শামীম আরা ডোরা
পবিত্র রমজান মাস। এক আত্মীয়ার বাড়িতে ইফতারের দাওয়াতে যাব। বাস থেকে নেমেই হাঁটা শুরু করলাম। অচেনা জায়গা। ঠিকানা খুঁজছি আর এদিক-ওদিক দেখছি।
আফ্রিকান এক ভবঘুরে। দেখেই মনে হলো হোমলেস, প্রেগন্যান্ট। মহিলাটি কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। বুঝতে একেবারেই দেরি হলো না-গভীর ক্ষুধার্ত আর পিপাসার্ত।
ইফতারের সময় হয়ে এসেছে। আশপাশে কোনো দোকানপাট নেই। ইচ্ছে হলেও প্রেগন্যান্ট মহিলার জন্য আমি কিছু করতে পারছি না। মনে হলো দীর্ঘ পথ শেষে তার ক্লান্ত পদ আর চলছে না। তার ভেতরের প্রাণের স্পন্দন তাড়িত করছে আর আহ্বান করছে। কিছুটা ভয় পেলাম। পথরোধ করে দাঁড়াল-ভাত দে, ভাত দে। আ-আ-মি তো এখানকার কিছুই চিনি না দেখতে পাও না?
আমি নির্বিকার, নিরুত্তর।
আমি গ্রেগন্যান্ট, আমি ক্ষুধার্ত!
তবু আমি নিরুত্তর।
এবার বীভৎস চিৎকার-আমি কি অভুক্ত থাকব?
আমি কিছুটা আতঙ্কিত। নিঃশব্দ ভাষা। তবু বুঝিয়ে দিলাম-কখনোই না। কখনোই না।
আমার কাক্সিক্ষত ঠিকানার উদ্দেশ্যে হেঁটে চলছি। সংযমের মাস। একটু শঙ্কিত। এক আবাসিক বাড়ির আঙিনায় মহিলাটি বসে পড়ল। ডাস্টবিনে যা কিছু সঞ্চিত ছিল, বিষাদভরা আর্তনাদে মুখে দিচ্ছে আর ভেতরের স্পন্দনকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছে।
পথে কোনো ভোগান্তির কথা ভাবছি না। ঠিক সময়মতো ইফতার ধরতে পারব কি না ভাবছি।
এদিক-ওদিক খুঁজছি, যদি কারও দেখা পাই। সৃষ্টিকর্তার ইশারা ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না। এগিয়ে এলেন আরেক প্রেগন্যান্ট নারী। মুসলিম নারী। হাতে ইফতার। এগিয়ে এলেন। এগিয়ে দিলেন।
আমার মনে হলো, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা তাকে এইমাত্র পাঠিয়েছেন। দুজন ভিন্ন দেশের মানুষ-ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ভাষা কিন্তু একই পথের পথিক।
কারও মুখে কোনো শব্দ নেইÑযুগ-যুগান্তরের চেনা। সে এক প্রাণবন্ত দৃশ্য। দুজন সন্তানসম্ভবা নারী। আমি তৃতীয় একজন। সেই মনে আমি দুজনের মোহিনী মায়ার অপরূপ বেশ, যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ খুঁজে পেলাম। প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে থাকলাম।
সাম্যবাদী কবি নজরুলের দুটি লাইন মনে পড়ে গেল : ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই,/ এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই!’
লেখক : অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা; সাবেক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।