প্রশান্তির ঘুম 

প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩৬ , অনলাইন ভার্সন
৬০ বছর বয়সী যেকোনো মানুষ তার জীবনকালে প্রায় ২০ বছর ঘুমিয়ে কাটিয়েছে, বিষয়টা ভাবলে সত্যিই অন্য রকম একটা অনুভূতি হয়। তবে এটা জেনে এবং এ বিষয়ে ভেবে কেউ যেন প্রয়োজনীয়তার চেয়ে কম ঘুমাবেন না।

ঘুম মানবদেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি শারীরিক প্রক্রিয়া। ঘুমের মাধ্যমে প্রতিদিন মানুষের দেহের নানা শূন্যস্থান পূরণ হয়। ঘুম মানুষের মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শরীর সুস্থ রাখতে দরকার ভালো খাদ্যাভ্যাস আর পর্যাপ্ত ঘুম। ভালো ঘুম হওয়া মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘুম আমাদের শরীরকে রিচার্জ করার মাধ্যমে মনে ও মগজে সজীব ও প্রাণচঞ্চল হতে সাহায্য করে, যা যেকোনো মানুষের সারা দিনের সার্বিক কাজের জন্য দারুণ সহায়ক হয়।
স্বাস্থ্যকর খাবার এবং ব্যায়ামের মতো ঘুমও সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ে মানুষের ঘুমের সময় ও মান আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। এটার অন্যতম কারণ হচ্ছে ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যাওয়া। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ বা সত্তরের দশকে আমার ছেলেবেলায় দেখেছি, মাগরিবের পরপরই রাতের খাওয়া, তার কিছুক্ষণ পরই এশার নামাজ শেষে আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম। অর্থাৎ রাতে ঘুমাতে যেতাম আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে আর ভোরে ঘুম থেকে উঠতাম পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটায়। ১৯৮০ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়তে শুরু হলো, মধ্যবিত্তদের ঘরে ঘরে টেলিভিশন আসতে লাগল। আমাদের ঘুমাতে যাওয়ার সময়ও আটটা সাড়ে আটটা থেকে দশটা সাড়ে দশটায় পৌঁছাল।

এখনকার সময়ে মানুষের রোগব্যাধির পরিমাণও বেড়ে গেছে আগের তুলনায় আর নতুন নতুন অসুখ-বিসুখের উৎপত্তি হয়েছে ইদানীংকালে। ঘুমের স্বল্পতা বা পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবের কারণে মানুষের অসুস্থ হয়ে পড়াটা খুবই স্বাভাবিক। সে জন্য মানুষের প্রয়োজনীয় ঘুমের দরকার। ঘুমালে মানুষের মস্তিষ্ক শীতল থাকে। ফলে সবকিছু খুব সহজেই মনে থাকে। মূলত মস্তিষ্কের কোষগুলো ঘুমের সময় স্মৃতিকে নতুন করে সাজিয়ে নেয়। এতে ঘুম থেকে ওঠার পর স্মৃতিগুলো ব্যবহারোপযোগী হয়।

ঘুমের অভাবে মানুষের আবেগগত সমস্যা হতে পারে। পর্যাপ্ত ঘুমের মাধ্যমে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারলে আবেগগত সমস্যা দূর হয়ে যায়। ঘুমের ফলে দেহের হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক হয়, যা যৌনতার জন্য প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। সে জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের মাধ্যমে যৌনতার উন্নতি হয়। মানুষের প্রতিদিন প্রায় আট ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। গবেষকেরা বলছেন, যারা রাতে ছয় ঘণ্টা বা এর চেয়ে বেশি ঘুমান, তারা একটু বেশিই আয়ু কমে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
ঘুমের ফলে দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। ঘুমের জন্য শরীরের হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকায় রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঘুম বেশি হলে ওজন কমে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ঘুম বেশি হলে বিপাকপ্রক্রিয়া ঠিকভাবে সম্পন্ন হয়। ফলে যেসব খাদ্য উপাদান মেদ বাড়ায়, সেগুলো হজম হয়ে যায়।

সুতরাং মেদ কমাতে শুধু পরিমিত খাওয়া, ব্যায়ামের পাশাপাশি ঘুমেরও দরকার। আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে স্ট্রেস মানুষের নিত্যসঙ্গী। সারা দিনের কাজ, বিভিন্ন রকমের ঝামেলা-এসব কিছু থেকেই তৈরি হয় স্ট্রেস। আর এই স্ট্রেস দূর করতে ঘুমের চেয়ে কার্যকর আর কিছুই হতে পারে না। সুন্দর ঘুম মানসিক স্বস্তি দেয়, শরীরটা ঝরঝরে অনুভূত হয়।

গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। মানুষের মোট ঘুমের ৭৫ শতাংশ সাধারণ ঘুম আর ২৫ শতাংশ গভীর ঘুম। ঘুমের প্রথম ৯০ মিনিট REM = Rapid eye movement. এই REM-এর সময়ে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকে। প্রতি রাতে অন্তত এক ঘণ্টা তিরিশ মিনিট গভীর ঘুম দরকার। মূলত গভীর ঘুমের সময় পেশি, কোষ, মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ বিশ্রাম অবস্থায় শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। এবং রক্ত সঞ্চালন, হৃৎস্পন্দনের গতি বৃদ্ধি পায়। গভীর ঘুমের এ সময়ে দিনের যাবতীয় ক্লান্তিভাব, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ দূর হয়।

এবার দেখা যাক, কীভাবে ঘুমানো শরীরের জন্য ভালো। গবেষকেরা দেখেছেন, ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ পাশ ফিরে ঘুমায়, ৩৮ শতাংশ ঘুমায় চিত হয়ে আর ৭ শতাংশ ঘুমায় উপুড় হয়ে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাত হয়ে ঘুমানোর সময়ও তাদের বাড়ে। তিন বছরের বেশি বয়সের বাচ্চারা চিত/কাত বা উপুড় হয়ে প্রায় সমান সময় ঘুমায় আর তিন বছরের নিচের শিশুরা প্রধানত চিত হয়েই ঘুমায়। মূলত নিরাপত্তার জন্য তাদের চিত করেই শুয়ে রাখা হয়। সুতরাং বেশির ভাগ লোক পাশ ফিরে ঘুমায় কিন্তু কোন পাশ হয়ে ঘুমানোটা বেশি উপকারী?

গবেষকেরা বলছেন, যারা ডান দিকে পাশ ফিরে ঘুমায়, তাদের ঘুমের মান যারা বাম দিকে পাশ হয়ে ঘুমায়, তাদের চেয়ে কিছুটা ভালো। চিত হয়ে ঘুমালে নাক ডাকার মতো শ্বাসকষ্টের সমস্যা বেশি হয়। যারা নিয়মিত চিত হয়ে ঘুমান, তাদের অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার জন্য ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস একবার বন্ধ একবার চালু হয়। আর পাশ ফিরে ঘুমালে মানুষের শ্বাসনালির উপরের দিকটায় কোনো বাধা থাকে না। সে জন্য অনেক ক্ষেত্রে চিত হয়ে ঘুমানোর পরিবর্তে পাশ ফিরে ঘুমালে স্লিপ অ্যাপনিয়া সমস্যা দূর হয়ে যায়। এ ছাড়া কাত হয়ে ঘুমালে পিঠে ব্যথা হওয়ার শঙ্কা কম। তবে কাত হয়ে ঘুমালে ঘাড়ে ব্যথা হওয়ার শঙ্কা থাকে, যদি না সমানভাবে না ঘুমায়। মুসলমানদের কাছে ডান পাশে কাত হয়ে ঘুমানো সুন্নত।
রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে না পারার সমস্যা আমাদের সবারই কম-বেশি হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনিদ্রাজনিত সমস্যা অনেকের ক্ষেত্রে বাড়তে থাকে। যদি কারও নিয়মিত ঘুমের সমস্যা হয়, তাহলে সম্ভবত তার অনিদ্রা রোগ বা Insomnia হয়েছে, বলা যায়।

ইনসমনিয়ার লক্ষণ হলো ঘুমাতে সমস্যা হয়, রাতে বেশ কয়েকবার ঘুম ভেঙে যায়, ঘুমের জন্য শুয়ে থাকলেও ঘুম না আসা, খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায় এবং পরে আর ঘুম আসে না, ঘুম থেকে উঠে ক্লান্তি লাগে, ক্লান্ত থাকলেও দিনের বেলা ঘুম হয় না, ক্লান্তির জন্য দিনের বেলা কোনো কাজে মন বসে না।
Insomnia সাধারণত যেসব কারণে হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও বিষণ্নতা, অতিরিক্ত শব্দ, অতিরিক্ত ঠান্ডা কিংবা অতিরিক্ত গরম ঘর, আরামদায়ক নয় এমন বিছানা, অ্যালকোহল, ক্যাফেইন ও নিকোটিন, কোকেইন কিংবা অন্য ধরনের মাদক, ভ্রমণজনিত ক্লান্তি, শিফটে কাজ করা প্রভৃতি। এ ছাড়া মানসিক সমস্যাজনিত রোগ সিজোফ্রেনিয়া কিংবা বাইপোলার ডিজঅর্ডার। আলঝেইমার বা পারকিনসন্স ডিজিজ, রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম নামে একধরনের রোগ, থাইরয়েড সমস্যা, মহিলাদের মেনোপজ। আবার উল্লিখিত অসুস্থতার কারণে নেওয়া বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়ও ইনসমনিয়া হতে পারে।

ঘুমের অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ইনসমনিয়া দূর করা সম্ভব। যেমন প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠা। ঘুমাতে যাওয়ার এক ঘণ্টা আগে থেকে বিশ্রাম নেওয়া। যে ঘরে ঘুমাবেন, সে ঘরটি যেন অন্ধকার ও নিঃশব্দ হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা। ব্যায়ামের অভ্যাস করা এবং বিছানাটা যেন আরামদায়ক হয়, সেটা নিশ্চিত করা। আর চা-কফি, কোলা-চকলেট, ড্রিঙ্কসহ বেশি মিষ্টি খাবার না খাওয়া।

তার পরও নানা শ্রেণির মানুষের নানা ধরনের সামাজিক, মানসিক, আর্থিক সমস্যা থাকাটা স্বাভাবিক। এসবের যেকোনো সমস্যার কারণে যদি মাঝরাতে অথবা রাতের যেকোনো সময় ঘুম ভেঙে যায় এবং পুনরায় ঘুম না আসে, তাহলে শুয়ে না থেকে উঠে প্রশান্তিকর কিছু করা ভালো। যেমন বইপড়া বা ভালো গান শোনা। অথবা শুয়ে শুয়ে মানসিক ব্যায়াম, যেমন নিজের মনমতো কোনো ভালো ঘটনা বা পরিবেশ-পরিস্থিতি ধাপে ধাপে সুন্দর পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করলে নিজস্ব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে ঘুম চলে আসে। উল্লিখিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করার পরও যদি রাতের পর রাত অনিদ্রা দূর না হয়, তাহলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। সাময়িক সময়ের জন্য ঘুমের ওষুধ গ্রহণ করা যেতে পারে, তবে দীর্ঘ মেয়াদে ঘুমের ওষুধ না নেওয়াই ভালো। সাধারণত এ জাতীয় ওষুধের বিভিন্ন রকম খারাপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়।
তথ্যসূত্র : পত্রপত্রিকা ও বিবিসি
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078