মুহম্মদ শামসুল হক
মুসলমানদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) এর অবিস্মরণীয় ত্যাগের স্মৃতিবিজড়িত এবং পরম করুণাময় আল্লাহর রহমতসিক্ত পবিত্র ঈদুল আজহা আবারও বিশ্ব মুসলিমের সামনে উপস্থিত। নবতিপর বৃদ্ধ নবী হজরত ইবরাহিম (আ.) এর অনন্য আত্মাহুতির দীক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুসলমানরাও একমাত্র বিশ্ব প্রতিপালকের সন্তুষ্টি বিধানার্থেই আজ ২৮ জুন বুধবার পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্্যাপন এবং কোরবানি আদায় করছেন। মূলত পৌত্তলিকতার সমূল উৎপাটন এবং আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পৌত্তলিক আজরের সন্তান ইবরাহিম কৈশোরে পিতৃগৃহ থেকে বিতাড়িত, যৌবনে খোদাদ্রোহী বাদশাহ নমরুদ কর্তৃক প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত এবং জীবনসায়াহ্নে নিজের অন্ধের যষ্ঠি পুত্র ইসমাইলের গলায় শাণিত ছোরা চালানোর চরম অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খলিলুল্লাহ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। আর হজরত ইবরাহিমের (আ.) সেই অবিস্মরণীয় ত্যাগের স্মৃতির প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা নিবেদনার্থে প্রতিবছর ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে ঈদুল আজহার সালাত শেষে শান্তির ধর্ম ইসলামের আর্থিকভাবে সচ্ছল অনুসারীরা নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থে কেনা পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। প্রকৃত প্রস্তাবে কোরবানির পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে মুসলমানরা রাব্বুল আল আমিনের সঙ্গে নতুনভাবে ওয়াদাবদ্ধ হন, পাপ-পঙ্কিলতার কবল থেকে ইমানকে রক্ষার ও হৃদয়ের পাশবিক প্রবৃত্তিকে জবাই করার সংকল্প গ্রহণ করেন। সামর্থ্য অনুযায়ী হালাল অর্থে কেনা মোটাতাজা পশুর গলায় ছুরি চালনাকালে তারা হৃদয় নিংড়ানো ভক্তি ও প্রগাঢ় শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করেন : হে আল্লাহ! তোমার সন্তুষ্টির খাতিরে যেভাবে আমরা পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে রক্ত প্রবাহিত করছি, প্রয়োজনে তেমনিভাবে আমরা নিজেদের রক্ত প্রবাহিত করতে ও আত্মাহুতি দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হব না।
যাহোক, করোনার দগদগে ক্ষত, স্বজন হারানোর মর্মবেদনা, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি, আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতার বাড়াবাড়ি, বাড়ি ভাড়ার দৌরাত্ম্য, ছাত্রঋণের প্রতি মাসে গড়ে বাধ্যতামূলক ১৬০ ডলার কিস্তি পরিশোধ, স্বদেশে ও প্রবাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংসার ভাঙার প্রবণতা, সামাজিক বিভেদ-বৈষম্য-বিভক্তি, ঘৃণ্য প্রতিহিংসা ইত্যাদিকে বুকে চাপা দিয়েই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুসলমানরা পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্্যাপন করছেন। বর্তমান বিশ্বের সিংহভাগ মুসলমানই একমাত্র বিশ্ব প্রতিপালকের অপরিসীম রহমত লাভের আশায়ই কোরবানি উপলক্ষে নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ ও সময় ব্যয়ে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করছেন না। তাই পবিত্র ঈদুল আজহা এবং কোরবানি উপলক্ষে করজোড়ে কামনা করছি : হে বিশ্ববিধাতা, তুমি আমাদের যাবতীয় অপরাধ মার্জনা করো, আমাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করো, পরচর্চা, হিংসা-বিদ্বেষ-পশুত্ববোধের অভিশাপ থেকে আমাদের মুক্তি দাও এবং আমাদের অন্তরে মনুষ্যত্ব ও সৌভ্রাতৃত্ববোধের উন্মেষ ঘটাও। বিশ্ব মুসলিমের অজানা নয় যে, ইসলামি মূল্যবোধের উন্মেষ, মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ জোরদার, মানব হিতে জীবন উৎসর্গ, জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণ লাভের আশায় আল্লাহর রহমত ভিক্ষার শাশ্বত আবেদন এবং হজরত ইবরাহিম (আ.) এর আত্মত্যাগের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত সমভিব্যাহারে প্রতিবছর ১০ জিলহজ আগমন ঘটে মুসলমানদের দ্বিতীয় জাতীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহার। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই আজ ২৮ জুন বুধবার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুসলমানরা পবিত্র ঈদুল আজহার সালাত শেষে কোরবানি সম্পন্ন করছেন। বস্তুত, হাসি-আনন্দ-খুশির বার্তা ছাড়াও স্বার্থের ঘেরাটোপে আচ্ছাদিত বর্তমানের চরম অবক্ষয়ের জমানায় বিশ্ব মুসলিমের নিকট পবিত্র ঈদুল আজহার আবেদনের পরিধিও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অতীতকে ভুলে যাওয়া, পরস্পরকে ক্ষমা করে দেওয়া, মানব চরিত্রের পাশবিক প্রবৃত্তিরাজিকে কোরবানি দেওয়া, জীবনাচরণে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনয়ন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় বজ্রকঠোর সংকল্প গ্রহণÑপবিত্র ঈদুল আজহার ইত্যাদি শাশ্বত আবেদনের সঙ্গে দানবীয় শক্তির বিনাশও বর্তমানে সংযুক্ত হয়েছে। অনবদ্য কারণে হজরত ইবরাহিম (আ.) এর আমলে প্রবর্তিত প্রথা অনুযায়ী ঈদুল আজহার সালাত, খুতবা ও মোনাজাত শেষে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে আমরা অতীতের যাবতীয় হিংসা-বিদ্বেষ-মনোমালিন্য ভুলে গিয়ে পরস্পরকে উষ্ণ আলিঙ্গনে বুকে জড়িয়ে ধরব। আর পবিত্র ঈদের সুমহান দীক্ষা সারা বছর ব্যক্তিগত জীবনে অনুশীলনে নতুনভাবে ওয়াদাবদ্ধ হব ইনশা আল্লাহ।
আমাদের দ্বিতীয় জাতীয় উৎসব ঈদুল আজহা : ধনী-নির্ধন প্রত্যেক মুসলমানের জীবনে ঈদুল আজহার আগমন ঘটে মহান আল্লাহর অপরিসীম রহমত লাভ এবং হজরত ইবরাহিম খলিলুল্লাহর সুমহান আত্মত্যাগের অনুসরণ ও পার্থিব আনন্দ-উচ্ছ্বাসের বার্তা নিয়ে। তবে বিয়োগব্যথাসহ জাগতিক বিভিন্ন কারণে ব্যক্তিগত ও পরিবার বিশেষের জীবনে ঈদের আনন্দ-আবেদনে যথেষ্ট গরমিল পরিলক্ষিত হয়। বিরহব্যথা, হাসি-আনন্দে ভরপুর এই বিশ্বচরাচরে প্রতিটি ঈদেই পরিবারের সদস্য কিংবা ঘনিষ্ঠজনদের বিয়োগব্যথা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে যায় ভুক্তভোগীদের মানসপটে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, অবিমিশ্র আনন্দ এই মাটির পৃথিবীতে পাওয়া যায় না। তিক্ততার স্বাদ আছে বলেই তো আনন্দ এত মধুর। তাই বিরহ-বেদনার অন্তর্জ্বালাকে বুকে চেপে ধরে এবং মহান আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় সিদ্ধান্তের সঙ্গে মতৈক্য প্রকাশ করেই প্রতিবছরের মতো এবারও ইবরাহিমি ত্যাগ-তিতিক্ষায় উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত হয়ে পবিত্র ঈদুল আজহাকে হাসিমুখে বরণ করা আমাদের ইমানি দায়িত্ব। পবিত্র কোরআনের ভাষায় : কুল্লু নাফসীন জায়িকাতুল মাউত (প্রত্যেক মানুষকে অবশ্যই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে) এবং আলহামদুলিল্লাহে আলা’ কুল্লে হালীন (প্রত্যেক অবস্থাতেই আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করো)। মুসলমানরা কায়মনোবাক্যে স্বীকার করেন যে জন্ম ও মৃত্যুর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তদাতা এবং একচ্ছত্র অধিপতি বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা। তাই মুসলমান হিসেবে আমাদের অবশ্যই যাবতীয় আনন্দে আলহামদুলিল্লাহ উচ্চারণ করে শুকরিয়া আদায় এবং সামগ্রিক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন উচ্চারণ করে আল্লাহর অভিপ্রায়ের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে হবে।
স্মর্তব্য, আরবি ভাষা থেকে উদ্ভূত ঈদের শাব্দিক অর্থ আনন্দ বা উৎসব। ঈদের দিবসটি হচ্ছে আরব-অনারব, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, বর্ণ-গোত্র, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে বিশ্ব মুসলিমের জাতীয় খুশি বা আনন্দের দিন। এ বিশেষ দিবসে বিত্তশালী মুসলমানদের গগনচুম্বী হর্ম থেকে হতদরিদ্র মুসলমানদের জীর্ণ কুটিরেও খুশি বয়ে যায়। এরই পটভূমিতে ঈদের দিবসকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর জাতীয় আনন্দ দিবস অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব উৎসবের দিন রয়েছে। আর আমাদের উৎসব হচ্ছে ঈদ (বুখারি ও মুসলিম)। জিলহজ মাসের দশম তারিখে গোটা বিশ্বের মুসলিম জনতা ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে এবং নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী নানা আয়োজনে ঈদুল আজহা উদ্্যাপন করে থাকেন। পবিত্র ঈদুল আজহার সঙ্গে নবতিপর বৃদ্ধ হজরত ইবরাহিমের (আ.) একমাত্র পুত্র ইসমাইলের (আ.) গলায় ছুরি চালিয়ে বিশ্ববিধাতার স্বপ্নাদেশ বাস্তবায়নের অবিনশ্বর স্মৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে বিজড়িত। একমাত্র মহান আল্লাহর নির্দেশেই অশীতিপর বৃদ্ধ হজরত ইবরাহিম (আ.) সবেধন নীলমণি পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) এবং পলিতকেশ স্ত্রী বিবি হাজেরাকে জনমানবশূন্য ঊষর মক্কায় নির্বাসিত করেছিলেন। আবার স্বপ্নযোগে কোরবানির আদেশ লাভের পর উপর্যুপরি তিন দিনে ৩০০ দুম্বা বা উট কোরবানি করেও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ব্যর্থ হলেন। পরিশেষে সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু কোরবানির প্রশ্নে ধ্যানমগ্ন ইবরাহিম (আ.) বুকের ওপর পাথরচাপা দিয়ে প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) কে কোরবানি দেওয়ার চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং আল্লাহ সন্তুষ্টির খাতিরে মানবসভ্যতার ইতিহাসে আত্মত্যাগের সর্বাপেক্ষা নজিরবিহীন অধ্যায়ের সংযোজন করলেন। আবার স্বপ্নাদেশ কার্যকরের পূর্বে পুত্রবৎসল পিতা ইবরাহিম (আ.) কিশোর পুত্র ইসমাইলের (আ.) সম্মতি নিয়েছিলেন। অতঃপর ইবরাহিম (আ.) জাগতিক যাবতীয় স্নেহবন্ধন ছিন্ন করে হাত-পা বাঁধা পুত্র ইসমাইলের (আ.) গলদেশে শাণিত ছুরি চালালেন। কিন্তু বিশ্ব প্রতিপালকের অদৃশ্য ইঙ্গিতে ইসমাইল (আ.) এর স্থলে একটি স্বর্গীয় দুম্বা জবাই হয়ে গেল এবং হজরত ইবরাহিম (আ.) চরম আত্মত্যাগের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খলিলুল্লাহ উপাধিতে ভূষিত হলেন। অন্যদিকে আল্লাহর অভিপ্রায়ের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশকারী শিশু ইসমাইলও (আ.) শাণিত কৃপাণের তলদেশ থেকে অক্ষত অবস্থায় রক্ষা পেলেন এবং জবিউল্লাহ খেতাবপ্রাপ্ত হলেন। সেই অবিস্মরণীয় আত্মোৎসর্গের অনুসরণেই একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই মুসলিম উম্মাহ প্রতিবছর পশু কোরবানি করেন।
উল্লেখ্য, ইবরাহিমি কোরবানি-ব্যবস্থা চালু হওয়ার পূর্বে হজরত আদম (আ.) এর পুত্র কাবিল নিজের পরমা সুন্দরী ভগ্নি আকলিমাকে এবং অপর পুত্র হাবিলও আকলিমাকে বিয়ে করার প্রশ্নে কোরবানি দিয়েছিলেন। কিন্তু কাবিলের কোরবানি গৃহীত না হওয়ায় ক্রোধের বশে সে হাবিলকে খুন করে মানুষ খুনের প্রথম ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য বিশ্ব মুসলিম হজরত ইবরাহিম (আ.) এর অনুসরণেই প্রতিবছর ১০ জিলহজ কোরবানি দিয়ে থাকেন। অবস্থাপন্ন প্রত্যেক মুসলমানের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। হালাল উপায়ে অর্জিত অর্থের সাহায্যে একাগ্রচিত্তে কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অতুলনীয় পুণ্য হাসিল করা যায়। কোরবানির মাধ্যমে বিশ্ব প্রতিপালকের রহমতপ্রত্যাশী মুসলিম জনগোষ্ঠী ইমান ও তাকওয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে থাকেন। বিশ্ব প্রতিপালক বলেন, আল্লাহর নিকট সেগুলোর (কোরবানির পশুর) গোশত এবং রক্ত পৌঁছায় না, পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া (সুরা হাজ : ৩৭)। বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, কোরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা কবুল হয়ে যায় (তিরমিজি)। হজরত মোহাম্মদ (সা.) আরও বলেছেন, কোরবানির পশুর প্রতিটি পশম বা লোমের জন্য একটি করে সাওয়াব পাওয়া যায় (ইবনে মাজাহ)। তাই ক্ষমতার প্রভাব, টাকার চাকচিক্য কিংবা অনর্থক বিত্তশালী জাহির করার জন্য নয়, বরং নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী কষ্টার্জিত হালাল অর্থে কেনা উত্তম পশু কোরবানি করাই বাঞ্ছনীয়। সংগত কারণেই বলতে হচ্ছে, গর্হিত উপায়ে অর্জিত কিংবা হারাম রোজগারের কোটি টাকার পশুও কোরবানির পণ্য হিসেবে আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে না। আবার কোরবানির পশু কেনার নামে বর্তমানের লাখ-কোটি টাকা ব্যয়ের ঘৃণ্য প্রবণতাও ইসলামে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কারণ পবিত্র কোরআনের ভাষায়, অপচয়কারী শয়তানের ভাই। এ অবস্থায় একমাত্র বিশ্ব প্রতিপালকের সন্তুষ্টি ও পুণ্য হাসিল এবং পরকালীন নাজাত লাভের আশায় আমরা নিজেদের কষ্টার্জিত হালাল অর্থে সামর্থ্য অনুযায়ী মোটাতাজা পশু কিনে পরিশুদ্ধ অন্তরে কোরবানিদানে সচেষ্ট থাকব, ইনশা আল্লাহ।
ঈদুল আজহার ওয়াজিব দুটি : ঈদগাহ বা মসজিদে সমবেত হয়ে ঈদের দুই রাকাত সালাত আদায় করা এবং কোরবানি করা।
সুন্নাতের মধ্যে রয়েছে : গোসল করা, খোশবু লাগানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড়চোপড় পরিধান করা, কোরবানির পর পশুর গোশত দিয়ে কিছু খাওয়া, ঈদগাহ বা ময়দানে গিয়ে সালাত আদায় করা, ঈদগাহে যাওয়ার সময় জোরে জোরে তাকবির উচ্চারণ করা এবং সম্ভব হলে এক পথে ঈদগাহে গমন করা এবং ভিন্ন পথে নিজ নিজ আলয়ে প্রত্যাবর্তন করা। আমির-ফকির নির্বিশেষে সকল মুসলমানের একই কাতারে দাঁড়িয়ে দুই রাকাত সালাত আদায় করা ঈদ-সালাতকে অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে। অতিরিক্ত ছয় তাকবির আবার মাজহাব ভেদে নয় তাকবিরের সঙ্গে ঈদের সালাত আদায় করা হয়। সালাতের নিয়ত জানা না থাকলে মনে মনে কেবলামুখী হয়ে ইমামের পেছনে অতিরিক্ত ৬/৯ তাকবিরের সঙ্গে আমি ঈদুল আজহার সালাত আদায় করছি উচ্চারণ করলেই চলবে। সালাত শেষে ইমাম সাহেব অতীব সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খুতবা দেবেন। একাগ্রচিত্তে ও অভিন্ন মনোযোগসহকারে খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব। পরিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসী, বিশেষত বহুধাবিভক্ত মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হয় এবং পারস্পরিক উষ্ণ আলিঙ্গন শেষে উপস্থিত সকলেই ঈদগাহ বা মসজিদ ত্যাগ করেন। এরপর কোরবানিদাতা পশু কোরবানির আয়োজনে ব্যতিব্যস্ত এবং শিশু-কিশোরেরা ঈদ আনন্দে বিভোর হয়ে ওঠেন।
লক্ষণীয় জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ সালাতের পর তাকবিরে তাশরিফ পড়া ওয়াজিব। জামাতে নামাজ আদায় করলে তাকবির আদায়ে ভুল হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। অবশ্য কোনো কারণে তাকবির পড়তে ভুলে গেলে স্মরণ হওয়ামাত্রই তা পড়তে হবে। তাকবিরে তাশরিফ হচ্ছে : আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবারু আল্লাহু আকবারু ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
হে মহান স্রষ্টা, পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে পাপ-পঙ্কিলতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর অসিলায় তুমি ক্ষমা করে দাও। যাবতীয় আসমানি-জমিনি বালা-মসিবতের সর্বগ্রাসী থাবা থেকে তুমি আমাদের পরিত্রাণ দাও এবং ঈদের যথার্থ শিক্ষা অনুশীলনে অনুপ্রাণিত করো।
ঠিকানার পক্ষ থেকে পরলোকগতদের আত্মার চিরপ্রশান্তি কামনা এবং স্বজনহারাদের প্রতি গভীর সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। সর্বোপরি পাঠক, শ্রদ্ধাভাজন কবি-সাহিত্যিক-লেখক এবং বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভানুধ্যায়ীদের জানাচ্ছি পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক!
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক
মুসলমানদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) এর অবিস্মরণীয় ত্যাগের স্মৃতিবিজড়িত এবং পরম করুণাময় আল্লাহর রহমতসিক্ত পবিত্র ঈদুল আজহা আবারও বিশ্ব মুসলিমের সামনে উপস্থিত। নবতিপর বৃদ্ধ নবী হজরত ইবরাহিম (আ.) এর অনন্য আত্মাহুতির দীক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুসলমানরাও একমাত্র বিশ্ব প্রতিপালকের সন্তুষ্টি বিধানার্থেই আজ ২৮ জুন বুধবার পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্্যাপন এবং কোরবানি আদায় করছেন। মূলত পৌত্তলিকতার সমূল উৎপাটন এবং আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পৌত্তলিক আজরের সন্তান ইবরাহিম কৈশোরে পিতৃগৃহ থেকে বিতাড়িত, যৌবনে খোদাদ্রোহী বাদশাহ নমরুদ কর্তৃক প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত এবং জীবনসায়াহ্নে নিজের অন্ধের যষ্ঠি পুত্র ইসমাইলের গলায় শাণিত ছোরা চালানোর চরম অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খলিলুল্লাহ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। আর হজরত ইবরাহিমের (আ.) সেই অবিস্মরণীয় ত্যাগের স্মৃতির প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা নিবেদনার্থে প্রতিবছর ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে ঈদুল আজহার সালাত শেষে শান্তির ধর্ম ইসলামের আর্থিকভাবে সচ্ছল অনুসারীরা নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থে কেনা পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। প্রকৃত প্রস্তাবে কোরবানির পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে মুসলমানরা রাব্বুল আল আমিনের সঙ্গে নতুনভাবে ওয়াদাবদ্ধ হন, পাপ-পঙ্কিলতার কবল থেকে ইমানকে রক্ষার ও হৃদয়ের পাশবিক প্রবৃত্তিকে জবাই করার সংকল্প গ্রহণ করেন। সামর্থ্য অনুযায়ী হালাল অর্থে কেনা মোটাতাজা পশুর গলায় ছুরি চালনাকালে তারা হৃদয় নিংড়ানো ভক্তি ও প্রগাঢ় শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করেন : হে আল্লাহ! তোমার সন্তুষ্টির খাতিরে যেভাবে আমরা পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে রক্ত প্রবাহিত করছি, প্রয়োজনে তেমনিভাবে আমরা নিজেদের রক্ত প্রবাহিত করতে ও আত্মাহুতি দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হব না।
যাহোক, করোনার দগদগে ক্ষত, স্বজন হারানোর মর্মবেদনা, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি, আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতার বাড়াবাড়ি, বাড়ি ভাড়ার দৌরাত্ম্য, ছাত্রঋণের প্রতি মাসে গড়ে বাধ্যতামূলক ১৬০ ডলার কিস্তি পরিশোধ, স্বদেশে ও প্রবাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংসার ভাঙার প্রবণতা, সামাজিক বিভেদ-বৈষম্য-বিভক্তি, ঘৃণ্য প্রতিহিংসা ইত্যাদিকে বুকে চাপা দিয়েই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুসলমানরা পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্্যাপন করছেন। বর্তমান বিশ্বের সিংহভাগ মুসলমানই একমাত্র বিশ্ব প্রতিপালকের অপরিসীম রহমত লাভের আশায়ই কোরবানি উপলক্ষে নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ ও সময় ব্যয়ে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করছেন না। তাই পবিত্র ঈদুল আজহা এবং কোরবানি উপলক্ষে করজোড়ে কামনা করছি : হে বিশ্ববিধাতা, তুমি আমাদের যাবতীয় অপরাধ মার্জনা করো, আমাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করো, পরচর্চা, হিংসা-বিদ্বেষ-পশুত্ববোধের অভিশাপ থেকে আমাদের মুক্তি দাও এবং আমাদের অন্তরে মনুষ্যত্ব ও সৌভ্রাতৃত্ববোধের উন্মেষ ঘটাও। বিশ্ব মুসলিমের অজানা নয় যে, ইসলামি মূল্যবোধের উন্মেষ, মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ জোরদার, মানব হিতে জীবন উৎসর্গ, জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণ লাভের আশায় আল্লাহর রহমত ভিক্ষার শাশ্বত আবেদন এবং হজরত ইবরাহিম (আ.) এর আত্মত্যাগের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত সমভিব্যাহারে প্রতিবছর ১০ জিলহজ আগমন ঘটে মুসলমানদের দ্বিতীয় জাতীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহার। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই আজ ২৮ জুন বুধবার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুসলমানরা পবিত্র ঈদুল আজহার সালাত শেষে কোরবানি সম্পন্ন করছেন। বস্তুত, হাসি-আনন্দ-খুশির বার্তা ছাড়াও স্বার্থের ঘেরাটোপে আচ্ছাদিত বর্তমানের চরম অবক্ষয়ের জমানায় বিশ্ব মুসলিমের নিকট পবিত্র ঈদুল আজহার আবেদনের পরিধিও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অতীতকে ভুলে যাওয়া, পরস্পরকে ক্ষমা করে দেওয়া, মানব চরিত্রের পাশবিক প্রবৃত্তিরাজিকে কোরবানি দেওয়া, জীবনাচরণে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনয়ন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় বজ্রকঠোর সংকল্প গ্রহণÑপবিত্র ঈদুল আজহার ইত্যাদি শাশ্বত আবেদনের সঙ্গে দানবীয় শক্তির বিনাশও বর্তমানে সংযুক্ত হয়েছে। অনবদ্য কারণে হজরত ইবরাহিম (আ.) এর আমলে প্রবর্তিত প্রথা অনুযায়ী ঈদুল আজহার সালাত, খুতবা ও মোনাজাত শেষে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে আমরা অতীতের যাবতীয় হিংসা-বিদ্বেষ-মনোমালিন্য ভুলে গিয়ে পরস্পরকে উষ্ণ আলিঙ্গনে বুকে জড়িয়ে ধরব। আর পবিত্র ঈদের সুমহান দীক্ষা সারা বছর ব্যক্তিগত জীবনে অনুশীলনে নতুনভাবে ওয়াদাবদ্ধ হব ইনশা আল্লাহ।
আমাদের দ্বিতীয় জাতীয় উৎসব ঈদুল আজহা : ধনী-নির্ধন প্রত্যেক মুসলমানের জীবনে ঈদুল আজহার আগমন ঘটে মহান আল্লাহর অপরিসীম রহমত লাভ এবং হজরত ইবরাহিম খলিলুল্লাহর সুমহান আত্মত্যাগের অনুসরণ ও পার্থিব আনন্দ-উচ্ছ্বাসের বার্তা নিয়ে। তবে বিয়োগব্যথাসহ জাগতিক বিভিন্ন কারণে ব্যক্তিগত ও পরিবার বিশেষের জীবনে ঈদের আনন্দ-আবেদনে যথেষ্ট গরমিল পরিলক্ষিত হয়। বিরহব্যথা, হাসি-আনন্দে ভরপুর এই বিশ্বচরাচরে প্রতিটি ঈদেই পরিবারের সদস্য কিংবা ঘনিষ্ঠজনদের বিয়োগব্যথা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে যায় ভুক্তভোগীদের মানসপটে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, অবিমিশ্র আনন্দ এই মাটির পৃথিবীতে পাওয়া যায় না। তিক্ততার স্বাদ আছে বলেই তো আনন্দ এত মধুর। তাই বিরহ-বেদনার অন্তর্জ্বালাকে বুকে চেপে ধরে এবং মহান আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় সিদ্ধান্তের সঙ্গে মতৈক্য প্রকাশ করেই প্রতিবছরের মতো এবারও ইবরাহিমি ত্যাগ-তিতিক্ষায় উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত হয়ে পবিত্র ঈদুল আজহাকে হাসিমুখে বরণ করা আমাদের ইমানি দায়িত্ব। পবিত্র কোরআনের ভাষায় : কুল্লু নাফসীন জায়িকাতুল মাউত (প্রত্যেক মানুষকে অবশ্যই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে) এবং আলহামদুলিল্লাহে আলা’ কুল্লে হালীন (প্রত্যেক অবস্থাতেই আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করো)। মুসলমানরা কায়মনোবাক্যে স্বীকার করেন যে জন্ম ও মৃত্যুর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তদাতা এবং একচ্ছত্র অধিপতি বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা। তাই মুসলমান হিসেবে আমাদের অবশ্যই যাবতীয় আনন্দে আলহামদুলিল্লাহ উচ্চারণ করে শুকরিয়া আদায় এবং সামগ্রিক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন উচ্চারণ করে আল্লাহর অভিপ্রায়ের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে হবে।
স্মর্তব্য, আরবি ভাষা থেকে উদ্ভূত ঈদের শাব্দিক অর্থ আনন্দ বা উৎসব। ঈদের দিবসটি হচ্ছে আরব-অনারব, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, বর্ণ-গোত্র, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে বিশ্ব মুসলিমের জাতীয় খুশি বা আনন্দের দিন। এ বিশেষ দিবসে বিত্তশালী মুসলমানদের গগনচুম্বী হর্ম থেকে হতদরিদ্র মুসলমানদের জীর্ণ কুটিরেও খুশি বয়ে যায়। এরই পটভূমিতে ঈদের দিবসকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর জাতীয় আনন্দ দিবস অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব উৎসবের দিন রয়েছে। আর আমাদের উৎসব হচ্ছে ঈদ (বুখারি ও মুসলিম)। জিলহজ মাসের দশম তারিখে গোটা বিশ্বের মুসলিম জনতা ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে এবং নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী নানা আয়োজনে ঈদুল আজহা উদ্্যাপন করে থাকেন। পবিত্র ঈদুল আজহার সঙ্গে নবতিপর বৃদ্ধ হজরত ইবরাহিমের (আ.) একমাত্র পুত্র ইসমাইলের (আ.) গলায় ছুরি চালিয়ে বিশ্ববিধাতার স্বপ্নাদেশ বাস্তবায়নের অবিনশ্বর স্মৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে বিজড়িত। একমাত্র মহান আল্লাহর নির্দেশেই অশীতিপর বৃদ্ধ হজরত ইবরাহিম (আ.) সবেধন নীলমণি পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) এবং পলিতকেশ স্ত্রী বিবি হাজেরাকে জনমানবশূন্য ঊষর মক্কায় নির্বাসিত করেছিলেন। আবার স্বপ্নযোগে কোরবানির আদেশ লাভের পর উপর্যুপরি তিন দিনে ৩০০ দুম্বা বা উট কোরবানি করেও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ব্যর্থ হলেন। পরিশেষে সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু কোরবানির প্রশ্নে ধ্যানমগ্ন ইবরাহিম (আ.) বুকের ওপর পাথরচাপা দিয়ে প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) কে কোরবানি দেওয়ার চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং আল্লাহ সন্তুষ্টির খাতিরে মানবসভ্যতার ইতিহাসে আত্মত্যাগের সর্বাপেক্ষা নজিরবিহীন অধ্যায়ের সংযোজন করলেন। আবার স্বপ্নাদেশ কার্যকরের পূর্বে পুত্রবৎসল পিতা ইবরাহিম (আ.) কিশোর পুত্র ইসমাইলের (আ.) সম্মতি নিয়েছিলেন। অতঃপর ইবরাহিম (আ.) জাগতিক যাবতীয় স্নেহবন্ধন ছিন্ন করে হাত-পা বাঁধা পুত্র ইসমাইলের (আ.) গলদেশে শাণিত ছুরি চালালেন। কিন্তু বিশ্ব প্রতিপালকের অদৃশ্য ইঙ্গিতে ইসমাইল (আ.) এর স্থলে একটি স্বর্গীয় দুম্বা জবাই হয়ে গেল এবং হজরত ইবরাহিম (আ.) চরম আত্মত্যাগের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খলিলুল্লাহ উপাধিতে ভূষিত হলেন। অন্যদিকে আল্লাহর অভিপ্রায়ের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশকারী শিশু ইসমাইলও (আ.) শাণিত কৃপাণের তলদেশ থেকে অক্ষত অবস্থায় রক্ষা পেলেন এবং জবিউল্লাহ খেতাবপ্রাপ্ত হলেন। সেই অবিস্মরণীয় আত্মোৎসর্গের অনুসরণেই একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই মুসলিম উম্মাহ প্রতিবছর পশু কোরবানি করেন।
উল্লেখ্য, ইবরাহিমি কোরবানি-ব্যবস্থা চালু হওয়ার পূর্বে হজরত আদম (আ.) এর পুত্র কাবিল নিজের পরমা সুন্দরী ভগ্নি আকলিমাকে এবং অপর পুত্র হাবিলও আকলিমাকে বিয়ে করার প্রশ্নে কোরবানি দিয়েছিলেন। কিন্তু কাবিলের কোরবানি গৃহীত না হওয়ায় ক্রোধের বশে সে হাবিলকে খুন করে মানুষ খুনের প্রথম ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য বিশ্ব মুসলিম হজরত ইবরাহিম (আ.) এর অনুসরণেই প্রতিবছর ১০ জিলহজ কোরবানি দিয়ে থাকেন। অবস্থাপন্ন প্রত্যেক মুসলমানের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। হালাল উপায়ে অর্জিত অর্থের সাহায্যে একাগ্রচিত্তে কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অতুলনীয় পুণ্য হাসিল করা যায়। কোরবানির মাধ্যমে বিশ্ব প্রতিপালকের রহমতপ্রত্যাশী মুসলিম জনগোষ্ঠী ইমান ও তাকওয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে থাকেন। বিশ্ব প্রতিপালক বলেন, আল্লাহর নিকট সেগুলোর (কোরবানির পশুর) গোশত এবং রক্ত পৌঁছায় না, পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া (সুরা হাজ : ৩৭)। বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, কোরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা কবুল হয়ে যায় (তিরমিজি)। হজরত মোহাম্মদ (সা.) আরও বলেছেন, কোরবানির পশুর প্রতিটি পশম বা লোমের জন্য একটি করে সাওয়াব পাওয়া যায় (ইবনে মাজাহ)। তাই ক্ষমতার প্রভাব, টাকার চাকচিক্য কিংবা অনর্থক বিত্তশালী জাহির করার জন্য নয়, বরং নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী কষ্টার্জিত হালাল অর্থে কেনা উত্তম পশু কোরবানি করাই বাঞ্ছনীয়। সংগত কারণেই বলতে হচ্ছে, গর্হিত উপায়ে অর্জিত কিংবা হারাম রোজগারের কোটি টাকার পশুও কোরবানির পণ্য হিসেবে আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে না। আবার কোরবানির পশু কেনার নামে বর্তমানের লাখ-কোটি টাকা ব্যয়ের ঘৃণ্য প্রবণতাও ইসলামে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কারণ পবিত্র কোরআনের ভাষায়, অপচয়কারী শয়তানের ভাই। এ অবস্থায় একমাত্র বিশ্ব প্রতিপালকের সন্তুষ্টি ও পুণ্য হাসিল এবং পরকালীন নাজাত লাভের আশায় আমরা নিজেদের কষ্টার্জিত হালাল অর্থে সামর্থ্য অনুযায়ী মোটাতাজা পশু কিনে পরিশুদ্ধ অন্তরে কোরবানিদানে সচেষ্ট থাকব, ইনশা আল্লাহ।
ঈদুল আজহার ওয়াজিব দুটি : ঈদগাহ বা মসজিদে সমবেত হয়ে ঈদের দুই রাকাত সালাত আদায় করা এবং কোরবানি করা।
সুন্নাতের মধ্যে রয়েছে : গোসল করা, খোশবু লাগানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড়চোপড় পরিধান করা, কোরবানির পর পশুর গোশত দিয়ে কিছু খাওয়া, ঈদগাহ বা ময়দানে গিয়ে সালাত আদায় করা, ঈদগাহে যাওয়ার সময় জোরে জোরে তাকবির উচ্চারণ করা এবং সম্ভব হলে এক পথে ঈদগাহে গমন করা এবং ভিন্ন পথে নিজ নিজ আলয়ে প্রত্যাবর্তন করা। আমির-ফকির নির্বিশেষে সকল মুসলমানের একই কাতারে দাঁড়িয়ে দুই রাকাত সালাত আদায় করা ঈদ-সালাতকে অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে। অতিরিক্ত ছয় তাকবির আবার মাজহাব ভেদে নয় তাকবিরের সঙ্গে ঈদের সালাত আদায় করা হয়। সালাতের নিয়ত জানা না থাকলে মনে মনে কেবলামুখী হয়ে ইমামের পেছনে অতিরিক্ত ৬/৯ তাকবিরের সঙ্গে আমি ঈদুল আজহার সালাত আদায় করছি উচ্চারণ করলেই চলবে। সালাত শেষে ইমাম সাহেব অতীব সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খুতবা দেবেন। একাগ্রচিত্তে ও অভিন্ন মনোযোগসহকারে খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব। পরিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসী, বিশেষত বহুধাবিভক্ত মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হয় এবং পারস্পরিক উষ্ণ আলিঙ্গন শেষে উপস্থিত সকলেই ঈদগাহ বা মসজিদ ত্যাগ করেন। এরপর কোরবানিদাতা পশু কোরবানির আয়োজনে ব্যতিব্যস্ত এবং শিশু-কিশোরেরা ঈদ আনন্দে বিভোর হয়ে ওঠেন।
লক্ষণীয় জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ সালাতের পর তাকবিরে তাশরিফ পড়া ওয়াজিব। জামাতে নামাজ আদায় করলে তাকবির আদায়ে ভুল হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। অবশ্য কোনো কারণে তাকবির পড়তে ভুলে গেলে স্মরণ হওয়ামাত্রই তা পড়তে হবে। তাকবিরে তাশরিফ হচ্ছে : আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবারু আল্লাহু আকবারু ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
হে মহান স্রষ্টা, পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে পাপ-পঙ্কিলতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর অসিলায় তুমি ক্ষমা করে দাও। যাবতীয় আসমানি-জমিনি বালা-মসিবতের সর্বগ্রাসী থাবা থেকে তুমি আমাদের পরিত্রাণ দাও এবং ঈদের যথার্থ শিক্ষা অনুশীলনে অনুপ্রাণিত করো।
ঠিকানার পক্ষ থেকে পরলোকগতদের আত্মার চিরপ্রশান্তি কামনা এবং স্বজনহারাদের প্রতি গভীর সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। সর্বোপরি পাঠক, শ্রদ্ধাভাজন কবি-সাহিত্যিক-লেখক এবং বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভানুধ্যায়ীদের জানাচ্ছি পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক!
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক