পবিত্র মাহে রমজানে বিশ্ববাসী, বিশেষত বিশ্ব মুসলিমের অবিনশ্বর জীবনবিধান পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। তাই মাহে রমজানের প্রতিটি মুহূর্তের গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম। তা সত্ত্বেও পুরো রমজান মাসকে তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আগামী ৩০ মার্চ শনিবার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাওম পালনকারী ভাইবোনদের জীবন থেকে কমপক্ষে এক বছরের জন্য মাগফিরাতের অধ্যায় বিদায় নেবে এবং ৩১ মার্চ রোববার থেকে জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের অধ্যায় সূচিত হবে। জাহান্নাম প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের একাধিক সুরা ও আয়াতে, বিশেষত মক্কায় অবতীর্ণ সুরা মুলকের ৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে, যারা তাদের রব বা প্রতিপালককে অস্বীকার করে, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি (বসবাসের জন্য), তা কতই-না মন্দ স্থান।
স্মর্তব্য, ৩১ মার্চ রোববারের আগে পবিত্র মাহে রমজানের রহমত ও মাগফিরাতের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় দুটোকে আমরা কতটুকু কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছি, তার চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। কারণ আগামী বছরের পবিত্র মাহে রমজানের রহমত ও মাগফিরাতের অধ্যায় লাভ কার কার ভাগ্যে ঘটবে, তা একমাত্র বিশ^বিধাতাই জানেন। তাই যারা চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবে এবং মানুষের চিরশত্রু শয়তানের প্ররোচনায় পবিত্র মাহে রমজানের রহমত ও মাগফিরাতের অধ্যায়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারিনি, তাদের উচিত হবে পরকালীন আজাব-গজব এবং জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের অধ্যায়ের প্রতিটি মুহূর্তই বিশ্ব প্রতিপালকের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাজে লাগানো। বলার অপেক্ষা রাখে না, ইবাদত-বন্দেগি, দান-খয়রাত কিংবা নিজস্ব পুণ্যের বিনিময়ে পরকালীন আজাব এবং জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণ লাভ কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। একমাত্র পরম করুণাময় বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর অপরিসীম রহমত এবং আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর সুপারিশই আমাদের পরকালীন আজাব থেকে মুক্তি এবং কাক্সিক্ষত বেহেশত দান করতে পারে। তাই সাওম পালনকারী ভাইবোনদের অপরিহার্য দায়িত্ব এবং কর্তব্য হচ্ছে অগ্নি থেকে পরিত্রাণ অধ্যায়ের বাদবাকি দিবা-রজনী যথাসম্ভব আল্লাহর স্মরণে কাটানো এবং নিজেদের সাগর পরিমাণ পাপরাশির জন্য অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে ও অশ্রুবিগলিত নয়নে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা।
এই অধ্যায়ে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ইতিকাফ এবং লাইলাতুল কদরের সন্ধানে যথাসাধ্য ত্যাগ স্বীকার করা। ইতিকাফ বিশ্বনবীর (সা.) উম্মতদের জন্য ইসলামি শরিয়তে সুন্নাতে দায়েমি কেফায়া হিসেবে স্বীকৃত। এটি গ্রামবাসী বা এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে এক বা একাধিক ব্যক্তি পালন করলে বাদবাকিরা দায়মুক্ত হবেন। তবে কোনো বিশেষ এলাকার একজন মুসলমানও ইতিকাফ না করলে গোটা এলাকার সকল মুসলিম উম্মাহ গোনাহগার হবেন। আম্মাজান আয়েশা (রা.) এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রতি রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন এবং মহাপ্রয়াণের বছর ২০ দিন ইতিকাফ করেছিলেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে নিউইয়র্ক প্রবাসী সাওম পালনকারী কিছুসংখ্যক ভাইবোনসহ সারা বিশে^ অগণিত মুসলমান ৩০ মার্চ শনিবার বাদ আসর থেকে পবিত্র শাওয়ালের চাঁদ দেখার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন মসজিদ, ইবাদতখানা কিংবা নিজ গৃহের নির্জন কোণে একাধারে নয়/দশ দিনের ইতিকাফ শুরু করেছেন। ইতিকাফকারীরা পায়খানা-প্রস্রাব, অজু-গোসল এবং খাওয়াদাওয়া ও অপরিহার্য নিদ্রা ছাড়া ঈদুল ফিতরের নামাজের আগ পর্যন্ত বাদবাকি সময় একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাসবিহ-তাহলিল, নামাজ-কালাম ও অন্যান্য ধরনের ইবাদতে মশগুল থাকবেন।
আবার জাহানামের আগুন থেকে পরিত্রাণের এই অধ্যায়েই লুকিয়ে আছে আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার বিশেষ আশীর্বাদপূর্ণ পবিত্র লাইলাতুল কদর বা অতীব মহিমান্বিত রজনী। ওই মর্যাদাসম্পন্ন বিশেষ রাতের ইবাদতকে সহস্র মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম বলে পবিত্র কোরআনের সুরা আল ক্বাদরে মহান আল্লাহ স্বয়ং উচ্চারণ করেছেন। নিজ উম্মতগণকে রমজানের তৃতীয় ১০ দিনের বিজোড় রাতগুলোর মধ্যে এই বিশেষ মহিমান্বিত রাতকে খোঁজার নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের দয়াল নবী মুহাম্মদ (সা.)।
যাহোক, ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত বিশ^ মুসলিম বর্তমান পাপসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। দুনিয়াকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আখিরাতকে পুরোপুরি উপেক্ষা করায় বর্তমানে সারা বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায় অমুসলমানদের হাতে চরমভাবে নাজেহাল হচ্ছে। বাস্তুহারা ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা বর্ণনায় ভাষা হার মানতে বাধ্য। তাই প্রত্যেকেরই উচিত হবে অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে ও তওবা-আস্তাগফারসহ যাবতীয় অপরাধের জন্য মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে তাঁর রহমত কামনা করা।
তবে ব্যক্তিগত-পারিবারিক, সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় র্যাশনালিটি বা হিতাহিতজ্ঞান বা মনুষ্যত্ববোধের অপমৃত্যু এবং অ্যানিমেলিটি বা পশুত্ব শক্তির উন্মেষ ঘটলে সমাজ-রাষ্ট্র এবং বিশ্বে নৈরাজ্য বা চরম অস্থিরতা তথা মাৎস্যন্যায় দশার সৃষ্টির হয়। পবিত্র কোরআনের সুরা আন-আমে বলা হয়েছে, ধর্মের সান্নিধ্যবঞ্চিত মানুষ দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না, এমনকি চতুষ্পদ প্রাণীর চেয়েও অধম। মূলত অপরাধপ্রবণতা মানুষের মনুষ্যত্বের দর্পণের ওপর ময়লার আবরণ ফেলে এবং সময়ের অগ্রযাত্রায় থমথমে বার্নিশ করা কালো ময়লার প্রলেপ মানুষের মনুষ্যত্ববোধের দর্পণকে পুরোপুরি আচ্ছাদিত করে ফেলে। ফলে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে পরিচিত মানুষ পশুর চেয়েও অধম এবং নরকের কীটে পরিণত হয়। পবিত্র কোরআনের চতুর্দশ অধ্যায়ের সুরা নহলের ১০৭, ১০৮ ও ১০৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, তারা পার্থিব জীবনকে পরকালের তুলনায় অতিশয় ভালোবেসেছে; আর এ কারণে আল্লাহ তায়ালা এরূপ কাফিরদের হেদায়েত করেন না। এরা ওই সকল লোক, আল্লাহ যাদের অন্তঃকরণ, কর্ণ ও চোখে মোহর (আবরণ) লাগিয়ে দিয়েছেন, আর এরা (স্বীয় পরিণাম সম্পর্কে) একেবারেই গাফেল বা উদাসীন। এটি অনিবার্য যে পরলোকে এরাই সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পবিত্র কোরআনের বর্ণনার সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনাচরণের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে অনায়াসেই আমরা নিজেদের অবস্থান নির্ণয় করতে পারি।
আদি পিতা আদম (আ.) এবং তাঁর বংশদের জাগতিক অবস্থান পবিত্র কোরআনের অষ্টম অধ্যায়ের সুরা আল-আরাফের ২২, ২৩, ২৪ ও ২৫ নং আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে : অনন্তর তাদের উভয়কে (আদম ও হাওয়া) ধোঁকা দিয়ে নিষিদ্ধ বৃক্ষের নিচে নিয়ে এল, তৎপর যেই মাত্র উভয়ে বৃক্ষটির ফল আস্বাদন করল (তৎক্ষণাৎ) তাদের আবৃতাঙ্গ পরস্পরের সম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং উভয়েই বেহেশতের পত্রপল্লব নিজেদের দেহে সংযুক্ত করতে (গোপনাঙ্গ লুকোতে) লাগলেন। এবং তাদের রব তাদের আহ্বান করে বললেন, আমি কি তোমাদের উভয়কে এই বৃক্ষের ফল (ভক্ষণ করতে) নিষেধ করিনি এবং আমি কি এও বলিনি যে শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন। উভয়ে বললেন, হে আমাদের রব (প্রতিপালক), আমরা নিজেদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছি, আর যদি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে অবশ্যই (আমাদের) অতিশয় ক্ষতি হবে। আল্লাহ বললেন, তোমরা নিচে যাও এমন অবস্থায় যে পরস্পর কিছুসংখ্যক অপর কিছুসংখ্যক দুশমনের মধ্যে কাল কাটাবে এবং তোমাদের জন্য ভূপৃষ্ঠে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকা বা বসবাসের স্থান ও লাভবান হওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। (আল্লাহ) আরও বললেন, সেখানেই তোমরা জীবনযাপন করবে এবং সেখানেই মরবে এবং তথা থেকে বের করা হবে। অতএব, জগতে আমাদের আগমন, মৃত্যু, পরকালীন হিসাব-নিকাশ, কার্যানুরূপ ফল ও পাপানুরূপ শাস্তি ইত্যাদি পূর্বনির্ধারিত এবং অবধারিত। লাখো প্রচেষ্টায়ও আদম সন্তান-সন্ততিদের জীবনে এর বিন্দুমাত্র হেরফের ঘটবে না।
পবিত্র কোরআনের ৭ম ও ৮ম অধ্যায়ের সুরা আন-আমের ১০২ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ইনিই আল্লাহ-তোমাদের রব, তিনি ভিন্ন কেউই ইবাদতের যোগ্য নয়, তিনিই সকল বস্তুর স্রষ্টা। অতএব তাঁরই ইবাদত করো। বস্তুত, তিনিই সকল বিষয়ের কার্যনির্বাহক বা সম্পাদক। অথচ দুর্ভাগ্যক্রমে পবিত্র কোরআনের সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণাদি আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না, মনোরাজ্যে বিন্দুমাত্র আঁচড় কাটে না। জাগতিক মোহাবিষ্ট ও ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত বিশ্ব মুসলিম ক্ষণস্থায়ী পার্থিব সুখ আহরণের নামে ইচ্ছাকৃতভাবেই পরকালীন পাথেয় সংগ্রহকে সজ্ঞানে উপেক্ষা করছে এবং পাপের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। এ অবস্থায় জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের অধ্যায়ে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য রোজাদারদের বজ্রকঠোর সংকল্প গ্রহণ করতে হবে। গিবত বা পরচর্চা সর্বাংশে পরিহার করতে হবে। অপরের ক্ষতিসাধনের মনোবৃত্তি কিংবা অন্য মুসলমানের প্রতি অন্তরে অহেতুক বিদ্বেষ পোষণ বর্জন করতেই হবে। ফিতনা বা ফ্যাসাদ সৃষ্টি এবং ঝগড়া-বিবাদে ইন্ধন জোগানোর স্বভাব পুরোপুরি নির্বাসনে পাঠাতে হবে। সর্বাবস্থায় ধৈর্য ধারণ করতে হবে। কেউ গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাতে উদ্যত হলে তাকে সহজভাবে বলতে হবে, আমি রোজাদার। ভুরিভোজন বা রসনাপূজার ব্যয়বাহুল্য পরিহার করতে হবে এবং যথাসাধ্য ব্যয়সংকোচের মাধ্যমে সাশ্রয়কৃত অর্থে অপর রোজাদার ও ক্ষুধার্তদের আপ্যায়নে সক্রিয় হতে হবে। গরির-দুঃখীর দুর্দশা লাঘবে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাতে হব। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। আমিন!
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক। ২৬ মার্চ ২০২৪।
স্মর্তব্য, ৩১ মার্চ রোববারের আগে পবিত্র মাহে রমজানের রহমত ও মাগফিরাতের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় দুটোকে আমরা কতটুকু কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছি, তার চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। কারণ আগামী বছরের পবিত্র মাহে রমজানের রহমত ও মাগফিরাতের অধ্যায় লাভ কার কার ভাগ্যে ঘটবে, তা একমাত্র বিশ^বিধাতাই জানেন। তাই যারা চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবে এবং মানুষের চিরশত্রু শয়তানের প্ররোচনায় পবিত্র মাহে রমজানের রহমত ও মাগফিরাতের অধ্যায়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারিনি, তাদের উচিত হবে পরকালীন আজাব-গজব এবং জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের অধ্যায়ের প্রতিটি মুহূর্তই বিশ্ব প্রতিপালকের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাজে লাগানো। বলার অপেক্ষা রাখে না, ইবাদত-বন্দেগি, দান-খয়রাত কিংবা নিজস্ব পুণ্যের বিনিময়ে পরকালীন আজাব এবং জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণ লাভ কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। একমাত্র পরম করুণাময় বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর অপরিসীম রহমত এবং আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর সুপারিশই আমাদের পরকালীন আজাব থেকে মুক্তি এবং কাক্সিক্ষত বেহেশত দান করতে পারে। তাই সাওম পালনকারী ভাইবোনদের অপরিহার্য দায়িত্ব এবং কর্তব্য হচ্ছে অগ্নি থেকে পরিত্রাণ অধ্যায়ের বাদবাকি দিবা-রজনী যথাসম্ভব আল্লাহর স্মরণে কাটানো এবং নিজেদের সাগর পরিমাণ পাপরাশির জন্য অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে ও অশ্রুবিগলিত নয়নে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা।
এই অধ্যায়ে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ইতিকাফ এবং লাইলাতুল কদরের সন্ধানে যথাসাধ্য ত্যাগ স্বীকার করা। ইতিকাফ বিশ্বনবীর (সা.) উম্মতদের জন্য ইসলামি শরিয়তে সুন্নাতে দায়েমি কেফায়া হিসেবে স্বীকৃত। এটি গ্রামবাসী বা এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে এক বা একাধিক ব্যক্তি পালন করলে বাদবাকিরা দায়মুক্ত হবেন। তবে কোনো বিশেষ এলাকার একজন মুসলমানও ইতিকাফ না করলে গোটা এলাকার সকল মুসলিম উম্মাহ গোনাহগার হবেন। আম্মাজান আয়েশা (রা.) এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রতি রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন এবং মহাপ্রয়াণের বছর ২০ দিন ইতিকাফ করেছিলেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে নিউইয়র্ক প্রবাসী সাওম পালনকারী কিছুসংখ্যক ভাইবোনসহ সারা বিশে^ অগণিত মুসলমান ৩০ মার্চ শনিবার বাদ আসর থেকে পবিত্র শাওয়ালের চাঁদ দেখার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন মসজিদ, ইবাদতখানা কিংবা নিজ গৃহের নির্জন কোণে একাধারে নয়/দশ দিনের ইতিকাফ শুরু করেছেন। ইতিকাফকারীরা পায়খানা-প্রস্রাব, অজু-গোসল এবং খাওয়াদাওয়া ও অপরিহার্য নিদ্রা ছাড়া ঈদুল ফিতরের নামাজের আগ পর্যন্ত বাদবাকি সময় একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাসবিহ-তাহলিল, নামাজ-কালাম ও অন্যান্য ধরনের ইবাদতে মশগুল থাকবেন।
আবার জাহানামের আগুন থেকে পরিত্রাণের এই অধ্যায়েই লুকিয়ে আছে আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার বিশেষ আশীর্বাদপূর্ণ পবিত্র লাইলাতুল কদর বা অতীব মহিমান্বিত রজনী। ওই মর্যাদাসম্পন্ন বিশেষ রাতের ইবাদতকে সহস্র মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম বলে পবিত্র কোরআনের সুরা আল ক্বাদরে মহান আল্লাহ স্বয়ং উচ্চারণ করেছেন। নিজ উম্মতগণকে রমজানের তৃতীয় ১০ দিনের বিজোড় রাতগুলোর মধ্যে এই বিশেষ মহিমান্বিত রাতকে খোঁজার নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের দয়াল নবী মুহাম্মদ (সা.)।
যাহোক, ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত বিশ^ মুসলিম বর্তমান পাপসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। দুনিয়াকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আখিরাতকে পুরোপুরি উপেক্ষা করায় বর্তমানে সারা বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায় অমুসলমানদের হাতে চরমভাবে নাজেহাল হচ্ছে। বাস্তুহারা ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা বর্ণনায় ভাষা হার মানতে বাধ্য। তাই প্রত্যেকেরই উচিত হবে অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে ও তওবা-আস্তাগফারসহ যাবতীয় অপরাধের জন্য মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে তাঁর রহমত কামনা করা।
তবে ব্যক্তিগত-পারিবারিক, সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় র্যাশনালিটি বা হিতাহিতজ্ঞান বা মনুষ্যত্ববোধের অপমৃত্যু এবং অ্যানিমেলিটি বা পশুত্ব শক্তির উন্মেষ ঘটলে সমাজ-রাষ্ট্র এবং বিশ্বে নৈরাজ্য বা চরম অস্থিরতা তথা মাৎস্যন্যায় দশার সৃষ্টির হয়। পবিত্র কোরআনের সুরা আন-আমে বলা হয়েছে, ধর্মের সান্নিধ্যবঞ্চিত মানুষ দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না, এমনকি চতুষ্পদ প্রাণীর চেয়েও অধম। মূলত অপরাধপ্রবণতা মানুষের মনুষ্যত্বের দর্পণের ওপর ময়লার আবরণ ফেলে এবং সময়ের অগ্রযাত্রায় থমথমে বার্নিশ করা কালো ময়লার প্রলেপ মানুষের মনুষ্যত্ববোধের দর্পণকে পুরোপুরি আচ্ছাদিত করে ফেলে। ফলে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে পরিচিত মানুষ পশুর চেয়েও অধম এবং নরকের কীটে পরিণত হয়। পবিত্র কোরআনের চতুর্দশ অধ্যায়ের সুরা নহলের ১০৭, ১০৮ ও ১০৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, তারা পার্থিব জীবনকে পরকালের তুলনায় অতিশয় ভালোবেসেছে; আর এ কারণে আল্লাহ তায়ালা এরূপ কাফিরদের হেদায়েত করেন না। এরা ওই সকল লোক, আল্লাহ যাদের অন্তঃকরণ, কর্ণ ও চোখে মোহর (আবরণ) লাগিয়ে দিয়েছেন, আর এরা (স্বীয় পরিণাম সম্পর্কে) একেবারেই গাফেল বা উদাসীন। এটি অনিবার্য যে পরলোকে এরাই সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পবিত্র কোরআনের বর্ণনার সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনাচরণের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে অনায়াসেই আমরা নিজেদের অবস্থান নির্ণয় করতে পারি।
আদি পিতা আদম (আ.) এবং তাঁর বংশদের জাগতিক অবস্থান পবিত্র কোরআনের অষ্টম অধ্যায়ের সুরা আল-আরাফের ২২, ২৩, ২৪ ও ২৫ নং আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে : অনন্তর তাদের উভয়কে (আদম ও হাওয়া) ধোঁকা দিয়ে নিষিদ্ধ বৃক্ষের নিচে নিয়ে এল, তৎপর যেই মাত্র উভয়ে বৃক্ষটির ফল আস্বাদন করল (তৎক্ষণাৎ) তাদের আবৃতাঙ্গ পরস্পরের সম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং উভয়েই বেহেশতের পত্রপল্লব নিজেদের দেহে সংযুক্ত করতে (গোপনাঙ্গ লুকোতে) লাগলেন। এবং তাদের রব তাদের আহ্বান করে বললেন, আমি কি তোমাদের উভয়কে এই বৃক্ষের ফল (ভক্ষণ করতে) নিষেধ করিনি এবং আমি কি এও বলিনি যে শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন। উভয়ে বললেন, হে আমাদের রব (প্রতিপালক), আমরা নিজেদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছি, আর যদি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে অবশ্যই (আমাদের) অতিশয় ক্ষতি হবে। আল্লাহ বললেন, তোমরা নিচে যাও এমন অবস্থায় যে পরস্পর কিছুসংখ্যক অপর কিছুসংখ্যক দুশমনের মধ্যে কাল কাটাবে এবং তোমাদের জন্য ভূপৃষ্ঠে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকা বা বসবাসের স্থান ও লাভবান হওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। (আল্লাহ) আরও বললেন, সেখানেই তোমরা জীবনযাপন করবে এবং সেখানেই মরবে এবং তথা থেকে বের করা হবে। অতএব, জগতে আমাদের আগমন, মৃত্যু, পরকালীন হিসাব-নিকাশ, কার্যানুরূপ ফল ও পাপানুরূপ শাস্তি ইত্যাদি পূর্বনির্ধারিত এবং অবধারিত। লাখো প্রচেষ্টায়ও আদম সন্তান-সন্ততিদের জীবনে এর বিন্দুমাত্র হেরফের ঘটবে না।
পবিত্র কোরআনের ৭ম ও ৮ম অধ্যায়ের সুরা আন-আমের ১০২ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ইনিই আল্লাহ-তোমাদের রব, তিনি ভিন্ন কেউই ইবাদতের যোগ্য নয়, তিনিই সকল বস্তুর স্রষ্টা। অতএব তাঁরই ইবাদত করো। বস্তুত, তিনিই সকল বিষয়ের কার্যনির্বাহক বা সম্পাদক। অথচ দুর্ভাগ্যক্রমে পবিত্র কোরআনের সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণাদি আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না, মনোরাজ্যে বিন্দুমাত্র আঁচড় কাটে না। জাগতিক মোহাবিষ্ট ও ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত বিশ্ব মুসলিম ক্ষণস্থায়ী পার্থিব সুখ আহরণের নামে ইচ্ছাকৃতভাবেই পরকালীন পাথেয় সংগ্রহকে সজ্ঞানে উপেক্ষা করছে এবং পাপের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। এ অবস্থায় জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের অধ্যায়ে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য রোজাদারদের বজ্রকঠোর সংকল্প গ্রহণ করতে হবে। গিবত বা পরচর্চা সর্বাংশে পরিহার করতে হবে। অপরের ক্ষতিসাধনের মনোবৃত্তি কিংবা অন্য মুসলমানের প্রতি অন্তরে অহেতুক বিদ্বেষ পোষণ বর্জন করতেই হবে। ফিতনা বা ফ্যাসাদ সৃষ্টি এবং ঝগড়া-বিবাদে ইন্ধন জোগানোর স্বভাব পুরোপুরি নির্বাসনে পাঠাতে হবে। সর্বাবস্থায় ধৈর্য ধারণ করতে হবে। কেউ গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাতে উদ্যত হলে তাকে সহজভাবে বলতে হবে, আমি রোজাদার। ভুরিভোজন বা রসনাপূজার ব্যয়বাহুল্য পরিহার করতে হবে এবং যথাসাধ্য ব্যয়সংকোচের মাধ্যমে সাশ্রয়কৃত অর্থে অপর রোজাদার ও ক্ষুধার্তদের আপ্যায়নে সক্রিয় হতে হবে। গরির-দুঃখীর দুর্দশা লাঘবে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাতে হব। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। আমিন!
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক। ২৬ মার্চ ২০২৪।