দেশের জন্য প্রবাসীদের মায়া অন্যদের চেয়ে একটু বেশী। একজন প্রবাসী নিজে না খেয়ে হলেও দেশে পরিবার-স্বজনদের মুখে আহার তুলে দেন। বলতে গেলে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে খেয়ে না খেয়ে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সেই দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু সেই প্রবাসী বা রেমিট্যান্সযোদ্ধাদেরই এখন ঢালাওভাবে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। দেশে হুন্ডি ব্যবসার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটলেও সরকার কোনোভাবেই তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ফলে দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের ‘পাচারকারী’ বলতে ন্যুনতম দ্বিধা করছে না। অথচ দেশ থেকে হুন্ডির টাকাই বৈধপথে রেমিট্যান্স হয়ে দেশে ফিরছে। রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবাহ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় এখন যেসব প্রবাসী বৈধভাবে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন তারাও যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের নজরে পড়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে অস্বাভাবিক রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবাহ। যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগ বিভিন্ন ব্যক্তির সম্পদের খোঁজ খবর নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
গত বছরের ২৭ জুলাই সংখ্যায় প্রবাসের প্রাচীনতম পত্রিকা ঠিকানা’য় ‘ডলার ইন, টাকা আউট’ শিরোনামে প্রধান খবর ছাপা হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে দেশের টাকা পাচার হয়ে বিদেশ যাচ্ছে। পরে তা রেমিট্যান্স হয়ে দেশে ফিরছে। অর্থাৎ হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হওয়া টাকা নানা কৌশলে বৈধ হচ্ছে। দেরীতে হলেও ঠিকানার প্রতিদেনই সত্যি হয়েছে।
এদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা প্রবাসীদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়েন সঙ্গতি খুঁজতে শুরু করছে। কানাডার মত যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে প্রবাসীদের আয় ও সম্পদের খোঁজ চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোর (ইউএসসিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের শেষে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ ৬৪ হাজার। এর মধ্যে কর্মসংস্থান হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজারের কিছু বেশির। দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের খানাপিছু গড় বার্ষিক আয় ৬৮ হাজার ডলারের কিছু কম।
ইউএস ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিস্টিকসের (্ইউএসবিএলএস) হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে ২০২১ সালে মাথাপিছু গড় ব্যয় ছিল প্রায় ৬৭ হাজার ডলার। সে অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি উপার্জনকারীরা গোটা বছরজুড়ে আয় করেছেন দেশটির গড় ব্যয়ের চেয়ে সামান্য বেশি। এ হিসাব আমলে নিলে বাংলাদেশি পরিবারগুলোর উদ্বৃত্ত বা সঞ্চয়ও খুব বেশি হওয়ার কথা না। যদিও এ যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিরাই এখন দেশের রেমিট্যান্সের সবচেয়ে বড় উৎস।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স গেছে ৩০৪ কোটি ৭৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। সে অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যেক বাংলাদেশি প্রতি মাসে গড়ে ২ হাজার ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বাংলাদেশে। যদিও সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের বক্তব্য হলো প্রতি মাসে জীবনযাপনের ব্যয় বহন করে দেশে ২ হাজার ডলার পাঠানো বেশির ভাগ বাংলাদেশি প্রবাসীর পক্ষেই প্রায় অসম্ভব।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সৌদি আরবে শ্রমিক হিসেবে গিয়েছেন ৫৪ লাখের বেশি বাংলাদেশি। এছাড়া দক্ষ পেশাজীবী হিসেবেও সেখানে অবস্থান করছেন আরো অনেকে। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এ বিপুলসংখ্যক সৌদিপ্রবাসী বাংলাদেশির চেয়েও বেশি অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসীরা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বাংলাদেশিদের বড় একটি অংশ সেখানে আছেন শিক্ষার্থী হিসাবে। শিক্ষার্থীদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি ও সেখানে বসবাসের খরচ বহন করে দেশে এত বিপুল অংকের অর্থ পাঠানো সম্ভব নয়। উপরন্তু দেশটিতে মূল্যস্ফীতি এখন প্রকট আকার নিয়েছে। এ মূল্যস্ফীতির কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সম্প্রতি আগ্রাসী মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের পথ থেকে সরে এসেছে। সে হিসেবে দেশটি থেকে এত বিপুল পরিমাণ অংক বাংলাদেশে রেমিট্যান্স হিসেবে আসার বিষয়টি বিস্ময়কর।
অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সকে সন্দেহের চোখে দেখে আসছেন ব্যাংক নির্বাহীরা। দেশের একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে, সেটি দেখে তারা নিজেরাও বিস্মিত। হঠাৎ করে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেটি বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ব্যাংকগুলো মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে রেমিট্যান্স কিনে নেয়। মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান কী প্রক্রিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ডলার কিনছে, সেটি জানা সম্ভব নয়।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে হঠাৎ রেমিট্যান্স আসা বেড়ে যাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বিষয়টিকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে ব্যাখ্যা করে পাচারের অর্থ রেমিট্যান্স হয়ে দেশে ফিরছে কিনা, এ প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি। সম্প্রতি সিপিডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, এটা একেবারেই আনইউজাল, কখনোই হয় না। কারণ, আমরা জানি আমাদের বেশিরভাগ রেমিট্যান্স মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে। গত ১০ মাসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৯ দশমিক ২২ লাখ মানুষ গেছে।
সেখান থেকে প্রত্যাশা মতো রেমিট্যান্স আসছে না। লোক যাওয়া ও রেমিট্যান্সের মধ্যে মিসম্যাচ হচ্ছে। এতদিন সৌদি আরব থেকে বেশি রেমিট্যান্স এলেও যুক্তরাষ্ট্র এখন সে জায়গা দখল করেছে। সিপিডি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সৌদি থেকে ৩.৮৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এলেও চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৩.০৪ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার, চলতি বছরের একই সময়ে তা বেড়ে ৩ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিকে সন্দেহের চোখে দেখছে সিপিডি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যারা যায় তাদের বেশিরভাগই হোয়াইট কালার জব করে। অনেকেই ঘরবাড়ি ও জমিজমা বিক্রি করে দেশ থেকে টাকা নিয়ে চলে যায়। অনেক শিক্ষার্থীও সে দেশে আছে। তারা তো আর টাকা পাঠাতে পারে না। তাহলে বিপুল এ রেমিট্যান্স আসছে কোথা থেকে! তিনি বলেন, এর একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে এমন- যেখান থেকে টাকাটা পাচার হয়েছে সেটা আবার রেমিট্যান্স হয়ে দেশে ফেরত আসছে। রেমিট্যান্সের ওপর যে আড়াই শতাংশ ইনসেন্টিভ বা সাবসিডি দেয়া হচ্ছে সেটার সুযোগ নেয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষকে আরও গভীরে গিয়ে বিষয়টির অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বৃহস্পতিবার বিআইডিএস আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, সরকার এবং ব্যাংক চাইলেও হুন্ডির সঙ্গে পারা সম্ভব নয়। হুন্ডিকে কীভাবে প্রপার চ্যানেলে আনা যায় সেজন্য ভারতকে অনুসরণ করে অ্যাপসের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আনার কাজ করা হচ্ছে।
প্রবাসীরা বলছেন, দেশে হুন্ডি বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারের। অথচ সরকার সেটি করতে ব্যর্থ হওয়ায় এখন সকল প্রবাসী সন্দেহের চোখে পড়ছেন। তাদের মতে, পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে তারা কষ্টার্জিত অর্থই দেশে পাঠান। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা অস্বচ্ছতা থাকে, যেমন একটি পরিবার যা আয় করে তার সবটুকু ট্যাক্স ফাইলে অন্তর্ভূক্ত করেন না। ওই বাড়তি অর্থটুকু সারা বছর ধরে দেশে পাঠান বৈধভাবে। কিন্তু সম্প্রতি অস্বাভাবিক রেমিট্যান্সের কারণে সবাই সন্দেহের চোখে দেখছেন। সরকার হুন্ডি বন্ধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে সাধারণ প্রবাসীরাও ভয়ে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দেবেন। এতে করে বৈধ পথেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাবে। এর বিরূপ পড়বে দেশের অর্থনীতিতে।
গত বছরের ২৭ জুলাই সংখ্যায় প্রবাসের প্রাচীনতম পত্রিকা ঠিকানা’য় ‘ডলার ইন, টাকা আউট’ শিরোনামে প্রধান খবর ছাপা হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে দেশের টাকা পাচার হয়ে বিদেশ যাচ্ছে। পরে তা রেমিট্যান্স হয়ে দেশে ফিরছে। অর্থাৎ হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হওয়া টাকা নানা কৌশলে বৈধ হচ্ছে। দেরীতে হলেও ঠিকানার প্রতিদেনই সত্যি হয়েছে।
এদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা প্রবাসীদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়েন সঙ্গতি খুঁজতে শুরু করছে। কানাডার মত যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে প্রবাসীদের আয় ও সম্পদের খোঁজ চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোর (ইউএসসিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের শেষে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ ৬৪ হাজার। এর মধ্যে কর্মসংস্থান হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজারের কিছু বেশির। দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের খানাপিছু গড় বার্ষিক আয় ৬৮ হাজার ডলারের কিছু কম।
ইউএস ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিস্টিকসের (্ইউএসবিএলএস) হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে ২০২১ সালে মাথাপিছু গড় ব্যয় ছিল প্রায় ৬৭ হাজার ডলার। সে অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি উপার্জনকারীরা গোটা বছরজুড়ে আয় করেছেন দেশটির গড় ব্যয়ের চেয়ে সামান্য বেশি। এ হিসাব আমলে নিলে বাংলাদেশি পরিবারগুলোর উদ্বৃত্ত বা সঞ্চয়ও খুব বেশি হওয়ার কথা না। যদিও এ যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিরাই এখন দেশের রেমিট্যান্সের সবচেয়ে বড় উৎস।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স গেছে ৩০৪ কোটি ৭৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। সে অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যেক বাংলাদেশি প্রতি মাসে গড়ে ২ হাজার ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বাংলাদেশে। যদিও সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের বক্তব্য হলো প্রতি মাসে জীবনযাপনের ব্যয় বহন করে দেশে ২ হাজার ডলার পাঠানো বেশির ভাগ বাংলাদেশি প্রবাসীর পক্ষেই প্রায় অসম্ভব।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সৌদি আরবে শ্রমিক হিসেবে গিয়েছেন ৫৪ লাখের বেশি বাংলাদেশি। এছাড়া দক্ষ পেশাজীবী হিসেবেও সেখানে অবস্থান করছেন আরো অনেকে। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এ বিপুলসংখ্যক সৌদিপ্রবাসী বাংলাদেশির চেয়েও বেশি অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসীরা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বাংলাদেশিদের বড় একটি অংশ সেখানে আছেন শিক্ষার্থী হিসাবে। শিক্ষার্থীদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি ও সেখানে বসবাসের খরচ বহন করে দেশে এত বিপুল অংকের অর্থ পাঠানো সম্ভব নয়। উপরন্তু দেশটিতে মূল্যস্ফীতি এখন প্রকট আকার নিয়েছে। এ মূল্যস্ফীতির কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সম্প্রতি আগ্রাসী মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের পথ থেকে সরে এসেছে। সে হিসেবে দেশটি থেকে এত বিপুল পরিমাণ অংক বাংলাদেশে রেমিট্যান্স হিসেবে আসার বিষয়টি বিস্ময়কর।
অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সকে সন্দেহের চোখে দেখে আসছেন ব্যাংক নির্বাহীরা। দেশের একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে, সেটি দেখে তারা নিজেরাও বিস্মিত। হঠাৎ করে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেটি বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ব্যাংকগুলো মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে রেমিট্যান্স কিনে নেয়। মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান কী প্রক্রিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ডলার কিনছে, সেটি জানা সম্ভব নয়।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে হঠাৎ রেমিট্যান্স আসা বেড়ে যাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বিষয়টিকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে ব্যাখ্যা করে পাচারের অর্থ রেমিট্যান্স হয়ে দেশে ফিরছে কিনা, এ প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি। সম্প্রতি সিপিডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, এটা একেবারেই আনইউজাল, কখনোই হয় না। কারণ, আমরা জানি আমাদের বেশিরভাগ রেমিট্যান্স মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে। গত ১০ মাসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৯ দশমিক ২২ লাখ মানুষ গেছে।
সেখান থেকে প্রত্যাশা মতো রেমিট্যান্স আসছে না। লোক যাওয়া ও রেমিট্যান্সের মধ্যে মিসম্যাচ হচ্ছে। এতদিন সৌদি আরব থেকে বেশি রেমিট্যান্স এলেও যুক্তরাষ্ট্র এখন সে জায়গা দখল করেছে। সিপিডি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সৌদি থেকে ৩.৮৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এলেও চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৩.০৪ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার, চলতি বছরের একই সময়ে তা বেড়ে ৩ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিকে সন্দেহের চোখে দেখছে সিপিডি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যারা যায় তাদের বেশিরভাগই হোয়াইট কালার জব করে। অনেকেই ঘরবাড়ি ও জমিজমা বিক্রি করে দেশ থেকে টাকা নিয়ে চলে যায়। অনেক শিক্ষার্থীও সে দেশে আছে। তারা তো আর টাকা পাঠাতে পারে না। তাহলে বিপুল এ রেমিট্যান্স আসছে কোথা থেকে! তিনি বলেন, এর একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে এমন- যেখান থেকে টাকাটা পাচার হয়েছে সেটা আবার রেমিট্যান্স হয়ে দেশে ফেরত আসছে। রেমিট্যান্সের ওপর যে আড়াই শতাংশ ইনসেন্টিভ বা সাবসিডি দেয়া হচ্ছে সেটার সুযোগ নেয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষকে আরও গভীরে গিয়ে বিষয়টির অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বৃহস্পতিবার বিআইডিএস আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, সরকার এবং ব্যাংক চাইলেও হুন্ডির সঙ্গে পারা সম্ভব নয়। হুন্ডিকে কীভাবে প্রপার চ্যানেলে আনা যায় সেজন্য ভারতকে অনুসরণ করে অ্যাপসের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আনার কাজ করা হচ্ছে।
প্রবাসীরা বলছেন, দেশে হুন্ডি বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারের। অথচ সরকার সেটি করতে ব্যর্থ হওয়ায় এখন সকল প্রবাসী সন্দেহের চোখে পড়ছেন। তাদের মতে, পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে তারা কষ্টার্জিত অর্থই দেশে পাঠান। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা অস্বচ্ছতা থাকে, যেমন একটি পরিবার যা আয় করে তার সবটুকু ট্যাক্স ফাইলে অন্তর্ভূক্ত করেন না। ওই বাড়তি অর্থটুকু সারা বছর ধরে দেশে পাঠান বৈধভাবে। কিন্তু সম্প্রতি অস্বাভাবিক রেমিট্যান্সের কারণে সবাই সন্দেহের চোখে দেখছেন। সরকার হুন্ডি বন্ধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে সাধারণ প্রবাসীরাও ভয়ে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দেবেন। এতে করে বৈধ পথেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাবে। এর বিরূপ পড়বে দেশের অর্থনীতিতে।