শেফালী আমার গৃহপরিচারিকা। আমার তিন বছরের মেয়েকে এতটা বেশি আদর করে যে, ওর আদরের ধরন দেখে তাকে কী বলা যায়, আমি বুঝে উঠতে পারি না। কত বোঝাতে চেষ্টা করি, কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। একদিন বলা নেই, কওয়া নেই, আমার আলমারি থেকে তিন-চারটি কাতান শাড়ি, আমার স্বামীর কালো স্যুট-প্যান্ট নামিয়ে সাবান গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলল আর দিব্যি মনে রৌদ্রে শুকোতে দিল। কাজ থেকে বাসায় ফিরে আসার পর তার কীর্তি দেখে আমার নিজেকেই ভারসাম্যহীন মনে হলো!
জানতে চাইলাম, শেফালী, কেন এমনটি করলে?
সহজ-সরল উত্তর-এসব ময়লা কাপড় আপনারা কেমনে পিনবেন?
বুঝলাম শেফালীর মাথায় ভালো সমস্যা আছে। তাকে আমার মেয়ের দেখাশোনার ভারটা দেওয়া সমীচীন মনে হলো না। কথার ফাঁকে জানতে পারলাম, জন্মের সময়ই শেফালীর মেয়েটিকে মৃত ঘোষণা করা হয়, আর সেই থেকেই সে অস্বাভাবিক। শেফালীকে উপায়ান্তর না দেখে বিদায় দিতেই হলো। তার করুণ কাতর কণ্ঠও আমাকে স্পর্শ করল না।
সে বুঝতে পেরেছে, আমার মেয়েকে দেখাশোনার উন্মুক্ত উচ্ছ্বাস চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে। বাসা বদল করে অন্য বাসায় চলে এলাম। সে ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করল। হাতে বিস্কুট।
এমনটি কেন করো শেফালী? চঞ্চল চোখ, দুটি হাত দিয়ে আমার মেয়ের ওপর ইশারা করল।
মাস ছয়েক পরে আবার আবির্ভাব। খুবই কালো মুখ। আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না।
আমি আবার কাম করমু। ছোট মাইয়াডার দেখাশোনা করমু।
মায়া পড়ে গেল-ঠিক আছে। তবে তোমাকে বুঝেশুনে কাজ করতে হবে, পারবে তো?
প্রবল উৎসাহ নিয়ে আমার মেয়ে সারার ওপর তার দৃষ্টি, আমাকে অভয় দিল-পাইরমু। হাতে সেই চিরপরিচিত লজেন্স আর বিস্কুট।
নতুন শাড়ি কিনে আনলাম, শেফালীর চঞ্চলতাকে থামিয়ে দিলাম।
অন্ধকার তখনো ঘোচেনি। শেফালী ডাকছে, কী ব্যাপার? সে কিছুই খেতে পারছে না। প্রতিবেশী ডাক্তার ভাইকে দেখালাম। শেফালীর তীব্র জন্ডিস। বাধ্য হয়ে তাকে আর রাখতে পারলাম না। সাধ্যমতো খুশি করেই বিদায় দিতে হলো। কিছুটা সময় বাদেই আবার আমার দরজায় দাঁড়িয়ে, হাতে সেই লজেন্স-বিস্কুট।
কী করে এই পাগলিকে বোঝাই তোমার জন্ডিস হয়েছে, আমার পক্ষে এই মুহূর্তে এটা নেওয়া সম্ভব নয়।
শেফালী বাড়ি যাও! তোমার বিশ্রাম দরকার। জগতের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা সব সাথি করে যাত্রা শুরু করল। যত দূর চোখ দেখা যায়, দেখতে পেলামÑক্ষীণ-জীর্ণ দুটি হাত, আর সেই বিস্কুট!
রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী উপন্যাস ‘কাবুলিওয়ালা’র কথা মনে পড়ে গেল।
আসলে কাবুলিওয়ালার রহমতরা কখনোই মরে না। কত সুখ-দুঃখ জড়িয়ে ছুটে চলেছে। কেউবা গৃহহারা। পার্থক্য শুধু ভিন্ন দেশ, ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন রূপ আর ভিন্ন সময়ের প্রেক্ষাপট।
আমাদের সমাজে কাবুলিওয়ালা রহমতরা পেয়ে না পেয়ে, খেয়ে না খেয়ে এভাবেই বেঁচে থাকে।
হায়রে স্নেহ-ভালোবাসা, যাকে যুক্তি দিয়ে দেখার সুযোগ নেই।
প্রত্যেক মানুষের জীবনে প্রকাণ্ড এক জগৎ গোপনে লুক্কায়িত থাকে। তার হাসি-কান্না, মায়া-মমতা, ভালোবাসার পেছনে থাকে সূক্ষ্ম অনুভূতি, যাকে নিজের ওজনে মাপা যায় না।
লেখক : ফরমার অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
জানতে চাইলাম, শেফালী, কেন এমনটি করলে?
সহজ-সরল উত্তর-এসব ময়লা কাপড় আপনারা কেমনে পিনবেন?
বুঝলাম শেফালীর মাথায় ভালো সমস্যা আছে। তাকে আমার মেয়ের দেখাশোনার ভারটা দেওয়া সমীচীন মনে হলো না। কথার ফাঁকে জানতে পারলাম, জন্মের সময়ই শেফালীর মেয়েটিকে মৃত ঘোষণা করা হয়, আর সেই থেকেই সে অস্বাভাবিক। শেফালীকে উপায়ান্তর না দেখে বিদায় দিতেই হলো। তার করুণ কাতর কণ্ঠও আমাকে স্পর্শ করল না।
সে বুঝতে পেরেছে, আমার মেয়েকে দেখাশোনার উন্মুক্ত উচ্ছ্বাস চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে। বাসা বদল করে অন্য বাসায় চলে এলাম। সে ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করল। হাতে বিস্কুট।
এমনটি কেন করো শেফালী? চঞ্চল চোখ, দুটি হাত দিয়ে আমার মেয়ের ওপর ইশারা করল।
মাস ছয়েক পরে আবার আবির্ভাব। খুবই কালো মুখ। আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না।
আমি আবার কাম করমু। ছোট মাইয়াডার দেখাশোনা করমু।
মায়া পড়ে গেল-ঠিক আছে। তবে তোমাকে বুঝেশুনে কাজ করতে হবে, পারবে তো?
প্রবল উৎসাহ নিয়ে আমার মেয়ে সারার ওপর তার দৃষ্টি, আমাকে অভয় দিল-পাইরমু। হাতে সেই চিরপরিচিত লজেন্স আর বিস্কুট।
নতুন শাড়ি কিনে আনলাম, শেফালীর চঞ্চলতাকে থামিয়ে দিলাম।
অন্ধকার তখনো ঘোচেনি। শেফালী ডাকছে, কী ব্যাপার? সে কিছুই খেতে পারছে না। প্রতিবেশী ডাক্তার ভাইকে দেখালাম। শেফালীর তীব্র জন্ডিস। বাধ্য হয়ে তাকে আর রাখতে পারলাম না। সাধ্যমতো খুশি করেই বিদায় দিতে হলো। কিছুটা সময় বাদেই আবার আমার দরজায় দাঁড়িয়ে, হাতে সেই লজেন্স-বিস্কুট।
কী করে এই পাগলিকে বোঝাই তোমার জন্ডিস হয়েছে, আমার পক্ষে এই মুহূর্তে এটা নেওয়া সম্ভব নয়।
শেফালী বাড়ি যাও! তোমার বিশ্রাম দরকার। জগতের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা সব সাথি করে যাত্রা শুরু করল। যত দূর চোখ দেখা যায়, দেখতে পেলামÑক্ষীণ-জীর্ণ দুটি হাত, আর সেই বিস্কুট!
রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী উপন্যাস ‘কাবুলিওয়ালা’র কথা মনে পড়ে গেল।
আসলে কাবুলিওয়ালার রহমতরা কখনোই মরে না। কত সুখ-দুঃখ জড়িয়ে ছুটে চলেছে। কেউবা গৃহহারা। পার্থক্য শুধু ভিন্ন দেশ, ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন রূপ আর ভিন্ন সময়ের প্রেক্ষাপট।
আমাদের সমাজে কাবুলিওয়ালা রহমতরা পেয়ে না পেয়ে, খেয়ে না খেয়ে এভাবেই বেঁচে থাকে।
হায়রে স্নেহ-ভালোবাসা, যাকে যুক্তি দিয়ে দেখার সুযোগ নেই।
প্রত্যেক মানুষের জীবনে প্রকাণ্ড এক জগৎ গোপনে লুক্কায়িত থাকে। তার হাসি-কান্না, মায়া-মমতা, ভালোবাসার পেছনে থাকে সূক্ষ্ম অনুভূতি, যাকে নিজের ওজনে মাপা যায় না।
লেখক : ফরমার অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।