প্রবাসে ঈদের আনন্দ ও স্মৃতির মাইল ফলক

প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩৯ , অনলাইন ভার্সন
ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে আনন্দ দেওয়া, আনন্দ পাওয়া। তবে দুটি ঈদে দু’রকম আনন্দ। ঈদুল ফিতর সারা মাস রোজা রেখে আত্মার সংশোধন করে নিজেকে সংযমী করে যাবতীয় পানাহার বন্ধ রেখে আল্লাহর নৈকট্য লাভ। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার পাশে থেকে সাহায্য-সহযোগিতার ভেতর দিয়েই আসে এই ঈদের সফলতা। দান-খয়রাত, জাকাত-ফিতরা আদায়ের মধ্য দিয়ে পবিত্র দায়িত্ব পালন করাই ঈদুল ফিতরের সন্তুষ্টিপূর্ণ কাজ। এই ঈদে আনন্দ পাওয়ার জন্য যে সাধনা, তা হলো সিয়াম সাধনা। কষ্টের পরই যে সুখ, তা হলো সত্যনিষ্ঠ সাধনাসিদ্ধ লাভ। এই মাসের বাড়তি আনন্দ হলো ইফতার ও সাহ্্রি। তবে এখানে বাড়তি আনন্দ আরও সংযুক্ত হয় সবাই মিলে বসে ইফতার করা। এই প্রবাসে তা সম্ভব নয়।

সম্ভব নয় কোনো একজন অসহায় হতদরিদ্র মানুষকে ইফতার করানো বা তার পাশে দাঁড়ানো। নিজ দেশে হলে অনায়াসে তা সম্ভব হতো। হ্যাঁ, আমরা ডলার পাঠাই দুস্থ, অসহায় মানুষের জন্য। আমরা স্বীয় চোখে পর্যবেক্ষণ করতে পারি না আমার মন যা করতে চায়, তা আদৌ হলো কি না। পুরোটাই ছেড়ে দিই প্রগাঢ় বিশ্বাসের ওপর। আমার সৌভাগ্য হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ঈদ ধর্মকর্ম করার। সেই দেশের ঈদ উদ্্যাপন, ঈদের আনন্দ আমেরিকার মতো নয়। যদিও দুটোই প্রবাস। কৃষ্টি-কালচার, ধর্ম পালন, জীবনযাপন একেক দেশে একেক রকম। এই দেশ হীরার। মধ্যপ্রাচ্য সোনার।
দুই দেশেই রুটি-রুজির ধান্দায় কাটে দিন প্রবাসীদের। দুই দেশেই বাংলা সংস্কৃতির বিকাশে বাঙালিরা কঠিন কষ্ট করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। দুটি দেশের ভাষা যেমন ভিন্ন, দুটি দেশের সংস্কৃতিও ভিন্ন। তবে মধ্যপ্রাচ্যের খাবারদাবার বলতেই হবে সবার শীর্ষে। ঈদ শপিংও শীর্ষে।

সারা রাত ঈদ শপিং চলছে। বিশাল বড় ধনীদের মল অলাইয়া। সোনার ঝালরে ঢাকা দোকানের পর্দা। সোনার ঝালর সরিয়ে অন্দরে প্রবেশ করা। সৌদি ক্যারেলা হিন্দি দোকান্দার। বাঙালি বলতে এসব মার্কেটে নেই। বাঙালিরা শুধু গ্রোসারিতে কাজ করে। শপিং করতে হলে তো আরবি, হিন্দি, ইংরেজি তিনটি ভাষা জানতেই হবে। মহিলা মার্কেট। ফ্যামিলি মার্কেট। ব্যাচেলরদের প্রবেশ নিষেধ। ব্যাচেলরদের জন্য বাথা ধীরা বদিয়া মানফুহা ফোক আলখাবর আল জাজিরা আরও বহুবিধ মার্কেট রয়েছে। ঈদের নামাজ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এক কাতারে। কোনো ভেদাভেদ নেই। আমি বাঙালি নারী। ঈদ জামাত যখন করছি, আমার পাশে শূন্যস্থান থাকলে সেখানে যেকোনো দেশের মিসরি, ইয়েমেনি, সৌদি পুরুষ-নারী যে কেউ দাঁড়াতে পারবে। আমি নামাজ পড়ছি, আরেকজন আমার সামনে চলাচল করছে। নামাজ পড়তে হবে, ব্যস পড়তে হবে। সৌদিরা নামাজ পড়ছে দাঁতে মেসওয়াক করতে করতে। দুই রাকাত, ঊর্ধ্বে চার রাকাতের বেশি ওরা নামাজ পড়ে না।

সৌদি আরবে আমার প্রথম ঈদ ছিল রোজার ঈদ। আমার প্রথম বাচ্চা ছয় বছরের। এত বড় বাসায় আমরা তিন প্রাণী। ঈদের ভোর। দরজায় খটখট শব্দ। দরজা খুলতেই সৌদি আমাদের বাড়িওয়ালা। আস্ত খাসি দরজায় ফেলে দিয়ে গেল। নামাজে গেলাম। আমাদের বাড়িওয়ালার মা সব বাঙালির হাতে ১০০ রিয়াল করে দিচ্ছেন। আমার কাছে এলেন। আমাকে বুকে তুলে কানের পাশে চুমু দিয়ে বলেন, এশ হাদা আজনবি। তোফা। বলেই ১০০ ডলার দিতে চাইলেন। আমি নিতে পারলাম না। নিইনি বলে উনি রেগে গেলেন। অনেক রেগে রেগে বলছেন, ইশহাদা মিসকিনা। ইন্তি খারবান। তবারাক খুশ মিয়া মিয়া ইন্তি গলাতান।

আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল বকা খেয়ে। বাসায় এসে মন আরও খারাপ হলো। বিরাট বড় হলরুমের বাসা যেন খাঁ খাঁ করছে। প্রশস্ত কাচের জানালার ভারী পর্দা সরিয়ে দেখি, মানুষ তো দূরের কথা, রাস্তায় কোনো কুকুর-বিড়ালও নেই। এত এত রান্না করেছি, খেতে ইচ্ছে করছে না। মনে পড়ে গেল বাবার বাড়ির ঈদের কথা। মনে পড়ে গেল স্বামীর বাড়ির ঈদের কথা। ইশ্্, কী আনন্দ। নতুন শাড়ি, নতুন সোনার গহনা পরে ননদ-জাদের সঙ্গে সে কী আড্ডা। আবার বাপের বাড়ি যাওয়ার আনন্দ। ভাইবোনদের সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে গল্পের ঝাঁপি খুলে বসা। কার শাড়ি, কার গহনা কত দামি এবং সুন্দর। এসব মনে পড়তেই চোখের পাতা ভিজে উঠল।

নন্দী বলে, সে কী! তোমরা কাঁদছ কেন? তন্বী বলে, আব্বুু বাংলাদেশে যাব, কী কান্না। ওর কান্না দেখে ভয়ে আমার কান্না থেমে গেল। নন্দী বলে, আমরা তিনজন এখন, তাই কাঁদছি? আর আমি যখন একা ছিলাম? ভেবে দেখো। আমি কিছুতেই নতুন কেনা শাড়ি-গহনা পরতে পারলাম না। অমন সময় দরজায় নক। এক সঙ্গে ঢুকল ১০ জন। সব নন্দীদের পাশের গ্রামের। ওরা এসে খাসি বানাতে শুরু করল। কেউ পেঁয়াজ কাটে, কেউ মসলা ব্লেন্ড করে। খাসি বসিয়ে দিল। আবার দরজায় কলিং বেল। দেখি নন্দীর ভাতিজা মোয়াজ্জেম। হাতভর্তি খাবার। আল ফাহাম। খবুজ, শর্মা, ফিশ ফ্রাই। আর প্রত্যেকেই তন্বীর জন্য নিয়ে এল চেইন, কানের দুল, ব্রেসলেট। আর দুষ্টু তন্বী তুমি কীভাবে কাঁদলে? কেন কাঁদলে? তন্বী বলে, আমি তো কাঁদিনি, আম্মু কেঁদেছে।
খাবার শেষ করে ছুটলাম ছয় গাড়িতে। মরুভূমির পর মরুভূমি ছাড়িয়ে দেবর তপনের দুষ্টুমিতে ভুলতেই হলো দেশের কথা। সে বলছে, ভাবি তো আসলে কান্না করছে আমাদের ঈদ সালামি-টালামি দিতে পারেনি, তাই। মোয়াজ্জেম বলে, চাচি, এইটা কোনো ব্যাপার! যেখানে যাচ্ছি এমন প্রকৃতি দেখে মন শীতল করে আমাদের সালামিও দেবেন, সব কষ্টও ভুলবেন। মনে পড়ে গেল আমার শ্বশুরবাড়িতে প্রথম ঈদ। দেবররা লম্বা লাইন করে উঠানে দাঁড়ানো। নন্দী বলে, বাইরে যাইয়ো না। সবাই তোমাকে সালাম করবে আর টাকা চাইবে। আমি তাকিয়ে দেখি ১৫ জন।

আমার শাশুড়ি বলেন, এই সালামি নিতে হলে দিতেও হয়, তা জানিস তো? ভাগ। নামাজে যা। লিংকন বলে, ঝিয়ের যে কথা। সাবের বউ। বড় ভাবি, তারে সালাম না করলে নামাজই তো হবে না। এ কথা এত জোরে বলছে হান্নান, যেন আমরা ঘর থেকে শুনতে পাই।
অগত্যা নন্দী আমার হাতে প্রতিজনের জন্য ২০ টাকা করে দিল। আমি পড়ে গেলাম মহা ফাপ্পরে। এত এত বড় বড় ছেলে আমাকে সালাম করবে? আমি একটা ছোট্ট মানুষ। আমি দরজার বাইরে বের হতেই সব কটি হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আমি লজ্জায় আবার ঘরে ঢুকি। কোনো সালাম চলবে না। তবে সালামি দেব। সবাই ঈদের দাওয়াত দিয়ে গেল।

সারাটা দিন লোক এল খেল। টেবিল চলছে তো চলছেই। ঠিক আমার বাবার বাড়ি যেমনটি।
নন্দী আমাকে নিয়ে বের হবে। সবার সঙ্গে দেখা করতে। আমার চাচাশ্বশুরদের বাড়ি প্রথম গেলাম। রহমান চাচি আমাকে ১০০ টাকা দিলেন। প্রায় জোর করেই। বলেন, নিতে হয়। তুমি নতুন বউ। প্রথম ঈদ। মজা খাইবা। এভাবে আমার প্রচুর টাকা হয়ে গেল। আমি বাড়ি এসে সব আমার শ্বাশুড়িকে দিই। আমার শাশুড়ি ৩০০ টাকা দিয়ে বলেন, আমি তো ভুলেই গেছিলাম, তাই লজ্জা দিলি?
পরের দিন বাবার বাড়ি, সে কী আনন্দ-উল্লাস। ১৯৯০ সালের ঈদ আনন্দ স্মরণে রাখার মতো। নন্দীকেও আমাদের আত্মীয়স্বজন ঈদ সালামি দিল প্রচুর। যা-ই হোক, ভুলে যাব প্রবাসের প্রথম ঈদ।

মরুভূমির হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে আল খাবেরে নামলাম। শিরশিরে পাহাড়ি ঝরনার পানি।
ঘন সবুজের চত্বর। সুইমিং পুল। নীল জল। স্বচ্ছ কাঁকর চোখে মাজা। যতই দেখছি আর অবাক হচ্ছি। সুন্দরের যেন শেষ নেই। মাটির কোপ। বালতি দিয়ে সবাই শখ করে পানি তুলতে থাকে। পায়ের পাতা ছুঁয়ে মাছের বিচরণ। ঘন খেজুর গাছে কাঁদি খেজুর ঝুলে আছে। পাকা কাঁচা। বরই গাছে বরই পাতা দেখা যায় না। আঙুর, সহরমা, টমাটো গাজর।
বিশাল এলাকাজুড়ে অনতিদূরেই সুইমিং পুল। তন্বী অস্থির সুইম করবে। মোয়াজ্জেম বাচ্চাদের সুইমিং পুলে নিয়ে গেল তন্বীকে। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা আসন্ন। ছুটলাম। আমি ভাবলাম বাসায় ফিরছি। কত দূর যেতেই গাড়ি থামানো হলো। দেখি পরপর ছয়টি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আইসক্রিমের গাড়ির টিংটং শব্দ। উটের মহড়া। সবাই উটে সওয়ার হলো। খ্যাপসার গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। ইস্তারাহায় সোফায় হেলান দিয়ে ওরা গাহওয়া খাওয়া শুরু করল। একটু পরেই ডিনার।

ডিনার শেষ হতেই হুক্কা হাজির। লম্বা সোনা রং পাইপ। সে কী বাদশাহি স্টাইলে তপন মোয়াজ্জেম পাইপ টানা শুরু করল। নন্দী তাস নিয়ে হাজির। আমি আর তন্বী ফিশিং গেম খেলছি। এভাবে রাত বাড়তে থাকে। যখন গাড়ি ছাড়ল, দূরে শয়তানের চোখ হয়ে জ্বলছে নিয়নের বাতি। সুনসান নীরবতা। কোনো জনমানবের চিহ্ন নেই। শুধু গাড়ির খসখসানি শব্দ ছাড়া। সারা দিনের ক্লান্তিতে সবাই নিদ্রা দেবীর কোলে আশ্রিত।
আমার চোখে ঘুম নেই। আমি দেখছি নীরবতাও কতটা বাঙ্্ময় হতে পারে। অন্ধকার গ্রাস করছে আলোর ফলক। মরুভূমির বালুর গতর রোদের তাপ শুষে শীতলতার রূপ নিয়েছে। নিয়নের তির্যক রশ্মির ল্যাম্পপোস্টগুলো হাসির ঝিলিক দিয়েই উধাও। মানফুহার দিঘল চত্বরে গাড়ি বসতেই ভোরের আজান পড়ল চতুর্দিকে। প্রবাসজীবনের প্রথম ঈদ স্মৃতির ফলকে গ্রথিত-প্রথিত হয়ে রইল।
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078