হঠাৎ যখন হাতে এসে পড়ে অন্য রকম কোনো প্রবন্ধের বই, আর সেটা যদি হয় গবেষামূলক, তখনই বোঝা যায় গবেষণামূলক বই শুধু সমাজ-শিল্প-সাহিত্যেরই ব্যাখ্যা করে না, বরং আমাদেরকেও নানা বিষয়ে সৃষ্টিশীলভাবে ভাবতে উসকে দেয়। অর্থাৎ সেই বই শুধু পড়ামাত্রই শেষ হয়ে যায় না, বরং হয়ে ওঠে নতুন নতুন ভাবনা ও পথের দিশারি। আর যদি এই বইয়ের মধ্যে চিন্তাসূত্রকে বিভিন্ন দিকে বিস্তার করার জন্য কয়েকটি পরস্পর সংলগ্ন ক্ষেত্রে ভাগ করে দেওয়া হয়, তখন পৃথক প্রতিটি অংশই আমাদের বিশেষ অভিনিবেশ দাবি করে। তথ্য, তত্ত্ব অনুসন্ধান অন্তরাখ্যান, এমনকি নির্ভেজাল বিবরণও তখন আমাদের অভিজ্ঞাতকে সমৃদ্ধ করে, হয়তো আমাদের নানা জিজ্ঞাসার উৎসও হয়ে ওঠে। এমন গবেষণালব্ধ বই অবশ্য খুব কমই চোখে পড়ে। এ জন্যই ড. মনজুর আহমদের আলোচ্য বইটি বাংলাদেশের শিক্ষাবিষয়ক একটি বেনজির গবেষণাগ্রন্থ হয়ে উঠেছে।
ড. মনজুর আহমদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। গণচীন, ইথিওপিয়া ও জাপানে ইউনিসেফের কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং ইউনিসেফের প্রধান দপ্তরে জ্যেষ্ঠ শিক্ষা পরামর্শক ও ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ গবেষক ছিলেন। অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার যুগান্তকারী ধারণা প্রবর্তনে যুক্ত ছিলেন ফিলিপ কুম্বসের সঙ্গে। ইউনিসেফের শিক্ষাকৌশল ও সবার জন্য শিক্ষা ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশ আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের চেয়ারপারসন। এডুকেশন ওয়াচ বাংলাদেশের আহ্বায়ক এবং শিক্ষার প্রায়োগিক ও তাত্ত্বিক আলোচনায় অগ্রবর্তী এই চিন্তক ও গবেষক বহু বইয়ের লেখক। এতে বুঝতে অসুবিধা হয় না, শিক্ষা বিষয়ে তার ব্যুৎপত্তি নেহাত অল্প নয়। আলাদা আলাদা করে না বললেও চলে। তার এসব বৈশিষ্ট্যই আলোচ্য বইতে বর্তমান। বইটি তাই শিক্ষা বিষয়ে আমাদের আগ্রহ ও ঔৎসুক্য বাড়িয়ে দেয়। কোনো কোনো প্রবন্ধ কিন্তু তার আলোচ্য বিষয় নিয়ে আদপেই শেষ কথা বলে না, বরং সে আরও কৌতূহল জাগায়, বিষয়টি নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে।
মোটামুটি বড়সড় চেহারার ‘একুশ শতকে বাংলাদেশ : শিক্ষার রূপান্তর’ বইয়ের নামাঙ্কনটি বড়ই চমৎকৃত, যা সহজে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একুশ শতক মানে একশ বছরের জন্য বাংলাদেশে কী ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা দরকার, সে বিষয়ে অনেক জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ আছে। বিশ্লেষণগুলো করেছেন বহুবর্ণিল বহুস্তরীয় বিচ্ছুরণ এমন এক দ্যোতনায়। সার্থক নামকরণ, এটা অবশ্যস্বীকার্য। বইটি অনেকগুলো প্রবন্ধের সংকলন, যেমন ‘শিক্ষার অর্ধশতক : বিহঙ্গ দৃষ্টিতে’, ‘শিক্ষার নবযাত্রা : বঙ্গবন্ধু ভাবনার আলোকে’, ‘শিশু ও শৈশব : প্রারম্ভিক বিকাশ ও প্রাক্্-প্রাথমিক শিক্ষা’, ‘বিদ্যালয় শিক্ষা ও সক্ষমতা’, ‘কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ’, ‘মাদ্রাসা শিক্ষা’, ‘উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়’, ‘উপানুষ্ঠানিক ও জীবনব্যাপী শিক্ষা’, ‘আদর্শ শিক্ষকের সন্ধানে’, ‘শিক্ষাক্রম-শিক্ষণতত্ত্ব-শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ও প্রযুক্তি’, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা’, ‘শিক্ষার সম্পদ ও অর্থায়ন’, ‘সমাজ রূপান্তরের শিক্ষা : সাফল্যের ২০ বিধান’। এতগুলো প্রবন্ধের কোনোটাকেই গুরুগম্ভীর বলা যাবে না। বরং ইংরেজি বয়ানে বলা যেতে পারে ডিসকোর্স। সব কটির বিষয় অবশ্য এই শিক্ষা। শিক্ষা সম্পর্কে লেখকের সদ্যতম ভাবনার রূপ। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্জীবনের ইতিহাস বোঝার পক্ষে এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলোর পাঠগুরুত্ব অবশ্যই অসামান্য। বইটির বিষয় একটি, কিন্তু প্রতিটি প্রবন্ধের আছে উপস্থাপনবৈচিত্র্য। ড. মনজুর আহমদের বইটির এটাই অন্যতম গুণ।
বিশ্বভারতী প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় লিখেছেন, ‘এই সংকল্পের বীজ আমার মগ্ন চৈতন্যের মধ্যে নিহিত ছিল, তা ক্রমে অগোচরে অঙ্কুরিত হয়ে জেগে উঠেছে। এর কারণ আমার নিজের জীবনের মধ্যেই রয়েছে। বাল্যকাল থেকে আমি যে জীবন অতিবাহিত করে এসেছি তার ভিতর থেকে এই প্রতিষ্ঠানের আদর্শটি জাগ্রত হয়ে উঠেছে।’
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার সঙ্গে ড. মনজুর আহমদের শিক্ষাচিন্তার কোথাও একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের মতো ড. আহমদের শিক্ষাচিন্তার প্রকৃতপক্ষে এটাই হচ্ছে মূলকথা। এই গবেষণামূলক বইয়ে লেখক উল্লিখিত দৃষ্টিভঙ্গিটি গ্রহণ করেই তাঁর শিক্ষাচিন্তার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। তাঁর ব্যক্তিক বিকাশ, সমকালীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ও শিক্ষাভাবনা যে পরস্পর সম্পর্কিত, তা তাঁর শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন রচনা এবং আলোচ্য বইয়ের সমগ্র শিক্ষাভাবনাকে অনুসরণ করলেই সহজে বোঝা যাবে। এই আলোচ্য পরিধি তাই সমকালীন বৃহত্তর ঐতিহাসিক ও মনোবৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডল পর্যন্ত বিস্তৃত, তেমনি তা তাঁর শিক্ষাভাবনা, শিক্ষাবিষয়ক গবেষণা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করা প্রভৃতি তাঁর চিন্তার উদ্ভব ও বিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষাবিষয়ক নানা রকম কাজ করতে গিয়ে ড. মনজুর আহমদ যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন কিংবা যে শিক্ষাভাবনার বীজ তাঁর মধ্যে উপ্ত হয়েছে, সেসবই এই বইয়ে আলোচ্য পরিধিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ড. আহমদের জীবনের অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এই সময়েই তাঁর শিক্ষাচিন্তার প্রকৃত স্বরূপ আমাদের কাছে সুন্দরভাবে প্রতিভাত হয়ে উঠতে পেরেছে।
শিক্ষাভাবনায় ড. মনজুর আহমদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি ব্রিটিশ-পাকিস্তানি শিক্ষাধারার পরিবর্তে দেশীয় বা প্রাচ্যদেশীয়, বিশেষ করে বাংলার দেশজ শিক্ষাকে আধুনিককালের উপযোগী করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তন করার কথা বলেছেন এই বইয়ে।
এই বইয়ের শেষে ড. মনজুর আহমেদ বলেছেন, ‘প্রকৃত শিক্ষায় বাংলা ও বিশ্বের নতুন প্রজন্মকে জাগানো একুশ শতকে প্রকৃত শিক্ষার রূপান্তর তথা সমাজ রূপান্তরের মূল কাজ।’
আমি মনে করি, বইটির নানা দিক থেকে উৎকর্ষ অতি উচ্চ প্রশংসার দাবি রাখে। বাংলার পাঠকসমাজে বইটি সমাদৃত হবে। এই বইতে শিক্ষাবিষয়ক যেসব দিকনির্দেশনা তিনি দিয়েছেন, তা নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া খুবই দরকার বলে আমি মনে করি।
ড. মনজুর আহমদ প্রচলিত শিক্ষার সঙ্গে একুশ শতকের সম্পর্ক নির্ণয়ে বলিষ্ঠ কথা বলতে পেরেছেন। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ।
বইটি উচ্চ শিক্ষার্থীর গবেষণার জন্য পাঠ্যবই হিসেবে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ বিবেচনায় নেবে বলে আমার প্রত্যাশা। গত ১৮ জানুয়ারি ঢাকার কাওরানবাজারস্থ প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবনে বইটির প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে অনুষ্ঠানে একজন আমন্ত্রিত হিসেবে আমিও উপস্থিত ছিলাম। লক্ষ করলাম, একটা ভিন্নমাত্রার অনুষ্ঠান। আলোচক ও আমন্ত্রিত অতিথিরা ছিলেন বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিকবৃন্দ।
বইটির প্রকাশক : প্রথমা প্রকাশন। ১৯ কাওরান বাজার, ঢাকা। প্রকাশকাল : সেপ্টেম্বর ২০২৩। প্রচ্ছদ করেছেন মাসুক হেলাল।
ড. মনজুর আহমদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। গণচীন, ইথিওপিয়া ও জাপানে ইউনিসেফের কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং ইউনিসেফের প্রধান দপ্তরে জ্যেষ্ঠ শিক্ষা পরামর্শক ও ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ গবেষক ছিলেন। অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার যুগান্তকারী ধারণা প্রবর্তনে যুক্ত ছিলেন ফিলিপ কুম্বসের সঙ্গে। ইউনিসেফের শিক্ষাকৌশল ও সবার জন্য শিক্ষা ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশ আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের চেয়ারপারসন। এডুকেশন ওয়াচ বাংলাদেশের আহ্বায়ক এবং শিক্ষার প্রায়োগিক ও তাত্ত্বিক আলোচনায় অগ্রবর্তী এই চিন্তক ও গবেষক বহু বইয়ের লেখক। এতে বুঝতে অসুবিধা হয় না, শিক্ষা বিষয়ে তার ব্যুৎপত্তি নেহাত অল্প নয়। আলাদা আলাদা করে না বললেও চলে। তার এসব বৈশিষ্ট্যই আলোচ্য বইতে বর্তমান। বইটি তাই শিক্ষা বিষয়ে আমাদের আগ্রহ ও ঔৎসুক্য বাড়িয়ে দেয়। কোনো কোনো প্রবন্ধ কিন্তু তার আলোচ্য বিষয় নিয়ে আদপেই শেষ কথা বলে না, বরং সে আরও কৌতূহল জাগায়, বিষয়টি নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে।
মোটামুটি বড়সড় চেহারার ‘একুশ শতকে বাংলাদেশ : শিক্ষার রূপান্তর’ বইয়ের নামাঙ্কনটি বড়ই চমৎকৃত, যা সহজে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একুশ শতক মানে একশ বছরের জন্য বাংলাদেশে কী ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা দরকার, সে বিষয়ে অনেক জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ আছে। বিশ্লেষণগুলো করেছেন বহুবর্ণিল বহুস্তরীয় বিচ্ছুরণ এমন এক দ্যোতনায়। সার্থক নামকরণ, এটা অবশ্যস্বীকার্য। বইটি অনেকগুলো প্রবন্ধের সংকলন, যেমন ‘শিক্ষার অর্ধশতক : বিহঙ্গ দৃষ্টিতে’, ‘শিক্ষার নবযাত্রা : বঙ্গবন্ধু ভাবনার আলোকে’, ‘শিশু ও শৈশব : প্রারম্ভিক বিকাশ ও প্রাক্্-প্রাথমিক শিক্ষা’, ‘বিদ্যালয় শিক্ষা ও সক্ষমতা’, ‘কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ’, ‘মাদ্রাসা শিক্ষা’, ‘উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়’, ‘উপানুষ্ঠানিক ও জীবনব্যাপী শিক্ষা’, ‘আদর্শ শিক্ষকের সন্ধানে’, ‘শিক্ষাক্রম-শিক্ষণতত্ত্ব-শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ও প্রযুক্তি’, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা’, ‘শিক্ষার সম্পদ ও অর্থায়ন’, ‘সমাজ রূপান্তরের শিক্ষা : সাফল্যের ২০ বিধান’। এতগুলো প্রবন্ধের কোনোটাকেই গুরুগম্ভীর বলা যাবে না। বরং ইংরেজি বয়ানে বলা যেতে পারে ডিসকোর্স। সব কটির বিষয় অবশ্য এই শিক্ষা। শিক্ষা সম্পর্কে লেখকের সদ্যতম ভাবনার রূপ। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্জীবনের ইতিহাস বোঝার পক্ষে এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলোর পাঠগুরুত্ব অবশ্যই অসামান্য। বইটির বিষয় একটি, কিন্তু প্রতিটি প্রবন্ধের আছে উপস্থাপনবৈচিত্র্য। ড. মনজুর আহমদের বইটির এটাই অন্যতম গুণ।
বিশ্বভারতী প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় লিখেছেন, ‘এই সংকল্পের বীজ আমার মগ্ন চৈতন্যের মধ্যে নিহিত ছিল, তা ক্রমে অগোচরে অঙ্কুরিত হয়ে জেগে উঠেছে। এর কারণ আমার নিজের জীবনের মধ্যেই রয়েছে। বাল্যকাল থেকে আমি যে জীবন অতিবাহিত করে এসেছি তার ভিতর থেকে এই প্রতিষ্ঠানের আদর্শটি জাগ্রত হয়ে উঠেছে।’
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার সঙ্গে ড. মনজুর আহমদের শিক্ষাচিন্তার কোথাও একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের মতো ড. আহমদের শিক্ষাচিন্তার প্রকৃতপক্ষে এটাই হচ্ছে মূলকথা। এই গবেষণামূলক বইয়ে লেখক উল্লিখিত দৃষ্টিভঙ্গিটি গ্রহণ করেই তাঁর শিক্ষাচিন্তার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। তাঁর ব্যক্তিক বিকাশ, সমকালীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ও শিক্ষাভাবনা যে পরস্পর সম্পর্কিত, তা তাঁর শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন রচনা এবং আলোচ্য বইয়ের সমগ্র শিক্ষাভাবনাকে অনুসরণ করলেই সহজে বোঝা যাবে। এই আলোচ্য পরিধি তাই সমকালীন বৃহত্তর ঐতিহাসিক ও মনোবৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডল পর্যন্ত বিস্তৃত, তেমনি তা তাঁর শিক্ষাভাবনা, শিক্ষাবিষয়ক গবেষণা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করা প্রভৃতি তাঁর চিন্তার উদ্ভব ও বিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষাবিষয়ক নানা রকম কাজ করতে গিয়ে ড. মনজুর আহমদ যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন কিংবা যে শিক্ষাভাবনার বীজ তাঁর মধ্যে উপ্ত হয়েছে, সেসবই এই বইয়ে আলোচ্য পরিধিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ড. আহমদের জীবনের অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এই সময়েই তাঁর শিক্ষাচিন্তার প্রকৃত স্বরূপ আমাদের কাছে সুন্দরভাবে প্রতিভাত হয়ে উঠতে পেরেছে।
শিক্ষাভাবনায় ড. মনজুর আহমদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি ব্রিটিশ-পাকিস্তানি শিক্ষাধারার পরিবর্তে দেশীয় বা প্রাচ্যদেশীয়, বিশেষ করে বাংলার দেশজ শিক্ষাকে আধুনিককালের উপযোগী করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তন করার কথা বলেছেন এই বইয়ে।
এই বইয়ের শেষে ড. মনজুর আহমেদ বলেছেন, ‘প্রকৃত শিক্ষায় বাংলা ও বিশ্বের নতুন প্রজন্মকে জাগানো একুশ শতকে প্রকৃত শিক্ষার রূপান্তর তথা সমাজ রূপান্তরের মূল কাজ।’
আমি মনে করি, বইটির নানা দিক থেকে উৎকর্ষ অতি উচ্চ প্রশংসার দাবি রাখে। বাংলার পাঠকসমাজে বইটি সমাদৃত হবে। এই বইতে শিক্ষাবিষয়ক যেসব দিকনির্দেশনা তিনি দিয়েছেন, তা নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া খুবই দরকার বলে আমি মনে করি।
ড. মনজুর আহমদ প্রচলিত শিক্ষার সঙ্গে একুশ শতকের সম্পর্ক নির্ণয়ে বলিষ্ঠ কথা বলতে পেরেছেন। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ।
বইটি উচ্চ শিক্ষার্থীর গবেষণার জন্য পাঠ্যবই হিসেবে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ বিবেচনায় নেবে বলে আমার প্রত্যাশা। গত ১৮ জানুয়ারি ঢাকার কাওরানবাজারস্থ প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবনে বইটির প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে অনুষ্ঠানে একজন আমন্ত্রিত হিসেবে আমিও উপস্থিত ছিলাম। লক্ষ করলাম, একটা ভিন্নমাত্রার অনুষ্ঠান। আলোচক ও আমন্ত্রিত অতিথিরা ছিলেন বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিকবৃন্দ।
বইটির প্রকাশক : প্রথমা প্রকাশন। ১৯ কাওরান বাজার, ঢাকা। প্রকাশকাল : সেপ্টেম্বর ২০২৩। প্রচ্ছদ করেছেন মাসুক হেলাল।