মাথা উঁচু করে টিকে থাকুক ‘ঠিকানা’

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১৩:০২ , বিশেষ সংখ্যা
 
প্রতিবার একুশ এলেই ‘ঠিকানা’র মুকুটে যুক্ত হয় নতুন একেক পালক। যে পালকে লেপ্টে থাকে অযুত বাধার প্রহর ডিঙিয়ে আরও এক স্বপ্নমাখা ভোরের গল্প। থাকে নতুন প্রত্যয়-প্রত্যাশার হাতছানি। এবার ছত্রিশের ভোরে পা বাড়াল প্রবাসী বাঙালির আনন্দ-বেদনার ঠিকানা, ‘ঠিকানা’। আচ্ছা, প্রবাসে থাকা মানে কি শুধু ভিন্ন এক আকাশের নিচে নিজের মাটি আর মানুষ থেকে দূরে থাকা? নাকি এর অর্থ আরও গভীর- নিজস্ব শিকড়ের টান, মায়ের ভাষা-সংস্কৃতির মায়া এবং চিরন্তন এক স্মৃতির খোঁজ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বারবার ফিরে আসতে হয় নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত প্রবাসী বাঙালির মুখপত্র ‘ঠিকানা’র দিকে। তিন যুগ ধরে এই পত্রিকাটি শুধু একটি সংবাদপত্র নয়, বরং প্রবাসী বাঙালিদের হৃদয়ের এক অদৃশ্য সেতু, যা মানুষকে তাদের শেকড়ের সঙ্গে অটুট করে রেখেছে। ফলে কালের পথপরিক্রমায় ‘ঠিকানা’ হয়ে উঠেছে প্রবাসে বাংলাভাষী মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার উজ্জ্বল এক দর্পণ।
ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে ‘ঠিকানা’ এক বিস্ময়ের নাম। আমাদের কাছে প্রবাস মানেই এক যন্ত্রজীবন। জীবিকার পেছনে আবেগ-অনুরাগহীন এক ঘোড়দৌড়। সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে একটি পত্রিকা এতগুলো বছর সমানতালে পাঠকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে টিকে আছে, এর চেয়ে বিস্ময়ের আর কী আছে!
‘ঠিকানা’ আমার কাছে অন্য রকম এক ভাবালুতার প্ল্যাটফর্ম। কান পাতলে আবেগের রিনিঝিনি নূপুর বেজে ওঠে। ভেতরটা নরম হয়ে আসে। পেছনে তাকালে স্মৃতির সোনালি রোদ গায়ে লাগে। আনন্দ উতলে ওঠে। ‘ঠিকানা’রই সহোদর কুলাউড়া থেকে প্রকাশিত ‘মানব ঠিকানা’য় আমার লেখালেখির হাতেখড়ি। সাংবাদিকতা, সংবাদপত্র, লেখালেখি- এই ব্যাপারগুলো আমার ভাবনার অলিন্দে ঢুকিয়ে দেয় ‘মানব ঠিকানা’ই। সেই আত্মশ্লাঘা নিয়ে আজও নিজেকে ‘ঠিকানা’ পরিবারের একজন ভেবে পুলক অনুভব করি।

বছর দুয়েক আগে নিউইয়র্কে কিছুদিন অবস্থান করার সুবাদে ‘ঠিকানা’র জনপ্রিয়তা টের পাই। প্রবাসী বাঙালিরা কেমন করে উন্মুখ হয়ে থাকে একটি পত্রিকার জন্য, তা নিজের চোখে দেখার, খুব কাছে থেকে অনুভব করার সুযোগ পাই। শুধু তা-ই নয়, যে কদিন ছিলাম আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গে নানা আলাপে, আড্ডায় ‘ঠিকানা’র পাঠকপ্রিয়তা, বিশ্বাসযোগ্যতা অনুভব করেছি দারুণভাবে। মনে হয়েছে, নিউইয়র্কের বাঙালি কমিউনিটির জীবন ও জীবন-সংলগ্ন গল্পের মধ্যে ‘ঠিকানা’র স্থান অনন্য উচ্চতার। শুধু সংবাদ প্রচার নয়, নিউইয়র্কে বসবাসরত বাঙালি কমিউনিটির অভাব-অভিযোগ, দাবি-দাওয়া, সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে ‘ঠিকানা’। শুধু তা-ই নয়, জ্যাকসন হাইটসের অফিসে বেড়াতে গিয়ে দেখি, লেখক, পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা, শুভানুধ্যায়ীদের কী আন্তরিক যাতায়াত, ভাববিনিময়! দেখি, কেমন করে ‘ঠিকানা’কে সবাই নিজেদের ভাবেন! আর এটাই ‘ঠিকানা’র মূল শক্তি। মানে পাঠকের অচ্ছেদ্য ভালোবাসা, নিরঙ্কুশ সমর্থনই ‘ঠিকানা’কে দিয়েছে পথচলার সাহস ও প্রেরণা।
এটা সবারই জানা, প্রবাসে বসবাসকারীদের জন্য ভাষা আর সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলা খুব সহজাত ব্যাপার। কিন্তু ‘ঠিকানা’ এই হারানোর বিপরীতে দাঁড়িয়েছে। এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় ফুটে ওঠে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে প্রবাসে বসবাসরত লেখকদের কবিতা, গান, সমসাময়িক সাহিত্যিকদের প্রবন্ধ, ছোটগল্প, নাটক, এমনকি প্রবাসী নতুন প্রজন্মের সৃষ্টিশীল চর্চাও। এতে উঠে আসে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী উৎসব, সাহিত্য আলোচনা, ইতিহাসের অনুরণন এবং বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি ও সমাজের নানাবিধ দিক।
‘ঠিকানা’য় একদিকে যেমন প্রবীণ প্রজন্মের জন্য পরিচিতের স্বাদ থাকে, তেমনি নতুন প্রজন্মের কাছে বাঙালি সংস্কৃতিকে করে তোলে সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয়। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ‘ঠিকানা’ হয়ে উঠেছে এক চলমান উত্তরাধিকার। প্রতি সপ্তাহে পাঠ করলে দেখা যায়, প্রবাসী জীবনের সুখ-দুঃখ, সংগ্রাম, সাফল্য এবং চ্যালেঞ্জগুলো ‘ঠিকানা’র পাতায় উঠে আসে জীবন্তভাবে। প্রবাসী বাঙালিদের সাফল্যের গল্প থেকে শুরু করে অভিবাসন-সংক্রান্ত জটিলতা, সামাজিক ইস্যু, প্রবাসের ছোট ছোট বিজয়ের মুহূর্তগুলোও এখানে স্থান পায়। এটি শুধু খবরের কাগজ নয়; বরং একধরনের আত্মজীবনী, যেখানে প্রবাসী বাঙালির জীবনের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে।
যুগ বদলাচ্ছে, ছাপা পত্রিকার পাশাপাশি এসেছে ডিজিটাল মিডিয়া। কিন্তু ‘ঠিকানা’ তার মূল দর্শন থেকে সরে যায়নি। অনলাইন সংস্করণ, ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থিতি- সবকিছু মিলিয়ে ‘ঠিকানা’ তার পাঠকদের আরও কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললেও এর অন্তর্নিহিত বাঙালিয়ানার সৌরভ কখনো কমেনি।
৩৫ বছরের পথচলায় ‘ঠিকানা’ হয়ে উঠেছে শুধু একটি পত্রিকা নয়, প্রবাসী বাঙালির ইতিহাসের অংশ। এটি আমাদের শেখায়, দূরত্ব কখনো ভাষা বা সংস্কৃতির দেয়াল গড়ে দিতে পারে না। যত দিন প্রবাসী বাঙালির হৃদয়ে বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা থাকবে, তত দিন ‘ঠিকানা’ তার নামের মতোই সবার হৃদয়ে গেঁথে থাকবে।
৩৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘ঠিকানা’কে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। অশেষ কৃতজ্ঞতা ‘ঠিকানা’ পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে। প্রবাসী বাঙালির এই নির্ভরতার জায়গাটি আরও বহু বছর ধরে বাঙালি চেতনার দীপশিখা জ্বালিয়ে রাখুক- আজকের শুভলগ্নে এই কামনাই রইল। আশা রইল, ‘ঠিকানা’ যেন মাথা উঁচু করে টিকে থাকে।
আমার মনে হয়, ‘ঠিকানা’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে আমরা শুধু একটি পত্রিকার ইতিহাস কিংবা পথচলাকে উদ্্যাপন করছি না, বরং উদ্্যাপন করছি প্রবাসী বাঙালির আত্মপরিচয়, তাদের লড়াই, স্বপ্ন আর সংস্কৃতির অনন্ত ধারাবাহিকতাকে। ‘ঠিকানা’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়-আমরা হয়তো ভিন্ন দেশে বাস করি, কিন্তু আমাদের শেকড় এখনো একই, আমাদের হৃদয় এখনো বাংলাদেশের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।

লেখক : সংগঠক, সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ইংরেজি বিভাগ, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
 
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078