ভ্রমণ

হঠাৎ নাশতা

প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২০:২১ , বিশেষ সংখ্যা
আজ বুধবার, কর্মদিবস। শীতের দানবটা হিমাঙ্কের একটু ওপরে উঠেছে। সকালে লেপের নিচ থেকে মুখ বের করে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করি, কয়টা বাজে?
মুক্তি হাসতে হাসতে বলে, সাড়ে সাতটা।
-জল স্কুলে গেছে?
ওর এবারের হাসিটা রহস্যময়। হাসির শব্দ যখন শেষ কম্পন তরঙ্গে স্থির, যখন শোবার ঘরে রাতের নিস্তব্ধতা, তখন আমি দেহটিকে ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ভেঙে হেডবোর্ডে পিঠ ও ঘাড় ঠেকাই। মুক্তির চোখ তখন সেলফোনের স্ক্রিনে। আমার দিকে না তাকিয়েই বলে, তোমার মেয়ে বাস মিস করেছে।
সাধারণত জল স্কুলের বাস মিস করলে মুক্তি খুব বিরক্ত হয় কিন্তু আজ ওর মুখে বিরক্তির তো কোনো চিহ্ন নেই-ই, বরং মেয়ের ঘুম থেকে উঠতে না পারার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে।
-অনেক রাতে ঘুমিয়েছে, বারোটা অবধি নড়াচড়ার শব্দ পেয়েছি।
আমি বলি, থাক তাহলে, ঘুমাক। নয়টার দিকে আমরা দিয়ে আসব। ভালো কোনো রেস্তোরাঁয় নাশতাটাও সেরে আসা যাবে।
রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করা মুক্তির চিরকালই প্রিয়, আগে আমি খুব একটা রাজি হতাম না বলে কার্পণ্যের বদনাম জুটেছে অনেক। আজকাল বরং আমিই ওকে রাজি করাই। শনিবার এলেই বলি, চলো, আজ বাইরে ব্রেকফাস্ট করি।
যাওয়া-আসা মিলে ড্রাইভ করতে হবে ৫০ কিলোমিটার। আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই, ড্রাইভিং আমার একটি প্রিয় স্পোর্টস।
গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনের দুই পাশে পুড়ে যাওয়া অরণ্যের মতো কালো বৃক্ষকাণ্ড-সারি। তেইশ এক্সিট নিয়ে ক্রস আইল্যান্ড পার্কওয়েতে উঠি। উইক ডেতে এই রাস্তাটা খুব বিজি থাকে, আজও তা-ই। ডান দিকে খানিকটা উঁচুতে এবং বাঁ দিকের সমতলে গড়ে উঠেছে বেলরোজ নেইবারহুড। সারি সারি একই আকৃতির অসংখ্য কলোনিয়াল বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এই মহল্লাটি ভারতীয় শিখ সম্প্রদায়ের লোকেদের দখলে। এক দশক আগে বাড়ি কেনার জন্য এলাকাটা চষে বেড়িয়েছিলাম।
আরও মিনিট পাঁচেক ড্রাইভ করার পরে, নিউইয়র্কের হিডেন জ্যাম খ্যাত, ভ্যালি স্ট্রিম পার্কের রোড সাইনটি চোখে পড়ে। সত্যিই হিডেন জ্যাম। ঢোকার সময় মনে হয়, ছোট্ট একচিলতে পার্ক কিন্তু ভেতরে ঢোকার পরে অরণ্যের ভেতরে ছোট্ট এক বুনো ক্রিকের পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় উদ্ভাসিত হয় বিশাল এক সোয়ান লেক। লেকের এক পাড়ে সারি সারি কাঠের বেঞ্চ পাতা, মাথার ওপর ওক, বার্চ, নানান রঙের চেরি ব্লসমের সারি। কি গ্রীষ্ম, কি শীত, যেকোনো ঋতুতে, এমনকি তুষারের দিনেও ওখানে গিয়ে বসলেই মন ভালো হয়ে যায়। ভ্যালি স্ট্রিম পার্ক ডানে রেখে এগিয়ে যাই ওয়েস্ট হ্যাম্পস্টেডের দিকে।

এক্সিট ১৭ নিয়ে ঢুকে পড়ি ছিমছাম পরিচ্ছন্ন একটি লোকালয়ে। একটি গ্যাসস্টেশনকে ডানে রেখে ঈগল অ্যাভিনিউতে বাঁক নিতেই জল হেসে ওঠে। ও জানে, স্কুল এসে গেছে। জলকে নামিয়ে দিয়ে বলি, কোথায় খেতে চাও? ডাইনার?
প্রশ্নের উত্তরে মুক্তি আরেকটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে সরাসরি তাকিয়ে আছে আমার চোখের দিকে।
-হতে পারে। নাকি নেইবারহুডের কোনো নির্জন রেস্তোরাঁয় যেতে চাও?
-মন্দ হয় না।
আমরা মাঝে মাঝে দূরে কোথাও, বিরল বসতির কোনো গ্রামে, চলে যাই। খুঁজে খুঁজে একটি নির্জন রেস্তোরাঁ বের করি। হয়তো দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তাদের একমাত্র কন্যাকে নিয়ে চালাচ্ছেন ছোট্ট এক রেস্তোরাঁ। খাবারের আইটেমগুলোতে তেমন চাকচিক্য নেই কিন্তু সেগুলো মমতা-মাখানো, প্রাণের ছোঁয়ায় উজ্জীবিত।
প্রায়ই দেখা যায়, প্রবীণ দম্পতিদের একজন, কখনো দুজনই, আমাদের সঙ্গে বসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে তাদের দীর্ঘ জীবনের গল্প বলছেন।
-জানো, আমার যখন চুয়ান্ন বছর হলো, ঠিক করি, জন্মদিনে চুয়ান্ন মাইল দৌড়াব।
-তা-ই করলেন?
-তো আবার কী।
বুড়ি তখন মুখে একটা গর্বের অভিব্যক্তি তুলে বলেন, আট ঘণ্টারও কম সময় লেগেছিল। সাত ঘণ্টা একান্ন মিনিট কুড়ি সেকেন্ড, প্রিসাইজলি।
স্ত্রী ঠিক করে সময়ের রেকর্ড না বলায় কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করেন বুড়ো।
এসব গল্পে আমরা দারুণ অনুপ্রাণিত হই। যদিও বেশ কবারই দুজন হাত-ধরাধরি করে হাইকিংয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম কিন্তু কখনোই ১৫ মাইলের ওপরে উঠতে পারিনি।
খাবার কি আসলে শুধুই দেহের খাবার? আমাদের কাছে তা কখনোই মনে হয় না। এর সঙ্গে মনের একটা দারুণ যোগসূত্র আছে। প্রয়োজন, পরিমাণ, পাচন, পরিবেশন, পরিবেশÑএই পঞ্চ প-এর যখন সমন্বয় ঘটে এবং তার আস্বাদন গ্রহণের জন্য সঙ্গে থাকে প্রিয়জন, তখনই খাবার মানুষকে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দেয়।
ঠিক হলো আমরা পানেরা ব্রেডে যাব। আজকাল তো রেস্টুরেন্ট খুঁজে পাওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। গুগল ম্যাপে গিয়ে লিখলেই হয় ‘পানেরা ব্রেড নেয়ার মি’। আমি এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে মুক্তিকে বলি, ঠিকানা বলো।
মুক্তি হয়তো একটু ভুলই করল। ভুলটাও বুঝতে পারল, যখন ড্যাশবোর্ডের ওপর হরাইজন্টালি রাখা সেলফোনের স্ক্রিন বলছে, ১১ মাইল।
আমি বলি, সো হোয়াট? এই সুন্দর সকালে আমরা দুজন একটা লম্বা ড্রাইভে বের হলাম, ক্ষতি কী?
এই হাইওয়েটা বেশ ফাঁকা। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ। জানুয়ারি মাসের এমন উজ্জ্বল দিনকেই বোধ হয় মার্কিনিরা বলে, ক্রিসপি কোল্ড। হঠাৎ কি অ্যাকুরার দুটো লাল ডানা গজাল? সৎভাই কুবেরকে পরাজিত করে যক্ষরাজ্যের রাজা হন রাবণ। দখলে চলে আসে ভাইয়ের প্রিয় পুষ্পক রথটিও, যেটি তৈরি করেছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। সেই উড়ালরথ নিয়ে রাবণ বেরিয়েছিলেন আনন্দ ভ্রমণে। রাবণের সেই মুহূর্তের আনন্দানুভূতিটা এখন আমরা অনুভব করার চেষ্টা করছি।
রাস্তার পাশে বেশ বড় বড় হরফে লেখা ব্যাবিলন। তখনই আমাদের গাড়িটি ঢুকে পড়ল পাঁচ হাজার বছর আগের এক সভ্যতায়।
ষোলো ফুট উঁচু এক পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন অতি মূল্যবান সিডার কাঠ দিয়ে নির্মিত নগরীর প্রধান তোরণে হেলান দিয়ে। তোরণ থেকে রাজ্যের সুপ্রশস্ত প্রধান সড়কটি ছুটে গেছে উরুকের রাজপ্রাসাদ অবধি। পথের দু’পাশে হাজারো মানুষ। রাজা গিলগামেশ বেরিয়েছিলেন অমরত্বের সন্ধানে, দীর্ঘ সফর শেষ করে তিনি কালই ফিরে এসেছেন। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে রাজার অমরত্ব প্রাপ্তির রোমাঞ্চকর খবর শোনার জন্য।
হঠাৎ গিলগামেশ আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে ওঠেন। তিনি বলেন, তিন ভাগ দেবতা হলেও আমার দেহের এক ভাগ তোমাদেরই মতো মানব, তাই সেই এক ভাগকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তবে আমি তোমাদের তিনগুণ কাল বেঁচে থাকব, তোমাদের নাতিপুতিদের কাল অবধি পূর্ণ যৌবনের অধিকারী থাকব। মৃত্যুভয়ে আমি ভীত নই এবং অমরত্বের অনুসন্ধান এখনো ত্যাগ করিনি।
এরপর গিলগামেশ একটি মহাপ্লাবনের গল্প বলেন। অমরত্বের খোঁজে আমি রহস্যপুরুষ উত্নাপিশতিমের গৃহে পৌঁছে যাই। সেখানে যাওয়ার জন্য আমাকে এক অন্ধকার গুহা-গিরিখাতের ভেতরে সাত দিন সাত রাত হাঁটতে হয়। উত্নাপিশতিম সকল দেবতার সঙ্গে কথা বলতে পারেন, কবে তার জন্ম হয়েছে, তা কেউ বলতে পারে না। আমি ভেবেছিলাম, তিনি অমরত্বের খোঁজ দিতে পারবেন। কেননা তিনি মহাপ্লাবনের অতীত থেকে উঠে আসা জ্ঞানী লোক।
উত্নাপিশতিম বলেন, সকল প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে এবং মৃত্যুই প্রাণিদেহের পূর্ণতা। তিনি আমাকে বলেন, মেসোপটেমিয়ায় নেফিলীয় সম্প্রদায়ের একদল লোক বাস করত, তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটি করত, অরণ্য উজাড় করত, দেবতাদের অসম্মান করত। তাদের শায়েস্তা করতেই দেবতা-সভায় সিদ্ধান্ত হয়, পৃথিবীতে এক মহাপ্লাবন দেওয়া হবে। আমাকে বলা হয়, একটি বড় নৌকা বানাতে এবং সকল প্রাণী জোড়ায় জোড়ায় তুলে নিতে। এভাবেই আমি ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও মহাপ্লাবনের ৪০ দিন অতিক্রম করেছি। যারা নৌকায় উঠেছিল, কেবল তারা ছাড়া বাকি সকলেই মহাপ্লাবনের অতলে তলিয়ে গেছে।
গিলগামেশ বলেন, উরুকের মানুষ যদি দেবতাদের অবাধ্য হয়, তারাও এভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর তিনি ঘোষণা করেন, আজ থেকে রাজ্যের নারীদের বিয়ের প্রথম রাত আমার সঙ্গে অতিবাহিত করতে হবে না। এই দায় থেকে আমি তোমাদের মুক্তি দিলাম।
উপস্থিত সবাই রাজার মহানুভবতায় উলুধ্বনি দিয়ে আনন্দ করতে লাগল।
আমরা ব্যাবিলন থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে একটি ধর্মশালার পাশে গাড়িটা পার্ক করি। ভেতরে সারগনের কন্যা এনহেদুয়ানা চন্দ্রদেবী ইনানার উদ্দেশে স্তুতিমন্ত্র পাঠ করছেন।
হঠাৎ শব্দ করে লাল অ্যাকুরা আছড়ে পড়ে নাসাউ কাউন্টির রাস্তায়।
-ওহ গড!
মুক্তির কণ্ঠে চাপা আশঙ্কা।
-এমন হার্ড ব্রেক!
-সামনের গাড়িটা হঠাৎ স্লো হয়ে গেল যে।
-সে জন্যই বলি, ড্রাইভ করার সময় টাইম ট্রাভেল না করাই ভালো।
-তথাস্তু।
প্রায় এগারোটা বাজে। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। এই নেইবারহুডে আগে কখনো এসেছি বলে মনে হয় না কিন্তু আশপাশটা কেমন চেনা চেনা লাগছে।
বাঁ দিকে একটি মার্কেট। সেখানে বেশ কিছু খাবারের দোকান। পাশাপাশি লা পিৎজা, মেরিক পিৎজা, বেগেল বস।
Ñঢুকে পড়ব নাকি?
Ñঅচেনা খাবার খেতে চাই না, তা ছাড়া নেইবারহুডে একটা ফকিরা ভাব আছে, খাবার ভালো না-ও হতে পারে।
Ñতা অবশ্য ঠিক। মাত্র তো আর দুই মাইল, পানেরা ব্রেডেই চলো।
এই দুই মাইলের মধ্যে আরও অনেকগুলো খাবারের দোকান চোখে পড়ল। সুশি এশিয়ান ফিউশন, কব’স ব্রেড, ফাইভ গাইজ। এ ছাড়া ম্যাক, বার্গার কিংÑএসব তো আছেই।
আমরা শেষমেশ পানেরা ব্রেডেই গেলাম। ওদের খাবারে একটা হোমলি টাচ পাওয়া যায়।
ভাপ ওঠা এভোকাডো মেল্ট চিকেন স্যান্ডউইচ, সঙ্গে এক বোল সালাদ। এমন সময় এক কাপ ধূমায়িত কফি না হলে কি চলে? আমার এই প্রস্তাবে সায় দিল না মুক্তি।
ফেরার পথে পানেরা ব্রেড থেকে একটি সাওয়ার ডো ব্রেড তুলে নিলাম।
Ñহলিসউড, নিউইয়র্ক
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078