জামাল আস-সাবেত
গভীর অন্ধকার। নিশ্চুপ বসে আছি। হাত বাড়াই, দেখি না। কেবল নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে রাতের চারণভূমিতে একাই পায়চারি করছি। ঘুম আসছে না। অস্থিরতা কাটাতে ডিমলাইটটা জ্বালিয়ে কফি বানিয়ে নিলাম। আবার অন্ধকার করে দিলাম। এক হাতে কফি নিয়ে পেয়ালায় চুমুক দিতেই কপাল ভাঁজ হয়ে এল।
সেদিন হলোটা কী?
হাসান সাহেব মেয়েটার সাথে এমন করল কেন? অথচ মেয়েটার মা পাশেই দাঁড়ানো ছিল। তার এ জিনিসটা কি মায়ের চোখ
এড়িয়েই গেল?
সব সময় হাসিমাখা মুখ মানুষের হৃদয় কেড়ে নিতে হাসান সাহেবের জুড়ি নেই। সবার সাথে মিলমিশে থাকা, সালাম দিয়ে মানুষের মন জয় করায় ছিল তার ব্যাপক সুখ্যাতি। তার মতো এ রকম হুজুর পাওয়া দুষ্কর। শ’য়ে একজন। এলাকাবাসী ধন্য। যেকোনো দোয়া-মিলাদে হাসান হুজুরের উপস্থিতি কাম্য। কবর জিয়ারত থেকে শুরু করে দোকান উদ্বোধন করা পর্যন্ত হাসান হুজুরের উপস্থিতি আছেই। মানুষের আস্থাভাজন আর বিশ্বস্তের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছেন তিনি। গত ছয় মাসে এলাকায় বেশ ভালোই নামডাক কামিয়েছেন। মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। সব মিলিয়ে আমিও মোটামুটি হাসান সাহেবকে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম। ভক্ত বনে গেলাম। কয়েকবার দাওয়াতেও এনেছি তাকে। তার হাতে মোনাজাতের ভারও দিয়েছি। আমার আব্বা-আম্মা আর আত্মীয়-স্বজনদের জন্য দোয়া করিয়েছি। তিনিও খুব ভালোভাবেই দোয়া করলেন। কেঁদেকেটে, দোয়া-দরুদ পড়ে, চোখের পানি নাকের পানি এক করে দোয়া শেষ করলেন। বেশ সুরেলা কণ্ঠ। তেলাওয়াতে কী টান। একেবারে মনকাড়া!
অথচ এ মানুষটার আচরণে সেদিন আমার চোখ কপালে উঠল! সত্যিই কি তিনি এমন? নাকি আমিই ভুল! যদি আমার ধারণা ঠিক হয়, তাহলে মেয়েটার মায়ের নজরে এল না কেন?
নিজের মেয়ে তো! নিজের মেয়েকে কেউ এমন করবে তা তো কোনো মা-ই সহ্য করবে না!
না, না...আমারই ভুল। হুজুরের প্রতি এমন সন্দেহ আনা ঠিক হচ্ছে না।
তবু ব্যাপারটা নিয়ে আমার বন্ধু সিয়ামের সাথে আলাপ করলাম।
-তুই পাগল হইছত? হুজুরের প্রতি তোর এ ধারণা করাও তো গোনাহ! জঘন্য কাজ!
বন্ধুর এ রিঅ্যাক্ট শুনে আমি থ হয়ে গেলাম। আসলেই তো কথা ঠিক। সবাই যাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করে, শ্রদ্ধা করে, তাকেই কিনা আমি সন্দেহ করতে লাগলাম। ধেৎ! কী মানুষ আমি।
রাত গভীর হতে চলল...
পেয়ালায় আরেকটা চুমুক দিলাম। ভাবনার দেয়ালজুড়ে বিভীষিকাময় সে দৃশ্য ক্রমাগত ভেসে আসছে। পেছনের দেয়ালজুড়ে এঁকে যাচ্ছে তার পুরোনো সব দৃশ্য!
সকালবেলায় সুরেলা কণ্ঠে ছোট ছোট বাচ্চাদের কোরআন তেলাওয়াতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো গ্রাম। ঢুলুঢুলু দেহে কাতর চোখে দলবেঁধে বাচ্চারা মসজিদমুখী হয়। কোনো কোনো ছেলেমেয়ের কচি হাতে শোভা পায় জায়নামাজ। মসজিদে গিয়ে স্ব স্ব স্থানে বসে পড়ে কোরআন শরিফ কিংবা কায়দা নিয়ে। তাদেরকে গ্রুপ করে বসানো হয়। তারপর আউজুবিল্লাহ-বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু হয় দিনের প্রথম পাঠ। শয়তান থেকে স্রষ্টার কাছে আশ্রয় চেয়ে প্রভুর পাঠ দিয়ে দিন আরম্ভ হয়...
দৃশ্যগুলো আর কাজের প্রারম্ভটা খুবই যুক্তিসংগত। নীতিনৈতিকতা শেখানোর মধ্য দিয়ে জানানো হয়, তুমি এটা করবে, ওটা করবে না। খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে আর ভালো কাজ করবে।
হাসান সাহেবের মুখের কথাগুলোই কচিকাঁচা ছেলেমেয়েরা শিখতে থাকে। তার উচ্চারণের সাথে উচ্চারণ করে, তার প্রতিটি কথা মুখস্থ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কি শীত! কি বর্ষা!! সবকিছুকে উপেক্ষা করেই ছেলেমেয়েরা হুজুরের কাছে এসে দিনের প্রথম পাঠ শিখে যায়...
হাদিয়া দেওয়া সুন্নত, নেওয়া সুন্নত। আজকের দান আগামীর জন্য ব্যাংক-ব্যালেন্স। হাশরের দিন মুক্তি পেতে চান না? নাজাতের জন্য দরজা খুলতে চান না? আজকের এক টাকা দানকে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন লক্ষকোটি টাকায় বৃদ্ধি করে দিবেন...
কী চমৎকার চমৎকার বয়ান। মানুষ শোনে, আর সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। জাহান্নামের আলোচনা শুনে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারে না।
ক্যারিশমা। এ সমাজের দেয়ালজুড়ে ক্যারিশমা লেগে থাকে। যে যত ক্যারিশমা জানে, তার ভক্তের অভাব হয় না। আর সে ক্যারিশমা যদি হয় ধর্মকে আশ্রয় করে, তাহলে তো কথাই নাই! জিরো থেকে হিরো হওয়া কোনো ব্যাপারই না। বিনা পুঁজিতে ব্যবসা সফল... যে ব্যবসা কোনো দিনও লোকসানের মুখ দেখবে না। একটা লম্বা জুব্বা, বড় একটা টুপি আর লম্বা লম্বা দাড়ি। ব্যস! হয়ে গেল ব্যবসার বাহ্যিক রূপ। তারপর ধর্মীয় গ্রন্থের কিছু সুবিধাজনক আয়াত আর সুবিধাজনক কিছু হাদিস আর নবী-রাসুলের কিছু কাহিনি...হয়ে গেল ব্যবসার মূলধন। এবার মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবহারের অভিনয় শুরু করা যায়। মানুষও হুজুরের কথায় সাড়া দেয়। পুণ্যের আশায় হুজুরকে দাওয়াত করে খাওয়ায়, হাদিয়া দেয়, হুজুরের দোয়া নেয়। ঘরের বালা-মুসিবত দূর করার জন্য বাড়িতে এনে বিশেষভাবে খাতির-যত্ন করে।
বুকের ভেতর থেকে বড় একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে এল। পেয়ালার কফি কতটুকু কমেছে, সেদিকে খেয়াল নেই। অন্ধকারের ভেতর পায়চারি করছি। জানালার পাশে বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বললামÑ
অন্ধকার, তোর বুক ছিঁড়ে কখনো কি দীর্ঘশ্বাস বের হয়েছে?
সাদা ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে মানুষটি হেঁটে যায়। মাঝারি ধরনের টুপি আর ছোট্ট একটি তসবিহ হাতের মুঠোয় ভরে রাখে। সব সময় ঠোঁট নড়ে। আতরের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে পাশকেটে যাওয়া প্রতিটি মানুষের নাকের ডগায়।
Ñআসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন? হুজুর।
Ñআলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ ভালো রাখছেন।
Ñদোয়া কইরেন, হুজুর।
Ñইনশা আল্লাহ।
যতদূর যায় সালাম আর দোয়া চাওয়ার লোকের অভাব হয় না। কী সম্মান! কী ইজ্জত!! যেন সবার মাথার তাজ!!!
হাসান সাহেবই যেন পুরো গ্রামের শান্তির দূত। আল্লাহকে পেতে হলে, আল্লাহর কাছাকাছি যেতে হলে, আল্লাহর রহমত পেতে হলে হাসান হুজুরের মাধ্যম লাগবেই। তিনি ছাড়া কোনোভাবেই দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা নাই। সবাই মনে করে, তারা নিজেরাই গোনাহগার। আল্লাহর অবাধ্য বান্দা। সুরা-কেরাত জানে না। যা জানে তাও আবার অশুদ্ধ। আর গোনাহগারের ডাক কি আল্লাহ শুনবেন? দোয়া কি কবুল করবেন! সে জন্য হাসান হুজুর ছাড়া কোনোভাবেই দোয়া কবুল হবে না।
মাথাটা টনটন করে উঠল। কেমন যেন বিষাদে ছেয়ে গেল পুরো দেহ। ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে, পেয়ালার সবটুকু গাঢ় জল শেষ হয়ে গেছে। একবিন্দু কফিও আর বাকি নেই। কপালে ভাঁজ পড়ে গেল...
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ছে অসাধু আর ধর্ম ব্যবসায়ী লোক। ধর্মান্ধরা তাদের অনুসরণ করেই চলছে। যাচাই-বাছাই ছাড়া এসব লোকের পেছনে নামাজ পড়ছে। তাদের কথায় হাদিয়া তোহফা দিয়ে দোয়া নিচ্ছে! আর ভাবছে, এদেরকে খুশি করলেই আল্লাহ খুশি হবেন। বেহেশতে যাওয়া সহজ হবে...!
সেদিন ছিল মঙ্গলবার। দুপুরে সবাই খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামছে। চোখে ঘুমঘুম ভাব দেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
হঠাৎ ধরছি ধরছি করে আওয়াজ উঠল। এ বৃষ্টির মধ্যেই ভিজতে ভিজতে বাইরে নেমে পড়লাম। কী হলো আবার! পোলাপান এমনভাবে চিল্লাচ্ছে কেন?
খেয়াল করলাম, সবিতাদের বাড়ির দিকেই তো চিল্লানি শোনা যাচ্ছে। দ্রুত এগোতে লাগলাম। কী হলো আবার! চোরটোর ধরল নাকি?
সেখানে গিয়ে আমি আচমকা প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা খেলাম! স্বপ্ন না তো!
হাসান হুজুর গাছের সাথে বাঁধা!
চতুর্দিকে মানুষজন ভিড় করে আছে। পাশে সবিতার মাকে আরেকটি গাছের সাথে বাঁধা হয়েছে। যে যেভাবে পারে, সেভাবে বেদম লাথি আর চড়-থাপ্পড় দিয়ে যাচ্ছে। প্রমাণস্বরূপ ভিডিও ধারণ করা হয়েছে।
কিছুক্ষণ মূক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছিল। সেদিন তাহলে সবিতার মা এ জন্যই চুপ ছিল! সবিতার বাবার দূর পরবাসের পরিণাম তাহলে এটা? সবিতার মা নিজের মেয়ের সাথে অমন আচরণ করা তাহলে নিজেই সুযোগ করে দিল! নিজের যৌন লালসা মেটানোর জন্য ছোট্ট ওই মেয়েটাকেও হুজুরের চাহিদার কাছে সঁপে দিল!
তবু অন্ধকারের দেয়ালজুড়ে হঠাৎ আলো অনুভব করলাম। ভাবলাম, সমাজ পরিচ্ছন্নের জন্য তাহলে কিছু সচেতন যুবক এখনো সমাজে বাস করে...
গভীর অন্ধকার। নিশ্চুপ বসে আছি। হাত বাড়াই, দেখি না। কেবল নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে রাতের চারণভূমিতে একাই পায়চারি করছি। ঘুম আসছে না। অস্থিরতা কাটাতে ডিমলাইটটা জ্বালিয়ে কফি বানিয়ে নিলাম। আবার অন্ধকার করে দিলাম। এক হাতে কফি নিয়ে পেয়ালায় চুমুক দিতেই কপাল ভাঁজ হয়ে এল।
সেদিন হলোটা কী?
হাসান সাহেব মেয়েটার সাথে এমন করল কেন? অথচ মেয়েটার মা পাশেই দাঁড়ানো ছিল। তার এ জিনিসটা কি মায়ের চোখ
এড়িয়েই গেল?
সব সময় হাসিমাখা মুখ মানুষের হৃদয় কেড়ে নিতে হাসান সাহেবের জুড়ি নেই। সবার সাথে মিলমিশে থাকা, সালাম দিয়ে মানুষের মন জয় করায় ছিল তার ব্যাপক সুখ্যাতি। তার মতো এ রকম হুজুর পাওয়া দুষ্কর। শ’য়ে একজন। এলাকাবাসী ধন্য। যেকোনো দোয়া-মিলাদে হাসান হুজুরের উপস্থিতি কাম্য। কবর জিয়ারত থেকে শুরু করে দোকান উদ্বোধন করা পর্যন্ত হাসান হুজুরের উপস্থিতি আছেই। মানুষের আস্থাভাজন আর বিশ্বস্তের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছেন তিনি। গত ছয় মাসে এলাকায় বেশ ভালোই নামডাক কামিয়েছেন। মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। সব মিলিয়ে আমিও মোটামুটি হাসান সাহেবকে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম। ভক্ত বনে গেলাম। কয়েকবার দাওয়াতেও এনেছি তাকে। তার হাতে মোনাজাতের ভারও দিয়েছি। আমার আব্বা-আম্মা আর আত্মীয়-স্বজনদের জন্য দোয়া করিয়েছি। তিনিও খুব ভালোভাবেই দোয়া করলেন। কেঁদেকেটে, দোয়া-দরুদ পড়ে, চোখের পানি নাকের পানি এক করে দোয়া শেষ করলেন। বেশ সুরেলা কণ্ঠ। তেলাওয়াতে কী টান। একেবারে মনকাড়া!
অথচ এ মানুষটার আচরণে সেদিন আমার চোখ কপালে উঠল! সত্যিই কি তিনি এমন? নাকি আমিই ভুল! যদি আমার ধারণা ঠিক হয়, তাহলে মেয়েটার মায়ের নজরে এল না কেন?
নিজের মেয়ে তো! নিজের মেয়েকে কেউ এমন করবে তা তো কোনো মা-ই সহ্য করবে না!
না, না...আমারই ভুল। হুজুরের প্রতি এমন সন্দেহ আনা ঠিক হচ্ছে না।
তবু ব্যাপারটা নিয়ে আমার বন্ধু সিয়ামের সাথে আলাপ করলাম।
-তুই পাগল হইছত? হুজুরের প্রতি তোর এ ধারণা করাও তো গোনাহ! জঘন্য কাজ!
বন্ধুর এ রিঅ্যাক্ট শুনে আমি থ হয়ে গেলাম। আসলেই তো কথা ঠিক। সবাই যাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করে, শ্রদ্ধা করে, তাকেই কিনা আমি সন্দেহ করতে লাগলাম। ধেৎ! কী মানুষ আমি।
রাত গভীর হতে চলল...
পেয়ালায় আরেকটা চুমুক দিলাম। ভাবনার দেয়ালজুড়ে বিভীষিকাময় সে দৃশ্য ক্রমাগত ভেসে আসছে। পেছনের দেয়ালজুড়ে এঁকে যাচ্ছে তার পুরোনো সব দৃশ্য!
সকালবেলায় সুরেলা কণ্ঠে ছোট ছোট বাচ্চাদের কোরআন তেলাওয়াতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো গ্রাম। ঢুলুঢুলু দেহে কাতর চোখে দলবেঁধে বাচ্চারা মসজিদমুখী হয়। কোনো কোনো ছেলেমেয়ের কচি হাতে শোভা পায় জায়নামাজ। মসজিদে গিয়ে স্ব স্ব স্থানে বসে পড়ে কোরআন শরিফ কিংবা কায়দা নিয়ে। তাদেরকে গ্রুপ করে বসানো হয়। তারপর আউজুবিল্লাহ-বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু হয় দিনের প্রথম পাঠ। শয়তান থেকে স্রষ্টার কাছে আশ্রয় চেয়ে প্রভুর পাঠ দিয়ে দিন আরম্ভ হয়...
দৃশ্যগুলো আর কাজের প্রারম্ভটা খুবই যুক্তিসংগত। নীতিনৈতিকতা শেখানোর মধ্য দিয়ে জানানো হয়, তুমি এটা করবে, ওটা করবে না। খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে আর ভালো কাজ করবে।
হাসান সাহেবের মুখের কথাগুলোই কচিকাঁচা ছেলেমেয়েরা শিখতে থাকে। তার উচ্চারণের সাথে উচ্চারণ করে, তার প্রতিটি কথা মুখস্থ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কি শীত! কি বর্ষা!! সবকিছুকে উপেক্ষা করেই ছেলেমেয়েরা হুজুরের কাছে এসে দিনের প্রথম পাঠ শিখে যায়...
হাদিয়া দেওয়া সুন্নত, নেওয়া সুন্নত। আজকের দান আগামীর জন্য ব্যাংক-ব্যালেন্স। হাশরের দিন মুক্তি পেতে চান না? নাজাতের জন্য দরজা খুলতে চান না? আজকের এক টাকা দানকে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন লক্ষকোটি টাকায় বৃদ্ধি করে দিবেন...
কী চমৎকার চমৎকার বয়ান। মানুষ শোনে, আর সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। জাহান্নামের আলোচনা শুনে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারে না।
ক্যারিশমা। এ সমাজের দেয়ালজুড়ে ক্যারিশমা লেগে থাকে। যে যত ক্যারিশমা জানে, তার ভক্তের অভাব হয় না। আর সে ক্যারিশমা যদি হয় ধর্মকে আশ্রয় করে, তাহলে তো কথাই নাই! জিরো থেকে হিরো হওয়া কোনো ব্যাপারই না। বিনা পুঁজিতে ব্যবসা সফল... যে ব্যবসা কোনো দিনও লোকসানের মুখ দেখবে না। একটা লম্বা জুব্বা, বড় একটা টুপি আর লম্বা লম্বা দাড়ি। ব্যস! হয়ে গেল ব্যবসার বাহ্যিক রূপ। তারপর ধর্মীয় গ্রন্থের কিছু সুবিধাজনক আয়াত আর সুবিধাজনক কিছু হাদিস আর নবী-রাসুলের কিছু কাহিনি...হয়ে গেল ব্যবসার মূলধন। এবার মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবহারের অভিনয় শুরু করা যায়। মানুষও হুজুরের কথায় সাড়া দেয়। পুণ্যের আশায় হুজুরকে দাওয়াত করে খাওয়ায়, হাদিয়া দেয়, হুজুরের দোয়া নেয়। ঘরের বালা-মুসিবত দূর করার জন্য বাড়িতে এনে বিশেষভাবে খাতির-যত্ন করে।
বুকের ভেতর থেকে বড় একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে এল। পেয়ালার কফি কতটুকু কমেছে, সেদিকে খেয়াল নেই। অন্ধকারের ভেতর পায়চারি করছি। জানালার পাশে বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বললামÑ
অন্ধকার, তোর বুক ছিঁড়ে কখনো কি দীর্ঘশ্বাস বের হয়েছে?
সাদা ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে মানুষটি হেঁটে যায়। মাঝারি ধরনের টুপি আর ছোট্ট একটি তসবিহ হাতের মুঠোয় ভরে রাখে। সব সময় ঠোঁট নড়ে। আতরের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে পাশকেটে যাওয়া প্রতিটি মানুষের নাকের ডগায়।
Ñআসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন? হুজুর।
Ñআলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ ভালো রাখছেন।
Ñদোয়া কইরেন, হুজুর।
Ñইনশা আল্লাহ।
যতদূর যায় সালাম আর দোয়া চাওয়ার লোকের অভাব হয় না। কী সম্মান! কী ইজ্জত!! যেন সবার মাথার তাজ!!!
হাসান সাহেবই যেন পুরো গ্রামের শান্তির দূত। আল্লাহকে পেতে হলে, আল্লাহর কাছাকাছি যেতে হলে, আল্লাহর রহমত পেতে হলে হাসান হুজুরের মাধ্যম লাগবেই। তিনি ছাড়া কোনোভাবেই দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা নাই। সবাই মনে করে, তারা নিজেরাই গোনাহগার। আল্লাহর অবাধ্য বান্দা। সুরা-কেরাত জানে না। যা জানে তাও আবার অশুদ্ধ। আর গোনাহগারের ডাক কি আল্লাহ শুনবেন? দোয়া কি কবুল করবেন! সে জন্য হাসান হুজুর ছাড়া কোনোভাবেই দোয়া কবুল হবে না।
মাথাটা টনটন করে উঠল। কেমন যেন বিষাদে ছেয়ে গেল পুরো দেহ। ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে, পেয়ালার সবটুকু গাঢ় জল শেষ হয়ে গেছে। একবিন্দু কফিও আর বাকি নেই। কপালে ভাঁজ পড়ে গেল...
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ছে অসাধু আর ধর্ম ব্যবসায়ী লোক। ধর্মান্ধরা তাদের অনুসরণ করেই চলছে। যাচাই-বাছাই ছাড়া এসব লোকের পেছনে নামাজ পড়ছে। তাদের কথায় হাদিয়া তোহফা দিয়ে দোয়া নিচ্ছে! আর ভাবছে, এদেরকে খুশি করলেই আল্লাহ খুশি হবেন। বেহেশতে যাওয়া সহজ হবে...!
সেদিন ছিল মঙ্গলবার। দুপুরে সবাই খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামছে। চোখে ঘুমঘুম ভাব দেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
হঠাৎ ধরছি ধরছি করে আওয়াজ উঠল। এ বৃষ্টির মধ্যেই ভিজতে ভিজতে বাইরে নেমে পড়লাম। কী হলো আবার! পোলাপান এমনভাবে চিল্লাচ্ছে কেন?
খেয়াল করলাম, সবিতাদের বাড়ির দিকেই তো চিল্লানি শোনা যাচ্ছে। দ্রুত এগোতে লাগলাম। কী হলো আবার! চোরটোর ধরল নাকি?
সেখানে গিয়ে আমি আচমকা প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা খেলাম! স্বপ্ন না তো!
হাসান হুজুর গাছের সাথে বাঁধা!
চতুর্দিকে মানুষজন ভিড় করে আছে। পাশে সবিতার মাকে আরেকটি গাছের সাথে বাঁধা হয়েছে। যে যেভাবে পারে, সেভাবে বেদম লাথি আর চড়-থাপ্পড় দিয়ে যাচ্ছে। প্রমাণস্বরূপ ভিডিও ধারণ করা হয়েছে।
কিছুক্ষণ মূক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছিল। সেদিন তাহলে সবিতার মা এ জন্যই চুপ ছিল! সবিতার বাবার দূর পরবাসের পরিণাম তাহলে এটা? সবিতার মা নিজের মেয়ের সাথে অমন আচরণ করা তাহলে নিজেই সুযোগ করে দিল! নিজের যৌন লালসা মেটানোর জন্য ছোট্ট ওই মেয়েটাকেও হুজুরের চাহিদার কাছে সঁপে দিল!
তবু অন্ধকারের দেয়ালজুড়ে হঠাৎ আলো অনুভব করলাম। ভাবলাম, সমাজ পরিচ্ছন্নের জন্য তাহলে কিছু সচেতন যুবক এখনো সমাজে বাস করে...