শামসাদ হুসাম
এটা এক চিরন্তন সত্য বিষয়। দুনিয়ার যেখানেই যুদ্ধ বিগ্রহ সংঘটিত হচ্ছে, বা হয়েছে, সেই যুদ্ধের কারণে যারা প্রথমেই ক্ষতির মুখে পড়ে, তারা হচ্ছেন নারী এবং শিশুরা। নারীর উপরে আক্রমণ আসে নানা দিক দিয়ে। তবে সবচেয়ে বেশি আসে শারীরিক দিক দিয়ে। এক কথায় যাকে বলে চারিত্রিক বিপর্যয়। যদি স্বামী যুদ্ধে অংশ নিয়ে থাকেন, তবে তাকে হারানোর ভয়ে আরেক ধরণের নিরাপত্তাহীনতাবোধে আক্রান্ত হয়ে অন্য এক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। এসব ঘটনা দুনিয়ার সর্বত্র ঘটে থাকে। আর বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় যুদ্ধ একটা অনিবার্য বিষয়ে পরিণত হয়ে পড়েছে। আর যে কোনো যুদ্ধে শত্রুপক্ষকে ঘাঁয়েল করার জন্য ‘ধর্ষণ’কে সহজেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এক সময়ে জাতিসংঘ তার এক প্রজ্ঞাপনে ঘোষণা করেছিলÑ ধর্ষণজনিত কারণে সারাবিশ্বে প্রায় দুই কোটি কন্যাশিশু আজ মানসিক বৈকল্যের শিকার। এটা শুধুমাত্র কন্যাশিশুদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল। কিন্তু বাদবাকি নারী সমাজের চিত্র এক কথায় ভয়াবহ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন বাংলার নারীসমাজ এক ভয়াবহ দুঃসময়ের মধ্যদিয়ে সময় পার করেছেন। বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সমাজের নারীরা ছিলেন এক কথায় অরক্ষিত। সেই সময়ে তারাই বেশিরভাগ আক্রান্ত হয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে ত্রিশ লাখ শহীদান আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল।
কিন্তু নির্যাতিত নারীদের সর্বস্ব হারানোর কথা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে কি নারীর আর কোনো অবদান ছিল না? ছিল নিশ্চয়, না হলে নিতান্তই তিনজন মহিলার যুদ্ধে অংশ নেয়ার কারণে ‘বীর প্রতীক’ সম্মাননা পাওয়ার কথাটা অন্তত খাতায়পত্রে উঠে আসতো না। তবে যুদ্ধে সর্বমোট কতজন মহিলা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন, সেই হিসাব কোথাও পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে না হোক, পরোক্ষভাবেও মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিলেন বাংলার অনেক সাহসী নারী। যারা যুদ্ধকালীন সময়ে সীমান্তের ওপারে না গিয়ে দেশের অভ্যন্তরে থেকে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। ’৭১ সালের ৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের আয়োজনে বায়তুল মোকাররমে যে জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল, সেই সভার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। এবং ওই সময়ে তার সাথে ছিলেন অধ্যাপিকা সেলিনা বাহার জামান, মিসেস সারা আলী, কণিকা ভট্টাচার্য, মনোয়ারা বিবিসহ অন্যান্য। সভার আহ্বায়িকা ছিলেন মালেকা বেগম। সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে মহিলা পরিষদ ১৮ মার্চ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত স্বাধীনতার চেতনায় মহিলা সমাজকে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সমানে সভা-সমাবেশের আয়োজন করেছেন। কবি সুফিয়া কামাল তার দুই কন্যাকে যুদ্ধে সহযোগিতা করার জন্য সীমান্তের ওপারে নির্ধিদ্বায় চলে যেতে দিয়েছেন। জাহানারা ইমাম ছিলেন আরেক সাহসী ও দেশপ্রেমিক নারী, যিনি তার পুত্রকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য সাহস যুগিয়ে বলেছিলেনÑ ‘আমি তোমাকে দেশের জন্য উৎসর্গ করলাম’।
এছাড়াও ছিলেন সেলিনা বানু, ডা. মাখদুমা নার্গিস, ডা. ফাওজিয়া মোসলেম, ফরিদা আখতার, নারীনেত্রী মালেকা বেগম ও আয়শা খানম। যাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকার কারণে মুক্তিযুদ্ধকে একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে সহায়তা জুগিয়েছে। এছাড়াও ছিলেন বাম আন্দোলনের নেত্রী মতিয়া চৌধুরী। ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।
কলকাতার পার্ক সার্কাস ও পদ্মপুকুর নামক স্থানের মাঝামাঝি ‘গোবরা’ নামক স্থানে শুধুমাত্র মহিলাদেরকে ট্রেনিং দেয়ার জন্য একটি ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়েছিল। সেখানে তিন ধরনের ট্রেনিং দেয়া হতো। যেমন- এক. সিভিল ডিফেন্স; দুই. নার্সিং এবং তিন নম্বরে ছিল অস্ত্র চালনা। ওই সেন্টারের পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।
গোবরা ক্যাম্প ছাড়াও আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে ওই ধরনের আরো তিনটি ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মহিলারা কেউ কেউ হাসপাতালে, কিংবা কেউ কেউ রণাঙ্গণে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ওই গোবরা সেন্টার থেকে ট্রেনিং নিয়ে যে সাহসী নারী শিরিন বানু মিতিল সক্রীয় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তার নাম ইতিহাসের খাতায় লেখা হলেও রাষ্ট্রীয় কোনধরনের কোনো সম্মাননা তার ভাগ্যে জোটেনি। তিনি যখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন, সেই সময়ে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধে এক কিশোরের ছদ্মবেশে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন মিতিল। নয় মাসের মধ্যে তার সহযোদ্ধারা পর্যন্ত কেউ টের পাননি যে মিতিল সদ্য কৈশর উত্তীর্ণ এক নারী ছিলেন! এক আত্মীয়ের কাছে মাত্র এক ঘণ্টার এক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে অস্ত্র চালনা নিজের করায়াত্ত্বে আনলেও পরবর্তীতে তিনিও গোবরা ট্রেনিং সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। ২৭ মার্চ পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে মিতিল অংশ নিয়েছিলেন। কথিত আছে, ওই যুদ্ধে ৩৬জন পাকসেনা নিহত হয়েছিল। অন্যদিকে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা সেই যুদ্ধে শাহাদৎ বরণ করেছিলেন।
এরকম আরো একজন মহিলা যুক্তিযোদ্ধার নাম শামসুন নাহার। বাগমারার গোয়ালকান্দি গ্রামের শামসুন নাহার মাত্র ১৫ বছর বয়সে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি অস্ত্রচালনা শিখে ৭ নম্বর সেক্টরে যোগ দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ী বাগমারা উপজেলায় ওই সময়ে মু্িক্তযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৫০৬ জন। কিন্তু একমাত্র মহিলা হওয়া সত্ত্বেও সেই তালিকায় তার নামটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এই স্বীকৃতি পেতে তাকে দীর্ঘ ৩৪টি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালে তার নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।
অন্যদিকে শিরিন বানু মিতিল মেজর জলিলের ৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধে অংশ নিয়ে অনেক সাহসী ইতিহাসের অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় সম্মাননার তালিকায় তাদের নামটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
বামনেত্রী মতিয়া চৌধুরীরও অবদান কম ছিলো না। আগরতলা সীমান্ত দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেয়া এই বাম রাজনীতিবিদ যুদ্ধের পুরো নয়টি মাস ঘুরেছেন শরণার্থী শিবির থেকে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে। এছাড়াও একজন প্রত্যক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক এবং শরণার্থী সমস্যাসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ভারতের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিভি গিরির কাছে পর্যন্ত ছুটে গেছেন।
এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে তার বক্তব্য ছিল- ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ নিয়ে কোনো এক জায়গায় শিশির ঝরা শুরু হয়েছে এমন খবরেও ছুটে গেছি সেখানে।
ইতিহাসের আলোকে মহিলাদের এসব অবদান কোথাও লিপিবদ্ধ হয়নি। যদিও যুদ্ধশেষে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয়ায় দু’জন মহিলাকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল। তাদের একজন ডা. সিতারা বেগম এবং অন্যজন তারামন বিবি। এই দু’জন ছাড়াও খেতাববিহীন আরো একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সিলেটের কাঁকন বিবি।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ভারতের মেঘালয়ে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল নামে ৪৮০ শয্যার যে হাসপাতাল ছিল, ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে সেখানে কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
কুড়িগ্রাম জেলার মাধবপুরের নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি যখন প্রথম যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্নার কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়ে তারামন ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে পরিচালিত একটি ক্যাম্পে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে দায়িত্বরত মুহিব হালদার নামক এক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে অস্ত্রচালনা শিখে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে গেলেন যুদ্ধে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে তার নামটি জড়িয়ে আছে। তারামন বিবির ওইসব সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার তাকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করেছিলেন। তাকে নিয়ে লেখা একটি বই ‘বীর প্রতীকের খোঁজে’ ছাড়াও ‘করিমন বেওয়া’ নামক একটি নাটকও লিখেছিলেন আনিসুল হক।
এছাড়াও সিলেটের সীমান্তের অপর পাড়ের এক গারো পল্লীর অধিবাসী নারীর নাম কাঁকন বিবি। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন মুসলিম এক যুবক শাহেদ আলীকে। বিয়ের পরের সময়টায় দেখেছেন পল্লীর অসহায় মহিলাদের উপর রাজাকারদের দৌরাত্ম। দেখেছেন পাকসেনাদের লালসার শিকারে পরিণত হওয়া নারীর আর্ত হাহাকার। বিপরীতে কিছু একটা করবেন- এই উদ্দেশ্য নিয়ে ৫ নম্বর সেক্টরে যোগ দিলেন গুপ্তচর হিসেবে। ওই কাজ করতে গিয়ে একদিন ধরা পড়লেন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। তারপর দীর্ঘ একটা সপ্তাহ তার শরীরের উপর এক অমানসিক নির্যাতন চললো। কিন্তু সেই অবস্থা থেকে পালিয়ে আসলেন কাঁকন বিবি। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে যোগ দিলেন যুদ্ধে। প্রায় কুড়িটিরও বেশি অপারেশনে কাঁকন বিবি সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে গিয়ে শরীরের একাধিক স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। কি মর্মান্তিক পরাজয় ঘটেছিল তার জীবনে! যুদ্ধ শেষে নিতান্তই এক গ্রাম্য গৃহবধূর জীবনে যোগ দিয়ে সবার অগোচরে কাটিয়ে দিলেন দীর্ঘ ২৫ বছরের মতো সময়।
১৯৯৬ সালে স্থানীয় এক সাংবাদিকের প্রচেষ্টায় তার জীবনের কাহিনী প্রকাশ্যে আসে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯৬ সালে সরকার তাকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করেছিল। কিন্তু জীবদ্দশায় তিনি রাষ্ট্রীয় বিশেষ কোনো অনুদান পাননি, ওই দীর্ঘসূত্রতার কারণে।
কিন্তু যুদ্ধের নয়মাসে নারীর জীবনে সবচেয়ে কলঙ্কজনক ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল ‘ধর্ষণ’ বা শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে। বলা হয়ে থাকেÑ আমাদের স্বাধীনতা এসেছে দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে। এই হিসাব দাখিলের পিছনের কারণ হিসেবে উপাত্তটাকে বিবেচনায় রাখা হয়েছিল, তা হলো- ওই সময়ে দেশে ৪৮০টি থানা ছিল। ওই ৪৮০টি থানা থেকে যদি প্রতিদিন দুইজন করে নারীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে নয় মাসে সংখ্যাটা দাঁড়ায় দুই লাখের কাছাকাছি। এটা একটা অনুমাননির্ভর হিসাব। কিন্তু যুদ্ধের পরে বিদেশের অনেক ডাক্তার, সমাজকর্মী এবং ত্রাণ তৎপরতায় অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে সেই সময়ে যারা বাংলাদেশে এসেছিলেন, তাদের মধ্যকার এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার এক বর্ণনায় বলেছিলেন- সখ্যাটা দুই লাখ নয়, চার লাখের কাছাকাছি হবে বলে মনে হয়েছে তার।
কানাডিয়ান ইউনিসেফের চেয়ারম্যান সুসান ব্রাউন মিলার যুদ্ধকালীন সময়ে একবার এবং যুদ্ধ শেষে আরো একবার অর্থাৎ মোট দুইবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি তার রিপোর্টে ১০ হাজার যুদ্ধশিশুর জন্মের কথা স্বীকার করেছেন। তার মতে প্রায় পঁচিশ হাজার নির্যাতিত মহিলা সেই সময় সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন।
যুদ্ধ পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু ওইসব নির্যাতিত মহিলাদেরকে ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব দিয়েছিলেন।
‘বীরাঙ্গনা’ অর্থ ‘বীর রমণী’। এই খেতাবটাই ছিল একধরনের প্রহসন। এই খেতাবের ফলে কার্যত ওইসব নির্যাতিতা মেয়েদেরকে একঘরে করে দেয়া হয়েছিল। প্রায় সবাই পরিত্যক্ত হয়েছিলেন নিজের পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে। প্রায় কোনো পরিবারই এসব নির্যাতিত মহিলাদেরকে আর গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না। ফলে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সরকার ওইসব নারীদের জন্য বাহাত্তর সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংঘ প্রতিষ্ঠা করে। আশ্রয়ের একটা ব্যবস্থা করা ছাড়াও গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও নারী পুনর্বাসন বোর্ডের কেন্দ্রীয় শাখা ঢাকায় থাকার পরেও ঢাকার বাইরে প্রায় ১৭টি স্থানে শাখা স্থাপনের মধ্যদিয়ে ওইসব নারীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানসহ নানাধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল।
সেই সময়ে মাদার তেরেসা কলকাতার ক্যাথলিক আশ্রমের একটি শাখা ঢাকায় স্থাপন করে তারাও ওইসব নির্যাতিত মহিলাদের সহায়তা দিয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদও সক্রিয় ছিল ওই সময়। বিশেষ করে ওই সময়ে প্রতিদিন একশটির বেশি গর্ভপাত করানো হতো বলে বিভিন্ন লিখিত দলিলে উল্লেখ আছে।
বাহাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ৬১জন বীরাঙ্গনা নারীর একটি তালিকা প্রথম প্রকাশ করেছিল। ওই তালিকাটি সম্পূর্ণ ছিল না। অনেক বীরাঙ্গনা নারী নিজের নাম প্রকাশে ইচ্ছুক ছিলেন না। অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে গিয়ে নাই-এর তালিকায় ঠাঁই পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পরের শাসনামলসমূহে আর এইসব মহিলাদের বিষয়ে খুব একটা উচ্চবা”্য করতে শোনা যায়নি।
পরবর্তীতে ২০০০ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে গেজেটভুক্ত বীরাঙ্গনা নারীর সংখ্যা ২০০ জন বলে উল্লেখ করেছিলেন। আরো পরে সেই সংখ্যা ৪১৬ জনে উন্নীত হয়। এই হিসাবটাও সঠিক ছিল না। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৬৫৪ জনে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী অ্যাসোসিয়েশন উচ্চ আদালতে ২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি ‘বীরাঙ্গনা’ নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি পিটিশন দাখিল করেছিলেন। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বীরাঙ্গনা নারীদেরকে মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননায় ভূষিত করার একটি প্রস্তাবও পাস হয়। ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার প্রথমবারের মতো চল্লিশজন বীরাঙ্গনা নারীকে মুক্তিযোদ্ধার খেতাবে ভূষিত করে। পরবর্তীতে ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গেজেটভুক্ত বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা পাঁচশো জনে উন্নীত হয়েছে। এই সম্মাননা পাওয়ার মধ্যবর্তী সময়কাল ছিল ৪৪ বছরের মতো। ততোদিনে কত নারী ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছেন। কতজন এক মুঠো খাবারের সংস্থান করতে না পেরে ক্ষুধার জ্বালায় আত্মহত্যা করেছেন। ওই খেতাব পাওয়ার খবরে একজন বীরাঙ্গনার উক্তি ছিল- ‘৪৪ বছর আগে রাজাকার শয়তানেরা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাতে আমার যে ক্ষতি হয়েছিল, আজ ৪৪ বছর পরে যদি কেউ আমাকে একদিনে মুক্তিযোদ্ধা বানাতে চায়, আমার তাতে কোনো লাভ নাই। আমি এই নিয়ে কিছু ভাবতেও চাই না’।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট