রেভারেন্ড ফাদার স্ট্যানলী গমেজ
মাস দুয়েক আগে জার্সি সিটি, নিউজার্সিতে আমাদের ইস্টার ও বাংলা নববর্ষ পুনর্মিলনী উৎসবে বিশেষ আকর্ষণ ছিল ছোট ও বড়দের নিয়ে বৈশাখী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সত্যি উপভোগ্য ছিল সন্ধ্যাটা। সেখানে আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় ও প্রিয়, একই সঙ্গে বাংলাদেশে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খুবই জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ও সুরকার কালিস্টুস অপূর্ব গাঙ্গুলি ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের অনেক জনপ্রিয় ‘কেউ বলে ফাল্গুন’ গানটা গাইলেন। অপুদার সুরেলা কণ্ঠে গানটা শুনে যেমন মনোমুগ্ধ হলাম, তেমনি আবার মনোবিজ্ঞানের ক্লাসে পড়া কিছু বিষয়ও মনে পড়ল; যা গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় কথা ও সুরের মূর্ছনায় অতি চমৎকারভাবে এই গানটাতে উপস্থাপন করেছেন। মানুষের মন বড় বিস্ময়কর! এতে কত যে বিষয় ঠেসে আছে, তা বলা দুষ্কর। এমনকি এটা সত্য যে অনেক বিষয় এখনো হয়তো মনোবিজ্ঞানীদের অগোচরে রয়েছে। ‘কেউ বলে ফাল্গুন’ গানের কথাগুলো পড়লে বা শুনলে মানবমনের একটা বিশেষ দিকÑনেতিবাচক ও হতাশার মনোভাব-ফুটে উঠবে, যা আমরা অনেকেই হয়তো কখনো কখনো উপলব্ধি করে থাকি। গানের কথাগুলো হলো :
কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস
আমি বলি আমার সর্বনাশ।
কেউ বলে দখিনা, কেউ বলে মাতাল বাতাস,
আমি বলি আমার দীর্ঘশ্বাস।
কেউ বলে নদী কেউ তটিনী
কেউবা দিয়েছে নাম তরঙ্গিনী।
আমি তো তাকে কোনো নামে ডাকিনি
সে যে আমার চোখেই জলোচ্ছ্বাস।
কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস
আমি বলি আমার সর্বনাশ।
জোনাকির নাম নাকি আঁধার মানিক
আমি তো দেখি আগুন জ্বলে ধিকিধিক।
খর বৈশাখে প্রথম যেদিন
মেঘের মিছিলে ওই আকাশ রঙিন
তৃষিত হৃদয়ে বাজে আনন্দ বীন,
আমি দেখি ঝড়ের পূর্বাভাস।
কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস
আমি বলি আমার সর্বনাশ।
কেউ বলে দখিনা, কেউ বলে মাতাল বাতাস,
আমি বলি আমার দীর্ঘশ্বাস ॥
(কথা, সুর ও কণ্ঠ : জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়)
নেতিবাচক মন হলো এমন, যা কখনো সন্তুষ্ট হয় না, সবকিছুতেই কিছু না কিছু নেতিবাচক বিষয় খুঁজে পায়। এ রকম মনের মানুষগুলো ফাল্গুন মাসে পলাশ কিংবা অন্যান্য মনোমুগ্ধকর ফুল দেখেও সেগুলোর সৌন্দর্য তারা দেখতে পায় না, বরং ফুলের শত রঙের মেলাকে তারা নিজেদের সর্বনাশ হিসেবে দেখে। শরীর জুড়িয়ে দেওয়া বাতাসকে তারা মনে করে তাদের দীর্ঘশ্বাসের মতো। এই হতাশাব্যঞ্জক মনোভাবের কারণে তারা ষড়ঋতুর ভিন্নতার মাঝেও সুন্দর কিছু খুঁজে পায় না, বরং ঝড়ের আশঙ্কায় কাতর হয়ে পড়ে। আমাদের চারপাশে খুঁজলে আমরা এ রকমের বহু মানুষের দেখা পাব, এমনকি আমরা নিজেরাও এ রকমের নেতিবাচক অথবা হতাশাব্যঞ্জক মানুষ হতে পারি। নদী দেখে আনন্দ না পেয়ে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কায় ভয় পেতে পারি।
এই ব্যাপারগুলো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, কোথাও যেন একটু ভারসাম্যের অভাব রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মানসিক স্বাস্থ্যকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছে, ‘মানসিক স্বাস্থ্য হলো কুশলতার একটি স্তর, যে স্তরে কোনো ব্যক্তি তার নিজস্ব ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারে, জীবনের স্বাভাবিক উদ্বেগের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, ফলদায়ক ও ফলপ্রসূভাবে কাজ করতে পারে এবং তার গোষ্ঠীতে (সমাজে) অবদান রাখতে সক্ষম হয়।’ এই মানসিক স্তরে বা ভারসাম্যে কোনোভাবে ব্যাঘাত ঘটলে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। শারীরিক অসুস্থতায় যেমন চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, তেমনি মানসিক অসুস্থতায়ও উপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন। তবে মানসিক অসুস্থতাকে অনেক সময়ই পারিবারিকভাবে উপেক্ষা করা হয়। এমনকি এখনো আমরা অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা দেখাই। এর কারণ হতে পারে সামাজিক কুসংস্কারের ভীতি। তবে মাঝে মাঝে মন খারাপ হলেই যে মানসিক সমস্যা, তা কিন্তু নয়। সব বয়সেই মানসিক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে এবং এর উপসর্গও বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে। এর মধ্যে যে দিকগুলো চোখে পড়ে, তা হলো :
লম্বা সময় ধরে মন খারাপ থাকা
নিজেকে অন্যের কাছ থেকে সরিয়ে রাখা
পরিচিত কিংবা অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা না করা
সময়ে-অসময়ে এমনিতেই অতিরিক্ত উত্তেজিত হওয়া
বিনা কারণে তর্কে কিংবা ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়া
কারণ ছাড়াই অন্যদের সন্দেহ করা
নিজের শারীরিক যত্ন কিংবা পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখা
পূর্বের আনন্দপূর্ণ কাজগুলোতে উৎসাহবোধ না করা
নিজের বিষয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা
নিজেকে দোষী বা দায়ী মনে করা
সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা
কাজে, দায়িত্ব পালনে অনীহা
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অতিরিক্ত অনুরক্ত হওয়া
অত্যধিক বা খুবই কম ঘুম
খাদ্য গ্রহণে অরুচি কিংবা অতিরিক্ত খাওয়া
অবাস্তব পরিস্থিতিতে নিজেকে কল্পনা করা ও তা বাস্তব বলে বিশ্বাস করা
অবাস্তব কথা, আওয়াজ শোনা
আত্মহত্যার চিন্তা, পরিকল্পনা কিংবা চেষ্টা করা
ইত্যাদি আরও বহু বিষয়...
মানসিক ব্যাধি থেকে নিরাময় হতে হলে অবশ্যই চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। সব দেশেই মানসিক রোগ সারাতে দুই ধরনের চিকিৎসা করা হয়। এর একটি হলো পরামর্শ সেবা (counseling) ও ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা (medication)। দুটোই গুরুত্বপূর্ণ, তবে চিকিৎসক ঠিক করবেন কোন চিকিৎসাপদ্ধতি রোগীকে দ্রুত সুস্থ করবে। যে মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত, সে কিন্তু নিজে নিজে সাহায্য চাইতে পারে না। এমনকি সে নিজেই উপলব্ধি করতে পারে না যে সে মানসিকভাবে অসুস্থ। চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া তার পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। তাই তারই পরিচিত হৃদয়বান কাউকে এগিয়ে আসতে হবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। এ জন্য পরিবারের উঠতি বা বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েদের (teenagers) এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের (elderly/geriatric) দিকে নজর রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো বয়সের কোনো ব্যক্তি যদি কোনো কারণে মানসিক আঘাত (trauma) পান (চাকরি হারানো, সম্পর্ক বিচ্ছেদ, দুর্ঘটনা, প্রিয়জনের মৃত্যু ইত্যাদি), তাদের প্রতিও বিশেষ মমতা দিয়ে সহযোগিতা করা আবশ্যক। মানসিক ব্যাধিকে ঘিরে কোনো প্রকার নিম্নভাব (taboo) পোষণ করা একেবারেই অনুচিত।
পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ভালোবেসে এমন সুন্দর এই পৃথিবীকে আমাদের বাসস্থান হিসেবে দিয়েছেন, যেখানে ষড়ঋতুতে ভিন্নতার মাঝে এত সৌন্দয্যের ছড়াছড়ি। সেই সৌন্দর্য দেখে আনন্দচিত্তে তাঁর আরাধনা, গৌরব, প্রশংসা ও ধন্যবাদ করা আমাদের কর্তব্য। এই পৃথিবীর পাহাড়, বন, নদী, হ্রদ, ধানক্ষেত, সরষে কিংবা সূর্যমুখীর আবাদস্থান, সাগর, সমুদ্রসৈকত, ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ, কত প্রজাতির পাখি, জন্তু, পোকা-মাকড় বহু বৈচিত্র্যের মাঝেও কী অপরূপ রূপে আমাদের দুই চোখকে, মনকে, হৃদয়কে আনন্দে-প্রশস্তিতে ভরে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষও কত রকমের, কত ভিন্ন গায়ের রঙের, কত ভাষার, কত সংস্কৃতির, কত দেশের, কত ধর্মের কিন্তু তবু সবাই মানবতার একই বন্ধনে আবদ্ধ, একই সুতায় বাঁধা এক মালা। প্রকৃতির ও মানবজাতির এই সৌন্দর্য অনুধাবন-উপভোগ করতে কোনো প্রকার মানসিক অসুস্থতা যেন বাধা হয়ে উঠতে না পারে। পরিবারের একজন হিসেবে, প্রতিবেশী হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে, সমাজের সভ্য হিসেবে, চিন্তাশীল হিসেবে, বুদ্ধিজীবী হিসেবে, চিকিৎসক হিসেবে আমরা যেন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে কখনোই দ্বিধা, সংশয় না করি। অমর হোক সৌন্দর্য, হৃদয়ে-মনে ফাল্গুন থাকুক আজীবন ॥
লেখক : একজন রোমান ক্যাথলিক যাজক, ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী, নটরডেমিয়ান, নিউজার্সিবাসী এবং ধর্মবিষয়ক কলামিস্ট।
মাস দুয়েক আগে জার্সি সিটি, নিউজার্সিতে আমাদের ইস্টার ও বাংলা নববর্ষ পুনর্মিলনী উৎসবে বিশেষ আকর্ষণ ছিল ছোট ও বড়দের নিয়ে বৈশাখী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সত্যি উপভোগ্য ছিল সন্ধ্যাটা। সেখানে আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় ও প্রিয়, একই সঙ্গে বাংলাদেশে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খুবই জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ও সুরকার কালিস্টুস অপূর্ব গাঙ্গুলি ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের অনেক জনপ্রিয় ‘কেউ বলে ফাল্গুন’ গানটা গাইলেন। অপুদার সুরেলা কণ্ঠে গানটা শুনে যেমন মনোমুগ্ধ হলাম, তেমনি আবার মনোবিজ্ঞানের ক্লাসে পড়া কিছু বিষয়ও মনে পড়ল; যা গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় কথা ও সুরের মূর্ছনায় অতি চমৎকারভাবে এই গানটাতে উপস্থাপন করেছেন। মানুষের মন বড় বিস্ময়কর! এতে কত যে বিষয় ঠেসে আছে, তা বলা দুষ্কর। এমনকি এটা সত্য যে অনেক বিষয় এখনো হয়তো মনোবিজ্ঞানীদের অগোচরে রয়েছে। ‘কেউ বলে ফাল্গুন’ গানের কথাগুলো পড়লে বা শুনলে মানবমনের একটা বিশেষ দিকÑনেতিবাচক ও হতাশার মনোভাব-ফুটে উঠবে, যা আমরা অনেকেই হয়তো কখনো কখনো উপলব্ধি করে থাকি। গানের কথাগুলো হলো :
কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস
আমি বলি আমার সর্বনাশ।
কেউ বলে দখিনা, কেউ বলে মাতাল বাতাস,
আমি বলি আমার দীর্ঘশ্বাস।
কেউ বলে নদী কেউ তটিনী
কেউবা দিয়েছে নাম তরঙ্গিনী।
আমি তো তাকে কোনো নামে ডাকিনি
সে যে আমার চোখেই জলোচ্ছ্বাস।
কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস
আমি বলি আমার সর্বনাশ।
জোনাকির নাম নাকি আঁধার মানিক
আমি তো দেখি আগুন জ্বলে ধিকিধিক।
খর বৈশাখে প্রথম যেদিন
মেঘের মিছিলে ওই আকাশ রঙিন
তৃষিত হৃদয়ে বাজে আনন্দ বীন,
আমি দেখি ঝড়ের পূর্বাভাস।
কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস
আমি বলি আমার সর্বনাশ।
কেউ বলে দখিনা, কেউ বলে মাতাল বাতাস,
আমি বলি আমার দীর্ঘশ্বাস ॥
(কথা, সুর ও কণ্ঠ : জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়)
নেতিবাচক মন হলো এমন, যা কখনো সন্তুষ্ট হয় না, সবকিছুতেই কিছু না কিছু নেতিবাচক বিষয় খুঁজে পায়। এ রকম মনের মানুষগুলো ফাল্গুন মাসে পলাশ কিংবা অন্যান্য মনোমুগ্ধকর ফুল দেখেও সেগুলোর সৌন্দর্য তারা দেখতে পায় না, বরং ফুলের শত রঙের মেলাকে তারা নিজেদের সর্বনাশ হিসেবে দেখে। শরীর জুড়িয়ে দেওয়া বাতাসকে তারা মনে করে তাদের দীর্ঘশ্বাসের মতো। এই হতাশাব্যঞ্জক মনোভাবের কারণে তারা ষড়ঋতুর ভিন্নতার মাঝেও সুন্দর কিছু খুঁজে পায় না, বরং ঝড়ের আশঙ্কায় কাতর হয়ে পড়ে। আমাদের চারপাশে খুঁজলে আমরা এ রকমের বহু মানুষের দেখা পাব, এমনকি আমরা নিজেরাও এ রকমের নেতিবাচক অথবা হতাশাব্যঞ্জক মানুষ হতে পারি। নদী দেখে আনন্দ না পেয়ে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কায় ভয় পেতে পারি।
এই ব্যাপারগুলো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, কোথাও যেন একটু ভারসাম্যের অভাব রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মানসিক স্বাস্থ্যকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছে, ‘মানসিক স্বাস্থ্য হলো কুশলতার একটি স্তর, যে স্তরে কোনো ব্যক্তি তার নিজস্ব ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারে, জীবনের স্বাভাবিক উদ্বেগের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, ফলদায়ক ও ফলপ্রসূভাবে কাজ করতে পারে এবং তার গোষ্ঠীতে (সমাজে) অবদান রাখতে সক্ষম হয়।’ এই মানসিক স্তরে বা ভারসাম্যে কোনোভাবে ব্যাঘাত ঘটলে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। শারীরিক অসুস্থতায় যেমন চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, তেমনি মানসিক অসুস্থতায়ও উপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন। তবে মানসিক অসুস্থতাকে অনেক সময়ই পারিবারিকভাবে উপেক্ষা করা হয়। এমনকি এখনো আমরা অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা দেখাই। এর কারণ হতে পারে সামাজিক কুসংস্কারের ভীতি। তবে মাঝে মাঝে মন খারাপ হলেই যে মানসিক সমস্যা, তা কিন্তু নয়। সব বয়সেই মানসিক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে এবং এর উপসর্গও বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে। এর মধ্যে যে দিকগুলো চোখে পড়ে, তা হলো :
লম্বা সময় ধরে মন খারাপ থাকা
নিজেকে অন্যের কাছ থেকে সরিয়ে রাখা
পরিচিত কিংবা অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা না করা
সময়ে-অসময়ে এমনিতেই অতিরিক্ত উত্তেজিত হওয়া
বিনা কারণে তর্কে কিংবা ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়া
কারণ ছাড়াই অন্যদের সন্দেহ করা
নিজের শারীরিক যত্ন কিংবা পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখা
পূর্বের আনন্দপূর্ণ কাজগুলোতে উৎসাহবোধ না করা
নিজের বিষয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা
নিজেকে দোষী বা দায়ী মনে করা
সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা
কাজে, দায়িত্ব পালনে অনীহা
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অতিরিক্ত অনুরক্ত হওয়া
অত্যধিক বা খুবই কম ঘুম
খাদ্য গ্রহণে অরুচি কিংবা অতিরিক্ত খাওয়া
অবাস্তব পরিস্থিতিতে নিজেকে কল্পনা করা ও তা বাস্তব বলে বিশ্বাস করা
অবাস্তব কথা, আওয়াজ শোনা
আত্মহত্যার চিন্তা, পরিকল্পনা কিংবা চেষ্টা করা
ইত্যাদি আরও বহু বিষয়...
মানসিক ব্যাধি থেকে নিরাময় হতে হলে অবশ্যই চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। সব দেশেই মানসিক রোগ সারাতে দুই ধরনের চিকিৎসা করা হয়। এর একটি হলো পরামর্শ সেবা (counseling) ও ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা (medication)। দুটোই গুরুত্বপূর্ণ, তবে চিকিৎসক ঠিক করবেন কোন চিকিৎসাপদ্ধতি রোগীকে দ্রুত সুস্থ করবে। যে মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত, সে কিন্তু নিজে নিজে সাহায্য চাইতে পারে না। এমনকি সে নিজেই উপলব্ধি করতে পারে না যে সে মানসিকভাবে অসুস্থ। চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া তার পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। তাই তারই পরিচিত হৃদয়বান কাউকে এগিয়ে আসতে হবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। এ জন্য পরিবারের উঠতি বা বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েদের (teenagers) এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের (elderly/geriatric) দিকে নজর রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো বয়সের কোনো ব্যক্তি যদি কোনো কারণে মানসিক আঘাত (trauma) পান (চাকরি হারানো, সম্পর্ক বিচ্ছেদ, দুর্ঘটনা, প্রিয়জনের মৃত্যু ইত্যাদি), তাদের প্রতিও বিশেষ মমতা দিয়ে সহযোগিতা করা আবশ্যক। মানসিক ব্যাধিকে ঘিরে কোনো প্রকার নিম্নভাব (taboo) পোষণ করা একেবারেই অনুচিত।
পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ভালোবেসে এমন সুন্দর এই পৃথিবীকে আমাদের বাসস্থান হিসেবে দিয়েছেন, যেখানে ষড়ঋতুতে ভিন্নতার মাঝে এত সৌন্দয্যের ছড়াছড়ি। সেই সৌন্দর্য দেখে আনন্দচিত্তে তাঁর আরাধনা, গৌরব, প্রশংসা ও ধন্যবাদ করা আমাদের কর্তব্য। এই পৃথিবীর পাহাড়, বন, নদী, হ্রদ, ধানক্ষেত, সরষে কিংবা সূর্যমুখীর আবাদস্থান, সাগর, সমুদ্রসৈকত, ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ, কত প্রজাতির পাখি, জন্তু, পোকা-মাকড় বহু বৈচিত্র্যের মাঝেও কী অপরূপ রূপে আমাদের দুই চোখকে, মনকে, হৃদয়কে আনন্দে-প্রশস্তিতে ভরে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষও কত রকমের, কত ভিন্ন গায়ের রঙের, কত ভাষার, কত সংস্কৃতির, কত দেশের, কত ধর্মের কিন্তু তবু সবাই মানবতার একই বন্ধনে আবদ্ধ, একই সুতায় বাঁধা এক মালা। প্রকৃতির ও মানবজাতির এই সৌন্দর্য অনুধাবন-উপভোগ করতে কোনো প্রকার মানসিক অসুস্থতা যেন বাধা হয়ে উঠতে না পারে। পরিবারের একজন হিসেবে, প্রতিবেশী হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে, সমাজের সভ্য হিসেবে, চিন্তাশীল হিসেবে, বুদ্ধিজীবী হিসেবে, চিকিৎসক হিসেবে আমরা যেন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে কখনোই দ্বিধা, সংশয় না করি। অমর হোক সৌন্দর্য, হৃদয়ে-মনে ফাল্গুন থাকুক আজীবন ॥
লেখক : একজন রোমান ক্যাথলিক যাজক, ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী, নটরডেমিয়ান, নিউজার্সিবাসী এবং ধর্মবিষয়ক কলামিস্ট।