যুগে যুগে মেধাবী নারীর সাফল্যে পুরুষের অমানবিক প্রতিক্রিয়া 

বিজ্ঞানী মাদাম কুরির নির্যাতিত জীবন

প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১৯:২২ , বিশেষ সংখ্যা
১৯১১ সালে পুরো দুনিয়াকে চমকে দিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য নোবেল প্রাইজ ঘোষণা করা হলো বিজ্ঞানী মাদাম মেরি কুরির নামে। তার আগে দ্বিতীয়বার নোবেল কেউ পাননি। প্রথমবার নোবেল পেয়েছিলেন রেডিওঅ্যাক্টিভিটি বা তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণার জন্য। মাত্র আট বছর পর দ্বিতীয় নোবেল পান রসায়নে, পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম আবিষ্কারের জন্য। বিজ্ঞানজগৎ আজও কুর্নিশ জানায় ম্যারি সেক্লাদাওস্কা কুরিকে বা মাদাম কুরিকে।
নিজের গবেষণা ও আবিষ্কারের পেটেন্ট গ্রহণে নারাজ ছিলেন মাদাম কুরি, বরং মানবসভ্যতার কল্যাণে নিবেদিত এ মহাপ্রাণ সকলের জন্যই এ আবিষ্কার। তাই এর ওপর ‘সকলের অধিকার’ থাকা উচিত বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। ‘রেডিয়াম কোনো ব্যক্তিকে সমৃদ্ধ করতে নয়; এটি একটি মৌল, এটি সকল মানুষের অধিকার।’ শেষ জীবন পর্যন্ত এ কথাই বলেছিলেন বিজ্ঞানী কুরি।
নাম ঘোষণা করেই স্টকহোমের নোবেল কমিটি তড়িঘড়ি মেরি কুরিকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল, ‘দয়া করে আপনি পুরস্কার গ্রহণ করতে আসবেন না। আমরা আমাদের বদনাম চাইছি না। প্লিজ মাদাম! আমরা আপনাকে পুরস্কারটি পাঠিয়ে দেব যথাসময়ে।’
মেরি কুরি হতবাক ও বিস্মিত হলেন। আট বছর আগে স্বামী পিয়েরের সঙ্গে যৌথভাবে যখন প্রথম নোবেল প্রাইজটি পেয়েছিলেন, অসুস্থতাজনিত দুজনের কেউই যেতে পারেননি, এবার কেন যাবেন না? তিনি তো কোনো অন্যায় করেননি! দৃঢ়ভাবে নোবেল কমিটিকে তিনি জানিয়ে দিলেন, ‘আমি পুরস্কার গ্রহণ করতে যাব। অবশ্যই যাব। ধন্যবাদ।’
নোবেল কমিটি পড়ল মহা বিপদে। মেরি কুরির নাম যখন ইন্টারনাল কমিটিতে চূড়ান্ত হয়েছে, তখনো তাদের হাতে এসে পড়েনি গরম ফরাসি সংবাদপত্রগুলো! কিন্তু এখন কুৎসায় ভরপুর সংবাদগুলো। বিশ্বের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী মাদাম মেরি কুরি নাকি পরকীয়ায় লিপ্ত! তাও আবার মৃত স্বামীর ছাত্র পলের সঙ্গে।
মনগড়া রগরগে প্রতিবেদনে তখন ফরাসি মিডিয়া লাগাতার আক্রমণ করে চলেছে দেশের সবচেয়ে প্রতিভাবান নারীটির ওপর। দেশের নাগরিকেরা জঘন্যতম বিশেষণে ধিক্কার জানাচ্ছে এই নিরপরাধ নারীকে। চাপা অসন্তোষ বিরাজ করছে। আহা, গত কয়েক দশক ধরে যতই দেশের নাম উজ্জ্বল করুক, মেয়ে হয়ে এত বাড়বাড়ন্ত কি ভালো, বাপু? মেয়ে হয়ে জন্মেছ, আর্টস নিয়ে পড়ো, তা নয়, সায়েন্সে পড়াশোনা কি মেয়েদের শোভা পায়! দেশের পুরুষগুলো বসে আছে, আর যত বিখ্যাত পুরস্কার থেকে বড় বড় বিজ্ঞান সংস্থার মাথায় কিনা একজন নারী!
বিখ্যাত প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিভাবান পুরুষ অধ্যাপকরা পড়ানোর সুযোগ পান না। সেখানে কিনা প্রথম অধ্যাপক হিসেবে একজন নারী যোগদান করেছেন। না, এতটা মেনে নেওয়া যায় না। সুযোগ যখন একটা পাওয়া গেছে, সেটা কেউ ছাড়ে? তার ওপর মেরি ফ্রান্সের ভূমিকন্যা নন, পোল্যান্ডে জন্ম তার। অন্য দেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসায় জনসাধারণের আক্রোশ মেরিকে নাস্তানাবুদ করতে লাগল।
নিজের জগতে এমনিই বহু পুরুষ বিজ্ঞানী সহ্য করতে পারতেন না মেরিকে, তারাও পরোক্ষ সমর্থনে জনগণকে উসকে দিলেন। কেউ পল-মেরির পরকীয়া নিয়ে আজগুবি সাক্ষাৎকার দিয়ে লাইমলাইটে আসতে চাইছিলেন, কেউ অন্য কোনোভাবে। বিশ শতকের গোড়ায় রক্ষণশীল ইউরোপীয় সমাজ ফুঁসছিল। এই মেয়েই কিনা আগে গর্বোদ্ধত সুরে বলেছিল, ‘মানুষ হওয়ার যাবতীয় অধিকার আমাদের সমাজে পুরুষেরাই মনোপলি করে রেখেছে।’
মেরির স্বামী পিয়ের শুধু তার জীবনসঙ্গী ছিলেন না, ছিলেন গবেষণার সহকর্মী থেকে সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সেই পিয়েরের হঠাৎ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে মেরি একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন।
এমন মানসিক বিপর্যয়ে তিনি কিছুটা মানসিক আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন পদার্থবিদ পল লজেভঁর কাছে। পল ছিলেন পিয়ের কুরিরই ছাত্র, মেরির চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট। পল বিবাহিত ছিলেন, যদিও স্ত্রীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটেছিল বহু আগেই। একাকিত্বে ভোগা দুজন বিজ্ঞানীর বন্ধুত্বে দুজনের কাজে স্বস্তি জুগিয়েছিল। কিন্তু পলের প্রাক্তন স্ত্রী জেনি দুজনের কিছু চিঠিপত্র হাতে পেলেন। রাগে-ক্ষোভে উন্মত্ত জেনি মেরিকে খুনের হুমকি তো দিলেনই, দেশের কাছে দেবীস্বরূপ মেরির ইমেজ একেবারে টুকরো টুকরো করে দিতে সেই চিঠিগুলো তুলে দিলেন মিডিয়ার হাতে।
মিডিয়া চরমানন্দে লুফে নিল চিঠিগুলো। সাধারণ চিঠির ওপর ক্রমাগত রং চড়িয়ে পরিবেশিত হতে লাগল রগরগে কুৎসা। এমনকি কিছু কিছু কাগজে কিস্তিতে ছাপা শুরু হলো মেরি-পলের কাল্পনিক প্রেমকাহিনি। প্রকাশিত হতে লাগল পলের স্ত্রী ও শাশুড়ির সাক্ষাৎকারও। পল যে আগে থেকেই বিবাহবিচ্ছিন্ন, সেই তথ্যটাকে ‘ফুটেজ’ এর লোভে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেল মিডিয়া এবং প্রকাশিত হলো মেরি পলের সংসার ভেঙেছেন।
সাংবাদিক গুস্তেভ টেরি আরও এক ধাপ এগিয়ে লিখলেন, ‘আসলে পিয়ের বেঁচে থাকতেই এই পরকীয়া শুরু। পিয়েরের মৃত্যু মোটেই আকস্মিক ছিল না, স্ত্রীর এই বিশ্বাসঘাতকতায় পিয়ের নিজেই ঘোড়ার গাড়ির তলায় ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করেন।’
এমন জলজ্যান্ত মিথ্যাচারে মেরি হতবাক। স্বামী পিয়ের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন মেরির প্রিয়তম বন্ধু। তিনি জীবিত থাকাকালীন পলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তো দূর, ভালোভাবে পরিচয়ও ছিল না মেরির। কিন্তু উত্তেজিত জনতা আর কবে যুক্তি দিয়ে কিছু বুঝতে চেয়েছে? যুক্তির চেয়ে গুজবের শক্তি বরাবরই বেশি। সাংবাদিক গুস্তেভ টেরির ওই প্রতিবেদনে আগুনে যেন ঘি পড়ল। জীবিত মানুষের সম্মানের চেয়ে মৃত পিয়েরকে ছদ্ম সমবেদনা জানানোর লোক কয়েকশ গুণ বেশি প্রচারিত হতে শুরু করল।
মেরি কুরির বাড়ি ঘেরাও করে উন্মত্ত জনতার বিক্ষোভ আর তাণ্ডব শুরু হলো। সঙ্গে অশ্রাব্য গালিগালাজ আর হুমকি। সন্তানদের নিয়ে তখন ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছেন নোবেলজয়ী কিংবদন্তী বিজ্ঞানী মেরি। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তিনি।
ওদিকে বিজ্ঞানী পলের সকল রিসার্চ হুমকির মুখে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি, বললেন, ‘সাংবাদিক গুস্তেভ টেরি সাংবাদিকতার লজ্জা। উনি সংবাদ নয়, মিথ্যা রগরগে কুৎসা প্রচারে সিদ্ধহস্ত। আমি ওকে আমার সঙ্গে ডুয়েল যুদ্ধে লড়ার জন্য আহ্বান করছি।’
মুখোমুখি দাঁড়ালেন সাংবাদিক ও বিজ্ঞানী। দুজনের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র। কিন্তু শেষমেশ ডুয়েল লড়লেন না। সাংবাদিক টেরি অবজ্ঞাভরে লিখলেন, ‘চাইলেই আমি এক গুলিতে পলকে হারাতে পারতাম, কিন্তু আমি চাই না দেশ একজন বরেণ্য বিজ্ঞানীকে অকালে হারাক!’
সংবাদপত্র ছেয়ে গেল স্লোগানে। ‘চরিত্রহীনা মেরি কুরিকে কিছুতেই নোবেল প্রাইজ দেওয়া যাবে না। ব্যান করা হোক মেরি কুরিকে। এখনই। সুইডেনের রাজার হাত অপবিত্র হতে দেওয়া যাবে না।’
মেরি ঘুরে দাঁড়ালেন। ছোট থেকে ভয়াবহ দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে তিনি এই পর্যায়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এত সহজে নিজেকে ফুরিয়ে যেতে দেবেন না। জ্যেষ্ঠা কন্যা আইরিন ও দিদি ব্রোনিয়াকে নিয়ে মাথা উঁচু করে স্টকহোম পৌঁছালেন তিনি। যাবতীয় বিক্ষোভকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে সুইডেনের রাজার হাত থেকে দৃঢ়চিক্তে বিশ্বের সর্বপ্রথম নারী হিসেবে গ্রহণ করলেন দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার। নোবেল প্রাইজ বক্তৃতায় বারবার উচ্চারণ করলেন স্বামী পিয়েরের প্রসঙ্গ।
ফরাসি মিডিয়া যদিও পাত্তাই দিল না এত বড় গৌরবটিকে। মেরির ওপর জঘন্য আক্রমণ অব্যাহত থাকল। নারী, তার ওপর সফল নারীকে চারিত্রিক দোষ দিয়ে টুকরো করে দেওয়ার মতো বিজয়োল্লাস আর কিছুতেই নেই। দৃঢ় মানসিকতার মানুষ হয়েও মেরির শরীর বিদ্রোহ করে। প্রবল প্রতিবাদের মধ্যে দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন, ভর্তি হতে হলো হাসপাতালে। দিনরাত তেজস্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে থাকার কারণে মেরির শরীরের বহু কোষ ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত। মিডিয়াকে এড়াতে ভিন্ন নামে হাসপাতালের কেবিন বুক করতে হলো।
কিন্তু সাংবাদিক ও দেশের জনতা তাকে রেহাই দিল না। রটিয়ে দেওয়া হলো, মেরি আসলে পলের অবৈধ সন্তানের মা হতে যাচ্ছিলেন, তাই গর্ভপাত করাতে গোপনে ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে।
এত কিছুর পরও ভগ্নদেহে বাড়ি ফিরলেন মেরি। ধীরে ধীরে ফিরলেন কাজেও। রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের ভবন তৈরি করা শুরু করলেন। ধীরে ধীরে অংশগ্রহণ করলেন নানা দেশের কনফারেন্সে। তাকে নিয়ে মহাসমারোহে আজকের ভাষায় ট্রলও চলতে থাকল। 
শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যে ফরাসি জনতা তাকে দিয়েছে অখ্যাতি, সেই ফরাসি সেনাদেরই সেবা-শুশ্রূষা ১৮টি ভ্যানে এক্স-রে মেশিন নিয়ে মেরি পড়ে রইলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। এ-মাথা থেকে ও-মাথা ছোটাছুটি করে দ্রুত রেডিওঅ্যাক্টিভ এক্স-রে মেশিনে নির্ণয় করতে লাগলেন অসুস্থতা কিন্তু এই লাগাতার নোংরা আক্রমণে ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ডভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ভীষণ দারিদ্র্যে বড় হয়েছিলেন তিনি। অক্লান্ত ও অমানুষিক পরিশ্রম তার শরীর গ্রহণ করতে পারেনি।
মেরির যুদ্ধক্ষেত্রে অত কর্মকাণ্ডে মিডিয়া একটু থমকে দাঁড়াল বটে, কিন্তু থামল না। বলল, ‘লোকের কাছে ভালো সাজতে চাইছে এমন শুশ্রূষা কর্ম করে।’
এরপর যত দিন বেঁচে ছিলেন, মনের দিক থেকে কোনো দিনও স্বাভাবিক হতে পারেননি মেরি কুরি। মৃত্যুর আগে মেয়েদের বলে গিয়েছিলেন, তাকে যেন সমাধিস্থ করা হয় স্বামী পিয়েরের কবরের ওপরই। বিস্ময়ের ব্যাপার, পল ও মেরির সম্পর্ক পূর্ণতা পায়নি, কিন্তু কয়েক দশক পরে পলের নাতি মাইকেল ও মেরি কুরির নাতনি হেলেন একে অন্যকে বিয়ে করে সুখী দম্পতি হয়েছিলেন।
বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী মাদাম মেরির যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের বিজ্ঞান ও বিশ্ব। চারিত্রিক দোষে প্রত্যক্ষভাবে নীতিহীন কত পুরুষ কর্মজগতে নন্দিতই হয়েছেন, অথচ এত বড় প্রতিভাবান বিজ্ঞানী শুধু নারী হয়ে জন্মানোর অপরাধে কত বড় মানসিক যাতনা সহ্য করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।
-নিউইয়র্ক
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078