শামসাদ হুসাম
সময় সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করে। চিরাচরিত এই কথাটি যে সব সময় সত্য হয়, সেটা যেমন সঠিক নয়, তেমনি হাজার বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও কোনো কোনো ঘটনার স্মৃতি কোনো কিছু দিয়েই মুছে ফেলা যায় না। টাইটানিক ট্র্যাজেডির স্মৃতি সেই রকম কালজয়ী এক ঘটনা, যা শতবর্ষ পার হয়ে যাওয়ার পরও মানুষকে স্মৃতিকাতর করে রাখে।
ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল। তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় ও আধুনিক জাহাজ টাইটানিক সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় একটি বরফখণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে প্রায় ১৫০০ যাত্রীসহ সলিলসমাধি ঘটেছিল।
জাহাজটিকে বলা হতো একটি ভাসমান রাজপ্রাসাদ। ৮৮২ ফুট ৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে জাহাজটির মোট আয়তন ছিল তিনটি বড় ফুটবল মাঠের সমান। বিলাসিতার দিক দিয়ে প্রথম শ্রেণির একটি হোটেলে যত ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকে, টাইটানিক জাহাজে তার সবকিছুই ছিল। নয়তলাবিশিষ্ট ওই জাহাজের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ১৭৫ ফুট। ওই জাহাজ প্রতিদিন ৮০০ টন কয়লা পোড়াত। আর প্রতি ঘণ্টায় তার গতিবেগ ছিল ২৪ নটিক্যাল মাইল বা ঘণ্টায় ২৭ মাইলের মতো। তিন হাজার শ্রমিকের দুই বছরের অক্লান্ত শ্রমে ওই জাহাজটি নির্মিত হয়েছিল। কথিত আছে, নির্মাণের সময়ে পাঁচজন শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছিল। আর টাইটানিকের নির্মাণব্যয় ছিল ৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার।
জাহাজের সব জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ১০ হাজার বাল্ব লাগানো ছিল। যাত্রী এবং ক্রুদের জন্য প্রতিদিন যে খাওয়ার পানির প্রয়োজন পড়ত, তা ছিল ১৪ হাজার গ্যালনের মতো। এ ছাড়া ছিল জাহাজের ভেতরে একটি সুইমিংপুল। একটি জিমনেসিয়াম, দুটি লাইব্রেরি এবং চুল কাটার জন্য দুটি সেলুন। আর ছিল ১৯টি ওয়াটার টাইট কম্পার্টমেন্ট। যাত্রীধারণক্ষমতা ছিল তিন হাজারের মতো। সব মিলিয়ে সেই সময়ে টাইটানিক জাহাজ নির্মাণে সর্বোচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছিল। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের দাবি ছিল এই জাহাজ কোনো কারণে এবং কোনো সময়েই ডোবার মতো কারণ ঘটবে না। একটা প্রচ্ছন্ন অহংকার জাহাজ কোম্পানির মালিকদের এতটাই অন্ধ করে রেখেছিল যে তারা জাহাজে কোনো লাইফবোট রাখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করতেন না। তবে এ-সংক্রান্ত বিষয়ে নিদেনপক্ষে সামান্য কয়েকটা লাইফবোট জাহাজে রাখার আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকায় মাত্র ২৪টি লাইফবোট তারা রেখেছিলেন। কিন্তু যখন বাড়তি লাইফবোটের প্রয়োজন পড়ল, তখন মাথা চাপড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না কর্তৃপক্ষের। ১৯০৭ সালে জাহাজটির নির্মাণকাজ শুরু করে টানা পাঁচ বছর কাজ চালিয়ে যাওয়ার পর ১৯১২ সালে এসে পূর্ণতা পায়। এই দায়িত্বে ছিল হল্যান্ডের (বর্তমানে নেদারল্যান্ডস) হোয়াইট স্টার লাইন নামের প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ মালিকানা ছিল ওই প্রতিষ্ঠানের। তবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ছিল হারল্যান্ড অ্যান্ড উলফ শিপ ইয়ার্ড, বেলফাস্ট।
টাইটানিক ছিল গ্রিক পুরাণের এক শক্তিশালী দেবতার নাম। সেই দেবতার নাম থেকে ‘টাইটানিক’ শব্দটির উৎপত্তি। পুরো নাম ছিল ‘আরএমএস টাইটানিক’। অর্থাৎ ‘রয়েল মেল স্টিমার টাইটানিক’।
মূলত ব্রিটিশ বিলাসবহুল যাত্রীবাহী লাইনার, যেটি ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল সাউদাম্পটন, ইংল্যান্ড থেকে রওনা হয়ে নিউইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিল। সেই যাত্রাপথে ক্যাপ্টেন জন স্মিথের নেতৃত্বে ৮৮৫ জন ক্রু জাহাজে আরোহণ করেছিলেন। সেই সময়ে যাত্রী ছিলেন প্রথম শ্রেণিতে ৩২৪ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২৮৪ জন আর তৃতীয় শ্রেণিতে ৭০৯ জন। মোট ১ হাজার ৩১৭ জন। অর্থাৎ ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল জাহাজটি। তারপর শেরবুর্গ থেকে ২৭৪ জন যাত্রী ওঠেন এবং আয়ারল্যান্ডের কর্ক পোতাশ্রয় থেকে জাহাজে ওঠেন দ্বিতীয় শ্রেণির আরও সাতজন যাত্রী এবং তৃতীয় শ্রেণির যাত্রী ওঠেন ১১৩ জন। সেই সময় ব্যয়বহুল প্রথম শ্রেণির প্যাকেজের দাম ছিল ৪ হাজার ৩৫০ ডলার, বর্তমান বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬৭ লাখ টাকারও বেশি।
ওই জাহাজের প্রথম শ্রেণিতে যাত্রী ধারণক্ষমতা ছিল ৭৩৯ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৬৭৪ জন এবং তৃতীয় শ্রেণিতে ১ হাজার ২০ জন। এ ছাড়া ক্রুসহ সর্বমোট তিন হাজারের মতো যাত্রী বহনের ক্ষমতাসম্পন্ন টাইটানিককে সেই সময়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জাহাজই শুধু বলা হতো না, এটাকে মনে করা হতো মর্ত্যরে সুন্দরতম ভাসমান প্রাসাদ।
পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ডুবে যাওয়ার পরের ইতিহাসে পৃথিবীতে অনেক ওলট-পালট ঘটেছে। টাইটানিকের চেয়েও আকারে বড় আরও অনেক জাহাজ পানিতে ভাসানো হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘সিম্ফনি অব দ্য সিজ’। এই ক্রুজ জাহাজটির যাত্রী ধারণক্ষমতা ছিল ৬ হাজার ৬৮০ জনের মতো।
‘হারমনি অব দ্য সিজ’ আরেকটি বৃহত্তম জাহাজ। ২০১২ সালে নির্মিত এই জাহাজের যাত্রী ধারণক্ষমতা সাত হাজারের মতো। এই জাহাজটি বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন প্রমোদতরী, যেটিকে ২০১৬ সালের ১০ মার্চ প্রথম সাগরে ভাসানো হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, টাইটানিকের চেয়ে কুড়ি গুণ বড়!
এ রকম আরও কয়েকটি বৃহৎ জাহাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আরএস কুইন, নরওয়েজিন ব্লিস, এমএসসি মেরাডিগলিয়া। ফ্রান্সের তৈরি এই জাহাজকে বলা হয় বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ ক্রুজ শিপ। জার্মানির তৈরি পঞ্চম বৃহত্তম জাহাজের নাম ‘এইডা আনোভা’। জাহাজটির যাত্রী ধারণক্ষমতা হচ্ছে ৬ হাজার ৬০০ জন। এ ছাড়া ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে এসএসসিতে বেলিসসিমো। পরের দিকে রয়েছে ব্রিটিশ ক্রুজ মেরি কুইন টু। এই নামে দুটি বৃহৎ জাহাজ থাকায় জাহাজটির নামের আগে ‘টু’ যুক্ত হয়েছে। মোটামুটিভাবে ১০টি জাহাজকে বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম জাহাজের মর্যাদা দেওয়া হলেও ১০০ বছর আগে টাইটানিকই ছিল একমাত্র জাহাজ, যেটি তার নান্দনিক সৌন্দর্য এবং বৃহৎ পরিসরের জন্য সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে এক অপার বিস্ময় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল।
প্রথম যেদিন পানিতে ভাসানো হয়েছিল, ওই দৃশ্য দেখার জন্য এক লাখ মানুষ সমুদ্রবন্দরে উপস্থিত হয়েছিল। পানিতে নামানোর আগে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিল, ‘সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে টাইটানিক এতটাই মজবুত করে বানানো হয়েছে যে স্বয়ং স্রষ্টা চাইলেও এর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না!’ মূলত এই অহংকারটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় টাইটানিকের জন্য। ১০ এপ্রিল, যেদিন সমুদ্রযাত্রার শুরু, সেই শুরুর সময়েই বড় একটা দুর্ঘটনার হাত থেকে অল্পের জন্য রেহাই পায় টাইটানিক। পশ্চিমমুখী সেই যাত্রা শুরুর সময়ে ‘এসএস সিটি অব নিউইয়র্ক’ নামক একটি জাহাজের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের হাত থেকে রক্ষা পায় মাত্র চার ফুট ব্যবধানের জন্য।
টাইটানিক জাহাজের ডুবে যাওয়ার পেছনে সমুদ্রে ভাসমান আইসবার্গকে দায়ী করা হয়েছিল। সেই আইসবার্গ বা ভাসমান বরফখণ্ডের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য হলো এই বরফখণ্ডগুলো কালচে ধরনের ছিল, অর্থাৎ সহসা দেখলে সমুদ্রের পানি থেকে আলাদা করা যায় না। আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো ওইসব বরফখণ্ডের আট ভাগের মধ্যে মাত্র এক ভাগ পানির উপরে থাকে, বাকি সাত ভাগ থাকে পানির নিচে। যার কারণে সহসা চোখে ধরা পড়ে না। তবে ১৪ এপ্রিল দুপুর দুইটার দিকে ‘আমেরিকা’ নামের একটি জাহাজ থেকে প্রথম এই আইসবার্গ সম্পর্কে রেডিও মারফত টাইটানিক জাহাজের রেডিও অপারেটরের কাছে একটি বার্তা পাঠানো হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে গবংধষবধ নামের একটি জাহাজ থেকে এ ধরনের আরও একটি সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছিল। ওই সময়ে টাইটানিকের রেডিও অপারেটর হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন জ্যাক ফিলিপস এবং হ্যারান্ড ব্রিজ নামের দুজন। তাদের দুজনের কাছেই এই সতর্কবার্তা গুরুত্বহীন মনে হয়েছিল। যেহেতু টাইটানিক হচ্ছে আনসিঙ্কেবল, অতএব বরফের চাঁইকে হার্মফুল মনে করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। তাই তারা বিষয়টি ক্যাপ্টেনের কানে তোলেননি। যে সময় দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল, তার ৪০ মিনিট আগে একইভাবে ‘ক্যালিফোর্নিয়া’ নামক আরও একটি জাহাজ ‘সামনে বড় একটি আইসবার্গ রয়েছে’, এই ধরনের বার্তা পাঠানোও একইভাবে টাইটানিকের রেডিও অপারেটরবৃন্দ সেই বার্তাকেও আমলে নিলেন না!
আসলে যে পানিপথ দিয়ে জাহাজটি যাত্রা শুরু করেছিল, সেদিকে এই ধরনের আইসবার্গ থাকার কথাও নয়। এ বিষয়ে টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিদেরা একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তাদের মতে, ওই হিমশিলা খণ্ডগুলো (আইসবার্গ) উত্তরের গ্রিনল্যান্ড থেকে এসেছিল। ওই সময়, অর্থাৎ ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জানুয়ারি ‘চাঁদ’ পৃথিবীর অত্যন্ত কাছে চলে এসেছিল। বিজ্ঞানীদের অভিমত হচ্ছে, এ ধরনের ঘটনা ঘটে সাধারণত ১৪০০ বছরের মধ্যে মাত্র একবার। সেই সময়ে আরও একটি ঘটনা ঘটেছিল, আর সেটা হলো সূর্যও তখন অন্য এক অবস্থানে চলে এসেছিল। যে কারণে সমুদ্রে এক অস্বাভাবিক মাত্রার জোয়ারের সৃষ্টি হয়েছিল, যে জোয়ারের টানে নিউফাউন্ডল্যান্ড এবং ল্যাব্রাডর থেকে পর্বত আকারের বহুসংখ্যক আইসবার্গ বা হিমশিলাখণ্ড আটলান্টিক সাগরের সমুদ্রগামী জাহাজের গতিপথে এসে বাধা সৃষ্টির নতুন এক ইতিহাসের জন্ম দেয়। যে ঘটনা ১৪০০ বছরে একবার ঘটে, সেই ঘটনাটা অলৌকিক এক শক্তি নিয়ে টাইটানিক নামক ‘আনসিঙ্কেবল’ এক জাহাজের গায়ে সামান্য আঘাত দিয়ে একেবারে ডুবিয়ে দিল। ইতিহাসের মোড় ঘোরানোর এমন এক প্রেক্ষাপটে স্বয়ং অদৃশ্য স্রষ্টা নিশ্চয় নীরবে হেসেছিলেন সে সময়! না হলে দুনিয়ায় এত বড় ঘটনা কী করেই-বা ঘটল?
যে আইসবার্গের সঙ্গে জাহাজের ধাক্কা লেগেছিল, সেই বরফখণ্ডটির রং ঠিক সাদা ছিল না। অনেকটা কালচে ভাবের হওয়ায় খুব কাছ থেকেও তা চোখে ধরা পড়েনি। এ ধরনের আইসবার্গকে আবার ‘ব্ল্যাকবার্গ’ও বলা হয়ে থাকে। ফলে যখন একেবারে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়ে পড়ে জাহাজটি, তখন আইসবার্গের সঙ্গে জাহাজের দূরত্ব মাত্র ৩৭ সেকেন্ডের। রাত তখন ১১টা ৪০ মিনিট। এই ৩৭ সেকেন্ডের দূরত্বে মৃত্যু দাঁড়িয়ে আছে সামনে।
বিষয়টা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করার পর টাইটানিকের ফার্স্ট অফিসার মুরডক জাহাজটি বামে মোড় ঘোরানোর নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন বন্ধ করারও নির্দেশ দিলেন। তখন বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গেছে, টাইটানিককে বাঁচানো আর সম্ভব নয়। কারণ ততক্ষণে জাহাজের ডান দিকে প্রচণ্ড এক ঘর্ষণের ফলে ৯০ মিটার অংশজুড়ে চিড় ধরে গেছে।
কথিত আছে, মোট ছয়বারের মতো ওই হিমশিলাখণ্ডের উপস্থিতি সম্পর্কে আটলান্টিকে ভাসমান বিভিন্ন জাহাজ থেকে সতর্কবার্তা পাঠালেও একটি বারের জন্যও টাইটানিকের রেডিও অপারেটরের মনে কোনো প্রশ্নের উদ্রেক করেনি। ফলে ক্যাপ্টেনের কাছে সেই সতর্কবার্তা সম্পর্কে জানানোরও কোনো গরজ অনুভব করেননি তারা। যদিও দুজন অপারেটর সে সময়ে দায়িত্ব পালনে ছিলেন। এমনকি একপর্যায়ে তারা ওয়্যারলেস বন্ধ করে ঘুমাতেও চলে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ বিষয়টার গুরুত্ব মোটেও বুঝতে পারেননি তারা। আর সত্য হলো বিষয়টাকে গুরুত্ব না দেওয়ার খেসারত দিতে হলো তিন হাজার মানুষকে।
এই টাইটানিকের বৈশিষ্ট্য ছিল, যদি কোনো দুর্ঘটনার কারণে জাহাজের ভেতরে পানি ঢুকে চারটি কম্পার্টমেন্টও জলপূর্ণ হয়ে পড়ে, তাহলেও সেই অবস্থাতেও জাহাজ ভাসমান থাকার ক্ষমতা ধরে রাখার কথা। কিন্তু বরফখণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যে ৯০ মিটার অংশজুড়ে চিড় ধরে গিয়েছিল, সেই চিড় ধরা অংশ দিয়ে বিপুল বেগে পানি প্রবেশ করার সেই সময়ে ছয়টি কম্পার্টমেন্ট জলপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ফলে এই বাড়তি ওজনের ধাক্কা বহনের শক্তি হারিয়ে জাহাজের সামনের অংশ ডুবতে থাকে।
এ ছাড়া জল প্রতিরোধের জন্য যে ১২টি গেট ছিল, প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা লাগায় তার সবগুলো ভেঙে পড়েছিল সেই সময়। এসব ঘটনার পরপর লাইফবোটগুলো পানিতে নামানো শুরু হয়ে যায়। যদিও টাইটানিকের ৬৪টি লাইফবোট বহনের ক্ষমতা ছিল এবং ৬৪টি লাইফবোট থাকলে চার হাজারের মতো মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হতো। কিন্তু জাহাজে ছিল মাত্র ২৪টি লাইফবোট। যে কারণে মোট যাত্রীসংখ্যার ৩৩ শতাংশ বহন করতে পেরেছিল ওই লাইফবোটগুলো। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো, মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়েও জাহাজ কর্তৃপক্ষের মনে শ্রেণিবৈষম্যের বিষয়টি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল তখন, অর্থাৎ লাইফবোটে ওঠার ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির যাত্রীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে, এ ক্ষেত্রে শিশুদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই শিশুদের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণির শিশুরা এক মর্মান্তিক বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়েছিল সেই সময়ে। তখন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির প্রায় সব শিশুকে লাইফবোটে তোলা হলেও তৃতীয় শ্রেণিতে ওই সময়ে ছিল ৭৬ জন শিশু, তার মধ্যে মাত্র ২৩ জনকে লাইফবোটে তোলা হয়েছিল, বাকি ৬০ শতাংশ শিশুর সলিলসমাধি ঘটেছিল।
এ রকম এক তেরো মাস বয়সী মেয়ে ‘ইনো’কে সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করেছিল ‘ম্যাকে বেনেটের’ (উদ্ধারকারী জাহাজ) নাবিকেরা। পশমি জ্যাকেট পরা এ শিশুটির মরদেহ উদ্ধারের পর জীবিত যাত্রীদের মধ্য থেকে কাউকেই তার স্বজন হিসেবে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি বলে অচেনা এক শিশুর তকমা নিয়ে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে লেকহেড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের চেষ্টায় যখন আরও অনেক মরদেহের হাড়গোড়ের ডিএনএ টেস্ট করা হয়েছিল, সেই সময়ে ইনোর পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। মেয়েটির সঙ্গে তার বাবা-মা ছাড়াও ছিল আরও চারটা ভাই, কিন্তু সেই সময়ে ইনো ছাড়া আর কারও মরদেহের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ওই পরিবারটি ফিনল্যান্ডের অধিবাসী। এ ধরনের আরও একটি কষ্টকর স্মৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল মানুষের। জাহাজডুবির প্রায় বছর পরে ১৯১৫ সালের গ্রীষ্মের এক প্রহরে ডানকেটল সৈকতের কাছে কুকুর নিয়ে হাঁটার সময় এক পর্যটকের দৃষ্টিতে পড়ে একটি ছিপি আঁটা বোতলের।
বোতলটির ভেতরে একটি চিরকুট পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে লেখা ছিল- ‘১৩/৪/১৯১২। টাইটানিক থেকে। সকলকে বিদায়’। গ্লেনমায়ারের বার্কদের কর্ক। জেরেস বার্ক নামের একটি বালকের জন্ম কর্ক সিটির কাছাকাছি গ্লেনমায়ারে। তার বোন (বড়) টাইটানিকের উদ্বোধনী জাহাজের একটি টিকিট কেটে দিয়েছিলেন ভাইকে। তার খুব শখ ছিল আমেরিকায় যাওয়ার। সেই জেরেস বার্কের কাছে মৃত্যু যখন নিকটবর্তী, তখন সে একটি কাগজে সকলকে বিদায় অভিবাদন জানিয়েছিল। লিখতে গিয়ে তারিখটা ভুল লিখেছিল, ওই দিন ছিল ১৪ এপ্রিল। ১৩ এপ্রিল ছিল না। হয়তো অসাবধানতাবশত লিখেছিল ১৩ তারিখের কথা। তবে মর্মান্তিক সত্য হলো প্রায় তিন হাজার মাইল পরিভ্রমণ শেষ করে বোতলটি জেরেসের জন্মস্থান কর্ক বন্দরে এসে নোঙর ফেলেছিল। জেরেসের মা তখনো জীবিত ছিলেন। তার কাছে সেই বোতলটি পৌঁছেছিল এবং তিনি শেষ পর্যন্ত নিখোঁজ হওয়া ছেলের খবর জেনে যেতে পেরেছিলেন। জাহাজ ডোবার সময়ে ৮৮৫ জন ক্রু ছাড়াও যাত্রী ছিলেন ২ হাজার ২২৩ জন। এই তিন হাজার মানুষের মধ্যে বেঁচে ছিলেন মাত্র ৭০৬ জন এবং সলিলসমাধি ঘটেছিল ১ হাজার ৫০০ জনের। বাকিরা রইলেন নিখোঁজের তালিকায়। তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীদের ক্ষতির পরিমাণটা ছিল বেশি। ওই তৃতীয় শ্রেণিতে যাত্রীসংখ্যা ছিল ৭১০ কিন্তু এদের মধ্যে বেঁচেছিলেন মাত্র ১৭৪ জন। এটাও ছিল শ্রেণিবৈষম্যের আরেকটা রূপ। এমনিতেই লাইফবোটের সংখ্যা ছিল কম। তার পরও যা-ও ছিল, সেসব লাইফবোটে স্থান সংকুলানের অজুহাতে তাদের আর জায়গা হয়নি। বেশির ভাগ মানুষ মারা গিয়েছিল প্রচণ্ড ঠান্ডার কারণে। তখন সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা ছিল ২৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা মাইনাস দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। এই তাপমাত্রায় মানুষ খুব বেশি সময় টিকে থাকতে পারে না।
এই ভয়াবহ অবস্থার সময়েও বর্ণবিদ্বেষের শিকারে পরিণত হয়েছেন পৃথিবীর কিছু অঞ্চলের মানুষ। যেমন টাইটানিকের বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের সঙ্গে ছয়জন চীনা নাগরিক অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলে তাদেরকে নিউইয়র্কের এলিস আইল্যান্ডের অভিবাসন অফিসে নিয়ে আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদেরকে আমেরিকা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়ে আমেরিকান নাগরিকত্ব আইনে চীনাদের প্রবেশাধিকার ছিল না। এ ঘটনার ১০৯ বছর পরে ওই ছয়জন চীনা নাগরিককে নিয়ে চায়নাতে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত ও জনসম্মুখে প্রদর্শিত হয়েছিল, সেখানে ওই ঘটনার বিশদ বিবরণ ছিল। টাইটানিক দুর্ঘটনায় অনেকের সঙ্গে মারা গিয়েছিলেন আমেরিকান এক বড় ব্যবসায়ী অস্কার হলভারসন। তিনি ও তার স্ত্রী সাউদাম্পটন থেকে জাহাজে উঠেছিলেন নিউইয়র্কে যাওয়ার উদ্দেশে। জাহাজডুবির আগের দিন তিনি তার মায়ের কাছে একটা চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে টাইটানিক সম্পর্কে অনেক কথা বলা ছাড়াও বিশেষ বিশেষ যাত্রীদের সম্পর্কেও বর্ণনা ছিল। অস্কার হলভারসন পানিতে ডুবে মারা গেলেও সেই চিঠিটা পাওয়া গিয়েছিল তার বুকপকেটে। সেই চিঠিটা অবশ্য তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। সাগরের নোনা জলে ভিজলেও চিঠির কাগজ অক্ষত ছিল।
শেষ পর্যন্ত সেই চিঠিটা তার মায়ের মৃত্যুর পরে নিলামে তোলা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্রিটিশ ক্রেতা, যার নেশাই ছিল অভিনব কিছু সংগ্রহে রাখা, চিঠিটা কিনেছিলেন ১২৬ হাজার ডলার মূল্যে। টাইটানিকে বসে পরিবারের কাছে যাত্রীদের লেখা চিঠির মধ্যে সর্বশেষ এই চিঠিটা নিলামে রেকর্ড দামে বিক্রি হয়েছিল।
উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বন্দর থেকে টাইটানিক তার যাত্রা শুরু করেছিল। সেই জাহাজের ক্রুদের মধ্যে প্রায় সবাই (বেশির ভাগ) ছিলেন সাউদাম্পটনের নাগরিক। সেই ঘটনার পরে শত বছর পার হলেও সেই শহরটি নানাভাবে তার হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের মনে করে থাকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-সেই শহরে ‘সি সিটি মিউজিয়াম’ নির্মাণের পরে সেখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ডুবন্ত জাহাজ থেকে উদ্ধার করে আনা নানা সামগ্রী। জাহাজের ক্যান্টেন ছাড়াও সব ক্রুর ছবি।
টাইটানিক থেকে উদ্ধার পাওয়া সবচেয়ে ছোট শিশু ছিল মিলডিনা ডিন। সেই সময়ে তার বয়স ছিল মাত্র নয় সপ্তাহ। তার মা-বাবা, ভাই সবাই পানিতে ডুবে মারা গেলেও অলৌকিকভাবে মিলডিনা বেঁচে গিয়েছিলেন এবং দীর্ঘ জীবনের পথ মাড়িয়ে তিনি মারা যান ২০০৯ সালের ৩১ মে। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে টাইটানিকের জীবিত অর্থাৎ উদ্ধার পাওয়া যাত্রীদের আর কেউই বেঁচে রইলেন না। তিনিই ছিলেন শেষ চিহ্ন। টাইটানিকে বরফখণ্ডের আঘাতের পর ডুবে যেতে সময় লেগেছিল আড়াই ঘণ্টার মতো। ১১টা ৪০ মিনিটে আঘাত লাগে, তারপর দুই অংশে বিভক্ত হয়ে সম্পূর্ণভাবে ডুবে যায় রাত দুইটা কুড়ি মিনিটে। সমুদ্রের যে স্থানে এই দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল, তা হলো গ্রেট ব্যাংকস অব নিউফাউন্ডল্যান্ড। সেখান থেকে দক্ষিণে দক্ষিণ-পূর্ব নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূলের প্রায় ৩৭০ মাইল দূরে এবং ১২ হাজার ৫০০ ফুট গভীরে দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজটি দুই খণ্ডে ভাগ হয়ে আজও তলিয়ে আছে।
টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট পরে ‘দ্য কারপাথিয়া’ নামক একটি জাহাজ দুর্ঘটনাকবলিত স্থানে এসে সমুদ্রে ভাসমান ৭০০ যাত্রীকে উদ্ধার করেছিল। তারপর ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এই ডুবে যাওয়া জাহাজের সন্ধান জানত না মানুষ। শেষ পর্যন্ত ৩৪ বছর ধরে গবেষণা শেষ করে এনেছিলেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফির কয়েকজন বিশেষজ্ঞ গবেষক। গবেষণাটি আমেরিকা ও ফরাসি গবেষকদের যৌথ প্রচেষ্টায় পরিচালিত হয়েছিল।
সেই গবেষণা থেকে সাগরের তলদেশে তলিয়ে থাকা টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের সন্ধান পায় মানুষ। ডুবন্ত জাহাজ থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র উদ্ধার করা গেলেও জাহাজটি তুলে আনা আর সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীদের অভিমত, ২০৩০ সালের পরে ডুবে যাওয়া টাইটানিকের আর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। বর্তমানে সেই ধ্বংসাবশেষ ইউনেসকোর উদ্যোগে সংরক্ষিত আছে। উল্লেখ্য, এই ঘটনাকে সম্বল করে জেমস ক্যামেরন যে কালজয়ী সিনেমা ‘টাইটানিক’ নির্মাণ করেছিলেন, তাতে ব্যবহার করা হয়েছিল তলিয়ে যাওয়া জাহাজের ধ্বংসাবশেষের ছবি। এসব ছবি ধারণ করার জন্য পরিচালক মোট ১২ বার সমুদ্রের তলদেশে গিয়েছিলেন। টাইটানিকের ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড স্মিথ ছিলেন একজন ব্রিটিশ রাজকীয় নৌ অফিসার। তিনি ইচ্ছা করলে লাইফবোটে উঠে নিজেকে বাঁচাতে পারতেন, কিন্তু সব দায় নিজের কাঁধে নিয়ে তিনিও ডুবন্ত টাইটানিকের মৃত্যুপথযাত্রীর তালিকায় নিজের নামটি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
সময় সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করে। চিরাচরিত এই কথাটি যে সব সময় সত্য হয়, সেটা যেমন সঠিক নয়, তেমনি হাজার বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও কোনো কোনো ঘটনার স্মৃতি কোনো কিছু দিয়েই মুছে ফেলা যায় না। টাইটানিক ট্র্যাজেডির স্মৃতি সেই রকম কালজয়ী এক ঘটনা, যা শতবর্ষ পার হয়ে যাওয়ার পরও মানুষকে স্মৃতিকাতর করে রাখে।
ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল। তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় ও আধুনিক জাহাজ টাইটানিক সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় একটি বরফখণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে প্রায় ১৫০০ যাত্রীসহ সলিলসমাধি ঘটেছিল।
জাহাজটিকে বলা হতো একটি ভাসমান রাজপ্রাসাদ। ৮৮২ ফুট ৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে জাহাজটির মোট আয়তন ছিল তিনটি বড় ফুটবল মাঠের সমান। বিলাসিতার দিক দিয়ে প্রথম শ্রেণির একটি হোটেলে যত ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকে, টাইটানিক জাহাজে তার সবকিছুই ছিল। নয়তলাবিশিষ্ট ওই জাহাজের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ১৭৫ ফুট। ওই জাহাজ প্রতিদিন ৮০০ টন কয়লা পোড়াত। আর প্রতি ঘণ্টায় তার গতিবেগ ছিল ২৪ নটিক্যাল মাইল বা ঘণ্টায় ২৭ মাইলের মতো। তিন হাজার শ্রমিকের দুই বছরের অক্লান্ত শ্রমে ওই জাহাজটি নির্মিত হয়েছিল। কথিত আছে, নির্মাণের সময়ে পাঁচজন শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছিল। আর টাইটানিকের নির্মাণব্যয় ছিল ৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার।
জাহাজের সব জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ১০ হাজার বাল্ব লাগানো ছিল। যাত্রী এবং ক্রুদের জন্য প্রতিদিন যে খাওয়ার পানির প্রয়োজন পড়ত, তা ছিল ১৪ হাজার গ্যালনের মতো। এ ছাড়া ছিল জাহাজের ভেতরে একটি সুইমিংপুল। একটি জিমনেসিয়াম, দুটি লাইব্রেরি এবং চুল কাটার জন্য দুটি সেলুন। আর ছিল ১৯টি ওয়াটার টাইট কম্পার্টমেন্ট। যাত্রীধারণক্ষমতা ছিল তিন হাজারের মতো। সব মিলিয়ে সেই সময়ে টাইটানিক জাহাজ নির্মাণে সর্বোচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছিল। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের দাবি ছিল এই জাহাজ কোনো কারণে এবং কোনো সময়েই ডোবার মতো কারণ ঘটবে না। একটা প্রচ্ছন্ন অহংকার জাহাজ কোম্পানির মালিকদের এতটাই অন্ধ করে রেখেছিল যে তারা জাহাজে কোনো লাইফবোট রাখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করতেন না। তবে এ-সংক্রান্ত বিষয়ে নিদেনপক্ষে সামান্য কয়েকটা লাইফবোট জাহাজে রাখার আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকায় মাত্র ২৪টি লাইফবোট তারা রেখেছিলেন। কিন্তু যখন বাড়তি লাইফবোটের প্রয়োজন পড়ল, তখন মাথা চাপড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না কর্তৃপক্ষের। ১৯০৭ সালে জাহাজটির নির্মাণকাজ শুরু করে টানা পাঁচ বছর কাজ চালিয়ে যাওয়ার পর ১৯১২ সালে এসে পূর্ণতা পায়। এই দায়িত্বে ছিল হল্যান্ডের (বর্তমানে নেদারল্যান্ডস) হোয়াইট স্টার লাইন নামের প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ মালিকানা ছিল ওই প্রতিষ্ঠানের। তবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ছিল হারল্যান্ড অ্যান্ড উলফ শিপ ইয়ার্ড, বেলফাস্ট।
টাইটানিক ছিল গ্রিক পুরাণের এক শক্তিশালী দেবতার নাম। সেই দেবতার নাম থেকে ‘টাইটানিক’ শব্দটির উৎপত্তি। পুরো নাম ছিল ‘আরএমএস টাইটানিক’। অর্থাৎ ‘রয়েল মেল স্টিমার টাইটানিক’।
মূলত ব্রিটিশ বিলাসবহুল যাত্রীবাহী লাইনার, যেটি ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল সাউদাম্পটন, ইংল্যান্ড থেকে রওনা হয়ে নিউইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিল। সেই যাত্রাপথে ক্যাপ্টেন জন স্মিথের নেতৃত্বে ৮৮৫ জন ক্রু জাহাজে আরোহণ করেছিলেন। সেই সময়ে যাত্রী ছিলেন প্রথম শ্রেণিতে ৩২৪ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২৮৪ জন আর তৃতীয় শ্রেণিতে ৭০৯ জন। মোট ১ হাজার ৩১৭ জন। অর্থাৎ ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল জাহাজটি। তারপর শেরবুর্গ থেকে ২৭৪ জন যাত্রী ওঠেন এবং আয়ারল্যান্ডের কর্ক পোতাশ্রয় থেকে জাহাজে ওঠেন দ্বিতীয় শ্রেণির আরও সাতজন যাত্রী এবং তৃতীয় শ্রেণির যাত্রী ওঠেন ১১৩ জন। সেই সময় ব্যয়বহুল প্রথম শ্রেণির প্যাকেজের দাম ছিল ৪ হাজার ৩৫০ ডলার, বর্তমান বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬৭ লাখ টাকারও বেশি।
ওই জাহাজের প্রথম শ্রেণিতে যাত্রী ধারণক্ষমতা ছিল ৭৩৯ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৬৭৪ জন এবং তৃতীয় শ্রেণিতে ১ হাজার ২০ জন। এ ছাড়া ক্রুসহ সর্বমোট তিন হাজারের মতো যাত্রী বহনের ক্ষমতাসম্পন্ন টাইটানিককে সেই সময়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জাহাজই শুধু বলা হতো না, এটাকে মনে করা হতো মর্ত্যরে সুন্দরতম ভাসমান প্রাসাদ।
পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ডুবে যাওয়ার পরের ইতিহাসে পৃথিবীতে অনেক ওলট-পালট ঘটেছে। টাইটানিকের চেয়েও আকারে বড় আরও অনেক জাহাজ পানিতে ভাসানো হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘সিম্ফনি অব দ্য সিজ’। এই ক্রুজ জাহাজটির যাত্রী ধারণক্ষমতা ছিল ৬ হাজার ৬৮০ জনের মতো।
‘হারমনি অব দ্য সিজ’ আরেকটি বৃহত্তম জাহাজ। ২০১২ সালে নির্মিত এই জাহাজের যাত্রী ধারণক্ষমতা সাত হাজারের মতো। এই জাহাজটি বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন প্রমোদতরী, যেটিকে ২০১৬ সালের ১০ মার্চ প্রথম সাগরে ভাসানো হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, টাইটানিকের চেয়ে কুড়ি গুণ বড়!
এ রকম আরও কয়েকটি বৃহৎ জাহাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আরএস কুইন, নরওয়েজিন ব্লিস, এমএসসি মেরাডিগলিয়া। ফ্রান্সের তৈরি এই জাহাজকে বলা হয় বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ ক্রুজ শিপ। জার্মানির তৈরি পঞ্চম বৃহত্তম জাহাজের নাম ‘এইডা আনোভা’। জাহাজটির যাত্রী ধারণক্ষমতা হচ্ছে ৬ হাজার ৬০০ জন। এ ছাড়া ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে এসএসসিতে বেলিসসিমো। পরের দিকে রয়েছে ব্রিটিশ ক্রুজ মেরি কুইন টু। এই নামে দুটি বৃহৎ জাহাজ থাকায় জাহাজটির নামের আগে ‘টু’ যুক্ত হয়েছে। মোটামুটিভাবে ১০টি জাহাজকে বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম জাহাজের মর্যাদা দেওয়া হলেও ১০০ বছর আগে টাইটানিকই ছিল একমাত্র জাহাজ, যেটি তার নান্দনিক সৌন্দর্য এবং বৃহৎ পরিসরের জন্য সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে এক অপার বিস্ময় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল।
প্রথম যেদিন পানিতে ভাসানো হয়েছিল, ওই দৃশ্য দেখার জন্য এক লাখ মানুষ সমুদ্রবন্দরে উপস্থিত হয়েছিল। পানিতে নামানোর আগে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিল, ‘সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে টাইটানিক এতটাই মজবুত করে বানানো হয়েছে যে স্বয়ং স্রষ্টা চাইলেও এর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না!’ মূলত এই অহংকারটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় টাইটানিকের জন্য। ১০ এপ্রিল, যেদিন সমুদ্রযাত্রার শুরু, সেই শুরুর সময়েই বড় একটা দুর্ঘটনার হাত থেকে অল্পের জন্য রেহাই পায় টাইটানিক। পশ্চিমমুখী সেই যাত্রা শুরুর সময়ে ‘এসএস সিটি অব নিউইয়র্ক’ নামক একটি জাহাজের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের হাত থেকে রক্ষা পায় মাত্র চার ফুট ব্যবধানের জন্য।
টাইটানিক জাহাজের ডুবে যাওয়ার পেছনে সমুদ্রে ভাসমান আইসবার্গকে দায়ী করা হয়েছিল। সেই আইসবার্গ বা ভাসমান বরফখণ্ডের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য হলো এই বরফখণ্ডগুলো কালচে ধরনের ছিল, অর্থাৎ সহসা দেখলে সমুদ্রের পানি থেকে আলাদা করা যায় না। আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো ওইসব বরফখণ্ডের আট ভাগের মধ্যে মাত্র এক ভাগ পানির উপরে থাকে, বাকি সাত ভাগ থাকে পানির নিচে। যার কারণে সহসা চোখে ধরা পড়ে না। তবে ১৪ এপ্রিল দুপুর দুইটার দিকে ‘আমেরিকা’ নামের একটি জাহাজ থেকে প্রথম এই আইসবার্গ সম্পর্কে রেডিও মারফত টাইটানিক জাহাজের রেডিও অপারেটরের কাছে একটি বার্তা পাঠানো হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে গবংধষবধ নামের একটি জাহাজ থেকে এ ধরনের আরও একটি সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছিল। ওই সময়ে টাইটানিকের রেডিও অপারেটর হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন জ্যাক ফিলিপস এবং হ্যারান্ড ব্রিজ নামের দুজন। তাদের দুজনের কাছেই এই সতর্কবার্তা গুরুত্বহীন মনে হয়েছিল। যেহেতু টাইটানিক হচ্ছে আনসিঙ্কেবল, অতএব বরফের চাঁইকে হার্মফুল মনে করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। তাই তারা বিষয়টি ক্যাপ্টেনের কানে তোলেননি। যে সময় দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল, তার ৪০ মিনিট আগে একইভাবে ‘ক্যালিফোর্নিয়া’ নামক আরও একটি জাহাজ ‘সামনে বড় একটি আইসবার্গ রয়েছে’, এই ধরনের বার্তা পাঠানোও একইভাবে টাইটানিকের রেডিও অপারেটরবৃন্দ সেই বার্তাকেও আমলে নিলেন না!
আসলে যে পানিপথ দিয়ে জাহাজটি যাত্রা শুরু করেছিল, সেদিকে এই ধরনের আইসবার্গ থাকার কথাও নয়। এ বিষয়ে টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিদেরা একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তাদের মতে, ওই হিমশিলা খণ্ডগুলো (আইসবার্গ) উত্তরের গ্রিনল্যান্ড থেকে এসেছিল। ওই সময়, অর্থাৎ ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জানুয়ারি ‘চাঁদ’ পৃথিবীর অত্যন্ত কাছে চলে এসেছিল। বিজ্ঞানীদের অভিমত হচ্ছে, এ ধরনের ঘটনা ঘটে সাধারণত ১৪০০ বছরের মধ্যে মাত্র একবার। সেই সময়ে আরও একটি ঘটনা ঘটেছিল, আর সেটা হলো সূর্যও তখন অন্য এক অবস্থানে চলে এসেছিল। যে কারণে সমুদ্রে এক অস্বাভাবিক মাত্রার জোয়ারের সৃষ্টি হয়েছিল, যে জোয়ারের টানে নিউফাউন্ডল্যান্ড এবং ল্যাব্রাডর থেকে পর্বত আকারের বহুসংখ্যক আইসবার্গ বা হিমশিলাখণ্ড আটলান্টিক সাগরের সমুদ্রগামী জাহাজের গতিপথে এসে বাধা সৃষ্টির নতুন এক ইতিহাসের জন্ম দেয়। যে ঘটনা ১৪০০ বছরে একবার ঘটে, সেই ঘটনাটা অলৌকিক এক শক্তি নিয়ে টাইটানিক নামক ‘আনসিঙ্কেবল’ এক জাহাজের গায়ে সামান্য আঘাত দিয়ে একেবারে ডুবিয়ে দিল। ইতিহাসের মোড় ঘোরানোর এমন এক প্রেক্ষাপটে স্বয়ং অদৃশ্য স্রষ্টা নিশ্চয় নীরবে হেসেছিলেন সে সময়! না হলে দুনিয়ায় এত বড় ঘটনা কী করেই-বা ঘটল?
যে আইসবার্গের সঙ্গে জাহাজের ধাক্কা লেগেছিল, সেই বরফখণ্ডটির রং ঠিক সাদা ছিল না। অনেকটা কালচে ভাবের হওয়ায় খুব কাছ থেকেও তা চোখে ধরা পড়েনি। এ ধরনের আইসবার্গকে আবার ‘ব্ল্যাকবার্গ’ও বলা হয়ে থাকে। ফলে যখন একেবারে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়ে পড়ে জাহাজটি, তখন আইসবার্গের সঙ্গে জাহাজের দূরত্ব মাত্র ৩৭ সেকেন্ডের। রাত তখন ১১টা ৪০ মিনিট। এই ৩৭ সেকেন্ডের দূরত্বে মৃত্যু দাঁড়িয়ে আছে সামনে।
বিষয়টা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করার পর টাইটানিকের ফার্স্ট অফিসার মুরডক জাহাজটি বামে মোড় ঘোরানোর নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন বন্ধ করারও নির্দেশ দিলেন। তখন বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গেছে, টাইটানিককে বাঁচানো আর সম্ভব নয়। কারণ ততক্ষণে জাহাজের ডান দিকে প্রচণ্ড এক ঘর্ষণের ফলে ৯০ মিটার অংশজুড়ে চিড় ধরে গেছে।
কথিত আছে, মোট ছয়বারের মতো ওই হিমশিলাখণ্ডের উপস্থিতি সম্পর্কে আটলান্টিকে ভাসমান বিভিন্ন জাহাজ থেকে সতর্কবার্তা পাঠালেও একটি বারের জন্যও টাইটানিকের রেডিও অপারেটরের মনে কোনো প্রশ্নের উদ্রেক করেনি। ফলে ক্যাপ্টেনের কাছে সেই সতর্কবার্তা সম্পর্কে জানানোরও কোনো গরজ অনুভব করেননি তারা। যদিও দুজন অপারেটর সে সময়ে দায়িত্ব পালনে ছিলেন। এমনকি একপর্যায়ে তারা ওয়্যারলেস বন্ধ করে ঘুমাতেও চলে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ বিষয়টার গুরুত্ব মোটেও বুঝতে পারেননি তারা। আর সত্য হলো বিষয়টাকে গুরুত্ব না দেওয়ার খেসারত দিতে হলো তিন হাজার মানুষকে।
এই টাইটানিকের বৈশিষ্ট্য ছিল, যদি কোনো দুর্ঘটনার কারণে জাহাজের ভেতরে পানি ঢুকে চারটি কম্পার্টমেন্টও জলপূর্ণ হয়ে পড়ে, তাহলেও সেই অবস্থাতেও জাহাজ ভাসমান থাকার ক্ষমতা ধরে রাখার কথা। কিন্তু বরফখণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যে ৯০ মিটার অংশজুড়ে চিড় ধরে গিয়েছিল, সেই চিড় ধরা অংশ দিয়ে বিপুল বেগে পানি প্রবেশ করার সেই সময়ে ছয়টি কম্পার্টমেন্ট জলপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ফলে এই বাড়তি ওজনের ধাক্কা বহনের শক্তি হারিয়ে জাহাজের সামনের অংশ ডুবতে থাকে।
এ ছাড়া জল প্রতিরোধের জন্য যে ১২টি গেট ছিল, প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা লাগায় তার সবগুলো ভেঙে পড়েছিল সেই সময়। এসব ঘটনার পরপর লাইফবোটগুলো পানিতে নামানো শুরু হয়ে যায়। যদিও টাইটানিকের ৬৪টি লাইফবোট বহনের ক্ষমতা ছিল এবং ৬৪টি লাইফবোট থাকলে চার হাজারের মতো মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হতো। কিন্তু জাহাজে ছিল মাত্র ২৪টি লাইফবোট। যে কারণে মোট যাত্রীসংখ্যার ৩৩ শতাংশ বহন করতে পেরেছিল ওই লাইফবোটগুলো। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো, মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়েও জাহাজ কর্তৃপক্ষের মনে শ্রেণিবৈষম্যের বিষয়টি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল তখন, অর্থাৎ লাইফবোটে ওঠার ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির যাত্রীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে, এ ক্ষেত্রে শিশুদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই শিশুদের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণির শিশুরা এক মর্মান্তিক বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়েছিল সেই সময়ে। তখন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির প্রায় সব শিশুকে লাইফবোটে তোলা হলেও তৃতীয় শ্রেণিতে ওই সময়ে ছিল ৭৬ জন শিশু, তার মধ্যে মাত্র ২৩ জনকে লাইফবোটে তোলা হয়েছিল, বাকি ৬০ শতাংশ শিশুর সলিলসমাধি ঘটেছিল।
এ রকম এক তেরো মাস বয়সী মেয়ে ‘ইনো’কে সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করেছিল ‘ম্যাকে বেনেটের’ (উদ্ধারকারী জাহাজ) নাবিকেরা। পশমি জ্যাকেট পরা এ শিশুটির মরদেহ উদ্ধারের পর জীবিত যাত্রীদের মধ্য থেকে কাউকেই তার স্বজন হিসেবে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি বলে অচেনা এক শিশুর তকমা নিয়ে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে লেকহেড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের চেষ্টায় যখন আরও অনেক মরদেহের হাড়গোড়ের ডিএনএ টেস্ট করা হয়েছিল, সেই সময়ে ইনোর পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। মেয়েটির সঙ্গে তার বাবা-মা ছাড়াও ছিল আরও চারটা ভাই, কিন্তু সেই সময়ে ইনো ছাড়া আর কারও মরদেহের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ওই পরিবারটি ফিনল্যান্ডের অধিবাসী। এ ধরনের আরও একটি কষ্টকর স্মৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল মানুষের। জাহাজডুবির প্রায় বছর পরে ১৯১৫ সালের গ্রীষ্মের এক প্রহরে ডানকেটল সৈকতের কাছে কুকুর নিয়ে হাঁটার সময় এক পর্যটকের দৃষ্টিতে পড়ে একটি ছিপি আঁটা বোতলের।
বোতলটির ভেতরে একটি চিরকুট পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে লেখা ছিল- ‘১৩/৪/১৯১২। টাইটানিক থেকে। সকলকে বিদায়’। গ্লেনমায়ারের বার্কদের কর্ক। জেরেস বার্ক নামের একটি বালকের জন্ম কর্ক সিটির কাছাকাছি গ্লেনমায়ারে। তার বোন (বড়) টাইটানিকের উদ্বোধনী জাহাজের একটি টিকিট কেটে দিয়েছিলেন ভাইকে। তার খুব শখ ছিল আমেরিকায় যাওয়ার। সেই জেরেস বার্কের কাছে মৃত্যু যখন নিকটবর্তী, তখন সে একটি কাগজে সকলকে বিদায় অভিবাদন জানিয়েছিল। লিখতে গিয়ে তারিখটা ভুল লিখেছিল, ওই দিন ছিল ১৪ এপ্রিল। ১৩ এপ্রিল ছিল না। হয়তো অসাবধানতাবশত লিখেছিল ১৩ তারিখের কথা। তবে মর্মান্তিক সত্য হলো প্রায় তিন হাজার মাইল পরিভ্রমণ শেষ করে বোতলটি জেরেসের জন্মস্থান কর্ক বন্দরে এসে নোঙর ফেলেছিল। জেরেসের মা তখনো জীবিত ছিলেন। তার কাছে সেই বোতলটি পৌঁছেছিল এবং তিনি শেষ পর্যন্ত নিখোঁজ হওয়া ছেলের খবর জেনে যেতে পেরেছিলেন। জাহাজ ডোবার সময়ে ৮৮৫ জন ক্রু ছাড়াও যাত্রী ছিলেন ২ হাজার ২২৩ জন। এই তিন হাজার মানুষের মধ্যে বেঁচে ছিলেন মাত্র ৭০৬ জন এবং সলিলসমাধি ঘটেছিল ১ হাজার ৫০০ জনের। বাকিরা রইলেন নিখোঁজের তালিকায়। তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীদের ক্ষতির পরিমাণটা ছিল বেশি। ওই তৃতীয় শ্রেণিতে যাত্রীসংখ্যা ছিল ৭১০ কিন্তু এদের মধ্যে বেঁচেছিলেন মাত্র ১৭৪ জন। এটাও ছিল শ্রেণিবৈষম্যের আরেকটা রূপ। এমনিতেই লাইফবোটের সংখ্যা ছিল কম। তার পরও যা-ও ছিল, সেসব লাইফবোটে স্থান সংকুলানের অজুহাতে তাদের আর জায়গা হয়নি। বেশির ভাগ মানুষ মারা গিয়েছিল প্রচণ্ড ঠান্ডার কারণে। তখন সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা ছিল ২৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা মাইনাস দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। এই তাপমাত্রায় মানুষ খুব বেশি সময় টিকে থাকতে পারে না।
এই ভয়াবহ অবস্থার সময়েও বর্ণবিদ্বেষের শিকারে পরিণত হয়েছেন পৃথিবীর কিছু অঞ্চলের মানুষ। যেমন টাইটানিকের বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের সঙ্গে ছয়জন চীনা নাগরিক অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলে তাদেরকে নিউইয়র্কের এলিস আইল্যান্ডের অভিবাসন অফিসে নিয়ে আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদেরকে আমেরিকা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়ে আমেরিকান নাগরিকত্ব আইনে চীনাদের প্রবেশাধিকার ছিল না। এ ঘটনার ১০৯ বছর পরে ওই ছয়জন চীনা নাগরিককে নিয়ে চায়নাতে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত ও জনসম্মুখে প্রদর্শিত হয়েছিল, সেখানে ওই ঘটনার বিশদ বিবরণ ছিল। টাইটানিক দুর্ঘটনায় অনেকের সঙ্গে মারা গিয়েছিলেন আমেরিকান এক বড় ব্যবসায়ী অস্কার হলভারসন। তিনি ও তার স্ত্রী সাউদাম্পটন থেকে জাহাজে উঠেছিলেন নিউইয়র্কে যাওয়ার উদ্দেশে। জাহাজডুবির আগের দিন তিনি তার মায়ের কাছে একটা চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে টাইটানিক সম্পর্কে অনেক কথা বলা ছাড়াও বিশেষ বিশেষ যাত্রীদের সম্পর্কেও বর্ণনা ছিল। অস্কার হলভারসন পানিতে ডুবে মারা গেলেও সেই চিঠিটা পাওয়া গিয়েছিল তার বুকপকেটে। সেই চিঠিটা অবশ্য তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। সাগরের নোনা জলে ভিজলেও চিঠির কাগজ অক্ষত ছিল।
শেষ পর্যন্ত সেই চিঠিটা তার মায়ের মৃত্যুর পরে নিলামে তোলা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্রিটিশ ক্রেতা, যার নেশাই ছিল অভিনব কিছু সংগ্রহে রাখা, চিঠিটা কিনেছিলেন ১২৬ হাজার ডলার মূল্যে। টাইটানিকে বসে পরিবারের কাছে যাত্রীদের লেখা চিঠির মধ্যে সর্বশেষ এই চিঠিটা নিলামে রেকর্ড দামে বিক্রি হয়েছিল।
উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বন্দর থেকে টাইটানিক তার যাত্রা শুরু করেছিল। সেই জাহাজের ক্রুদের মধ্যে প্রায় সবাই (বেশির ভাগ) ছিলেন সাউদাম্পটনের নাগরিক। সেই ঘটনার পরে শত বছর পার হলেও সেই শহরটি নানাভাবে তার হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের মনে করে থাকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-সেই শহরে ‘সি সিটি মিউজিয়াম’ নির্মাণের পরে সেখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ডুবন্ত জাহাজ থেকে উদ্ধার করে আনা নানা সামগ্রী। জাহাজের ক্যান্টেন ছাড়াও সব ক্রুর ছবি।
টাইটানিক থেকে উদ্ধার পাওয়া সবচেয়ে ছোট শিশু ছিল মিলডিনা ডিন। সেই সময়ে তার বয়স ছিল মাত্র নয় সপ্তাহ। তার মা-বাবা, ভাই সবাই পানিতে ডুবে মারা গেলেও অলৌকিকভাবে মিলডিনা বেঁচে গিয়েছিলেন এবং দীর্ঘ জীবনের পথ মাড়িয়ে তিনি মারা যান ২০০৯ সালের ৩১ মে। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে টাইটানিকের জীবিত অর্থাৎ উদ্ধার পাওয়া যাত্রীদের আর কেউই বেঁচে রইলেন না। তিনিই ছিলেন শেষ চিহ্ন। টাইটানিকে বরফখণ্ডের আঘাতের পর ডুবে যেতে সময় লেগেছিল আড়াই ঘণ্টার মতো। ১১টা ৪০ মিনিটে আঘাত লাগে, তারপর দুই অংশে বিভক্ত হয়ে সম্পূর্ণভাবে ডুবে যায় রাত দুইটা কুড়ি মিনিটে। সমুদ্রের যে স্থানে এই দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল, তা হলো গ্রেট ব্যাংকস অব নিউফাউন্ডল্যান্ড। সেখান থেকে দক্ষিণে দক্ষিণ-পূর্ব নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূলের প্রায় ৩৭০ মাইল দূরে এবং ১২ হাজার ৫০০ ফুট গভীরে দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজটি দুই খণ্ডে ভাগ হয়ে আজও তলিয়ে আছে।
টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট পরে ‘দ্য কারপাথিয়া’ নামক একটি জাহাজ দুর্ঘটনাকবলিত স্থানে এসে সমুদ্রে ভাসমান ৭০০ যাত্রীকে উদ্ধার করেছিল। তারপর ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এই ডুবে যাওয়া জাহাজের সন্ধান জানত না মানুষ। শেষ পর্যন্ত ৩৪ বছর ধরে গবেষণা শেষ করে এনেছিলেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফির কয়েকজন বিশেষজ্ঞ গবেষক। গবেষণাটি আমেরিকা ও ফরাসি গবেষকদের যৌথ প্রচেষ্টায় পরিচালিত হয়েছিল।
সেই গবেষণা থেকে সাগরের তলদেশে তলিয়ে থাকা টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের সন্ধান পায় মানুষ। ডুবন্ত জাহাজ থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র উদ্ধার করা গেলেও জাহাজটি তুলে আনা আর সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীদের অভিমত, ২০৩০ সালের পরে ডুবে যাওয়া টাইটানিকের আর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। বর্তমানে সেই ধ্বংসাবশেষ ইউনেসকোর উদ্যোগে সংরক্ষিত আছে। উল্লেখ্য, এই ঘটনাকে সম্বল করে জেমস ক্যামেরন যে কালজয়ী সিনেমা ‘টাইটানিক’ নির্মাণ করেছিলেন, তাতে ব্যবহার করা হয়েছিল তলিয়ে যাওয়া জাহাজের ধ্বংসাবশেষের ছবি। এসব ছবি ধারণ করার জন্য পরিচালক মোট ১২ বার সমুদ্রের তলদেশে গিয়েছিলেন। টাইটানিকের ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড স্মিথ ছিলেন একজন ব্রিটিশ রাজকীয় নৌ অফিসার। তিনি ইচ্ছা করলে লাইফবোটে উঠে নিজেকে বাঁচাতে পারতেন, কিন্তু সব দায় নিজের কাঁধে নিয়ে তিনিও ডুবন্ত টাইটানিকের মৃত্যুপথযাত্রীর তালিকায় নিজের নামটি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।