মোহাম্মদ সোহরাব আলী
কোটন কাকা, এটা কি রশিদ দারোগার বাড়ি?
হ্যাঁ! তুই আমেরিকা থেকে এসে সব ভুলে গেলি নাকি?
না, ভুলি নাই। তবে রশিদ দারোগা আবার পাঁচতলা বিল্ডিং করল কবে?
চার-পাঁচ বছর আগে।
ওমা! কত সুন্দর টাইলস করা, কত সুন্দর দরজা ও জানালা, কী সুন্দর করে রং করছে, কত চকচক ঝকঝক করছে, চারপাশে কী সুন্দর লাইট জ্বলছে। কী সুন্দর ফেনসি বিল্ডিং। মনে হচ্ছে শহরেও এমন বিল্ডিং কমই আছে।
কোটন কাকা বলল, বাপু শোন, এখন গ্রাম আর শহরের মধ্যে তেমন পার্থক্য নাই। গ্রামের লোকেরা শহরের লোকের মতো ব্যস্ত হয়ে গেছে। তারা একে অপরের সাথে আর সেই আগের মতো গল্পগুজব করার সময় পায় না। অনেক সময় পরিচিত লোক দেখলেও না দেখার ভান করে পাশ কেটে চলে যায়।
মানুষ বাপু ওই মডার্ন নাকি যেন কয়, সেটা হয়েছে। আমরা বাপু তেমন পড়ালেখা জানি না। মডার্ন কী বুঝি না। তবে নিত্যনতুন পোশাক-পরিচ্ছেদ দেখি ছেলেমেয়েরা পরিধান করে। আগে গ্রামের মেয়েরা কত সুন্দর গ্রাম্য পোশাক পরিধান করত। এখন বাপু কেউ ছেলেদের মতো ফুলপ্যান্ট পরে। কত কী যে দেখি বাপু। আমরা কিছু বললে লোকেরা ভুল ধরবে। তাই চুপ করে থাকি আর মাঝে মাঝে এই পোশাক-পরিচ্ছেদ পরিধান দেখে বলি কী কলির যুগই এল গ্রামে। এগুলো বাপু শহরে মানায় কিন্তু গ্রামে দৃষ্টকটু মনে হয়।
বাপু, তুমি তো আর গ্রামে থাকো না, খোঁজখবরও রাখো না। বাপু, আগে দেখতাম গ্রামের মায়েরা শাড়ি পরিধান করে বাইরে বের হলে মাথায় কাপড় দিয়ে ঘোমটা দিয়ে যেত। এ যুগে তারা শাড়ি পরিধান করা একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। মায়েরা শহরের মায়েদের মতো থ্রি-পিস পরে, ম্যাক্সি পরে। বাপু, আরও কত কী পরিধান করে, আমি সবকিছুর নাম জানি না।
আগে আমরা তপন পরে স্কুলে যেতাম আর এখন ছেলেমেয়েরা শহরের মতো সবাই এক ড্রেস পরিধান করে স্কুলে যায়।
কোটন কাকা, তপন কী? হারে বাপু রে, এই জন্য তো বলি আমরা অশিক্ষিত মানুষ, আমাদের ভুল হয় বেশি। শিক্ষিত লোকেরা যেটা লুঙ্গি বলে। আগে প্রতিদিন তোমার চাচি গরম ভাত আর গরম তরকারি রান্না করত, তা খেয়ে কী মজা পেতাম। বাপু, এখন বাড়িতে একটা ফ্রিজ কিনেছে। গৃহিণীরা বলে আর কষ্ট করে প্রতিদিন রান্না করব না। তরকারি রান্না করে ফ্রিজে রাখে আর ভাত রান্না করে, মাঝে মাঝে আবার ফ্রিজ থেকে বের করে খেতে দেয়। বাপু, এগুলো শুনেছি শহরের মানুষ বেশি করে। আর সেই শহরের পরিবেশ গ্রামে এখন চলে এসেছে। বাপু, গ্রাম আর শহরের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তোমার চাচি টিউবওয়েল থেকে পানি তুলে দিত, কত আরাম করে গোসল করতাম। আর এখন সুইচ টিপ মারলে টপটপ করে কোথা থেকে পানি চলে আসে। সেই পানিতে গোসল করি।
গ্রামে আগে কত বড় বড় তালগাছ ছিল, সেই তালগাছে কত বাবুই পাখি বাসা বানাত, কত তাল খাওয়া হতো, কত তালগাছের পাতা দিয়ে হাতপাখা বানানো হতো, কত গাছপালা বন-জঙ্গলে ভরা ছিল, সেগুলো কেটে ফেলে দিয়ে শহরের মতো বড় বড় বিল্ডিং তৈরি করছে মানুষ। পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙত, কী সুন্দর মুক্ত বাতাস গায়ে এসে লাগত। গ্রাম আর শহরের মধ্যে তেমন পার্থক্য নাই। গ্রামের রাস্তাঘাট আগে ছিল কাঁচা। বৃষ্টি হলে পানি জমে কাদা হয়ে যেত। এখন গ্রামের রাস্তাঘাট শহরের মতো পাকা। লোকেরা এখন আর পায়ে হেঁটে অনেক দূরে যায় না। তারা শহরের মতো রিকশা ও গাড়িতে চলাফেরা করে। শহরের মতো গ্রামের লোকেরা হাতে হাতে ফোন ব্যবহার করে। এক পরিবারে চারজন সদস্য থাকলে ফোনও আছে চারটা। শহরের মতো গ্রামের ছেলেমেয়েরা ঘরে বসে কার্টুন দেখে। এখন গ্রামের বাচ্চারা শহরের বাচ্চাদের মতো সময় পেলেই টিভির সামনে বসে। গ্রাম শহর হয়ে গেছে, বাপু।
আগে গ্রামের বাড়িতে চুড়ি-মালা বিক্রি করার জন্য কত দোকানি আসত। বালতিতে করে ছুনু বিক্রি করত। আঠালো মাটি দিয়ে মাথা আর তিতপোল্লার খোসা দিয়ে গা ঘষত। সোডা দিয়ে জামাকাপড় পরিষ্কার করত, মাটির পাতিলে ভাত রান্না করত। আর মাটির সানকিতে খাওয়াদাওয়া করত। গ্রামে কুপিবাতি, চেরাগ ও হারিকেন ছিল। বাপু, গ্রাম যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। গ্রামের লোকেরা কসকো সাবান দিয়ে গোসল করে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে সাবানের গন্ধ নাকে ভেসে আসে। গ্রামের মেয়েরাও পারফিউম মেখে কোথায় বেড়াতে যায়। গ্রামে নতুন বছর পালন করে। রাতে মাঝে মাঝে আতশবাজি করে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা শহরের ছেলেমেয়েদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।
বাপজান, তোমার টগা কাকার ছেলে গ্রাম থেকে যেয়ে ও বুয়েটে চান্স পেয়েছে। গ্রামের ওই মোমিনপাড়া হাইস্কুলের সব ছাত্র শহরের স্কুলের মতো এ প্লাস পায়।
আগে গ্রামে কুমারেরা মাটির পাতিলের জিনিস বিক্রি করতে আসত, শিকারিরা ফাঁদ পেতে ঘুঘু ধরতে আসত। রাস্তার ওপর দুহি গান পাল্টাপাল্টি করে গাওয়া হতো। কত বেদেনি মাথায় করে কত কিছু যে গ্রামে এনে বিক্রি করত। রশিনিরা রস-বাত খসাত, গোয়ালেরা গৌ গৌ করে এসে গরুর ব্যায়া খুলত। সাপুড়েরা এসে সাপখেলা দেখাত। কুতকুত, বউচি, গোল্লাছুট, কানা মাছি ভোঁ ভোঁ, হাডুডু-কত রকমের খেলা গ্রামে ছিল। আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া পেয়ে সবকিছু বিলীন হয়ে গেছে। গ্রাম শহরে পরিণত হয়েছে। শহরের সাথে গ্রামের পার্থক্য কমে গেছে।
আগে গ্রামের লোকের মধ্যে কত আন্তরিকতা ছিল। একে অপরের বিপদে-আপদে পাশে এসে দাঁড়াত। এখন কেউ খগেন কাকার পার্টির লোক, কেউ নগেন কাকার পার্টির লোক। নগেন কাকার সাথে খগেন কাকা কথা বলে না, খগেন কাকার সাথে নগেন কাকার কথা চলে না। খগেন কাকা হুংকার দেয় বাঘের মতো আর নগেন কাকা হুংকার দেয় সিংহের মতো। গ্রাম হয়ে গেছে কলুষিত। এক গ্রামের লোকের সাথে আরেক গ্রামের লোকের ঝগড়া হয়। মারামারি হয়ে খুন-খারাবি পর্যন্ত ঘটে। পুলিশ এসে ভরে যায়, লোকেরা ভয়ে ভয়ে পালায়। শহরের মতো মানুষ একে অপরের সাথে কথা বলে না। একজন একতলা বিল্ডিং করলে আরেকজন দোতলা বিল্ডিং করে। শহরের লোকের মতো কোট-টাই পরিধান করে গোল্ডলিপ সিগারেট টানতে টানতে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে। ছেলেমেয়েরা শহরের ছেলেমেয়ের মতো স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। শহরের সবকিছু রন্ধ্রে রন্ধ্রে গ্রামে ঢুকে পড়েছে। গ্রাম আর শহরের মধ্যে পার্থক্যটা কমে যাচ্ছে।
শহরের লোকের মতো গ্রামের লোকেরা বড় বড় ফ্রিজ কেনে। কোরবানির সময় কোরবানি দিয়ে মাংস শহরের লোকের মতো ফ্রিজেও রাখে। শহরের মতো বাড়িঘর তালা দিয়ে রাখে। বাড়িঘর থাকে নিশ্চুপ। ভিক্ষুক বেলে কল করলে শহরের লোকের মতো মাঝে মাঝে বলে মাফ করো। শহরের মতো এখন গ্রামেও অনেক লোক মুরগি, মাছ ও সবজি বিক্রি করতে নিয়ে আসে। সেই গানের কথা মনে পড়ে-গ্রামের মধ্যে শহরের ভাব দেখা যাচ্ছে ভাই রে। গ্রাম ভরে যাচ্ছে কালো ধোঁয়াতে। এখন গ্রাম আর শহরের মধ্যে পার্থক্য নাই বললেই চলে।
গ্রামের অনুষ্ঠানগুলো গ্রামে না হয়ে চলে গেছে কমিউনিটি সেন্টারে। শহরের মতো গ্রামেও বিউটি পার্লার আছে। বিউটি পার্লারে গিয়ে সেজে কাক হয় ময়ূর। কী মডার্ন স্টাইলে ছেলেমেয়েরা শহরের ছেলেমেয়ের মতো চলাফেরা করে। শহরের সাথে গ্রামের ছেলেমেয়েরা তাল মিলিয়ে চলে। শহর ও গ্রামের মধ্যে পার্থক্য দিন দিন কমে আসছে।
শহরের মতো গ্রামে নিত্যনতুন কত মার্কেট বসছে। ঈদে গ্রামের লোকেরা সেই মার্কেটে গিয়ে বাজার করে। গ্রামের কিছু বাজারঘাট ও শহরের মতো অনেক রাত খোলা রাখে। গ্রামেও অনেক মাছের বাজার আছে। লোকজন তাদের সুবিধামতো গিয়ে মাছ কিনে আনে।
গ্রামেও শহরের মতো কোচিং সেন্টার আছে। শহরের মতো গ্রামেও এখন ভালো কলেজ মেলে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা শহরের ছেলেমেয়েদের চেয়ে পিছিয়ে নাই। কত মুভি গ্রামের ছেলেরা শহরের ছেলেদের মতো দেখে। শহরের মতো গ্রামেও জন্মদিন পালন করা হয় কেক কেটে। গ্রামেও শহরের মতো গায়েহলুদের অনুষ্ঠান হয়। গ্রাম আর শহরের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
শহরে যেমন টিভি সেটের সামনে বসে দেশ ও বিদেশে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা দেখে, গ্রামের লোকেরাও দেখে। শহরে যেমন আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ও অন্যান্য দেশের পতাকা ঝুলিয়ে রাখে, গ্রামেও তেমনি ঝুলিয়ে রাখে। শহরে যেমন পক্ষে বা বিপক্ষে সাপোর্টার থাকে, গ্রামেও থাকে। গ্রাম ও শহর একেবারে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
কোটন কাকা, এটা কি রশিদ দারোগার বাড়ি?
হ্যাঁ! তুই আমেরিকা থেকে এসে সব ভুলে গেলি নাকি?
না, ভুলি নাই। তবে রশিদ দারোগা আবার পাঁচতলা বিল্ডিং করল কবে?
চার-পাঁচ বছর আগে।
ওমা! কত সুন্দর টাইলস করা, কত সুন্দর দরজা ও জানালা, কী সুন্দর করে রং করছে, কত চকচক ঝকঝক করছে, চারপাশে কী সুন্দর লাইট জ্বলছে। কী সুন্দর ফেনসি বিল্ডিং। মনে হচ্ছে শহরেও এমন বিল্ডিং কমই আছে।
কোটন কাকা বলল, বাপু শোন, এখন গ্রাম আর শহরের মধ্যে তেমন পার্থক্য নাই। গ্রামের লোকেরা শহরের লোকের মতো ব্যস্ত হয়ে গেছে। তারা একে অপরের সাথে আর সেই আগের মতো গল্পগুজব করার সময় পায় না। অনেক সময় পরিচিত লোক দেখলেও না দেখার ভান করে পাশ কেটে চলে যায়।
মানুষ বাপু ওই মডার্ন নাকি যেন কয়, সেটা হয়েছে। আমরা বাপু তেমন পড়ালেখা জানি না। মডার্ন কী বুঝি না। তবে নিত্যনতুন পোশাক-পরিচ্ছেদ দেখি ছেলেমেয়েরা পরিধান করে। আগে গ্রামের মেয়েরা কত সুন্দর গ্রাম্য পোশাক পরিধান করত। এখন বাপু কেউ ছেলেদের মতো ফুলপ্যান্ট পরে। কত কী যে দেখি বাপু। আমরা কিছু বললে লোকেরা ভুল ধরবে। তাই চুপ করে থাকি আর মাঝে মাঝে এই পোশাক-পরিচ্ছেদ পরিধান দেখে বলি কী কলির যুগই এল গ্রামে। এগুলো বাপু শহরে মানায় কিন্তু গ্রামে দৃষ্টকটু মনে হয়।
বাপু, তুমি তো আর গ্রামে থাকো না, খোঁজখবরও রাখো না। বাপু, আগে দেখতাম গ্রামের মায়েরা শাড়ি পরিধান করে বাইরে বের হলে মাথায় কাপড় দিয়ে ঘোমটা দিয়ে যেত। এ যুগে তারা শাড়ি পরিধান করা একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। মায়েরা শহরের মায়েদের মতো থ্রি-পিস পরে, ম্যাক্সি পরে। বাপু, আরও কত কী পরিধান করে, আমি সবকিছুর নাম জানি না।
আগে আমরা তপন পরে স্কুলে যেতাম আর এখন ছেলেমেয়েরা শহরের মতো সবাই এক ড্রেস পরিধান করে স্কুলে যায়।
কোটন কাকা, তপন কী? হারে বাপু রে, এই জন্য তো বলি আমরা অশিক্ষিত মানুষ, আমাদের ভুল হয় বেশি। শিক্ষিত লোকেরা যেটা লুঙ্গি বলে। আগে প্রতিদিন তোমার চাচি গরম ভাত আর গরম তরকারি রান্না করত, তা খেয়ে কী মজা পেতাম। বাপু, এখন বাড়িতে একটা ফ্রিজ কিনেছে। গৃহিণীরা বলে আর কষ্ট করে প্রতিদিন রান্না করব না। তরকারি রান্না করে ফ্রিজে রাখে আর ভাত রান্না করে, মাঝে মাঝে আবার ফ্রিজ থেকে বের করে খেতে দেয়। বাপু, এগুলো শুনেছি শহরের মানুষ বেশি করে। আর সেই শহরের পরিবেশ গ্রামে এখন চলে এসেছে। বাপু, গ্রাম আর শহরের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তোমার চাচি টিউবওয়েল থেকে পানি তুলে দিত, কত আরাম করে গোসল করতাম। আর এখন সুইচ টিপ মারলে টপটপ করে কোথা থেকে পানি চলে আসে। সেই পানিতে গোসল করি।
গ্রামে আগে কত বড় বড় তালগাছ ছিল, সেই তালগাছে কত বাবুই পাখি বাসা বানাত, কত তাল খাওয়া হতো, কত তালগাছের পাতা দিয়ে হাতপাখা বানানো হতো, কত গাছপালা বন-জঙ্গলে ভরা ছিল, সেগুলো কেটে ফেলে দিয়ে শহরের মতো বড় বড় বিল্ডিং তৈরি করছে মানুষ। পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙত, কী সুন্দর মুক্ত বাতাস গায়ে এসে লাগত। গ্রাম আর শহরের মধ্যে তেমন পার্থক্য নাই। গ্রামের রাস্তাঘাট আগে ছিল কাঁচা। বৃষ্টি হলে পানি জমে কাদা হয়ে যেত। এখন গ্রামের রাস্তাঘাট শহরের মতো পাকা। লোকেরা এখন আর পায়ে হেঁটে অনেক দূরে যায় না। তারা শহরের মতো রিকশা ও গাড়িতে চলাফেরা করে। শহরের মতো গ্রামের লোকেরা হাতে হাতে ফোন ব্যবহার করে। এক পরিবারে চারজন সদস্য থাকলে ফোনও আছে চারটা। শহরের মতো গ্রামের ছেলেমেয়েরা ঘরে বসে কার্টুন দেখে। এখন গ্রামের বাচ্চারা শহরের বাচ্চাদের মতো সময় পেলেই টিভির সামনে বসে। গ্রাম শহর হয়ে গেছে, বাপু।
আগে গ্রামের বাড়িতে চুড়ি-মালা বিক্রি করার জন্য কত দোকানি আসত। বালতিতে করে ছুনু বিক্রি করত। আঠালো মাটি দিয়ে মাথা আর তিতপোল্লার খোসা দিয়ে গা ঘষত। সোডা দিয়ে জামাকাপড় পরিষ্কার করত, মাটির পাতিলে ভাত রান্না করত। আর মাটির সানকিতে খাওয়াদাওয়া করত। গ্রামে কুপিবাতি, চেরাগ ও হারিকেন ছিল। বাপু, গ্রাম যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। গ্রামের লোকেরা কসকো সাবান দিয়ে গোসল করে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে সাবানের গন্ধ নাকে ভেসে আসে। গ্রামের মেয়েরাও পারফিউম মেখে কোথায় বেড়াতে যায়। গ্রামে নতুন বছর পালন করে। রাতে মাঝে মাঝে আতশবাজি করে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা শহরের ছেলেমেয়েদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।
বাপজান, তোমার টগা কাকার ছেলে গ্রাম থেকে যেয়ে ও বুয়েটে চান্স পেয়েছে। গ্রামের ওই মোমিনপাড়া হাইস্কুলের সব ছাত্র শহরের স্কুলের মতো এ প্লাস পায়।
আগে গ্রামে কুমারেরা মাটির পাতিলের জিনিস বিক্রি করতে আসত, শিকারিরা ফাঁদ পেতে ঘুঘু ধরতে আসত। রাস্তার ওপর দুহি গান পাল্টাপাল্টি করে গাওয়া হতো। কত বেদেনি মাথায় করে কত কিছু যে গ্রামে এনে বিক্রি করত। রশিনিরা রস-বাত খসাত, গোয়ালেরা গৌ গৌ করে এসে গরুর ব্যায়া খুলত। সাপুড়েরা এসে সাপখেলা দেখাত। কুতকুত, বউচি, গোল্লাছুট, কানা মাছি ভোঁ ভোঁ, হাডুডু-কত রকমের খেলা গ্রামে ছিল। আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া পেয়ে সবকিছু বিলীন হয়ে গেছে। গ্রাম শহরে পরিণত হয়েছে। শহরের সাথে গ্রামের পার্থক্য কমে গেছে।
আগে গ্রামের লোকের মধ্যে কত আন্তরিকতা ছিল। একে অপরের বিপদে-আপদে পাশে এসে দাঁড়াত। এখন কেউ খগেন কাকার পার্টির লোক, কেউ নগেন কাকার পার্টির লোক। নগেন কাকার সাথে খগেন কাকা কথা বলে না, খগেন কাকার সাথে নগেন কাকার কথা চলে না। খগেন কাকা হুংকার দেয় বাঘের মতো আর নগেন কাকা হুংকার দেয় সিংহের মতো। গ্রাম হয়ে গেছে কলুষিত। এক গ্রামের লোকের সাথে আরেক গ্রামের লোকের ঝগড়া হয়। মারামারি হয়ে খুন-খারাবি পর্যন্ত ঘটে। পুলিশ এসে ভরে যায়, লোকেরা ভয়ে ভয়ে পালায়। শহরের মতো মানুষ একে অপরের সাথে কথা বলে না। একজন একতলা বিল্ডিং করলে আরেকজন দোতলা বিল্ডিং করে। শহরের লোকের মতো কোট-টাই পরিধান করে গোল্ডলিপ সিগারেট টানতে টানতে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে। ছেলেমেয়েরা শহরের ছেলেমেয়ের মতো স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। শহরের সবকিছু রন্ধ্রে রন্ধ্রে গ্রামে ঢুকে পড়েছে। গ্রাম আর শহরের মধ্যে পার্থক্যটা কমে যাচ্ছে।
শহরের লোকের মতো গ্রামের লোকেরা বড় বড় ফ্রিজ কেনে। কোরবানির সময় কোরবানি দিয়ে মাংস শহরের লোকের মতো ফ্রিজেও রাখে। শহরের মতো বাড়িঘর তালা দিয়ে রাখে। বাড়িঘর থাকে নিশ্চুপ। ভিক্ষুক বেলে কল করলে শহরের লোকের মতো মাঝে মাঝে বলে মাফ করো। শহরের মতো এখন গ্রামেও অনেক লোক মুরগি, মাছ ও সবজি বিক্রি করতে নিয়ে আসে। সেই গানের কথা মনে পড়ে-গ্রামের মধ্যে শহরের ভাব দেখা যাচ্ছে ভাই রে। গ্রাম ভরে যাচ্ছে কালো ধোঁয়াতে। এখন গ্রাম আর শহরের মধ্যে পার্থক্য নাই বললেই চলে।
গ্রামের অনুষ্ঠানগুলো গ্রামে না হয়ে চলে গেছে কমিউনিটি সেন্টারে। শহরের মতো গ্রামেও বিউটি পার্লার আছে। বিউটি পার্লারে গিয়ে সেজে কাক হয় ময়ূর। কী মডার্ন স্টাইলে ছেলেমেয়েরা শহরের ছেলেমেয়ের মতো চলাফেরা করে। শহরের সাথে গ্রামের ছেলেমেয়েরা তাল মিলিয়ে চলে। শহর ও গ্রামের মধ্যে পার্থক্য দিন দিন কমে আসছে।
শহরের মতো গ্রামে নিত্যনতুন কত মার্কেট বসছে। ঈদে গ্রামের লোকেরা সেই মার্কেটে গিয়ে বাজার করে। গ্রামের কিছু বাজারঘাট ও শহরের মতো অনেক রাত খোলা রাখে। গ্রামেও অনেক মাছের বাজার আছে। লোকজন তাদের সুবিধামতো গিয়ে মাছ কিনে আনে।
গ্রামেও শহরের মতো কোচিং সেন্টার আছে। শহরের মতো গ্রামেও এখন ভালো কলেজ মেলে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা শহরের ছেলেমেয়েদের চেয়ে পিছিয়ে নাই। কত মুভি গ্রামের ছেলেরা শহরের ছেলেদের মতো দেখে। শহরের মতো গ্রামেও জন্মদিন পালন করা হয় কেক কেটে। গ্রামেও শহরের মতো গায়েহলুদের অনুষ্ঠান হয়। গ্রাম আর শহরের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
শহরে যেমন টিভি সেটের সামনে বসে দেশ ও বিদেশে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা দেখে, গ্রামের লোকেরাও দেখে। শহরে যেমন আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ও অন্যান্য দেশের পতাকা ঝুলিয়ে রাখে, গ্রামেও তেমনি ঝুলিয়ে রাখে। শহরে যেমন পক্ষে বা বিপক্ষে সাপোর্টার থাকে, গ্রামেও থাকে। গ্রাম ও শহর একেবারে একাকার হয়ে যাচ্ছে।