‘প্রান্তিক মানুষের কাছে স্বাধীনতার সুফল পৌঁছে দেবার প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আরও বহু পথ যেতে হবে।’ (রবার্ট ফ্রস্ট)
একটা গল্প বলি শুনুন। কাল্পনিক নয়- সত্যি। যদিও প্রবন্ধ লিখতে গেলে কিছুটা ইতিহাস সচেতন হতে হয়। এবং বিষয়টি নিয়ে পড়ালেখা করতে হয়। সেখানে গল্প বা কাহিনীর একদম যে সুযোগ নেই- সেটা কখনো নয়। এইসব কথার বুনটের মাঝে ইতিহাস অনেক সময় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সময়টা ১৯৭২। দেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। চারদিকে তখনও হাহাকার।
সন্তান আর স্বজন হারানোর বেদনায় চারদিকের বাতাস বড়ই শোকার্ত। মনে পড়ে- একদিন বড় ভাইয়ের খোঁজে গুলিস্তান থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট হেঁটে গিয়েছিলাম। বুকে বড় আশা- কোথায়ও যদি দেখা মেলে!! আজ অনেক ক’টি বছরÑ দেখা পাইনি!! বুকের মধ্যে আরেকটি আশা পোষণ করছিলাম। ইচ্ছে ছিলো কোথায়ও যদি বৃত্তি পাওয়া যায়Ñ তবে উচ্চশিক্ষার জন্য পা বাড়াবো। অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাসের মহামান্য রাষ্ট্রদূত মি. এলেনের সাথে কোনো এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়। কথা প্রসঙ্গে আমার আশা-নিরাশার কথা জানালাম।
মি. এলেন চমৎকার বাংলা বলেন। একটু হেসে বললেন- ‘অস্ট্রেলিয়াতে এখনো তেমন কোনো সুযোগ হয়নি, হয়তো হবে ভবিষ্যতে। তুমি বরং আমেরিকান দূতাবাসে যাও। তুমি যে বিষয় নিয়ে পড়তে চাইছোÑ ওখানে নিশ্চিৎ কিছু পাওয়া যাবে।’
বলাবাহুল্য তখন আমি ফার্মেসিতে মাস্টার্স শেষ করেছি। যেহেতু বিষয়টি মানুষের জীবনের অপরিহার্য ‘ওষুধ’ প্রস্তুত প্রণালী এবং মানবদেহে তার প্রতিক্রিয়া বিষয়ক- তার জন্য রিসার্চ অত্যন্ত জরুরি। এখানে আরো একটু জেনে রাখা জরুরি- ‘ফার্মেসি’ নিয়ে কেউ পড়তে চাইতেন না! বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে, এমন কি বাংলাদেশেও, এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।
যাহোক- মার্কিন দূতাবাসে ফিরে যাই এবার। ডেস্কে ছিলেন মি. মজুমদার। ফার্মাসিস্ট শুনে বললেন- আমেরিকা যাবার সুযোগ অবশ্যই আছে। সাহেব অর্থাৎ কনস্যুলার সাহেবের সাথে দেখা করতে হবে। গেলাম, পরিচয় দিলাম। উনি বললেন- ডাক্তার, নার্স এবং ফার্মাসিস্ট এখন আমেরিকাতে ইমিগ্রেন্ট হয়ে আসতে পারবে। তবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র লাগবে। তাহলে পড়াশোনা? সাহেব বললেন- ‘যদি যেতে পারো- ওটাও হবে। তবে খাটতে হবে।’
এবার শেষ প্রশ্ন- ‘তোমরা বাংলাদেশ থেকে এই স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিয়ে যেতে আগ্রহী কেনো?’
মৃদু হেসে উনি বললেন- ‘বাছাধন ভুলে যেও না, তোমরা এখন একটি নতুন দেশের সূর্যসন্তান। পাকিস্তান নয়, এখন তোমরা এই নতুন দেশ “বাংলাদেশের” নাগরিক। আমেরিকা সব সময় নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের নাগরিকদের সুবিধা দিতে আগ্রহী।’
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসলাম। মতিঝিলে বেলাশেষের পথযাত্রীদের ভীড়। মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে- আমরা সবাই আজ স্বাধীন। আমরা সবাই নতুন এক দেশের নাগরিক। অথচ কিছুদিন আগেও এই ধরণের সুযোগ-সুবিধার কথা ছিলো না। জয়তু বাংলাদেশ।
গল্পটি এখানেই শেষ। কিন্তু শেষের পরেও শুরু রয়েছে। শুরুটা হলো- চিন্তা ও ভাবনার শুরু। স্বাধীনতা- এই চারটি অক্ষরে এমন কী তেজস্বীতার স্বাক্ষর রয়েছে যে- বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাকে সমাদৃত করে। তাইতো যখন দেখি জ্যাকসন হাইটস থেকে জ্যামাইকা পর্যন্ত আমাদের বাঙালিরা পসরা সাজিয়ে বসে আছেন- যেমন দেখি রাস্তাঘাটে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভীড়, তখন মনে হয় স্বাধীনতা আসলেই একটা অর্থবহুল ভাবাবেগ। এই স্বাধীনতার সুবাদে আজ ৫২ বছর পরে শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্বব্যাপী আমাদের পথচারণা। এবং সেটার মূলে ছিলো আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। ছিলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, সাহস এবং জীবন বিসর্জনের এক অমর ইতিহাস। এই বিজয়গাঁথার পেছনে ছিলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত বজ্র আহ্বান- “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই সংগ্রামে কতো প্রাণ ঝরে গেছে। হারিয়ে গেছে কতো মেধা, কতো জ্ঞানী ব্যক্তি- কতো সৃজনশীল দেশপ্রেমিক মানুষ-শিক্ষক-ছাত্র-জনতা-মজুর-কৃষকসহ বাংলার মেহনতী মানুষ। স্বাধীনতার এই মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁদেরকে অবনত মস্তকে স্মরণ করার জন্য আমরা দায়বদ্ধ।
কবি শামসুর রাহমান কবিতায় গেয়ে গেলেন- “হে অজ্ঞাত বীর শোনো/ তোমার সংগ্রামী স্মৃতি/ মাছের কাঁটার মতো/ লেগে আছে/ আমাদের বিবেকের শীর্ণ গলায়।” (জয়দেবপুরের মুক্তিযোদ্ধা)
তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে ‘স্বাধীনতা’ পাওয়া যেমন কঠিন- স্বাধীনতা রক্ষা করারও তেমনি সুকঠিন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনা তার কিছুটা প্রমাণ করে। এবং তার পরেই দেখা যায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিভাজন। এবং আজও অনেকে বিরূপ মন্তব্য করে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। কিন্তু উনারা (বিজ্ঞজন) জানে না- স্বাধীনতা একদিনের সংগ্রামী অর্জন নয়। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৬, তারপর ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং তারপর ১৯৭১- এই দীর্ঘ সময় ধরে সংগ্রাম চলেছে। এবং বীর বাঙালি প্রস্তুতি নিয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ করার আগে তাঁদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে আমরা দায়বদ্ধ। এই পবিত্র রমজান মাসে যখন সবাই সিয়াম সাধনার ব্রত নিয়ে ব্যস্ত- তখন পবিত্র কুরআন শরীফ মন দিয়ে পড়ে দেখুন- কী লেখা আছে পাতায় পাতায়? রাব্বুল আলামীন বারবার এরশাদ করেছেন- “তোমরা কৃতজ্ঞ থাকিও- অকৃতজ্ঞ নয়।” অকৃতজ্ঞতাকে তিনি বারে বারেই অভিশাপ দিয়েছেন। তবুও বিজ্ঞজনেরা বোঝেন না- স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ। যে কোনো সরকারের বা প্রতিষ্ঠানের নীতিমালায় প্রতিবাদের সুযোগ আছে। তেমনি ‘প্রতিবাদ’ (যাকে আমরা Action) বলি, সেটা কতোটুকু যুক্তিসঙ্গত বা আদৌ প্রয়োজন আছে কীনাÑ সেটাও ভেবে দেখা নাগরিক কর্তব্য। বিভাজন প্রক্রিয়ায় না গিয়ে বরং কেমন করে স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে আরো শক্তিশালী করা যায়- সেইদিকে মনোযোগ আর সময় দিলে আপামর জনসাধারণের মঙ্গল হতো। ঠিক কী না???
আরেকটি অংকের সমাধান করা দরকার। এবং সেটা হচ্ছে- স্বাধীনতা কেমন করে ব্যক্তিজীবনকে প্রভাবিত করতে পারে? এই প্রসঙ্গে মতবাদ হলো- FREFDOM Lends to increased productivity, creativity and high quality of life. Also, it gives you pride and self-worth.
ভাবার্থ দাঁড়ায়- মুক্তজীবন ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলে। যেহেতু ‘মুক্তি’ একটা গর্বেও বিষয়, তেমনি সেখানে আত্মবিকাশের সুযোগ রয়েছে। সৃষ্টিধর্মী কাজের সুযোগ রয়েছে। শিল্পায়ন এবং উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ রয়েছে। কথা বলে- ‘সুযোগ’ জীবনে একবারই আসে এবং তাকে সদ্ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু দলাদলি করে, প্রতিষ্ঠান ভেঙে এবং সর্বোপরি শৃঙ্খলা ভেঙে আমরা কী আদৌ ‘স্বাধীনতা’র অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো?
সমাজ পুনর্গঠনের দায়িত্ব আমাদের। দায়িত্ব বাঙালি সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দায়িত্ব মেহনতি মানুষের সাথে সংহতি। যারা রোদে পুড়ে, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে এবং কাদামাটি জলে পা ডুবিয়ে ফসল উৎপাদন করেন, তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য আমাদের শিক্ষা-বুদ্ধি-বিবেক ও চেতনার সমন্বয় প্রয়োজন। ÔDEVIDED WE FALLÕ। একতা না থাকলে জাতীয় শক্তি প্রাণহীন হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগার থেকে বের হয়ে এসেছি মুক্ত বায়ু সেবনের জন্য। সেই বায়ু যেনো দূষিত না হয়- এটাই হোক সবার শপথ।
আত্মশক্তিকে বিসর্জন দেয়া শুধু দেশের নয়-দশের ক্ষতি। নিজেরও ক্ষতি। কুড়িয়ে পাওয়া ধন, পা দিয়ে মাড়িয়ে গেলে ঈশ্বর নারাজ হবেন- সবারই সেটা জানা।
একটা উদাহরণ দেই। পরিবারটি নিউইয়র্কেই থাকেন। ব্যাংক থেকে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে চাকরি হারিয়ে যখন দিশেহারা- তখন দ্বারস্থ হলেন প্রবাসী ভাইয়ের কাছে। যথারীতি ইমিগ্রেশন হলো। বলা চলে গোটা পরিবার নিয়ে পালিয়েই আসলেন। তারপর ভাগ্যদেবী যখন সুপ্রসন্ন হলেন- তখন উনি বললেন- ‘আমার ভাই আমার জন্য কিচ্ছুই করেনি।’ আর উনার পরমাসুন্দরী স্ত্রী এক পা এগিয়ে বললেন- ‘আমি এসেছি আমার স্বামীর হাত ধরে।’
বাহ্, বাহ্, আনন্দের কথা?? তা দেবী- আপনার স্বামী কার হাত ধরে এসেছেন? এরকম আরো উদাহরণ আছে। প্রশ্ন হলো- সবকিছুই হয়েছে স্বাধীনতা প্রাপ্তির সুবাদে। আমেরিকার সরকারের কোনো মাথাব্যাথা নেই- কোন দেশে কার চাকরি গেলো? বরং একটা জায়গায় কৃতজ্ঞ থাকা প্রয়োজন- এই দেশে এখনো রক্তের সম্পর্কের ভাই-বোনদের আনার সুযোগ রয়েছে। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে এখন যদি বদনাম করে বেড়ান এবং সেটা যদি কোনদিন আমেরিকান সরকার জানতে পারে- আপনার সবুজ কার্ড লাল কার্ড হয়ে যাবে!!
আসলেই হয়তো স্বাধীনতা বা মুক্তি (FREFDOM)-এর প্রকৃত অর্থ আমাদের জানা নেই। ইতিহাসবিদরা বলেন, ‘বঙ্গ’ কথাটি এসেছে ‘ভঙ্গ’ থেকে। তাইতো সবাই বলে- ‘বাঙালি ভাঙ্গাতেই জানে, গড়তে জানে না।’
এভাবে মূল্যবোধ হারিয়ে গেলে হাশরের ময়দানে কী জবাব দেবো আমরা? বাংলাদেশের স্বাধীনতা আমাদের অর্জন। আমাদের গর্ব। আমাদের পরিচয়।
লেখক: কলামিস্ট
একটা গল্প বলি শুনুন। কাল্পনিক নয়- সত্যি। যদিও প্রবন্ধ লিখতে গেলে কিছুটা ইতিহাস সচেতন হতে হয়। এবং বিষয়টি নিয়ে পড়ালেখা করতে হয়। সেখানে গল্প বা কাহিনীর একদম যে সুযোগ নেই- সেটা কখনো নয়। এইসব কথার বুনটের মাঝে ইতিহাস অনেক সময় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সময়টা ১৯৭২। দেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। চারদিকে তখনও হাহাকার।
সন্তান আর স্বজন হারানোর বেদনায় চারদিকের বাতাস বড়ই শোকার্ত। মনে পড়ে- একদিন বড় ভাইয়ের খোঁজে গুলিস্তান থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট হেঁটে গিয়েছিলাম। বুকে বড় আশা- কোথায়ও যদি দেখা মেলে!! আজ অনেক ক’টি বছরÑ দেখা পাইনি!! বুকের মধ্যে আরেকটি আশা পোষণ করছিলাম। ইচ্ছে ছিলো কোথায়ও যদি বৃত্তি পাওয়া যায়Ñ তবে উচ্চশিক্ষার জন্য পা বাড়াবো। অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাসের মহামান্য রাষ্ট্রদূত মি. এলেনের সাথে কোনো এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়। কথা প্রসঙ্গে আমার আশা-নিরাশার কথা জানালাম।
মি. এলেন চমৎকার বাংলা বলেন। একটু হেসে বললেন- ‘অস্ট্রেলিয়াতে এখনো তেমন কোনো সুযোগ হয়নি, হয়তো হবে ভবিষ্যতে। তুমি বরং আমেরিকান দূতাবাসে যাও। তুমি যে বিষয় নিয়ে পড়তে চাইছোÑ ওখানে নিশ্চিৎ কিছু পাওয়া যাবে।’
বলাবাহুল্য তখন আমি ফার্মেসিতে মাস্টার্স শেষ করেছি। যেহেতু বিষয়টি মানুষের জীবনের অপরিহার্য ‘ওষুধ’ প্রস্তুত প্রণালী এবং মানবদেহে তার প্রতিক্রিয়া বিষয়ক- তার জন্য রিসার্চ অত্যন্ত জরুরি। এখানে আরো একটু জেনে রাখা জরুরি- ‘ফার্মেসি’ নিয়ে কেউ পড়তে চাইতেন না! বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে, এমন কি বাংলাদেশেও, এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।
যাহোক- মার্কিন দূতাবাসে ফিরে যাই এবার। ডেস্কে ছিলেন মি. মজুমদার। ফার্মাসিস্ট শুনে বললেন- আমেরিকা যাবার সুযোগ অবশ্যই আছে। সাহেব অর্থাৎ কনস্যুলার সাহেবের সাথে দেখা করতে হবে। গেলাম, পরিচয় দিলাম। উনি বললেন- ডাক্তার, নার্স এবং ফার্মাসিস্ট এখন আমেরিকাতে ইমিগ্রেন্ট হয়ে আসতে পারবে। তবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র লাগবে। তাহলে পড়াশোনা? সাহেব বললেন- ‘যদি যেতে পারো- ওটাও হবে। তবে খাটতে হবে।’
এবার শেষ প্রশ্ন- ‘তোমরা বাংলাদেশ থেকে এই স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিয়ে যেতে আগ্রহী কেনো?’
মৃদু হেসে উনি বললেন- ‘বাছাধন ভুলে যেও না, তোমরা এখন একটি নতুন দেশের সূর্যসন্তান। পাকিস্তান নয়, এখন তোমরা এই নতুন দেশ “বাংলাদেশের” নাগরিক। আমেরিকা সব সময় নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের নাগরিকদের সুবিধা দিতে আগ্রহী।’
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসলাম। মতিঝিলে বেলাশেষের পথযাত্রীদের ভীড়। মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে- আমরা সবাই আজ স্বাধীন। আমরা সবাই নতুন এক দেশের নাগরিক। অথচ কিছুদিন আগেও এই ধরণের সুযোগ-সুবিধার কথা ছিলো না। জয়তু বাংলাদেশ।
গল্পটি এখানেই শেষ। কিন্তু শেষের পরেও শুরু রয়েছে। শুরুটা হলো- চিন্তা ও ভাবনার শুরু। স্বাধীনতা- এই চারটি অক্ষরে এমন কী তেজস্বীতার স্বাক্ষর রয়েছে যে- বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাকে সমাদৃত করে। তাইতো যখন দেখি জ্যাকসন হাইটস থেকে জ্যামাইকা পর্যন্ত আমাদের বাঙালিরা পসরা সাজিয়ে বসে আছেন- যেমন দেখি রাস্তাঘাটে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভীড়, তখন মনে হয় স্বাধীনতা আসলেই একটা অর্থবহুল ভাবাবেগ। এই স্বাধীনতার সুবাদে আজ ৫২ বছর পরে শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্বব্যাপী আমাদের পথচারণা। এবং সেটার মূলে ছিলো আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। ছিলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, সাহস এবং জীবন বিসর্জনের এক অমর ইতিহাস। এই বিজয়গাঁথার পেছনে ছিলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত বজ্র আহ্বান- “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই সংগ্রামে কতো প্রাণ ঝরে গেছে। হারিয়ে গেছে কতো মেধা, কতো জ্ঞানী ব্যক্তি- কতো সৃজনশীল দেশপ্রেমিক মানুষ-শিক্ষক-ছাত্র-জনতা-মজুর-কৃষকসহ বাংলার মেহনতী মানুষ। স্বাধীনতার এই মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁদেরকে অবনত মস্তকে স্মরণ করার জন্য আমরা দায়বদ্ধ।
কবি শামসুর রাহমান কবিতায় গেয়ে গেলেন- “হে অজ্ঞাত বীর শোনো/ তোমার সংগ্রামী স্মৃতি/ মাছের কাঁটার মতো/ লেগে আছে/ আমাদের বিবেকের শীর্ণ গলায়।” (জয়দেবপুরের মুক্তিযোদ্ধা)
তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে ‘স্বাধীনতা’ পাওয়া যেমন কঠিন- স্বাধীনতা রক্ষা করারও তেমনি সুকঠিন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনা তার কিছুটা প্রমাণ করে। এবং তার পরেই দেখা যায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিভাজন। এবং আজও অনেকে বিরূপ মন্তব্য করে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। কিন্তু উনারা (বিজ্ঞজন) জানে না- স্বাধীনতা একদিনের সংগ্রামী অর্জন নয়। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৬, তারপর ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং তারপর ১৯৭১- এই দীর্ঘ সময় ধরে সংগ্রাম চলেছে। এবং বীর বাঙালি প্রস্তুতি নিয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ করার আগে তাঁদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে আমরা দায়বদ্ধ। এই পবিত্র রমজান মাসে যখন সবাই সিয়াম সাধনার ব্রত নিয়ে ব্যস্ত- তখন পবিত্র কুরআন শরীফ মন দিয়ে পড়ে দেখুন- কী লেখা আছে পাতায় পাতায়? রাব্বুল আলামীন বারবার এরশাদ করেছেন- “তোমরা কৃতজ্ঞ থাকিও- অকৃতজ্ঞ নয়।” অকৃতজ্ঞতাকে তিনি বারে বারেই অভিশাপ দিয়েছেন। তবুও বিজ্ঞজনেরা বোঝেন না- স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ। যে কোনো সরকারের বা প্রতিষ্ঠানের নীতিমালায় প্রতিবাদের সুযোগ আছে। তেমনি ‘প্রতিবাদ’ (যাকে আমরা Action) বলি, সেটা কতোটুকু যুক্তিসঙ্গত বা আদৌ প্রয়োজন আছে কীনাÑ সেটাও ভেবে দেখা নাগরিক কর্তব্য। বিভাজন প্রক্রিয়ায় না গিয়ে বরং কেমন করে স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে আরো শক্তিশালী করা যায়- সেইদিকে মনোযোগ আর সময় দিলে আপামর জনসাধারণের মঙ্গল হতো। ঠিক কী না???
আরেকটি অংকের সমাধান করা দরকার। এবং সেটা হচ্ছে- স্বাধীনতা কেমন করে ব্যক্তিজীবনকে প্রভাবিত করতে পারে? এই প্রসঙ্গে মতবাদ হলো- FREFDOM Lends to increased productivity, creativity and high quality of life. Also, it gives you pride and self-worth.
ভাবার্থ দাঁড়ায়- মুক্তজীবন ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলে। যেহেতু ‘মুক্তি’ একটা গর্বেও বিষয়, তেমনি সেখানে আত্মবিকাশের সুযোগ রয়েছে। সৃষ্টিধর্মী কাজের সুযোগ রয়েছে। শিল্পায়ন এবং উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ রয়েছে। কথা বলে- ‘সুযোগ’ জীবনে একবারই আসে এবং তাকে সদ্ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু দলাদলি করে, প্রতিষ্ঠান ভেঙে এবং সর্বোপরি শৃঙ্খলা ভেঙে আমরা কী আদৌ ‘স্বাধীনতা’র অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো?
সমাজ পুনর্গঠনের দায়িত্ব আমাদের। দায়িত্ব বাঙালি সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দায়িত্ব মেহনতি মানুষের সাথে সংহতি। যারা রোদে পুড়ে, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে এবং কাদামাটি জলে পা ডুবিয়ে ফসল উৎপাদন করেন, তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য আমাদের শিক্ষা-বুদ্ধি-বিবেক ও চেতনার সমন্বয় প্রয়োজন। ÔDEVIDED WE FALLÕ। একতা না থাকলে জাতীয় শক্তি প্রাণহীন হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগার থেকে বের হয়ে এসেছি মুক্ত বায়ু সেবনের জন্য। সেই বায়ু যেনো দূষিত না হয়- এটাই হোক সবার শপথ।
আত্মশক্তিকে বিসর্জন দেয়া শুধু দেশের নয়-দশের ক্ষতি। নিজেরও ক্ষতি। কুড়িয়ে পাওয়া ধন, পা দিয়ে মাড়িয়ে গেলে ঈশ্বর নারাজ হবেন- সবারই সেটা জানা।
একটা উদাহরণ দেই। পরিবারটি নিউইয়র্কেই থাকেন। ব্যাংক থেকে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে চাকরি হারিয়ে যখন দিশেহারা- তখন দ্বারস্থ হলেন প্রবাসী ভাইয়ের কাছে। যথারীতি ইমিগ্রেশন হলো। বলা চলে গোটা পরিবার নিয়ে পালিয়েই আসলেন। তারপর ভাগ্যদেবী যখন সুপ্রসন্ন হলেন- তখন উনি বললেন- ‘আমার ভাই আমার জন্য কিচ্ছুই করেনি।’ আর উনার পরমাসুন্দরী স্ত্রী এক পা এগিয়ে বললেন- ‘আমি এসেছি আমার স্বামীর হাত ধরে।’
বাহ্, বাহ্, আনন্দের কথা?? তা দেবী- আপনার স্বামী কার হাত ধরে এসেছেন? এরকম আরো উদাহরণ আছে। প্রশ্ন হলো- সবকিছুই হয়েছে স্বাধীনতা প্রাপ্তির সুবাদে। আমেরিকার সরকারের কোনো মাথাব্যাথা নেই- কোন দেশে কার চাকরি গেলো? বরং একটা জায়গায় কৃতজ্ঞ থাকা প্রয়োজন- এই দেশে এখনো রক্তের সম্পর্কের ভাই-বোনদের আনার সুযোগ রয়েছে। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে এখন যদি বদনাম করে বেড়ান এবং সেটা যদি কোনদিন আমেরিকান সরকার জানতে পারে- আপনার সবুজ কার্ড লাল কার্ড হয়ে যাবে!!
আসলেই হয়তো স্বাধীনতা বা মুক্তি (FREFDOM)-এর প্রকৃত অর্থ আমাদের জানা নেই। ইতিহাসবিদরা বলেন, ‘বঙ্গ’ কথাটি এসেছে ‘ভঙ্গ’ থেকে। তাইতো সবাই বলে- ‘বাঙালি ভাঙ্গাতেই জানে, গড়তে জানে না।’
এভাবে মূল্যবোধ হারিয়ে গেলে হাশরের ময়দানে কী জবাব দেবো আমরা? বাংলাদেশের স্বাধীনতা আমাদের অর্জন। আমাদের গর্ব। আমাদের পরিচয়।
লেখক: কলামিস্ট