ফিরে যাওয়া

প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, ১২:৩১ , বিশেষ সংখ্যা
সান্তাহার থেকে মিতু লিখেছে, ‘... শেষ পর্যন্ত আমার বাবা-মায়ের একমাত্র হিরের টুকরো ছেলে খড়কুটো খামচে ধরে অকূলে কূল পেয়েছে। স্টার্টিংয়ে সর্বসাকল্যে এক হাজার টাকার মতো মহামূল্যবান মাইনা পড়বে। তবু অন্তত জিতু ভাইয়ার এ চাকরি অবসরপ্রাপ্ত বাবার ঘোরতর ডায়াবেটিকে ইনসুলিন ইনজেকশনের মতো চমৎকার কাজ দিয়েছে। মাইনা আর যা-ই হোক না কেন, দাদা যে প্রতিদিন ঘুম থেকে সকাল সকাল উঠে নয়টা-পাঁচটার নিয়মমাফিক শৃঙ্খলার কসরত আরম্ভ করেছে, ওতেই বাবা দুরারোগ্য ডায়াবেটিস থেকে একটু রিলাক্স পেলেন বলেই মনে হচ্ছে। তুমি তো ঢাকায় সেই যে কবে পাড়ি জমিয়েছ। কোথায় আছ, কেমন আছ, সেসবের কিছুই জানিনে! অথচ আমার শিলা বান্ধবীর বড় ভাই মঞ্জুর রানা, গত মাসের ৮ তারিখে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করার জন্য ইউএসএতে পাড়ি জমিয়েছে। এই গতকাল শিলার মা-বাবা তার একটা চিঠি পেয়েছেন। অথচ! তুমি কী খেয়ালি মানুষ! চাকরি চাকরি করে জানটা শেষ করে দিচ্ছ! দু’কলম লেখার সময়টুকু বা সদিচ্ছাটুকুও তোমার নেই! আশ্চর্য মানুষ তুমি!
‘জানি না বিএ পাস করে কোন সে দুরারোগ্য ক্ষয়ব্যাধিতে ভুগছ তুমি! যে পিশপিশে স্বভাবের মানুষ তুমি! তোমার খাওয়া, ঘুম ইত্যাদি নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। আমার কথা জানতে চেয়ে চিঠি না-ইবা লিখলে! কিন্তু তোমার খবরাখবর তো লিখতে পারো। কী! তারও কোনো সংগতি নেই নাকি তোমার? তোমার বন্ধু-ম্যানেজার রঞ্জনের প্রেসের ঠিকানায় পরপর বেশ কয়েকটি চিঠি লিখলাম। জানি, একদিন তুমি কোটিপতি হয়ে গেলেও তোমার বন্ধুর ওই হস্তচালিত ব্রজহরি-মার্কা প্রেসের ঠিকানা আর চেঞ্জ হবে না। ওখানকার আন্ধারকোঠায় বসে বেকার ছেলেপিলেদের নিয়ে সাহিত্যের আড্ডায় মজে থাকবে নিশিদিন। তোমার বদভ্যাসের ধরন, ভালো করেই জানি আমি। শোনো, শিগগিরই মা হতে চলেছি আমি! খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ এটা...।’
সান্তাহার থেকে পাওয়া অবসরপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারের একমাত্র কন্যা, বাংলা সম্মানের ছাত্রী মিতুর লম্বা চিঠিটা দুমড়েমুচড়ে ফেলে বেণু। রঞ্জনের প্রেসের ঠিকানায় কাল এসেছে এটা। এ নিয়ে দফায় দফায় বেশ কয়েকটা চিঠি পেয়েছে বেণু। কিন্তু উত্তর আর লেখা হয়নি। অবশ্য অনিচ্ছা-টনিচ্ছা কিছু নয়। এই লিখি লিখি করেই এ যাবৎ...। ইন্টারভিউ ইন্টারভিউ করে বেশ কটা দিন ধকল গেছে ওর ওপর দিয়ে। শালার চাকরি! কর্মকর্তা আর কর্মচারীরা, একেকটা সংস্থা আমরণ আঁকড়ে ধরে বসে আছে! যেন বাপ-দাদার ব্যবসায় আর কি! কোথাও পাত্তা না পেয়ে বিএ পাস সুদর্শন এবং বিবাহিত-বেকার বেণু, সোনার হরিণ চাকরির আশা বাদ দিয়ে আপাতত টিউশনিতে লেগে গেছে। ঢাকায় টিউশনি পেতে হলেও আজকাল সে রকম কাঠখড় পোড়াতে হয়! এককালের কলেজ-বন্ধু পিন্টুই আপদ-বিপদে ওর পরম সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওরা একসঙ্গে এক মেসেই খায়। এক মেসেই ঘুমায়।
মিতু লিখেছিল, ‘তুমি দেখো, আমাদের ছেলে হবে।’ বেণু পাল্টা লিখেছিল, ‘বেকার বাপের জন্য পুত্রসন্তানই একমাত্র ভরসা ও সান্ত্বনা। ভবিষ্যতে একদিন সেই পুত্রসন্তান বড় চাকুরে বা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে, অনেক টাকা আয় করবে, এসব ভেবে বসে থাকলেই জীবন সার্থক। তুমি মা হতে চলেছ। ভালো! তোমার সেই যোগ্যতাও আছে! হও! আর তোমার এই মা হওয়াটাই আমার জন্য বিরাট একটা প্রমোশন! প্রথমে স্বামী! তারপর পিতা! অন্তত শিশুখাদ্য ডিপার্টমেন্টে নিত্য দৌড়াদৌড়ি করার ক্রেডিটেবল অধিকার! আহ্! বুক ফুলে যায় গর্বে! দারিদ্র্যপীড়িত এই তৃতীয় বিশ্বে বিবাহিত অথচ বেকার যুবকদের এর চেয়ে সম্মানীয় বড় অধিক কিছু পাওয়ার নেই বোধ করি!’ তা-ও বেশ কয়েক মাস আগের কথা।
মিতু আবার লিখেছিল, ‘ঢাকায় কিছু করতে না পারলে সান্তাহার চলে এসো। অন্তত স্কুলে মাস্টারিটা করতে পারবে এখানে।’ বেণু জানে, মফস্বলে এই ‘সম্মানজনক’ পেশায় পেট তো ভরেই না! মনও ভরে না! তাই শ্রদ্ধেয় শ্বশুর সাহেবের ওয়ারিশি সম্মানটুকু পারতপক্ষে মাথায় তুলতে রাজি নয় বেণু। যদিও টিউশনি তারই হুবহু ডুপ্লিকেট কার্বন কপি। তবু তো ঢাকায় থাকা যায়! জিতু। সম্বন্ধী তার একজন বলতেই হবে! মান্যবর তিনি, এমএ পাস। হাতে গোনা কয়েকটি টাকার নিশ্চয়তা পেয়ে সেই সান্তাহারেই রয়ে গেলেন! ব্যক্তিগত উচ্চাকাক্সক্ষা বলতে তার কিছুই নেই! একেই বলে, সাচ্চা জনদরদি এবং দেশপ্রেমিক!
বেণু মিতুকে উদ্দেশ করে বলে, ‘আপনার বাবা আমার পিতৃতুল্য শ্বশুর মহাশয় এখন রিটায়ার্ড, অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার। কী পেয়েছেন তিনি জীবনে? তার যৌবনটা খরচ করে দিয়েছেন অন্যের ছেলেমেয়েদের পেছনে! এখন উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের নিয়মিত রোগী তিনি। স্মরণশক্তিও দ্রুত তার লোপ পাচ্ছে দিন দিন। হিরের টুকরো নিজের ছেলেটার চাকরি না হলে হয়তো পুরো ব্রেনই আউট হয়ে যেত তার!’
আর তারই সবেধন জামাই বাবাজি বেণু! চাকরির নেশায় রাজধানীর অফিসপাড়ার দ্বারে দ্বারে হন্যে হয়ে ছুটে চলেছে। তাই চেহারায় তার সাচ্চা পোড়খাওয়া মানুষের ছবি ফুটে উঠেছে। বলা যায়, আধুনিক কবি একজন। প্রেসের ম্যানেজার বন্ধু রঞ্জন প্রায়ই বলে, ‘কিছু লিখলেই তো পারিস। বই আমি ছাপিয়ে দেব।’
বেণুর চিন্তা আপাতত একটা চাকরি। উপযুক্ত পরিমাণে কিছু টাকা। মানে, সংগতি নিয়ে বেঁচে থাকার জরুরি প্রক্রিয়ায় মত্ত হওয়ার মতো খাঁটি নিশ্চয়তা। ওদিকে শ্বশুরালয়ে বেণুর প্রতীক্ষায় পতিপ্রাণা মিতু, এক আসন্ন সন্তানসম্ভবা রমণী!
সরকারি চাকরির বয়স এরই মধ্যে প্রমোশনের ডেটলাইন অতিক্রম করে ঊর্ধ্বগতিতে অবসরপ্রাপ্তির দিকে ধেয়ে চলেছে তার! হায় বিধাতা! গতকালের কিশোর, আজ যুবক! আজকের যুবক, আগামীকাল প্রৌঢ়! দিয়েছ বয়স! মানুষকে এতটা লম্বা করে পরক্ষণেই আবার ইলাস্টিকের মতো কুঁচকে দুমরে ফেলো তুমি! আর কী দিয়েছ আমাদের? দেশের বাইরে মধুচন্দ্রিমার সুবর্ণ সুযোগ? যুবতী স্ত্রীকে নিয়ে কক্সবাজার না হোক, ঢাকার রমনা পার্কের মধুরেণ-সান্নিধ্য? না! মোটামুটি বেতনে ঢাকায় না হোক; মফস্বল সান্তাহারে শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি একটা সম্মানজনক পেশার আস্বাদ লাভের দুর্লভ সুযোগ? কিছুই না! বাপ-দাদার ব্যাংক ব্যালান্স আছে তো সার্টিফিকেট আছে। আর আছে মঞ্জুর রানাদের মতো ইউএসএর মতো স্বর্গভূমিতে গিয়ে নিজেদের বয়সটাকে চিরসবুজ করে লাইফটাকে এনজয় করা। নচেৎ মাননীয় সম্বন্ধীর মতো হাজার টাকার ফিজিক্যাল অ্যান্ড মেন্টাল এক্সারসাইজিং ডিউটি। এ যেন চরম শারীরিক অস্বস্তিতে হোমিও ডোজ! দীর্ঘমেয়াদি স্লো অ্যাকশন। ওদিকে মহামান্য শ্বশুর মহাশয় এই অক্ষম জামাতা সম্পর্কে যে খুব ভালো ধারণা নিচ্ছেন না, তার প্রমাণ তার নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা। একমাত্র হিরের টুকরো ছেলের বেকারত্ব যদি ডায়াবেটিসের অপ্রিয় অনুভূতি হয়, তো জামাই-বাবা তো পরের ছেলে। নেহাত তার একমাত্র মেয়েকে সঁপে দিয়েছেন ওর হাতে। তাতে তার ব্লাড ক্যানসার হওয়াটাও বিচিত্র নয়!
বাংলায় অনার্স মিতুর কাণ্ডজ্ঞান, আউট নলেজ ইত্যাদি নিয়ে বেণুর এখন ভাবার সময় নেই। মিতুর চিঠিটা কুচি কুচি করে ছুড়ে মারে পাশের নর্দমায়। সে রঞ্জনের প্রেসে কি মেসে কোথায়, এতক্ষণে তার খেয়াল হলো। আসলে সে উল্লিখিত কোথাও নেই। সে এখন মানুষের কোলাহলমুখর রাস্তায় দাঁড়িয়ে। সামনে দুর্গন্ধময় ময়লার ভাগাড়। আর ডানে-বাঁয়ে চিপাগলি।
পাশ দিয়ে একটা রিকশা তাকে ক্রস করে পেছন দিকে ছুটে গেল। রিকশায় পাশাপাশি স্বামী-স্ত্রী আর কোলে ছোট্ট ফুটফুটে কন্যাশিশু। বেণু ঘাড় বাঁকা করে পেছনে তাকিয়ে দেখে, ততক্ষণে রিকশাটা চলে গেছে অনেক দূর। সে আবার হাঁটতে থাকে উল্টো দিকে।
আচ্ছা, তার মিতু কি মা হয়েছে এত দিনে? আপাতত কোনো আপডেট নেই। আগামীকালই সে সান্তাহার রওনা হবে। এটাই নিশ্চিত। মিতুর পেইন উঠলে কী সাংঘাতিক বিপদ হবে!
নাহ্। কাল নয়, বরং আজই বিকেলে বেণু সান্তাহারের ট্রেনে চড়বে। এটাই এখন তার জন্য জরুরি।
‘গুডবাই ঢাকা! পরিশেষে, ইস্কুল মাস্টারির কাজটা পেলেই এবার বাঁচি!’ বেণু মনে মনে এ চিত্রই কল্পনা করে, ঢাকায় আর নেই সে। রাজধানীর সবকিছু গুটিয়ে, পরিশেষে সান্তাহারেই মিতুর কাছে ফিরে গেছে। মিতুর বড় ভাই জিতু যেখানে শিক্ষকতা করছেন, বেণুও সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছে।
‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার...’ আবৃত্তি করতে করতে ডান দিকে মোড় নিয়ে ডানের চিপাগলির ভেতরে ঢুকে পড়ে বেণু।-মেরিল্যান্ড
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041