
নানুর মাথায় আকস্মিক ভেঙে পড়ল বিরাট এক ঝাড়বাতি। আমি আর নানু তখন পায়ে পা মিলিয়ে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে সাদা বালির ওপর হাঁটছি। কোথা থেকে পড়ল ঝাড়বাতি? আমি চীৎকার দিয়ে আকাশের দিকে তাকাই। ঠিক তখনই আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘড়িতে তিনটা বেজে তেইশ মিনিট। বালিশের পাশে রাখা আদরের গীতবিতান বুকে চেপে ধরে অন্ধকারে বসে আমি অন্ধকার দেখি। আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করে না। পচা ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমে প্রাণ যায় যায় দশা। গরম ছাড়াও দুশ্চিন্তা, ভয়ে শুধু শরীর নয়, যেন আত্মাও ঘামছে। অস্বাভাবিক বোধ করি। নানুর কথা মনে পড়ে। জীবনে এমন একজন অপার্থিব নানুর সান্নিধ্য পেয়েছি ভেবে ভয়ের মধ্যেও খুশি লাগে। পৃথিবীকে নানু তার শরীরের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলতেন। জীবনকে যেমন ব্যাকুল ভালোবাসতেন, পৃথিবীকেও তেমন ভালোবাসতেন। তিনি মানুষ, প্রকৃতি তথা প্রতিটি প্রাণ ভালোবাসতেন। তিনি চাইতেন মানুষ প্রকৃতির মতো সহজ হোক, জলের মতো বয়ে যাক। তার অন্তরের দয়ালু সৌন্দর্য সদা ফুটে উঠত চোখেমুখে। তাই তো, অশীতিপর নানুকে আমার মনে হতো প্রাণবন্ত অষ্টাদশী যুবতীর মতন। সুমধুর কুহু স্বরে কোকিলের মতো কথা বলতেন, তার হাসিতে যেন পাহাড়ের চূড়া থেকে শিউলি বৃষ্টি ঝরে পড়ত। তার মুখাবয়বে দেখেছি এক শান্ত নদী, যে নদীর বুকে আকাশের মুখ দেখা যায়।

নানুর সঙ্গে আমি ঘুমাতাম। ভোরে ঘুম-চোখ মেলেই তিনি আমার কপালে আদরের তিলক এঁকে দিতেন। অতঃপর বিছানা ছেড়ে এই ঘর, ওই ঘর, বারান্দায় পায়চারি করতেন। ফজরের নামাজ শেষে গীতবিতান হতে ‘আলোর অমল কমলখানি কে ফুটালে, নীল আকাশের ঘুম ছুটালে। আমার মনের ভাবনাগুলি বাহির হলো পাখা তুলি, ওই কমলের পথে তাদের সেই জুটালে...’ গানটি গলা ছেড়ে গাইতেন। তার মুগ্ধ ডাকে ঘরের সকলের ঘুম ভাঙত, নতুন দিনের সূচনা হতো নতুন জীবনীশক্তিতে। তার জীবনের সকল শুভ রং তিনি ঢেলে দিয়েছেন আমাদের ওপর।
নানুর দিকে তাকিয়ে আমার আম্মা প্রায়ই বলতেন, ‘মানুষ ছেড়ে যায়, আলো যায় না।’ নানুর মুখে নাকি মামার মুখখানি তিরতির করে কাঁপে, আম্মা সেটি দেখতে পেতেন। আমার একমাত্র মামাকে নানু হারিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে নানা শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়লেও আম্মার মুখে শুনেছি, নানুর অন্তর পোড়া গনগনে আগুনের আভা মুখে ফুটে উঠলেও তিনি অনেকটা স্বাভাবিক ছিলেন। ভাবি, ওই সময় নানুর স্বাভাবিক না থেকে অন্য কোনো উপায়ও তো ছিল না। হার্টের রোগী নানা এবং একমাত্র কন্যা আমার আম্মাকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বিধ্বস্ত সময়টা তার জন্য মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বেড়ালের মতো রাতদিন নানুর গায়ের সঙ্গে এলিয়ে থেকে সেসব কঠিন দিনের অনেক গল্পও শুনেছি।
নানুর মধ্যে মেধা ও প্রতিভার একটা প্রভা ছিল, তার কথা ও কাজে সেটি বিচ্ছুরিত হতো। সোহেল মামা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর তার মাথার ওপর আকাশ, পায়ের তলে মাটি ছাড়া ভরসা হিসেবে তেমন কাউকে পাননি। সংসারের ঘানি টেনেছেন একা। তার স্বপ্ন ছিল নানা এবং আম্মা ভালোভাবে বাঁচুক, আর কোনো কষ্ট যেন তাদের ছুঁতে না পারে। তিনি তাদের মাথার ওপর ছাদ হয়ে ছিলেন জীবনভর।
আব্বার সঙ্গে সোহেল মামার দেখা হয় আগরতলার মেলাঘর ক্যাম্পে, সেখানেই তাদের সখ্য গড়ে ওঠে। আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তারা প্রশিক্ষণ নেন, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আব্বার মুখে শুনেছি, যুদ্ধের বেসিক ট্রেনিংগুলোয় ভালো পারফর্ম করায় মামা লিডারশিপ ট্রেনিংয়ের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। মামা খুব লম্বা-চওড়া ও মেধাবী ছিলেন। ছোটবেলায় তবলা, গান শিখেছেন। ট্রেনিং চলাকালীন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম, অনুশীলনের পর উদাস চোখজোড়া নিঃসীমতার পানে ছড়িয়ে দিয়ে মামা দেশাত্মবোধক গান গাইতেন। সেই সুরের ইন্দ্রজালে সমস্ত ভয় কেটে চারপাশে সকলের মধ্যে এক আশ্চর্য শক্তি সঞ্চারিত হতো। মানুষের বহুত্বকে নিয়ে থাকতে মামার আনন্দ হতো। তার মুখে মাঝেমধ্যে গভীর বিষাদ দেখতেন আব্বা, সেই বিষাদের কারণ জানা যায়নি। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আব্বা এবং মামা আলাদা সেক্টরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘট। যুদ্ধ শেষে আব্বা ফিরে এলেন। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র-নির্বিশেষে বহুর আনন্দে আনন্দিত মামা মিশে গেলেন বাংলাদেশের হৃদয়ে, বাংলাদেশিদের দৈনন্দিন যাপনের ক্যানভাসে। আব্বা, আম্মা এবং নানুর মুখে মামার গল্প শুনে শুনে পরম শ্রদ্ধায় আমার স্মৃতিসুধায় লেপ্টে আছেন তিনি। জীবনযাপনের কণ্টকাকীর্ণ পথে হাঁপিয়ে উঠলে দেশের জন্য মামার ত্যাগ, মানবতা, সরলতাকে আঁকড়ে থাকি, প্রাণে তখন যেন অক্সিজেন সরবরাহ বেড়ে যায়, আরাম পাই।
নানু আমাকে বলতেন, চলার পথে যত প্রলয়ংকরী ঝড় আসুক, সব সময় জীবনকে পছন্দ করবি। জীবনে সুখে থাকার, সুখ বেছে নেওয়ার সবটা দায়িত্ব নিজের, অন্য কারও নয়। সে জন্য বোধ করি, নানু আব্বাকে পছন্দ করেছেন আম্মার জন্য। আব্বার মধ্যে হয়তো নানু তার হারিয়ে ফেলা সন্তানের সুখ পেতেন। আব্বাও ছেলের মতো নানুর যত্ন নিতেন, শ্রদ্ধা করতেন। নানা মারা গেলে নানু গ্রামের বাড়িতে আট মাস একা থেকেছেন। আম্মা শিশুর মতো কেঁদে বারবার চেষ্টা করেও তাকে ঢাকায় আসার জন্য রাজি করাতে পারেননি। আমি চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে বলেছিলাম, একা বাড়িতে থাকতে তোমার ডর লাগে না, নানু? তিনি উত্তরে বলেছেন, ‘একা কোথায়, তোর নানা আছে! মানুষটাকে একা রেখে কীভাবে ঢাকা যাই? প্রতিদিন ঘুম ভেঙেই বাড়ির পূর্ব পাশে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করি, কথা বলি। একইভাবে দুপুরে-সন্ধ্যায়ও যাই।’
আম্মা, আমি কারও অনুরোধই শোনেননি। আমাদের শত অনুনয়-বিনয়ে নিস্পৃহ, বিকারহীন নানু আব্বার শরীর খারাপ শুনেই মাইক্রোবাসে চেপে একাকী ঢাকায় চলে আসেন। তার আগমনে আম্মার ওষ্ঠাগত প্রাণ যেন পানি পেল। সেই থেকে নানু আমাদের সঙ্গে থেকে গেলেন। আব্বা এবং নানুর মধ্যে সম্পর্ক ছিল গভীরতর, ঠিক পাহাড়ি ঝরনার উৎসের মতো।
আম্মার হু হু কান্নার শব্দে মনের ভাবনা থেকে বের হয়ে বিছানা ছেড়ে নামি, দু’হাতে জানালার গ্রিল শক্ত করে চেপে ধরি। তার হাউমাউ কান্না যেকোনো মানুষের মর্ম স্পর্শ করবে, আমি তো তার মেয়ে। তখনো ফজরের আজান পড়েনি। জানালার গ্রিল গলে একটা শ্যামল হাওয়া উড়ে এসে ছুঁয়ে যায় আমাকে। বারান্দায় নানুর হাতের যত্নে টবে বেড়ে ওঠা গাছগুলো দুলছে। নানু নেই, কিন্তু তার ছায়া হাওয়ার মতো চুপচাপ আমাদের সঙ্গে সর্বত্র হাঁটছে। এমন ভোরে তিনি আমাকে ডেকে তুলে তার ঝুলবারান্দার বাগান দেখিয়ে বলতেন, ‘কোন গাছটা তোর প্রিয়?’ সর্বদা আমি বেলি ফুলগাছটাই বেছে নিতাম। আমার বন্ধুরা এসেও এই বাগানে হুল্লোড় করত। সবার পছন্দের গাছ তিনি টবে পুঁততেন। নানু বলতেন, ‘মানুষ যেমন প্রেমে বাঁচে, যত্ন চায়, গাছও তেমন প্রেম চায়, যত্ন চায়। মানুষের মুখ যেমন বলে দেয় তার পাশের মানুষটা তাকে কেমন প্রেমে, যত্নে রেখেছে, তেমন একেকটা গাছের দিকে তাকালেও বোঝা যায় গাছটি মানুষের কেমন যত্ন, প্রেমে আছে।’ তিনি গাছগুলোর সঙ্গে কথা বলতেন, কবিতা শোনাতেন, আমি অবাক বিস্ময়ে উপভোগ করতাম। গাছ মানুষকে সহিষ্ণু হতে শেখায়, যত বেশি গাছের সঙ্গে থাকা যায়, তত বেশি সহিষ্ণু হওয়া যায়, তার কাছ থেকেই শিখেছি।
নানুর বাগানে আমি একা দাঁড়িয়ে। অন্তর পুড়ে যাচ্ছে, গাছের সান্নিধ্যে কেন শীতল হতে পারছি না? নানুর মতো গাছগুলোকে প্রেম, যত্ন দিতে পারিনি, তাই হয়তো ওরা আমার অন্তর শীতল করছে না। জগতের সবকিছু চলে দেওয়া-নেওয়ার ভিত্তিতে, যা দেব তা-ই ফেরত পাব, এটাই প্রকৃতির নিয়ম! নানুর নাম আলো কে রেখেছিলেন, জানা হয়নি। যেখানটায় তিনি ছিলেন, সব শুভ আলো সেখানটায় ঝলমল করত।
ফজরের নামাজ শেষ করে আম্মা আমার পাশে এসে দাঁড়ান। তখনো ভোরের আলো ফোটেনি, অচিরেই ফুটবে, আকাশে তেমন ভাব উঠেছে। বিবর্ণ, বিধ্বস্ত আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। গাছের নরম ডালের মতো মসৃণ চুলগুলো উসকোখুসকো হয়ে আছে, পাক ধরেছে। তার অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির মতো। কাঁদতে কাঁদতে গত দুই মাসে তার চোখে শ্যাওলা জমেছে। নানু মারা যাওয়ার পর আম্মার ডিমনেশিয়া, ইনসমনিয়া বেড়েছে হু হু করে। ঘুমের ওষুধ খেয়েও রাত জেগে থাকেন। গতকালের ঘটনা আজ ভুলে গেলেও রক্তাক্ত জুলাই-আগস্টে নির্বিচারে ছাত্র হত্যা, সাধারণ মানুষ হত্যার ভয়ংকর ঘটনাগুলো সব মনে রেখেছেন।
আমি তাকে জড়িয়ে ধরি। কিছু বলি না। মনে হয়, পৃথিবীর প্রাচীন মানুষটা অসহায়ের মতো আমার বুকে থরথর কাঁপছেন। ভাষাহীন আমরা কাঁদতে থাকি, কাঁদতেই থাকি। আব্বা এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে আম্মাকে খেতে দেন। লক্ষ করি, পানিটাও যেন তার গলায় ঠেকে ঠেকে যাচ্ছে। একটু চুমুক দিয়ে গ্লাসটা মেঝেতে রেখেই আব্বার ওপর আম্মা ক্ষিপ্র হয়ে ওঠেন। বিদ্যুৎ বেগে আব্বার সামনে গিয়ে ক্রোধোন্মত্ত কণ্ঠে বলেন, ‘তুমি গ্রাম থেকে আমার মাকে কেন ঢাকায় এনেছিলে? গ্রামে থাকলে জুলাইয়ের এমন সহিংসতা, মানুষ হত্যা মা দেখতেন না, খবর পেতেন না, তার প্যানিক অ্যাটাক হতো না, মা বেঁচে থাকতেন।’
নানু মারা যাওয়ার পর আম্মার বেসামাল অবস্থা দেখে আমি আর আব্বা চেষ্টা করছি স্বাভাবিক থাকার জন্য, সোহেল মামাকে হারিয়ে বুকে কষ্ট চেপে নানু যেমন স্বাভাবিক ছিলেন, ঠিক তেমন। আব্বা চুপচাপ নিজের কক্ষে ফিরে যান। আম্মা তখনো তার মতো করে নিজের পাণ্ডুলিপি কাটাছেঁড়া করছেন। নানুর আচমকা মৃত্যুটা তার কাছে অস্বাভাবিক, কোনোভাবেই তাকে শান্ত করতে পারছি না। ‘ওহ, মাগো!’ বলে আম্মা কাতরাতে কাতরাতে বলেন, ‘মৃত্যুর আগের দিনও মা নিজ হাতে লাল শাক রান্না করেছেন, গোসল শেষে কাপড় ধুয়েছেন, গাছের পরিচর্যা করেছেন। আমার থেকে টাকা নিয়ে তোর বাবাকে দিয়ে পানির কেইস কিনে এনেছেন। ছাত্রদের মিছিলে পানির বোতল দিয়েছেন। এই রক্তাক্ত জুলাই, এত ছাত্র, নিরীহ মানুষের মৃত্যু আমার শক্তপোক্ত মাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। সুস্থ মা আমার রাতে টেলিভিশনে বীভৎস সব খবর দেখে চিরঘুমে তলিয়ে গেছেন। আমি এতিম হয়ে গেলাম। বাবা-মা, একমাত্র ভাই সবাইকে হারালাম।’
মায়ের আত্মগত সংলাপ খসে খসে পড়ছে পাখির পালকের মতো। কিছু বলি না, কিছুই বলতে পারি না আমি। কষ্টে বুকটা চৌচির হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই তো, নানুর অকস্মাৎ মৃত্যুর জন্য তো আমিই দায়ী, কিংবা আমরাই দায়ী। নানুকে না বলে বন্ধুদের সঙ্গে মিছিলে গিয়েছি, কোনো দিন বাড়িই ফিরিনি, যখন ঘরে ফিরেছি, দেখেছি তার চোখে নৈঃশব্দ্য, উপাসনা। জুলাই-আগস্ট শেষ হলেও সেসব শ্বাসরুদ্ধকর উদ্বেগের দিনগুলো মাখামাখি হয়ে ঘুরঘুর করছে আম্মার মস্তিষ্কে, আমার পরিবারে। এই ক্ষত জীবনে কোনো দিন ঘুচবে কি না, জানি না।
ততক্ষণে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে ঝরনাধারার মতো। জানালার পর্দা সরিয়ে আম্মাকে বলি, অন্ধকারের পাহাড় ডিঙিয়ে কী সুন্দর নতুন আলো ফুটেছে, দেখো! আম্মা মুখের ওপর তেরচাভাবে হাত রেখে বলেন, ‘আমার আলো হারিয়ে গেছে। যন্ত্রণাময় ধূসর চার দেয়ালের ফাঁকে এই আলোয় আমার ক্ষত শুধু বাড়ছে রে, মা।’ আম্মার ক্ষতের পাশে শিউলি ফোটা ম-ম গন্ধে ডুবে ক্লান্ত আমি দিগন্তে আলো দেখি। লেখক : কথাসাহিত্যিক

নানুর সঙ্গে আমি ঘুমাতাম। ভোরে ঘুম-চোখ মেলেই তিনি আমার কপালে আদরের তিলক এঁকে দিতেন। অতঃপর বিছানা ছেড়ে এই ঘর, ওই ঘর, বারান্দায় পায়চারি করতেন। ফজরের নামাজ শেষে গীতবিতান হতে ‘আলোর অমল কমলখানি কে ফুটালে, নীল আকাশের ঘুম ছুটালে। আমার মনের ভাবনাগুলি বাহির হলো পাখা তুলি, ওই কমলের পথে তাদের সেই জুটালে...’ গানটি গলা ছেড়ে গাইতেন। তার মুগ্ধ ডাকে ঘরের সকলের ঘুম ভাঙত, নতুন দিনের সূচনা হতো নতুন জীবনীশক্তিতে। তার জীবনের সকল শুভ রং তিনি ঢেলে দিয়েছেন আমাদের ওপর।
নানুর দিকে তাকিয়ে আমার আম্মা প্রায়ই বলতেন, ‘মানুষ ছেড়ে যায়, আলো যায় না।’ নানুর মুখে নাকি মামার মুখখানি তিরতির করে কাঁপে, আম্মা সেটি দেখতে পেতেন। আমার একমাত্র মামাকে নানু হারিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে নানা শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়লেও আম্মার মুখে শুনেছি, নানুর অন্তর পোড়া গনগনে আগুনের আভা মুখে ফুটে উঠলেও তিনি অনেকটা স্বাভাবিক ছিলেন। ভাবি, ওই সময় নানুর স্বাভাবিক না থেকে অন্য কোনো উপায়ও তো ছিল না। হার্টের রোগী নানা এবং একমাত্র কন্যা আমার আম্মাকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বিধ্বস্ত সময়টা তার জন্য মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বেড়ালের মতো রাতদিন নানুর গায়ের সঙ্গে এলিয়ে থেকে সেসব কঠিন দিনের অনেক গল্পও শুনেছি।
নানুর মধ্যে মেধা ও প্রতিভার একটা প্রভা ছিল, তার কথা ও কাজে সেটি বিচ্ছুরিত হতো। সোহেল মামা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর তার মাথার ওপর আকাশ, পায়ের তলে মাটি ছাড়া ভরসা হিসেবে তেমন কাউকে পাননি। সংসারের ঘানি টেনেছেন একা। তার স্বপ্ন ছিল নানা এবং আম্মা ভালোভাবে বাঁচুক, আর কোনো কষ্ট যেন তাদের ছুঁতে না পারে। তিনি তাদের মাথার ওপর ছাদ হয়ে ছিলেন জীবনভর।
আব্বার সঙ্গে সোহেল মামার দেখা হয় আগরতলার মেলাঘর ক্যাম্পে, সেখানেই তাদের সখ্য গড়ে ওঠে। আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তারা প্রশিক্ষণ নেন, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আব্বার মুখে শুনেছি, যুদ্ধের বেসিক ট্রেনিংগুলোয় ভালো পারফর্ম করায় মামা লিডারশিপ ট্রেনিংয়ের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। মামা খুব লম্বা-চওড়া ও মেধাবী ছিলেন। ছোটবেলায় তবলা, গান শিখেছেন। ট্রেনিং চলাকালীন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম, অনুশীলনের পর উদাস চোখজোড়া নিঃসীমতার পানে ছড়িয়ে দিয়ে মামা দেশাত্মবোধক গান গাইতেন। সেই সুরের ইন্দ্রজালে সমস্ত ভয় কেটে চারপাশে সকলের মধ্যে এক আশ্চর্য শক্তি সঞ্চারিত হতো। মানুষের বহুত্বকে নিয়ে থাকতে মামার আনন্দ হতো। তার মুখে মাঝেমধ্যে গভীর বিষাদ দেখতেন আব্বা, সেই বিষাদের কারণ জানা যায়নি। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আব্বা এবং মামা আলাদা সেক্টরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘট। যুদ্ধ শেষে আব্বা ফিরে এলেন। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র-নির্বিশেষে বহুর আনন্দে আনন্দিত মামা মিশে গেলেন বাংলাদেশের হৃদয়ে, বাংলাদেশিদের দৈনন্দিন যাপনের ক্যানভাসে। আব্বা, আম্মা এবং নানুর মুখে মামার গল্প শুনে শুনে পরম শ্রদ্ধায় আমার স্মৃতিসুধায় লেপ্টে আছেন তিনি। জীবনযাপনের কণ্টকাকীর্ণ পথে হাঁপিয়ে উঠলে দেশের জন্য মামার ত্যাগ, মানবতা, সরলতাকে আঁকড়ে থাকি, প্রাণে তখন যেন অক্সিজেন সরবরাহ বেড়ে যায়, আরাম পাই।
নানু আমাকে বলতেন, চলার পথে যত প্রলয়ংকরী ঝড় আসুক, সব সময় জীবনকে পছন্দ করবি। জীবনে সুখে থাকার, সুখ বেছে নেওয়ার সবটা দায়িত্ব নিজের, অন্য কারও নয়। সে জন্য বোধ করি, নানু আব্বাকে পছন্দ করেছেন আম্মার জন্য। আব্বার মধ্যে হয়তো নানু তার হারিয়ে ফেলা সন্তানের সুখ পেতেন। আব্বাও ছেলের মতো নানুর যত্ন নিতেন, শ্রদ্ধা করতেন। নানা মারা গেলে নানু গ্রামের বাড়িতে আট মাস একা থেকেছেন। আম্মা শিশুর মতো কেঁদে বারবার চেষ্টা করেও তাকে ঢাকায় আসার জন্য রাজি করাতে পারেননি। আমি চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে বলেছিলাম, একা বাড়িতে থাকতে তোমার ডর লাগে না, নানু? তিনি উত্তরে বলেছেন, ‘একা কোথায়, তোর নানা আছে! মানুষটাকে একা রেখে কীভাবে ঢাকা যাই? প্রতিদিন ঘুম ভেঙেই বাড়ির পূর্ব পাশে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করি, কথা বলি। একইভাবে দুপুরে-সন্ধ্যায়ও যাই।’
আম্মা, আমি কারও অনুরোধই শোনেননি। আমাদের শত অনুনয়-বিনয়ে নিস্পৃহ, বিকারহীন নানু আব্বার শরীর খারাপ শুনেই মাইক্রোবাসে চেপে একাকী ঢাকায় চলে আসেন। তার আগমনে আম্মার ওষ্ঠাগত প্রাণ যেন পানি পেল। সেই থেকে নানু আমাদের সঙ্গে থেকে গেলেন। আব্বা এবং নানুর মধ্যে সম্পর্ক ছিল গভীরতর, ঠিক পাহাড়ি ঝরনার উৎসের মতো।
আম্মার হু হু কান্নার শব্দে মনের ভাবনা থেকে বের হয়ে বিছানা ছেড়ে নামি, দু’হাতে জানালার গ্রিল শক্ত করে চেপে ধরি। তার হাউমাউ কান্না যেকোনো মানুষের মর্ম স্পর্শ করবে, আমি তো তার মেয়ে। তখনো ফজরের আজান পড়েনি। জানালার গ্রিল গলে একটা শ্যামল হাওয়া উড়ে এসে ছুঁয়ে যায় আমাকে। বারান্দায় নানুর হাতের যত্নে টবে বেড়ে ওঠা গাছগুলো দুলছে। নানু নেই, কিন্তু তার ছায়া হাওয়ার মতো চুপচাপ আমাদের সঙ্গে সর্বত্র হাঁটছে। এমন ভোরে তিনি আমাকে ডেকে তুলে তার ঝুলবারান্দার বাগান দেখিয়ে বলতেন, ‘কোন গাছটা তোর প্রিয়?’ সর্বদা আমি বেলি ফুলগাছটাই বেছে নিতাম। আমার বন্ধুরা এসেও এই বাগানে হুল্লোড় করত। সবার পছন্দের গাছ তিনি টবে পুঁততেন। নানু বলতেন, ‘মানুষ যেমন প্রেমে বাঁচে, যত্ন চায়, গাছও তেমন প্রেম চায়, যত্ন চায়। মানুষের মুখ যেমন বলে দেয় তার পাশের মানুষটা তাকে কেমন প্রেমে, যত্নে রেখেছে, তেমন একেকটা গাছের দিকে তাকালেও বোঝা যায় গাছটি মানুষের কেমন যত্ন, প্রেমে আছে।’ তিনি গাছগুলোর সঙ্গে কথা বলতেন, কবিতা শোনাতেন, আমি অবাক বিস্ময়ে উপভোগ করতাম। গাছ মানুষকে সহিষ্ণু হতে শেখায়, যত বেশি গাছের সঙ্গে থাকা যায়, তত বেশি সহিষ্ণু হওয়া যায়, তার কাছ থেকেই শিখেছি।
নানুর বাগানে আমি একা দাঁড়িয়ে। অন্তর পুড়ে যাচ্ছে, গাছের সান্নিধ্যে কেন শীতল হতে পারছি না? নানুর মতো গাছগুলোকে প্রেম, যত্ন দিতে পারিনি, তাই হয়তো ওরা আমার অন্তর শীতল করছে না। জগতের সবকিছু চলে দেওয়া-নেওয়ার ভিত্তিতে, যা দেব তা-ই ফেরত পাব, এটাই প্রকৃতির নিয়ম! নানুর নাম আলো কে রেখেছিলেন, জানা হয়নি। যেখানটায় তিনি ছিলেন, সব শুভ আলো সেখানটায় ঝলমল করত।
ফজরের নামাজ শেষ করে আম্মা আমার পাশে এসে দাঁড়ান। তখনো ভোরের আলো ফোটেনি, অচিরেই ফুটবে, আকাশে তেমন ভাব উঠেছে। বিবর্ণ, বিধ্বস্ত আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। গাছের নরম ডালের মতো মসৃণ চুলগুলো উসকোখুসকো হয়ে আছে, পাক ধরেছে। তার অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির মতো। কাঁদতে কাঁদতে গত দুই মাসে তার চোখে শ্যাওলা জমেছে। নানু মারা যাওয়ার পর আম্মার ডিমনেশিয়া, ইনসমনিয়া বেড়েছে হু হু করে। ঘুমের ওষুধ খেয়েও রাত জেগে থাকেন। গতকালের ঘটনা আজ ভুলে গেলেও রক্তাক্ত জুলাই-আগস্টে নির্বিচারে ছাত্র হত্যা, সাধারণ মানুষ হত্যার ভয়ংকর ঘটনাগুলো সব মনে রেখেছেন।
আমি তাকে জড়িয়ে ধরি। কিছু বলি না। মনে হয়, পৃথিবীর প্রাচীন মানুষটা অসহায়ের মতো আমার বুকে থরথর কাঁপছেন। ভাষাহীন আমরা কাঁদতে থাকি, কাঁদতেই থাকি। আব্বা এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে আম্মাকে খেতে দেন। লক্ষ করি, পানিটাও যেন তার গলায় ঠেকে ঠেকে যাচ্ছে। একটু চুমুক দিয়ে গ্লাসটা মেঝেতে রেখেই আব্বার ওপর আম্মা ক্ষিপ্র হয়ে ওঠেন। বিদ্যুৎ বেগে আব্বার সামনে গিয়ে ক্রোধোন্মত্ত কণ্ঠে বলেন, ‘তুমি গ্রাম থেকে আমার মাকে কেন ঢাকায় এনেছিলে? গ্রামে থাকলে জুলাইয়ের এমন সহিংসতা, মানুষ হত্যা মা দেখতেন না, খবর পেতেন না, তার প্যানিক অ্যাটাক হতো না, মা বেঁচে থাকতেন।’
নানু মারা যাওয়ার পর আম্মার বেসামাল অবস্থা দেখে আমি আর আব্বা চেষ্টা করছি স্বাভাবিক থাকার জন্য, সোহেল মামাকে হারিয়ে বুকে কষ্ট চেপে নানু যেমন স্বাভাবিক ছিলেন, ঠিক তেমন। আব্বা চুপচাপ নিজের কক্ষে ফিরে যান। আম্মা তখনো তার মতো করে নিজের পাণ্ডুলিপি কাটাছেঁড়া করছেন। নানুর আচমকা মৃত্যুটা তার কাছে অস্বাভাবিক, কোনোভাবেই তাকে শান্ত করতে পারছি না। ‘ওহ, মাগো!’ বলে আম্মা কাতরাতে কাতরাতে বলেন, ‘মৃত্যুর আগের দিনও মা নিজ হাতে লাল শাক রান্না করেছেন, গোসল শেষে কাপড় ধুয়েছেন, গাছের পরিচর্যা করেছেন। আমার থেকে টাকা নিয়ে তোর বাবাকে দিয়ে পানির কেইস কিনে এনেছেন। ছাত্রদের মিছিলে পানির বোতল দিয়েছেন। এই রক্তাক্ত জুলাই, এত ছাত্র, নিরীহ মানুষের মৃত্যু আমার শক্তপোক্ত মাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। সুস্থ মা আমার রাতে টেলিভিশনে বীভৎস সব খবর দেখে চিরঘুমে তলিয়ে গেছেন। আমি এতিম হয়ে গেলাম। বাবা-মা, একমাত্র ভাই সবাইকে হারালাম।’
মায়ের আত্মগত সংলাপ খসে খসে পড়ছে পাখির পালকের মতো। কিছু বলি না, কিছুই বলতে পারি না আমি। কষ্টে বুকটা চৌচির হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই তো, নানুর অকস্মাৎ মৃত্যুর জন্য তো আমিই দায়ী, কিংবা আমরাই দায়ী। নানুকে না বলে বন্ধুদের সঙ্গে মিছিলে গিয়েছি, কোনো দিন বাড়িই ফিরিনি, যখন ঘরে ফিরেছি, দেখেছি তার চোখে নৈঃশব্দ্য, উপাসনা। জুলাই-আগস্ট শেষ হলেও সেসব শ্বাসরুদ্ধকর উদ্বেগের দিনগুলো মাখামাখি হয়ে ঘুরঘুর করছে আম্মার মস্তিষ্কে, আমার পরিবারে। এই ক্ষত জীবনে কোনো দিন ঘুচবে কি না, জানি না।
ততক্ষণে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে ঝরনাধারার মতো। জানালার পর্দা সরিয়ে আম্মাকে বলি, অন্ধকারের পাহাড় ডিঙিয়ে কী সুন্দর নতুন আলো ফুটেছে, দেখো! আম্মা মুখের ওপর তেরচাভাবে হাত রেখে বলেন, ‘আমার আলো হারিয়ে গেছে। যন্ত্রণাময় ধূসর চার দেয়ালের ফাঁকে এই আলোয় আমার ক্ষত শুধু বাড়ছে রে, মা।’ আম্মার ক্ষতের পাশে শিউলি ফোটা ম-ম গন্ধে ডুবে ক্লান্ত আমি দিগন্তে আলো দেখি। লেখক : কথাসাহিত্যিক