আবু সাঈদ রতন
নিউইয়র্কে বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে বসে জামিল শেখ আপনমনে পায়েস খাচ্ছে। পায়েস খাওয়া মানে পায়েসের বাটি নিয়ে বসে থাকা। কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। তবে তার দৃষ্টিতে যেন একটি শূন্যতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ঈদের দিনে পায়েস খাবে, এতে তো আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
অদূরেই অন্য একটি চেয়ারে তমাল বসে আছে তার বন্ধুদের নিয়ে। সকলের বয়স পঞ্চাশের উপরেই হবে। টুপি, পাঞ্জাবি পরে আছে সকলে। ঈদের জামাত পড়েই দ্রুত ঢুকে পড়েছে রেস্টুরেন্টে। চলছে তুমুল আড্ডা। চেয়ার দখল করার জন্যই সকলে তাড়াহুড়ো করে চলে আসে রেস্টুরেন্টে।
তমালদের আড্ডার একপর্যায়ে হঠাৎ চোখ যায় জামিল শেখের দিকে। জামিল শেখের বয়স সত্তরের কাছাকাছি। চেহারায় বিষণ্নতার ছাপ। শরীরেও ক্লান্তি এসেছে বলে মনে হয়। তমালের এক বন্ধু বলে উঠল, ‘দেখ, লোকটি পায়েসের বাটি নিয়ে চুপচাপ বসে আছে অনেকক্ষণ যাবৎ, কিন্তু খাচ্ছে না। ফোনে যেন কারও সাথে কথা বলছে।’ সকলে তার কথা শুনছে, কিন্তু লোকটির সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। তাদের পাশের টেবিলে বসে ছিল রহিম মিয়া। সেও পায়েস খাচ্ছে। ঈদের দিন পায়েস খেতে হয়, তাই সে খাচ্ছে। রহিম মিয়া তমালের পরিচিত। তমালদের দেখে রহিম মিয়া তাদের পাশে এসে বসে। তারপর সকলকে পায়েস খেতে অফার করল। তমাল শ্রদ্ধার সাথে ‘না খাব না’ বলে মানা করে দিল। রহিম মিয়া বলল, ‘আপনি তো ঘরে গিয়ে বউয়ের হাতে পায়েস খাবেন, আমাদের তো সেই কপাল নেই।’ এই বলেই রহিম মিয়ার মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল।
তমালের এক বন্ধু রহিমকে বলল, ‘দেখেন, ওই লোকটি অনেকক্ষণ ধরে পায়েস নিয়ে বসে আছে, কিন্তু খাচ্ছে না।’
রহিম বলল, ‘আমিই তাকে পায়েস দিয়ে এসেছি। বেচারা গত ৩০টি বছর আমেরিকায় কাটিয়ে দিল। দেশে আর যেতে পারছে না। কাগজপত্র নেই।’
তমাল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কাগজপত্র নেই মানে? দেশে যাচ্ছে না কেন?’
রহিম বেশ গম্ভীরভাবেই বলল, ‘অবৈধভাবে এ দেশে এসেছে। বৈধ কাগজপত্র হয়নি। তাই দেশে যাওয়াও হয়নি।’
তমালের বন্ধু বলল, ‘দেশে চলে গেলেই পারে, বয়স তো আর কম হয়নি।’
রহিম বলল, ‘ডলারের নেশা একবার পেয়ে বসলে সব ভুলে যায়। দেশ, বউ, বাচ্চাÑসব।’
‘ও ভাই, পায়েস খান, কার সাথে এত কথা বলছেন?’
রহিম মিয়ার প্রশ্নের উত্তরে জামিল শেখ বলল, ‘নাতনির সাথে কথা বলি। তারা আমাকে খুব মিস করছে। ঈদের দিন তো তাই কথা বলি।’ বলেই জামিল শেখ আবার কথায় মনোযোগ দিল।
রহিম মিয়া বলতে শুরু করল, এই জামিল শেখ যৌবনে নদীপথে জাহাজে করে এ দেশে এসে পৌঁছায়। আর ফিরে যায়নি। বৈধ কাগজ নেই। তাই অবৈধভাবেই এখানে থেকে যায়। যা উপার্জন করে, সব দেশে পাঠিয়ে দেয়। এখানে একটি মেসে থাকে। বিয়ের দুই বছরের মাথায় সে স্ত্রী, বাবা, মা ও বাচ্চাদের রেখে বিদেশে পাড়ি জমায়। তার সুন্দর ফুটফুটে একটি ছেলে ও একটি মেয়েসন্তান আছে। অবশ্য এত দিনে ছেলেমেয়ে উভয়ের বিয়ে হয়েছে। মেয়ের ঘরে নাতিও হয়েছে। তবুও তার দেশে যাওয়া হয়নি।
‘আপনারা তাকে একটু বোঝাতে পারেন না?’
তমালের এমন প্রশ্নে একটু তাচ্ছিল্যের স্বরেই রহিম মিয়া বলল, ‘অনেক বুঝিয়েছি। বলে, দেশে গিয়ে কী করব। ডলার কামাচ্ছে আর দেশে পাঁচ-ছয়তলা বাড়ি বানাচ্ছে। কিছু বললেই বলে, এই তো চলে যাব। বাড়ির ছাদের ঢালাই চলছে, অনেক টাকার প্রয়োজন। ছাদের ঢালাইয়ের কাজ শেষ হলেই চলে যাব।
এভাবেই চলছে জামিল শেখের প্রবাসজীবন। দেশে স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়স্বজন রেখে এ কেমন মোহে এখানে পড়ে আছে? সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি করে কোনোমতে দিন পার করছে। অসুখে-বিসুখে দেখার কেউ নেই। কাজের পরে টেলিফোনে কথা বলা। যৌবনে রেখে আসা যুবতী স্ত্রীর মনের ভাষাগুলো কি জামিল শেখ একবারের জন্যও উপলব্ধি করতে পেরেছে? একটিমাত্র জীবন কাটিয়ে দিল কিসের মোহে? দেশে দালান হচ্ছে, নামীদামি মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। তবুও জামিল শেখের দেশে যাওয়া হয়নি।
হঠাৎ জামিল শেখ তাদের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসে। সালাম দিয়ে তাদের পাশে বসে। সাথে পায়েসের বাটিও নিয়ে আসে।
তমাল বলে, ‘কার সাথে এত কথা বললেন?’
জামিল শেখ বলল, ‘আমার নাতি, ছেলেমেয়ের সাথে।’
‘দেশে যাবেন না?’
‘যাব, এবার চলেই যাব। কত দিন ছেলেমেয়েদের দেখি না, বাবা-মা তো মরেই গেল। শেষ দেখাটাও হলো না। আমারও শরীরটা ভালো না। স্ত্রীও খুব অসুস্থ। কান্নাকাটি করে। ইশ, কেন যে এত দিন দেশে গেলাম না। প্রবাসে থাকলে সময় যে কত দ্রুত চলে যায়, বুঝতেই পারিনি। ৩০টি বছর চলে গেল এক নিমেষে। আর ভালো লাগে না।
জামিল শেখের চোখের কোণে পানি টলমল করছে, কণ্ঠ অনেক ভারী হয়ে আসছে। পরিবেশ স্বাভাবিক করতে রহিম মিয়া বলল, ‘যা হবার হয়েছে, নিন পায়েস খান। ঈদের দিন পায়েস খেতে হয়।’ জামিল শেখ কিছু না বলে পায়েসের বাটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হয়তো এই পায়েস নিয়েই অতীতের কোনো সুখস্মৃতির হিসাব মেলাচ্ছে।
আমরাও কফিতে চুমুক দিতে শুরু করেছি। পরিবেশটা কেমন যেন স্তব্ধ মনে হচ্ছে। বিদায় নিয়ে আমরা চলে এলাম। পেছন ফিরে আড় চোখে দেখলাম, জামিল শেখ পায়েসের বাটির দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে।
ঈদের পায়েস-এতে অবাক হওয়ার কী আছে?
নিউইয়র্কে বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে বসে জামিল শেখ আপনমনে পায়েস খাচ্ছে। পায়েস খাওয়া মানে পায়েসের বাটি নিয়ে বসে থাকা। কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। তবে তার দৃষ্টিতে যেন একটি শূন্যতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ঈদের দিনে পায়েস খাবে, এতে তো আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
অদূরেই অন্য একটি চেয়ারে তমাল বসে আছে তার বন্ধুদের নিয়ে। সকলের বয়স পঞ্চাশের উপরেই হবে। টুপি, পাঞ্জাবি পরে আছে সকলে। ঈদের জামাত পড়েই দ্রুত ঢুকে পড়েছে রেস্টুরেন্টে। চলছে তুমুল আড্ডা। চেয়ার দখল করার জন্যই সকলে তাড়াহুড়ো করে চলে আসে রেস্টুরেন্টে।
তমালদের আড্ডার একপর্যায়ে হঠাৎ চোখ যায় জামিল শেখের দিকে। জামিল শেখের বয়স সত্তরের কাছাকাছি। চেহারায় বিষণ্নতার ছাপ। শরীরেও ক্লান্তি এসেছে বলে মনে হয়। তমালের এক বন্ধু বলে উঠল, ‘দেখ, লোকটি পায়েসের বাটি নিয়ে চুপচাপ বসে আছে অনেকক্ষণ যাবৎ, কিন্তু খাচ্ছে না। ফোনে যেন কারও সাথে কথা বলছে।’ সকলে তার কথা শুনছে, কিন্তু লোকটির সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। তাদের পাশের টেবিলে বসে ছিল রহিম মিয়া। সেও পায়েস খাচ্ছে। ঈদের দিন পায়েস খেতে হয়, তাই সে খাচ্ছে। রহিম মিয়া তমালের পরিচিত। তমালদের দেখে রহিম মিয়া তাদের পাশে এসে বসে। তারপর সকলকে পায়েস খেতে অফার করল। তমাল শ্রদ্ধার সাথে ‘না খাব না’ বলে মানা করে দিল। রহিম মিয়া বলল, ‘আপনি তো ঘরে গিয়ে বউয়ের হাতে পায়েস খাবেন, আমাদের তো সেই কপাল নেই।’ এই বলেই রহিম মিয়ার মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল।
তমালের এক বন্ধু রহিমকে বলল, ‘দেখেন, ওই লোকটি অনেকক্ষণ ধরে পায়েস নিয়ে বসে আছে, কিন্তু খাচ্ছে না।’
রহিম বলল, ‘আমিই তাকে পায়েস দিয়ে এসেছি। বেচারা গত ৩০টি বছর আমেরিকায় কাটিয়ে দিল। দেশে আর যেতে পারছে না। কাগজপত্র নেই।’
তমাল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কাগজপত্র নেই মানে? দেশে যাচ্ছে না কেন?’
রহিম বেশ গম্ভীরভাবেই বলল, ‘অবৈধভাবে এ দেশে এসেছে। বৈধ কাগজপত্র হয়নি। তাই দেশে যাওয়াও হয়নি।’
তমালের বন্ধু বলল, ‘দেশে চলে গেলেই পারে, বয়স তো আর কম হয়নি।’
রহিম বলল, ‘ডলারের নেশা একবার পেয়ে বসলে সব ভুলে যায়। দেশ, বউ, বাচ্চাÑসব।’
‘ও ভাই, পায়েস খান, কার সাথে এত কথা বলছেন?’
রহিম মিয়ার প্রশ্নের উত্তরে জামিল শেখ বলল, ‘নাতনির সাথে কথা বলি। তারা আমাকে খুব মিস করছে। ঈদের দিন তো তাই কথা বলি।’ বলেই জামিল শেখ আবার কথায় মনোযোগ দিল।
রহিম মিয়া বলতে শুরু করল, এই জামিল শেখ যৌবনে নদীপথে জাহাজে করে এ দেশে এসে পৌঁছায়। আর ফিরে যায়নি। বৈধ কাগজ নেই। তাই অবৈধভাবেই এখানে থেকে যায়। যা উপার্জন করে, সব দেশে পাঠিয়ে দেয়। এখানে একটি মেসে থাকে। বিয়ের দুই বছরের মাথায় সে স্ত্রী, বাবা, মা ও বাচ্চাদের রেখে বিদেশে পাড়ি জমায়। তার সুন্দর ফুটফুটে একটি ছেলে ও একটি মেয়েসন্তান আছে। অবশ্য এত দিনে ছেলেমেয়ে উভয়ের বিয়ে হয়েছে। মেয়ের ঘরে নাতিও হয়েছে। তবুও তার দেশে যাওয়া হয়নি।
‘আপনারা তাকে একটু বোঝাতে পারেন না?’
তমালের এমন প্রশ্নে একটু তাচ্ছিল্যের স্বরেই রহিম মিয়া বলল, ‘অনেক বুঝিয়েছি। বলে, দেশে গিয়ে কী করব। ডলার কামাচ্ছে আর দেশে পাঁচ-ছয়তলা বাড়ি বানাচ্ছে। কিছু বললেই বলে, এই তো চলে যাব। বাড়ির ছাদের ঢালাই চলছে, অনেক টাকার প্রয়োজন। ছাদের ঢালাইয়ের কাজ শেষ হলেই চলে যাব।
এভাবেই চলছে জামিল শেখের প্রবাসজীবন। দেশে স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়স্বজন রেখে এ কেমন মোহে এখানে পড়ে আছে? সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি করে কোনোমতে দিন পার করছে। অসুখে-বিসুখে দেখার কেউ নেই। কাজের পরে টেলিফোনে কথা বলা। যৌবনে রেখে আসা যুবতী স্ত্রীর মনের ভাষাগুলো কি জামিল শেখ একবারের জন্যও উপলব্ধি করতে পেরেছে? একটিমাত্র জীবন কাটিয়ে দিল কিসের মোহে? দেশে দালান হচ্ছে, নামীদামি মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। তবুও জামিল শেখের দেশে যাওয়া হয়নি।
হঠাৎ জামিল শেখ তাদের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসে। সালাম দিয়ে তাদের পাশে বসে। সাথে পায়েসের বাটিও নিয়ে আসে।
তমাল বলে, ‘কার সাথে এত কথা বললেন?’
জামিল শেখ বলল, ‘আমার নাতি, ছেলেমেয়ের সাথে।’
‘দেশে যাবেন না?’
‘যাব, এবার চলেই যাব। কত দিন ছেলেমেয়েদের দেখি না, বাবা-মা তো মরেই গেল। শেষ দেখাটাও হলো না। আমারও শরীরটা ভালো না। স্ত্রীও খুব অসুস্থ। কান্নাকাটি করে। ইশ, কেন যে এত দিন দেশে গেলাম না। প্রবাসে থাকলে সময় যে কত দ্রুত চলে যায়, বুঝতেই পারিনি। ৩০টি বছর চলে গেল এক নিমেষে। আর ভালো লাগে না।
জামিল শেখের চোখের কোণে পানি টলমল করছে, কণ্ঠ অনেক ভারী হয়ে আসছে। পরিবেশ স্বাভাবিক করতে রহিম মিয়া বলল, ‘যা হবার হয়েছে, নিন পায়েস খান। ঈদের দিন পায়েস খেতে হয়।’ জামিল শেখ কিছু না বলে পায়েসের বাটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হয়তো এই পায়েস নিয়েই অতীতের কোনো সুখস্মৃতির হিসাব মেলাচ্ছে।
আমরাও কফিতে চুমুক দিতে শুরু করেছি। পরিবেশটা কেমন যেন স্তব্ধ মনে হচ্ছে। বিদায় নিয়ে আমরা চলে এলাম। পেছন ফিরে আড় চোখে দেখলাম, জামিল শেখ পায়েসের বাটির দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে।
ঈদের পায়েস-এতে অবাক হওয়ার কী আছে?