার রহস্যাবৃত রোমান্টিকতাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। আধুনিক কবিতার ধাঁচে গ্লিক রোমান্টিকতার লিরিক্যাল পঙ্্ক্তিতে তিনি কবিতাকে উন্নত ক্ল্যাসিকধর্মী করে তুলতেও কার্পণ্য করেননি। বিশ্বসাহিত্যের নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে লুইস গ্লিক ষোড়শতম নারী। তিনি তার কবিতাকে শুধু আত্মজৈবনিক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখেননি। সর্বজনীন মানবতাবোধের অন্বেষণে লুইসের কবিতা ঈর্ষণীয় দৃষ্টান্ত রেখেছে। তিনি শুধু কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও গদ্য লিখেও তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন।
বিশাল জনসংখ্যা-অধ্যুষিত পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্র আমেরিকায় প্রবীণ কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে বর্তমানে তরুণ প্রজন্মও কবিতার ভুবনে অগ্রসরমান।
বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত টলটলায়মান ও বিধ্বস্তপ্রায় বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন জো বাইডেন। ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত এবং সর্বালোচিত ছিল লস অ্যাঞ্জেলেসে জন্মগ্রহণকারী ২২ বছর বয়সী তরুণী উদীয়মান কবি আমান্ডা গোরম্যানের কবিতা। গোরম্যানের কণ্ঠে নিজের লেখা কবিতা The Hill We Climb-এর আবৃত্তি ছিল একটি চমক। এবং একই সঙ্গে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ভোরের স্নিগ্ধ হিমশীতল হোয়াইট হাউসের মুক্তাঙ্গনে সেদিনের সে অনুষ্ঠান উপভোগ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ সমগ্র বিশ্ববাসী। আমেরিকার ২২ বছর বয়সী এই তরুণতম কবি আমান্ডার কবিতাটি ইতিমধ্যে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।
বলাবাহুল্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইউনিগ্রেশন/অভিষেক অনুষ্ঠানে দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত কবির কবিতা পাঠ করার সূচনা হয় প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে জন এফ কেনেডির অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রথম কবিতা পড়েন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবি রবার্ট ফ্রস্ট। সেদিনের প্রাতস্নাত স্নিগ্ধ ভোরের সূর্যালোকে রবার্ট ফ্রস্ট দুটি কবিতা পড়ে যেমন আলোড়ন সৃষ্টি করেন, তেমনি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের এক উদীয়মন কবি আমান্ডা গোরম্যান ছয় মিনিটের মতো নিজ রচিত কবিতা পাঠ করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতসর্বস্ব যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলার চক্রান্তে ২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলে সংঘটিত সর্বাধিক নিন্দিত ও লজ্জাজনক ঘটনাপ্রবাহের পর আমান্ডা গোরম্যান দ্বিধাগ্রস্ত মনে লেখা শুরু করেন।
বলাবাহুল্য, অভিষেক অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগের দিন বিশেষভাবে উদ্বেলিত, শঙ্কিত ও উৎকণ্ঠিত মনে এক রাতেই কবিতাটি লেখা সম্পন্ন হয়। ‘The Hill We Climb’ কবিতাটিতে ‘গোরম্যান’ বর্ণবৈষম্য, মানববিধ্বংসী যুদ্ধ ও সন্ত্রাস এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ আর সহিংসতার বিরুদ্ধে আমেরিকাকে একতা, সংহতি আর মানবতার প্রতি সহমর্মিতার আহ্বান জানানোর সুযোগ করে দেয় :
‘যখন সুদিন আসবে, আমরা আলো-আঁধারির ছায়া থেকে বেরিয়ে আসব বিপুল দীপ্তিতে প্রজ্বলিত ও নির্ভীকরূপে।
একটি নতুন ভোরের সূচনা হবে আমরা যখন একে মুক্ত করি।
কারণ, প্রতিদিনকার আলোর পরশ নিত্য বিরাজমান, যদি আমরা সে দৃশ্য দেখার মতো সাহসী হয়ে উঠি।’
প্রায় ছয় মিনিট স্থায়ী ৭২৩ শব্দের দীর্ঘ কবিতাটি শুরু হয় একটি তীব্র প্রশ্নের মাধ্যমে :
‘যখন দিবস আসে নিজেকে শুধাই,
আলো কোথায় পাই এ অফুরান ছায়ায়?’
৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলের সন্ত্রাসী আক্রমণকে তিনি বর্ণনা করেন, ‘একটি শক্তি, যা আমাদের জাতিকে এক করার বদলে করতে পারে দ্বিখণ্ডিত। তারপর তিনি দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘গণতন্ত্রকে সাময়িক বিলম্বিত করা যেতে পারে, কখনো পরাজিত করা যাবে না।’
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েট আমান্ডা গোরম্যান ২০১৭ সালে আমেরিকার জাতীয় যুবকবি পুরস্কার লাভ করেন। তার প্রথম বই ‘The One for Whom Food is Not Enough’ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। তিনি ২০১৩ সালে জাতিসংঘে পাকিস্তানের নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাইর ভাষণ শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
তারপর ২০২০ সালে আমেরিকান ফার্স্ট লেডি ‘জিল বাইডেন’ এর বিশেষ রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে ২২ বছরের তরুণী কবি আমান্ডা গোরম্যান প্রেসিডেন্ট অভিষেকে পাঠ করেন ‘The Hill We Climb’ ‘যে পাহাড় আমরা জয় করি’।
কবিতার মধ্য দিয়ে ঘোষিত হয় :
‘আমাদের অবশ্যই সকল ভেদাভেদ দূর করতে হবে।
আমরা অস্ত্র নামিয়ে অন্যজনের প্রতি যেন বাড়িয়ে দিতে পারি আমাদের উদার হাত।
আমরা কারও ক্ষতি চাই না, বরং চাই সবার মেলবন্ধন।
আমরা অবশ্যই আর পেছনে যাব না ফিরে, এগিয়ে যাব আগামীর পথে।
কোনো ভয় দেখিয়ে আমাদের সত্যপথ থেকে ফেরানো যাবে না, বাধা দিতে পারবে না,
যখন দিবস আসবে, আমরা আঁধারের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসব প্রদীপ্ত, প্রজ্বলিত ও নির্ভীক রূপে।
একটি নতুন ভোরের সূচনা হবে, যখন আমরা তাকে মুক্ত করব।
কারণ প্রতিদিনকার প্রদীপ্ত আলো নিত্য বিরাজমান, যদি আমরা তা যেন দেখার মতো সাহসী হই।’
২২ বছর বয়সী এক তরুণী ওয়াশিংটন ডিসির হোয়াইট হাউসে বহুল আলোচিত অভিষেকে উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং তাদের পাশাপাশি টেলিভিশনে যোগ দেওয়া বিশ্বের অসংখ্য মানুষকে নিজের লেখা কবিতার দুর্দমনীয় শব্দ ঝংকারের মাধ্যমে ‘দ্য হিল উই ক্লাইম্ব’ কবিতাটি শুনিয়েছেন।
পৃথিবীর মানুষের ধ্বংসসীমানার এক কঠিন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ কবি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বকনিষ্ঠ তরুণী (২২) কবি আমান্ডা গোরম্যান। নিজের কবিতা কবিদের মধ্যে তিনিই তখনকার বিশ্বে সবচেয়ে চমকিত ও আলোচিত হয়ে ওঠেন। ঐতিহাসিক অভিষেক অনুষ্ঠানে পাঁচ মিনিট স্থায়ী ৭২৩ শব্দের কবিতাটির মাধ্যমে সমগ্র দুনিয়ায় ছুড়ে মারেন এক বজ্রকঠিন প্রশ্ন :
‘যখন দিবস আসে, আমরা নিজেদের কাছে জানতে চাই, এই শেষ না হওয়া ছায়ার মাঝে কোথায় এবং কীভাবে আমরা খুঁজে পাবো আলো?’
যার কবিতার ছন্দে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করে দেয় পৃথিবীর রাষ্ট্রপুঞ্জের শাসকদের। সমগ্র বিশ্বে চমক সৃষ্টি হয়। সমর্থকদের হামলার প্রসঙ্গও উঠে আসে আমান্ডার কবিতায়।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একচোখা শাসনপ্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার রেজাল্টকে না মেনে অপশক্তির আস্ফালনের মুখে যখন হোয়াইট হাউস আক্রান্ত (!) হয়, তখন সমগ্র বিশ্বকে চমকে দেয় আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী গোরম্যনের কবিতা।
‘আমরা এমন শক্তি দেখেছি, যা আমাদের ভূখণ্ড, আমাদের রাষ্ট্রকে সবার মাঝে বিলিয়ে না দিয়ে
চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে, গণতন্ত্রকে বিলম্বিত না পেরে দেশকে করে দেবে ধ্বংস।
আমরা জেগে উঠব সূর্যালোক-শোভিত দিগন্তে
আমরা পুনর্গঠন করব, পুনর্মিলন ঘটাব এবং পুনরুদ্ধার করব আমাদের জাতির প্রতিটি পরিচিত প্রতিটি প্রান্তে..
আমাদের বর্ণিল বৈচিত্র্যময়, সুন্দর জনগোষ্ঠী পরিণত হবে পরিপক্বতায় এবং ছায়াময় সুন্দরে
যখন সুদিন আসবে, আমরা আঁধার ছায়া থেকে দীপ্তির পথে বেরিয়ে আসব প্রজ্বলিত ও নির্ভীক রূপে।
এমন চেষ্টা প্রায় সফলও হয়েছিল। গণতন্ত্র হয়তো সময়ে সময়ে বিলম্বে আসতে পারে, কিন্তু তাকে কভু স্থায়ীভাবে পরাজিত করা যাবে না।’
নিজের সুদীর্ঘ কবিতার বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা দেন তরুণতম কবি আমান্ডা গোরম্যান।
এপ্রিল মাস আমেরিকার শুধু কবিতার মাসই নয়, এ মাসটি শরতের স্নিগ্ধছোঁয়ায় গাছে গাছে ফুল ফোটার মাস। গ্রীষ্মের নিদাঘশোভায় কবিতার ছন্দময়তায় নিবিষ্টচিত্তে ধ্যানমগ্ন হওয়ার মাস।
বাংলা নববর্ষ : ভারতবর্ষের বাদশাহ আকবর প্রথমে বাংলা নববর্ষের গোড়াপত্তন করেন। তিনি বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে ভারতের বাংলা ভাষাভাষী এবং সকল জনগণের আনন্দোৎসব হিসেবে আরবি মাসের হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে নতুন বছরের নীতি ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে বছরের সাল তামামিরূপে ব্যবসায়ী বছরান্তের হিসাব-নিকাশের ইতি টানার ব্যবস্থা চালু হয়। এ ছাড়া ভারতের প্রজাসাধারণের কৃষি এবং অন্যান্য পণ্যের খাজনা আদায়ের নিয়মটিও তখন থেকে চালু করা হয়। পরবর্তী সময়ে সকল সম্রাট একই নিয়মে পহেলা বৈশাখ পালন করতেন।
সম্রাট আকবর মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশমতে রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌর সন এবং আরবির ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা-পদ্ধতি কার্যকর করা হয় সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে ‘বঙ্গাব্দ’ অর্থাৎ বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও কালের পরিবর্তনে সেসব ঐতিহ্যগাথা ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে পার্শ্বকালচারের অনেক অযাচিত বিষয় যুক্ত হয় বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে!
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। বছরের শেষান্তে জনগণকে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করার নিয়ম বাধ্যতামূলক চালু হয়। তার পরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।
নতুন বছর শুরুর আগেই শুভ হালখাতার প্রচলন রয়েছে। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বইকে বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরোনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকেন। বাংলাদেশে এই প্রথাটি এখনো অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানসহ ছোট-বড় সব দোকানে এখনো চালু আছে। যদিও বর্তমানে পহেলা বৈশাখ উদ্্যাপনের ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলার লোকজ সত্তা এবং আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও ইতিহাসের দিকটির প্রতি অবশ্যই নজর রাখা উচিত, যেন বাংলার মানুষের ভেতরকার ঐতিহ্যবোধ, সুশীল ধর্মবোধ ও সংস্কৃতিবোধের আসল সত্তা বিনষ্ট না হয়।
এপ্রিল মাস বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ এবং বৈশাখের ঝড়বিদগ্ধ উত্তাপের মাস। আবহমান কাল থেকে পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। বাংলার মুসলমান-হিন্দু-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধসহ সবাইকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার শাশ্বত উৎসব এই পহেলা বৈশাখ। কালের পরিবর্তনে এ উৎসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা ধরনের উপাদান। গ্রাম-বাংলায় শাশ্বত নিয়মে বহু পদের সবজি নিরামিষ, পিঠাপুলি, মাংস-পোলাওয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে পান্তা-ইলিশের আয়োজন। এসব খাওয়াখাওয়ির প্রতিযোগিতায় শিশু-কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীসহ আবাল বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও। গ্রাম-বাংলার বাজারঘাটের দোকানে দোকানে নানা রকম মিষ্টি-মিষ্টান্নের থাকে রমরমা আয়োজন। পার্কে, উদ্যানে শিশু-কিশোরীর খেলাধুলার মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে আনন্দমেলা।
বৈশাখকে অনেকে কল্পনা করেন যুগ পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে। পুরোনো বছরের অসুখ-বিসুখ, ব্যথা-ব্যর্থতা, জরাজীর্ণতাকে উতরে প্রেম-বিরহ ও ভালোবাসার নির্যাসে, খেতে-খামারে শস্যে-সঙ্গীতে, সুখ-শান্তির মিলিত উচ্ছ্বাসে যেন ভরিয়ে নতুন বছরকে দেখতে চান। বৈশাখের নবধারায় দুর্বার আহ্বান।
বাংলা সাহিত্যে বৈশাখ নিয়ে কবি-সাহিত্যিকদের বিস্তর লেখা রয়েছে। বৈশাখ আসে তাদের কাছে রুদ্ররূপে। কিন্তু সেই রুদ্ররূপে তারা বিচলিত নন। বরং বৈশাখের কালবৈশাখীর জন্য উচ্ছ্বসিত ও আশা-প্রত্যাশায় উদ্্গ্রীব হয়ে থাকেন। গাছগাছালির জীর্ণ পাতারা ঝরঝর করে ঝরে পড়ে। গজিয়ে ওঠে নবপল্লবে। খুশিতে আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে বাংলার জনপদ। চেতনার কবি কাজী নজরুল তাই গর্জে ওঠেন সন্ধ্যা কাব্যের ‘কাল-বৈশাখী’ কবিতায় তার স্বভাবসিদ্ধ অগ্নিঝরা কণ্ঠে :
‘বারেবারে যথা কাল-বৈশাখী ব্যর্থ হল রে পুব-হাওয়ায়
দধীচি-হাড়ের বজ্র-বহ্নি বারেবারে যথা নিভিয়া যায়,
কে পাগল সেথা যাস হাঁকি-
বৈশাখী কাল-বৈশাখী!
হেথা বৈশাখী-জ্বালা আছে শুধু, নাই বৈশাখী-ঝড় হেথায়
সে জ্বালায় শুধু নিজে পুড়ে মরি, পোড়াতে কারেও পারিনে, হায়।’
কবি আক্ষেপ করেন, বৈশাখ তার কাছে প্রকৃত রুদ্ররূপ ধরে আবির্ভূত হয়নি বলেই সারা দেশ আজও পুরাতন জংধরা জরাজীর্ণতায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে। এখানে তার আক্ষেপ ও ক্ষোভ প্রকাশ পায় এভাবে :
‘কাল-বৈশাখী আসেনি হেথায়, আসিলে মোদের তরু-শিরে
সিন্ধু-শকুন বসিত না আসি’ ভিড় করে আজ নদীতীরে।
জানি না কবে সে আসিবে ঝড়
ধূলায় লুটাবে শত্রুগড়,
আজিও মোদের কাটেনি ক’ শীত, আসেনি ফাগুন বন ঘিরে।
আজিও বলির কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়া উঠেনি মন্দিরে।
জাগেনি রুদ্র, জাগিয়াছে শুধু অন্ধকারের প্রমথ-দল,
ললাট-অগ্নি নিভেছে শিবের ঝরিয়া জটার গঙ্গাজল।
জাগেনি শিবানী-জাগিয়াছে শিবা,
আঁধার সৃষ্টি-আসেনি ক’ দিবা,
এরি মাঝে হায়, কাল-বৈশাখী স্বপ্ন দেখিলে কে তোরা বল।
আসে যদি ঝড়, আসুক, কুলোর বাতাসকে দিবি অগ্রে চল।’
একইভাবে রবীন্দ্রনাথও বৈশাখকে রুদ্ররূপে অবলোকন করেছেন। কল্পনা কাব্যের ‘বৈশাখ’ কবিতায় বৈশাখকে তার সরাসরি সম্বোধন এ নামেই :
‘হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ,
ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,
তপঃ ক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল
কারে দাও ডাক-
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ?
জ্বলিতেছে সম্মুখে তোমার
লোলুপ চিতাগ্নিশিখা লেহি লেহি বিরাট অম্বর-
নিখিলের পরিত্যক্ত মৃত স্তূপ বিগত বৎসর
করি ভস্মসার-
চিতা জ্বলে সম্মুখে তোমার।
কবিতার শুরুতেই কবি বৈশাখের রুক্ষরূপ তুলে ধরেছেন। কিন্তু তিনি নজরুলের মতো বৈশাখের বজ্রকঠিন আঘাতের পক্ষপাতী নন। স্রেফ নির্বিঘ্ন শান্তির প্রার্থনায় তিনি মগ্ন হয়ে আছেন :
‘হে বৈরাগী, করো শান্তিপাঠ।
উদার উদাস কণ্ঠ যাক ছুটে দক্ষিণে ও বামে-
যাক নদী পার হয়ে, যাক টলি গ্রাম হতে গ্রামে,
পূর্ণ করি মাঠ।
হে বৈরাগী, করো শান্তিপাঠ।
দুঃখ সুখ আশা ও নৈরাশ
তোমার ফুৎকারক্ষুব্ধ ধুলাসম উড়ুক গগনে,
ভরে দিক নিকুঞ্জের স্খলিত ফুলের গন্ধ-সনে
আকুল আকাশ-
দুঃখ সুখ আশা ও নৈরাশ।
ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ!’
বৈশাখকে নিয়ে অসংখ্য গানও রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বর্ষবরণের এ গানটি এখন বাঙালির প্রাণের সংগীত :
‘এসো এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।’
রবীন্দ্র-নজরুলের পর বাংলা ভাষায় পহেলা বৈশাখকে নিয়ে যারা দীর্ঘতম কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ফররুখ আহমদ অন্যতম। রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে বসে তিনি ‘বৈশাখ’ ও ‘বৈশাখের কালো ঘোড়া’ নামে যে দুটি কবিতা রচনার মাধ্যমে বৈশাখের কবিতায় নতুন মাত্রা দান করেছেন। এসব কবিতা কিছুটা রবীন্দ্রনাথের আদলে রচিত হলেও ভিন্নতর বার্তা ও আলাদা কণ্ঠস্বর ধারণ করে আছে ফররুখ আহমদের ‘বৈশাখ’ কবিতাটি। তিনিও এখানে বৈশাখকে দেখেছেন রুদ্ররূপে। বৈশাখ কবির কাছে মহাশক্তির প্রতীক, যা মহাকল্যাণ সাধনের জন্যই আবির্ভূত হয়েছে মর্ত্য।ে শুরুতেই কবি বৈশাখকে সম্বোধন করেছেন এভাবে :
‘ধ্বংসের নকীব তুমি হে দুর্বার, দুর্ধর্ষ বৈশাখ
সময়ের বালুচরে তোমার কঠোর কণ্ঠে
শুনি আজ অকুণ্ঠিত প্রলয়ের ডাক।’
কিন্তু তিনি যখন এ রকম করে বলেন :
‘রোজ হাশরের দগ্ধ তপ্ত তাম্র মাঠ, বন, মৃত্যুপুরী, নিস্তব্ধ নির্বাক;
সুরে ইস্রাফিল কণ্ঠে পদ্মা মেঘনার তীরে
এসো তুমি হে দৃপ্ত বৈশাখ।’
একইভাবে ‘ঝড়’ নামক দীর্ঘ কবিতায় ফররুখের দৃপ্ত উচ্চারণ :
‘হে বন্য বৈশাখী ঝড়! হে দুর্গম! দীবন-মৃত্যুর
হিংস্র পটভূমিকায় ভ্রাম্যমাণ, তুমি যাযাবর,
পাড়ি দিয়ে যেতে চাও মহাবিশ্ব, দূরান্ত সুদূর!...’
...
‘হে বন্য বৈশাখী ঝড়! গতিস্রোত প্রমত্ত ভয়াল
ধ্বংসের নেশায় মাতি, যৌবনের উল্লাসে নির্মম
পাড়ি দাও অনায়াসে ফেন-ক্ষুব্ধ সমুদ্র উত্তাল...’
বাংলা নতুন বছরের শুরুতে আমাদের ভেতরকার সত্যান্বেষণ, সত্যানুসন্ধান ও সত্যবোধই হয় যেন পথচলার পাথেয়। সাহিত্যের নিখুঁত পরিচর্যায় কবিতার মিলিত উচ্ছ্বাসে নিবিড় একাত্মতায় গড়ে উঠুক সবার আনন্দভুবন।
বিশ্বব্যাপী মানববিধ্বংসী যুদ্ধবিগ্রহ সকল প্রকাশ দুর্যোগ ও ভয়তাড়িত শঙ্কা কাটিয়ে পৃথিবীর মানুষ আবার জেগে উঠুক নব উদ্যমে। নির্মল আনন্দধারায় সবার জীবন হয়ে উঠুক সুখময়। জয় হোক মানবতার। জয় হোক কবিতার।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
১৯৯৬ সালে এপ্রিলকে আমেরিকার জাতীয় কবিতার মাস হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। তার পর থেকেই আমেরিকার সর্বত্র যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে এপ্রিলকে কবিতার মাস হিসেবে পালন করা হয়। কবিতাকে সর্ববিস্তারী করে তোলার জন্য পুরো একটি মাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে মুখর হয়ে থাকে কবি ও কবিতার কর্মশালা।
কবিতা কী? আমরা কবিতা কেন পড়ি এবং কেন লিখি? প্রশ্নটি ছোট হলেও তার অর্থ অনেক ব্যাপক। যিনি সৃষ্টি করেন, তাকে যেমন স্রষ্টা বলা হয়; কবিতা যিনি লেখেন তাকে কবি বলা হয়। কবির দায়িত্ব সৃষ্টি করা। সৃজনে মননে সাহিত্যের সুশীল ছায়ায় সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে মানুষের জন্য কবিতাকে ছড়িয়ে দেওয়া।
সভ্যতার উষালগ্ন থেকে মননশীল মানুষের মেধা ও মননের উৎকর্ষ ঘটেছে। মানুষের ভেতর সৃষ্টিতত্ত্বের প্রবল সৃজনশীল ক্ষমতা জগৎকে পরিশীলিত ও পরিমার্জিত করে তুলেছে। মানুষের চেতনায় আধুনিক মনন ও বিজ্ঞানমনস্ক মনোজগতের আবির্ভাব ঘটেছে। সাহিত্য-সংস্কৃতির গতিময়তায় কবিতার বিকাশমান ধারাটিও মানবসংস্কৃতির একটি অন্যতম অংশ হয়ে প্রতিষ্ঠিত।
আমরা জানি, ছন্দময় লেখনীর ঔজ্জ্বল্যে যুগে যুগে এই পৃথিবীর সৃষ্টিকুল এবং মানুষের জন্য ছন্দময় পঙ্্ক্তি সাজিয়ে কবিতার ফরম্যাট তৈরি হয়।
সেই শক্তির বলয়ে অন্তরস্পর্শী লেখার মধ্য দিয়ে কবি যা লেখেন, সেটিই কবিতা। এই গুরুদায়িত্বটি কবির ওপরই বেশি বর্তায়। রাষ্ট্রপুঞ্জ যেমন জনকল্যাণের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তেমনি কবির সৃষ্টিশীল রচনা কবিতা হয়ে পাঠকের জন্য অনুকরণীয় নীতিমালা সৃষ্টি করা হয়। উদাহরণস্বরূপ কবি ও সাহিত্যিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথা অনুপাতে বলতে হয়, ‘একজন কবি যখন নিজের মুক্তির কথা লিখছেন, তা পড়ে অন্যরাও মুক্তি অনুভব করছে। কবি তো সরস্বতীর সঙ্গে দায়িত্বতার চুক্তি করে লিখতে বসছেন না। তবে কবির দায়বদ্ধতা থাকে কবিতার প্রতি, নিজের প্রতি।’
কবিকে সর্বদা আত্মমগ্ন থাকতে হয়। আমি মনে করি, কবিকে অবশ্যই সৃষ্টিশীলতার গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি রেখে স্বনির্মিতির ওপর অটল ও অবিচল থাকতে হবে। কবি মূলত বিত্তহীন। তার মূল সম্পদ হচ্ছে তার সৃষ্টিকর্ম ও নিজস্ব কাব্যবোধ। কবিতার গুণে এবং মহত্ত্বের দ্বারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে একজন কবির কাছে মানুষ ও প্রকৃতি হচ্ছে আসল চিন্তার উৎস। কবিতা চিরকালই একজন কবির মনন ও চেতনায় সৃজনশীলতার প্রকৃষ্ট সম্পদ। আমি মনে করি, মানুষের পক্ষে নিঃস্বার্থ ও নিরপেক্ষতার নিঃশর্ত ঘোষণা দিয়েই কবি তার কাব্যরচনা করেন। একজন প্রকৃত কবির কাজ মূলত তা-ই। কেননা কবিতা সর্বদাই জীবন্ময় ও মানুষের জীবনের শক্তিময়তার জোগানদাতা। কবিকে তার সৃষ্টিশীল কবিতার মাধ্যমে সেটি আয়ত্ত করে নিতে হয়।
একটি ভালো কবিতা একজন দৃঢ়চেতা বিশ্বাসী মানুষের মতো। বিশ্বাসী মানুষের সান্নিধ্য লাভ করতে যেমন সবাই চায়, তেমনি একটি ভালো কবিতাও পাঠক আশা করে। যে কবিতা মানুষের স্বপ্ন-সম্ভাবনা ও আশার দুয়ার খুলে দেয়। মোটকথা, একটি ভালো কবিতা পাঠ করার মধ্য দিয়ে আমরা সত্যিকারভাবে বিশ্বাসের আলো পেতে পারি। সেই কবিতা সবাই প্রত্যাশা করে। একটি ভালো কবিতা বিশ্বাসের দীপ্তিকে অবারিত করে। মানবচৈতন্যে আনন্দ ও পরিতৃপ্তির খোরাক জোগায়। একটি ভালো কবিতার যে আনন্দ আছে, তৃপ্তি আছে; একজন সত্যিকার কাব্যপ্রেমী মানুষই তার অনুভব ও উপলব্ধির মধ্য দিয়ে ঋদ্ধ হন এবং সিক্ত হয়ে ওঠেন।
কবিকে আমি আলোকিত মানুষ মনে করি। যিনি আগামীকে দেখেন এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য লিখে যান। একজন প্রকৃত কবিকে যখন সত্যিকার মানুষ হিসেবে পেয়ে যাই, তখন আনন্দের সীমা থাকে না। কবি সর্বদাই চক্ষুষ্মান ও সত্যান্বেষী। তাকে সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকতে হয়। সত্যের নিরন্তর অন্বেষণ হচ্ছে কবির প্রধান দায়িত্ব ও কাজ। সত্যানুসন্ধানের মধ্য দিয়ে কবি সর্বদা মানুষ ও প্রকৃতির ভবিষ্যৎ পথনির্দেশনার কাজটি করতে পারেন।
কবির মধ্যে মানবিক ও প্রাকৃতিক উভয় দিকের সাম্যদর্শন আছে, যা দ্বারা তিনি অনাগত ও ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। কবির মাঝে প্রেম, বিরহ-বেদনা, দ্রোহ, বিদ্রƒপ ও প্রতিবাদের প্রখর চেতনাবোধ থাকে। ওই চেতনার মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবী, মানুষ ও প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেন। মানুষকে ভালোবাসেন এবং কবিতার বাণী দিয়ে ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ করেন। কবিতার মাসের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আমাদের আমেরিকার কবিতা ও কবিদের দিকেই তাকানো উচিত। আমেরিকায় হাজার বছর ধরেই চলে আসছে কবিতার চাষ। শিক্ষা, সামাজিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য আমেরিকার সর্বত্র শিল্প-সাহিত্যের কদর আছে। কবিতার গতিময়তা এবং সর্বব্যাপী কবিতাকে সর্বত্র গ্রহণযোগ্য করে তোলার নিরন্তর প্রয়াসে এপ্রিল মাসকে কবিতার মাস বলা হয়। কবিতার জাগরণে আমেরিকায় এপ্রিল মাসে নানাবিধ কার্যক্রম বিদ্যমান।
কবিকে ইতিহাসের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়। পূর্বগামী কবির কাছ থেকে স্পৃহাবোধ সংগ্রহ করে তিনি নিজের কবিতাটিকে ভবিষ্যৎ নিয়তির ওপর ছেড়ে দিতে উদ্যত হন। কবিতার মধ্য দিয়ে প্রেম, বিরহ, দ্রোহ ও ভালোবাসার পথ সৃষ্টি করেন। কবিতার স্থিতি ও পরিমিতির মধ্য দিয়ে কবিকে যেমন প্রেম ও রোমান্টিকতা আস্বাদন করতে হয়, তেমনি মানুষের স্বার্থেই কবিকে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে হয়। কবিতার স্পষ্ট উচ্চারণের মধ্য দিয়ে বৈষম্যের পরিবর্তে তাকে সাম্যের পথ নির্ণয় করে দিতে হয়।
কবি ও কবিতাকে বিচার করতে হলে অপরের সৃজনের প্রতি সম্মানবোধ থাকতে হবে। যিনি এটি করতে পারেন, মূলত তিনিই উত্তম মানুষ।
কবিকে তার কবিতার অসম্ভব বীজগুলো সবার জন্য উজাড় করে দিতে হয়। এভাবেই কবিতা মানুষের মধ্যে প্রেম, মমত্ববোধ এবং অপার ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে। আমেরিকা-ইউরোপসহ পৃথিবীর সকল কবির কাব্যচর্চার মূল ভিত্তি সেটি। কেননা উপলব্ধি ও অনুভবের ছোঁয়ায় কবি কাব্য সৃষ্টির প্রবল স্পৃহা ও প্রেরণা পান। এ জন্য কবিতায় আত্মমগ্নতা একটা জরুরি বিষয়। সাহিত্যের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কবি তৃপ্ত ও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেন।
আমাদের ক্ষীণায়মান জীবনে সর্বদা যে নৈরাশ্যের ছাপ থাকে; সেই নৈরাশ্য থেকে রক্ষাকল্পে উন্নত ব্যবহারের মানুষের ছায়াঘন স্পর্শই পৃথিবী, প্রকৃতি ও মানুষের অনেক দিন বাঁচার সুযোগ করে দেয়। ঘনিষ্ঠতা এবং আত্মার মিলনের মধ্য দিয়ে মূলত মানুষ স্মরণীয় হয়ে থাকে। যতই অন্ধকারে থাকি না কেন, সাহিত্যের মাঝে সত্যিকার আলোর আবাসটুকুই আমাদের ছায়া মায়া দেয়। বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়।
রবার্ট ফ্রস্ট আমেরিকার বিখ্যাত কবিদের অন্যতম। কবিতার মাস হিসেবে এখানে রবার্ট ফ্রস্টের একটি কবিতার কিয়দংশ-যেমন ‘দ্য রোড নট টেকেন’ (যে পথে যাইনি আমি) নামে একটি বিখ্যাত কবিতা এ রকম :
‘দুটো পথ : একটি হরিদ্রাভ মসৃণ
আরেকটি গিয়েছে বনখণ্ডের মধ্য দিয়ে। আমি
একই সঙ্গে দুটো পথে চলতে পারি না। তাই
যতদূর চোখ যায়-
দাঁড়িয়ে দেখলাম
একটি পথ ঘন আগাছায় ভরা জনপদ চিহ্নহীন!
অন্য পথটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন-
আরও রয়েছে
মানুষের পায়ে হাঁটার স্বাক্ষর।
উভয় পথেই সকালের মিষ্টি রোদ পড়েছেÑ
কিন্তু যে পথে কেউ কখনো পা রাখেনি
আমি সে-পথটিই বেছে নিলাম।’
রবার্ট ফ্রস্টের কবিতায় জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার দৃপ্ত অঙ্গীকার আছে। কঠিনতম দিনে দুর্গম পথের যাত্রী হয়েও তিনি প্রচুর রোমান্টিক কবিতা লিখেছেন। তেমন একটি কবিতা :
‘একুয়েন্টেড উইথ দ্য নাইট’
‘নিশিরাতের সঙ্গী’
‘আমি তো এখন নিশিরাত (নিশাচর) সঙ্গী বৃষ্টিতে ভিজে আবার ফিরে এসেছি বৃষ্টির মাঝে
পার হয়ে গেছি শহরের দূরতম শহরের প্রদীপ
স্বচক্ষে দেখেছি দুঃখক্লিষ্ট অলিগলি সরুপথ দায়িত্ব পালন করেছি দারোয়ানের পাশে
সব কথা গোপন রেখেছি দু’চোখের পাতায়...
শুভ অথবা অশুভ এটাই এখনকার প্রদীপ
অথচ,
এখনো আমি নিশাচর হয়ে নিশুত রাতের সঙ্গী।’
এই হচ্ছে রবার্ট ফ্রস্টের জীবন ও কর্মের কিছুটা দৃষ্টান্ত। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও যিনি জীবনকে বিচিত্রভাবে উপভোগ করেছেন। সমাজ-রাষ্ট্রে তার ভূমিকা রেখেছেন। রবার্ট ফ্রস্টের জীবন ও কর্মের কঠিনতম দিকগুলো তাকে আরও বেশি স্পষ্ট করে তোলে। মাটি, মানুষ ও দেশাত্মবোধের প্রবল স্পৃহা নিয়ে তিনি আজীবন কাব্যসাধনা করেছেন। কবিতার মধ্য দিয়েই তিনি বিশ্বে খ্যাতিমান হয়েছেন।
এই পৃথিবী তো একটি পান্থশালা। এখানে পথের টানে জীবনের পানেই মূলত আমরা ছুটে চলি। কখনো পিছিয়ে গেলেও আলোর পথের সন্ধানেই যেন জীবন অতিবাহিত হয়। তাই তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কলি মনে পড়ে :
‘পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে।
পিছিয়ে পড়েছি আমি, যাব যে কী করে।
এসেছে নিবিড় নিশি, পথরেখা গেছে মিশি-
সাড়া দাও, সাড়া দাও আঁধারের ঘোরে।’
আরেকটি কবিতায় তিনি পথের কূলকিনারা নিয়ে বলেন :
‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!
এত কামনা, এত সাধনা কোথায় মেশে।
ঢেউ ওঠে-পড়ে কাদার সম্মুখে ঘন আঁধার
পার আছে কোন্ দেশে।’
তেমনি মানবতার কবি; দ্রোহ, বিরহ ও রোমান্টিকতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়ও আমরা মানবজীবনের সকল চৈতন্য ও ঐশ্বর্যের সন্ধান পাই। প্রেম-বিরহ, দ্রোহ, মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য প্রতিবাদের দীক্ষা পাই। তিনি নারী-পুরুষের মিলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে আত্ম-অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করার দাবি করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
‘নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, ক্ষুধায় সুধায় মিলে
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে।’
আরেক জায়গায় নারী-পুরুষের (স্বামী-স্ত্রী) রহস্য-রোমাঞ্চের কথা তিনি অকপটে উচ্চারণ করেন :
‘পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,
কামিনী এনেছে যামিনী শান্তি, সমীরণ বারিদাহ।
দিবসে শক্তি সাহস, নিশীথে হয়েছে বধূ,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে, নারী যোগায়েছে মধু।’
কবিতার কোনো স্থান-কাল-পাত্র নেই। পৃথিবীর যেকোনো বিষয়াবৃত্তিতেই কবিতার স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ রয়েছে।
আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্ট বাংলার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় সমসাময়িক। রবীন্দ্রনাথের কাব্যপ্রতিভার প্রতি রবার্ট ফ্রস্টের সম্মানবোধ ছিল। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে রবার্ট ফ্রস্ট আমেরিকান টেলিভিশনে এক ভাষণে রবীন্দ্রনাথের প্রতি সম্মান জানিয়েছিলেন। কথাটি এ জন্য উচ্চরণ করলাম, কবিতাকে কোনো সীমায়িত গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা যায় না। কবিতা সব সময় সর্বব্যাপী ও সর্ববিস্তারী। আমরা চাই, বাংলা কবিতার জগতে সেই কাব্যবোধ সর্ববিস্তারী হয়ে উঠুক। বাংলা সাহিত্যের সম্প্রসারণে কবিদেরকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। আমেরিকায় কবিতার মাস প্রসঙ্গে আসা যাক। আমেরিকা দেশটি যেমন অনেক বড়, তেমনি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও ঐতিহ্যের স্বকীয়তায় এই দেশটি বিখ্যাত হয়ে আছে। এখানকার শিল্প-সাহিত্য যেমন উন্নত, তেমনি কবিতাও ব্যাপক এবং সর্ববিস্তারী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র উন্নততর শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যোগসূত্রতা ঘটিয়ে কবিতাকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়ে সর্বব্যাপী কবিতার প্রতি গুরুত্ব দিয়েই এপ্রিল মাসকে কবিতার মাস হিসেবে পালন করা হয়। কবিতার মাস উপলক্ষে আমেরিকার দুজন বিখ্যাত কবির কবিতার উদ্ধৃতি ও প্রসঙ্গ তুলে এই লেখা শেষ করতে চাই।
একজন কবিকে বিখ্যাত হতে হলে অনেক কবিতার দরকার হয় না। অসংখ্য কাব্যসম্ভারের মধ্যে দু-চারটি উল্লেখযোগ্য কবিতাই তাকে খ্যাতিমান করে তুলতে পারে। লুইস এলিজাবেথ গ্লিক ২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পাওয়া একজন প্রখ্যাত আমেরিকান কবি। ১৯৪৩ সালের ২২ এপ্রিল তিনি নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। স্বাভাবিক জীবনের চৈতন্যের ওপর সহজ ও সাবলীল পরিমিতিবোধের মধ্য দিয়েই তিনি একজন সত্যিকার কবি হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। জীবনকে সর্বসাধারণের আকরে সাজিয়ে তিনি তার অপার কাব্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। যেখানে প্রেম আছে, রোমান্টিকতা ও দেশাত্মবোধের শিক্ষা আছে। আরও আছে দ্রোহ ও প্রতিবাদের ভাষা।
‘হ্যাপিনেস’ ‘সুখ’ নামক একটি রোমান্টিক কবিতায় তিনি বলেন :
‘দুজন মানুষ (স্ত্রী-পুরুষ) শুয়ে আছে রাত্রিনিশিতে
সাদা বিছানায় মাখামাখি দুজন-দুজনায়
ভোরের স্নিগ্ধতায় সহসাই ভাঙবে তাদের ঘুম
সজ্জা-শিয়রের ফুলদানিতে
শোভামান একগুচ্ছ লিলিÑ
ওদের সর্বাঙ্গে পড়েছে
সূর্যের মোহময় আলো...
পুরুষটি পাশ ফেরে;
মৃদুস্বরে প্রিয় সঙ্গিনীকে করে আলিঙ্গন
সহসাই দুলে উঠল সুখের পর্দা, স্নিগ্ধ বাতায়নে
বাহিরে পাখির কলতান।
এবার নারীটিও পাশ ফেরে, সর্বাঙ্গের উষ্ণতাপে
প্রিয় সঙ্গীর নিঃশ্বাসে দুজনায়
একাকার হয়ে যায়...’
এই কবিতার মধ্য দিয়ে লুইস গ্লিক মানুষের জীবন্ময়তার রহস্যাবৃত রোমান্টিকতাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। আধুনিক কবিতার ধাঁচে গ্লিক রোমান্টিকতার লিরিক্যাল পঙ্্ক্তিতে তিনি কবিতাকে উন্নত ক্ল্যাসিকধর্মী করে তুলতেও কার্পণ্য করেননি। বিশ্বসাহিত্যের নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে লুইস গ্লিক ষোড়শতম নারী। তিনি তার কবিতাকে শুধু আত্মজৈবনিক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখেননি। সর্বজনীন মানবতাবোধের অন্বেষণে লুইসের কবিতা ঈর্ষণীয় দৃষ্টান্ত রেখেছে। তিনি শুধু কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও গদ্য লিখেও তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন।
বিশাল জনসংখ্যা-অধ্যুষিত পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্র আমেরিকায় প্রবীণ কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে বর্তমানে তরুণ প্রজন্মও কবিতার ভুবনে অগ্রসরমান।
বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত টলটলায়মান ও বিধ্বস্তপ্রায় বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন জো বাইডেন। ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত এবং সর্বালোচিত ছিল লস অ্যাঞ্জেলেসে জন্মগ্রহণকারী ২২ বছর বয়সী তরুণী উদীয়মান কবি আমান্ডা গোরম্যানের কবিতা। গোরম্যানের কণ্ঠে নিজের লেখা কবিতা The Hill We Climb-এর আবৃত্তি ছিল একটি চমক। এবং একই সঙ্গে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ভোরের স্নিগ্ধ হিমশীতল হোয়াইট হাউসের মুক্তাঙ্গনে সেদিনের সে অনুষ্ঠান উপভোগ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ সমগ্র বিশ্ববাসী। আমেরিকার ২২ বছর বয়সী এই তরুণতম কবি আমান্ডার কবিতাটি ইতিমধ্যে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।
বলাবাহুল্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইউনিগ্রেশন/অভিষেক অনুষ্ঠানে দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত কবির কবিতা পাঠ করার সূচনা হয় প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে জন এফ কেনেডির অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রথম কবিতা পড়েন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবি রবার্ট ফ্রস্ট। সেদিনের প্রাতস্নাত স্নিগ্ধ ভোরের সূর্যালোকে রবার্ট ফ্রস্ট দুটি কবিতা পড়ে যেমন আলোড়ন সৃষ্টি করেন, তেমনি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের এক উদীয়মন কবি আমান্ডা গোরম্যান ছয় মিনিটের মতো নিজ রচিত কবিতা পাঠ করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতসর্বস্ব যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলার চক্রান্তে ২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলে সংঘটিত সর্বাধিক নিন্দিত ও লজ্জাজনক ঘটনাপ্রবাহের পর আমান্ডা গোরম্যান দ্বিধাগ্রস্ত মনে লেখা শুরু করেন।
বলাবাহুল্য, অভিষেক অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগের দিন বিশেষভাবে উদ্বেলিত, শঙ্কিত ও উৎকণ্ঠিত মনে এক রাতেই কবিতাটি লেখা সম্পন্ন হয়। ‘The Hill We Climb’ কবিতাটিতে ‘গোরম্যান’ বর্ণবৈষম্য, মানববিধ্বংসী যুদ্ধ ও সন্ত্রাস এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ আর সহিংসতার বিরুদ্ধে আমেরিকাকে একতা, সংহতি আর মানবতার প্রতি সহমর্মিতার আহ্বান জানানোর সুযোগ করে দেয় :
‘যখন সুদিন আসবে, আমরা আলো-আঁধারির ছায়া থেকে বেরিয়ে আসব বিপুল দীপ্তিতে প্রজ্বলিত ও নির্ভীকরূপে।
একটি নতুন ভোরের সূচনা হবে আমরা যখন একে মুক্ত করি।
কারণ, প্রতিদিনকার আলোর পরশ নিত্য বিরাজমান, যদি আমরা সে দৃশ্য দেখার মতো সাহসী হয়ে উঠি।’
প্রায় ছয় মিনিট স্থায়ী ৭২৩ শব্দের দীর্ঘ কবিতাটি শুরু হয় একটি তীব্র প্রশ্নের মাধ্যমে :
‘যখন দিবস আসে নিজেকে শুধাই,
আলো কোথায় পাই এ অফুরান ছায়ায়?’
৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলের সন্ত্রাসী আক্রমণকে তিনি বর্ণনা করেন, ‘একটি শক্তি, যা আমাদের জাতিকে এক করার বদলে করতে পারে দ্বিখণ্ডিত। তারপর তিনি দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘গণতন্ত্রকে সাময়িক বিলম্বিত করা যেতে পারে, কখনো পরাজিত করা যাবে না।’
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েট আমান্ডা গোরম্যান ২০১৭ সালে আমেরিকার জাতীয় যুবকবি পুরস্কার লাভ করেন। তার প্রথম বই ‘The One for Whom Food is Not Enough’ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। তিনি ২০১৩ সালে জাতিসংঘে পাকিস্তানের নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাইর ভাষণ শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
তারপর ২০২০ সালে আমেরিকান ফার্স্ট লেডি ‘জিল বাইডেন’ এর বিশেষ রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে ২২ বছরের তরুণী কবি আমান্ডা গোরম্যান প্রেসিডেন্ট অভিষেকে পাঠ করেন ‘The Hill We Climb’ ‘যে পাহাড় আমরা জয় করি’।
কবিতার মধ্য দিয়ে ঘোষিত হয় :
‘আমাদের অবশ্যই সকল ভেদাভেদ দূর করতে হবে।
আমরা অস্ত্র নামিয়ে অন্যজনের প্রতি যেন বাড়িয়ে দিতে পারি আমাদের উদার হাত।
আমরা কারও ক্ষতি চাই না, বরং চাই সবার মেলবন্ধন।
আমরা অবশ্যই আর পেছনে যাব না ফিরে, এগিয়ে যাব আগামীর পথে।
কোনো ভয় দেখিয়ে আমাদের সত্যপথ থেকে ফেরানো যাবে না, বাধা দিতে পারবে না,
যখন দিবস আসবে, আমরা আঁধারের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসব প্রদীপ্ত, প্রজ্বলিত ও নির্ভীক রূপে।
একটি নতুন ভোরের সূচনা হবে, যখন আমরা তাকে মুক্ত করব।
কারণ প্রতিদিনকার প্রদীপ্ত আলো নিত্য বিরাজমান, যদি আমরা তা যেন দেখার মতো সাহসী হই।’
২২ বছর বয়সী এক তরুণী ওয়াশিংটন ডিসির হোয়াইট হাউসে বহুল আলোচিত অভিষেকে উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং তাদের পাশাপাশি টেলিভিশনে যোগ দেওয়া বিশ্বের অসংখ্য মানুষকে নিজের লেখা কবিতার দুর্দমনীয় শব্দ ঝংকারের মাধ্যমে ‘দ্য হিল উই ক্লাইম্ব’ কবিতাটি শুনিয়েছেন।
পৃথিবীর মানুষের ধ্বংসসীমানার এক কঠিন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ কবি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বকনিষ্ঠ তরুণী (২২) কবি আমান্ডা গোরম্যান। নিজের কবিতা কবিদের মধ্যে তিনিই তখনকার বিশ্বে সবচেয়ে চমকিত ও আলোচিত হয়ে ওঠেন। ঐতিহাসিক অভিষেক অনুষ্ঠানে পাঁচ মিনিট স্থায়ী ৭২৩ শব্দের কবিতাটির মাধ্যমে সমগ্র দুনিয়ায় ছুড়ে মারেন এক বজ্রকঠিন প্রশ্ন :
‘যখন দিবস আসে, আমরা নিজেদের কাছে জানতে চাই, এই শেষ না হওয়া ছায়ার মাঝে কোথায় এবং কীভাবে আমরা খুঁজে পাবো আলো?’
যার কবিতার ছন্দে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করে দেয় পৃথিবীর রাষ্ট্রপুঞ্জের শাসকদের। সমগ্র বিশ্বে চমক সৃষ্টি হয়। সমর্থকদের হামলার প্রসঙ্গও উঠে আসে আমান্ডার কবিতায়।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একচোখা শাসনপ্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার রেজাল্টকে না মেনে অপশক্তির আস্ফালনের মুখে যখন হোয়াইট হাউস আক্রান্ত (!) হয়, তখন সমগ্র বিশ্বকে চমকে দেয় আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী গোরম্যনের কবিতা।
‘আমরা এমন শক্তি দেখেছি, যা আমাদের ভূখণ্ড, আমাদের রাষ্ট্রকে সবার মাঝে বিলিয়ে না দিয়ে
চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে, গণতন্ত্রকে বিলম্বিত না পেরে দেশকে করে দেবে ধ্বংস।
আমরা জেগে উঠব সূর্যালোক-শোভিত দিগন্তে
আমরা পুনর্গঠন করব, পুনর্মিলন ঘটাব এবং পুনরুদ্ধার করব আমাদের জাতির প্রতিটি পরিচিত প্রতিটি প্রান্তে..
আমাদের বর্ণিল বৈচিত্র্যময়, সুন্দর জনগোষ্ঠী পরিণত হবে পরিপক্বতায় এবং ছায়াময় সুন্দরে
যখন সুদিন আসবে, আমরা আঁধার ছায়া থেকে দীপ্তির পথে বেরিয়ে আসব প্রজ্বলিত ও নির্ভীক রূপে।
এমন চেষ্টা প্রায় সফলও হয়েছিল। গণতন্ত্র হয়তো সময়ে সময়ে বিলম্বে আসতে পারে, কিন্তু তাকে কভু স্থায়ীভাবে পরাজিত করা যাবে না।’
নিজের সুদীর্ঘ কবিতার বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা দেন তরুণতম কবি আমান্ডা গোরম্যান।
এপ্রিল মাস আমেরিকার শুধু কবিতার মাসই নয়, এ মাসটি শরতের স্নিগ্ধছোঁয়ায় গাছে গাছে ফুল ফোটার মাস। গ্রীষ্মের নিদাঘশোভায় কবিতার ছন্দময়তায় নিবিষ্টচিত্তে ধ্যানমগ্ন হওয়ার মাস।
বাংলা নববর্ষ : ভারতবর্ষের বাদশাহ আকবর প্রথমে বাংলা নববর্ষের গোড়াপত্তন করেন। তিনি বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে ভারতের বাংলা ভাষাভাষী এবং সকল জনগণের আনন্দোৎসব হিসেবে আরবি মাসের হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে নতুন বছরের নীতি ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে বছরের সাল তামামিরূপে ব্যবসায়ী বছরান্তের হিসাব-নিকাশের ইতি টানার ব্যবস্থা চালু হয়। এ ছাড়া ভারতের প্রজাসাধারণের কৃষি এবং অন্যান্য পণ্যের খাজনা আদায়ের নিয়মটিও তখন থেকে চালু করা হয়। পরবর্তী সময়ে সকল সম্রাট একই নিয়মে পহেলা বৈশাখ পালন করতেন।
সম্রাট আকবর মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশমতে রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌর সন এবং আরবির ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা-পদ্ধতি কার্যকর করা হয় সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে ‘বঙ্গাব্দ’ অর্থাৎ বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও কালের পরিবর্তনে সেসব ঐতিহ্যগাথা ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে পার্শ্বকালচারের অনেক অযাচিত বিষয় যুক্ত হয় বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে!
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। বছরের শেষান্তে জনগণকে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করার নিয়ম বাধ্যতামূলক চালু হয়। তার পরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।
নতুন বছর শুরুর আগেই শুভ হালখাতার প্রচলন রয়েছে। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বইকে বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরোনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকেন। বাংলাদেশে এই প্রথাটি এখনো অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানসহ ছোট-বড় সব দোকানে এখনো চালু আছে। যদিও বর্তমানে পহেলা বৈশাখ উদ্্যাপনের ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলার লোকজ সত্তা এবং আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও ইতিহাসের দিকটির প্রতি অবশ্যই নজর রাখা উচিত, যেন বাংলার মানুষের ভেতরকার ঐতিহ্যবোধ, সুশীল ধর্মবোধ ও সংস্কৃতিবোধের আসল সত্তা বিনষ্ট না হয়।
এপ্রিল মাস বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ এবং বৈশাখের ঝড়বিদগ্ধ উত্তাপের মাস। আবহমান কাল থেকে পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। বাংলার মুসলমান-হিন্দু-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধসহ সবাইকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার শাশ্বত উৎসব এই পহেলা বৈশাখ। কালের পরিবর্তনে এ উৎসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা ধরনের উপাদান। গ্রাম-বাংলায় শাশ্বত নিয়মে বহু পদের সবজি নিরামিষ, পিঠাপুলি, মাংস-পোলাওয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে পান্তা-ইলিশের আয়োজন। এসব খাওয়াখাওয়ির প্রতিযোগিতায় শিশু-কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীসহ আবাল বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও। গ্রাম-বাংলার বাজারঘাটের দোকানে দোকানে নানা রকম মিষ্টি-মিষ্টান্নের থাকে রমরমা আয়োজন। পার্কে, উদ্যানে শিশু-কিশোরীর খেলাধুলার মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে আনন্দমেলা।
বৈশাখকে অনেকে কল্পনা করেন যুগ পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে। পুরোনো বছরের অসুখ-বিসুখ, ব্যথা-ব্যর্থতা, জরাজীর্ণতাকে উতরে প্রেম-বিরহ ও ভালোবাসার নির্যাসে, খেতে-খামারে শস্যে-সঙ্গীতে, সুখ-শান্তির মিলিত উচ্ছ্বাসে যেন ভরিয়ে নতুন বছরকে দেখতে চান। বৈশাখের নবধারায় দুর্বার আহ্বান।
বাংলা সাহিত্যে বৈশাখ নিয়ে কবি-সাহিত্যিকদের বিস্তর লেখা রয়েছে। বৈশাখ আসে তাদের কাছে রুদ্ররূপে। কিন্তু সেই রুদ্ররূপে তারা বিচলিত নন। বরং বৈশাখের কালবৈশাখীর জন্য উচ্ছ্বসিত ও আশা-প্রত্যাশায় উদ্্গ্রীব হয়ে থাকেন। গাছগাছালির জীর্ণ পাতারা ঝরঝর করে ঝরে পড়ে। গজিয়ে ওঠে নবপল্লবে। খুশিতে আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে বাংলার জনপদ। চেতনার কবি কাজী নজরুল তাই গর্জে ওঠেন সন্ধ্যা কাব্যের ‘কাল-বৈশাখী’ কবিতায় তার স্বভাবসিদ্ধ অগ্নিঝরা কণ্ঠে :
‘বারেবারে যথা কাল-বৈশাখী ব্যর্থ হল রে পুব-হাওয়ায়
দধীচি-হাড়ের বজ্র-বহ্নি বারেবারে যথা নিভিয়া যায়,
কে পাগল সেথা যাস হাঁকি-
বৈশাখী কাল-বৈশাখী!
হেথা বৈশাখী-জ্বালা আছে শুধু, নাই বৈশাখী-ঝড় হেথায়
সে জ্বালায় শুধু নিজে পুড়ে মরি, পোড়াতে কারেও পারিনে, হায়।’
কবি আক্ষেপ করেন, বৈশাখ তার কাছে প্রকৃত রুদ্ররূপ ধরে আবির্ভূত হয়নি বলেই সারা দেশ আজও পুরাতন জংধরা জরাজীর্ণতায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে। এখানে তার আক্ষেপ ও ক্ষোভ প্রকাশ পায় এভাবে :
‘কাল-বৈশাখী আসেনি হেথায়, আসিলে মোদের তরু-শিরে
সিন্ধু-শকুন বসিত না আসি’ ভিড় করে আজ নদীতীরে।
জানি না কবে সে আসিবে ঝড়
ধূলায় লুটাবে শত্রুগড়,
আজিও মোদের কাটেনি ক’ শীত, আসেনি ফাগুন বন ঘিরে।
আজিও বলির কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়া উঠেনি মন্দিরে।
জাগেনি রুদ্র, জাগিয়াছে শুধু অন্ধকারের প্রমথ-দল,
ললাট-অগ্নি নিভেছে শিবের ঝরিয়া জটার গঙ্গাজল।
জাগেনি শিবানী-জাগিয়াছে শিবা,
আঁধার সৃষ্টি-আসেনি ক’ দিবা,
এরি মাঝে হায়, কাল-বৈশাখী স্বপ্ন দেখিলে কে তোরা বল।
আসে যদি ঝড়, আসুক, কুলোর বাতাসকে দিবি অগ্রে চল।’
একইভাবে রবীন্দ্রনাথও বৈশাখকে রুদ্ররূপে অবলোকন করেছেন। কল্পনা কাব্যের ‘বৈশাখ’ কবিতায় বৈশাখকে তার সরাসরি সম্বোধন এ নামেই :
‘হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ,
ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,
তপঃ ক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল
কারে দাও ডাক-
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ?
জ্বলিতেছে সম্মুখে তোমার
লোলুপ চিতাগ্নিশিখা লেহি লেহি বিরাট অম্বর-
নিখিলের পরিত্যক্ত মৃত স্তূপ বিগত বৎসর
করি ভস্মসার-
চিতা জ্বলে সম্মুখে তোমার।
কবিতার শুরুতেই কবি বৈশাখের রুক্ষরূপ তুলে ধরেছেন। কিন্তু তিনি নজরুলের মতো বৈশাখের বজ্রকঠিন আঘাতের পক্ষপাতী নন। স্রেফ নির্বিঘ্ন শান্তির প্রার্থনায় তিনি মগ্ন হয়ে আছেন :
‘হে বৈরাগী, করো শান্তিপাঠ।
উদার উদাস কণ্ঠ যাক ছুটে দক্ষিণে ও বামে-
যাক নদী পার হয়ে, যাক টলি গ্রাম হতে গ্রামে,
পূর্ণ করি মাঠ।
হে বৈরাগী, করো শান্তিপাঠ।
দুঃখ সুখ আশা ও নৈরাশ
তোমার ফুৎকারক্ষুব্ধ ধুলাসম উড়ুক গগনে,
ভরে দিক নিকুঞ্জের স্খলিত ফুলের গন্ধ-সনে
আকুল আকাশ-
দুঃখ সুখ আশা ও নৈরাশ।
ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ!’
বৈশাখকে নিয়ে অসংখ্য গানও রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বর্ষবরণের এ গানটি এখন বাঙালির প্রাণের সংগীত :
‘এসো এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।’
রবীন্দ্র-নজরুলের পর বাংলা ভাষায় পহেলা বৈশাখকে নিয়ে যারা দীর্ঘতম কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ফররুখ আহমদ অন্যতম। রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে বসে তিনি ‘বৈশাখ’ ও ‘বৈশাখের কালো ঘোড়া’ নামে যে দুটি কবিতা রচনার মাধ্যমে বৈশাখের কবিতায় নতুন মাত্রা দান করেছেন। এসব কবিতা কিছুটা রবীন্দ্রনাথের আদলে রচিত হলেও ভিন্নতর বার্তা ও আলাদা কণ্ঠস্বর ধারণ করে আছে ফররুখ আহমদের ‘বৈশাখ’ কবিতাটি। তিনিও এখানে বৈশাখকে দেখেছেন রুদ্ররূপে। বৈশাখ কবির কাছে মহাশক্তির প্রতীক, যা মহাকল্যাণ সাধনের জন্যই আবির্ভূত হয়েছে মর্ত্য।ে শুরুতেই কবি বৈশাখকে সম্বোধন করেছেন এভাবে :
‘ধ্বংসের নকীব তুমি হে দুর্বার, দুর্ধর্ষ বৈশাখ
সময়ের বালুচরে তোমার কঠোর কণ্ঠে
শুনি আজ অকুণ্ঠিত প্রলয়ের ডাক।’
কিন্তু তিনি যখন এ রকম করে বলেন :
‘রোজ হাশরের দগ্ধ তপ্ত তাম্র মাঠ, বন, মৃত্যুপুরী, নিস্তব্ধ নির্বাক;
সুরে ইস্রাফিল কণ্ঠে পদ্মা মেঘনার তীরে
এসো তুমি হে দৃপ্ত বৈশাখ।’
একইভাবে ‘ঝড়’ নামক দীর্ঘ কবিতায় ফররুখের দৃপ্ত উচ্চারণ :
‘হে বন্য বৈশাখী ঝড়! হে দুর্গম! দীবন-মৃত্যুর
হিংস্র পটভূমিকায় ভ্রাম্যমাণ, তুমি যাযাবর,
পাড়ি দিয়ে যেতে চাও মহাবিশ্ব, দূরান্ত সুদূর!...’
...
‘হে বন্য বৈশাখী ঝড়! গতিস্রোত প্রমত্ত ভয়াল
ধ্বংসের নেশায় মাতি, যৌবনের উল্লাসে নির্মম
পাড়ি দাও অনায়াসে ফেন-ক্ষুব্ধ সমুদ্র উত্তাল...’
বাংলা নতুন বছরের শুরুতে আমাদের ভেতরকার সত্যান্বেষণ, সত্যানুসন্ধান ও সত্যবোধই হয় যেন পথচলার পাথেয়। সাহিত্যের নিখুঁত পরিচর্যায় কবিতার মিলিত উচ্ছ্বাসে নিবিড় একাত্মতায় গড়ে উঠুক সবার আনন্দভুবন।
বিশ্বব্যাপী মানববিধ্বংসী যুদ্ধবিগ্রহ সকল প্রকাশ দুর্যোগ ও ভয়তাড়িত শঙ্কা কাটিয়ে পৃথিবীর মানুষ আবার জেগে উঠুক নব উদ্যমে। নির্মল আনন্দধারায় সবার জীবন হয়ে উঠুক সুখময়। জয় হোক মানবতার। জয় হোক কবিতার।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক