বসন্তের নাতিশীতোষ্ণ দিন। দীর্ঘ শীত শেষে ব্যালকনির স্লাইডিং ডোর ঠেলে ইজিচেয়ারে বসে ছিলাম। লনে গাছের ডালে পাখিরা অলস সময় পার করছে। আমি প্রসন্ন মুখে দূরের উইপিং উইলো গাছের দিকে তাকাই। ভ্যানিলা আইস্ক্রিমে জিভ ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে ফোনে গুগল সার্চ দিচ্ছিলাম। সমস্ত মুখ ঘন দুধের স্বাদে ভরে গেল। আর মাত্র দুই মাস বাদেই পুত্রদের স্কুল-কলেজ ছুটি হবে। গ্রীষ্মকালীন ছুটি। এ বছর অবকাশ যাপন করতে কোথায় যাওয়া যায়? হাওয়াই, মেক্সিকো নাকি ইউরোপ? সাগর, পাহাড়, নাকি অরণ্যের সান্নিধ্য? চার সদস্যের পরিবারের সবার পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরোনোর আগেই রিনিউ করে রাখা হয়েছে। সারা বছর রুদ্ধশ্বাস ব্যস্ততা পরিবারের সবার। কেউ পড়াশোনায়, কেউ কর্মক্ষেত্রে। সবকিছুকে দূরে সরিয়ে দূরদেশে একত্রে ঘুরে বেড়ানোর একমাত্র সময় এই গ্রীষ্মকালীন ছুটি।
বসন্তের হাওয়া তেমন গায়ে লাগছে না। তবে শোঁ শোঁ শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল পাহাড়ি এলাকা থেকে কোনো ঝোড়ো হাওয়া ধেয়ে আসবে। ম্যাগনোলিয়া গাছের ডালে একটি একলা পাখি বিরহী বিষণ্ন সুরে ডেকে ওঠে আচমকা। ঠিক তখনই রিং বেজে উঠল। দেশের নম্বর থেকে ফোন এলে বুকের ভেতরটা আঁতকে ওঠে। বাবা-মা বেঁচে নেই যদিও, তবুও। অবশ্য আঁতকে ওঠার মতো সংবাদ আসেনি সেদিন। এসেছে আশ্বস্ত হওয়ার সংবাদ। আমার কোভিড-আক্রান্ত ছোট খালাকে অবশেষে বাসায় নেওয়া হয়েছে।
আমার ছোট খালা শান্ত, ধীর, স্থির, বয়ে চলা নদীর মতো। তাঁর জন্যে আমার এক-পৃথিবীসমান মায়া। তিনি যখন হেঁটে যান, ঘন দিঘল চুল বাতাসে দুলে ওঠে, মনে হয় যেন নিস্তরঙ্গ জল ঢেউ খেলে যায়। শীতল অথচ কর্মঠ মানুষটি জীবনের অধিকাংশ সময়ই নানান রকম শারীরিক জটিলতার মধ্য দিয়ে যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে পার করেছেন। দুর্ভোগের শুরুটা তরুণ বয়সে। আটাশির বন্যার সময় আচমকা এক সকালে ঘুম ভেঙে দেখেন, শরীর নাড়ানো যাচ্ছে না। সেই থেকে প্যারালাইজড হয়ে দিনাতিপাত করছেন। মানুষের জীবনে আচমকা আমূল পরিবর্তন আসে কখনো কখনো। ছোট খালার বিষয়টা অনেকটা তেমন। খুব বেশি দিন বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন না। একটু একটু করে ঘরের দেয়াল ধরে হাঁটতে শিখেছিলেন সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুর মতো। রান্নাঘর পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারছিলেন। তার পর থেকে আবারও শুরু হয়ে গেল সংসারের রান্নার কাজ। বলতেন, ‘তোর খালু বুয়া বা অন্য কারও হাতের রান্না খাইতে পারে না।’ আমাদের আরও আশ্বস্ত করতেন এই বলে, ‘আমার তেমন কোনো কষ্ট হয় না। বুয়াই কাটা-ধোয়া সব কাজ করে। আমি শুধু রান্নাটা বসাই। দ্যাখছ না রান্নাঘরের জন্য তোর খালু নতুন এই চেয়ারটা কিনে দিছে।’ বলতে বলতে চেয়ারে বসেই কড়াইয়ের গরম তেলে পেঁয়াজ কুচি ছেড়ে দেন ছোট খালা। তারপর আদা, রসুন, হলুদ, মরিচ, লবণ দিয়ে নাড়তে থাকেন। মসলার ঝাঁজালো গন্ধ আর ধোঁয়ায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে। আঁচলে চোখ মুছে মাছের টুকরোগুলো মসলার ওপর বিছিয়ে দেন সযত্নে। চুলার নীলচে আগুনের দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে ভাবতে থাকি, যে মানুষটি কোনো দিন কারও অহিত কামনা করে না, কারও মনে কষ্ট দিয়ে কথা পর্যন্ত বলে না; জীবনের কাছে, পরিবারের কাছে তাঁর কোনো আকাক্সক্ষা আছে বলেও শুনিনি, সেই মানুষটিই কিনা এত শারীরিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে! সৃষ্টিকর্তার এ কেমন শাস্তি!
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে থাকতাম, তখন মাস শেষে পকেটের টাকা ফুরিয়ে গেলে ছুটির দিনে মিরপুরের বাস ধরে খালার বাসায় চলে যেতাম। সারা দিন কাটাতাম। খালা যত্ন করে খাওয়াতেন। ফিরে আসার সময় ব্যাগ ধরিয়ে দিতেন। হলে ফিরে ব্যাগ থেকে ছোট ছোট বক্স ভর্তি খাবার নামিয়ে রাখতাম, যা দিয়ে পরবর্তী বেশ কিছুদিন নিশ্চিন্তে থাকা যেত।
ছোট খালার সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক। দাদি বলতেন, ‘পৃথিবীতে বাবা-মায়ের পর যদি কারও কাছে ঋণী থাকতে হয়, সে তোর ছোট খালা।’ কেননা, তিনি আমাদের লালন-পালন করেছেন মায়ের অবর্তমানে। মায়ের তখনো পড়া শেষ হয়নি। ঢাকায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে। নানু, খালা আর বাবাই আমাদের তিন ভাইবোনকে দেখভাল করতেন। সেই সুবাদে খালা আমাদের বাসার পাশের স্কুলে পড়তেন। এসএসসি পরীক্ষার ঠিক আগে হুট করেই নানা এসে তাকে নিয়ে যান। বিয়ে ঠিক হয়েছে। পাত্র দেখতে সিনেমার নায়ক আলমগীরের মতো। বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ঢাকায় বড় চাকরি করছে। আব্বা-আম্মার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও একদিন হুট করেই ছোট খালার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর খালা চলে গেলেন দূরের এক অন্তঃগ্রামে। সেখানে থাকতে হয়েছে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে। ছোটবেলায় একবার ছোট খালার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন নবান্নের দিন ছিল। সদ্য ওঠা নতুন ধানের সুবাসে ভরপুর গোটা গ্রাম। কৃষকের চোখে লাল-সবুজ স্বপ্ন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ছোট খালা তখন রান্না শেষে সবাইকে খাবার দিয়ে পুকুরঘাটে কাপড় কাচছিলেন। এতটুকুন মানুষটি কত কাজ করতে পারে? ক্যামন এক সুনসান নীরবতার মধ্য দিয়ে দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলেন শেষ বিকেলে একাকী। খাবার চিবোতে চিবোতে বিষণ্ন স্বরে বলেছিলেন, ‘বুঝলি ঝলক, বাড়ির বড় বউ হইলে অনেক দায়িত্ব। শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবর...।’ তাঁর কণ্ঠস্বর সমুদ্রের ঢেউভাঙা শব্দের ন্যায় বিষণ্ন শোনাল। এ কদিনেই ছোট খালা কেমন ম্লান, ম্রিয়মাণ হয়ে গেছেন। আমি সেই স্বতঃস্ফূর্ত, হাসিখুশি মানুষটিকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। চলে আসার সময় বুকে জড়িয়ে ধরে খুব করে কেঁদেছিলেন। অনেকগুলো বছর গ্রামে কাটিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির মৃত্যুর পর খালাকে শহরে নিয়ে আসা হয় খালুর একলা শহুরে জীবনে খাওয়াদাওয়ায় সমস্যা হওয়ায়। সেই থেকে ছোট খালা ঢাকায়।
ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করায় মরুর বুকে তৃষ্ণার্ত পথিকের তেষ্টা মেটানোর মতো আমার হোস্টেল-জীবনটা প্রাণ পেয়েছিল। মাস্টার্স ফাইনালের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হুট করেই ডিভি লটারি পেয়ে আমেরিকায় আসার সুযোগটা পেয়ে যাই। যাবতীয় পেপার ওয়ার্ক সম্পন্ন। শুধু ভিসা ফি দেওয়া বাকি। এতগুলো টাকা কোথায় পাব? বাবা-মাকে টেনশনে ফেলতে ইচ্ছে করল না। বিষয়টা নিয়ে বুদ্ধি-পরামর্শের জন্যে হোস্টেলের কয়েন বক্স থেকে ছোট খালার সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছিলাম মাত্র। অস্থিরতায় ঘুম আসে না। নির্ঘুম রাত শেষে ভোরের দিকে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম। কে যেন মশারির বাইরে থেকে ডেকে ডেকে জাগানোর চেষ্টা করছিল। মনে হলো স্বপ্ন দেখছি। বোবায় ধরার মতো করে মুখ দিয়ে গোঙানির শব্দ বের হচ্ছিল। কেউ জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে তুলল। চোখ কচলে ধড়ফড়ে বুক নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসি। দেখি, আমার খালাতো ভাই শৈবাল। একটা রুমালের পুঁটলি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঝলক ভাইয়া, এইটা রাখো। আম্মা দিছে।’ ঘুমঘোর কাটার আগেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল। চোখ মেলে দেখি রুমালের ভেতর কী যেন গিঁট দিয়ে বাঁধা। সঙ্গে চিরকুট। খুলে পড়তে শুরু করি। ‘বাবা ঝলক, এই মুহূর্তে এই জিনিসগুলোই আমার সম্বল। বিক্রয় করিয়া যাহা পাও, তাহা দিয়া আপাতত কাজ চালাও। ইতি তোমার ছোট খালা।’ ছোট খালা আমাকে তুই সম্বোধন করলেও চিঠিতে তুমি সম্বোধন করেছেন। বিষয়টি মনের জানালায় তীব্র বেগে ডানা ঝাপটায়। সেই আওয়াজের মাঝেই রুমালের গিঁট খুলি। একটি চেইন, বেঁকে যাওয়া আংটি ও নাকফুল। দীর্ঘ ব্যবহারে ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে কালচে রং ধারণ করেছে। আমার চোখ থইথই জলে ভরে ওঠে। বর্ষার ভারন্ত নদীর মতো। গহনাহীন ছোট খালার বিবর্ণ রূপ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দাদির বলে যাওয়া সেই কথাটি প্রবল বেগে কড়া নাড়ে হৃদয় গহিনে, ‘পৃথিবীতে বাবা-মার পরে যদি কারও কাছে ঋণী থাকতে হয়, সে তোর ছোট খালা।’ দুর্দিনে যে এমন করে সুপারওম্যান হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। জিনিসগুলো বিক্রি করে ভিসা ফি জমা দিই। সহসাই একদিন উড়াল যানে চেপে আমেরিকার উদ্দেশে রওনা দিই। এই সব আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগের কথা।
এই তিন দশকে দেশে গিয়েছি বেশ কয়েকবার। যতবারই দেখা হয়, ছোট খালার মুখনিঃসৃত প্রথম বাক্য, ‘কিরে ঝলক, তুই এত শুকায়ে গেছস ক্যান? মাইনসে বিদেশ গিয়া সুন্দর হয়, হৃষ্টপুষ্ট হয়। তোর কোনো অসুখ হইছে নি?’ এমন বাক্য চিরকাল আম্মার মুখে শুনে অভ্যস্ত ছিলাম। ফোন করলেই বলতেন, ‘তুই ইট্টু মোটা হইছস নি রে, ঝলক?’ ছোট খালার মুখে একই কথার পুনরাবৃত্তি শুনে মনে হলো আমার মায়ের সংস্করণ। আমি খালাকে জড়িয়ে ধরি। একেবারে বুকের সঙ্গে পিষে ফেলার মতো জোরে। ‘আহ ছাড় ছাড়...’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন তিনি। তখন আমার ভেতরে বিচিত্র এক অনুভূতি হয়। সারা ঘরে মা মা মিষ্টি সুবাস ভেসে বেড়ায়।
সেই ছোট খালা করোনার সময়ে আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন আরও তেরো জন রোগীর সঙ্গে। আজ এই রোগী মারা যায় তো কাল অন্য রোগী। রোগীর স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে রোজ। ভাগ্যিস, ছোট খালা হিয়ারিং এইড ছাড়া কানে তেমন শুনতে পান না। ভারী পর্দা টানানো প্রত্যেক রোগীর বিছানার চারপাশে। নইলে একজনের মৃত্যুতে অন্যরা মনোবল হারিয়ে ফেলাটা স্বাভাবিক ছিল। ছোট খালা কখনো কখনো অচেতন থাকেন। বিদেশের বাড়িতে বসে এসব সংবাদ শুনে আমার মস্তিষ্ক অনুভূতিশূন্য হয়ে উঠত। সেই সময়ে প্রায়ই বাড়ির সামনের লনে কারও পোষা কুকুর ডেকে উঠত। এমন অদ্ভুত সুরে কুকুরের কান্না আমি আগে কখনো শুনিনি। অজানা আশঙ্কায় আমার সমস্ত শরীর হিম হয়ে আসত। ডাক্তাররা সব আশা ছেড়ে দিয়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে লাইফ সাপোর্টে নিতে চায় খালাকে। কিন্তু শৈবাল কিছুতেই রাজি হয় না। কদিন হাসপাতালে থেকে তার বদ্ধমূল ধারণা ও আশঙ্কা জন্মেছে, এতে তার মায়ের মৃত্যুকে আরও ত্বরান্বিত করা হবে। যে এগারো জনকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছিল, শেষ অবধি তারা কেউই আর ফিরে আসেনি। ছোট খালার অক্সিজেন স্যাচুরেশন অস্বাভাবিকভাবে নেমে যাচ্ছিল। অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছিল। রক্তে শর্করার আধিক্য। কদিন যমে-মানুষে লড়াই চলে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে, ডাক্তারদের ভুল প্রমাণ করে তিনি ফিরে আসেন অবশেষে। আইসিইউ থেকে সিসিইউ, তারপর কেবিনে স্থানান্তরিত করা হলে ছোট খালা তার সঙ্গের বাকি রোগীদের কথা জানতে চান। তারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছে বলে জানানো হয়। সব মিথ্যে তো আর ক্ষতিকর নয়! নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো ছোট খালাও বাড়ি ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। হাতের শিরায় স্যালাইনের তার লাগানো অবস্থায় আর শুয়ে থাকতে চান না হাসপাতালের সাদা বিছানায়।
দীর্ঘ হাসপাতাল-বাস শেষে ছোট খালাকে বাসায় নেওয়া হয়েছে। অযত্নে তাঁর ঘন দিঘল চুলে জট লেগে যায় বিধায় ঘাড় অবধি সব চুল কেটে ফেলা হয়। পশ্চিম গোলার্ধে ব্যালকনিতে বসে বসন্তের নাতিশীতোষ্ণ দিনে ফোনের এই প্রান্তে আমি ভিডিও কলে খালাকে দেখি। দীর্ঘ অসুস্থতায় শুকিয়ে ছোট হয়ে গিয়েছেন। ‘কেমন আছেন?’ জানতে চাই। খুব ক্ষীণ কণ্ঠে ধীরে ধীরে বললেন, দোয়া করিস, যেন বাথরুমে অন্তত যাইতে পারি। নিজে নিজে টয়লেট করতে পারি। সবাইরে আর কত কষ্ট দিমু?’ আমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে দুষ্টুমির ছলে বলি, ‘বয়কাট চুলে তোমারে নায়িকা ববিতার মতো স্মার্ট লাগতেছে, খালা।’ তিনি হা হা করে হাসেন। তারপর প্রচণ্ড কাশির দমক। বালিশ পেছনে দিয়ে ছোট খালাকে হেলান দিয়ে বসিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হয়। তিনি বড় বড় শ্বাস ফেলছিলেন। বুকের পাঁজর ওঠা-নামা করছিল। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা শ্বাস অদ্ভুত এক আওয়াজ তুলছিল। আমি তার বুকের ভেতরের শাঁ শাঁ শব্দ হাজার হাজার মাইল দূর থেকে শুনতে পাই। যেন বাঁশঝাড়ের ওপর দিয়ে প্রবল প্রলয় বইছে।
ছোট খালা-সংক্রান্ত ভাবনায় ছেদ পড়ে। মুখ তুলে উইপিং উইলো গাছের দিকে তাকাই। বাঁ পাশের জানালায় দৃষ্টি স্থির হয়। মিসেস চাও হাসি হাসি মুখ করে কুশলাদি জানতে চায় ক্ষীণ স্বরে। উত্তর দিতে ইচ্ছা হলো না। তবু বললাম, ভালো আছি। হালকা-পাতলা গড়নের চায়নিজ প্রায় শতবর্ষী বৃদ্ধা মিসেস চাওকে এবার অনেক দিন পর দেখলাম। প্রথম দিন অর্থাৎ বছর পাঁচেক আগে সে পরিচয় দিয়েছিল এভাবে, ‘হাই, আমার নাম চাও। চাও মানে ছেড়ে যাওয়া। নামের মতোই আমাকে একে একে সকলে ছেড়ে গেছে। স্বামী পরপারে। ছেলেমেয়েরা যে যার মতো আছে। হা হা হা...’
কী অদ্ভুত! দুঃখের কথা বলতে গিয়েও মানুষ এভাবে হাসে? প্রত্যুত্তরে আমিও নির্বোধের মতো শুধু স্মিত হেসেছিলাম।
‘জানো তো, এবার মরতে মরতে ফিরে এসেছি।’ প্রতিবেশী চাও তার বাঁধাই করা দন্ত বিকশিত হাসি হেসে বলল। যদিও তার হাসিটা এবার বরাবরের মতো স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। মলিন লাগছিল। এবং অতটুকু বলতেই তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেল।
সত্যিই অনেক দিন তার ঘর থেকে মিউজিকের আওয়াজ ভেসে আসেনি। ভেবেছিলাম বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছি।
-উনত্রিশ দিন রিহ্যাবে ছিলাম, বুঝলে? আজই ফিরেছি। আবার জ্বালাতন করব তোমাদের, হা হা হা।
সব কথার শেষে হা হা করে হেসে ওঠা তার মুদ্রাদোষ মনে হয়। হাসলে চাওয়ের চোখ প্রসববেদনায় কাতর রোগীর চোখের মতো কুঁচকে বন্ধ হয়ে যায়।
Ñআশা করি সুস্থ হয়ে আবারও ব্যালকনিতে আসতে পারব। তার চোখজুড়ে ‘কোথাও কেউ নেই’ দৃষ্টি।
এরপর আর কথা চালিয়ে নেওয়ার মতো দম পেল না মিসেস চাও। ফলে কথা বলা থেকে বিরত রইল।
বললাম, তোমার ছেলেরা দেখতে এল না?
সে না-সূচক মাথা নাড়ল। তার প্রতিক্রিয়া মাথা নাড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল।
আমরা যে কমপ্লেক্সে থাকি, তার দেয়ালে বড় বড় হরফে নিয়মকানুন-সংবলিত সাইনবোর্ড টানানো। লনে বাইক চালানো যাবে না। বল খেলা যাবে না। উইক ডেগুলোতে রাত দশটার পর জোরে মিউজিক বাজানো যাবে না, অন্যের অসুবিধা করা যাবে না ইত্যাদি। মিসেস চাওকে অপছন্দ করার কারণ, সে এসব নিয়মের ধার ধারে না। রাত দশটার পর তার জানালা দিয়ে উচ্চ ভলিউমের মিউজিকের আওয়াজ ভেসে আসে। ঘরের দেয়ালে বল ছুড়ে মারে। এতে দেয়ালের ও-পাশের ফ্ল্যাটে বিকট আওয়াজ হয়। বেশ কবার অনেকেই রাগান্বিত হয়ে তাকে সচেতন করতে গিয়েছিল। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে সবাই হাসি হাসি মুখ করে নিজ অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গিয়েছে। অগত্যা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ভলিউম কমানোর কথা বলতে গিয়েছিলাম আমিও একাধিকবার। দরজা খুলেই হাসিমুখ করে ‘হ্যালো মিস্টার জেলাস’ সম্বোধন করত। প্রতিবারই মিসেস চাও কমপক্ষে আমার কুড়ি মিনিট সময় নষ্ট করেছে নাছোড়বান্দার মতো তার যৌবনকালের গল্প জুড়ে দিয়ে।
-জানো, বিয়ের আগেই আমার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। আমি মা হই আঠারোর আগে। তারপর আরও দুই সন্তান। আমরা বিয়ে করি পঞ্চাশের পর। বিয়েটা জরুরি ছিল না। বিশ্বাসটাই জরুরি। কী বলো? হা হা হা! ভেতরে এসে বসো। তোমাকে আমাদের বিয়ের অ্যালবাম দেখাই।
সত্যিই সে হাতের কাছে রাখা অ্যালবাম পাতা উল্টে দেখায়। যেন এটি দেখানোর জন্যেই ওত পেতে বসে ছিল। অ্যালবামের পাতায় তাকিয়ে দেখি মধ্যবয়সী দুজন নর-নারী বর-কনে সাজে বসে আছে। পাশেই তাদের তরুণ তিন সন্তান। আমি আশ্চর্য হই। আমার দেশে বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে এমন সন্তান জন্ম নিলে তাদের জারজ বলে আখ্যায়িত করা হয়। অথচ কী অবলীলায় মিসেস চাও তার জীবনদর্শন শোনাল!
যে ঘুমের ব্যাঘাত হওয়ার অভিযোগ জানাতে এসেছিলাম, তা বেমালুম ভুলে গিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম অন্য রকম এক উপলব্ধি নিয়ে।
বসন্ত বা গ্রীষ্মের বিকেলগুলোয় ব্যালকনিতে, লনে ওয়াকার ঠেলে হাঁটতে বের হতো মিসেস চাও। বয়সের ভারে কিঞ্চিৎ বেঁকে যাওয়া সব কটি আঙুলে আংটি। মুখভর্তি কড়া মেকআপ। সামনে পেলেই গল্প জুড়ে দিত। চোখেমুখে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে বলত, মাদারস ডে তে ছেলে কার্ড ও উপহার পাঠিয়েছে, আসছে থ্যাংকস গিভিং ডে তে ছেলেরা বেড়াতে আসবে, ক্রিসমাসের ছুটিতেও আসবে... ইত্যাদি। কিন্তু কোনো দিন মেইলম্যান আর অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া আর কাউকে তার কাছে আসতে দেখিনি। মাঝে মাঝে ফোরটি সিক্স অ্যাভিনিউর রাস্তা বন্ধ করে, চক্রাকারে জ্বলতে থাকা লাল বাতির অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত অনেকটা সময়। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দেখতাম, স্ট্রেচারে করে মিসেস চাওকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মাঝে মাঝে কোথাও তার অস্তিত্ব চোখে পড়ত না। মিউজিকের আওয়াজও নেই। দেয়ালে বল ছুড়ে মারার আওয়াজ নেই। বাঁ দিকের ব্যালকনিতে, বন্ধ জানালায় সুনসান নিস্তব্ধতা নেমে আসত বেশ কদিনের জন্যে। তখন আমার প্রায়ই মনে পড়ত কানের কাছে মুখ এনে নিচু স্বরে বলা মিসেস চাওয়ের কথাগুলো। ‘এই যে উচ্চ ভলিউমে মিউজিক বাজালে তোমরা ছুটে আসো, অভিযোগ জানাও, তারপর কিছুক্ষণ গল্প করে ফিরে যাও, এই সঙ্গটুকুর জন্যেই...। নিঃসঙ্গভাবে দীর্ঘ জীবন বেঁচে থাকা একটা অভিশাপের মতো, বুঝলে? এমন বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়? হা হা হা...’
ব্যালকনিতে বসে খাঁজকাটা গাছের পাতা দেখতে দেখতে ভ্যানিলা আইসক্রিমে জিভ ছোঁয়াই। মুখজুড়ে সুমিষ্ট এক স্বাদে ভরে যায়। আমি বসন্তের তাজা বাতাসে শ্বাস নিতে নিতে ফোনের স্ক্রিনে মনোযোগী হই। এ বছর কোথায় যাওয়া যায় অবকাশ যাপনে? ইউরোপ, মেক্সিকো, গ্র্যান্ড-ক্যানিয়ন নাকি হাওয়াই? গতবার যেহেতু অরণ্যে গিয়েছি, এবার তবে পাহাড়ে। একটি একলা পাখি আচমকা বিরহী বিষণ্ন সুর তুলে ডেকে ওঠে। আমি সেদিকে তাকাই। সুনীল আকাশে একখণ্ড নিঃসঙ্গ মেঘ থেমে আছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কোথাও দিগন্তবিস্তৃত খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে বুকভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে। পৃথিবী ভর্তি অক্সিজেন। অথচ আমার ছোট খালা অক্সিজেনের অভাবে শ্বাস নিতে পারছে না। কেউ দেশে গেলে লাগেজ ভর্তি করে অক্সিজেন পাঠিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। মানুষ কতখানে যায়! আমরা কতখানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। অথচ আমার ছোট খালা বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। প্রতিবেশী মিসেস চাও এক চিলতে সঙ্গের জন্যে কী অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ডই না করে বেড়ায়। শোবার ঘর থেকে ব্যালকনিতে যাওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা পোষণ করে। স্বপ্ন দেখে। একই পৃথিবীর আলো-বাতাসে শ্বাস নেওয়া মানুষদের স্বপ্নগুলোর মাঝে আকাশ-পাতাল ফারাক।
-কুইন্স, নিউইয়র্ক
বসন্তের হাওয়া তেমন গায়ে লাগছে না। তবে শোঁ শোঁ শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল পাহাড়ি এলাকা থেকে কোনো ঝোড়ো হাওয়া ধেয়ে আসবে। ম্যাগনোলিয়া গাছের ডালে একটি একলা পাখি বিরহী বিষণ্ন সুরে ডেকে ওঠে আচমকা। ঠিক তখনই রিং বেজে উঠল। দেশের নম্বর থেকে ফোন এলে বুকের ভেতরটা আঁতকে ওঠে। বাবা-মা বেঁচে নেই যদিও, তবুও। অবশ্য আঁতকে ওঠার মতো সংবাদ আসেনি সেদিন। এসেছে আশ্বস্ত হওয়ার সংবাদ। আমার কোভিড-আক্রান্ত ছোট খালাকে অবশেষে বাসায় নেওয়া হয়েছে।
আমার ছোট খালা শান্ত, ধীর, স্থির, বয়ে চলা নদীর মতো। তাঁর জন্যে আমার এক-পৃথিবীসমান মায়া। তিনি যখন হেঁটে যান, ঘন দিঘল চুল বাতাসে দুলে ওঠে, মনে হয় যেন নিস্তরঙ্গ জল ঢেউ খেলে যায়। শীতল অথচ কর্মঠ মানুষটি জীবনের অধিকাংশ সময়ই নানান রকম শারীরিক জটিলতার মধ্য দিয়ে যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে পার করেছেন। দুর্ভোগের শুরুটা তরুণ বয়সে। আটাশির বন্যার সময় আচমকা এক সকালে ঘুম ভেঙে দেখেন, শরীর নাড়ানো যাচ্ছে না। সেই থেকে প্যারালাইজড হয়ে দিনাতিপাত করছেন। মানুষের জীবনে আচমকা আমূল পরিবর্তন আসে কখনো কখনো। ছোট খালার বিষয়টা অনেকটা তেমন। খুব বেশি দিন বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন না। একটু একটু করে ঘরের দেয়াল ধরে হাঁটতে শিখেছিলেন সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুর মতো। রান্নাঘর পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারছিলেন। তার পর থেকে আবারও শুরু হয়ে গেল সংসারের রান্নার কাজ। বলতেন, ‘তোর খালু বুয়া বা অন্য কারও হাতের রান্না খাইতে পারে না।’ আমাদের আরও আশ্বস্ত করতেন এই বলে, ‘আমার তেমন কোনো কষ্ট হয় না। বুয়াই কাটা-ধোয়া সব কাজ করে। আমি শুধু রান্নাটা বসাই। দ্যাখছ না রান্নাঘরের জন্য তোর খালু নতুন এই চেয়ারটা কিনে দিছে।’ বলতে বলতে চেয়ারে বসেই কড়াইয়ের গরম তেলে পেঁয়াজ কুচি ছেড়ে দেন ছোট খালা। তারপর আদা, রসুন, হলুদ, মরিচ, লবণ দিয়ে নাড়তে থাকেন। মসলার ঝাঁজালো গন্ধ আর ধোঁয়ায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে। আঁচলে চোখ মুছে মাছের টুকরোগুলো মসলার ওপর বিছিয়ে দেন সযত্নে। চুলার নীলচে আগুনের দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে ভাবতে থাকি, যে মানুষটি কোনো দিন কারও অহিত কামনা করে না, কারও মনে কষ্ট দিয়ে কথা পর্যন্ত বলে না; জীবনের কাছে, পরিবারের কাছে তাঁর কোনো আকাক্সক্ষা আছে বলেও শুনিনি, সেই মানুষটিই কিনা এত শারীরিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে! সৃষ্টিকর্তার এ কেমন শাস্তি!
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে থাকতাম, তখন মাস শেষে পকেটের টাকা ফুরিয়ে গেলে ছুটির দিনে মিরপুরের বাস ধরে খালার বাসায় চলে যেতাম। সারা দিন কাটাতাম। খালা যত্ন করে খাওয়াতেন। ফিরে আসার সময় ব্যাগ ধরিয়ে দিতেন। হলে ফিরে ব্যাগ থেকে ছোট ছোট বক্স ভর্তি খাবার নামিয়ে রাখতাম, যা দিয়ে পরবর্তী বেশ কিছুদিন নিশ্চিন্তে থাকা যেত।
ছোট খালার সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক। দাদি বলতেন, ‘পৃথিবীতে বাবা-মায়ের পর যদি কারও কাছে ঋণী থাকতে হয়, সে তোর ছোট খালা।’ কেননা, তিনি আমাদের লালন-পালন করেছেন মায়ের অবর্তমানে। মায়ের তখনো পড়া শেষ হয়নি। ঢাকায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে। নানু, খালা আর বাবাই আমাদের তিন ভাইবোনকে দেখভাল করতেন। সেই সুবাদে খালা আমাদের বাসার পাশের স্কুলে পড়তেন। এসএসসি পরীক্ষার ঠিক আগে হুট করেই নানা এসে তাকে নিয়ে যান। বিয়ে ঠিক হয়েছে। পাত্র দেখতে সিনেমার নায়ক আলমগীরের মতো। বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ঢাকায় বড় চাকরি করছে। আব্বা-আম্মার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও একদিন হুট করেই ছোট খালার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর খালা চলে গেলেন দূরের এক অন্তঃগ্রামে। সেখানে থাকতে হয়েছে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে। ছোটবেলায় একবার ছোট খালার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন নবান্নের দিন ছিল। সদ্য ওঠা নতুন ধানের সুবাসে ভরপুর গোটা গ্রাম। কৃষকের চোখে লাল-সবুজ স্বপ্ন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ছোট খালা তখন রান্না শেষে সবাইকে খাবার দিয়ে পুকুরঘাটে কাপড় কাচছিলেন। এতটুকুন মানুষটি কত কাজ করতে পারে? ক্যামন এক সুনসান নীরবতার মধ্য দিয়ে দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলেন শেষ বিকেলে একাকী। খাবার চিবোতে চিবোতে বিষণ্ন স্বরে বলেছিলেন, ‘বুঝলি ঝলক, বাড়ির বড় বউ হইলে অনেক দায়িত্ব। শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবর...।’ তাঁর কণ্ঠস্বর সমুদ্রের ঢেউভাঙা শব্দের ন্যায় বিষণ্ন শোনাল। এ কদিনেই ছোট খালা কেমন ম্লান, ম্রিয়মাণ হয়ে গেছেন। আমি সেই স্বতঃস্ফূর্ত, হাসিখুশি মানুষটিকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। চলে আসার সময় বুকে জড়িয়ে ধরে খুব করে কেঁদেছিলেন। অনেকগুলো বছর গ্রামে কাটিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির মৃত্যুর পর খালাকে শহরে নিয়ে আসা হয় খালুর একলা শহুরে জীবনে খাওয়াদাওয়ায় সমস্যা হওয়ায়। সেই থেকে ছোট খালা ঢাকায়।
ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করায় মরুর বুকে তৃষ্ণার্ত পথিকের তেষ্টা মেটানোর মতো আমার হোস্টেল-জীবনটা প্রাণ পেয়েছিল। মাস্টার্স ফাইনালের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হুট করেই ডিভি লটারি পেয়ে আমেরিকায় আসার সুযোগটা পেয়ে যাই। যাবতীয় পেপার ওয়ার্ক সম্পন্ন। শুধু ভিসা ফি দেওয়া বাকি। এতগুলো টাকা কোথায় পাব? বাবা-মাকে টেনশনে ফেলতে ইচ্ছে করল না। বিষয়টা নিয়ে বুদ্ধি-পরামর্শের জন্যে হোস্টেলের কয়েন বক্স থেকে ছোট খালার সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছিলাম মাত্র। অস্থিরতায় ঘুম আসে না। নির্ঘুম রাত শেষে ভোরের দিকে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম। কে যেন মশারির বাইরে থেকে ডেকে ডেকে জাগানোর চেষ্টা করছিল। মনে হলো স্বপ্ন দেখছি। বোবায় ধরার মতো করে মুখ দিয়ে গোঙানির শব্দ বের হচ্ছিল। কেউ জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে তুলল। চোখ কচলে ধড়ফড়ে বুক নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসি। দেখি, আমার খালাতো ভাই শৈবাল। একটা রুমালের পুঁটলি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঝলক ভাইয়া, এইটা রাখো। আম্মা দিছে।’ ঘুমঘোর কাটার আগেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল। চোখ মেলে দেখি রুমালের ভেতর কী যেন গিঁট দিয়ে বাঁধা। সঙ্গে চিরকুট। খুলে পড়তে শুরু করি। ‘বাবা ঝলক, এই মুহূর্তে এই জিনিসগুলোই আমার সম্বল। বিক্রয় করিয়া যাহা পাও, তাহা দিয়া আপাতত কাজ চালাও। ইতি তোমার ছোট খালা।’ ছোট খালা আমাকে তুই সম্বোধন করলেও চিঠিতে তুমি সম্বোধন করেছেন। বিষয়টি মনের জানালায় তীব্র বেগে ডানা ঝাপটায়। সেই আওয়াজের মাঝেই রুমালের গিঁট খুলি। একটি চেইন, বেঁকে যাওয়া আংটি ও নাকফুল। দীর্ঘ ব্যবহারে ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে কালচে রং ধারণ করেছে। আমার চোখ থইথই জলে ভরে ওঠে। বর্ষার ভারন্ত নদীর মতো। গহনাহীন ছোট খালার বিবর্ণ রূপ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দাদির বলে যাওয়া সেই কথাটি প্রবল বেগে কড়া নাড়ে হৃদয় গহিনে, ‘পৃথিবীতে বাবা-মার পরে যদি কারও কাছে ঋণী থাকতে হয়, সে তোর ছোট খালা।’ দুর্দিনে যে এমন করে সুপারওম্যান হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। জিনিসগুলো বিক্রি করে ভিসা ফি জমা দিই। সহসাই একদিন উড়াল যানে চেপে আমেরিকার উদ্দেশে রওনা দিই। এই সব আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগের কথা।
এই তিন দশকে দেশে গিয়েছি বেশ কয়েকবার। যতবারই দেখা হয়, ছোট খালার মুখনিঃসৃত প্রথম বাক্য, ‘কিরে ঝলক, তুই এত শুকায়ে গেছস ক্যান? মাইনসে বিদেশ গিয়া সুন্দর হয়, হৃষ্টপুষ্ট হয়। তোর কোনো অসুখ হইছে নি?’ এমন বাক্য চিরকাল আম্মার মুখে শুনে অভ্যস্ত ছিলাম। ফোন করলেই বলতেন, ‘তুই ইট্টু মোটা হইছস নি রে, ঝলক?’ ছোট খালার মুখে একই কথার পুনরাবৃত্তি শুনে মনে হলো আমার মায়ের সংস্করণ। আমি খালাকে জড়িয়ে ধরি। একেবারে বুকের সঙ্গে পিষে ফেলার মতো জোরে। ‘আহ ছাড় ছাড়...’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন তিনি। তখন আমার ভেতরে বিচিত্র এক অনুভূতি হয়। সারা ঘরে মা মা মিষ্টি সুবাস ভেসে বেড়ায়।
সেই ছোট খালা করোনার সময়ে আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন আরও তেরো জন রোগীর সঙ্গে। আজ এই রোগী মারা যায় তো কাল অন্য রোগী। রোগীর স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে রোজ। ভাগ্যিস, ছোট খালা হিয়ারিং এইড ছাড়া কানে তেমন শুনতে পান না। ভারী পর্দা টানানো প্রত্যেক রোগীর বিছানার চারপাশে। নইলে একজনের মৃত্যুতে অন্যরা মনোবল হারিয়ে ফেলাটা স্বাভাবিক ছিল। ছোট খালা কখনো কখনো অচেতন থাকেন। বিদেশের বাড়িতে বসে এসব সংবাদ শুনে আমার মস্তিষ্ক অনুভূতিশূন্য হয়ে উঠত। সেই সময়ে প্রায়ই বাড়ির সামনের লনে কারও পোষা কুকুর ডেকে উঠত। এমন অদ্ভুত সুরে কুকুরের কান্না আমি আগে কখনো শুনিনি। অজানা আশঙ্কায় আমার সমস্ত শরীর হিম হয়ে আসত। ডাক্তাররা সব আশা ছেড়ে দিয়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে লাইফ সাপোর্টে নিতে চায় খালাকে। কিন্তু শৈবাল কিছুতেই রাজি হয় না। কদিন হাসপাতালে থেকে তার বদ্ধমূল ধারণা ও আশঙ্কা জন্মেছে, এতে তার মায়ের মৃত্যুকে আরও ত্বরান্বিত করা হবে। যে এগারো জনকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছিল, শেষ অবধি তারা কেউই আর ফিরে আসেনি। ছোট খালার অক্সিজেন স্যাচুরেশন অস্বাভাবিকভাবে নেমে যাচ্ছিল। অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছিল। রক্তে শর্করার আধিক্য। কদিন যমে-মানুষে লড়াই চলে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে, ডাক্তারদের ভুল প্রমাণ করে তিনি ফিরে আসেন অবশেষে। আইসিইউ থেকে সিসিইউ, তারপর কেবিনে স্থানান্তরিত করা হলে ছোট খালা তার সঙ্গের বাকি রোগীদের কথা জানতে চান। তারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছে বলে জানানো হয়। সব মিথ্যে তো আর ক্ষতিকর নয়! নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো ছোট খালাও বাড়ি ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। হাতের শিরায় স্যালাইনের তার লাগানো অবস্থায় আর শুয়ে থাকতে চান না হাসপাতালের সাদা বিছানায়।
দীর্ঘ হাসপাতাল-বাস শেষে ছোট খালাকে বাসায় নেওয়া হয়েছে। অযত্নে তাঁর ঘন দিঘল চুলে জট লেগে যায় বিধায় ঘাড় অবধি সব চুল কেটে ফেলা হয়। পশ্চিম গোলার্ধে ব্যালকনিতে বসে বসন্তের নাতিশীতোষ্ণ দিনে ফোনের এই প্রান্তে আমি ভিডিও কলে খালাকে দেখি। দীর্ঘ অসুস্থতায় শুকিয়ে ছোট হয়ে গিয়েছেন। ‘কেমন আছেন?’ জানতে চাই। খুব ক্ষীণ কণ্ঠে ধীরে ধীরে বললেন, দোয়া করিস, যেন বাথরুমে অন্তত যাইতে পারি। নিজে নিজে টয়লেট করতে পারি। সবাইরে আর কত কষ্ট দিমু?’ আমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে দুষ্টুমির ছলে বলি, ‘বয়কাট চুলে তোমারে নায়িকা ববিতার মতো স্মার্ট লাগতেছে, খালা।’ তিনি হা হা করে হাসেন। তারপর প্রচণ্ড কাশির দমক। বালিশ পেছনে দিয়ে ছোট খালাকে হেলান দিয়ে বসিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হয়। তিনি বড় বড় শ্বাস ফেলছিলেন। বুকের পাঁজর ওঠা-নামা করছিল। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা শ্বাস অদ্ভুত এক আওয়াজ তুলছিল। আমি তার বুকের ভেতরের শাঁ শাঁ শব্দ হাজার হাজার মাইল দূর থেকে শুনতে পাই। যেন বাঁশঝাড়ের ওপর দিয়ে প্রবল প্রলয় বইছে।
ছোট খালা-সংক্রান্ত ভাবনায় ছেদ পড়ে। মুখ তুলে উইপিং উইলো গাছের দিকে তাকাই। বাঁ পাশের জানালায় দৃষ্টি স্থির হয়। মিসেস চাও হাসি হাসি মুখ করে কুশলাদি জানতে চায় ক্ষীণ স্বরে। উত্তর দিতে ইচ্ছা হলো না। তবু বললাম, ভালো আছি। হালকা-পাতলা গড়নের চায়নিজ প্রায় শতবর্ষী বৃদ্ধা মিসেস চাওকে এবার অনেক দিন পর দেখলাম। প্রথম দিন অর্থাৎ বছর পাঁচেক আগে সে পরিচয় দিয়েছিল এভাবে, ‘হাই, আমার নাম চাও। চাও মানে ছেড়ে যাওয়া। নামের মতোই আমাকে একে একে সকলে ছেড়ে গেছে। স্বামী পরপারে। ছেলেমেয়েরা যে যার মতো আছে। হা হা হা...’
কী অদ্ভুত! দুঃখের কথা বলতে গিয়েও মানুষ এভাবে হাসে? প্রত্যুত্তরে আমিও নির্বোধের মতো শুধু স্মিত হেসেছিলাম।
‘জানো তো, এবার মরতে মরতে ফিরে এসেছি।’ প্রতিবেশী চাও তার বাঁধাই করা দন্ত বিকশিত হাসি হেসে বলল। যদিও তার হাসিটা এবার বরাবরের মতো স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। মলিন লাগছিল। এবং অতটুকু বলতেই তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেল।
সত্যিই অনেক দিন তার ঘর থেকে মিউজিকের আওয়াজ ভেসে আসেনি। ভেবেছিলাম বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছি।
-উনত্রিশ দিন রিহ্যাবে ছিলাম, বুঝলে? আজই ফিরেছি। আবার জ্বালাতন করব তোমাদের, হা হা হা।
সব কথার শেষে হা হা করে হেসে ওঠা তার মুদ্রাদোষ মনে হয়। হাসলে চাওয়ের চোখ প্রসববেদনায় কাতর রোগীর চোখের মতো কুঁচকে বন্ধ হয়ে যায়।
Ñআশা করি সুস্থ হয়ে আবারও ব্যালকনিতে আসতে পারব। তার চোখজুড়ে ‘কোথাও কেউ নেই’ দৃষ্টি।
এরপর আর কথা চালিয়ে নেওয়ার মতো দম পেল না মিসেস চাও। ফলে কথা বলা থেকে বিরত রইল।
বললাম, তোমার ছেলেরা দেখতে এল না?
সে না-সূচক মাথা নাড়ল। তার প্রতিক্রিয়া মাথা নাড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল।
আমরা যে কমপ্লেক্সে থাকি, তার দেয়ালে বড় বড় হরফে নিয়মকানুন-সংবলিত সাইনবোর্ড টানানো। লনে বাইক চালানো যাবে না। বল খেলা যাবে না। উইক ডেগুলোতে রাত দশটার পর জোরে মিউজিক বাজানো যাবে না, অন্যের অসুবিধা করা যাবে না ইত্যাদি। মিসেস চাওকে অপছন্দ করার কারণ, সে এসব নিয়মের ধার ধারে না। রাত দশটার পর তার জানালা দিয়ে উচ্চ ভলিউমের মিউজিকের আওয়াজ ভেসে আসে। ঘরের দেয়ালে বল ছুড়ে মারে। এতে দেয়ালের ও-পাশের ফ্ল্যাটে বিকট আওয়াজ হয়। বেশ কবার অনেকেই রাগান্বিত হয়ে তাকে সচেতন করতে গিয়েছিল। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে সবাই হাসি হাসি মুখ করে নিজ অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গিয়েছে। অগত্যা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ভলিউম কমানোর কথা বলতে গিয়েছিলাম আমিও একাধিকবার। দরজা খুলেই হাসিমুখ করে ‘হ্যালো মিস্টার জেলাস’ সম্বোধন করত। প্রতিবারই মিসেস চাও কমপক্ষে আমার কুড়ি মিনিট সময় নষ্ট করেছে নাছোড়বান্দার মতো তার যৌবনকালের গল্প জুড়ে দিয়ে।
-জানো, বিয়ের আগেই আমার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। আমি মা হই আঠারোর আগে। তারপর আরও দুই সন্তান। আমরা বিয়ে করি পঞ্চাশের পর। বিয়েটা জরুরি ছিল না। বিশ্বাসটাই জরুরি। কী বলো? হা হা হা! ভেতরে এসে বসো। তোমাকে আমাদের বিয়ের অ্যালবাম দেখাই।
সত্যিই সে হাতের কাছে রাখা অ্যালবাম পাতা উল্টে দেখায়। যেন এটি দেখানোর জন্যেই ওত পেতে বসে ছিল। অ্যালবামের পাতায় তাকিয়ে দেখি মধ্যবয়সী দুজন নর-নারী বর-কনে সাজে বসে আছে। পাশেই তাদের তরুণ তিন সন্তান। আমি আশ্চর্য হই। আমার দেশে বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে এমন সন্তান জন্ম নিলে তাদের জারজ বলে আখ্যায়িত করা হয়। অথচ কী অবলীলায় মিসেস চাও তার জীবনদর্শন শোনাল!
যে ঘুমের ব্যাঘাত হওয়ার অভিযোগ জানাতে এসেছিলাম, তা বেমালুম ভুলে গিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম অন্য রকম এক উপলব্ধি নিয়ে।
বসন্ত বা গ্রীষ্মের বিকেলগুলোয় ব্যালকনিতে, লনে ওয়াকার ঠেলে হাঁটতে বের হতো মিসেস চাও। বয়সের ভারে কিঞ্চিৎ বেঁকে যাওয়া সব কটি আঙুলে আংটি। মুখভর্তি কড়া মেকআপ। সামনে পেলেই গল্প জুড়ে দিত। চোখেমুখে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে বলত, মাদারস ডে তে ছেলে কার্ড ও উপহার পাঠিয়েছে, আসছে থ্যাংকস গিভিং ডে তে ছেলেরা বেড়াতে আসবে, ক্রিসমাসের ছুটিতেও আসবে... ইত্যাদি। কিন্তু কোনো দিন মেইলম্যান আর অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া আর কাউকে তার কাছে আসতে দেখিনি। মাঝে মাঝে ফোরটি সিক্স অ্যাভিনিউর রাস্তা বন্ধ করে, চক্রাকারে জ্বলতে থাকা লাল বাতির অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত অনেকটা সময়। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দেখতাম, স্ট্রেচারে করে মিসেস চাওকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মাঝে মাঝে কোথাও তার অস্তিত্ব চোখে পড়ত না। মিউজিকের আওয়াজও নেই। দেয়ালে বল ছুড়ে মারার আওয়াজ নেই। বাঁ দিকের ব্যালকনিতে, বন্ধ জানালায় সুনসান নিস্তব্ধতা নেমে আসত বেশ কদিনের জন্যে। তখন আমার প্রায়ই মনে পড়ত কানের কাছে মুখ এনে নিচু স্বরে বলা মিসেস চাওয়ের কথাগুলো। ‘এই যে উচ্চ ভলিউমে মিউজিক বাজালে তোমরা ছুটে আসো, অভিযোগ জানাও, তারপর কিছুক্ষণ গল্প করে ফিরে যাও, এই সঙ্গটুকুর জন্যেই...। নিঃসঙ্গভাবে দীর্ঘ জীবন বেঁচে থাকা একটা অভিশাপের মতো, বুঝলে? এমন বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়? হা হা হা...’
ব্যালকনিতে বসে খাঁজকাটা গাছের পাতা দেখতে দেখতে ভ্যানিলা আইসক্রিমে জিভ ছোঁয়াই। মুখজুড়ে সুমিষ্ট এক স্বাদে ভরে যায়। আমি বসন্তের তাজা বাতাসে শ্বাস নিতে নিতে ফোনের স্ক্রিনে মনোযোগী হই। এ বছর কোথায় যাওয়া যায় অবকাশ যাপনে? ইউরোপ, মেক্সিকো, গ্র্যান্ড-ক্যানিয়ন নাকি হাওয়াই? গতবার যেহেতু অরণ্যে গিয়েছি, এবার তবে পাহাড়ে। একটি একলা পাখি আচমকা বিরহী বিষণ্ন সুর তুলে ডেকে ওঠে। আমি সেদিকে তাকাই। সুনীল আকাশে একখণ্ড নিঃসঙ্গ মেঘ থেমে আছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কোথাও দিগন্তবিস্তৃত খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে বুকভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে। পৃথিবী ভর্তি অক্সিজেন। অথচ আমার ছোট খালা অক্সিজেনের অভাবে শ্বাস নিতে পারছে না। কেউ দেশে গেলে লাগেজ ভর্তি করে অক্সিজেন পাঠিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। মানুষ কতখানে যায়! আমরা কতখানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। অথচ আমার ছোট খালা বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। প্রতিবেশী মিসেস চাও এক চিলতে সঙ্গের জন্যে কী অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ডই না করে বেড়ায়। শোবার ঘর থেকে ব্যালকনিতে যাওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা পোষণ করে। স্বপ্ন দেখে। একই পৃথিবীর আলো-বাতাসে শ্বাস নেওয়া মানুষদের স্বপ্নগুলোর মাঝে আকাশ-পাতাল ফারাক।
-কুইন্স, নিউইয়র্ক