মায়ের ডাক

প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০০:১৩ , বিশেষ সংখ্যা
গত সন্ধ্যা থেকেই টানা বৃষ্টি। তাই মাটির দেয়াল চুইয়ে পানি আসছে। উপরের চাল থেকেও পানি ঝরছে। ভোরের দিকে ঘুমটা একটু কড়া হয়েছে। বাইরে বৃষ্টির পানির ঝটকা খেয়ে, চোখ মেলে তাকায় অনল। ঘরের মেঝেটা অর্ধেকের বেশি ভিজে, স্যাঁতসেঁতে হয়ে উঠেছে। দমকা বাতাসে, ঘরের শণের নড়বড়ে চাল দুটোও নড়ছে। পেছনের কাঁঠালগাছটার ডালপালাগুলো চালের ওপর দাপাদাপি করেছে। তো, টানা মুষলধারায় বৃষ্টি মন্দ লাগছে না। আস্তে আস্তে উঠে জানালা দিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকায় অনল। দেখে, মা তার কাজ করছেন। গমগম করে রান্নাঘর থেকে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
আজ সকাল নয়টায় অনলের ক্লাস। সময় পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। ভালোই হলো। ঘরে বসে বর্ষণমুখর দিনটা কাটানো যাবে মজা করে! তাই তো, ইংলিশ স্যারের পড়াটাও ধীরে-সুস্থে ঠিক করে নেওয়া যাবে। আর অঙ্ক স্যারের সূত্রমালা! বাপরে! কাল যে ক্লাস-পরীক্ষা! কালকের পরীক্ষাটা বেশ ভালোই হবে মনে হচ্ছে। কুপিটা জ্বেলে অঙ্ক বইটা মেলে খাতা-পেনসিল নিয়ে বসে পড়ে অনল।
ভিজতে ভিজতে মা এসে ঘরে ঢোকেন। অনলের সামনে একটা থালায় কিছু চালভাজা রাখেন। অনল চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকায়। ইশ! মা যে একদম ভিজে গেছেন! ঠান্ডায় তার শরীরটা কাঁপছে!
-মা! তুমি যে একেবারেই ভিজে গেছ! এক্ষুনি শাড়িটা বদলে নাও, মা!
-তাতে কিছুই হবে না, বাবা। নে, খেয়ে নে। ঘরে আটা নেই। তাই চাল ভেজে আনলাম।
অনল উঠে রশিতে ঝোলানো শাড়িটা আনতে গিয়ে দেখে, সেটাও ভেজা।
-মা, তোমার এই শাড়িটাও যে ভেজা! ঘরে পরার আর তো কোনো শাড়ি নেই তোমার!
-কাল যে সন্ধ্যাবেলায় গা ধুয়েছি, তাই।
-তো, বাইরে পরার তোমার ভালো শাড়িটা দিই, মা।
-না বাবা! দরকার নেই। গায়ের শাড়িটা খুব বেশি ভেজেনি!
-কী যে বলো তুমি, মা! আমি তো দেখছি পুরো শাড়িটাই তোমার ভিজে গেছে!
মায়ের মুখে হাসি। গতকাল সুমনদের বাড়িতে মুড়ি ভাজতে গিয়েছিলেন অনলের মা। অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে অনলকে নিয়ে দিন কাটিয়ে দেন তিনি। অনেকবারই আপত্তি করেছে অনল। লেখাপড়া না করে খেয়াঘাটে যাত্রী পারাপার করবে। সে তার মায়ের মুখে হাসি ফোটাবেই। কিন্তু মা তাতে রাজি নন। অনলের মায়ের একমাত্র স্বপ্ন, লেখাপড়া শিখে অনলকে মানুষ হতেই হবে। তবেই তার সব দুঃখ দূর হবে।
আহা বেচারা মা! এখনই আবার যাবেন তিনি চেয়ারম্যান কাকার বাড়িতে কাজ করতে। মায়ের আরও একটা শাড়ি দরকার। অথচ চেয়ারম্যান কাকা তা দেখেও দেখেন না! তাদের আত্মা নেই! মায়া-মমতা নেই! তারা আবার বড়লোক!
যদিও বর্ষণমুখর দিনটা অনলের কাছে বড্ড ভালো লাগে, কিন্তু শুধু তো ভালো লাগলেই বাঁচা যাবে না। ওদের মতো গরিবদের কাছে বর্ষা আর খরার মাঝে তো কোনো তফাত নেই। সামান্য কটা চালভাজা খেয়ে অনলকে পড়তে বলে মা তার ভেজা কাপড়েই ছালামুড়ি দিয়ে চেয়ারম্যান কাকার বাড়ি চলে গেছেন। বইতে মন বসাতে পারছে না অনল। মা এত কষ্ট করেন! এ কষ্ট আর কত দিন সইবেন তিনি? তার শরীরেও নানা রোগ বাসা বেঁধেছে! ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ আর বুকের ব্যথা নিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে যেতে হয় তাকে। আবার অনলের খাবারও জোগাড় করতে হয় তাকে। অনল ঠিকই বুঝতে পারছে, দিন দিন মায়ের শরীর দুর্বল হয়ে আসছে! আর তার ছেলে হয়ে সে কতকাল তা দেখে যাবে? না। এবার আর নয়। এবার নৌকা একটা ভাড়া নেবেই। যদিও নৌকা ভালো বাইতে পারে না সে। তবে অল্প দিনেই রপ্ত করে নিতে পারবে। ক্লাসের ‘ফার্স্টবয়’ হয়ে সামান্য নৌকাবাইচটা শিখতে পারবে না? মাকে শাড়ি কিনে দিতে পারবে না? ওদের দুজনার খাবার জোগাতে পারবে না? মাকে সুখী করতে পারবে না? পারবে। অবশ্যই পারবে সে। তাকে পড়াশোনার সঙ্গে এত কিছুও করতে হবে!
হ্যাঁ! হ্যাঁ! এক এক করে সবই পারবে অনল। পারতে তাকে হবেই যে। আর নয়। তার মা নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দেবেন! আর অনল তা দেখে যাবে? না। কিছুতেই না। ভাবনার অতলে ডুবে যায় অনল।
দুপুরে বাড়ি আসেন মা। অপলক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে অনল। আহা! সেই ভেজা শাড়িটা এখনো মায়ের গায়ে! ‘মা! তুমি। তুমি...!’
আর কিছু বলতে পারে না অনল। কান্নায় ভেঙে পড়ে সে।
-আমি আর পড়ব না, মা! তোমার এই কষ্ট! আমি সইতে পারছি না, মা!
দুই হাতে সামনের বইগুলো দূরে ঠেলে দেয় সে।
-দূর পাগল ছেলে আমার! আমার কষ্ট হবে কেন রে? এই তো শুকিয়ে গেছে। দ্যাখ। যা বাবা। হাতমুখ ধুয়ে ভাত কটা খেয়ে নে লক্ষ্মীটি! আমার আবার তাড়াতাড়ি যেতে হবে। এদিকে ছাগলটা সারা দিনে কিছু খায়নি। কটা কাঁঠাল পাতা কেটে দিই।
মা দা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যান।
সন্ধ্যার পর আবার মুষলধারায় বৃষ্টি। অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারদিক। ছাগলটা বারান্দার কোণে বেঁধে বই নিয়ে বসে পড়ে অনল।
হুমড়ি খেয়ে ঘরে এসে পড়েন মা। থরথর করে তার সিক্ত শীর্ণ দেহটা কাঁপছে। ব্যস্ত হয়ে মাকে কাছে টেনে নেয় অনল। ইশ! জ্বরে সারাটা গা পুড়ে যাচ্ছে তার! মাকে বিছানায় শুইয়ে দুটো কাঁথা টেনে তার গায়ে চেপে দেয় সে। মা প্রলাপ বকছেন। কী করবে সে এখন? বাইরে তো প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। ঘোর অন্ধকার। পরিষ্কার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। উত্তেজনায় দেহটা কাঁপছে অনলের। এদিকে মাও তার বেহুঁশ হয়ে পড়েছেন! মায়ের জন্য ওষুধ আনতেই হবে। এখনই সে গমেজ ডাক্তার কাকার কাছে যাবে। আর দেরি নয়! দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে পড়ে অনল। উঠান পেরিয়ে উভ্রান্তের মতো ছুটে যায় পূর্ব দিকে। মাথার ওপর প্রবল বর্ষণ! সঙ্গে দমকা বাতাস! ঘন জঙ্গলের পাশ দিয়ে এগিয়ে যায় সে সামনের দিকে। তার একটাই ভাবনা-মায়ের জন্য ওষুধ। তাই সব ভয় উপেক্ষা করে দ্রুত পা চালায় সে। ওই তো! ওই তো দূরে, বিলের আবছায়া অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। এখনই ওপারে গমেজ ডাক্তারের বাড়ি যেতে হবে তাকে। ওষুধ এনে মাকে খাওয়াতে হবে। তাকে ভালো করতেই হবে। নিশ্চয়, মা তার সুস্থ হয়ে উঠবেন। সে উঁচু গলায় বলে, ‘ঈশ্বর, তুমি মাকে রক্ষা করো!’
-তোমার কষ্ট আমি বুঝি, মা। আমি তোমার সব কষ্ট দূর করে দেব মা! তোমার আশীর্বাদে সবই আমি করতে পারব মা!
মাকে উদ্দেশ করে বলে অনল, ‘মা, তুমি একটু সবুর করো। আমি ওষুধ নিয়ে আসছি, মা! তুমি ভালো হয়ে যাবে, লক্ষ্মী মা আমার!’
বিলের পারে ছুটে যায় অনল। উত্তেজনায় বুকটা ধড়পড় করছে তার। বিজলির ঝলকে সে কাছেই সুমনদের বোরো খেতে একটি লগি দেখতে পাচ্ছে। তার সঙ্গে পানির নিচে ডুবে থাকা একটি ডিঙি নৌকার গলুই দেখতে পায়। নিশ্চয় এটি সুমনদের নৌকা। অনল জানে, এখানে পানির গভীরতা খুব বেশি নয়। খুব বেশি হলে বুক পর্যন্ত পানি হবে। ত্বরিতে বোরো খেতে নেমে পড়ে সে। দুই হাতে প্রাণপণ চেষ্টা করে, অল্পক্ষণের মধ্যেই ডিঙিটা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়। এদিক-ওদিক কাত করে ডিঙির পানি অনেকটাই সরিয়ে ফেলে। তারপর একটানে লগিটা তুলে জোরসে ভর মারে। শাঁ শাঁ করে সামনের দিকে ছুটে চলে ডিঙিটা। ঘন অন্ধকারে সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এ আরেক ঝামেলা! তবু অনুমানের ওপর ভর করে এগিয়ে চলছে সে। বুকটা কাঁপছে দুরু দুরু। মাকে উদ্দেশ করে বলে, ‘লক্ষ্মী মা! একটু অপেক্ষা করো। আমি ওষুধ নিয়ে আসছি! তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে, মা!’
এই তো গমেজ ডাক্তার কাকার বাড়ির ঘাট। হিজলগাছের পরে বাঁশতলা পেরিয়ে গেলে সামনেই ডাক্তার কাকার বাড়ি। তড়িঘড়ি করে নৌকা থেকে নেমেই মাথার ওপর বৃষ্টি নিয়ে পা চালায় সে। আকাশ ভেঙে ঠাটা পড়ছে বারবার ! সঙ্গে আলোর ঝলকানি! তাতে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই অনলের মনে।
গমেজ ডাক্তারের উঠানে এসে পিচ্ছিল খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে উল্টে পড়ে যায় অনল। দুই হাতে ভর করে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে গিয়ে ‘ডাক্তার কাকা! ডাক্তার কাকা! আমি অনল!’, ‘ডাক্তার কাকা, দরজাটা খোলেন! আমার মায়ের খুব কষ্ট!’ বলে গমেজ ডাক্তারের দরজায় অনবরত ঘা মারতে থাকে।
দীর্ঘক্ষণ পর খানিকটা ফাঁকা হয়ে আসে দরজাটা।
-ডাক্তার কাকা! ডাক্তার কাকা! আমার মাকে বাঁচান!
হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে অনল। তার পুরো শরীর বেয়ে পানি পড়ছে। দরজা ঠেলে গমেজ ডাক্তারের ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে সে।
-আরে! আরে, করছিস কী? এই ভিজা শরীরে আমার ঘরে ঢুকে পড়লি যে!
এই অবস্থায় অনলকে দেখে ‘ভূত’ দেখার মতো চমকে ওঠেন শুকনো কাঠখোট্টা চেহারার গমেজ ডাক্তার।
লণ্ঠনের মৃদু আলোয় অনলের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করেন তিনি। চশমাটা চোখের কাছে টেনে নিয়ে নড়েচড়ে বসে বলেন, ‘হু! ঠেকায় পড়লেই ডাক্তার কাকা! তোদের ভাগ্য, আমি গমেজ ডাক্তার এখনো বেঁচে আছি! আরে, আমি মরলেই টের পাইবি; কত ধানে কত চাল!’
নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে অনল। এ কেমন কথা!
-আরে! আমার ঘরে খাড়াইয়া, কাঁথা-বালিশ ভিজাইবি নাকি! টেকা দে!
উঁচু গলায় খেঁকিয়ে ওঠেন অশীতিপর গমেজ ডাক্তার।
-ডাক্তার কাকা! আমার মাকে বাঁচান! যত টাকা লাগে...!
এগিয়ে গমেজ ডাক্তারের পায়ের কাছে বসে পড়ে অনল।
-এই রাইতে খায়াদায়া আমার আর কাম নাই? যা! বাইর হ!
উঠে দাঁড়িয়ে অনলকে ধাক্কা মেরে দরজা বন্ধ করে দেন গমেজ ডাক্তার।
অনলও উঠে দাঁড়ায়। সে ডাক্তারের দরজায় আবার ঘা মারে কয়েকবার। দরজা খুলে যায়। সামনে দাঁড়িয়ে গমেজ ডাক্তার! অনল তার মুখোমুখি।
-কী হয়েছে?
-কাকা! মায়ের গায়ে ভীষণ জ্বর! সর্দি-কাশি! বুকে ব্যথা! আরও...!
-খাড়া বেটা! আরও...! ব্যারামের তো শেষ নাই...! এ্যাহ্!
ঘরে ঢুকে আবার ফিরে আসেন তিনি।
-এই নে। গিয়েই আগে দুইটা বড়ি খাইতে দিবি। দাম কিন্তু পাঁচ টাকা। আমি খাতায় লিখে রেখেছি। টাকা আনবি তো আরও ওষুধ পাইবি। বাকিতে ওষুধ নাই! যাহ্‌!
-ঠিক আছে, কাকা। অনেক ধন্যবাদ। আপনের টাকা আমি পরিশোধ করবই।
-হ্যাঁ। কথাটা মনে থাকে যেন।
বিলের ঘাটে ছুটে যায় অনল। কিন্তু কোথায় তার ডিঙি নৌকা? সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, মা তাকে ডাকছেন, ‘বাবা অনল! তুই কোথায়, বাবা? আমার ওষুধের আর দরকার নাই! তুই চলে আয়, বাবা!’
সে এখন স্পষ্টই মায়ের ডাক শুনতে পাচ্ছে! আর দেরি নয়। তার হাতের শক্ত মুঠোয় মায়ের জন্য ওষুধ। এই ওষুধ খেয়ে মা নিশ্চিত সুস্থ হয়ে উঠবেন। মা যে তার আদরের অনলের ডাকের অপেক্ষায় কান পেতে আছেন!
কোনো উপায় না দেখে ‘মা! আমি আসছি!’ বলে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনল। এ সময় একমাত্র মা-ই যে তার পরম আশ্রয়। তার সুস্থ মায়ের সান্নিধ্য লাভে আপ্লুত হবে সে। তার বুকে মাথা রেখে উপভোগ করবে অনাবিল সুখ ও স্বর্গীয় আনন্দ!
ঘোর অন্ধকারে ঘন কালো আকাশ ভেঙে অবিরাম ঝরছে জলধারা। সঙ্গে টানা গুরুগম্ভীর মেঘের গর্জন। জোর বাতাসের ধাক্কায় আন্দোলিত হচ্ছে বর্ষায় টইটম্বুর বিলের পানি। মুহুর্মুহু জেগে উঠছে উঁচু ঢেউ। অদম্য সব ঢেউয়ের বিপরীতে অজানা লক্ষ্যে ছুটে চলছে অভিযাত্রী সাহসী কিশোর অনল। এতক্ষণে নিশ্চয় অন্য এক অচেনা জগতে সুস্থ-সবলা মায়ের সাক্ষাৎ পেয়ে গেছে আমাদের গল্পের নায়ক অনল!
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078