আমাদের জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার নানামুখী প্রভাব

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:০৬ , বিশেষ সংখ্যা
কিছুদিন আগের কথা, বিশেষ কারণে আমার কয়েকজন খুব কাছের মানুষের ফেসবুক আইডি ডিজঅ্যাবল হয়ে গিয়েছিল। তারা যে কী পরিমাণ হতাশাগ্রস্ত হয়েছিল, আমি তাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানতে পেরেছি। আমি নিজেও ফেসবুকে সক্রিয়, প্রতিদিন ব্যবহার করি। কিন্তু আমার আসলে জানা ছিল না যে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ফেসবুক একটি প্রাথমিক প্রয়োজন, যা কিনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় একটি মূল ভূমিকা পালন করে। ফেসবুককে বর্তমান সময়ের যোগাযোগের একটা সহজ মাধ্যম বলা চলে।
আমার বন্ধুরা যখন তাদের ফেসবুক আইডি ফিরে পেয়েছে, তখন তারা খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়, যেন এখন তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে। যে কদিন তাদের আইডি আন্ডার রিভিউতে ছিল, তাদের নাওয়া-খাওয়া-ঘুম সব বন্ধ প্রায়। তারা তাদের আইডি ফিরে পেয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে এসেছে। সে সময় তাদের কেবল ডিপ্রেশনে যাওয়ার আরেকটু বাকি ছিল।
এখন আমার প্রশ্ন হলো আমাদের জীবনে ফেসবুকের ভূমিকা কী? আসলেই কি ফেসবুক ছাড়া আমরা পঙ্গু? ফেসবুকের আগের প্রজন্ম কি উন্নত ছিল না?
আমেরিকায় স্কুলের বাচ্চাদের ঘটা করে এক সপ্তাহের জন্য ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ফ্রি সপ্তাহ পালন করা হয়। সেই সপ্তাহে বাচ্চাদেরকে চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়, স্কুল থেকে বাসায় আসার পর তারা কোনো রকমের কোনো ডিভাইস ব্যবহার করতে পারবে না। ফোন, আইপ্যাড, টিভি কোনো কিছুই দেখতে পারবে না। এক সপ্তাহের জন্য এটাই তাদেরকে চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়। সে সপ্তাহে বাচ্চারাও বাসায় এসে স্কুলের হোমওয়ার্ক শেষ করার পর বই পড়ে, ছবি আঁকে, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের গেম খেলে, বাবা-মায়ের সঙ্গে সংসারের অন্যান্য কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করে, পরিবারের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটিয়ে সেই সময়টা অতিবাহিত করে। যেসব বাচ্চা এই চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হয়, স্কুল থেকে তাদের ট্রিট দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু কিছু বাচ্চা আছে, যারা এক সপ্তাহ এই ডিভাইস থেকে দূরে থাকতে পারে না।
একটু আগে থেকেই বলি, আচ্ছা আপনাদের কি মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা, যখন বাসায় একটা ল্যান্ডফোন ছিল? সাধারণত ড্রইংরুমের কর্নারের টেবিলে থাকত। কারও ফোন এলে সেখানে সোফায় বসে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে কথা বলতে হতো। এই প্রজন্মের কাছে হয়তো অবিশ্বাস্য। কিন্তু আমরা অনেকেই আছি, যারা সেই দিনগুলো দেখেছি। এরপর বাজারে যখন প্রথম কর্ডলেস ফোন বের হয়েছে, আমি গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে একটা সেট কিনে নিয়ে এসেছি। সেই সেটের মধ্যে তিনটা ফোন ছিল। একটা কিচেনে দিয়েছি, একটা ড্রইংরুমে, একটা বেডরুমে। এবার মজা করে বেডরুমে শুয়ে শুয়ে প্রিয়জনদের সঙ্গে শুরু হয়ে গেল আলাপন। শুধু তা-ই নয়, সারা ঘরে হেঁটে হেঁটে কথা বলা যেত, সে কী এক্সাইটমেন্ট! তারপর ধীরে ধীরে বাসায় এল ইন্টারনেট, পার্সোনাল কম্পিউটার, আমার না একটা এওএল অ্যাকাউন্ট ছিল। আর এখন এসেছে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, টিকটক, স্ন্যাপচ্যাট, হোয়াটসঅ্যাপ, লিঙ্কডইন, পিন্টারেস্ট, রেডিডট- আরও আছে, আমি অবশ্য সবগুলোর নাম জানি না। তো আপনাদের এগুলোতে অ্যাকাউন্ট আছে তো, না হলে কিন্তু অনেক পিছিয়ে যাবেন বলে দিচ্ছি।
সারা বিশ্বে বসবাসরত আমাদের পরিচিত সবার জানতে হবে আমি কী খাচ্ছি, কী পরছি, কী করছি, কখন কোথায় যাচ্ছি, আর সবাই এগুলো দেখে লাইক কমেন্ট দিতে হবে। এটাই হচ্ছে আমাদের আধুনিক সমাজে সভ্যতার চর্চা। এককথায় বলা যায়, ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস কমিউনিকেশন ইন সোশ্যাল মিডিয়া স্টাইল।’
যা-ই হোক, প্রথমে এর ভালো দিকগুলো নিয়ে একটু বলি। তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে আজ সারা বিশ্ব আমাদের হাতের মুঠোয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো আমাদের জ্ঞানের ভান্ডার বিকাশে সহায়তা করে এবং বিনোদন দেয়, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। যেহেতু ফেসবুক, ইউটিউব মানুষের প্রতিভা প্রদর্শনের প্ল্যাটফর্ম, পৃথিবীর যেকোনো কিছু শিখতে হলে সোশ্যাল মিডিয়া এখন একমাত্র উপায়। সেটা হতে পারে একটি গাছের পরিচর্যা কীভাবে করবেন থেকে শুরু করে আলুর ভর্তা কীভাবে বানাবেন, মজাদার শাহি চিকেন রেজালা কীভাবে রান্না করবেন, কীভাবে সুস্থ থাকবেন, কীভাবে রোগের প্রতিরোধ করবেন, কীভাবে বাচ্চা পালবেন, কীভাবে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখবেন পর্যন্ত। দুনিয়াতে এমন কিছু নেই, যার সমাধান সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই। সেটা ছাড়াও যদি কোনো কারণে মন খারাপ থাকে, যেকোনো একটা হাসির ভিডিও দেখে নিমেষেই মন ভালো করে নিতে পারেন।
রান্নার ভিডিও দেখে যেমন দেশ-বিদেশের হরেক রকমের মজাদার রান্না আয়ত্ত করতে পারবেন, ঠিক তেমনি ভ্রমণের ভিডিও দেখে ঘরে বসেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দর্শনীয় স্থান উপভোগ করতে পারবেন। অনেকে ভালো গান করে, অনেকে ভালো ছবি আঁকে, অনেকে ভালো গল্প লিখে। অনেকে সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করে। সবকিছু পেতে হলে চাই সোশ্যাল মিডিয়া।
বলার অপেক্ষা রাখে না, শুধু এই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে অনেক লোক তাদের ব্যবসায় ব্যাপকভাবে সফলতা অর্জন করেছে। শুধু সঠিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত থেকে সঠিক টেকনিকগুলো অ্যাপ্লাই করতে জানতে হবে। ইউটিউব লাইভ, ফেসবুক লাইভ, ইনস্টাগ্রাম লাইভ, মানুষ তাদের পণ্য বিক্রি করে বেশ লাভবান হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার লাইভ আড্ডাগুলোতে জয়েন করে অনেক সময় অনেক ভালো কিছু তথ্য জানা যায়।
কিন্তু সবকিছু এত প্রগতিশীল এবং প্রতিটি সেক্টরে এত বেশি কম্পিটিশন যে এগুলোতে টিকে থাকা অনেক কষ্টসাধ্য। সে জন্য যেকোনো সেক্টরে টিকে থাকতে হলে নিজের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। দেখতে ভালোই লাগে, অমুকের কত ফ্রেন্ডস ফলোয়ার্স, কিন্তু এর পেছনে যে কত বিনিদ্র রাত এবং হাড়ভাঙা পরিশ্রম, সেটা যে করে শুধু সে-ই জানে। কিন্তু তাই বলে নতুনদের হতাশ করা যাবে না।
দিন শেষে এটাই বলব, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ড্রামা সিরিয়াল না দেখে যদি কেউ ওই সময়টা কোনো সৃজনশীল কাজে ব্যবহার করতে চায়, তাকে সব সময় সাপোর্ট করা উচিত। মায়ের পেট থেকে কেউ কোনো কিছু শিখে আসে না, সবাইকে কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতে হয়।
এবার এর খারাপ দিকগুলো বলি। আপনার যদি কোনো শত্রু না থাকে, তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি অ্যাকাউন্ট খুলবেন আর আপনার ভালো জিনিসগুলো পোস্ট করতে থাকবেন। দেখবেন, আপনার শত্রু অটোমেটিক তৈরি হয়ে গেছে। এমনি উপর দিয়ে আপনাকে কমেন্ট করবে ভালো হয়েছে, সুন্দর হয়েছে এটা সেটা, কিন্তু ভেতরে ভেতরে হিংসায় জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায়। অনেক সময় তারা আবার হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকে, তাদের ওয়ালে তারা টিটকারিমূলক পোস্ট করবে। এই সোশ্যাল মিডিয়া সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি করে, সেটা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আসক্তি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইউটিউবে ভিডিও দেখা কিংবা ফেসবুকে স্ক্রলিং করা। আমাদের দৈনন্দিন পারিবারিক সময় থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করছে। ভালো-মন্দ যাচাই-বাছাই না করে অনেক সময় আমরা যার তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলি এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হই। সে জন্য সোশ্যাল মিডিয়া অনেক সাবধানে ব্যবহার করতে হবে।
সবশেষে এটাই বলব, প্ল্যাটফর্মে আমাদের শেখার ভান্ডার দেওয়া আছে। সেখান থেকে আমরা শুধু যাচাই-বাছাই করে ভালোটাই জানার এবং শেখার চেষ্টা করে আমাদের কাজে লাগাব। আর এর পেছনে মাত্রাতিরিক্ত সময় দিয়ে নিজেদের জীবনের মূল্যবান সময়টা নষ্ট না করাই শ্রেয়। আসুন, নতুন বছরের অন্যান্য রেজুলেশনের লিস্টে এটাও যোগ করি। দিনে একটা নির্দিষ্ট সময় ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করব না। তাতে করে অনেক সময় বাঁচবে, যে সময়টায় আমরা অন্যান্য অনেক প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারব এবং পরিবারকে সময় দিতে পারব। একটা ভালো বই পড়তে পারব। কারণ বইপড়ার বিকল্প কিন্তু আর কিছুই নেই। বিল গেটস বছরে ৫০টি বই পড়েন, আর মার্ক জুকারবার্গ প্রতি সপ্তাহে একটি করে বই পড়েন। আপনি এ বছর কয়টি বই পড়েছেন, যদি এখনো না পড়েন, তাহলে খুব শিগগিরই শুরু করুন।
লেখক : কথাকার
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078