‘শেষবারের মতো কী দেখতে চাও তুমি?’ কথাটা শুনে মুখে অল্প হাঁ নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন মোহসিন।
প্রশ্নটা গোলমাল পাকিয়ে উঠছে মাথার মধ্যে। কিছুটা রসিকতার মতোও মনে হতে লাগল। কেননা কথার ফাঁকে দড়াম করে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে আনা হাবীবের লক্ষণ। প্রশ্ন শুনে সামনের লোক ঘাবড়ে যায় আর ও মজা দ্যাখে।
‘তোমার কথাটা তো বুঝলাম না হাবীব, খোলাসা করো।’
আর কত খোলাসা করব, খোসা কেলিয়ে বলেছি মামা, হাবীব উত্তর দিল।
‘মানে?’
‘মানে আপনি এই জীবনের বেলা শেষে মৃত্যুশয্যায় যখন আজরাইল ফেরেশতার অপেক্ষায় থাকবেন, তখন ফাইনাল চোখ বোজার আগে কী বা কাকে দেখতে চান? অতি সাধারণ সওয়াল।’
মোহসিনের মুখটা আবারও হাঁ হলো। এবার একটু বেশি রকম। থুতনিটা ঝুলে গেল। একটা মাছি ভনভন করছে। হাঁ-খোলা মুখে গেলেও বোধ হয় মুখের ভেতর থেকে গান-বাজনা সেরে বেরিয়ে আসতে পারবে। মুখ বন্ধ করে চোখ খুললেন একটু বেশি।
দুপুরের ঝাঁ-ঝাঁ রোদ আয়না হয়ে আছে। চৈত্র মাস। পৃথিবী তাতিয়ে তুলেছে আগুনের মতো সূর্যালোক। তবে বেশি গরম লাগছে না। পেয়ারাতলায় ঝুলন্ত চেয়ারে বসে আছেন মোহসিন। দুদিকে খুঁটি পুঁতে টান করা জালের ইজিচেয়ার। একবার উঠে আধশোয়া হলে এমনিতেই দুলে ওঠে। পিঠ এদিক-ওদিক করলে দোলা থামে না। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে পল্লবীর দিকে যেতে মিনিট দশেক হাঁটলে মোহসিনের বাসা। আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় পার হলে দু-তিনটে বাড়ির পরে ডান দিকের টিনশেড। রাস্তা থেকে এক টুকরো ঘন বন মনে হয়। বিশাল কৃষ্ণচূড়ার একটা ডাল নুয়ে এসে আড়াল করেছে মেইন গেটটাও। বাড়ির ভেতরে ধবধবে আঙিনা। গ্রামের বাড়িটার আদল উঠিয়ে এনেছেন মনে হয়। ইটের দেয়ালের ওপর টিনের ছাউনি। বারান্দায় ওঠার আগে চওড়া সারি করে ইট পুঁতে পুঁতে মাঝখানে টুকরো পাথর বিছিয়ে পথ করা। সারি সারি পাতাবাহার ঝাঁকড়া হয়ে সরু পথ সরুতর করেছে আরও। যাওয়া-আসার পথে গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় যেন পাতাগুলো। কাঁঠালগাছ লাগিয়েছেন এক কোনায়। আরেক পাশে জামরুল। বেশি জায়গা যাতে না নেয়, তাই কলমের আমগাছও লাগিয়েছেন। কাঁঠালগাছের বেলায় আপত্তি তুলেছিলেন গিন্নি। বলেছিলেন, ‘এখানে ছাগলও পুষবে নাকি। খোকনকে বলে বাঁকা একটা লাঠিও কিনিয়ে এনে দিই। মুসা নবীর মতো পাতা পেড়ে পেড়ে খাওয়াবে।’ মুখ তুলে সুর করে জবাব দিয়েছিলেন, ‘কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়...।’ মৃদু হেসে অন্যদিকে চলে গিয়েছিলেন গিন্নি।
মোহসিনের হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আরেকবার তাড়া দিল হাবীব, যেন জবাবটা শোনা খুবই জরুরি। ‘কী হলো মামা, শুধু মনে মনে হাসবা না উত্তরটা দিবা?’ একমাত্র বোনের একমাত্র ছেলে। বড় মামার হৃদয়ের ভেতরে ওর আনাগোনা। চতুর্থ সন্তান বলা যায়। বড় ছেলে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছে। হারমেন মেইনার স্কুল অ্যান্ড কলেজে ইংরেজির প্রভাষক। মেয়েটা এবার ফিজিকসে এমএ ফাইনাল দেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ছোট ছেলে ক্লাস টেনে পড়ে। নিজের সন্তানদের তালিকায় হাবীবের স্থান কোনটা, তা ভেবে বের করা মুশকিল মোহসিনের জন্য। বয়সের দূরত্ব, সম্পর্কের গম্ভীরতা কিংবা জেনারেশন গ্যাপের পরিমাপ কমে এসে একরকম মিহি মোলায়েম বন্ধুত্বের বাষ্পময় উষ্ণতায় জাত হয়ে আছে মামা-ভাগনের সম্পর্ক। তাই তো হাবীব মৃত্যুশয্যার মতো বিষয়টা নিয়ে এ রকম সরল রসিকতা করতে পারে।
‘আমি আমার এই বাড়ির উঠোনটায় বেদে পাটি পেতে আকাশভরা তারা দেখে দেখে চোখ চিরবন্ধ করতে চাই হাবীব।’ খুব গভীর ভাবনামগ্ন মন নিয়ে জবাব দিলেন মোহসিন। হো হো করে হেসে উঠল হাবীব। জানালার পর্দা সরিয়ে একনজর দেখে আবার পর্দা টেনে দিলেন রোকেয়া।
‘মা-মা... কোনো গ্যারান্টি আছে, তোমার অন্তিম সময়টা রাতের বেলায়ই এসে হাজির হবে? তা ছাড়া আকাশে যদি তখন মেঘ থাকে, কী করবা?’
মোহসিন মাথা চুলকালেন। অনেক ভেবে উত্তরটা তৈরি করেছিলেন। আবার চিন্তায় ফেলে দিল ছেলেটা।
হাবীবের দিকে অসহায় চোখে তাকালেন। বললেন, ‘তুই বাসায় যা, তোর ছুটি চলছে বলে আমার অবসর সময়টা নষ্ট করিস না।’
‘তোমার অফুরন্ত অবসর অনন্ত ভাবনায় ভরে দিচ্ছি মামা, থ্যাংক য়্যু দাও।’
‘হা-বী-ব, আমার সামনে থেকে যা।’ অন্য রকম স্বরে বললেন মোহসিন। হাবীব আস্তে করে উঠে মামির রুমের দিকে গেল।
কলেজ থেকে কী কারণে যেন একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরল বড় ছেলে তৌহিদ। রোকেয়া দুপুরের খাবার দিয়ে দিলেন টেবিলে। হাতলওয়ালা বড় চেয়ারটায় মোহসিন বসেন। অন্য প্রান্তের চেয়ারে রোকেয়া। টেবিলে সবকিছু সাজিয়ে দিয়ে তিনিও বসে পড়েন সবার সাথে। ডাইনিং টেবিলের মাঝখানে নিচে চাকা লাগানো কাঠের গোলাকার প্রশস্ত চাকতি বসানো আছে। তার ওপর বিভিন্ন পাত্রে নানা পদের তরকারি আর ভাত সাজানো। একেকজনের নেওয়া হয়ে গেলে চাকা ঘুরিয়ে নিজের কাছে এনে ইচ্ছেমতো তুলে নিচ্ছে সবাই। অন্যান্য দিন হলে হাবীব কথা বলে মাতিয়ে রাখত সবাইকে। আজ চুপচাপ। রোকেয়া তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। তৌহিদ এমনিতেই কম কথার ছেলে। অল্প শব্দে টেনে টেনে ছোট ছোট বাক্যে কথা বলে। মা মনে মনে বলেন, এই ছেলে ক্লাসে লেকচার দেয় কীভাবে, তা একদিন দেখতে হবে। মোহসিন ধীরে নলা তুলছেন মুখে। দু-একবার তাকালেন তৌহিদের দিকে। কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মৃত্যু সম্পর্কে তোর ভাবনা কী রকম রে?’
অবাক আর ব্যথাদীর্ণ দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাল তৌহিদ। জবাব না দিয়ে শান্তভাবে তাকিয়ে থাকল। মায়ের দিকে দেখল একবার। মায়ের চোখেও কিছু না বোঝার দৃষ্টি। মোহসিন তাড়া দিলেন, ‘কী রে, কিছু বলছিস না যে?’
‘মৃত্যু জীবনে খুব স্বাভাবিক পরিণতি, বাবা।’ বলল তৌহিদ।
‘আরও বিস্তারিত বল।’ মোহসিন বললেন। ‘পারলে কোটেশন-টোটেশন টেনে বল।’
কবি আলফ্রেড টেনিসন মৃত্যুকে ‘সীমানা-অতিক্রম’ বলেছেন। সসীম থেকে অসীমে যাত্রার সিংহ দরজা হলো মৃত্যু। তাঁর Crossing the Bar কবিতার কয়েকটা লাইন এ রকম বাবা :
‘Twilight and evening bell,
And after that the dark!
And may there be no sadness of farewell,
When I embark;
For thoÕ from out our bourne of Time and Place
The flood may bear me far,
I hope to see my Pilot face to face
(When I have crost the ba.’
আর ব্রাউনিং তো প্রবীণতাকে জ্ঞানসমৃদ্ধতায় উপনীত ভরপুর এক মুগ্ধ বয়স ভেবেছেন। জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো নেড়েচেড়ে দেখার অবসর মেলে এই বয়সে।
রোকেয়া অবাক হলেন। যে ছেলেকে শাসন করেছেন, বকেছেন কখনো কখনো, টুঁ শব্দ করেনি, নিচু স্বরে জবাব দিয়েছে কথার; নীরবে কীভাবে জীবনের সুগভীর জ্ঞান শুষে নিল টের পাননি তিনি। তৌহিদের কথার মধ্যে কোনো ছায়া নেই। শুধু আলো। কেমন নিস্তরঙ্গ, নিরন্তর কথামালার ভেতর সুবাসিত উপলব্ধি জড়ানো। চোখ ছলছল করে উঠল রোকেয়ার। মোহসিন চোখ বন্ধ করে আছেন। হয়তো টেনিসনের ‘সীমানা’র কথা ভাবছেন। তাঁর ‘পাইলট’কে দেখতে পাওয়ার আশাও জাগছে মনে। ব্রাউনিংয়ের মুগ্ধময় প্রবীণতার কথা ভাবছেন।
মেইন গেটে খটখট আওয়াজে সবাই তাকাল সেদিকে। কে এল, মনে হয় তারা চলে এসেছে। মনে মনে বললেন রোকেয়া। কেউ কিছু বলার আগে হাবীব উঠল। ডান হাত উঁচু করে রেখে বাম হাত দিয়ে খিল খুলল। পকেট গেট দিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকল তারা। মুখ তুলেই দেখল হাবীব দাঁড়ানো।
‘তুই এত সকাল সকাল আসলি যে? ক্লাস শেষ?’ বলল হাবীব।
‘আগে বলো, আমাকে রেখে খেতে খেতে কী গল্প করলে? রিপিট করতে হবে।’
‘আমি আজ একটা কথাও বলিনি, লেকচার শুনেছি প্রফেসর সাহেবের।’
‘মানে?’
‘তৌহিদ প্রফেসরের।’
তাদের হাসি সবাই শুনল ডাইনিং টেবিলে বসে। কাছে এলে রোকেয়া বললেন, ‘এক্ষুনি হাত-মুখ ধুয়ে আয়, খেয়ে নে।’
‘আচ্ছা মা।’
গরমের দিনগুলো খুব বড়। সারা দিনের উত্তাপ এসে জড়ো হয় সন্ধ্যায়। বৃষ্টি হলে ভাঁপ ওড়ে। বিকেলে কী ভেবে বেশ এক ঝাপটা বৃষ্টি দিয়েছিল ঠনঠনে আকাশটা। সে সময় হাওয়া ভিজে হয়ে এলেও এখন আবার যা তা-ই। কিছুক্ষণ পরপর থমকে ছুটে এসে উড়ে যাচ্ছে পল্লবীর ওই দিকে। নতুন নতুন বাড়িঘর পার হয়ে এয়ারপোর্টের ওপাশের খোলা মাঠের দিকে যাচ্ছে মনে হয়। মাগরিবের নামাজের পর চা বসাতে যাচ্ছিলেন রোকেয়া। মোহসিনের কথায় ফিরে তাকালেন।
‘আমাদের বাসায় বেদে পাটি আছে? খেজুর পাতার মাদুর?’ মোহসিন জানতে চাইলেন।
রোকেয়া তাকিয়ে থাকলেন। বুঝতে চেষ্টা করছেন। টেনে টেনে বললেন, ‘মা-দু-র আছে, খেজুর পাতারটা তো নেই।’ মনে মনে অবাক হলেন। কী হলো লোকটার। বাসায় কী আছে না আছে তা ওর চেয়ে আর কে ভালো জানে? আজ হঠাৎ বেদে পাটির কথা বলছে কেন? এ নিশ্চয় হাবীবের কাণ্ড। নতুন নতুন চিন্তা ঢুকিয়ে দেয় মাথায়।
‘আচ্ছা, মাদুরটা দাও।’ ভাবলেশহীন স্বরে বললেন মোহসিন।
একটু পরে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে মাদুর বাড়িয়ে দিলেন। মোহসিন অলস হাতে বগলদাবায় গুঁজে উঠোনে এলেন। খোলা জায়গায় পাটিটা পেতে কনুইয়ে ভর দিয়ে কাত হয়ে শুলেন। সামনে ছোট বকুলগাছটার পাশ দিয়ে কৃষ্ণচূড়ার মাথা ছুঁয়ে দৃষ্টি দিলেন আকাশের দিকে। দিনের বেলা বৃষ্টি হওয়াতে খুশি হয়েছিলেন। রাতের বৃষ্টি পছন্দ নয় মোহসিনের। মেঘে ঢেকে যায় তারাগুলো। মনে হয় দুদ্দাড় জলের তোড়ে ধুয়ে যাবে তারার আলো।
আকাশে এখন মেঘের চিহ্ন নেই। কাঁসার থালার মতো মাজাঘষা চাঁদ একলা লটকে আছে ডালটার আগায়। আজ মনে হচ্ছে পূর্ণিমা। তবে জোসনা অতটা ফকফকে নয়। কেমন যেন মিনমিনে। চাঁদটা হটিয়ে দেওয়া যেত। তারারা তবে মার্বেলের মতো এমন ঝকঝকে আকাশ-মাঠে গুড়গুড় করে গড়িয়ে নেমে আসতে পারত।
কনুইয়ের কাছে নরম কিছু অনুভব করলেন। ফিরে দেখেন হাতের নিচে বালিশ পুরে দিচ্ছেন রোকেয়া। দুপদাপ পায়ের শব্দে তাকালেন পাতাবাহার গাছগুলোর দিকে। তারা আসছে।
‘কী করছ, বাবা?’
‘তারা দেখার চেষ্টা করছি, চাঁদটার জন্য হচ্ছে না।’
‘এই তো আমি বাবা।’
‘তুই তো আমার সাত আকাশের তারা, মা। আচ্ছা, তোদের পদার্থবিদ্যায় সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে কি কিছু আছে?’
‘বাবা, আইনস্টাইনই তো বলেছেন, “আমার বিশ্বাস, আমরা যা কিছু করি কিংবা যে জন্য বাঁচি, সবকিছুর পেছনে কার্যকারণতত্ত্ব ক্রিয়াশীল রয়েছে; এটা বরং ভালো যে আমরা এর সবকিছু দেখতে পাই না।” তুমি কি জানো বাবা, কথাগুলো কার সঙ্গে বলেছিলেন? আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আলাপের সময় বলেছিলেন। তাই অত বেশি ঘাঁটতে বা দেখতে না যাওয়াই ভালো, বাবা।’
‘আমার দেখা নিয়ে তোর মাথা ঘামাতে হবে না। তোকে যা জিজ্ঞেস করেছি, তা-ই বল।’
‘আচ্ছা তাহলে শোনো। পদার্থবিজ্ঞানী মরিস পেজ বলেছেন, যেমন সাগরের উপরিভাগ আমাদের জানা সমগ্র এলাকার তুলনায় একটি নগণ্য অংশ, তেমনি আমাদের প্রাকৃতিক বিশ্বের সবই মহাশূন্য ও কালের বিশেষ আয়তনের মধ্যে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও যে সমগ্র বাস্তবতার অতীব ক্ষুদ্র একটি অংশ হতে পারে-সেই বাস্তব রাজ্যে তাঁর (স্রষ্টার) অবস্থিতি।’
কথাগুলো বলে বাবার দিকে তাকাল তারা। রোকেয়া আলতো করে মেয়ের হাত ধরলেন। অন্য হাত রাখলেন মাথার ওপর। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলেন মুখের দিকে। এই ম্রিয়মাণ জোসনায় তারার মুখখানা কেমন উজ্জ্বল! সেদিনের মেয়ে মুখ বেঁকিয়ে কেঁদে বায়না করত, আজ বাবার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে কী সুন্দর! চোখ দুটো একটু চুলকে উঠল রোকেয়ার। মোহসিন চোখ বন্ধ করে ছিলেন। তারা বাবার গায়ে হাত রেখে ডাকল।
‘তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ, বাবা?’
ঘুম থেকে চোখ মেলার মতো করে তাকালেন মোহসিন। সেই চোখে ঘুম নেই, ভাবনার রেখা আঁকা।
‘বাবা, একটা কথা বলি?’
‘বল।’ ভারী গলায় বললেন মোহসিন।
‘তোমার মনটা মনে হয় এলোমেলো হয়ে আছে, চিন্তা করছ খুব। দু-একটা কবিতার লাইন শোনাই?’
‘তুই বলবি ফিজিকসের কথাবার্তা, কবিতা পাবি কোথায়?’
‘বাবা, তুমি তোমার মেয়েকেও চেনো না? এমন কবিতা শোনাব, যাতে মাটির ঘ্রাণ আছে, শিশির, কাঁঠাল ছায়া এইসব...
‘কোন যেন পরী চেয়ে আছে দুটি চঞ্চল চোখ তুলে!
পাগলা হাওয়ায় অনিবার তার ওড়না যেতেছে দুলে!
গেঁথে গোলাপের মালা
তাকায়ে রয়েছে বালা,
বিলায়ে দিয়েছে রাঙা নার্গিস কালো পশমিনা চুলে!
বসেছে বালিকা খর্জুরছায়ে নীল দরিয়ার কূলে!’
মোহসিন অবাক হয়ে শুনলেন মেয়ের মগ্ন উচ্চারণ। কী সুন্দর আবৃত্তি করল, জীবনানন্দ। কোন কবিতাটা যেন। কপাল কুঞ্চিত করে ভাবলেন। মনে পড়ল, ‘মরীচিকার পিছে’। মেয়েটা বাংলা সাহিত্য পড়লেও পারত।
খেজুরের ছায়ায় না হোক, খেজুর পাটিই সই এখন। আর দরিয়া? জীবনের চেয়ে বড় দরিয়া কোথায়? এই দরিয়ার কূলে বসে বসে ওই বালিকার মতো স্মৃতির মালা গাঁথতে গাঁথতে দিন যায়। কী আশ্চর্য আমাদের জীবন! জন্মের পর থেকে যখন চারদিকে তাকাবার বয়স হলো, মনের ভেতর গেঁথে যেতে লাগল সব। মন-ক্যামেরার রিল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ইচ্ছেমতো দেখে নেওয়া যায় দৃশ্যগুলো। কখনো মলিন হয় না তা। ঠিক সেই রকম রঙিন, চকচকে, উজ্জ্বল।
অস্তিত্ববান হওয়াটাও কত ভাগ্যের। কত প্রাণী আছে এই পৃথিবীতে। গাছপালা। ডালপালা নাড়িয়ে দিয়ে যায় হাওয়া। ওরাও অসীম উল্লাসে ঝড় এলে উড়ে যেতে চায়। অনড় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তবু। আমরা মানুষ। কথা বলতে পারি। হাঁটাচলা ইচ্ছেমতো। ওহ! কী উদার দান এই অস্তিত্ব, বেঁচে থাকা। মহাকালের কোন সময়ে আমি আসব, তা অজানা আমার। যাওয়ার সময়টা হয়তো আঁচ করে নেওয়া যায়। সূর্য আর কত দিন ঘুরবে আকাশে, কে জানে? আমি শুধু জানি, এই চোখ আলোহীন হবে একদিন। আমার এই ঘর-বাড়ি, স্ত্রী-কন্যা, পুত্র-প্রিয়জন সবই থেকে যাবে আকাশের নিচে। আমার যাত্রা হবে হয়তো-বা অন্য কোনো আকাশের দিকে। একবার যখন দেখার অধিকার মিলেছে, শেষ দেখা বলতে বোধ হয় কিছু নেই। সে রকম মানতেও মন চায় না। হাবীবকে বলে দিতে হবে চোখ বোজার আগের ও পরের দৃশ্যগুলো একই চোখে ধারণ করে নেব।
প্রশ্নটা গোলমাল পাকিয়ে উঠছে মাথার মধ্যে। কিছুটা রসিকতার মতোও মনে হতে লাগল। কেননা কথার ফাঁকে দড়াম করে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে আনা হাবীবের লক্ষণ। প্রশ্ন শুনে সামনের লোক ঘাবড়ে যায় আর ও মজা দ্যাখে।
‘তোমার কথাটা তো বুঝলাম না হাবীব, খোলাসা করো।’
আর কত খোলাসা করব, খোসা কেলিয়ে বলেছি মামা, হাবীব উত্তর দিল।
‘মানে?’
‘মানে আপনি এই জীবনের বেলা শেষে মৃত্যুশয্যায় যখন আজরাইল ফেরেশতার অপেক্ষায় থাকবেন, তখন ফাইনাল চোখ বোজার আগে কী বা কাকে দেখতে চান? অতি সাধারণ সওয়াল।’
মোহসিনের মুখটা আবারও হাঁ হলো। এবার একটু বেশি রকম। থুতনিটা ঝুলে গেল। একটা মাছি ভনভন করছে। হাঁ-খোলা মুখে গেলেও বোধ হয় মুখের ভেতর থেকে গান-বাজনা সেরে বেরিয়ে আসতে পারবে। মুখ বন্ধ করে চোখ খুললেন একটু বেশি।
দুপুরের ঝাঁ-ঝাঁ রোদ আয়না হয়ে আছে। চৈত্র মাস। পৃথিবী তাতিয়ে তুলেছে আগুনের মতো সূর্যালোক। তবে বেশি গরম লাগছে না। পেয়ারাতলায় ঝুলন্ত চেয়ারে বসে আছেন মোহসিন। দুদিকে খুঁটি পুঁতে টান করা জালের ইজিচেয়ার। একবার উঠে আধশোয়া হলে এমনিতেই দুলে ওঠে। পিঠ এদিক-ওদিক করলে দোলা থামে না। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে পল্লবীর দিকে যেতে মিনিট দশেক হাঁটলে মোহসিনের বাসা। আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় পার হলে দু-তিনটে বাড়ির পরে ডান দিকের টিনশেড। রাস্তা থেকে এক টুকরো ঘন বন মনে হয়। বিশাল কৃষ্ণচূড়ার একটা ডাল নুয়ে এসে আড়াল করেছে মেইন গেটটাও। বাড়ির ভেতরে ধবধবে আঙিনা। গ্রামের বাড়িটার আদল উঠিয়ে এনেছেন মনে হয়। ইটের দেয়ালের ওপর টিনের ছাউনি। বারান্দায় ওঠার আগে চওড়া সারি করে ইট পুঁতে পুঁতে মাঝখানে টুকরো পাথর বিছিয়ে পথ করা। সারি সারি পাতাবাহার ঝাঁকড়া হয়ে সরু পথ সরুতর করেছে আরও। যাওয়া-আসার পথে গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় যেন পাতাগুলো। কাঁঠালগাছ লাগিয়েছেন এক কোনায়। আরেক পাশে জামরুল। বেশি জায়গা যাতে না নেয়, তাই কলমের আমগাছও লাগিয়েছেন। কাঁঠালগাছের বেলায় আপত্তি তুলেছিলেন গিন্নি। বলেছিলেন, ‘এখানে ছাগলও পুষবে নাকি। খোকনকে বলে বাঁকা একটা লাঠিও কিনিয়ে এনে দিই। মুসা নবীর মতো পাতা পেড়ে পেড়ে খাওয়াবে।’ মুখ তুলে সুর করে জবাব দিয়েছিলেন, ‘কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়...।’ মৃদু হেসে অন্যদিকে চলে গিয়েছিলেন গিন্নি।
মোহসিনের হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আরেকবার তাড়া দিল হাবীব, যেন জবাবটা শোনা খুবই জরুরি। ‘কী হলো মামা, শুধু মনে মনে হাসবা না উত্তরটা দিবা?’ একমাত্র বোনের একমাত্র ছেলে। বড় মামার হৃদয়ের ভেতরে ওর আনাগোনা। চতুর্থ সন্তান বলা যায়। বড় ছেলে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছে। হারমেন মেইনার স্কুল অ্যান্ড কলেজে ইংরেজির প্রভাষক। মেয়েটা এবার ফিজিকসে এমএ ফাইনাল দেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ছোট ছেলে ক্লাস টেনে পড়ে। নিজের সন্তানদের তালিকায় হাবীবের স্থান কোনটা, তা ভেবে বের করা মুশকিল মোহসিনের জন্য। বয়সের দূরত্ব, সম্পর্কের গম্ভীরতা কিংবা জেনারেশন গ্যাপের পরিমাপ কমে এসে একরকম মিহি মোলায়েম বন্ধুত্বের বাষ্পময় উষ্ণতায় জাত হয়ে আছে মামা-ভাগনের সম্পর্ক। তাই তো হাবীব মৃত্যুশয্যার মতো বিষয়টা নিয়ে এ রকম সরল রসিকতা করতে পারে।
‘আমি আমার এই বাড়ির উঠোনটায় বেদে পাটি পেতে আকাশভরা তারা দেখে দেখে চোখ চিরবন্ধ করতে চাই হাবীব।’ খুব গভীর ভাবনামগ্ন মন নিয়ে জবাব দিলেন মোহসিন। হো হো করে হেসে উঠল হাবীব। জানালার পর্দা সরিয়ে একনজর দেখে আবার পর্দা টেনে দিলেন রোকেয়া।
‘মা-মা... কোনো গ্যারান্টি আছে, তোমার অন্তিম সময়টা রাতের বেলায়ই এসে হাজির হবে? তা ছাড়া আকাশে যদি তখন মেঘ থাকে, কী করবা?’
মোহসিন মাথা চুলকালেন। অনেক ভেবে উত্তরটা তৈরি করেছিলেন। আবার চিন্তায় ফেলে দিল ছেলেটা।
হাবীবের দিকে অসহায় চোখে তাকালেন। বললেন, ‘তুই বাসায় যা, তোর ছুটি চলছে বলে আমার অবসর সময়টা নষ্ট করিস না।’
‘তোমার অফুরন্ত অবসর অনন্ত ভাবনায় ভরে দিচ্ছি মামা, থ্যাংক য়্যু দাও।’
‘হা-বী-ব, আমার সামনে থেকে যা।’ অন্য রকম স্বরে বললেন মোহসিন। হাবীব আস্তে করে উঠে মামির রুমের দিকে গেল।
কলেজ থেকে কী কারণে যেন একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরল বড় ছেলে তৌহিদ। রোকেয়া দুপুরের খাবার দিয়ে দিলেন টেবিলে। হাতলওয়ালা বড় চেয়ারটায় মোহসিন বসেন। অন্য প্রান্তের চেয়ারে রোকেয়া। টেবিলে সবকিছু সাজিয়ে দিয়ে তিনিও বসে পড়েন সবার সাথে। ডাইনিং টেবিলের মাঝখানে নিচে চাকা লাগানো কাঠের গোলাকার প্রশস্ত চাকতি বসানো আছে। তার ওপর বিভিন্ন পাত্রে নানা পদের তরকারি আর ভাত সাজানো। একেকজনের নেওয়া হয়ে গেলে চাকা ঘুরিয়ে নিজের কাছে এনে ইচ্ছেমতো তুলে নিচ্ছে সবাই। অন্যান্য দিন হলে হাবীব কথা বলে মাতিয়ে রাখত সবাইকে। আজ চুপচাপ। রোকেয়া তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। তৌহিদ এমনিতেই কম কথার ছেলে। অল্প শব্দে টেনে টেনে ছোট ছোট বাক্যে কথা বলে। মা মনে মনে বলেন, এই ছেলে ক্লাসে লেকচার দেয় কীভাবে, তা একদিন দেখতে হবে। মোহসিন ধীরে নলা তুলছেন মুখে। দু-একবার তাকালেন তৌহিদের দিকে। কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মৃত্যু সম্পর্কে তোর ভাবনা কী রকম রে?’
অবাক আর ব্যথাদীর্ণ দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাল তৌহিদ। জবাব না দিয়ে শান্তভাবে তাকিয়ে থাকল। মায়ের দিকে দেখল একবার। মায়ের চোখেও কিছু না বোঝার দৃষ্টি। মোহসিন তাড়া দিলেন, ‘কী রে, কিছু বলছিস না যে?’
‘মৃত্যু জীবনে খুব স্বাভাবিক পরিণতি, বাবা।’ বলল তৌহিদ।
‘আরও বিস্তারিত বল।’ মোহসিন বললেন। ‘পারলে কোটেশন-টোটেশন টেনে বল।’
কবি আলফ্রেড টেনিসন মৃত্যুকে ‘সীমানা-অতিক্রম’ বলেছেন। সসীম থেকে অসীমে যাত্রার সিংহ দরজা হলো মৃত্যু। তাঁর Crossing the Bar কবিতার কয়েকটা লাইন এ রকম বাবা :
‘Twilight and evening bell,
And after that the dark!
And may there be no sadness of farewell,
When I embark;
For thoÕ from out our bourne of Time and Place
The flood may bear me far,
I hope to see my Pilot face to face
(When I have crost the ba.’
আর ব্রাউনিং তো প্রবীণতাকে জ্ঞানসমৃদ্ধতায় উপনীত ভরপুর এক মুগ্ধ বয়স ভেবেছেন। জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো নেড়েচেড়ে দেখার অবসর মেলে এই বয়সে।
রোকেয়া অবাক হলেন। যে ছেলেকে শাসন করেছেন, বকেছেন কখনো কখনো, টুঁ শব্দ করেনি, নিচু স্বরে জবাব দিয়েছে কথার; নীরবে কীভাবে জীবনের সুগভীর জ্ঞান শুষে নিল টের পাননি তিনি। তৌহিদের কথার মধ্যে কোনো ছায়া নেই। শুধু আলো। কেমন নিস্তরঙ্গ, নিরন্তর কথামালার ভেতর সুবাসিত উপলব্ধি জড়ানো। চোখ ছলছল করে উঠল রোকেয়ার। মোহসিন চোখ বন্ধ করে আছেন। হয়তো টেনিসনের ‘সীমানা’র কথা ভাবছেন। তাঁর ‘পাইলট’কে দেখতে পাওয়ার আশাও জাগছে মনে। ব্রাউনিংয়ের মুগ্ধময় প্রবীণতার কথা ভাবছেন।
মেইন গেটে খটখট আওয়াজে সবাই তাকাল সেদিকে। কে এল, মনে হয় তারা চলে এসেছে। মনে মনে বললেন রোকেয়া। কেউ কিছু বলার আগে হাবীব উঠল। ডান হাত উঁচু করে রেখে বাম হাত দিয়ে খিল খুলল। পকেট গেট দিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকল তারা। মুখ তুলেই দেখল হাবীব দাঁড়ানো।
‘তুই এত সকাল সকাল আসলি যে? ক্লাস শেষ?’ বলল হাবীব।
‘আগে বলো, আমাকে রেখে খেতে খেতে কী গল্প করলে? রিপিট করতে হবে।’
‘আমি আজ একটা কথাও বলিনি, লেকচার শুনেছি প্রফেসর সাহেবের।’
‘মানে?’
‘তৌহিদ প্রফেসরের।’
তাদের হাসি সবাই শুনল ডাইনিং টেবিলে বসে। কাছে এলে রোকেয়া বললেন, ‘এক্ষুনি হাত-মুখ ধুয়ে আয়, খেয়ে নে।’
‘আচ্ছা মা।’
গরমের দিনগুলো খুব বড়। সারা দিনের উত্তাপ এসে জড়ো হয় সন্ধ্যায়। বৃষ্টি হলে ভাঁপ ওড়ে। বিকেলে কী ভেবে বেশ এক ঝাপটা বৃষ্টি দিয়েছিল ঠনঠনে আকাশটা। সে সময় হাওয়া ভিজে হয়ে এলেও এখন আবার যা তা-ই। কিছুক্ষণ পরপর থমকে ছুটে এসে উড়ে যাচ্ছে পল্লবীর ওই দিকে। নতুন নতুন বাড়িঘর পার হয়ে এয়ারপোর্টের ওপাশের খোলা মাঠের দিকে যাচ্ছে মনে হয়। মাগরিবের নামাজের পর চা বসাতে যাচ্ছিলেন রোকেয়া। মোহসিনের কথায় ফিরে তাকালেন।
‘আমাদের বাসায় বেদে পাটি আছে? খেজুর পাতার মাদুর?’ মোহসিন জানতে চাইলেন।
রোকেয়া তাকিয়ে থাকলেন। বুঝতে চেষ্টা করছেন। টেনে টেনে বললেন, ‘মা-দু-র আছে, খেজুর পাতারটা তো নেই।’ মনে মনে অবাক হলেন। কী হলো লোকটার। বাসায় কী আছে না আছে তা ওর চেয়ে আর কে ভালো জানে? আজ হঠাৎ বেদে পাটির কথা বলছে কেন? এ নিশ্চয় হাবীবের কাণ্ড। নতুন নতুন চিন্তা ঢুকিয়ে দেয় মাথায়।
‘আচ্ছা, মাদুরটা দাও।’ ভাবলেশহীন স্বরে বললেন মোহসিন।
একটু পরে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে মাদুর বাড়িয়ে দিলেন। মোহসিন অলস হাতে বগলদাবায় গুঁজে উঠোনে এলেন। খোলা জায়গায় পাটিটা পেতে কনুইয়ে ভর দিয়ে কাত হয়ে শুলেন। সামনে ছোট বকুলগাছটার পাশ দিয়ে কৃষ্ণচূড়ার মাথা ছুঁয়ে দৃষ্টি দিলেন আকাশের দিকে। দিনের বেলা বৃষ্টি হওয়াতে খুশি হয়েছিলেন। রাতের বৃষ্টি পছন্দ নয় মোহসিনের। মেঘে ঢেকে যায় তারাগুলো। মনে হয় দুদ্দাড় জলের তোড়ে ধুয়ে যাবে তারার আলো।
আকাশে এখন মেঘের চিহ্ন নেই। কাঁসার থালার মতো মাজাঘষা চাঁদ একলা লটকে আছে ডালটার আগায়। আজ মনে হচ্ছে পূর্ণিমা। তবে জোসনা অতটা ফকফকে নয়। কেমন যেন মিনমিনে। চাঁদটা হটিয়ে দেওয়া যেত। তারারা তবে মার্বেলের মতো এমন ঝকঝকে আকাশ-মাঠে গুড়গুড় করে গড়িয়ে নেমে আসতে পারত।
কনুইয়ের কাছে নরম কিছু অনুভব করলেন। ফিরে দেখেন হাতের নিচে বালিশ পুরে দিচ্ছেন রোকেয়া। দুপদাপ পায়ের শব্দে তাকালেন পাতাবাহার গাছগুলোর দিকে। তারা আসছে।
‘কী করছ, বাবা?’
‘তারা দেখার চেষ্টা করছি, চাঁদটার জন্য হচ্ছে না।’
‘এই তো আমি বাবা।’
‘তুই তো আমার সাত আকাশের তারা, মা। আচ্ছা, তোদের পদার্থবিদ্যায় সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে কি কিছু আছে?’
‘বাবা, আইনস্টাইনই তো বলেছেন, “আমার বিশ্বাস, আমরা যা কিছু করি কিংবা যে জন্য বাঁচি, সবকিছুর পেছনে কার্যকারণতত্ত্ব ক্রিয়াশীল রয়েছে; এটা বরং ভালো যে আমরা এর সবকিছু দেখতে পাই না।” তুমি কি জানো বাবা, কথাগুলো কার সঙ্গে বলেছিলেন? আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আলাপের সময় বলেছিলেন। তাই অত বেশি ঘাঁটতে বা দেখতে না যাওয়াই ভালো, বাবা।’
‘আমার দেখা নিয়ে তোর মাথা ঘামাতে হবে না। তোকে যা জিজ্ঞেস করেছি, তা-ই বল।’
‘আচ্ছা তাহলে শোনো। পদার্থবিজ্ঞানী মরিস পেজ বলেছেন, যেমন সাগরের উপরিভাগ আমাদের জানা সমগ্র এলাকার তুলনায় একটি নগণ্য অংশ, তেমনি আমাদের প্রাকৃতিক বিশ্বের সবই মহাশূন্য ও কালের বিশেষ আয়তনের মধ্যে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও যে সমগ্র বাস্তবতার অতীব ক্ষুদ্র একটি অংশ হতে পারে-সেই বাস্তব রাজ্যে তাঁর (স্রষ্টার) অবস্থিতি।’
কথাগুলো বলে বাবার দিকে তাকাল তারা। রোকেয়া আলতো করে মেয়ের হাত ধরলেন। অন্য হাত রাখলেন মাথার ওপর। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলেন মুখের দিকে। এই ম্রিয়মাণ জোসনায় তারার মুখখানা কেমন উজ্জ্বল! সেদিনের মেয়ে মুখ বেঁকিয়ে কেঁদে বায়না করত, আজ বাবার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে কী সুন্দর! চোখ দুটো একটু চুলকে উঠল রোকেয়ার। মোহসিন চোখ বন্ধ করে ছিলেন। তারা বাবার গায়ে হাত রেখে ডাকল।
‘তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ, বাবা?’
ঘুম থেকে চোখ মেলার মতো করে তাকালেন মোহসিন। সেই চোখে ঘুম নেই, ভাবনার রেখা আঁকা।
‘বাবা, একটা কথা বলি?’
‘বল।’ ভারী গলায় বললেন মোহসিন।
‘তোমার মনটা মনে হয় এলোমেলো হয়ে আছে, চিন্তা করছ খুব। দু-একটা কবিতার লাইন শোনাই?’
‘তুই বলবি ফিজিকসের কথাবার্তা, কবিতা পাবি কোথায়?’
‘বাবা, তুমি তোমার মেয়েকেও চেনো না? এমন কবিতা শোনাব, যাতে মাটির ঘ্রাণ আছে, শিশির, কাঁঠাল ছায়া এইসব...
‘কোন যেন পরী চেয়ে আছে দুটি চঞ্চল চোখ তুলে!
পাগলা হাওয়ায় অনিবার তার ওড়না যেতেছে দুলে!
গেঁথে গোলাপের মালা
তাকায়ে রয়েছে বালা,
বিলায়ে দিয়েছে রাঙা নার্গিস কালো পশমিনা চুলে!
বসেছে বালিকা খর্জুরছায়ে নীল দরিয়ার কূলে!’
মোহসিন অবাক হয়ে শুনলেন মেয়ের মগ্ন উচ্চারণ। কী সুন্দর আবৃত্তি করল, জীবনানন্দ। কোন কবিতাটা যেন। কপাল কুঞ্চিত করে ভাবলেন। মনে পড়ল, ‘মরীচিকার পিছে’। মেয়েটা বাংলা সাহিত্য পড়লেও পারত।
খেজুরের ছায়ায় না হোক, খেজুর পাটিই সই এখন। আর দরিয়া? জীবনের চেয়ে বড় দরিয়া কোথায়? এই দরিয়ার কূলে বসে বসে ওই বালিকার মতো স্মৃতির মালা গাঁথতে গাঁথতে দিন যায়। কী আশ্চর্য আমাদের জীবন! জন্মের পর থেকে যখন চারদিকে তাকাবার বয়স হলো, মনের ভেতর গেঁথে যেতে লাগল সব। মন-ক্যামেরার রিল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ইচ্ছেমতো দেখে নেওয়া যায় দৃশ্যগুলো। কখনো মলিন হয় না তা। ঠিক সেই রকম রঙিন, চকচকে, উজ্জ্বল।
অস্তিত্ববান হওয়াটাও কত ভাগ্যের। কত প্রাণী আছে এই পৃথিবীতে। গাছপালা। ডালপালা নাড়িয়ে দিয়ে যায় হাওয়া। ওরাও অসীম উল্লাসে ঝড় এলে উড়ে যেতে চায়। অনড় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তবু। আমরা মানুষ। কথা বলতে পারি। হাঁটাচলা ইচ্ছেমতো। ওহ! কী উদার দান এই অস্তিত্ব, বেঁচে থাকা। মহাকালের কোন সময়ে আমি আসব, তা অজানা আমার। যাওয়ার সময়টা হয়তো আঁচ করে নেওয়া যায়। সূর্য আর কত দিন ঘুরবে আকাশে, কে জানে? আমি শুধু জানি, এই চোখ আলোহীন হবে একদিন। আমার এই ঘর-বাড়ি, স্ত্রী-কন্যা, পুত্র-প্রিয়জন সবই থেকে যাবে আকাশের নিচে। আমার যাত্রা হবে হয়তো-বা অন্য কোনো আকাশের দিকে। একবার যখন দেখার অধিকার মিলেছে, শেষ দেখা বলতে বোধ হয় কিছু নেই। সে রকম মানতেও মন চায় না। হাবীবকে বলে দিতে হবে চোখ বোজার আগের ও পরের দৃশ্যগুলো একই চোখে ধারণ করে নেব।